ঘাতক
লেখক: অরিন্দম দেবনাথ
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
“হে সর্বশক্তিমান থরের বংশধর, হে মহাধিপতি হেরন, তবে কি আমরা বসে বসে মার খাব? যুগযুগ ধরে বরফ গলার সময় ওরা আসছে। কিন্তু কোনওদিন আমরা অত্যাচারিত হইনি। উল্টে আমাদের চিরচারিত রীতি মেনে আমরা ওঁদের সমস্তরকম সহযোগিতা করে চলেছি। কতদিন, আর কতদিন এই আক্রমণ মেনে নেব?”
“শান্ত হও ওলাফ, ধৈর্য ধরতে শেখ। ভুলে যেও না আমরা ধরিত্রীর শ্রেষ্ঠ বীর ওডিন পুত্র থরের বংশধর। এই ধরিত্রীকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। অপ্রয়োজনে হত্যা বা আক্রমণ আমাদের নীতি বিরুদ্ধ।”
“প্রভু হেরন, আপনি বিগত কয়েক বছর ধরেই এই একটি বাক্যই শুনিয়ে আসছেন। বলছেন পরমপিতা স্বয়ং অডিন আমাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু নিয়ম করে এখন প্রতি বছর বরফ গলার সময় ওরা আসছে আগুনলাঠি নিয়ে আর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া আগুন-পাহাড়ের গহ্বর থেকে চকচকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। আমরা মহান ওডিন পুত্র থরের বংশধররা শুধুই তাকিয়ে আছি কবে আমাদের মহান পিতা তাঁর হাতুড়ি নিয়ে হাজির হবেন আগুনলাঠি হাতের ওই দূর দ্বীপের দুরাত্মাদের শায়েস্তা করতে।”
“বাক্য সম্বরণ কর ওলাফ! তুমি যাদের দুরাত্মা বলছ ওঁরাও আমাদের মত মহান থরের বংশধর। আমাদের মহান পুরোহিত হেলগে দেখছেন কী করে এর সমাধান করা যেতে পারে।”
“কিন্তু আর কতদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে মহাধিপতি হেরন?”
“মহান পুরোহিত হেলগে জানিয়েছেন, সময় আগত প্রায়। দেখবে ওরা আর আসবে না।”
“হলেই ভাল। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন ওই আগুনলাঠি নিয়ে আসা ইনুইটরা আর ইনুইট নেই। ওরা আমাদের মত কাঁচা মাছ-মাংস খায় না। ওরা এখন মাছ আগুনে পুড়িয়ে খায়। ওরা আর কঠিন শীতের সময় বরফ-ঘর ইগলুতে থাকে না। ওরা কাঠ পাথরের বাড়ি বানাতে শিখেছে। এমনকি ওরা শক্তিমান কুকুরে টানা স্লেজেও চড়ে না। ওরা কলে চালান স্লেজে চড়ে। আমাদের আগুন গহ্বর থেকে লুঠ করে নিয়ে যাওয়া চকচকে পাথর, ধোঁয়া-ওঠা কলের নৌকোর ওই তিমি শিকারিদের দিয়ে ওদের কাছ থেকে আগুন লাঠি নিচ্ছে আর এইসব সুবিধা পাচ্ছে।”
“এইসব কথা তুমি জানলে কী করে ওলাফ!”
“ওই ধোঁয়া-ওঠা কলের নৌকোর লোকেরাই আমাকে বলেছে। মহাধিপতি হেরন, ওই তিমি শিকারিরাই বলেছে আমরা যদি ওদের ওই আগুন পাহাড়ের গহ্বরে নিয়ে যাই তবে ওরাও আমাদের এইসব দেবে।”
“এইকথা মনে আনাও পাপ ওলাফ। আমাদের মধ্যে একমাত্র মহান পুরোহিতের অধিকার আছে ওই গহ্বরে প্রবেশের।”
“মহাধিপতি হেরন ভুলে যাবেন না। ওই দূর সমুদ্রের ইনুইটরা কিন্তু আগুন লাঠি দেখিয়ে গহ্বরে ঢুকছে। ওই আগুন লাঠি দিয়ে ওরা আমাদের দুজনকে হত্যা করেছে। এমনকি ওদের আগুনগহ্বরে যাওয়ায় বাধা দেওয়ায় আমাকেও ওরা আঘাত করছে।”
“সবই আমার অবগত আছে ওলাফ।”
নরওয়ের একেবারে উত্তরে মেরু সমুদ্রের মাঝে এক ছোট্ট দ্বীপ জান-মায়েন। চতুর্দিকে চির বরফের সাম্রাজ্য। দ্বীপের উত্তরপূর্ব প্রান্ত সমুদ্রতল থেকে উঠে গেছে মেঘের পানে ৭৪০০ ফুট উঁচুতে। খাড়া পাহাড়ের ঠিক মধ্যিখানটা দূর থেকে দেখতে অনেকটা সমতলের মত। আসলে ওই সমতলের মত দেখতে মাথাটা এক বিশাল গহ্বর। আগুন গহ্বর। এক আগ্নেয়গিরির মুখ ওটা। কচ্চিৎ অগ্নিবর্ষণ হয় ওই জ্বালামুখি থেকে। ওই অঞ্চলে তিমি মাছ শিকারে যাওয়া মৎস্যজীবীরা ওই আগুনদ্বীপের নাম দিয়েছে বেরেনবার্গ। মানে ভালুকের দ্বীপ। দলে দলে মেরু ভালুক ওই দ্বীপে বরফের চাঁইয়ে ভেসে গ্রীষ্মকালে হানা দেয় সমুদ্র কিনারায় রোদ পোয়াতে থাকা সিলমাছের লোভে। তিমিশিকারিরা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে ওই দ্বীপের সান্নিধ্য। এই দ্বীপ নাকি বজ্রের দেবতা থরের বাসস্থান। গ্রীষ্মের কয়েকমাস বাদ দিলে ওই দ্বীপের ধারেকাছে পৌঁছান সম্ভব নয়। জান-মায়েনের সবচাইতে কাছের শহর তিনশো মাইল দূরের গ্রিনল্যান্ড।
দু-একটি তিমি শিকারির দল ছাড়া কেউ জানে না যে, ওই দ্বীপে কিছু মানুষও বাস করে। ইনুইট! ওরা ওদের পরিচয় দেয় থর দেবতার বংশধর বলে। আরও একটি দল এদের অস্তিত্ব জানে। প্রতি বছর তিনশো মাইল জলপথ পাড়ি দিয়ে ওরা আসে আরেক বরফ সাম্রাজ্য থেকে। ওরাও ইনুইট। ওরাও নাকি থর দেবতার বংশধর। ওরাও নাকি কোনও এক সময় এই দ্বীপে বাস করত। একবার অগ্নিগহ্বর অগ্নি উদ্গিরণ শুরু করতে ওদের এক পূর্বপুরুষ কয়েকজন মহিলা পুরুষকে নিয়ে চামড়ার নৌকা চেপে পাড়ি দিয়েছিল অজানা সমুদ্রে। তারপর ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছেছিল অজানা এক দ্বীপে। সেখানেই আস্তানা গেড়েছিলে।
অন্য দ্বীপে পাড়ি জমানো ইনুইটদের একটি ছোট দল প্রতি বছর তিমি শিকার মরশুমের শুরুতে একবার করে এখানে আসত থর দেবতার বাসস্থান অগ্নিগহ্বরকে প্রণাম জানাতে। প্রণাম সেরে ফিরে যাবার সময় পুরোহিতের কাছ থেকে অগ্নিগহ্বরের চকচকে একটুকরো পাথর দেবতার আশীর্বাদ হিসেবে পেত। গহ্বরের গায়ে এরকম অজস্র পাথর লেগে আছে। এমনকি গরমকালে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলের ধারায় ছোট চকচকে ওই পাথরের টুকরোও নাকি জলের স্রোত বয়ে সমুদ্রে মিশে যায়। দু এক বার বহিরাগত তিমি শিকারিরা এই দ্বীপে নামার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মেরুভালুকের রুদ্রমূর্তি দেখে নিরস্ত হয়েছে। অথচ দ্বীপবাসীদের এই ভালুকরা কিছু করে না। শোনা যায় দ্বীপের শিশুরা নাকি ভালুকের পিঠে উঠে খেলা করে।
“অনেক বছর পর আমি সবার সাথে কথা বলতে চাইছি মহাধিপতি হেরন, আপনি সবাইকে একত্রিত করুন।” অনেকগুলো ছোট ছোট পাথরের টুকরোর মাঝে, একটা বড় পাথরের ওপর বসে থাকা বৃদ্ধ হেরনের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে হাঁফাতে লাগলেন অতিবৃদ্ধ পুরোহিত হেলগে।
নিজের আসন থেকে উঠে পুরোহিত হেলগের হাত ধরে পাশের সবচাইতে উঁচু পাথরের ওপর বসিয়ে হেরন বললেন “যথা আজ্ঞা মহান পুরোহিত।”
এই স্থানটি এই দ্বীপের বাসিন্দাদের মিলন ক্ষেত্র। যেকোন অনুষ্ঠান এইখানেই মহাধিপতি হেরন ও মহান পুরোহিত হেলগের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়।
কোমরে ঝোলানো তিমি মাছের হাড় থেকে তৈরি একটি বাঁশি বের করে তাতে ফুঁ দিলেন হেরন। এখন গ্রীষ্মকাল। এ-সময় ইনুইটদের চামড়ার ঘরে থাকার সময়। হেরনের বাঁশির তীক্ষ্ণ শব্দে চামড়ার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দ্বীপের বাসিন্দারা জড়ো হল পাথুরে আড্ডায়।
এসময় মাথার ওপর সবসময় জ্বলজ্বল করেন সূর্যদেব। অন্ধকারের প্রবেশ নিষিদ্ধ এই বরফ গলার সময়। আবার বরফ জমার সময় ঠিক উল্টোটাই হয়। তখন সূর্যদেব বিশ্রামে যান দীর্ঘ সময়ের জন্য। চামড়ার ঘর গুটিয়ে ইনুইটরা তখন আশ্রয় নেয় বরফের ঘর ইগলুতে।
নিঃশব্দে এসে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের ওপর বসল।
সবাই তাকিয়ে অতিবৃদ্ধ পুরোহিতের দিকে। অগ্নিগহ্বরের কাছে পাথরের গুহা থেকে বেড়িয়ে খুব কমই সর্বসমক্ষে আসেন থরের পূজারী হেলগে। এই দ্বীপ থেকে কোথাও যান না বৃদ্ধ পুরোহিত। শুধু তিমি শিকারের সময় দ্বীপের শক্ত-সমর্থ পুরুষরা যখন চামড়ার নৌকোয় চেপে বরফ মুক্ত নীলসমুদ্রে ভেসে পড়েন তখন উনি ওঁনার আস্তানা থেকে বেড়িয়ে এসে শিকারে যেতে প্রস্তুত শিকারিদের মস্তক চুম্বন করে আশীর্বাদ করে যান। দ্বীপবাসীরাই ওনাকে ইনুইটদের স্বভাব খাদ্য কাঁচা মাংস পৌঁছে দেন ওঁনার গুহায়। দুটো মেরু ভাল্লুক সবসময় ওঁনার গুহার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। যেন ওঁর পাহারাদার। এছাড়াও বছরে একবার দুরান্ত থেকে আসা একদা এই দ্বীপের বাসিন্দারা এলে উনি ওঁনার গুহা থেকে বেড়িয়ে এসে চকচকে পাথরের টুকরো দিয়ে ওদের আশীর্বাদ করে যান।
কিন্তু বছর পাঁচেক আগে যেবার প্রথম একসময়কার দ্বীপবাসীরা আগুনলাঠি নিয়ে এসে জোর করে আগুনগহ্বরে ঢুকে থলে বোঝাই করে চকচকে পাথর নিয়ে গেছিল, সেইবার দ্বীপের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ নৌকাচালককে নিয়ে বড় চামড়ার নৌকোয় চেপে গোটাকতক মুখ আটকানো চামড়ার থলে নিয়ে সমুদ্রে ভেসেছিলেন বৃদ্ধ পুরোহিত। দিনকয়েক পরে ফিরে এসে আবার ওঁনার গুহায় ঢুকে পরেছিলেন। ওঁনার সমুদ্রভ্রমণের সাথীদের কাছ থেকে শুধু এটাই জানা গেছিল যে উনি মাঝসমুদ্রে ওই থলেগুলো সমুদ্রে উপুড় করে কিছু ফেলে দিয়েছিলেন।
সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে এসে অতিবৃদ্ধ পুরোহিত শুধু বলেছিলেন “মহান দেবতা থর ওঁদের আবার আগের জীবনে ফিরিয়ে দেবেন।”
“আজ্ঞা করুন সর্বশক্তিমান থরের পুরোহিত।” বললেন হেরন।
“আমাকে সমুদ্রযাত্রায় যেতে হবে।”
“হে মহান পুরোহিত, আপনার বয়স হয়েছে। সমুদ্রযাত্রার ধকল আপনি সইতে পারবেন? আপনি আমাকে আদেশ করুন…”
“না মহাধিপতি হেরন আমাকেই যেতে হবে। সর্বশক্তিমান থরের ইচ্ছে না হওয়া পর্যন্ত আমার মৃত্যু নেই। আমাকে একটি সিলের চামড়ার নৌকো ‘উমিএট’ ও আটজন মাল্লা দিন। আমার ইচ্ছে ওলাফও আমার যাত্রাসঙ্গী হোক। দেখবেন নৌকোয় যেন দিন কয়েকের খাবার ও পানীয় থাকে।”
বেরেনবার্গ কিন্তু মোটেই মৃত আগ্নেয়গিরি নয়। বরং মাঝে মাঝেই ছোটখাট অগ্ন্যূৎপাত ঘটে। ফুটন্ত লাভা গড়িয়ে আসে বরফের ঢাল বেয়ে। এইরকম দ্বীপে কারও বাস করার কথা নয়। কিন্তু লাভার স্রোতের মাঝেও গুটিকয়েক ইনুইট পরিবার লোকচক্ষুর আড়ালে বেঁচে আছে। শোনা যায় কী করে যেন অতিবৃদ্ধ পুরোহিত আগেই টের পেয়ে যান অগ্ন্যূৎপাতের সম্ভবনা আর সবাইকে ঢুকিয়ে নেন ওনার গুহার ভেতর। এই গুহার অবস্থানটাই নাকি এরকম যে লাভার স্রোত কিছুতেই প্রবেশ করতে পারে না ওই গুহার ভেতর।
এ হেন জান মায়েন দ্বীপের ইনুইটরা আনন্দেই ছিল। গরমকালে পুরুষরা সমুদ্র থেকে তিমি মাছ শিকার করে নিয়ে এলে মহিলারা সেই মাছের মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খানিক যত্ন করে শুকিয়ে তুলে রাখত শীতের জন্য। তিমি মাছের শরীরের প্রায় কোন কিছুই ফেলা যায় না। চর্বি জমিয়ে রাখা হয় শীতকালীন বরফ ঘর ইগলুকে গরম রাখার জন্য। হাড় দিয়ে তৈরি হয় গ্রীষ্মকালীন চামড়ার ঘরের খুঁটি, কুকুরে টানা স্লেজ গাড়ির অংশ। এই দ্বীপে মেরু ভালুক ‘নানুক’ আর ইনুইটদের কুকুর ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর বসবাস নেই। তবে নেরসেক (সিল) আর টুগার (সিন্ধুঘোটক) দ্বীপের তটে খেলা করে। আর আসে ঝাঁকে ঝাঁকে পেঙ্গুইন। শীতকালে অবশ্য কোনটা তট আর কোনটা ডাঙ্গা বোঝা মুস্কিল। বরফে ঢেকে সবই সমান। কিন্তু ইনুইটরা ঠিক ফারাক করতে পারে সমুদ্র আর ডাঙার। সমুদ্রের বরফের মাঝে শীতকালে ইনুইটদের সর্বক্ষণের সঙ্গী কুকুর ঠিক খুঁজে বের করে সিলেদের উপস্থিতি। সিলদের মাঝে মধ্যে বাতাসের প্রয়োজন পরে। তখন ওরা বরফের তলায় ওলটানো বালতির আকারে গর্ত করে। সঙ্গী কুকুর সিলের আস্তানার হদিশ দিলেই ইনুইট শিকারি বরফের ছিদ্রটাকে বড় করে চুপচাপ অপেক্ষা করে সিলের আগমনের। তারপর যেই না সিল তার মুখটা ওই বরফের গর্ত দিয়ে বাইরে বের করে ওমনি শিকারি তার হাতের হারপুন ছুঁড়ে দেয় সিলকে লক্ষ্য করে। তারপর বরফ খুঁড়ে নিহত সিলকে নিয়ে আসে গ্রামে সবার সাথে ভাগ করে নিতে। ইনুইটরা অপ্রয়োজনে শিকার করে না।
কয়েকবছর আগেও দ্বীপের শিকারিরা অনেক সময় ৩০০ মাইল দূরের গ্রিনল্যান্ডে এই দ্বীপের একদা বাসিন্দাদের রাজ্যে পৌঁছে বল্গা হরিণ শিকার করে নিয়ে আসত। কিন্তু একদা এই দ্বীপের বাসিন্দারা আগুনলাঠি নিয়ে এই অগ্নিদ্বীপে পদার্পণের পর জান-মায়েনের ইনুইটরা নিজের দ্বীপ ছেড়ে অন্য দ্বীপে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বীপে স্কার্ভি ঘাসের অভাব নেই। গ্রীষ্মে বরফ গলে সমুদ্রতটের কাছের পাথরের খাঁজে খাঁজে সাদা ফুলের এই গুল্ম অনেক মাথাচারা দেয়। এই গাছগুলোই ইনুইটদের রোগবালাই-এর হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই দ্বীপের বাসিন্দারা কখনও আগুনে ঝলসানো খাবার খায় না। কাঁচা মাংসই এদের প্রধান খাবার। শুধু জলের প্রয়োজনে বরফ গলাতে এরা আগুন ব্যাবহার করে। চকমকি পাথর ঠুকে শুকনো ঘাসে আগুন জ্বালাতে এরা ওস্তাদ। পাথর গরম করে করে ফেলে দেয় বরফ বোঝাই পাথরের পাত্রে। তপ্ত পাথর, বরফ গলিয়ে পানীয় জল ‘মিক’-এর যোগান দেয়।
হেলগে সমুদ্র যাত্রার প্রস্তুতির আদেশ দিয়ে চলে গেছিলেন নিজের আস্তানায়। খানিক পরে বৃদ্ধকে টলতে টলতে কাঁধে ছোট্ট একটি পুঁটুলি নিয়ে ফিরে আসতে দেখা গেল। দূর থেকে বৃদ্ধ পুরোহিতকে টলতে টলতে কাঁধে করে কিছু একটা বয়ে নিয়ে আসতে দেখে ওলাফ দৌড়ে গিয়ে বৃদ্ধের কাঁধ থেকে বস্তুটিকে হাতে নিয়েই চমকে উঠল। তিমির ছোট ছোট হাড় জুড়ে তৈরি গোল বৃত্ত থেকে ঝুলছে শুকনো গুল্ম পাকিয়ে তৈরি সরু সরু কতগুলো গিঁট বাঁধা দড়ি। দড়িগুলো নিচে সবকটা একসাথে জড়ানো। একটা লম্বা কাঠের ডাণ্ডা গোল বৃত্তটির সাথে আড়াআড়ি ভাবে বাঁধা। এই জিনিসটা সে পুরোহিতের গুহায় আগে দেখেছে। এরকম অনেক কিছুই বৃদ্ধের বাসগুহায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকে। একবার হাতেও নিয়ে ছিল। পুরোহিতের কাছ থেকেই শুনেছিল এটাকে দিয়ে নাকি ছোট ছোট মাছ ধরা যায়। পুরোহিতের গুহার ভেতর ছোট ছোট চৌবাচ্চায় অনেক রকম জ্যান্ত মাছ আর রকমারি কাঁকড়া দেখেছে ওলাফ। আশ্চর্যজনক ভাবে গুহার ভেতরটা সবসময় গরম থাকে। এই চৌবাচ্চার জল নাকি কোনদিন জমে না। ওলাফকে পুরোহিত খুব স্নেহ করলেও সে কোনওদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারেনি যে এই মাছ আর কাঁকড়াগুলো পুরোহিত খান কিনা।
এই দ্বীপের ইনুইটরা জাল কী জিনিস জানে না। তাই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অদ্ভুত বস্তটির দিকে।
একটি আটমাল্লার চামড়ার নৌকো ‘উমিএট’ প্রস্তুত হয়ে সমুদ্রের তটে খাদ্য-পানীয় বোঝাই হয়ে শান্ত সমুদ্রের পাথুরে তটে শুয়েছিল। সমুদ্র কিন্তু এইসময় এখানে খুব অশান্ত। ইতিউতি বরফের চাঙ্গড় ভেসে চলেছে সমুদ্রের জলে। এই দ্বীপের তটরেখা জুড়ে সুমুদ্রের বুকে জেগে থাকা অজস্র সূচালো পাথরের টুকরো প্রাচীরের মত আগলে রেখেছে এই আগুনদ্বীপকে। এই পাথরের জন্যই কোন তিমিশিকারি এই দ্বীপের আশপাশে তাদের জাহাজ নিয়ে ঘেঁষে না, ডুবো পাথরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যাবার ভয়ে। কিন্তু ওই তিমি শিকারিদের কেউ কেউ এই দ্বীপের আগুনগহ্বরের চকচকে দামী পাথরের কথা জানে। একবার ছোট নৌকা করে পাথরের আঘাত সামলে ওরা দ্বীপে নেমেওছিল। কিন্তু নামামাত্র মেরুভালুকের দল অতর্কিত আক্রমনে ওদের হত্যা করে। শুধু মাত্র ইনুইটরাই পাথর ও ভাসমান বরফের মারাত্মক আঘাত এড়িয়ে এই দ্বীপে আসা যাওয়ার উপায় জানে।
বৃদ্ধ পুরোহিত হেলগে সোজা এগিয়ে গেলেন উমিএট-এর দিকে। হাতের চামড়ার দস্তানাটা একবার খুলে আবার পরে নিলেন হাতে। লোমশ কানঢাকা টুপিটা ভাল করে টেনে নিলেন ঘাড় পর্যন্ত। তারপর আদেশ দিলেন নৌকো ভাসাতে।
একটা বিশাল ভাসমান বরফের চাঙ্গড়কে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় প্রায় হুড়মুড় করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল একদল পেঙ্গুইন(কিভাবে? উত্তর মেরুতে পেঙ্গুইন?)। নৌকোয় প্রায় ধাক্কা লাগার অবস্থা পেঙ্গুইনের দলের সাথে। কোনওক্রমে সংঘাত সামলে একটা বড় ঢেউয়ের মাথায় চেপে পাথুরে চত্বরটা পার হয়ে খোলা সমুদ্রে পড়তে মুখ খুললেন বৃদ্ধ।
“ওলাফ তুমি জানতে চাইছিলে না, আমাদের মহান পিতা ওডিন কবে হাজির হবেন আমাদের রক্ষা করতে?”
“আমাকে মার্জনা করবেন মহান পুরোহিত, আমরা মানুষের সাথে লড়াই করতে শিখিনি ঠিকই। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে যাদের আমাদের ভাই বলে জেনেছি তাদের মহান থরের ভাণ্ডার লুণ্ঠন করতে দেখে, আর তাদের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। কাউকে আঘাত না করার শিক্ষা ভুলে গেছিলাম মহান পুরোহিত।“
“না ভুল তুমি করনি ওলাফ। ঈশ্বরের অবমাননা করা ইনুইটদের সাজে না। লক্ষ্য করেছ কি, বরফ গলে গেলেও আমাদের জাত ভাইরা এবার এখনও আসেনি? তিমি শিকারের সময় কি এখনও হয়নি?
“আদেশ করুন সর্বশক্তিমান থরের পুরোহিত।”
“আমাকে নিয়ে চল আমাদের ভাইদের কাছে।”
উত্তাল সমুদ্রে ভাসমান বরফের পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে চামড়ার ছোট নৌকো। মাঝে মাঝে নীল জলের মাঝে ভুস করে তিমি মাছ জেগে উঠে পিঠ থেকে ফোয়ারার মত জল ছুঁড়ে দিচ্ছে। চুপ করে নৌকোর মাঝে বসে আছেন পুরোহিত দুদিন ধরে। তিনি জানেন ইনুইটরা দিকভ্রষ্ট হয়ে সমুদ্রে হারিয়ে যাবে না। আকাশের জাজ্জল্যমান সূর্য তার অবস্থান দেখিয়ে পথ দেখাবে। অন্য সময় হলে এই সময় মহানন্দে তিমিমাছের পিছু করত ইনুইট শিকারিরা। কিন্তু সাথে শিকারের সামান্য সরঞ্জাম থাকলেও পুরোহিতকে নিয়ে অন্য জগতে বসবাসকারী ইনুইট ভাইদের কাছে পৌঁছনটাই এখন জরুরী। ছ’জন পালা করে দাঁড় টেনে চলেছে।
ওলাফ খানিক অবাক হয়ে গেছে। অন্যান্য গ্রীষ্মে এই সময় ধোঁয়া ওঠা অনেক দৈত্য নৌকো সমুদ্রে তিমি মাছ ধরে বেড়ায়। কিন্তু এই কদিনে মাত্র তিনটি দৈত্য নৌকো দেখেছে তাঁরা। এই দৈত্য নৌকোর লোকেদের থেকেই আগুন বন্দুক পেয়েছে তার অন্য দ্বীপের জাতভাইরা। এই দৈত্য নৌকোর লোকেদের জন্যই বদলে গেছে ওরা। সে শুনেছে ঐ আগুন পাহাড়ের চকচকে পাথরের বিনিময়ে ওরা আগুনলাঠি, কলে চালান স্লেজ, অন্যরকম ঘর পেয়েছে।
বৃদ্ধ পুরোহিত তাঁর অদ্ভুত মাছ ধরার সরঞ্জামটা দিয়ে মাঝে মাঝেই সমুদ্র থেকে লাল কাঁকড়া ধরছেন। সেগুলো নৌকোয় তুলে নিয়ে এসে খানিক দেখে আবার ছেড়ে দিচ্ছেন সমুদ্রে। ওলাফ লাল কাঁকড়াগুলো দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। এত বড় বড় রাক্ষুসে লাল কাঁকড়া সে আগে দেখেনি।
মাথার ওপর অ্যালবেট্রস আর সি-গালের ঝাঁক বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা প্রায় এসে গেছে জাতভাইদের দেশে। হালকা তটরেখা দেখা দিল। ঢেউয়ের দুলুনিতে আর দীর্ঘ যাত্রায় বৃদ্ধ পুরোহিত নির্জীবের মত বসে ছিলেন নৌকার মাঝে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে একটা মেরুভালুকের চামড়া জড়িয়ে দিয়েছিল ওলাফ আর তার দুই সঙ্গী পুরোহিতের শরীরে।
সমুদ্র এখানে উত্তাল নয়। বরং প্রায় স্থির। যদিও সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে ধবধবে সাদা বরফের চাঙ্গড়। দেখা গেল বেশ কয়েকটা নৌকো এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। নৌকোগুলো কাছে আসতে দেখা গেল একটি নৌকোর এক আরোহীর হাতে আগুনলাঠি। লোকটিকে দেখেই চিনতে পারল ওলাফ। এই সেই লোক যে তাকে এই আগুন লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল। দুটি নৌকো পাশাপাশি হতেই নৌকোর মাঝে চোখ বন্ধ করা বৃদ্ধ পুরোহিতকে দেখে চমকে উঠল লোকটা।
তাড়াতাড়ি আগুনলাঠি নৌকোয় নামিয়ে উঠে আকাশের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল লোকটা। “হে মহান থরের পুরোহিত আমাদের রক্ষা কর।”
ওলাফ এটা আশা করেনি। সে বুঝে উঠতে পারল না কিসের থেকে রক্ষা পেতে চাইছে এরা। এদের হাতে আগুন লাঠি আছে, তাহলে ভয় কী?
তীরে পৌঁছতে দেখা গেল বেশ কিছু ইনুইট দাঁড়িয়ে রয়েছে তটভূমিতে। ধরাধরি করে বৃদ্ধ পুরোহিতকে নৌকো থেকে নামাতেই পোঁ পোঁ করে তীক্ষ্ণ শব্দে এক বিউগল বেজে উঠল। সমুদ্রের তটে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার লাল কাঁকড়া। এর আগে ওলাফ এই দ্বীপে বহুবার এসেছে কিন্তু এই কাঁকড়ার দল দেখেনি।
খানিক সময়ের মধ্যে দলে দলে ইনুইট এসে জড়ো হল পুরোহিতকে ঘিরে। বাচ্চা, বৃদ্ধ, তরুণ, তরুণী। সবাই এসে মাথা তটের পাথুরে জমিতে ঠেকিয়ে বসে পড়ল। এখন বরফমুক্ত সমুদ্রকূল। কুল কুল করে অগনিত ছোট ছোট জলের ধারা বয়ে চলেছে চারপাস দিয়ে।
এক বৃদ্ধ পুরুষ এগিয়ে এসে পুরোহিতের পা জড়িয়ে ধরে বললেন “হে মহান পুরোহিত, রক্ষা কর থরের বংশধরদের।”
ওলাফ চুপ করে সাত সঙ্গীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে পুরোহিতের পাশে। কী ঘটছে বোধগম্য হচ্ছে না তাদের। এরা এত ভীত কেন? দূরে একদল কুকুর তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে। ঠিক চিৎকার নয়, এ যেন কান্নার শব্দ। খাবার না পেলে কুকুরের দল ঠিক এভাবে শব্দ করে। ওলাফ ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্র কিনারায় কোনওরকম তিমি শিকারের চিহ্ন দেখতে পেল না। অথচ এই সময়টাই ইনুইটদের সবচাইতে ব্যাস্ততার সময়। এই সময় তিমি, সিল আর রকমারি মাছ সমুদ্র থেকে শিকার করে এনে রোদে শুকিয়ে রাখার সময় শীতকালের কঠিন সময়ের জন্য। এখানকার লোকজন আনন্দে নেই কেন? এই সময় তো টাটকা মাংস খাবার সময়। বাচ্চাদের হুল্লোড় করার সময়। হচ্ছেটা কী এখানে?
বিগত কয়েক বছর ওলাফরা কেউ আসেনি এই দ্বীপে। আগুনলাঠির আক্রমণ তারা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কিইবা করার ছিল। এই ইনুইটরা শিকার করতে জানে, কিন্তু লড়াই করতে জানে না। শুধু ভরসা ছিল হেরন ও পুরোহিতের স্তোক বাক্যে। কিন্তু এদের দুজনকে আগুনলাঠির আক্রমন ঠেকানোর কোন রকম উদ্যোগ না নিতে দেখে এবার ক্ষেপে গেছিল ওলাফ। তার জাত ভাইদের আসার সময় হয়ে গেছিল যে?
ইশারায় জল চাইলেন পুরোহিত। খানিক আগে পুরোহিতের পা জড়িয়ে ধরা বৃদ্ধের ঈশারায় একটা স্লেজগাড়ি নিয়ে এগিয়ে এলেন চারজন। স্লেজের ওপর পুরোহিতকে বসিয়ে স্লেজটাকে হাতে তুলে এগোতে লাগলো সবাই গ্রামের দিকে। বরফ নেই তাই স্লেজ বিকল এখন।
একটি শিশু চলছিল স্লেজের পাশাপাশি। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ ক্ষুধার্ত সে। পুরোহিত তার মাথা স্পর্শ করল। চোখ দিয়ে জলের ধারা বইছিল পুরোহিতের।
খানিক হাঁটার পর গ্রামে পৌঁছল সবাই। ওলাফ অবাক হয়ে গেল, চামড়ার তাঁবু ঘরের বদলে পাথর আর কাঠের ঘর চারদিকে। আগুনগহ্বরের চকচকে পাথরের বদলে, এই সব থাকার জায়গা আর আগুনলাঠি পাইয়ে দেবার কথা বলেছিল ধোঁয়া ওঠা দৈত্য নৌকোর তিমি শিকারিরা!
গ্রামের কাঠ-পাথরের একটি ঘরে পুরোহিতকে ঢোকাতে যেতেই তিনি বাধা দিলেন। তিনি বললেন তিনি বিজাতীয় ঘরে প্রবেশ করবেন না। তিনি ঘরের বাইরেই একটা উঁচু পাথরের ওপর বসলেন। একজন মহিলা একটি চামড়ার পাত্রে জল নিয়ে এসেছিলেন। পুরোহিত সেই জল-গ্রহণ করলেন না। তিনি ওলাফকে বললেন তাঁদের নৌকো থেকে জল নিয়ে আসতে।
পুরোহিত জল-গ্রহণ অস্বীকার করার সাথে সাথে গোটা গ্রামের মানুষ একসাথে কান্নায় ভেঙে পড়ল। “রক্ষা কর মহান পুরোহিত থরের অভিশাপ থেকে। আমরা সবাই না খেয়ে মারা যাচ্ছি। সমুদ্র আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তিমি সহ কোন মাছই আর নেই সমুদ্রে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সিলের দলও। একটাও সিল নেই সমুদ্র উপকুলে।”
চুপ করে পাথরের ওপর বসে সব শুনছিলেন পুরোহিত। একটি শিশু কেঁদে উঠল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আস্তে আস্তে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন
“মহান থরের বংশধর বলে তোমরা আর নিজেদের পরিচয় দিও না। তোমরা কাঁচা মাংস আর খাও না। এখন তোমরা আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে খাও। তোমরা বরফ আর তাঁবু ঘরে থাক না। তোমরা আর ইনুইট নও। থরের বংশধর বলার অধিকার হারিয়েছ তোমরা।”
“হে অডিনপুত্র থরের পুরোহিত, লোভে পরে অন্যায় করেছে আমাদের ছেলেরা। ঐ ধোঁয়া ওঠা নৌকোর লোকেদের চকচকে পাথর দেখাতেই ওই পাথরের বদলে ওঁরা আমাদের আগুনলাঠি দেয়। তারপর আমাদের শিকারিরা আরও পাথর জোগাড় করে দেবে বলাতে ওঁরা আমাদের কলের গাড়ি, জ্বালানী আর এই ঘরবাড়ি বানিয়ে দেয়।” বলে উঠলেন গ্রামের বৃদ্ধ লোকটি।
“প্রতি বছর তিমি শিকারের আগে তোমরা একটা করে অগ্নিগহ্বরের পাথর আশীর্বাদ স্বরূপ নিয়ে আস আমার কাছ থেকে। শক্তিমান থরের বাসস্থানের সেই পাথর, তোমাদের শিকারিদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করে আর দেয় সমুদ্রের সম্পদ, এটা কী তোমরা ভুলে গেছিলে?”
“আমি আমাদের শিকারিদের বারণ করেছিলাম এই পাথরের কথা বলতে। ওরা শোনেনি। প্রতি বছর ধোঁয়া ওঠা নৌকো নিয়ে তিমি শিকারিরা আমাদের এখানে আসে। আগুনলাঠি দিয়ে সিল শিকার করে ওরা। এক গুলিতে একটা সিলকে মরতে দেখে ওরা আগুনলাঠি পাবার জন্য আমাদের শিকারিরা পবিত্র পাথরের কথা ওদের বলে দেয়। তারপর আমাদের কাছে বছরের পর বছর ধরে জমা হতে থাকা পাথরের বিনিময়ে আমাদের শিকারির ওই আগুনলাঠি পায়।”
“অগ্নিগহ্বরের চকচকে পাথরের কথা বিদেশীদের বলে দিয়ে অন্যায় করেছ তোমরা। শুধু তাই নয় প্রতিবছর তোমরা যে একটি করে অগ্নি-পাথর পাও তার বিনিময়ে বিদেশী তিমি শিকারিদের কাছ থেকে আগুনলাঠি ও কলে চালান গাড়ি তোমরা নিয়েছ। তোমরা আগুনলাঠি নিয়ে থরের বাসস্থানে প্রবেশ করে তার ঐশ্বর্য চকচকে পাথর লুঠ করেছ। এর শাস্তি তোমাদের মহান থর দিয়েছেন। তোমাদের খাবার কেড়ে নিয়েছেন উনি।”
“আমি তোমাদের এই কথাটাই বলতে এসেছি। তোমরা এই তট ছেড়ে চলে যাও অন্য জায়গায়। বিদেশীদের ঘেঁষতে দিও না তোমাদের কাছে। যেদিন তোমরা আবার আবার ইনুইট হয়ে উঠবে, থরের বংশধরদের মত জীবন কাটাতে শিখবে ফিরে এস এখানে। ওলাফ চল, আমার কাজ শেষ। ফিরে যাই মহান থরের দ্বীপে।”
টলমল করে উঠে দাঁড়ালেন দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ধকলে ক্লান্ত বৃদ্ধ। ওলাফের কাঁধে হাত দিয়ে এগোতে লাগলেন সমুদ্র তটের দিকে।
নতমস্তকে এগিয়ে এল ইনুইট গ্রামের প্রধান। হাত নেড়ে পুরোহিত বললেন “আমাদের পিছু এসো না। তাহলে আর ফিরে পাবে না থরের বংশধরের জীবন।”
নৌকোয় ওঠার আগে বৃদ্ধ পুরোহিত ওনার চামড়ার পুরু জামার তলা থেকে শক্ত করে দড়ি দিয়ে আটা একটা ছোট একটা থলের মুখ খুলে ঝাঁকাতে থাকলেন। খুব খুদে খুদে কিছু থলের ভেতর থেকে ঝরে ঝরে পরে,পাথরের খাঁজে খাঁজে ঢুকে গেল। বস্তুটা যে কী বুঝল না ওলাফ। তার মনে পরে গেল, তার জাতভাইদের আগুনলাঠি হাতে তাদের দ্বীপে আক্রমনের কথা। দুজনকে আগুনলাঠি দিয়ে হত্যা করে অগ্নি গহ্বরে প্রবেশ করে চকচকে পাথর লুঠ করে চলে যাবার পর, বৃদ্ধ পুরোহিত এই দ্বীপের তটের কাছে এসে চামড়ার মুখ বন্ধ থলে থেকে সমুদ্রের জলে এরকমই কিছু ফেলে দিয়ে গেছিলেন।
নৌকো ছাড়ার পর ওলাফকে বৃদ্ধ পুরোহিত বললেন, “কয়েক বছর পর ওরা আবার আসল ইনুইট হয়ে উঠবে। মহামান্য থর তাঁর সৈন্য কাঁকড়াদের দিয়ে এই সমুদ্রের সব প্রাণীদের নিঃশেষ করিয়েছেন। এবার ওই কাঁকড়াদের নিঃশেষ হবার পালা। কাঁকড়া নিধনকারী সৈন্যদের ছেড়ে দিয়ে গেলাম দ্বীপে। এই সৈন্য এই বরফ সাম্রাজ্যে কোথাও পাবে না। এরা গরম দেশের কিট। আমার গুহাতেই এদের বরফের দেশের উপযোগী করতে পালন করেছি এতদিন। এরা সমুদ্রের তটে রোদ পোয়াতে আসা কাঁকড়ার বাচ্চাদের শেষ করবে। ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে এই কাঁকড়ার দল। আর এই কাঁকড়ার ঝাঁক শেষ হলেই আবার ফিরে আসবে সমুদ্রের মাছের দল। মাছ খেতে ফিরে আসবে সিলের ঝাঁক। খাবারের অভাব থাকবে না।”
***************************************
Tags: অরিন্দম দেবনাথ, কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস