গ্রহণে স্মরণে
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
মানুষের যদি কোন একটা গুণ থাকে, অনেক সময়ে দেখা যায় তার প্রভাব তাঁর সমস্ত কাজের ওপরেই পড়ে। ধরুন কেউ যদি নিখুঁত কাজ করতে ভালবাসেন, দেখা যাবে তাঁর হাতের লেখা থেকে শুরু করে, ঘর গুছানো, সবেতেই একটা পরিপাটি কাজের ছাপ থেকে যায়।
অদ্রীশ বর্ধনের ব্যাপারে সেইরকম একটা গুণের যদি খোঁজ করি, যার প্রভাব তাঁর জীবনের সর্বত্র ছাপ ফেলেছে, তাহলে একটাই কথা মাথায় আসে।
সাহসিকতা।
আমার ঠাকুমার মুখে শোনা একটা গল্প বলি। স্বাধীনতার কিছুকাল আগেকার কথা, ভারিক্কী ভাষায় বলতে গেলে যাকে বলে ‘অগ্নিগর্ভ সময়’; সে সময়ে গুলি, বন্দুক, বোমার সন্ধানে পুলিস বাড়িতে বাড়িতে নিয়মিত তল্লাসী চালাচ্ছে। বোমা মজুত করা আছে এই সন্দেহে অদ্রীশ বর্ধনের পারিবারিক বাড়িতেও তেনাদের একদিন পায়ের ধুলো পড়ল।
তাঁদের সন্দেহ অবশ্য অমূলক ছিল না, চিলেকোঠার ছাদে সত্যিই ও জিনিষ খানকয়েক পিস রাখা ছিল।
বাড়ির সদর দরজায় পুলিশ, পালাবেন আর কোথায়! ঘরের মেঝেতে বিছানা পাতা ছিল, তার চটের নিচে বোমাগুলো গুঁজে দিয়ে অম্লান বদনে ভদ্রলোক বিছানায় শুয়ে পড়লেন। পুলিস এসে ঘরের দু–একটা জিনিস উল্টেপাল্টে দেখল বটে, কিন্তু কোন সুস্থ মানুষ পেটোর ওপর শুয়ে থাকতে পারে এটা তাদের হয়ত তাদের মাথাতেই ঢোকেনি, সুতরাং তাঁকে দুএকটা প্রশ্ন করে তারা বিদায় নিল।
এই সাহসের প্রভাব পড়েছে তাঁর জীবনের অনেক জায়গায়। সাধারণ বাঙালী যে সময়ে খোঁজে একটা মাস্টারি কি একটা কেরানীর চাকরি, তখন তিনি কাজ নিলেন ক্যালক্যাটা কেমিক্যালের সেলসে। আর সেই কাজই বা কোথায়? না, কলকাতায় নয়। সুদূর ব্যাঙ্গালোরে। এও সেই পঞ্চাশের দশকের শেষের সময়কার কথা, যখন কলকাতার মানুষের কাছে দক্ষিণ ভারতীয় মানেই ‘মাদ্রাজী’ আর ব্যাঙ্গালোরের নামও কেউ শুনেছে কিনা সন্দেহ। একে দুঃসাহস ছাড়া আর কি বলব!
এই ব্যাঙ্গালোরেই অদ্রীশ বর্ধনের লেখক জীবনের সূত্রপাত। থাকতেন গান্ধীনগরে, চাকরির প্রয়োজনে ঘুরে বেড়াতেন মাইসোরে, ম্যাঙ্গালোরে আর ব্যাঙ্গালোরের এদিক সেদিকে। সঙ্গে পরিবার পরিজন নেই, অবসর সময়ে কাটাবেন কি করে? মাঝে মধ্যে অলঙ্কার থিয়েটারে একটা আধটা সিনেমা দেখতে যেতেন হয়ত, কিন্তু সময় কাটানোর মূল উপাদান হয়ে দাঁড়াল লেখা।
না, লেখক হওয়ার জন্যে লেখা নয়, লেখার জন্যে লেখা। প্রসঙ্গতঃ বলি, এ বিষয়ে তাঁর কিছু স্পষ্ট মতামত ছিল। ‘ফুল ফুটলে যেমন প্রজাপতি আপনা থেকেই আসে, তেমনি লেখা ভাল হলে তার পাঠক নিজেই জোটে। লেখা কোথায় ছাপা হবে সে বিষয়ে চিন্তা না করে, বরং লেখাটাকে কি করে আরো ভালো করা যায় সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়াটা বেশি দরকার।’ – এই কথাটা তাঁর মুখ থেকে বেশ কয়েকবার শুনেছি।
দুঃসাহসের সেই প্রভাব যে তাঁর কলমেও পড়বে সেটা এক রকম ধরেই নেওয়া যায়। অতএব, যে সময়ে সায়েন্স ফিকশনের কথা পাঠক মহলে অজানা, তাকেই সামনে আনতে শুরু হল প্রয়াস। যার প্রথম পদক্ষেপ জুল ভের্ণের অনুবাদ, এবং পরে নাট–বল্টু–চক্র চরিত্রটির সৃষ্টি।
আরো আছে। সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব গড়া, সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় ফ্যাণ্টাস্টিকের মত পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করা, সবেতেই সেই অসমসাহসিকতার ছাপ সুস্পষ্ট।
তবে শুধু সাহস থাকলেই হয় না। নিজের বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা থাকা চাই। স্বীকৃতি কোন লটারি নয়, তাকে অনায়াসে পাওয়া যায় না, তা বহু পরিশ্রমের ফসল। কল্পবিজ্ঞান এমন একটা বিষয়, যাতে ‘অনেকখানি পড়লে, তবে একটুখানি লেখা যায়’, এ কথাটাও বহুবার তাঁর মুখে শুনেছি। অতএব বই পড়াটা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল। পড়তেন, এবং পড়তে বলতেন। এবং পড়া ধরেছিলেন এমন একটা সময়ে যখন বিদেশী লেখকদের বই যোগাড় করা প্রায় অসাধ্য ছিল।
কল্পবিজ্ঞান মানে বিজ্ঞানভিত্তিক খটমটে একটা প্রবন্ধ নয়, গল্পের গতিটা না বজায় থাকলে, লেখাটা সুখপাঠ্য হয় না। কিন্তু কি করে আসে তেমন লেখা? আমাকে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন ‘ঘাড় গুঁজে, কলম খুঁচিয়ে, জোর করে বার করা লেখা নয়। যখন দেখবি কলম তরতর করে চলছে, চিন্তা করার আগেই কলম হাতকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে, বুঝবি ঠিকঠিক লেখা হচ্ছে।’
যদিও কথায় বলে ঋণ করতে নেই, আমার মত অনেকেরই হয়ত অদ্রীশ বর্ধনের কাছে উত্তরোত্তর কল্প সাহিত্য উপদেশে ঋণী হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। নিউটনের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে – If I have seen further, it is by standing on the shoulders of giants। আমার দৃষ্টি যদি বহুদুর প্রসারিত হয়ে থাকে, তবে দীর্ঘদেহীদের কাঁধে চড়ার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। আশা রাখি কল্পবিজ্ঞানের এই বিশালাকায় পথিকৃৎটি পিতৃস্নেহে আমাদের তাঁর সাধনালব্ধ সাহিত্য অভিজ্ঞতার কাঁধে চড়িয়ে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের আগামী ধারাপথটুকু চেনাতে থাকবেন।
সমানি ব আকুতিঃ, সমানা হৃদয়ানি বঃ।
Tags: গ্রহণে স্মরণে, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুমিত বর্ধন, সৌরভ দে, স্মৃতিচারণ