ডক্টর বিন্দু ও ফসিল রহস্য
লেখক: কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক ডক্টর অর্কদেব বিন্দুর কথা তো সবাই জানেন । লম্বা, ছিপছিপে, সৌম্য মানুষটি, একমাথা চুলে রূপোর ঝিলিক, নিখুঁত শেভ করা মুখ আর সোনালী ফ্রেমের চশমার আড়ালে দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ । তাঁর এই চেহারা এখন মিডিয়ার দৌলতে বিশ্বের অনেকের কাছেই পরিচিত । এমনকি পরিচিত তাঁর অসামান্য কিছু আবিষ্কারের কথাও, যা শুধু ভারত বা এশিয়া নয়, এই সীমায়িত গণ্ডী ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁকে খ্যাতিমান করে তুলেছে ।
বিগত প্রায় তিন বছর যাবৎ তিনি যে নিরুদ্দেশ ছিলেন, এবং সেই নিরুদ্দিষ্ট অবস্থা থেকে হঠাৎ একদিন আবির্ভূত হলেন, আর তাঁর নতুন এক রক্তকণিকা আবিষ্কার নিয়ে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় ফেলে দিলেন, এ কথাও সকলের জানা । আর সেই সুবাদে তাঁর ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট স্বাগত রায়ের তৈরি ব্লগের কথাও এখন সারা বিশ্বে প্রচারিত । কারণ তারপর থেকে সেই ব্লগের মাধ্যমেই গোটা পৃথিবী নজর রাখতে শুরু করেছে ডঃ বিন্দুর সাম্প্রতিক কাজকর্মের ওপর ।
আমি একটা গোপন সরকারী অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত ছিলাম গত কয়েক মাস । ফলে নিজের জন্য আলাদা করে কোন সময় বার করতে পারিনি । আর তাই এই ক’মাসে যা সব কাণ্ড ঘটেছে, তার বিন্দুমাত্র খবর রাখাও সম্ভব হয়নি ।
সবে গতকাল সে কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরেছি । আজ তাই একটু ধাতস্থ হয়ে বসলাম সব খবরাখবর নিতে । নেট সার্ফ করতে করতেই ডঃ বিন্দুর কথা মনে পড়লো আর তৎক্ষণাৎ খুলে বসলাম স্বাগত রায়ের ব্লগটা, যার পোশাকি নাম ‘স্বাগতভাষণ’ ।
সেই অকূল অনন্ত সমুদ্রের ছবি । যথারীতি বাঁদিকে সেই ডঃ বিন্দুর পরিচিতি, তাঁর আবিষ্কারের তালিকা, তাঁর প্রকাশিত পেপারগুলি, আর সবশেষে — রোজনামচা !! জানি, একমাত্র ওখানেই পাওয়া যায় ডঃ বিন্দুর নিত্যনতুন আপডেট । তাই ওখানেই ক্লিক করি, আর পেজটা খুলে যেতেই চমকে উঠি ।
স্বাগত রায়ের শেষ আপডেট যা বলছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আমার এই কয়েক মাসের অনুপস্থিতিতে আমার অজান্তেই ঘটে গেছে এক অভাবনীয় ঘটনা, এক অপ্রত্যাশিত কাহিনী !
তাই আর দেরী না করে চলে যাই একেবারে মার্চ মাসের গোঁড়ায় । সেই সময় থেকেই আমার এ ব্লগ আর খোলা হয়নি, তাই সেখান থেকেই শুরু করি পড়তে ।
# # # #
স্বাগতভাষণ.ব্লগস্পট.ইন
১০ই মার্চ, শনিবার
গত দুদিন যাবৎ বাড়ি ফেরা হয়নি । স্যারের বাড়িতেই আছি আর দিনে প্রায় কুড়ি ঘণ্টা করে কাজ করে চলেছি । কারণ প্রথমত, স্যারের নতুন আবিষ্কার এখন প্রায় সাফল্যের মুখে । তার চূড়ান্ত রূপ দেখার জন্য আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি ।
দ্বিতীয়ত, আগামী ৩০শে মার্চ রাজস্থানের ভরতপুরে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন । ওখানেই স্যর তাঁর নতুন আবিষ্কারটি ডেমনস্ট্রেট করবেন । কাজেই আমাদের এখন নাওয়া নেই, খাওয়া নেই । প্রজেক্ট সম্পূর্ণ সাফল্য না পাওয়া পর্যন্ত আমরা মনে মনে সুস্থির হতে পারছি না ।
১৩ই মার্চ, মঙ্গলবার
প্রত্যাশাপূরণ । ডঃ অর্কদেব বিন্দুর নতুন আবিষ্কার ‘বোনোগ্রাফ’ পুরোপুরি সফল ।
কাল সারা রাত কাজ করে আমরা তখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসেছি । টিঙ্কাই সবে ট্রে-তে করে কফি এনে রাখছে । স্যার ওকে কাছে ডাকলেন । ছোটখাটো যন্ত্রটা টেবিলের ওপর রাখা ছিল । তার ফ্লেক্সিব্ল্ প্রোব-টা নিয়ে স্যার টিঙ্কাইয়ের কব্জিতে চেপে ধরলেন ।
কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটলো না । তারপর ডিজিটাল ডিসপ্লেতে শুরু হয়ে গেল বেশ কিছু অঙ্কের খেলা । অঙ্কগুলো বদলাতে বদলাতে ক্রমে স্থির হল একটা অঙ্কে এসে । ১৫ বছর ৪ মাস ১১ দিন । অর্থাৎ টিঙ্কাইয়ের এই মুহূর্তের বয়স ওটাই ।
স্যার প্রায় ছেলেমানুষের মত লাফ দিয়ে উঠলেন, ‘দেখেছ স্বাগত, কি বলেছিলাম ! আমার এ যন্ত্র ১০০ বছর পর্যন্ত বয়স বলে দেবে মাস-দিন সমেত । তার বেশি হলে শুধু বছরটাই ধরা পড়বে । যাক, এবার নিশ্চিন্ত ।’
স্যার পরম তৃপ্তিতে কফির কাপে চুমুক দেন । আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি । আমাদের এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হল ।
এরপর কয়েকটা জরুরী কথা সেরে নিয়ে স্যরের কাছে আজকের মতো ছুটি নিয়ে এসেছি । কাল থেকে আবার কাজ । জিনিসপত্র গোছগাছ, রিসার্চ পেপার তৈরি করা, তাছাড়া বোনোগ্রাফ নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষাও বাকি । ৩০শে মার্চের খুব বেশি দেরী নেই ।
১৭ই মার্চ, শনিবার
আশ্চর্য ব্যাপার । হৈ হৈ পড়ে গেছে চারিদিকে । ব্লগ জুড়ে কমেন্টের পর কমেন্ট । অজস্র প্রশ্ন । প্রচুর এন্কোয়ারি । এমনকি অনেকেই চেয়েছেন কমপক্ষে যন্ত্রটার একটা ছবি আপলোড করা হোক । কিন্তু সকলকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, যন্ত্রটা ৩০শে মার্চের সম্মেলনে ডেমনস্ট্রেট করার আগে স্যার ঐ যন্ত্র সম্পর্কে কোন ইন্ফর্মেশন প্রকাশ করতে নারাজ ।
সুতরাং দয়া করে আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন । বোনোগ্রাফ ডেমনস্ট্রেশনের পর বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়াটুকু জানা অত্যন্ত জরুরী । তারপর তো মিডিয়াই জানিয়ে দেবে সবকিছু । আর আমি জানাবো ভেতরের খবর । ৩০শে মার্চ রাত্রে, এই ব্লগে ।
২৯শে মার্চ, বৃহস্পতিবার, হোটেল মহারাণা প্যালেস
আজ সকালেই আমরা এসে পৌঁছেছি ভরতপুরে । রয়্যাল সায়েন্স একাডেমী ব্যবস্থাপনার কোন ত্রুটি রাখেননি । দিব্যি বড় হোটেল, আরামপ্রদ ঘর, এলাহি খাওয়াদাওয়া । পাশাপাশি দুটো ঘর পেয়েছি আমরা । একটা ঘরে স্যার আছেন, একটায় আমি ।
লাঞ্চ-টাইমে আলাপ হল এক জার্মান বিজ্ঞানীর সঙ্গে । ইনি হলেন অর্নিথোলজিস্ট, অর্থাৎ পক্ষীবিদ, প্রফেসর আইখ্লার । পাখিদের ভাষা নিয়ে ওনার সাম্প্রতিক গবেষণার পেপার পড়তে উনি আমন্ত্রিত হয়েছেন । এনার সঙ্গে আলাপ হবার পর মূলত এনার পীড়াপীড়িতেই এখানকার বিখ্যাত পক্ষীনিবাসে একবার ঘুরে আসার প্রোগ্রামটা ঠিক করা হল । আর ওখানেই ঘটলো এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ।
# # # # #
ভরতপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য এই বার্ড স্যাংচুয়ারি, যা এখন ‘কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্ক’ নামেই অভিহিত । এরকম অদ্ভুত একটা নামের কারণ হচ্ছে এই পার্কের মধ্যে অবস্থিত ভগবান শিবের একটি মন্দির, স্থানীয় লোকেদের কাছে যিনি পরিচিত কেওলাদেও নামে ।
পার্কের আয়তন খুব বেশি নয়, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে মিলিয়ে মাত্র ২৯ বর্গ কিমি, কিন্তু আশ্চর্য এখানকার ইতিহাস । কবে এই জলাভূমির সৃষ্টি, আর কবে থেকেই বা এখানে জানা-অজানা শতসহস্র পাখির বাসস্থান গড়ে উঠেছে, তা জানা যায় না । এক বিশাল সংখ্যক পরিযায়ী পাখির দলই বা কবে থেকে এখানে আসা-যাওয়া শুরু করেছে, তাও কেউ বলতে পারে না । হঠাৎ অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি আবিষ্কৃত হয় এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি, আর তারপরেই শুরু হয় হত্যা লীলা । রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে ইংরেজ সাহেবরা দলে দলে এখানে আসতে লাগলেন পাখি শিকার করতে । বছরের পর বছর হাজার হাজার পাখির রক্তে লাল হয়ে উঠতে লাগলো এখানকার মাটি আর জল । শেষে ১৯৭১ সালে সরকার একে সুরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করার পর বন্ধ হয় এই নির্বিচার পাখি-বধ । আর এখন তো এ জায়গাটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ । এখন দেশবিদেশের পাখিরা নিশ্চিন্তে এখানে আসে, বাসা করে, ডিম পাড়ে, তারপর কখনো বাচ্চাদের নিয়ে উড়ে যায় অন্য কোন দেশে ।
পার্কের মেন গেটের ভেতরে ঢুকে কিছুটা গেলে শান্তি কুটির । ওখানে গাড়ি রেখে আমরা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা দিয়ে চলছিলাম আর প্রফেসর আইখ্লার আমাদের শোনাচ্ছিলেন এইসব গল্প । উনি আগে বেশ কয়েকবার এসেছেন এখানে । তাই তাঁর চোখ দিয়ে আমরা পাখির জগৎ দেখতে পাচ্ছিলাম নতুনভাবে । এমন সময় ব্যাপারটা চোখে পড়লো ।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা তখন চলে গেছি অনেকটা ভেতরে । দূর থেকে একটা মন্দিরের চূড়া দেখতে পাচ্ছিলাম । জানা গেল ওটাই সেই কেওলাদেও মন্দির, যার নামে এই পার্কের নামকরণ হয়েছে ।
আমাদের ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে, জলের মধ্যে এক ঝাঁক সারসজাতীয় পাখি দেখা যাচ্ছিল । অদ্ভুত চিত্রবিচিত্র তাদের পাখা আর গায়ের রঙ । লাল রঙের মাথা, লম্বা গোলাপি ঠোঁট । আইখ্লার জানালেন ওগুলো হল ‘Painted Stork’।
ভাল করে দেখবো বলে বাইনোকুলারটা হাতে নিয়ে আর একটু এগিয়ে গেলাম । রাস্তার পাশেই শুরু হয়েছে জলাজমি, ঝোপঝাড় । একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারটা চোখে তুললাম । আর তখনই নজরে পড়লো একটা লোক । দূর থেকে জলকাদা ভেঙে এগিয়ে আসছে । শ্যামলা গায়ের রঙ, প্যান্টটা একটু গুটোনো, গায়ে একটা জ্যাকেট ।
ঐ জলাজমির ভেতরে লোকটা গেল কি করে ? আর কেনই বা ? বাইরের কোনো ট্যুরিস্টের তো ওখানে যাওয়ার পারমিশন নেই ! তবে কি লোকটা এই স্যাংচুয়ারির কোনো স্টাফ ?
উত্তেজিত হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি, স্যার ও প্রফেসর আইখ্লার দুজনেই লক্ষ্য করেছেন লোকটিকে । স্যার ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বললেন । অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকলাম আর লোকটির গতিবিধি দেখতে লাগলাম ।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চারিদিক দেখতে দেখতে লোকটি উঠে এল পীচরাস্তায় । তারপর বাঁদিকে ফিরে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিল মেইন গেটের দিকে । আমরা ছিলাম উল্টোদিকে, প্রায় পাঁচ-ছয় মিটার পেছনে । বেলাও পড়ে এসেছে । একটা আবছায়া ক্রমে ঢেকে ফেলছে চারিদিক । তাই স্বভাবতই সে আমাদের দেখতে পায়নি । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার হঠাৎ ডেকে উঠলেন, ‘এক্সকিউজ মি ! প্রফেসর মুথুরামাইয়া !’
লোকটি চমকে উঠে পেছন ফিরলো । তারপরেই বিস্মিত মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো, ‘ওয়্যাও ! ডক্টর বিন্দু ! ওয়াট আ সারপ্রাইজ !’
বড় বড় পায়ে ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে । কাছে এসে স্যরের হাতটা চেপে ধরে বললেন, ‘ডক্টর, আমার দীর্ঘ তিরিশ বছরের মিশন সাক্সেস্ফুল । সেই যে আপনাকে বলেছিলাম, একটা জ্যাকপট না হলে আমার চলবে না ! মনে হয় সেই জ্যাকপট আজ আমার হাতের মুঠোয় ।’ কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন । বেশ বোঝা যাচ্ছিল, উত্তেজনায় ওনার নাড়ি রীতিমতো চঞ্চল ।
‘তার মানে ?’ স্যার যেন রীতিমতো বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি সত্যিই তেমন কোন রেয়ার . . .’
‘ইয়েস ডক্টর, আয়াভ ক্র্যাক্ড্ ইট’, স্যারকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে ভদ্রলোক বলতে থাকেন, ‘মাত্র কিছুদিন আগেই খবরটা পাই । তারপর সরকারী পারমিশন যোগাড় করে লোকজন সঙ্গে নিয়ে এখানে চলে আসি মাসখানেক আগে । সেই থেকে এখানকার ফরেস্ট লজে আছি আর খোঁজাখুঁজি করে চলেছি । আর তা করতে করতে মাত্র তিনদিন হ’ল খুঁজে পেয়েছি সেই সাত রাজার ধন । আমার জ্যাকপট । আর আমি নিশ্চিত জানি যে এই জ্যাকপট আমাকে এবার পৌঁছে দেবে খ্যাতির শিখরে ।’
স্বাভাবিক কৌতূহলেই স্যার বলে ওঠেন, ‘মানে ? আপনি কিসের কথা বলছেন প্রফেসর ?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘ওয়েল ডক্টর, আজ আমার একটু তাড়া আছে । আপনি যদি কৌতূহলী হন তো মোস্ট ওয়েলকাম । যে কোন দিন আমার লজে চলে আসুন । আপনাকে দেখাবো ।’
ঠিক হয়, আগামীকাল সম্মেলনটা মিটে গেলে পরশু সকালে আমরা আসবো লজে, প্রফেসরের স্যুইটে ।
পরে স্যারের কাছে সব জানা গেল । এই প্রফেসর মুথুরামাইয়ার কাজ নাকি ফসিল নিয়ে গবেষণা । বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাদের বলে প্যালিওন্টোলজিস্ট । প্রায় তিরিশ বছর তিনি এই সাধনায় নিমগ্ন । আর তাঁর মনের মধ্যে এক লালিত স্বপ্ন হল কোন এক প্রাচীন ফসিলের আবিষ্কার । স্যরের ধারণা, হয়তো তেমন কোন ফসিলই তিনি খুঁজে পেয়েছেন । তবে এখন সবটাই অনুমান । আগামী পরশু গিয়ে নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয় ।
# # # # #
হোটেলে পৌঁছে দেখলাম, আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীরা সবাই এসে পড়েছেন । রাত্রে ডাইনীং রুমে তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আলাপ হল । এঁদের মধ্যে স্যরের পূর্বপরিচিত কয়েকজনও আছেন ।
কাল সকাল দশটা থেকে সম্মেলনের অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু কালকের জন্য নয়, আমার মনের মধ্যে পরশুর জন্য প্রতীক্ষা শুরু হয়েছে ।
৩০শে মার্চ, শুক্রবার
সম্মেলনে অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া । বোনোগ্রাফের সুখ্যাতি সবার মুখে মুখে । ডেমনস্ট্রেশনের পুরো সেশনটা লাইভ শো হয়েছে । মিডিয়ার কল্যাণে সে খবর তো আপনারা পেয়েছেন । সেই সঙ্গে এটাও আপনাদের জানা হয়ে গেছে যে, এই বোনোগ্রাফ জীবিত বা মৃত শরীরের বয়স নির্ধারণ করে দেবে একেবারে নিখুঁতভাবে । প্রচলিত ‘কার্বন ডেটিং’ বা ‘রেডিওমেট্রিক ডেটিং’-এর দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া ও অন্যান্য খুঁটিনাটি সমস্যা অতিক্রম করেছে এই যন্ত্র । ফলে কোন আইনি সমস্যায় বা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ এগিয়ে যেতে পারবে আরও কয়েকটা ধাপ ।
স্বভাবতই স্যার বেশ খুশি । আর স্যারকে এই কাজে সাহায্য করতে পেরেছি বলে আমার আনন্দও খুব একটা কম নয় ।
এবার কালকের পালা । স্যারকেও এ প্রসঙ্গে দু একবার আলোচনা করতে শুনেছি প্রফেসর আইখ্লারের সঙ্গে । কারণ উনিও কাল আমাদের সঙ্গ নিচ্ছেন । পক্ষীবিদ হিসেবে এমন একটা অভিজ্ঞতার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চান না ।
২রা এপ্রিল, সোমবার
পৃথিবীতে কত যে অদ্ভুত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, আমরা তার কতটুকু সন্ধান রাখি ? আজ সন্ধের পর থেকে সমস্ত সংবাদমাধ্যম আর ইন্টারনেটে যে চাঞ্চল্যকর ঘটনার শিরোনামে দেশবিদেশ মুখরিত, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করছি । সেইসঙ্গে এটাও সত্যি যে, গত তিনদিন ধরে একের পর এক অভাবনীয় ঘটনার শেষে আজকের এই চমকপ্রদ সমাপ্তির ধাক্কায় শরীর-মন সম্পূর্ণ বিবশ ।
তবু, মাননীয় প্রাজ্ঞজনেরা, যে অধীর কৌতূহলে আপনারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন এই ব্লগে, তাকে সম্মান জানানো আমার কর্তব্য । তাই পুরো ঘটনাটি এখানে যথাসম্ভব প্রাঞ্জল করে জানানোর চেষ্টা করছি । আশা করি এতেই আপনাদের সব কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটবে ।
# # # # #
আগের কথামতোই গত পরশু অর্থাৎ শনিবার সকালে আমরা তিনজন গিয়ে পৌঁছলাম লজে । সঙ্গে ছিল আমাদের বোনোগ্রাফ যন্ত্র । যদি আমাদের অনুমান মিলে যায়, তাহলে এই যন্ত্র দিয়ে সহজেই সেই ফসিলের বয়স জানা যাবে, সেইসঙ্গে যন্ত্রটির এক নতুন পরীক্ষাও হয়ে যাবে, সম্ভবত এই ধারণা থেকেই স্যার ওটা নিতে বলেছিলেন ।
একটা চমৎকার টু-রুম স্যুইট । দরজা খুলে দিল লম্বা-চওড়া একজন লোক । প্রফেসর অপেক্ষা করছিলেন বসার ঘরে । সেখানে একটা সেন্টার-টেবিলে কাচের একটা বড়োসড়ো বাক্সে রাখা ছিল আমাদের সেই ইপ্সিত বস্তু । দেখা গেল আমাদের অনুমানই ঠিক । সত্যিই সেটা একটা ফসিল ।
অদম্য কৌতূহল মনে চেপে বসে ছিলাম । পরিচয়পর্ব শেষে প্রফেসর বাক্সের ঢাকনাটা খুলে দিতেই একসঙ্গে সবাই মিলে টেবিলটা ঘিরে ঝুঁকে পড়লাম ।
ফসিল আগে কয়েকবার দেখেছি, কিন্তু এতবড়ো ফসিল আগে কখনো আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি । আর্কিওপ্টেরিক্স-এর ফসিলের যে ছবি আগে দেখেছি, তার সঙ্গে খানিকটা মিল আছে । আবার তফাৎ-ও খুব কম নয় । এর ঠোঁট ছোট আর চওড়া, পা গুলোও বেঁটে বেঁটে, দেহের প্রান্তে একটা লেজের মতো, আর দুদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হাতের গায়ে যে পর্দার মতো অংশগুলো আছে, তাকে খুব সহজেই পাখনার সঙ্গে আইডেন্টিফাই করা যায় ।
স্যার ফসিলটা ভাল করে দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন, ‘ প্রফেসর ! এ তো প্রোটো আভিসের ফসিল মনে হচ্ছে !’
‘ইয়েস ডক্টর, অনেকটা তাই বটে । কিন্তু প্রোটো আভিসের সঙ্গে এর তফাৎটা দেখতে পাচ্ছেন তো ? এবার বলুন অ্যাপারেন্টলি দেখে আপনি কি বুঝছেন ? কত বয়স এই ফসিলটার ?’
স্যার বললেন, ‘আমার তো দেখে মনে হচ্ছে, এ সেই ট্রায়াসিক যুগের কোন ফসিল !’
এবার একটু হেসে প্রফেসর বলে ওঠেন, ‘ডক্টর বিন্দু ! ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, আমার ‘ডেটিং পরীক্ষা’ অলরেডি কমপ্লিট । আর তার রেজাল্ট কি বলছে জানেন ? মাটির যে লেয়ারে ফসিলটি পাওয়া গেছে, আর এই পাথরের যা রেডিওঅ্যাক্টিভ এলিমেন্ট মিলেছে, তার ভিত্তিতে এই ফসিলের বয়স আন্দাজ ‘চব্বিশ কোটি বছর’ । তার মানে পৃথিবীতে তখন ট্রায়াসিক যুগও আসেনি । চলছে পৃথিবীর আদিম কল্পের শেষ যুগ – পার্মিয়ান যুগ । অর্থাৎ ডাইনোসর নামের জীবটি তখনও আবির্ভূতই হয়নি । শুধু উভচর আর সরীসৃপ এখানে বিরাজ করছে । এর মানে দাঁড়ায় এই যে, আজ পর্যন্ত সমস্ত ফসিলের আবিষ্কারের বিচারে এই হল পৃথিবীর প্রথম পাখি ।’
ব্যাপারটা এতটাই অভাবিত যে আমরা কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারি না । খানিকটা অবিশ্বাস আর খানিকটা বিস্ময়, এর মাঝামাঝি অবস্থায় পড়ে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি প্রফেসরের দিকে । প্রফেসর তখন বলে চলেছেন, ‘সেইসঙ্গে আর একটা বিষয় আমি ভেবেছি । এই ফসিলের যা চেহারা, তা থেকে আমার মনে হয়, এ আসলে ‘কটিলোসর’ নামক সরীসৃপটির পরবর্তী ধাপ, যার চেহারা ছিল অনেকটা কুমীরের মতো । ওই সরীসৃপই ক্রমাগত আকাশে ভাসবার চেষ্টা করতে করতে বিবর্তিত হয়ে এই চেহারা নিয়েছে । তাই আমি এই জীবের নাম রেখেছি ‘অর্নিথোলোসর’ । কেমন হয়েছে নামটা, ডক্টর ?’
প্রফেসর আইখ্লার এতক্ষণ কোন কথা বলেননি । এবার উত্তেজিত গলায় বলে ওঠেন, ‘মাই গড ! এ তো মির্যাক্ল্ ব্যাপার ! আপনি বলছেন চব্বিশ কোটি বছর আগের এই ফসিল আপনি খুঁজে পেয়েছেন এখানে ? কোথায় কিভাবে পেলেন এই ফসিল ?’
মুথুরামাইয়া বলেন, ‘ওই যে কেওলাদেও মন্দিরটা আপনারা দেখেছেন, ওখান থেকে প্রায় ১১ কিমি পশ্চিমে একটা ভাঙা বাঁধের মতো আছে । প্রচুর চুনাপাথরে ভর্তি জায়গাটা । ওখানেই খুঁড়তে গিয়ে মাটির প্রায় সাড়ে চার মিটার নিচে এটা পাই । প্রথমে তো গুরুত্বই দিইনি । লজে তুলে নিয়ে এসে কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কার করতেই বুঝে যাই, আমার তিরিশ বছরের সাধনা এতদিনে সার্থক হতে চলেছে । নাউ দ্য বল ইজ ইন মাই কোর্ট ।’
‘স্প্লেন্ডিড্ ! গ্রেট !’ উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রফেসর আইখ্লার বলেন, ‘আপনি তো একটা অভাবনীয় কাণ্ড করেছেন দেখছি ! তবে আমার মনে হয়, এই ব্যাপারে ডক্টর বিন্দুর বোনোগ্রাফ বোধহয় আরও কিছু তথ্য যোগাতে পারে । কি বলেন ডক্টর ?’
মুথুরামাইয়া অবাক হয়ে স্যরের দিকে তাকান । তার মানে গতকালের খবর কিছুই ওঁর কানে আসেনি । অগত্যা স্যারকে বলতে হয় তাঁর বোনোগ্রাফ যন্ত্রের কথা । পুরো ব্যাপারটা শুনে প্রফেসর মুথুরামাইয়া তো খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন ।
সুতরাং এবার আমার কাজ । ব্যাগ থেকে বোনোগ্রাফটা বার করে এগোই । আর তারপরেই এক অদ্ভুত কাণ্ড ! যে যন্ত্র আগের দিন তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের সামনে অবিশ্বাস্য সব খেল দেখিয়েছে, তা সেই সময়ে সম্পূর্ণ অজানা কোন কারণে যেন বিগড়ে গেল । ডিস্প্লেতে উল্টোপাল্টা সব অঙ্ক । ফসিলের কোন কোন হাড় হয়তো প্রাচীনত্বের কারণে জীর্ণ হয়ে ভুল রেজাল্ট দিচ্ছে, এই ভেবে নানান অংশে টেস্ট করলাম, তাতেও সেই এক ব্যাপার । একেক সময় একেক রকম রেজাল্ট ।
কয়েকবার চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিলাম । স্যার বললেন, ‘আয়াম স্যরি প্রফেসর । আমার যন্ত্রের কার্যকারিতা আপনাকে দেখাতে পারলাম না । ইট্’জ্ মাই ফল্ট ।’
মুথুরামাইয়া আন্তরিক গলায় বললেন, ‘ওহ্ নো ডক্টর । আই ডোন্ট মাইন্ড । শুনুন, আগামী সোমবার আমি মিডিয়াকে এখানে ডেকেছি । সেখানেই আমি এই আবিষ্কারটি ঘোষণা করবো । যদি আপনার আর্জেন্ট কোন কাজ না থাকে, আই লাইক টু সী ইউ হিয়ার ।’
স্যার মনমরা গলায় বলেন, ‘ও শিয়োর ।’
ফেরার সময় গাড়িতে বসে স্যার চুপ করে কি যেন ভাবছিলেন । আইখ্লার জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা ডক্টর বিন্দু, আপনি কি সত্যিই ভাবছেন যে এই ফসিলটাই সেই ‘মিসিং লিঙ্ক’, স্থলচর জীবের পাখি হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ ?’
স্যার বললেন, ‘অসম্ভব নয় । এখন পর্যন্ত আমরা সবচেয়ে আদিম পাখি হিসেবে যাকে পেয়েছিলাম, তা হল জুরাসিক যুগের আর্কিওপ্টেরিক্স, যার বয়স চোদ্দ-পনেরো কোটি বছর । তারপর আবার পাওয়া গেল ট্রায়াসিক যুগের প্রোটো আভিসের খোঁজ, যার বয়স হল সাড়ে বাইশ কোটি বছর । এখন এই ফসিলের বয়স যদি সত্যিই চব্বিশ কোটি বছর হয়, তাহলে তো মানতেই হবে যে এখন পর্যন্ত এই হল পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি !’
আইখ্লার চুপ করে যান । স্যারও আর কোন কথা বলেন না ।
# # # # #
কাল সারাদিন ফ্রি ছিলাম আমরা । সায়েন্স অ্যাকাডেমি একটা প্রোগ্রাম ঠিক করেছিলেন যে সবাইকে নিয়ে আজ ভরতপুর ঘোরানো হবে, সেটা নিয়েই আলোচনা চলছিল । আমরা সেখানে যাব, নাকি মুথুরামাইয়ার প্রেস কনফারেন্সে, তা নিয়ে মনস্থির করা যাচ্ছিল না । স্যরের মনমেজাজ খারাপ, তাই আমিও আর স্যারকে খুব একটা ডিসটার্ব করিনি ।
সকালে স্যার নিজে একবার বোনোগ্রাফ যন্ত্রটা নিয়ে পরীক্ষা করতে বসলেন । তারপর দুপুরে দু-একটা ফোন করার পর হঠাৎই ডিসিশান নিলেন যে আমরা আজকের ভরতপুর ট্যুরে যাচ্ছি না । তার বদলে আমরা মুথুরামাইয়ার আমন্ত্রণই অ্যাটেন্ড করবো ।
# # # # #
প্রেস কনফারেন্স দুপুর দুটোয় । তাই সকালটা আলস্য করে কাটালাম। আটটার মধ্যে বিজ্ঞানীর দল বেরিয়ে গেছেন ভরতপুর ট্যুরে।
আমরা লাঞ্চ সেরে লজে পৌঁছলাম সওয়া দুটোয়। প্রফেসরের ড্রয়িং রুমে তখন ভিড় করেছে সাংবাদিকের দল । ফসিলের বাক্স সামনে রেখে প্রফেসর বক্তৃতা শুরু করেছেন । পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সেই লম্বা-চওড়া সঙ্গী ।
আমাদের দেখে প্রফেসর হৈ হৈ করে ডেকে নিয়ে বসালেন । তারপর আবার তাঁর আবিষ্কারের বর্ণনা শুরু করলেন । মাঝে মাঝে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছিলেন আর প্রফেসর তার জবাব দিচ্ছিলেন ।
প্রায় পনেরো মিনিট বক্তৃতা চলার পর হঠাৎ স্যরের মোবাইলে একটা ফোন এলো । স্যার ঘরের বাইরে চলে গেলেন ফোনটা অ্যাটেন্ড করতে । প্রফেসর তখন বলে চলেছেন, ‘আমার তিরিশ বছরের সাধনা আজ সার্থক হল । আশা করি আপনারা এখন নিঃসন্দেহ যে, চব্বিশ কোটি বছর আগের এই ‘অর্নিথোলোসর’-ই পৃথিবীর প্রথম পাখি, যার আবিষ্কর্তার নাম ‘এন. মুথুরামাইয়া’ !’
চারিদিকে পটাপট হাততালির শব্দ আর ক্যামেরার ফ্ল্যাশ । পরপর ছবি উঠে চলেছে প্রফেসর আর ওই ফসিলের । তারই মাঝখানে স্যার ঘরে ঢোকেন, তাঁর পেছনে স্যুট-টাই পরা এক ভদ্রলোক ।
স্যার বলে ওঠেন, ‘এক্সকিউজ মি প্রফেসর । এই ভদ্রলোক একবার ফসিলটা পরীক্ষা করে দেখতে চান ।’
প্রফেসর ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন, ‘কে উনি ?’
ভদ্রলোক বুকপকেট থেকে একটা আইডেন্টিটি কার্ড বার করে বলেন, ‘এস. পাণিগ্রাহী । অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ।’
ভদ্রলোকের কথা শেষ হতে না হতেই এমন কতকগুলো কাণ্ড ঘটে, যার জন্য শুধু আমি কেন, ঘরে উপস্থিত কোন সাংবাদিকও বোধহয় প্রস্তুত ছিল না । একইসঙ্গে প্রফেসর মুথুরামাইয়া লাফিয়ে তেড়ে আসতে যান, আর প্রফেসরের সেই সঙ্গীর হাতে একটা রিভলভার ঝলসে ওঠে । কিন্তু পরক্ষণেই তারা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই স্ট্যাচুর মতো স্থির হয়ে যায় । কারণ ডক্টর বিন্দুর হাতে ম্যাজিকের মতো উঠে এসেছে তাঁর নিজের আবিষ্কৃত অস্ত্র ‘প্যারালাইস্টার’, যা থেকে দুটো রশ্মি বেরিয়ে ওই দুজনের সমস্ত স্নায়ু পলকে অচল করে দিয়ে তাদের আধ ঘন্টার জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিয়েছে ।
গোটা ঘর নিস্তব্ধ । স্যার গিয়ে বাক্সের ডালাটা খুলে ধরেন, তারপর আগত ভদ্রলোকটিকে ডাকেন, ‘মিঃ পাণিগ্রাহী, প্লীজ ।’
ভদ্রলোক কাছে গিয়ে ফসিলটা খুঁটিয়ে দেখেন, তারপর হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করেন, সবশেষে পকেট থেকে একটা বড় আতস কাচ বার করে কি সব দেখে নিয়ে ঘাড় নাড়েন । এরপর পেছন ফিরে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলে ওঠেন, ‘জেন্টলমেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে, এই ফসিলটি একটি নকল ফসিল । বিভিন্ন প্রাচীন ফসিলের হাড় মিলিয়ে মিশিয়ে অত্যন্ত নিপুণভাবে এটি তৈরি করা হয়েছে সকলের চোখে ধূলো দেবার জন্য । আসলে এই ব্যাপারটা পুরোটাই খুব উঁচুদরের জোচ্চুরি ।’
নিমেষে গোটা ঘরে হৈ চৈ আর গোলমাল শুরু হয়ে যায় । মাত্র হাত দুয়েক তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর মুথুরামাইয়া আর তাঁর সঙ্গী । প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের দুরন্ত ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা অসহায় । কারণ তাঁদের চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত হলেও শরীরের সমস্ত স্নায়ু অসাড় ।
স্যার দুহাত তুলে বলতে থাকেন, ‘প্লীজ, প্লীজ মাই ডিয়ার জেন্টেলমেন । আপনারা দয়া করে একটু চুপ করুন ।’ ধীরে ধীরে সকলের গুঞ্জন থেমে আসে ।
স্যার এবার বলেন, ‘আমি জানি, এ ঘরের সকলের মনে এখন কৌতূহলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে । ওয়েল, আমি একে একে সেই কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করছি । দেখুন, আমার মনে প্রথম সন্দেহটা জেগে ওঠে আমার বোনোগ্রাফে ওইরকম বিক্ষিপ্ত ফলাফল দেখে । যন্ত্রটা হঠাৎ এমন ফেল করে গেল ? সাময়িকভাবে হতাশ হয়ে পড়লেও একটা ক্ষীণ সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধতে শুরু করে । তাই গতকাল আবার ভালভাবে পরীক্ষা করতে শুরু করি এবং বুঝতে পারি যে, আমার যন্ত্রে কোন দোষ নেই । আর তখনই বিদ্যুতের মতো মনে পড়ে যায় নকল ফসিল তৈরির প্রসেসটা । যারা এই নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা জানেন যে কয়েকটা বহু প্রাচীন ফসিলের হাড় নিয়ে ল্যাবরেটরিতে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাদের সংমিশ্রণ করে এমন নকল ফসিল তৈরি করা যায়, যা দেখে আপাতভাবে মনে হবে একদম নতুন ধরণের কোন ফসিল । মনে হল, মুথুরামাইয়া হয়তো এই পন্থাই অবলম্বন করেছেন, আর তাই আমার যন্ত্র বিভিন্ন হাড়ের জন্য বিভিন্ন ফলাফল দেখাচ্ছে !’
স্যার দম নেওয়ার জন্য একটু চুপ করেন । সমস্ত হলটায় এখন পিন ড্রপ সাইলেন্স ।
সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্যার আবার বলতে শুরু করেন, ‘তখন আরও শিয়োর হবার জন্য দু-চারটে ফোন আমায় করতে হয় । আর তখনই জানতে পারি যে, এই পার্কে খোঁড়ার ব্যাপারে কোন সরকারী পারমিশন নেওয়াই হয়নি । কাজেই খননকার্য আদৌ হয়েছে কিনা তারই কোন প্রমাণ নেই । তার মানে প্রথম থেকেই একটা জোচ্চুরির গল্প এখানে তৈরি করা হয়েছে । সুতরাং আর দেরী না করে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করি মিঃ পাণিগ্রাহীর সঙ্গে, কারণ এখানে কোন ক্রাইমের ব্যাপারে যা করার উনিই করতে পারেন । আর এর পরে সবকিছু তো আপনাদের সামনেই ঘটলো । এনি হাউ, ফসিলের খবর, খননকার্য, সর্বোপরি চব্বিশ কোটি বছর আগের ফসিল আবিষ্কার, সব মিলিয়ে মুথুরামাইয়া গপ্পোটা জমিয়েছিলেন ভালই । আসলে তিরিশ বছর ধরে ফসিলের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্রমাগত হতাশ হয়ে পড়া মুথুরামাইয়া একটা ব্রেক থ্রু চাইছিলেন । না পেয়ে মরীয়া হয়ে এই সিদ্ধান্ত । আর উনি যেহেতু বহুদিন ফসিল নিয়েই নাড়াঘাঁটা করছেন, তাই বিভিন্ন ফসিলের হাড় সংগ্রহ করতে ওনার কোন অসুবিধাই হয়নি ।’
স্যার চুপ করেন । ঘর ভর্তি সাংবাদিকরা এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো স্তব্ধ হয়ে ছিল । এবার শুরু হল তাদের তৎপরতা । আবার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠতে লাগলো বারংবার । এবার লক্ষ্য ডক্টর অর্কদেব বিন্দু । সাংবাদিকরা একটা রোমাঞ্চকর স্টোরি পেয়ে গেছে ।
Tags: কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্প, ডক্টর বিন্দু ও ফসিল রহস্য, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা