গ্রন্থ পরিচিতি – দোর্দোবুরুর বাক্স
লেখক: অপরাজিত সেনগুপ্ত
শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ
বইঃ দোর্দোবুরুর বাক্স
লেখকঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদঃ ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
প্রকাশকঃ আনন্দ
প্রথম সংস্করনঃ জানুয়ারী ২০১০
পরিচায়কঃ অপরাজিত সেনগুপ্ত
বর্ষাকাল, সন্ধ্যা হব হব করছে। তুমুল বৃষ্টিতে আমার বন্ধুবান্ধবরা কেউই আজ নিজ নিজ কর্মস্থলে পা রাখেনি। সন্ধ্যার দিকে তাই অনেকদিন বাদে আড্ডা জমল পাড়ার ছোট্ট ক্লাবঘরে। ক্লাবের আড্ডার মজাই আলাদা। হরেকরকম জিনিসের মত নানা রংবেরঙের গপ্প-গুজব, কেচ্ছা সবই পাবেন; তবে ওই একটা বিষয় “বিশ্বাস” মূল্যে দরদাম বারন। সেটা করলেই শুম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধ হয়ে যাবে। আর আড্ডার মেজাজ অনুযায়ী আমরা সবাই নিজেকে বিদ্যার জাহাজ প্রমান করতে তৎপর। তা সেদিন চাঁদের জমি বেচা থেকে পাশের বাড়ির শ্রীজনের প্রেম নিবেদন ইত্যাদি অলিগলি ঘুরে হঠাৎ আলোচনা এল সাম্প্রতিক মহেঞ্জোদারো মুভিটি নিয়ে।
নড়েচড়ে বসলাম মশাই, কিছুদিন আগেই সিন্ধু সভ্যতার উপরে একটা চমৎকার কিশোর ফিকশন পড়েছি যা বেশ চমকপ্রদ। ওই ফিকশন যদি গম্ভীর মুখে এদের খাওয়াতে পারি তাহলেই আজ কেল্লা ফতে। হঠাৎ গম্ভীর মুখে বলে উঠলাম, “ডিরেক্টর পড়াশুনা করেনি।”
লাল্টু বলে উঠল, “না, তুই করেছিস! হরফটাও পড়ে ফেললি নাকি সিন্ধুসভ্যতার?” (ওমা কি ভাল ছেলেরে, আয় বাবা কোলে আয়!)
-গাম্ভীর্য আরেক টোন চড়িয়ে বললাম, “সিন্ধু সভ্যতার ভাষা আবিষ্কার কোনদিন সম্ভব না।” (বা! বেশ খাচ্ছে লোকজন।)
পচা বলল, “তা কেন? মিশরের হায়ারোগ্লিফিক্স ডেসিফার করেছে যখন এটা হবে না কেন?” (জয় মা! কার মুখ দেখে উঠেছি আজ!)
-“বইপত্র তো তুলে রেখে দিয়েছিস তোরা, আর কি জানবি? আচ্ছা, ওয়াজিরিস্তান ছাড়িয়ে হিরাদিয়া পাহাড় বলে একটা জায়গা আছে নাম শুনেছিস? বা তুরিখেল উপজাতির নাম? পিশাচ হয়ে যাওয়া কালকঞ্জ দের নাম? যারা হাওয়ায় বিষ ছড়িয়ে একের পর এক গ্রাম ধ্বংস করত। আকাশ থেকে নেমে আসা দানব দোর্দোবুরুর নাম?” (ঘনাদা সুলভ বিস্ময় ছড়াতে পেরেছি ব্যাস মার দিয়া কেল্লা।)
-“শোন বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাত বুঝলি। টাইম মেশিন চড়ে যদি স্বাধীনতার আশপাশে কলেজস্ট্রীট চত্বরে অলি-গলিতে একটু ঘুরতিস, চোখে পড়ত শুশ্রত বিজ্ঞানলয় বলে একটা দোকান। আর ওই দোকানেই দেখা পেতিস বাঙালী জাতির অন্যতম হিরো ত্রিলোক আথুরি মশাইয়ের সাক্ষাৎ শিষ্য ক্ষনজন্মা বিষবৈদ্য সনাতন-এর।”
এ পর্যন্ত শুনে তো ওই ক্লাবের বন্ধুদের খাবি খাওয়া অবস্থা। কিন্তু না মশাই আপনাদের সাথে অমন ছলা-কলা করার স্পর্ধা নেই। আগেভাগেই স্বীকার করেনি যে বইটার কথা বলছি সেটা হল দেবজ্যোতি ভট্টচার্যের লেখা “দোর্দোবুরুর বাক্স”।
বহুপন্থী লেখক দেবজ্যোতিবাবুর কলমে আমরা পেয়ে চলেছি বিভিন্ন ধরনের লেখা। সুপ্রসিদ্ধ ‘জয়ঢাক’ পত্রিকার সম্পাদকের এক অনন্য সৃষ্টি এই বিষবৈদ্য চরিত্রটি। তাকে নিয়ে লেখা অ্যাডভেঞ্চারগুলিকে কোন একটা নির্দিষ্ট জঁ’রে আটকে রাখা অসম্ভব। জলতরঙ্গের আওয়াজের মত মিঠে অথচ নির্ভার ভাষায় লেখা কিশোর কাহিনীগুলোতে রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার, কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি মেশানো অপূর্ব স্বাদ। “দোর্দোবুরুর বাক্স” গল্পে লেখক ফেঁদেছেন এমনি এক গল্পের যা শুরু হয় মিথ থেকে সেখান থেকে ফ্যান্টাসি-কল্পবিজ্ঞানের মাঝামাঝি জায়গায় গল্প যেখানে শেষ করলেন সেটা তারিফযোগ্য। তার এই ধরনের গল্পগুলি মূলত অ্যাডভেঞ্চার। কিশোর (আমাদের মত বুড়ো খোকাদেরও) মনকে প্রলুব্ধ করতে এর থেকে বড় অস্ত্র আর কি আছে! এর সঙ্গে সঙ্গেই লেখক সুচারুভাবে মিশিয়ে দেন হাল্কা ইতিহাস, মিথ আর ভৌগলিক তথ্যাবলী। তবে কখনই গল্পের শরীর এসবের ভারে নুব্জ হয়ে পড়ে না। বরং বিভিন্ন জিনিসের আকার-আকৃতি বা কোন জায়গায় ম্যাপে অবস্থান বর্ণনা করতে তিনি যে উদাহরণ ব্যাবহার করেন তা কিশোর মনোপযোগী মনে হয়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – “পেশোয়ার শহরটাকে ম্যাপে দেখলে মনে হবে ঠিক যেন একটা রিভলভার। তার ট্রিগারটা যেখানে, সেইখানটাতে রেলওয়ে স্টেশন।”
গুল দেওয়াতে বা বলা ভাল গল্প ফাঁদতে বিষবৈদ্য প্রায় ঘনাদার সমকক্ষ। ইমাজিনেশনের যে দৌড় এই কাহিনী ও অন্যান্য বিষবৈদ্য কাহিনীতে লেখক দেখিয়ে চলেছেন তা এককথায় অনবদ্য। বিষবৈদ্য সনাতনের বেশিরভাগ গল্পই স্মৃতিচারণ। তাই বেশ একটা মজলিশি ব্যাপার আছে যা গল্প শোনার আগ্রহকে আরো জোরালো করে তোলে। অহেতুক ঘুরপথে বেশি না ঘুরে মূল বিষয়ে দ্রুত প্রবেশ লেখাগুলোর একটা গুন। যাতে কমবয়সী পাঠকদের শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনায় রাখা যায়।
দোর্দোবুরুর বাক্সে আকাশ থেকে নেমে আসা দানব, তার তৈরি পিশাচদল, আপাতদৃষ্টিতে মিথ মনে হলেও লেখক সমস্ত খোলা প্রান্তগুলোকে বলিষ্ঠ কল্পনায় জুড়ে দিয়েছেন কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির সুতো দিয়ে। যা একাধারে গল্পটার চমককে ধরে রেখেছে শেষ অব্দি, অন্যদিকে কল্পনার মধ্যে কোথাও একটা লজিকাল ভাবনার (দুটো জিনিস মূলত বিপ্রতীপ হলেও) বীজও বপন করে দেয় প্রচ্ছন্নভাবে।
সর্বশেষ কথা বিষবৈদ্য-এর মত ক্যারিশম্যাটিক, মিস্টিরিয়াস চরিত্র নিয়ে একের পর এক গল্প লিখে চলেছেন দেবজ্যোতিবাবু। তবু কোথাও গিয়ে মনে হয় এখন যতটা খ্যাতি এ চরিত্রের পাওয়া উচিৎ ছিল তা এখনও পায়নি। তার একটা কারন বইগুলো নিয়ে আলোচনার অভাব। আশা রাখি আপনিও আপনার আশেপাশের কচিকাঁচাদের হাতে তুলে দেবেন এই বই। হয়ত কিছু ক্ষেত্রে কিছু কনসেপ্ট তাদের জটিল মনে হতে পারে কিন্তু ভাল জিনিসের রসাস্বাদন করতে করতে সেই প্রতিবন্ধকতা কেটে যাবে আশা রাখি।
Tags: অপরাজিত সেনগুপ্ত, গ্রন্থ সমালোচনা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, দোর্দোবুরুর বাক্স, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা