ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য – বাংলা কল্পবিজ্ঞানের এক বিস্মৃত অধ্যয়
লেখক: সন্তু বাগ
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
বাংলা ভাষায় শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রথম যুগে বিজ্ঞান ভাবনার প্রচলন করে গিয়েছেন যে রথীমহারথীরা তাদের মধ্যে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য এক উল্লেখযোগ্য নাম। জীবনের বেশীর ভাগ লেখাই তিনি লিখেছেন ছোটদের জন্য। শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়কে সুন্দর ও সরস করে প্রবন্ধ বা গল্পাকারে পরিবেশনায় আজও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
ক্ষিতীন্দ্রানারায়ণের পিতা বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য কর্মসুত্রে ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি প্রথমে কিছুদিন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরে অ্যাডিশন্যাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে কাজ করেছেন। কিন্তু অন্যধারে তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তাঁর উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের ‘মানিকচাঁদের গান’, ‘গোপীচাঁদের গান’ প্রভৃতি অমূল্য কাব্যগাথার সংগ্রহ বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শিশুসাহিত্যের জন্য তাঁর ভাবনা যে কত গভীর তা প্রকাশ পায় তাঁরই হাতে তৈরি ছোটদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রামধনু’র মধ্যে দিয়ে। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ছিলেন বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের কনিষ্ঠ পুত্র। তাঁর পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড়দা হেমেন্দ্রনারায়ণ বারানসী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের রিডার ছিলেন আর মেজদা মনোরঞ্জন ছিলেন রিপন কলেজের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণের জন্ম ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় এক তীক্ষ্ণধী ব্রাহ্মণ বংশে। পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় ছেলেবেলায় তাঁকে অনেকগুলি স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল। শেষে কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। সেখান থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে বি. এস. সি. পাশ করেন। ১৯৩১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়নে প্রথম স্থান অধিকার করে এম. এস. সি. পাশ করেন। তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং ডঃ হেমেন্দ্রকুমারের অধীনে রসায়নে গবেষণা করেছিলেন।
এম. এস. সি. পাশ করার পর তিনি অধ্যাপনার ডাক পেতে থাকলেন নানা কলেজ থেকে। কিন্তু তিনি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করে পুস্তক ব্যাবসা শুরু করার মনস্থির করেন। তাঁদের কালিতারা প্রেস নামে একটি পৈত্রিক প্রকাশনালয় ছিল। তিনি সত্যি একটি বইয়ের দোকান চালু করেন, কিন্তু তাঁর ব্যাবসায়িক বুদ্ধি তেমন পোক্ত হয়নি। যথারীতি তাঁর পুস্তক ব্যাবসা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ওই দোকান বিক্রি করে দেন এবং অধ্যপনার কাজ শুরু করেন। প্রথমে কলকাতার আশুতোষ কলেজ রসায়নে অধ্যপনা শুরু করেন। পরে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন যোগমায়া দেবী কলেজে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক হিসেবেও যোগ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি সহকর্মী অধ্যাপক বিশ্বমোহন মুখার্জির সাথে যৌথভাবে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য লেখেন “এলিমেন্টস অব কেমিস্ট্রি” বইটি। কিন্তু অধ্যাপক হয়ে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণের মন ভরল না। তাঁর মন পড়ে রইল সাহিত্যের আঙ্গিনায়। আগে থেকেই তিনি লেখালিখির সাথে যুক্ত ছিলেন ক্রমে তিনি আরও জড়িয়ে পড়লেন বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প এবং প্রবন্ধ রচনায়।
তাঁদের ১৬ নম্বর টাউনসেন্ড রোড, ভবানীপুরের বাড়িতে সাহিত্যের একটা পরিবেশ ছিল। বাবা, মা, ভাইবোনেরা সকলেই লেখালিখি করতেন অল্পবিস্তর। তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি সাত বছর বয়সে। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর সাহিত্য জগতের সাথে পরিচিতি এবং ওই সময় থেকে তিনি নানা প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করেন। প্রথমে শুধুই কবিতা লিখতেন, পরে কয়েকজন প্রবীণ সাহিত্যিক এবং শিক্ষকের পরামর্শে গদ্যসাহিত্যে লেখা শুরু করেন। প্রেসিডেন্সী কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সময় পপুলার সায়েন্স নিয়ে লেখা শুরু করেন তিনি।
বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা লিখতেই তিনি বেশি ভালবাসতেন। আর বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকরাও তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাই বেশি চাইতেন। সেই কারণেই তিনি সারাজীবন মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাই লিখেছেন। তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক লেখার মূল প্রেরণা ছিলেন অধ্যাপক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, কবিশেখর কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। মূলত কিশোরদের জন্য লিখতেন তিনি। এছাড়া শিশুদের জন্য কিছু রুপকথার বই লিখেছেন দাদা মনোরঞ্জনের সাথে। তাদের মধ্যে ‘গল্পস্বল্প’ এবং ‘ছুটির গল্প’ উল্লেখযোগ্য। ছোটরাও তাঁর লেখা খুব পছন্দ করত। সারা জীবন শিশুসাহিত্য নিয়েই মেতে ছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে লিখে এসেছেন বহু বিখ্যাত পত্রিকায়। যেমন রামধনু, বার্ষিক শিশুসাথী, শুকতারা, দেব সাহিত্য কুটির পূজাবার্ষিকী, বেতার জগৎ, সন্দেশ, কিশোর ভারতী, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, যুগান্তর, আনন্দমেলা ইত্যাদি পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেত তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প এবং বিজ্ঞানের প্রবন্ধ।
বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ইত্যাদি সহজ ভাষায় গল্পের মত সুখপাঠ্য করে লিখে তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন। সেকালে জগদানন্দ রায় তাঁর গ্রহনক্ষত্র, প্রাকৃতিকী, বৈজ্ঞানিকী ইত্যাদি বইয়ে বৈজ্ঞানিক বস্তুকে যেমন স্বাদু করে পাঠকদের কাছে এনে দিতেন, লেখনীর সেই যাদু রয়েছে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণের বিভিন্ন রচনাতেও। খগেন্দ্রনাথ মিত্র রামধনুতে তাঁর লেখা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন “মাথায় মানুষটি লম্বা ন’ন, কিন্তু বিদ্যা বুদ্ধিতে বেশ লম্বা… একটা কথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে, যে, শিশুসাহিত্যে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের রচনায় ইদানিং কালে তাঁকে অতিক্রম কেউ করতে পারেন নি। তাঁর মতো সুন্দর ও সরস রচনা আর একজনের। তিনি হলেন অধ্যাপক শ্রীচারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। তবে তাঁর রচনার সংখ্যা খুবই অল্প। এই দুজনের বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা পাঠ করে সুন্দর গল্প পাঠের যে আনন্দ তা লাভ করা যায়।”
ছোটদের নতুন মনে বিজ্ঞান বোধ জাগাতে তিনি লিখেছেন একগুচ্ছ বিজ্ঞানের বই। ‘বিজ্ঞানবুড়ো’ তার প্রথম বই। এর ভূমিকায় লিখেছিলেন “বিজ্ঞানকে এখানে কল্পনা করা হয়েছে – রূপকথার সেই শুভ্র যাদুকররূপে। যাদুকর যেমন তাঁর যাদুর কাঠি ছোঁয়াইয়া আশ্চর্য-আশ্চর্য অবিশ্বাস্য সমস্ত ব্যাপার ঘটাইয়া তোলে, বিজ্ঞানের সোনার কাঠির স্পর্শেও কি তেমনি অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড – যা আগে কেউ কল্পনায়ও আনিতে পারিত না – নিত্য ঘটিতেছে না?” এরপরে এক এক করে প্রকাশ পেতে থাকে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, আকাশের গল্প, আবিষ্কারের গল্প, মহাকাশের কথা ইত্যাদি বই। ‘বিজ্ঞানবুড়ো’ বইতে আছে কয়েকজন প্রধান প্রধান বৈজ্ঞানিকের জীবন এবং কার্যাবলীর বর্ণনা। তাঁর ‘আবিষ্কারের গল্প’ বইতে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা আবিষ্কারের রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনীর সংকলন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা পঁচিশের অধিক। তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর রেখাচিত্রে ছয় খণ্ডে ছোটদের বিশ্বকোষ রচনা।
তিনি সারা জীবন ধরে লিখেছেন অসংখ্য বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প। তাঁর প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প ‘কাশ্মীরী রহস্য’ প্রকাশ পায় রামধনু পত্রিকায় ১৩৩৮ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায়। তাঁর গল্পগুলির মধ্যে প্রেতাত্মার দ্বীপ, অভিশপ্ত গুহা, প্রেতাত্মার উপত্যাকা, দানবের দ্বীপ, ঘুম পাড়ানি দ্বীপ, জ্বলন্ত দ্বীপের কাহিনী, প্রফেসর এক্স, রঙ্গিলা পাহাড়ের নীলকুঠি, কুরুকুয়াভিয়ের মন্ত্রপূত পাহাড়, ফুটোস্কোপ, মেঘনাদ, লুপ্তধন, ফিরিঙ্গির গড়, ভানুবাবু ও ফটিকগির রহস্য, তুষারলোকের রহস্য, টিটিঙ্গি পাহাড়ের দেবতা, চৌহান গুম্ফার দেওতা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লুপ্তধন গল্পের ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন “বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশের মানুষের মধ্যেই একটা বিজ্ঞান মানসিকতা গড়ে উঠেছে – কোথাও একটু আগে, কোথাও একটু পরে। আমাদের দেশও বাদ যায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটি নতুন ধরনের বা নতুন স্বাদের কথা সাহিত্যের আমদানী হয়েছে যাকে বলা হয় বিজ্ঞান নির্ভর গল্প বা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প। কেউ কেউ বলেন ‘কল্পবিজ্ঞান’। শেষোক্ত নামটি, মনে হয়, প্রথম দু’টির তুলনায় শ্রুতিমধুর।” সত্যি বলতে কি তাঁর লেখা বাদ দিয়ে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক কিংবা কল্পবিজ্ঞান গল্পের সংকলনের কথা ভাবাই যায় না। তাঁর সমকালীন লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র মামাবাবু এবং ঘনাদা চরিত্র দুটি নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণের লেখায় কোন চরিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যায় না। তাঁর গল্পের কথক বা মূল চরিত্র বেশিরভাগ সময়েই বিজ্ঞানের কোন শাখার মানুষ।
বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লেখার বিষয়ে তিনি তাঁর নিজের অভিমত জানিয়েছেন যে, “শিশু সাহিত্যে বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা লেখার জন্য অনেকে অনেক অপ্রাকৃত ঘটনার সাহায্য নেন, আমি পারতপক্ষে নিই না। আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তা থেকেই… প্লট পাওয়া যেতে পারে। প্রথমে কথা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প হলেও সেটা আসলে গল্প হওয়া চাই। তার সাহিত্যের মূল্য থাকা চাই; না হলে তা অচল।… বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প লিখতে গেলে বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্র গুলি অগ্রাহ্য করা চলবে না।… বিপরীত কিছু আনতে হলে, তার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ অবশ্যই দেখাতে হবে। না হলে তাকে বিজ্ঞান ভিত্তিক বলা যাবে না। সেটা হবে ফ্যান্টাসি বা রূপকথার সমগোত্রী।… আমি তা লিখি না, লিখতে পারি না।”
ছোটখাটো মানুষ ক্ষিতীন্দ্রের পরনে থাকতো সাদা ধুতি পাঞ্জাবী আর পায়ে চপ্পল। তাঁর সর্বদাই প্রফুল্ল বদন, স্পষ্টবক্তা কিন্তু রূঢ় কথা বলেন না। অন্যান্য প্রতিভাবান অথবা খ্যাতিমান লেখকদের সম্বন্ধে তিনি কখনোই ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন না। গুণী লেখকদের হিংসে না করে তাদের সহায়তা করতেন এবং তাদের সাফল্যে আনন্দিত হতেন। তিনি কারোর খোশামোদ করতেন না। দরকার হবে ভদ্রভাবে স্পষ্ট কথা বলতে পারতেন। লীলা মজুমদারের স্মৃতিচারণ থেকে তাঁর সম্বন্ধে জানতে পারি “ছোটোদের জগতে ঘরকুনোদের ঠাঁই নেই। মন হওয়া চাই আকাশের মতো উদার। হৃদয়মনের মৌলিক উপাদান নিয়ে শিশুসাহিত্যিকদের কারবার। ক্ষিতীনের সে রকম মন ছিল। এতটুকু গুণের সন্ধান পেলেই হল, অমনি তার লালনপালন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিত।”
তাঁদের পারিবারিক পত্রিকা ‘রামধনু’ কথা না বললে তাঁর জীবনের একটি দিক সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে যায়। তাঁর পিতা বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের সদিচ্ছায় ১৩৩৪ সালের মাঘ মাসে ছেলেমেয়েদের সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘রামধনু’-র যাত্রা শুরু হয়। সূচনাকাল থেকেই তিনি পত্রিকায় প্রবন্ধ, জীবনী, বিজ্ঞানের কথা, ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে লেখা আরম্ভ করেন। প্রথম থেকেই তিনি রামধনুর কার্য্যাধক্ষ ছিলেন। প্রায় প্রতি সংখ্যায় তাঁর লেখা বেরিয়েছে সুদীর্ঘ ষাট বছর ধরে। সেই সময় বাংলা ভাষায় কিশোরসাহিত্যের পত্রিকার অভাব ছিল। সন্দেশ তখন বন্ধ। তাই বহু শিশু সাহিত্যিক লেখা শুরু করেন রামধনুতে। প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিবরাম চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, সুনির্মল বসু, অখিল নিয়োগী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৃতীয় বর্ষের প্রথম থেকেই পিতা বিশ্বেশ্বর রামধনু সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন দ্বিতীয় পুত্র মনোরঞ্জনের স্কন্ধে। অধ্যাপক মনোরঞ্জনের বাংলা শিশুসাহিত্যে একটি বড় অবদান জাপানি গোয়েন্দা হুকাকাশির গল্প। এছাড়াও তিনি লিখে গেছেন বহু হাস্যরসমূলক গল্প, জীবনী, অনুবাদ গল্প ইত্যাদি।
মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ১৩৪৫ সালের ২১শে মাঘ রামধনুর সম্পাদক অগ্রজ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মারাত্মক টাইফয়েড ও ম্যানিন্জাইটিস রোগে পরলোক গমন করেন। সেইসময় ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণও ভয়ানক রুগ্ন হয়ে পড়েন। শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলে ক্ষিতীন্দ্রের উপরে ‘রামধনু’-র সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি আমৃত্যু সম্পাদনা করেন পত্রিকাটি। পরে তাঁর কন্যা ডঃ সুচেতা মিত্র তাঁকে সম্পাদনায় সাহায্য করতেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি কন্যা বিয়োগের মর্মান্তিক শোক পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সমাজের বহু কাজ করে গিয়েছেন সেই সময়ও। স্বনামে লেখার পাশাপাশি কৌটিল্য এবং রসোদর শর্মা ছদ্মনামে তাঁর বহু রচনা প্রকাশ পেয়েছিল রামধনুর পাতায়। পাঁচমিশেলী বিভাগে শিশুদের বিজ্ঞান সচেতনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন, সাথে থাকত ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি আরও নানা শাখার খবর। রামধনুতে জনপ্রিয় লেখকের রচনা ছেপে লাভবান হবার চেষ্টা না করে প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন নতুন লেখকদের পাঠক সমাজের সামনে হাজির করতেন। যাদের অনেকেই পরে বিখ্যাত হয়েছেন, যেমন শিশিরকুমার মজুমদার, উজ্জ্বল মজুমদার প্রমুখ। তাঁর মৃত্যুর পরে রামধনুর প্রকাশও বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ষাট বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত রামধনু বাংলা শিশু সাহিত্যের জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকবে।
শিশু সাহিত্যে তাঁর আরও একটি বিশাল অবদান হল ‘শিশু সাহিত্য পরিষদ’ এর সুচনা। তাঁর নিজের টাউনসেন্ড রোডের বাড়িতেই ছিল পরিষদের অফিস। এছাড়াও ‘সায়েন্স ফর চিলড্রেন’ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখায় জানতে পারি, শিশু সাহিত্য পরিষদের জন্ম থেকে তিনিই ছিলেন সম্পাদক এবং পরিষদকে তাঁরই গৃহে আশ্রয় দিয়ে এসেছেন। এ জন্য তাঁকে হাজারও অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে, তবুও পরিষদের প্রতি তাঁর দরদের ফলে কোনদিন সামান্য বিরক্তিও তিনি প্রকাশ করেন নি। পরিষদের তিন ভাগ প্রতিপালনের এবং খরচের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। পরিষদের সেই আসর সন্মন্ধে লীলা মজুমদারের লিখেছেন, “তাঁর বাড়ির বৈঠকখানার ঘরে বারোমাস প্রায় প্রতিদিন শিশুসাহিত্যের আসর বসে। তাঁর সব আলমারি ভরা শিশুসাহিত্যের বই। তার খরচায় লাইট জ্বলে, চা-জলখাবারও সাধারণত হয়। এক যদি-না সদস্যরা কিছুকিছু আনে। এমন আনন্দ সম্মেলন কম আছে।”
শিশুসাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৫৬ সালে পান ভুবনেশ্বরী পদক, ১৯৮২ সালে ফটিক স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮৭ বিদ্যাসাগর পুরস্কার। এছাড়াও তিনি কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত বিজ্ঞান পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০ সালের ৩রা জুন একাশি বছর বয়সে এই বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ লেখকের কলম ছুটি পায়। বাংলার কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য হারায় এক পরম মনীষাকে।
তথ্যসুত্রঃ
১। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য – লীলা মজুমদার
২। যাঁদের লেখা তোমরা পড় – খগেন্দ্রনাথ মিত্র, রামধনু, মাঘ ১৩৫৯
৩। বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান – সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, সেপ্টেম্বর ২০১৩
৪। বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান – সাহিত্য তক্কো, বসন্ত ১৪২১
৫। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য আজও প্রাসঙ্গিক – আনসার উল হক, দীপায়ন, জুন ২০১১
৬। লুপ্তধন – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, শৈব্যা প্রকাশন, ডিসেম্বর ১৯৮১
Tags: ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, বিশেষ আকর্ষণ, সন্তু বাগ
অসামান্য প্রবন্ধটির জন্য ধন্যবাদ জানাই নতুন করে। এই মানুষটির লেখাগুলোও আমাদের কাছে ফিরে আসবে আপনাদের সৌজন্যে, এই আশা রাখি।
অভিভূত হয়ে গেলাম তোমার লেখাটা পড়ে। একটা সর্বাঙ্গীন সুন্দর রচনা। অজস্র ধন্যবাদ আর অভিনন্দন নিয়ো। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ও আমি একই স্কুলে পড়েছে আর আমাদের বাড়ির আধ কিলোমিটারের মধ্যেই তাঁর বসবাস ছিল জেনে যেমন গর্ব হচ্ছে তেমনই ক্ষণজন্মা মনোরঞ্জনের দাদা এই কৃতিপুরুষের কথা আজকের আগে না জানার জন্য হচ্ছে লজ্জাও। এবার তাঁর লেখা খুঁড়ে বের করতে হবে।
পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য্য আমার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক ও শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশিত পূজাবার্ষিকিতে তার অনেক গল্প পড়েছিলাম। ‘জ্বলন্ত দ্বীপের কাহিনী’, ‘অশ্বত্থামার পা’ আরও কত গল্প। খুবই ভাল লেগেছিল যখন কলেজে ওনাকে কেমিস্ট্রি ক্লাশে শিক্ষক রূপে পেয়েছিলাম। ইনর্গানিক কেমিস্ট্রি পড়াতেন। একদিনের জন্যও ওনার ক্লাশ মিস করি নি।
খুব ভাল লাগল সন্তু বাগের লেখা পড়ে। ওনার বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্পগুলি নিয়ে যদি কল্পবিশ্ব একটি সংকলন প্রকাশ করতে পারে তো ভাল হয়।