গোরস্থান হল পৃথিবী
লেখক: সি সি ম্যাকঅ্যাপ, বাংলা অনুবাদ - প্রদীপ্ত সাহা
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
মৃত্যু আর কি এমন খারাপ? আসলে এর প্রচারটাই ঠিকমতো হয়নি কখনও।
সমস্যার সূত্রপাত হিসেব রাখার নতুন যন্ত্রটা থেকেই হয়েছিল। একটা ট্রানজিসটর পুড়ে গেছিল বা ওই দাঁতওয়ালা চাকতিটা দু’ঘর পিছলে গেছিল। তাতেই ভুলটা হল, দশমিকটাও দু’ঘর পরে গিয়েই বসল। এটাই বিচিত্র যে পশ্চিমের অত বড় কফিন প্রস্তুতকারী সংস্থা হয়েও ভুলটা কিন্তু কীভাবে যেন এতগুলো মানুষের চোখ আর যন্ত্রের নিরীক্ষা এড়িয়ে একেবারে শেষে এসে ধরা পড়ল। ততক্ষণে ছাপা সংখ্যা বেদবাক্যে পরিণত হয়েছে, সে কি আর বদলানো যায়? কোম্পানির প্রধান বা বোর্ডের বড়কর্তাও এই নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার সাহসই দেখাতেন না। অবশ্য তারা তখন অফিসে থাকলে তবে তো।
সংস্থার বিজ্ঞাপন অধিকর্তাও আর এসবের দায়ভার নিতে চাননি। বাজেটের কাগজপত্র নিয়ে, টলমল পায়ে ঘরে ফিরে থপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। এ কী দেখছেন উনি? ওঁর বিভাগের জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ প্রায় শতগুণ বেশি। এমনকি উনি যা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন তার থেকেও নয় নয় করে পঞ্চাশগুণ বেশি পাওয়া গেছে।
অভিঘাত কমলে ওঁর মুখে ফুটে উঠল গভীর চিন্তার ছাপ। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই উনি চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর সেক্রেটারিকে কী যেন বলে সটান গাড়ি নিয়ে বাড়িমুখো রওনা হলেন। বাড়ি ফিরে কোনওক্রমে জামাকাপড় ব্যাগে পুরে ফেলে বউকে দু-চার কথায় সব বোঝালেন। তারপর চকাৎ করে একটা চুমু খেয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলেন বিমানবন্দরের উদ্দেশে। একবার ফোন করে কাউকে সব বলারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। পূর্বগামী যে কোনও বিমানে উঠতে তাকে হবেই, তা সে যে করেই হোক।
সে বছর কোনও না কোনও কারণে দেশের অর্থনীতির হাল হকিকত বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। বড়দিনের বাজারেও তেমন তেজি ভাব নেই। কর্তৃপক্ষের লম্বাচওড়া, দুঃসাহসী ভাষণ সত্বেও থ্যাংকস গিভিং উৎসবে কেনাবেচা বেশ কমই হল। এই উৎসবের দিনেও তাই উপহার বিক্রেতাদের মনে কৃতজ্ঞতার চেয়ে আত্মকরুণাই বেশি ঝলক দিচ্ছিল।
থ্যাংকস গিভিং এর পরের শুক্রবার সেই কফিনের বিজ্ঞাপনটা বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই বাজারে এসেছিল। অবশ্য এসেছিল বললে কমই বলা হবে। পথচলতি মানুষজন অবাক হয়ে দেখল কীভাবে একদল শশব্যস্ত কর্মী শহর জুড়ে, বিদ্যুৎগতিতে বিজ্ঞাপনের বোর্ডে পোস্টার মারছে। প্রথম পোস্টারটাই বিজ্ঞাপনের আদর্শ উদাহরণ। এক তরুণী বেশ উত্তেজক ভাবভঙ্গি নিয়ে, দেঁতো হাসি হেঁসে কফিনের উপর ঝুঁকে পড়ে তার মোড়ক ছাড়াচ্ছে। মুখের ভাবটা এমন যেন সে কোনও অশীতিপর কোটিপতির কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাব পেয়েছে। সুনিপুণভাবে মোড়া কফিনটার পেছনে একটা ক্রিসমাস ট্রি। মেয়েটিকে দেখে বেশ বোঝাই যাচ্ছে যে সে এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে অথবা এবার হয়তো ঘুমতে যাবে। আমুদে ছেলে-বুড়োর কাছে বার্তাটা স্পষ্টই। শোনা গেল নতুন জিগির— “জিন্দেগী কে সাথ ভি, জিন্দেগিকে বাদ ভি।” বড়দিনের উৎসবের সঙ্গে এহেন বিজ্ঞাপনের যোগাযোগটা আসলে কারোরই মাথায় ঢুকল না।
যারা ঘরে ছিলেন তাঁরা টিভিতে চতুর ও চটকদার সব বিজ্ঞাপনে বিদ্ধ হলেন। কয়েকজন তো ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দিল যে থ্যাংকস গিভিং এ দ্রুত কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে তরুণীটির উচিত বিছানায় আর না শুয়ে ওই কফিনেরই সদ্ব্যবহার করা।
সুপ্রতিষ্ঠিতদের রুচি ও চাহিদা অনুসারে তৈয়ার হল আলাদা বিজ্ঞাপন। বিবাহিত পুরুষরা ঘুসিটা খেল সরাসরি নাকের উপর— “আপনি কি চান আপনার পরলোক গমনের পর আপনার অর্ধাঙ্গিনী অর্ধেক সুরক্ষা পাক?” আরেকটা বিজ্ঞাপনে এক অবিবাহিতা নারীকে বলতে শোনা গেল— “কি দুঃস্বপ্নই না দেখলাম আমি! মৃত্যুর পর আমার উপযুক্ত ‘কুমারীসুলভ’ একটা কফিনও কাছে নেই।”
খবরের কাগজে, পত্রপত্রিকায় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে কণামাত্র শিথিলতা না দেখিয়ে ক্রমাগত চলতে থাকল আক্রমণ। এমন সর্বব্যাপী, ভয়ানক প্রচারাভিযান মানব চেতনায় এর আগে কখন এত সুতীব্র আঘাত আনেনি। বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষজন বোকার মতো প্রথমটা চেয়ে রইল, মাথা ঝাঁকাল আর তারপর সবাই মিলে হামলে পড়ল কফিন কিনতে।
বড়দিনের বাজারে এখন তেজি ভাব। যেসব ডিপার্টমেন্ট স্টোরের দোকানীরা আগে একটা কফিনও রাখতে নারাজ ছিল, তারাই আজ খোদ মালিকের পরামর্শে মাল তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, মুখের ভাষা এমন যে সস্তা দালালদেরও লজ্জায় ফেলে দেবে। বড় বড় মুদির দোকানগুলোও বাদ পড়ল না, রাতারাতিই দোকানে কফিন বাক্স রাখার আলাদা জায়গা ওরা করে নিল।
মাঝে খুচরো ওষুধ বিক্রেতাদের সমিতির তরফে আদালতে নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য আপিল করা হল, যাতে পেট্রোল পাম্পগুলো আবার এই ব্যবসায় না ঢুকতে পারে। ওদের ধারণা কফিনের কারবারে ওদের দাবীই বেশি। কিন্তু বিধি বাম। শুনানির দিন দেখা গেল একজন বিচারপতিও কাজে আসেননি। আসবেনই বা কি করে? সবাই তো তখন কফিন বাক্স কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই সুযোগে বিউটি পার্লারগুলোও বুদ্ধি খাটিয়ে ভালোই ব্যবসা করে নিল। রাস্তায় ঘাটে ট্রাক, টেম্পোর ভিড়। যত রকমের যানবাহন কফিন বয়ে নিয়ে যেতে পারে সবই যেন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে। শেয়ার বাজারের উন্মাদ অবস্থা। প্রতিদিনই স্ট্রাইক হচ্ছে আবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব মিটমাটও হয়ে যাচ্ছে। সংসদের অধিবেশন বসল সময়ের আগেই। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে গেছিল কিন্তু তুলনায় জোগান ছিল কমই। রাষ্ট্রপতি বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রীর জোগান নিয়ন্ত্রণ করলেন। বিভিন্ন প্রদেশে কফিন লবি তাদের প্রভাব খাটিয়ে মড়া পোড়ান নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। কফিনের দাম এতই ভালো পাওয়া যাচ্ছিল যে সিঁদেল চোরের দল রাতারাতি পুরোনো ব্যবহৃত কফিনগুলোকে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করে পুনরায় কালোবাজারে বিক্রি করতে লাগল।
সেই বিজ্ঞাপন অধিকর্তা বারবারই কারখানা পরিচালককে বলেছিলেন উৎপাদন বাড়াতে। ওরা বাড়িয়েও ছিল বটে খানিকটা, কিন্তু চাহিদার ঝড়ে সেসব খড়কুটোর মতো কোথায় যেন উড়ে গেল। প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোও ওদের মতোই ঝিমচ্ছিল, থ্যাংকস গিভিং এর পরের বুধবার ঘুম ছুটে গেল। তারপর আর কি? দিনরাত এক করে তারাও আদাজল খেয়ে লেগে পড়ল। তবে এত করেও চাহিদার কিয়দংশটুকুই পূরণ হয়েছিল। বড় বড় যাত্রিবাহী জেট বিমানে ইয়াঙ্কি [১] সোনা রপ্তানি শুরু হয়ে গেল। বিনিময়ে সারা পৃথিবী থেকে শুধু একটি বস্তুই কাম্য, প্রচুর পরিমাণ কফিনে বাক্স।
আপনারা হয়তো কেউ কেউ ভাবছেন কফিন বাক্স ছাড়া বাকি জিনিসপত্রের বিক্রি নিশ্চয়ই খুব মার খেয়েছিল। তা কিন্তু একেবারেই নয় বরং কফিন বাক্সের জোগান কম থাকায় বাকি প্রায় সব কিছুই দেদার বিকিয়েছিল। বড়দিনের প্রাক্কালে কফিন কেনার হিড়িক কমে এল। দেশটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যদিও বড়দিনের দিন সকালেও কিছু উৎসাহী ক্রেতা তখনও কফিন কেনার আশায় ফাঁকা বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে বসার ঘরে আর অন্য কোনও আসবাব রাখার মতো জায়গা পর্যন্ত বাকি নেই। তাই কফিনের ওপরেই বসে গল্প, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সবই চলছে। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে তখন এমন কেউ আর বাকি নেই যার বুকে হঠাৎ ব্যথা উঠলে পছন্দসই কফিন বাক্সটা সে বাড়িতে বসেই বেছে নিতে পারবে না। তবে বাকি পৃথিবীও যদি এভাবে এখনই অক্কা পায় তাহলে পুরো সভ্যতাটাই হঠাৎ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে।
সবাই ভেবেছিল বড়দিনের পর কফিন আর একেবারেই বিক্রি হবে না। কিন্তু ততদিনে সেই বিজ্ঞাপন অধিকর্তা পদোন্নতি পেয়ে বিক্রয় বিভাগের প্রধান হয়ে গেছেন। তিনি তো আর চুপটি করে বসে থাকতে পারেন না। বহু বছর কফিন শিল্পে হতাশায় কাটাবার পর একটা বেশ করার মতো কাজ তিনি পেয়েছেন, কিছু একটা করে তাকে দেখাতেই হবে। তবে তিনি প্রথমটা রেহাই দিলেন, সেই সময়টুকু পেয়ে মানুষজন ধারে কেনা কফিনগুলির দাম চুকিয়ে দিল। ততদিনে বসার ঘর থেকে সেগুলো সরে গেছে। তারপর জানুয়ারির শেষাশেষি নিক্ষেপ করলেন তাঁর মেগাটন ওজনের নতুন প্রচার বোমা। এক সপ্তাহের মধ্যেই সবাই পরিষ্কার বুঝল বড়দিনের সময় কেনা কফিনগুলো পুরোনো মডেলের। কফিনই হয়ে উঠল মর্যাদা আর প্রতিষ্ঠার নতুন প্রতীক।
গাড়িশিল্প ভূমিসাৎ হল। কিছু ট্রাক আর বাস বাদ দিলে আর কিছুই তৈরি হচ্ছিল না। কারণ যাদের নতুন গাড়ি কেনার ক্ষমতা ছিল তারাও পুরোনো গাড়ির বদলে নতুন গাড়ি এনে বাইরে রোদে-জলে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইল না। বসার ঘর থেকে সরে গিয়ে কফিনগুলো সব তখন গাড়ির গ্যারাজে জড়ো হয়েছে। গাড়ি বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খনিজ তেল শিল্পেরও একই অবস্থা হল। শোনা গেল এই দুই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকে লাভজনক কফিন শিল্পে আর্থিক বিনিয়োগ করেছেন। প্রত্যাশিত ভাবে ডেট্রয়েট শহরেই গড়ে উঠল এদের মূল আস্তানা।
বাজারে আসা নতুন কফিন বাক্সগুলোতে এমন খাঁটি শিল্প ভাবনা প্রকাশ পেল যে সেগুলো মুদির দোকান আর বিউটি পার্লার ছেড়ে এবার আর্ট গ্যালারিতে স্থান করে নিল। তার মধ্যে কফিনের মডেলের নানা রকমফের তো ছিলই। একধরনের মডেল এতটাই ছোট যে মৃত ব্যক্তির পা মুড়ে কানের পাশে এনে তবেই তাকে বাক্সে ঢোকান যেত। প্রতিযোগিতায় অন্য আরেকটা কোম্পানি নিয়ে এল গোলাকার মডেল। তাদের বক্তব্য জন্মের পূর্বেকার হেঁট মুণ্ড ঊর্ধ্ব পদই মৃতদের পক্ষে উপযুক্ত আসন। বড় মানুষদের কথা অবশ্য আলাদা, তাদের এলাহি ব্যাপার। তাঁদের কফিন তো আর কফিন নয়, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সমস্ত সাজসরঞ্জামে পরিপূর্ণ যেন একটি সুন্দর বাড়ি। তবে পারিবারিক ওই “আমরা সবাই” মডেলগুলো হয়তো আকারে বেশ খানিকটা বড়ই ছিল। সেখানে বাবা, মা, আট সন্তানসন্ততি আর তাদের দু’জন বন্ধুদের জন্য ঘর কাটা আছে, সঙ্গে উল্টোদিকের কোনায় বেড়ালের জন্য আলাদা জায়গা।
এর বেশ কিছুদিন পর, মন্দা তখন শেষ হয়ে গেছে। প্রায় সব বাড়িতেই কফিন অতিরিক্ত রয়েছে। অনেকে আবার জায়গা বাঁচাতে বাড়ির দেওয়ালের খাঁজে আলমারির মতো করে কফিন রেখেছে। এত কিছু দেখেও অর্থনীতিবিদরা বেশ জোর দিয়েই বললেন যে বাজারের এই নতুন উত্থান স্থায়ী হবে না। তবে সেই বিজ্ঞাপন অধিকর্তা, থুড়ি সেই বিক্রয় প্রধানের চোখে তখনও লোভের দীপ্তি। এখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য ক্রেতাদের দিয়ে বিক্রীত কফিনগুলোকে ব্যবহার করান। তাঁর হাতে তখন বরাদ্দ টাকার অঙ্কও খুব একটা কম নয়, সেসব ব্যবহার করলে অনেক অসম্ভব কাজই সম্ভব হতে পারে।
নতুন এই প্রচারের শুরুটা ধীরেই হল। আগের মতো এখন আর এই বিজ্ঞাপন বা প্রচার কৌশলকে সাধারণের থেকে বিশেষভাবে আলাদা করা গেল না। তবে একটা বিজ্ঞাপনে দেখা গেল বেশ পুরুষালী চেহারার এক তরুণ উল্কি দেখিয়ে, মুখে হাসি মেখে, চিবুক উঁচিয়ে কফিনে শুয়ে আছে। ছেলেটা বেশ স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ, অবিশ্যি হাতে গুলিওয়ালা মুষ্ক জোয়ানগুলোর তুলনায় কমই। সে মারা গিয়েও শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে পৌরুষ উজাড় করে দিচ্ছে। ইংল্যান্ডেশ্বর সিংহহৃদয়,বীরপুরুষ প্রথম রিচার্ডের পরেই যেন এর স্থান।
সঙ্গীত বিজ্ঞাপনগুলোও কোনও অংশে কম যায় না। সেই প্রথম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জ্যাজ্ গান চালিয়ে সবাইকে চমকে দিল এক কফিন সংস্থা। কি জনপ্রিয়ই না হয়েছিল সেই গান।
এমন সুপরিকল্পিত অভিযানের ফল মিলতে দেরি হল না, শুরু হল আত্মহত্যার পালা। প্রথমটা এতটাই অহিংস ছিল এই প্রক্রিয়া যে কম লোকই একে আত্মহত্যা বলল। কিশোরকিশোরীরা বলত “পটল তোলার পার্টি”। বড়রা প্রথমটা মৃদু আপত্তি জানালেও পরে কিন্তু তারাও ওই একই পথে হেঁটেছিল। পরিশ্রান্ত, অপ্রশংসিত, অসুস্থ মানুষ দলে দলে বেছে নিল আত্মহননের পথ। শুরু হল বিষের কালোবাজারি। তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়েনি। সামাজিক চাপ ও প্ররোচনা এতটাই ছিল যে বেশির ভাগ মানুষেরই আর বিষের প্রয়োজন পড়েনি। আরামদায়ক কফিন বাক্সগুলোতে শোওয়া মাত্রই মুখে হাসি নিয়ে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল।
বীটনিকদের [২] কফিনগুলো আবার একটু অপরিষ্কার ধরনের, ছাতা পড়া আর ঢাকনাবিহীন। কারণে হোক বা অকারণে, নিজেদের জাহির করার গোঁ তাদের বহুদিনের, তাই ওদের কফিনগুলো সান ফ্রানসিসকো শহরের গ্র্যান্ড এভেন্যুতে শায়িত রাখা হয়েছিল। মরার সময় ওদের সবার মুখেই বেশ বুদ্ধিজীবী মার্কা ভাব। একটু বৃষ্টি হতেই সেসব ধুয়ে গেল। “বিপর্যয় বিপর্যয়” বলে হাঁক ডাক শোনা গেল। সে আর কবে না যায়? সেসব কেউ কানে তুলেছিল বলে তো শোনা যায়নি। কিশোর কিশোরীদের মারণ খেলা ততদিনে দেশ জুড়ে আন্দলনের রূপ নিয়েছে।
এসব দেখে শুনে বাকি পৃথিবীর যে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেসব অনুমান করা খুব শক্ত নয়। কম্যুনিস্টরা তৎক্ষণাৎ পুরো ঘটনাকে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শুয়োরদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা আখ্যা দিল। চিন দেশ বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন পন্থা নিয়ে চিরকাল ঝগড়াঝাঁটি করে এসেছে, ওরা এবার যুদ্ধ ঘোষণার কথা ভাবতে লাগল। রাশিয়া অবশ্য বলল যুদ্ধ করা সমীচীন হবে না। পুঁজিবাদীরা যদি মরতেই চায় তবে যুদ্ধ করে তাদেরকে সাহায্য করার কোনও মানে হয় কি? চিন কিন্তু লুকিয়ে চুরিয়ে নিজেদের দেশে এই মার্কিনী পরিকল্পনাই বলবত করল। ওরা বুঝেছিল দেশের বিরাট জনসংখ্যা কমাতে এ এক অব্যর্থ দাওয়াই। এই আন্দোলন গোমড়ামুখো, দুঃখবিলাসী রাশিয়ানদের স্পর্শ করেছিল মর্মের গভীরে। অনেক ভেবে চিন্তে লাল শিবির দেখল যে কোনও অবস্থাতেই পুঁজিবাদীদের থেকে পিছিয়ে থাকা যায় না, তাই তারা আর দেরি না করে নিজেদের কর্মসূচি কিছুদিন পরই ঘোষণা করল। ঠিক কী কী ভাবে তাদের কার্যক্রম মার্কিনীদের থেকে আলাদা ও উন্নত তার বিষদ বর্ণনা সেই ঘোষণা পত্রে ছিল।
এক প্রবীণ ব্রিটিশ দার্শনিক বললেন পৃথিবীতে এলোমেলো পরিবর্তন এড়াতে হলে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সাময়িক লাগাম প্রয়োজন। তাই তিনি এই আন্দোলন সমর্থন করেন।
স্বাধীন শিবির, লাল শিবির, নিরপেক্ষ শিবির আর বাকি যেসব দেশের কোনও শিবিরেই স্থান হয়নি তারাও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডুবে গেল যুগান্তরের এই ঘূর্ণিপাকে। মাত্র দু’বছরের মধ্যেই পৃথিবীকে যা কিছু এতদিন বিপর্যস্ত করেছিল সবই অন্তর্হিত হল।
যে দেশে এই আন্দোলনের জন্ম সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এতে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত হতে সময় নিল সবচেয়ে বেশি। তবে সেভাবে ভাবলে এতে হয়তো ততটা আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। বিশ্বব্যাপী মার্কিনী কফিন শিল্প ততদিনে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছে। উৎপাদন সারিতে, মোড়ক ব্যবস্থায় ঘটেছে বিভিন্ন প্রকারের অভিনব সংযোজন। কবর খোঁড়ার কাজও তখন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্রের হাতেই চলে গেছে। অবশ্য পরিচালনায়, বিতরণ বিভাগে কিছু কাজের বিজ্ঞাপন তখনও বার হচ্ছে। পাওয়া গেল না শুধু বিজ্ঞাপনে সাড়া দেওয়ার মতো মানুষ। আরেক কফিন সংস্থা, জেনারেল মর্চুয়ারির অত্যুৎসাহী প্রধান দাঁতে সিগার কামড়ে, এক সাংবাদিককে একবার বলেই ফেলল, “যদি একজনও সম্ভাব্য কফিন ক্রেতা ও স্টেকহোল্ডার বাকি থাকে এই পৃথিবীতে, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব যাতে সে উপযুক্ত কফিনেই শুতে যায় আর সঙ্গে শেয়ারের দামটাও ভালই পায়।” একে যে সবাই “কবুরে শ্যাম” বলেই ডাকত তাতে আর আশ্চর্য কি? শ্যাম অবশ্য নিজে ঠিক কীরকম কফিনে শুয়েছিল তা কখনই জানা যায়নি।
শেষে একদিন নিঃসঙ্গ এক ব্যক্তির ডেনভার শহরের পথে প্লাটিনামের সূক্ষ্ম কারুকাজ করা মেহগনি কাঠের সুন্দর একটা বাক্স পছন্দ হল। সে পথে পথে তার পছন্দসই একটা কফিন বাক্স খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মনের মতো কফিন বাক্স পাওয়ায় তার মুখের সন্তুষ্ট ভাবটা দেখে মনে হল যেন সে নিজেকে মনুষ্যজাতির শেষ প্রতিনিধি বলেই ভেবে বসেছে। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় বাক্সটার মধ্যে রয়েছে বিশেষ টেকসই প্লাস্টিকে ঢাকা, স্প্রিং দেওয়া নরম গদি যা মৃতদেহের অবয়বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সেটার পাশে সাজানো রয়েছে ছোট্ট, সুন্দর একটি সুরাদান। আর সময় নষ্ট না করে লোকটা তখনই রাস্তার থেকে ওপরে সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠে গিয়ে সেটার ভেতরে ঢুকল। এক গ্লাস দামি স্কচ গলায় ঢালতেই আধশোয়া অবস্থায় সে অনুভব করল নতুন গদিটার স্প্রিংগুলো তাকে যেন খোঁচা দিয়ে বারবার বিরক্ত করছে। যেন চিনতে চাইছে তার চামড়ার স্পর্শ। প্রথমটা একটু হাসি পেল ওর। তারপর কখন যেন তার চোখ আপনা হতেই বুজে এল আরামে। অবলীলাক্রমেই ইহজাগতিক অস্তিত্ব সাঙ্গ হল তার। যন্ত্রসঙ্গীতের আবহে ধীরে ধীরে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ হয়ে গেল।
পাশের একটা বাড়ির ছাদ থেকে শকুনটা ছোঁ মারতে নামল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বিশ্রী স্বরে ডাকতে ডাকতে ঢাকনাটা আঁচড়ে কামড়ে খোলার চেষ্টা করল সে। ইঁদুর-বাঁদর এসব ছাইপাঁশ খেয়ে মুখে অরুচি ধরে গেছে। লস এঞ্জেলস এর দিকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ভালোই জুটে যাচ্ছে। এবার ওদিকে গেলেই ভালো। উড়তে উড়তে পশ্চিমের শুখা পাহাড়গুলোর গায়ে দুটো কালো বিন্দু তার চোখে পড়ল। একটু কাছে যেতেই সে বুঝল ওই দুটো বিন্দু আসলে এক বুড়ো খনিজ অনুসন্ধানকারী আর তার সঙ্গের পোষা একটা মাদী গাধা। ভীষণ রাগ হল তার। রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে সে সটান উড়ে গেল উল্টোদিকে। ওদিক পানে চেয়ে আর লাভ নেই। পাখি জানে ওরা দুজনে এখনও মরতে শেখেনি।
অ্যাডামস নামের ওই ব্যক্তি ততক্ষণে তার গাধাটাকে সঙ্গে নিয়ে, এটা সেটা বলতে বলতে শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছে। লোকালয়ের ঠিক বাইরে এসে অ্যাডামস বুঝল ঘোরতর কিছু ঘটে গেছে। সুনসান রাস্তাঘাট, কয়েকটা ইঁদুর আর চড়ুই বাদ দিয়ে কোথাও কিছুই নড়ছে চড়ছে না।
সে বিড়বিড় করল, “সর্বনাশ! শেষে মঙ্গলবাসীরা এই পৃথিবীকে আক্রমণ করল নাকি?”
একটা খবরের কাগজ মাটিতে পড়েছিল। সেটা তুলে নিয়ে পড়ে ফেলতেই তার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। তার পোষা মাদী গাধাটার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “ওরা দেখছি সব অক্কা পেয়েছে রে। কেউই আর নেই!” তারপর সেই পোষ্যের গলা জড়িয়ে করুণ সুরে বৃদ্ধ বলে চলল, “ওরে আমার ইভ, মনে হয় আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার দায়িত্ব এবার আমাদেরই নিতে হবে।” শেষে খানিকক্ষণ চুপ থেকে অভিযোগের স্বরে বৃদ্ধ বলল, “দেখিস আবার, বাড়ির ভাগটা এবার যেন ঠিকমতো হয়, তোর দিকে বেশি না চলে যায়।”
মূল লেখা: All The Earth A Grave
প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৩ সালে গ্যালাক্সি ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর সংখ্যায়। পরবর্তীকালে “সামহোয়ের ইন স্পেস অ্যান্ড আদার স্টরিজ”-এ সঙ্কলিত এবং একাধিক অডিয়োবুক প্রকাশিত।
পাদটীকা
[১] ইয়ঙ্কি: উত্তর মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের অধিবাসী।
[২] বীটনিক: পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মার্কিনী উপ সংস্কৃতি বিশেষ।
Tags: অনুবাদ গল্প, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রদীপ্ত সাহা, সি সি ম্যাকঅ্যাপ, সৌরভ ঘোষ