টাইম মেশিন
লেখক: সুবীর মণ্ডল
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
হাসছে তারা। কেউ কেউ খুশিতে গলা ছেড়ে নানান রকম অঙ্গভঙ্গি করতে করতে গান করছে। কেউ হাত পা ছাড়িয়ে নাচছে। সবার মুখ খশিতে ঝলমল করছে। আর করবে নাই বা কেন? যে ইতিহাস তারা শুধুমাত্র ডিজি-বুকে পড়ে, আজ তারা সেখান থেকে ঘুরে এসেছে। আজ তারা অতীত ভ্রমণ করেছে। নিঃসন্দেহে ৩৫৫৬ সালের সব থেকে বড় আবিষ্কার এই টাইম মেশিনের আবিষ্কার। তবে সেইসঙ্গে সময় ভ্রমনের জন্য বেশ কিছু নিয়ম লাগু করা হয়েছে এবং এই নিয়ম রক্ষা করার জন্য টাইম সিকিওরিটি ফোর্স রাখা হয়েছে। সাধারন মানুষ খুব ভাল ভাবেই সেটা ব্যবহার করছে।
অনন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেখছিল। ওর মনে পড়ল ও যখন ছোট ছিল ও নিজের বাবা মায়ের হাত ধরে এই রকম ভাবে এসেছিল টাইম ট্রাভেল করতে। কিন্তু কিভাবে যে কি হয়ে গেল! ওর বাবা ওর জন্য স্ন্যক্স কিনতে গিয়েছিল আর ফেরার সময় একটা এয়ার বাস নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ওর বাবার উপর এসে পড়ে। তারপর……। একটা যান্ত্রিক শব্দে ওর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়। অনন্ত পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে নিল। কিছুদিন আগে অনন্ত সীতানাথের গ্যারেজে একটা টাইম মেশিনের ডেমো মডেল দেখেছিল আর ওটা কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, হয়তো সেখান থেকেই ফোন এসেছে।
*****
“তাহলে পঞ্চাশ হাজারই নেবেন!”
যাকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলা সেই ঝানু ব্যবসায়ী সীতানাথ সামন্ত একটা কাঠের টেবিলের উপর হাতে একটা বিংশ শতাব্দীর অগ্নি ইউজ এন্ড থ্রো কলম নিয়ে একটা কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছিলেন। প্রযুক্তি এখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে ডিজিটালাইজেসন হওয়ার পর তো মানুষ কাগজ কলমের ব্যবহারই ভুলে গেছে। কিন্তু সীতানাথ সামন্তর মত কিছু মানুষজন এখনো আছেন। যারা এই সব পুরানো ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে বেঁচে থাকতে ভালবাসেন। টেবিল থেকে মাথা তুলে তিনি অনন্তর দিকে তাকালেন। কলমটা কানে গুঁজে বললেন, “আপনি কি ওটা কিনতে খুব আগ্রহী?”
অনন্ত মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ছোট করে জবাব দিল, “হুম”।
“তাহলে দাম নিয়ে এত কচকচ করছেন কেন? এতই যখন আগ্রহ পঞ্চাশ হাজার দিয়ে নিয়ে যান।” সীতানাথ কলম নিয়ে আবার তার কাজে মন দিলেন।
কোন কাজ হবে না ভেবে অনন্ত ব্যাগ থেকে একতাড়া নোটের বান্ডিল সীতানাথের দিকে বাড়িয়ে দিল।
সীতানাথ টাকাগুলোর দিকে একবার তাকালেন। তারপর তার মুখে হাসি খেলে গেল। টাকা গুনতে গুনতেই তিনি বললেন, “মশাই আপনি তো একেবারে খুশ করে দিলেন। এখন তো দশহাজার বললেই সবাই একটা নোট বাড়িয়ে দেয়। সেটাতে হাত বুলিয়েই রেখে দিতে হয়। এইভাবে খুচরো টাকা গুনে যে কত সুখ, সে একমাত্র যারা গুনেছে তারাই জানে। তারপর ভিতরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “আরে স্বপন। স্যারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে মালটা ডেলিভারি দিয়ে আয়।” তারপর একটা একশ টাকার নোট অনন্তর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, “ধরুন। আপনার জন্য একশ টাকা কম নিলাম।”
অনন্ত একশ টাকার নোটের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর বলল, “থাক ও নোট আপনি রাখুন। তারপর স্বপনকে নিজের গ্যারেজের ঠিকানা দিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এল।
*****
কি বলছিস! তুই টাইম মেশিন তৈরি করবি! সে তো অনেক খরচের ব্যাপার। তুই ভাল মতই জানিস তোর বাবার চিকিৎসার পিছনে খরচ করে আমাদের কাছে আর বিশেষ কিছু টাকা পয়সা নেই। আবার হাসপাতাল থেকেও তোর বাবাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন তোর বাবার চিকিৎসা কিভাবে করাবি সেটাই ভাব। আমাদের এই রকম অবস্থায় তুই টাকা পয়সা নিয়ে বাজে খরচ করিস না। তার থেকে তুই বরং টাকাটা তোর গ্যারেজের পিছনে খরচ কর।”
অনন্তর খাওয়া হয়ে এসেছিল। সে চুপচাপ জলের ঘটি নিয়ে উঠে গেল। বাইরে থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে সে বলল,”ডাক্তার বক্সী জবাব দিয়ে দিয়েছেন। বাবার কাছে আর বেশিদিন নেই। অ্যাক্সিডেন্টের পর বাবার মনের উপর যে প্রভাব পড়েছে তার কারণে ওনার বাঁচার ইচ্ছাটাই চলে গেছে। এখন যদি সময় ভ্রমণ করিয়ে ওনার পুরোন দিনের স্মৃতিগুলিকে আবার নতুন করে মনে করানো যায় তাহলে কিছু কাজ হতে পারে।”
তারপর একটু থেমে বলল, “আমি শুধু বাবাকে ফিরিয়ে আনতে চাই মা। আমি চাই কিছুক্ষনের জন্য হলেও বাবা ওনার ফেলে আসা অতীতের আনাচে কানাচে আনন্দ নিয়েই কাটাক। আর আমি বাবার জন্য এটা করব।”
মা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, “কত খরচ হবে?”
অনন্ত বলল, “সেসব নিয়ে তুমি ভেবো না, ও ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে।”
“যা ভাল বুঝিস কর”, মা এঁটো বাসনগুলো নিয়ে চলে গেল।
*****
আজ অনেকদিন পর অনন্ত নিজের গ্যারেজে এসেছে। গ্যারেজের অবস্থা ঠিকই আছে। খালি দুচার জায়গায় মাকড়শা জাল বুনেছে।অনেকদিন ব্যাবহার না করার ফল আর কি। অনন্ত এবারে প্যাকেট খুলে সীতানাথের কাছ থেকে আনা টাইম মেশিন মডেলটা বাইরে বার করল। কোন নতুম প্রডাক্ট বা মেশিন বাজারে আসার আগে তার একটা ডামি মডেল তৈরি করা হয়। এটা তেমনই একটা ডামি মডেল। পিয়োর স্টিলে তৈরি একটা ডামি মডেল। এটা শুধুমাত্র একটা পুরানো টাইম মেশিনের কাঠামো এর ভিতরে কোন ইঞ্জিন নেই। অনন্ত মডেলের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে উঠল,”এবার শুরু হবে এটাকে ডামি থেকে আসল বানানোর কাজ।
অনন্ত তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই ব্যাপারে ওর দু’বছরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ক্রাশ কোর্স খুব কাজে এসেছে। মডেলের নিচের ফাঁকা অংশে ও দুটো পুরানো গাড়ীর ইঞ্জিন ফিট করে দিয়েছে। আর পুরোনো লোহার চাদর দিয়ে সেগুলোকে ঢেকে দিয়েছে। মেশিনের ভিতরে অনন্ত পুরানো গাড়ির গদিওয়ালা সিট ফিট করে দিয়েছে। সেটাকে এমন ভাবে বসিয়েছে ইচ্ছা করলে শোয়াও যাবে। ইঞ্জিন দুটো চালু করলে মেশিনের ভিতরে একটা হালকা কম্পন অনুভুত হয়। বেশ কিছুক্ষণ এর মধ্যে থাকলে একটা ঘুম ঘুম ভাব আসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ক্লান্তি অনুভব করলে অনন্ত ইঞ্জিন চালু করে ওটার ভিতরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েও নেয়।
গ্যারেজের একদিকে পরিষ্কার করে অনন্ত একটা থিয়োডলি পর্দা* লাগিয়ে দিয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন একটা বিশাল চৌকনা বুদবুদ ভেসে বেড়াচ্ছে।
*****
চোখ বন্ধ করে সিটের উপর বসে আছে অনন্ত। মাথায় একটা হেলমেট যার কাঁচে লাল নিল বিচিত্র সব আলো খেলে বেড়াচ্ছে। তার একটা হাতে সামনের একটা লিভার ধরা আছে। অনন্ত চোখ বন্ধ করে সেই লিভারটা নিয়ে একটা টান দিল। গোঁ গোঁ আওয়াজ করে টাইম মেশিন চালু হয়ে গেল। অনন্তর মনে হল তার চারপাশের দেয়াল গুলো সব সচল হয়ে ছুটতে শুরু করেছে। ঝড়ের তীব্র হাওয়া অনুভব করছিল সে। ঠান্ডা হাওয়ার পরশে তার খুব শীত করতে লাগল। অনন্ত চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন পর ইঞ্জিনটা থেমে গেল। ঠান্ডা হাওয়ার ঝড়ও থেমে গেছে। চারপাশটা আবার আগের মত হয়ে গেছে। অনন্ত চোখ খুলল। তার সামনের দিকে দেয়ালটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। অনন্ত সিট ছেড়ে উঠল আর ধীরে ধীরে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে ওর জন্য নতুন কিছু অপেক্ষা করছিল।
টাইম মেশিন থেকে বেরিয়ে অনন্ত দেখল সাদা রঙের একটা ছোট একতলা বাড়ী। বারান্দায় বসে একটা ছেলে হাতের ডিজিটাল স্লেটে অঙ্ক কষছে। পাশে একটা চেয়ারে ছেলেটার বাবা হাতে একটা থালা নিয়ে ছেলেটার পাশে বসে আছে। আর মাঝে মাঝে থালা থেকে খাবার নিয়ে ছেলেটার গালে দিচ্ছে। পাশের রান্না ঘরে ছেলেটার মা রান্না করছে। অনন্ত আস্তে আস্তে সেই দিকে পা বাড়াল।
*****
ডাঃ বক্সি চুপচাপ অনন্তর কথা গুলো শুনছিলেন। অনন্ত চুপ করলে তিনি বললেন,”এভাবে যদি কাজ না হয়! তখন কি করবে? তোমার সমস্ত চেষ্টা যদি বেকার হয়ে যায়।”
“আমার কাছে তো আর কোন উপায় নেই ডাক্তার বাবু। আর তাছাড়া আপনিও ভাল মতই জানেন আমি এছাড়া আর অন্য কিছু করতেও পারবো না।”
“কিন্তু এইভাবে হাসপাতালের সুপার কম্পিউটার সিস্টেম থেকে তোমার বাবার ব্রেন স্ক্যান রিপোর্ট কপি করলে যদি পরে কোনপ্রকার অসুবিধা হয়। তাহলে!”
“কিন্তু আমাদের তো একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত।”
“কিন্তু এই ব্রেন স্ক্যান রিপোর্টকে তুমি ভিডিওতে কনভার্ট করবে কি করে? শুধুমাত্র সুরক্ষা দপ্তরের কর্মচারীরা এটা করতে পারে। আমাদের কাছে তো এরকম কোন প্রযুক্তি নেই।”
“আপনার সুবিমলকে মনে আছে?”
“দিনেশ বাবুর ছেলে সুবিমল! মনে থাকবে না কেন। এখন কি করছে সে।”
“ও এখনো পড়াশোনা নিয়ে আছে। তবে পড়াশোনার পাশাপাশি নানারকম বিষয় নিয়ে চর্চা করা ওর নেশা। ও এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে।”
“ঠিক আছে আমি নিজের ডাটা ইউস করে তোমার বাবার ব্রেন স্ক্যান রিপোর্টের একটা কপি বার করে দেব।”
*****
অনন্ত আজ ওর বাবাকে গ্যারেজে নিয়ে এসেছে। ও বাবাকে টাইম মেশিনের সিটে বসিয়ে মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিল। তারপর বলল, “এবার তুমি একটু পুরানো দিনের কথা ভাব।
আর লিভারটা টেনে ও বাইরে চলে এল। বিরাট মেশিনটা গোঁ গোঁ করতে করতে একটু পর থেমে গেল। অনন্ত দেখল মেশিনের যেদিকে থিয়ডলি পর্দা লাগান আছে সেদিকের দরজা খুলে বাবা ওই চৌকনা জায়গায় প্রবেশ করল। আর পর্দার গায়ে শুরু হল লাল নীল বিভিন্ন রঙের খেলা। থিয়োডলি পর্দা স্বচ্ছ হওয়ায় বাইরে থেকে সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অনন্ত জানে তার বাবা তাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাবা চতুর্মাত্রিক ইলিউশানে দেখছে নিজের ফেলে আসা দিনগুলো। দেখতে পাচ্ছে নিজের হারিয়ে যাওয়া অতীত।
অনন্ত কোন টাইম মেশিন তৈরি করেনি। ও তৈরি করেছে একটা চতুর্মাত্রিক সিনেমা হল। কিন্তু ওর তৈরি সিনেমা হলে কোন সিনেমা চলছে না। সেখানে চলছে তার বাবার ব্রেন স্ক্যান রিপোর্ট থেকে তৈরি অতীত দিনের স্মৃতির ভিডিও। হ্যাঁ সুবিমল পেরেছে ওই ব্রেন রিপোর্টকে ডিকোড করে ভিডিওতে রুপান্তরিত করতে।
বাইরে ডাঃ বক্সি, সুবিমল দাঁড়িয়ে দেখছে। অনন্তর তৈরি অভিনব টাইম মেশিন। আর দেখছে এক বাবার জন্য তার ছেলের পাগলামি।
থিয়োডলি পর্দার লাল নিল আলো গুলো নিভে গেছে। পর্দাটা আবার আগের মত হয়ে গেছে। অনন্ত বাবাকে দেখল। বাবার চোখে এক অদ্ভুত আলো খেলা করছে। অনন্ত জানে সে টাইম মেশিনের নামে তার বাবাকে ঠকাচ্ছে। কিন্তু এছাড়া তো ওর আর কোনো উপায় ছিল না। অনন্তর এই অপরাধ টুকু ওর বাবা নিশ্চিত ক্ষমা করে দেবেন।
*থিয়োডলি পর্দা– চতুর্মাত্রিক ছবি দেখার জন্য বিশেষ এক ধরনের পর্দা। যেখানে দেখার সাথে সাথে সেই পরিবেশ অনুভব করা যাবে। (কাল্পনিক)
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, টাইম মেশিন, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস, সুবীর মণ্ডল