গ্রন্থ পরিচিতি – পাঁচটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস
লেখক: কুণাল কর্মকার
শিল্পী: ইন্টারনেট
দ্য মেগ- স্টিভ অল্টেন
বইটা ঝটপট পড়ে ফেলুন দেখি, এমন টান টান উত্তেজনার বই অনেকদিন পর পড়লাম ।
মারিয়ানা পরিখা থেকে, Deep sea Exploratory Submersible কে ধাওয়া করে উঠে আসে প্রাগৈতিহাসিক দৈত্য হাঙর ‘মেগালোডন’। ২০ টন ওজন, ৬৫ ফুট লম্বা দানবের, দাঁতের কাছে তিমি কোন ছাড় নিউক্লিয়ার ডুবোজাহাজেরও রক্ষে নেই। মানবজাতি চায় দানবীর নিকেশ, কিন্তু বাধ সাধে নায়ক আর তার কয়েকজন সঙ্গী যারা জীবটিকে সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। ব্যাস, আর কি চাই, অত্যাধুনিক জাহাজ, হেলিকপ্টার, সাবমেরিনসহ জমাটি এ্যাকশন। মাঝেমধ্যেই মনে হবে, ধুর, এমনটা হতেই পারে না, কিন্তু পড়া বন্ধ করতে পারবেন না।
গল্পটি বাঁধা ছকে এগোলেও, লেখার মুন্সীয়ানা আর সম্পাদনার জোরে, আপনার দম মাঝেমধ্যেই উত্তেজনায় বন্ধ হয়ে আসবে, রক্ত হয়ে যাবে হিম; বিশেষ করে যখন লেখক মেগালোডনের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন।
হিরোর নাম জেনে কি করবেন? এখানে হিরোইন ‘মেগ’ ।
লেখক এখনও অবধি এই সিরিজে পাঁচটি উপন্যাস ও একটি বড়গল্প লিখেছেন ।
মেড থিংস- এ্যাড্রিয়ান চাইকভস্কি
আর্থার সি ক্লার্ক পুরষ্কারবিজয়ী লেখকের নবতম উপন্যাসিকাটি একটি স্টিমপাঙ্ক ফ্যান্টাসি।
যাদুকরদের শহর ফাউন্টেনস প্যারিসে আপনাদের স্বাগত। এই নোংরা, অতিজনাকীর্ণ শহরে ছিঁচকে চুরি, পকেটমারি করে দিন গুজরান করে কোপেলীয়া আর তার দুই পুতুল সঙ্গী টেফ ও আর্ক। ঘটনাচক্রে, এক ডাকাত সর্দার, কোপেলীয়া আর তার গুরু আন্ট কাউণ্টলেশ’র ওপর ভার দেয় এক গোলেম’র ওপর নজরদারির, আর বেচারিরা আবিষ্কার বসে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। কোপেলীয়া বন্দী হয় শহরের নীচের শয়তানের হাতে। উদ্ধারে নামে পুতুল সঙ্গীরা। নানা অদ্ভুত জীব, যন্ত্র ও যাদুর সমাহারে এই গল্পটি বেশ অন্যধরনের এক কল্পবিশ্বের সন্ধান দেয়।
উপন্যাসিকাটি শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক সংস্করণেই পাওয়া যাচ্ছে।
দ্য হিডেন শিপ-মার্ক ওয়েন ম্যাকগীনেস
ভীনগ্রহীরা পৃথিবী আক্রমণ করেছে; না Independence Day সিনেমার মতো মানবজাতির জয় এখানে হয় না, প্রযুক্তিগত ভাবে ইয়ারুপিটানরা এতটাই এগিয়ে, যে প্রায় বিনাযুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় পৃথিবী। সাত ফুটি সরীসৃপদের ভয়াবহ রাজত্বে মানবসভ্যতা ও প্রযুক্তি প্রায় বিলুপ্ত। অভাব নেই বিশ্বাসঘাতকেরও।
এই আতঙ্কের দুনিয়ায় জোট বাঁধতে থাকে বিদ্রোহীদের দল, ব্রায়ান পল্ক নামের এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিমানবাহিনী ক্যাপ্টেন তাদের দলপতি। হাতানো ভীনগ্রহী অস্ত্র ও প্রযুক্তির সাহায্যে শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ।
ছকটা চেনা হলেও গল্পটা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ। ভারী ভারী শক্ত সাইফাইয়ের পরে এই উপন্যাসটি, একটু হলেও স্বর্ণযুগের linear storyline -র স্বাদ মনে করিয়ে দেবে।
দ্য লাইট ব্রিগেড- ক্যামেরন হার্লি
ডিটস ও তার সহযোদ্ধারা একটি বৃহৎ কর্পোরেশনের সৈন্যদল, তারা আলোয় রূপান্তরিত হয়ে যুদ্ধে যায়, মানে ঠিক Star Trek র Teleportation র মতো। নিমেষে ব্যারাক থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে (এখানে মঙ্গল)। প্রযুক্তিটি অবশ্য নিখুঁত নই, তাই মাঝেমধ্যেই অনেকে চিরতরে হারিয়ে যায়, অনেকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভুল জায়গায় জোড়া লাগে, নিদারুন যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যু আসে।
ডিটসের বিপদ অবশ্য অন্য জায়গায়, তার যুদ্ধস্মৃতি অন্যদের সঙ্গে মিলতেই চায় না, মানে সে হয়তো নিজের স্কোয়াডের সঙ্গে রূপান্তরিত হল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দেখল সহযোদ্ধারা সব অচেনা, আবার ফিরে এসে দেখল তার নিজের স্কোয়াডের বন্ধুরা তার বীরত্বের বাহবা দিচ্ছে, এমন এক যুদ্ধের জন্য যাতে সে অংশগ্রহণই করেনি। সবার স্মৃতি হয়তো মঙ্গলের, ডিটসের কিন্তু রবিন আইল্যান্ডের।
তবে কি সে ভবিয্যতে চলে যায় না কি অন্য কোনও ডাইমেনশনে? সবাই তাকে পাগল ভাবে, সাইকিয়াট্রিস্টরা তাকে observation এ রাখলেও পাঠাতে থাকে একের পর এক মিশনে, সে যেন গিনিপিগ। ডিটস খুঁজতে থাকে উত্তর, এমন এক বদ্ধ জীবনে, যেখানে ক্যালেন্ডার দেখারও এক্তিয়ার নেই একজন সৈনিকের।
লেখিকা উপন্যাসটিতে জলবায়ু বিপর্যয় পরবর্তী corporate owned একটি ডিস্টোপিক দুনিয়ার ছবি এঁকেছেন, পৃথিবী আবার সবুজ, কিন্তু তার স্বাদ পায় হাতে গোনা কিছু নাগরিক। বাকিরা কাঙ্খিত জীবনের আশায় গোলামী করে চলে কর্পোরেশনগুলির। এক যুদ্ধ কাহিনি যেখানে যুদ্ধ কমই এসেছে বরং সর্বগ্রাসী সেন্সরশীপের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মঙ্গলবাসী শত্রুদের (তারাও মানুষ) স্বাধীন সুন্দর জীবনের সঙ্গে নিজেদের অন্ধকার জীবনের ঈর্ষাতুর তুলনা। সৈন্যদের মধ্যে বারবার কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে, কার স্বার্থে এত মৃত্যু, মঙ্গল কি সত্যিই তাদের শত্রু, নাকি কর্পোরেশনগুলো নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ করে চলেছে?
উপন্যাসটি শেষ হয়ে গেলেও শিরশিরানিটা থেকে যায়, আজকের দুনিয়ার সঙ্গে বড় বেশি মিল যে।
ইনফাইনাইট-জেরেমি রবিনসন
আলোর চেয়ে দ্রুততর মহাকাশযান গালাহাদ ছুটে চলেছে চোদ্দশো আলোকবর্ষ দূরের কেপলার ৪৫২ বি গ্রহের দিকে। পৃথিবী মৃত, মঙ্গল মৃতপ্রায়, জাহাজের পঞ্চাশ জন নিদ্রাচ্ছন্ন আরোহীই মানবজাতির শেষ সম্বল। বসতি স্থাপন করতে পারলে মানবজাতি হয়তো টিকে যাবে।
যানের সিনিয়ার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম, দশ বছরের ক্রায়ো ঘুম থেকে জেগে উঠেই খুন হয়ে যায় তার বন্ধু ও সহকারী টম এর হাতে, কিন্তু মরণ তার জন্য নয়, সে আবার উঠে দাঁড়ায়, অবাক হয়ে আবার আক্রমণ শানায় খুনি, এবার মৃত্যু হয় টমের।
গালাহাদের Artificial Intelligence (AI) জানায়, ক্রায়োঘুমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় টম পাগল হয়ে ক্যাপ্রিয়া ডিক্সন ছাড়া আর সবাইকে খুন করেছে। শুধু তাই নয় জাহাজের পথনির্ণায়ক পদ্ধতিটিকে হ্যাক করে যানটিকে গন্তব্যচ্যুত করে অসীমের পথে ঠেলে দিয়েছে। শত চেষ্টাতেও উইলিয়াম সেই সিস্টেম লক কোড ভাঙতে অসমর্থ। ইতিমধ্যে জানতে পারে অমরত্ব নিয়ে জিনগত গবেষণার একমাত্র সাফল্য সে নিজে। ক্যাপ্রিয়াকে সে আর জাগায় না কারণ কাউকে সে আর হারাতে চায় না। অমরত্বের একাকীত্ব তাঁকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে, ঘুমন্ত মানবী তার কাছে একটা আধার হয়ে দাঁড়ায়; যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়; যার কাছে সমস্ত সুখ-দুঃখ উজাড় করা যায়; কিন্তু জাগিয়ে হতাশার দিকে ঠেলে দেওয়া যায় না। মানবজাতির শেষ পুরুষ তাই নিজের জন্য তৈরি করে ফেলে এক ভার্চুয়াল জগৎ যেখানে সবকিছু সুন্দর, কিন্তু সেখানেও তার মন বসে না । মহাকাশযানের আরেক অমর আরোহী AI গ্যাল ও বড় একা। অ্যাডভেঞ্চার গল্প কখন যেন প্রেমের গল্পে পরিণতি পায়।
জায়গা বিশেষে উপন্যাসের গতি শ্লথ হলেও, অপূর্ব চরিত্রচিত্রণ এবং জটিল দর্শনকে সহজপাচ্য করে তুলতে পারাটা ঔপন্যাসিকের বিরাট সাফল্য। রেশ থেকে যায়, শেষের পরেও।
Tags: ইন্টারনেট, কুণাল কর্মকার, গ্রন্থ পরিচিতি, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী
দারুন লাগলো, এরকম আরও অনেক গ্রন্থপরিচয় চাই কুণালবাবু!
ধন্যবাদ। আপনাদের ভালোলাগাটা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।কল্পবিশ্ব’র সাথে থাকবেন।অন্য লেখাগুলিও পড়বেন,অনুরোধ করলাম।
আগের issue গুলিতেও এমন বইয়ের খবর অনেক পাবেন।
মেগ আর লাইট ব্রিগেড বাদে বাকিগুলো পড়া ছিল না। কুনালবাবু লোভ ধরিয়ে দিলেন তাঁর গ্রন্হপরিচিতিতে
The Meg যে সিনেমাটা বের হইছে তা কি এটারই কাহিনী??