চোঙদার’স ইনইক্যুয়ালিটি
লেখক: শুভময় মিশ্র
শিল্পী: প্রতিম দাস
বাসটা ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে এগোচ্ছে। স্ট্যান্ড থেকে বেরনো ইস্তক হেল্পার আর কন্ডাক্টর সমানে হাঁকডাক চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ দশ মিনিটে বাসটা দশ হাত এগিয়েছে কিনা সন্দেহ। তবে এসব হল কথার কথা; সময় আর রাস্তার লম্বাই কি অত সহজ অংক মেনে চলে! এই বাসটাই হু হু করে ছুটতে শুরু করলে রাস্তাটাই বেঁকেচুরে গিয়ে সময়ের হিসেব পাল্টে দেবে। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ডঃ চোঙদার, আপাততঃ স্থান–কালের জটিলতা নিয়ে ভাবনার গভীরে ডুব দিলেন। প্ল্যানেটরি স্পেসবাসের সামনের সিটে বসে আকাশ দেখতে দেখতে আকাশপাতাল ভাবার মজাটাই আলাদা!
বাসটায় জনা কয়েক প্যাসেঞ্জার ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে, এখনও খালিই বলা চলে। সান্ধ্যকালীন ব্যস্ত রাস্তার গোলমালের মধ্যেও ডঃ চোঙদার রাস্তার আলোগুলোর কথা ভাবতে লাগলেন। এখন আলোগুলো দূর থেকে ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসছে, তারপর বাসটাকে পেরিয়ে পেছনে চলে যাচ্ছে; সব সাদা রঙের আলো। আসলে বাস আর আলোগুলোর মধ্যে রিলেটিভ ভেলোসিটি আছে। বাসটা ঠিকঠাক গতিতে দৌড়তে শুরু করলে এই আলোগুলোই ছুটে এসে বেগনী বা নীলাভ রঙে বাসের ভেতরটা ঝলমলিয়ে দিয়ে পেছনে মিলিয়ে যাবে কমলা বা গাঢ় লাল হয়ে। বাসের পেছনের কাঁচটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং–এ ঢাকা না থাকলে লাল আলোর ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাওয়া দেখতে বেশ মজা লাগে তাঁর।
উদ্ভট একটা শব্দ শুনে ভীষণ চমকে উঠলেন ডঃ চোঙদার, সঙ্গে সঙ্গে বাসটাও ব্রেক করায় সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সামলে নেওয়ার পরে বুঝতে পারলেন – বলা নেই কওয়া নেই একটা স্কাইঅটো বামদিক থেকে হঠাৎ সামনে এসে পড়ায় হেল্পার সজোরে চাপড় মারে বাসের গায়ে, আর ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে। রাস্তাঘাটে এমনটা ঘটেই থাকে, অল্প গালাগালি আর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপের পরে যে যার পথ ধরে। ডপলার এফেক্ট আর হাবল শিফট নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি; নয়তো এমন চমকে উঠে হুমড়ি খাওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি।
মনে মনে একটু হাসলেন ডঃ চোঙদার – জেগে থাকা, চিন্তায় ডুবে থাকা, হালকা ঝিমুনি আর গভীর ঘুম – বিভিন্ন অবস্থায় অনুভূতিগুলো কেমন পাল্টে যায়! এই যে গাড়ির গায়ে পেটানোর শব্দটা জেগে থাকলে বিচ্ছিরি লাগবে, চিন্তার মধ্যে বিরক্তিকর, হালকা ঘুমের মধ্যে পিলে চমকাবে, গভীর ঘুমের মধ্যে হয়তো শোনাই যাবে না। একটা জটিল কথা মাথায় উঁকি দিল ডঃ চোঙদারের – ‘অবজার্ভার এক্সপেক্টেন্সি এফেক্ট’। কি গোলমেলে বিষয়রে বাবা, নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছে তাবড় পন্ডিতদের। জনমানবহীন জঙ্গলে গাছ ভেঙে পড়লে শব্দ হয়, নাকি শ্রোতার অভাবে শব্দও হয় না; “একাকী গায়কের নহে তো গান” জাতীয় সমস্যা। আকাশমুখো না তাকালে আস্ত চাঁদটাই নাকি হাওয়া হয়ে যেতে পারে! তাহলে চাঁদ দেখতে গিয়ে তোমায় দেখে ফেলাটা রোমান্টিক কল্পনা নয়। আবার পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে পরীক্ষাটাই বানচাল হতে পারে। গাড়ির চাকায় যেমন হাওয়া মাপতে গেলে কিছুটা হাওয়া বের করতেই হয়, তাতে হাওয়ার মাপটা আবার গোলমাল হয়ে যায়। বন্ধ বাক্সের মধ্যে বেড়াল আর বিষাক্ত গ্যাস রেখে দিলে, বাক্স খুলে না দেখা পর্যন্ত বেড়ালটা নাকি বেঁচেও নেই, মারাও যায়নি। অথবা বেঁচেও আছে মারাও গেছে। আবার বাক্স খুলে দেখতে গিয়ে যদি বিষাক্ত গ্যাসটা বেরিয়ে যায় তাহলে বেড়ালটা বেঁচেও যেতে পারে। এই জটিলতা নিয়ে নিলস বোর আর আইনস্টাইন এর তর্কাতর্কি তো ইতিহাস! কত প্রবলেম, প্যারাডক্স, থট এক্সপেরিমেন্ট জন্ম নিল সেই তর্ক থেকে কিন্তু সূতোর জট খুলল না। ‘Solvay Conference’ করেও প্রবলেম ‘সলভ’ হল না।
ডঃ চোঙদারের ভাবনা আর বাস দুটোই এগোচ্ছে, যদিও বাসটা ঢিমে তেতালায় আর ভাবনাগুলো দ্রুত লয়ে। গাড়ির দরজায় হেল্পারটা অবিরাম চিৎকার করে যাচ্ছে – “মঙ্গল… ফোবোস… অমলথিয়া… বেস্পতি… গ্যানিমিড… টাইটান… শনি….. শনি….. শনি…..”। মাঝে মাঝে কন্ডাক্টর ধরতাই দিচ্ছে – “শনি… ডায়ন… লেপ্টাস… প্লুটো….”। গন্তব্যের পথে কোন কোন গ্রহ উপগ্রহ ছুঁয়ে যাবে বাসটা তার হিসেব দিতে দুজনেই গলা ফাটাচ্ছে।
‘ভেনেরা’ স্পেসস্টেশন থেকে ছাড়ার মুখে একজন দৌড়োতে দৌড়োতে এসে জিজ্ঞাসা করল – “হিমালিয়া?” মঙ্গল–বেস্পতি–শনি করতে করতেই হেল্পার মাথা নেড়ে না বলল। কিন্তু কন্ডাক্টর একটাও প্যাসেঞ্জার ছাড়তে রাজি নয়, মুখ বাড়িয়ে বলল – “গ্যানিমিড–এ নেমে অটো ধরে নেবেন।” ভদ্রলোক দোনামনা করে উঠে পড়লেন, বাসটা আবার চলতে শুরু করল।
ডঃ চোঙদার বাসগুলোর অদ্ভুত চালচলন নিয়ে অনেক ভেবেছেন। স্টার্টারের হুইসেল বাজার পরেও স্ট্যান্ড কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন স্ট্যাটিক ইনারসিয়া কাটিয়ে উঠতে পারছে না বা ফ্রিকশানাল ফোর্স জাপ্টে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সেসব সামলে ওঠার পরে স্ট্যান্ড থেকে মুখটা বের করেই আবার ‘সারফেস টেনশন’–এ আটকে যায়। তারপর রাস্তার ধার ঘেঁষে গুটি গুটি এগোতে থাকে আর পাশ দিয়ে অন্য সব গাড়ি হুশহাশ করে চলে যায়, যেন ‘ভিস্কোসিটি’র তত্ব প্রমানের দায়িত্ব নিয়েছে। কখনও কখনও মনে হয় বাসগুলোর চরিত্র অনেকটা ইলেক্ট্রনের মত। ফোটন গিলে গিলে এনার্জি সংগ্রহ করে ইলেক্ট্রন লাফালাফি করে, সবশেষে পরমাণু ছেড়ে ছুট লাগায়; একটা একটা করে প্যাসেঞ্জার তুলে একসময় দৌড় লাগাবে বাসটাও। আবার এনার্জি উগরে দিয়ে ইলেক্ট্রন যেমন নিজের জায়গায় ফিরে আসে, তেমনি বাসটাও সব প্যাসেঞ্জার নামিয়ে স্ট্যান্ডে ফিরে আসবে। ইলেক্ট্রনের লম্ফঝম্প, ছোটাছুটির অংক যেমন সবাই বুঝতে পারে না, প্যাসেঞ্জার তোলার সঙ্গে গাড়ির চলার হিসেবও কেবল ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর জানে। তবে হ্যাঁ, বাইরে থেকে অন্য কোনও কণা দিয়ে ধাক্কা মারলে যেমন ইলেক্ট্রন ছিটকে বেরোয় তেমনি একই দিকের আরেকটা বাস এসে পড়লে এই বাসটাও হুড়মুড়িয়ে দৌড়োবে। আবার জ্যাম হলে বাস ভর্তি প্যাসেঞ্জার নিয়েও ঘেঁষাঘেঁষি করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকবে কনডেন্সড ম্যাটার–এর মধ্যে পার্টিকল–এর মতো। ম্যাক্সওয়েল–বোলজম্যান, ফের্মি–ডিরাক, বোস–আইনস্টাইন, কোন তত্ত্ব যে গাড়ির ক্ষেত্রে খাটবে বলা মুশকিল।
এক অধৈর্য্য প্যাসেঞ্জার বললেন – “এই কন্ডাক্টর, অনেকক্ষণ তো হল! এবার চল।”
উৎসাহ পেয়ে আরেকজনের মন্তব্য – “সাইড কর, নেমে যাই।”
কন্ডাক্টর নির্বিকার, সে জানে নেমে গিয়ে আরেকটা বাস ধরা সহজ নয়; সব জেনেও প্যাসেঞ্জাররা এমন বলে। রুটে নামার পরে সব গাড়ি এভাবেই চলে, স্পেস ভেহিকল অফিস থেকে লাইসেন্স পাওয়ার পর সব ড্রাইভার–কন্ডাক্টর একই ভাবে গাড়ি চালায়। সব মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশেরও এক স্বভাব, তারা এসব দেখেও দেখেনা। এনট্যাঙ্গেলমেন্টের পরাকাষ্ঠা।
যাইহোক, এমনি করেই চাঁদ পেরিয়ে গেল, সিটগুলো ভর্তি হয়েছে। সামনে বড় স্টপেজ বলতে মঙ্গল, ওখানে আজ হাট ছিল। যদিও মঙ্গলা হাটের সেই রমরমা আর নেই, তবু হাটফেরত প্যাসেঞ্জার পেতে বাসটা ওই পর্যন্ত এভাবেই যাবে। আর মঙ্গলের ওখানটায়, হাটবার হোক বা না হোক, ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে। বাস, ঠেলা, দোকান, মানুষ, সব মিলে এমন জট পাকিয়ে থাকে জায়গাটা যে ‘ক্যাওটিক থিওরি’ও ফেল মেরে যাবে। স্পেসট্রাফিকের নিয়মকানুন ওখানে চলে না! গাড়িঘোড়া একেবারে ইঞ্চি মেপে এগোয়।
কন্ডাক্টর টিকিট কাটা শুরু করেছে। একজন ‘রিয়া’র টিকিট চাইতে কন্ডাক্টর জানিয়ে দিল ওখানে পৌঁছনোর আগেই ‘রিয়া’ অনেক দূরে সরে যাবে। বিরক্ত প্যাসেঞ্জাররা মওকা পেয়ে তর্ক জুড়ে দিল। দুচারজন ‘রিয়া’যাত্রীর উপকারে লেগে পড়ল আগ বাড়িয়ে। শনিতে নেমে বাস ধরা যায় বা ‘রিয়া’র কক্ষপথের ক্রসিং–এ নেমে অটো বা শাটল ট্যাক্সিও পাওয়া যায়। বিস্তারিত আলোচনার শেষে ক্রসিং–এ বাস একটু স্লো হলে নেমে যাওয়া সাব্যস্ত হল।
এই এক সমস্যা এসব প্ল্যানেটরি স্পেসবাসে যাতায়াত করার! গ্রহ উপগ্রহের অবস্থান প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যায়, একই রুটের বাসে চড়েও আজ বৃহস্পতি তুঙ্গে তো কাল শনির দশা! অবশ্য প্রতিটা প্যাসেঞ্জার শেড–এ কোন রুটের গাড়ি কখন কোথায় যাবে, তার ডিসপ্লে থাকে। যেহেতু স্টপেজ আর দূরত্বগুলো পাল্টাতে থাকে তাই বিশদ তথ্য সহ লেটেস্ট ফেয়ারচার্ট কন্ডাক্টরের কাছেও থাকার কথা, প্রতি গুমটিতে টাইম লেখানোর সময় তা আপডেট করানোর কথা; সরকারি নির্দেশ সেরকমই। তবু বাসের গুটি গুটি গতির জন্য হিসেবে একচুল এদিক ওদিক হলে বাস নির্দিষ্ট স্টপেজে পৌঁছনোর আগে স্টপেজটাই অনেকখানি দূরে চলে যেতে পারে। তখন অন্য গাড়ি ধরে ‘গেছোদাদা’র পিছু ধাওয়া করা ছাড়া উপায় নেই। এসব কারণে বাসে চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি খুব বেড়েছে আজকাল; আর বেড়েছে স্কাইঅটো, স্পেসটোটোগুলোর রমরমা।
ডঃ চোঙদারের কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে গেল, কলকাতায় পড়তে এসে প্রথম প্রথম খুব ঘাবড়ে যেতেন। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, ট্রাম – কে কোনদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারতেন না। প্রাণ হাতে নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে এল–এস–ই–সি–টি–মিনি–মিডি–সরকারি–প্রাইভেট বাস ধরা এক অসম্ভব ব্যাপার মনে হতো। নো এন্ট্রি আর ওয়ানওয়ের জন্য, একই গন্তব্যে যেতে সকালে আর বিকেলে দুটো আলাদা স্টপেজে নেমে দুটো উল্টো ডিরেকশনে হাঁটতে হতো। দিনে আর রাতে ট্যাক্সির ভাড়ায় হেরফের হতো, তার ওপর ছিল এদিকে যাব না ওদিকে যাব না ইত্যাদির হাজার বায়নাক্কা। সব মিলিয়ে কলকাতার রাস্তাঘাটের স্পেস–টাইম জিওমেট্রি বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল।
একই দিকের আরেকটা স্পেসবাস এসে পড়ায় হঠাৎ শুরু হয়ে গেল দৌড়। দুটো বাসের মধ্যে রেষারেষি অগুনতি দুর্ঘটনা ঘটানোর পরেও চালু আছে। বোধহয় ড্রাইভার–কন্ডাক্টরদের জীবনে উত্তেজনার খোরাক খুব কম, তাই রেষারেষিটা ওদের আনন্দ যোগায়।
যাইহোক, মঙ্গল এসে পড়ল। হাটের ভিড় পাতলা হয়েছে বটে, তবুও প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা কম নয়। ডঃ চোঙদারদের বাসটা দাঁড়াতেই অন্য বাসটা সামনে গিয়ে তেরছা ভাবে দাঁড়িয়ে গেল। দুজন হেল্পার তারস্বরে হাঁকডাক করতে লাগল। একজন বলতে লাগল – খালি গাড়ি, খালি গাড়ি, সিট আছে; আরেকজন চেঁচাতে লাগল – আগে যাবে, সোজা যাবে। খানিক দৌড়োদৌড়ি করে প্যাসেঞ্জাররা দুটো গাড়িতেই উঠে পড়ল যে যার মতো; কারও হাতে পোঁটলা, কারও হাতে বড় মালপত্র ভর্তি ব্যাগ। কয়েক মিনিটের ভেতর জায়গাটা সরগরম করে দুটো বাসই আবার ছুটতে শুরু করল।
টিকিট কাটছে কন্ডাক্টর। মালপত্রের ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি, ওগুলোকে ঠেলেঠুলে সিটের নিচে ঢোকানোর আয়োজন, মন্তব্য, পাল্টা মন্তব্য ইত্যাদি চলতে লাগল বাসের ভেতরে। ডঃ চোঙদার ভাবলেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞান এতো এগিয়ে গেল, পৃথিবীর মানুষ গ্রহান্তরে থাকতে শুরু করল, প্ল্যানেটরি স্পেসবাস চালু হল, তবু মূল ব্যাপারটা যেন একই রয়ে গেছে! কলকাতার রাস্তায় বহু বছর আগে মিনিবাসে যা হতো আজও তা বদলায়নি। সব কিছুই যেন কোনও অদৃশ্য সুতো দিয়ে বাঁধা আছে আর বাইরের পরিবর্তনগুলো সেই সূতো বেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। ‘স্ট্রিং থিওরি’র মতো কিছু একটা চাই এটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য!
সেই ‘হিমালিয়া’র যাত্রী টিকিট কাটার সময় কন্ডাক্টরকে বললেন – “ভাই, ‘গ্যানিমিড’ এলে বলে দেবেন একটু।”
কন্ডাক্টর আশ্বস্ত করল – “বসুন, দেরি আছে।”
আরেকজন জিজ্ঞাসা করল – “সোজা সোজা করে চেল্লাচ্ছ, ‘ডায়ন’ যাবে তো?”
কন্ডাক্টর বলল – “হ্যাঁ, শনির পরে ‘ডায়ন’, ‘টাইটান’ হয়ে নতুন ব্রিজ ধরে নেব।”
-“গিয়ে নামবে কোথায়?”
-“সোজা ‘চারণ’–এ, তারপর ‘নিক্স’, ‘কার্বেরস’ হয়ে ‘প্লুটো’।”
বিরক্ত প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে একজন সুযোগ পেয়ে রাগ উগরে দিলেন – “এরা শুরুতে হামাগুড়ি দেবে, তারপর ছুটতে শুরু করবে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। শেষে রাস্তা বদল করে শর্টকাট মারবে!”
কন্ডাক্টর বলল – “কি করব বড়দা! এই শেষ ট্রিপটায় প্যাসেঞ্জার না থাকলে ব্রীজ দিয়ে একটু শর্টে মেরে দিই। ইউরেনাস, নেপচুনের দিকে আর ঢুকিনা, গাড়ি গ্যারেজ করতে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে যায়।”
-“তা বলে ইচ্ছে মত রুট বদল করবে; মামাবাড়ি নাকি?”
“ওদের বেশি বলে লাভ নেই দাদা, মাথার ওপর ইউনিয়ন আর হাতে ধর্মঘট আছে” – কেউ পাশ থেকে মন্তব্য করল।
কন্ডাক্টর উত্তর দিল – “ওগুলো সব সাহেব পাড়া, আমাদের প্যাসেঞ্জার নেই। খরচ পোষায় না।”
আপত্তি যিনি জানিয়েছিলেন তিনি আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে গজগজ করতে লাগলেন।
ডঃ চোঙদার বুঝলেন নতুন ব্রিজ মানে এরা ‘ই–আর’ ব্রীজের কথা বলছে। অনেকদিন আগে তৈরি হলেও নতুন ব্রিজ নামটাই চালু রয়ে গেছে। অনেকে আবার বলে ইয়ার ব্রিজ; আইনস্টাইন আর রোজেনবার্গকে নামের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে একদম ইয়ারদোস্ত বানিয়ে ফেলেছে। প্যাসেঞ্জার গাড়িগুলো সাধারণতঃ ওদিক দিয়ে যায়না; ব্রিজের ওপরে স্টপেজ নেই। তবে ব্যস্ত সময়ে প্রাইভেট স্পেসকারের খুব ভিড় হয় বলে শুনেছেন তিনি। প্লুটোর ওদিকে আজকাল অনেক বসতি বেড়ে গেছে, জায়গার দাম, ঘরভাড়া দুটোই নাকি খুব বেশি; দিনকে দিন ভিড় বাড়ছে। ওদিকের লোকেরা নাকি বাড়ির আগে গাড়ি কেনে, যাতে টুক করে ই–আর ব্রিজ ধরে এদিকে, সেন্ট্রাল সোলারসিস্টেম–এর দিকে চলে আসা যায়। সবই অবশ্য শোনা কথা বা কাগজে পড়া, ডঃ চোঙদার ওদিকে বহু বছর যাননি।
ই–আর ব্রিজটা খুব ভালো ভাবে বানানো হয়েছিল, ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল ওটা। আসলে একটা ‘ট্রাভার্সিং ওয়ার্মহোল’ ওটা; ‘কাশিমির এফেক্ট’ কাজে লাগিয়ে ‘এক্সোটিক ম্যাটার’ আর ‘নেগেটিভ এনার্জি ডেনসিটি’ দিয়ে তৈরি বেশ টেকসই ডিজাইন, হঠাৎ ভেঙে পড়ার ভয় নেই। দু দিক দিয়েই যাওয়া আসা করা যায়।
কন্ডাক্টর সামনে এসে দাঁড়াল। টাকা দিয়ে টিকিট আর খুচরো ফেরত নিতে নিতে ডঃ চোঙদার জিজ্ঞাসা করলেন – “ভাই, পুরানো ব্রিজটা আছে এখনও?” কন্ডাক্টর জানাল – “আছে, তবে অবস্থা খুব খারাপ। যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে, কোনও রকমে ঠেকা দিয়ে চলছে।”
তৈরি হওয়ার দিন থেকেই পুরানো ব্রিজটার ওইরকম নড়বড়ে অবস্থা। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছে অনেক, মেরামতির কাজ লেগেই থাকে। ওটাতে কোনোদিনই দুদিক থেকে যাওয়া আসা করা যায় না, সম্ভবই নয়; ডিজাইনটাই শক্তপোক্ত ব্রিজ বানানোর উপযুক্ত নয়! তবে আর কিছু না থাকলেও, একটা খটোমটো নাম আছে ওটার – ‘সার্জচাইল্ড ওয়ার্মহোল’।
আজকাল চারিদিকে পরিকাঠামো উন্নয়নের অঙ্গ হিসেবে রাস্তা আর ব্রিজ তৈরী হচ্ছে খুব। আগেকার দিনে একটা ব্রিজ তৈরি মানে হৈ হৈ ব্যাপার ছিল। ভিড় করে লোকে লোহা বাঁধা, পিলার গাঁথা, ঢালাই দেখতে আসত। আশেপাশের এলাকায় ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে পড়ত প্রায়শঃই, নরবলি দিলে নাকি ব্রিজ শক্তপোক্ত হয়। আজকাল আর ওসব হয় না; দাঁড়িয়ে থেকে মসলা মাখানো দেখার মত সময় কোথায় মানুষের! ছোট আকারের ব্রিজ তো রেডিমেড ‘কোয়ান্টাম ফোম’ দিয়েই তৈরি হয়ে যায়; অল্প সময়ে, কম খরচে কাজ শেষ। ‘কসমিক স্ট্রিং’ দিয়ে বেশ শক্তপোক্ত মাঝারি আকারের ব্রিজও বানিয়ে ফেলা যায়। আজকাল তো ‘স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক’ ‘ড্রেইনহোল’ও তৈরী হচ্ছে, যা দিয়ে বড় বড় গাড়ি ভারী ভারী মালপত্র নিয়ে সহজে স্পেস ট্রাভেল করতে পারে। ওসব এখন জলভাত; অথচ কয়েক দশক আগে নালার ওপর একটা সাঁকো একটা এলাকার জীবনধারাটাই বদলে দিত।
*****
কলেজে নরেন চোঙদার আর গোপেন সমাদ্দার হরিহর আত্মা ছিলেন। তারপর একজন কলেজে চাকরি নিয়ে কলকাতা থেকে বহু দূরে ঘাঁটি গাড়লেন, আরেকজন কলকাতার ফুলবাগানে নিজের বাড়িতে থেকে সরকারি অফিস সামলালেন; মুখোমুখি মোলাকাৎ আর হয়নি বললেই চলে। এবারে যাদবপুরে একটা সেমিনারের জন্য ডঃ চোঙদার কলকাতা আসায় দুই বন্ধুতে সন্ধ্যেবেলা চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার প্ল্যান বানিয়ে ফেললেন।
সেইমতো সেমিনার শেষ করে সন্ধ্যের মুখে ডঃ নরেন চোঙদার যাদবপুরের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে একভাঁড় চা নিয়ে আয়েস করে চুমুক দিলেন। হঠাৎ 45 সংখ্যাটা মাথায় কেন খেলে গেল কে জানে! এক অংকের সব সংখ্যাগুলোর যোগফল হল 45। তাছাড়া ওটা একটা কাপ্রেকার সংখ্যা, হেক্সাগোনাল চরিত্র আছে সংখ্যাটার। চা খেয়ে বেশ চাঙ্গা বোধ করায় বাজে ভাবনা সরিয়ে রেখে সামনের মিনিবাসটায় উঠে পড়লেন; বাসের গায়ে ফুলবাগান লেখা। মিনিবাসটা কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দিল। সারাদিন গুরুগম্ভীর আলোচনার পরে সন্ধ্যের ফুরফুরে হাওয়াটা বেশ লাগছিল তাঁর। সামনের সিটে বসে পাল্টে যাওয়া কলকাতা দেখতে ভালোই লাগছিল ডঃ চোঙদারের; গল্ফগ্রীনের মোড়টা আর চেনা যায়না, নবীনাও পাল্টে গেছে।
হঠাৎ একটা নাড়া খেলেন ডঃ চোঙদার; হাঁটু ধরে ঝাঁকুনিটা দিয়েছে কন্ডাক্টর, বলছে– “ফুলবাগান নামবেন তো? সামনে আসছে।”
চোখ কচলে দেখলেন নারকেলডাঙা রেলব্রিজ পেরোচ্ছে বাসটা; প্ল্যানেটরি স্পেসবাস নয়, কলকাতার আদি অকৃত্রিম মিনিবাস। এতক্ষন যা ভেবেছেন তার সঙ্গে প্যাচপ্যাচে কাদা, জঞ্জালের স্তুপ, ঠেলা, অটো, ফুটপাথের দোকান, কিছুরই মিল নেই। ঘড়ি বলছে ন’টা বাজতে যায়। এতক্ষন লেগে গেল যাদবপুর থেকে আসতে! কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করেও ভাবনা আর বাস্তব মেলাতে পারলেন না। আসলে এই ইনইক্যুয়ালিটিটার সমাধান নেই, সব ইমাজিনারী কমপ্লেক্স ফাংশান। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। পাশে বসা একজন প্যাসেঞ্জার বলল – “খুব ঘুমোলেন দাদা।”
ফুলবাগান মোড়ে বাসটা থামতেই নেমে পড়লেন ডঃ চোঙদার; সামনেই দেখলেন গোপেনবাবু উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুকে; গোপেনবাবু অবাক হয়ে বললেন – “এই বাসটা থেকে নামলি নাকি? ফোনটা কোথায়?”
ডঃ চোঙদারের মনে পড়ল ফোনটা সকাল থেকেই বন্ধ আছে, সেমিনার শেষে আর চালু করা হয়নি। আরও মনে পড়ল চা খাওয়ার সময় ৪৫ এর সঙ্গে সল্টলেক আর এয়ারপোর্ট শব্দ দুটোও মাথায় এসেছিল। এখন বুঝতে পারলেন সবগুলোই যাদবপুর থেকে ফুলবাগান যাওয়ার সোজা রুটের বাস; গোপেনবাবু পইপই করে ওই বাসগুলোর কথাই বলেছিলেন। যাদবপুর–পূর্বাচল রুটের মিনিবাসটা ঘন্টা দুয়েক ধরে নিউ আলিপুর–খিদিরপুর–বাবুঘাট–ডালহৌসি–শিয়ালদা, প্রায় অর্ধেক কলকাতা ঘুরে কয়েক মিনিট আগে ফুলবাগানের মোড়ে তাঁকে নামিয়েছে।
গোপনবাবু বললেন – “বারবার করে সব বলে দিলাম, ভুলে মেরে দিয়েছিস তো!”
লজ্জা পেলেও শুকনো হেসে উত্তর দিলেন ডঃ চোঙদার – “কি করব বল, আমার মাথায় ‘মেমরিস্টর’টা এখনও লাগানো হয় নি।”
মেট্রোর খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ফুলবাগানের মোড়টা একটা জটিল জ্যামিতিক আকার নিয়েছে। গোপেনবাবু বন্ধুর হাতটা পাকড়ে রাস্তা পেরোতে শুরু করলেন। প্রায় তিরিশ বছর আগে এভাবেই মফঃস্বল থেকে আসা বন্ধুকে কলকাতার রাস্তাঘাটের হালহকিকৎ বুঝিয়েছিলেন তিনি। ডঃ চোঙদার একটু চা খেয়ে নেওয়ার কথা তুলতেই গোপেনবাবু ধমকে বললেন – “চল, বাড়ি গিয়ে তোকে ঘি দিয়ে ব্রাহ্মীর রস খাওয়াব।”
শুনতেই হবে, বিজ্ঞানের ভারী ভারী তত্ত্ব ভাবতে গিয়ে ডঃ চোঙদার বরাবরই সহজ জিনিসগুলো ভুলে যান যে! একদিকে গভীর ভাবনা আর একদিকে বাস্তব, এই দুয়ের মাঝে সমান চিহ্নটা বসানো সহজ নয় মোটেই
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, চোঙদার’স ইনইক্যুয়ালিটি, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রতিম দাস, শুভময় মিশ্র
অসম্ভব রকম ভাল লাগল। 🙂 আর যাদবপুর–পূর্বাচল রুটের মিনিবাস সত্যিই পুরো কলকাতা ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ। 😀
ধন্যবাদ
কল্পবিশ্ব পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা প্রকাশ করার জন্য সম্পাদক মন্ডলীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো ছবি আঁকার জন্য শ্রী প্রতিম দাস কেও ধন্যবাদ জানাই।
Chomotkar golpo