তোতা রহস্য
লেখক: প্রদীপ্ত সাহা
শিল্পী: ইন্টারনেট
মুসান্দম উপত্যকার শুষ্ক, পাহাড়ি প্রকৃতি ইশায়ুর মন্দ লাগল না। এই অঞ্চল পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী, অবস্থান হরমুজ্ প্রণালীর দক্ষিণে। শীতকালীন মৃদু আবহাওয়ায় এখানে এখন চলছে পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ। মাটির নিচে পাওয়া গেছে মানব সভ্যতার প্রাচীন অবশেষ। একটি আন্তর্দেশীয় দল এই অনুসন্ধানের কাজে নিযুক্ত। ইশায়ু ও স্বেতলানা সেই দলেরই সদস্য। ইশায়ু এসেছে ভারতবর্ষ থেকে। সে পুরাতত্ত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। স্বেতলানা উক্রেনীয়, সে ভূপদার্থবিদ। মাটির নিচে মানুষের তৈরি কোনও প্রাচীন নির্মাণ কাজ চাপা পড়ে আছে কিনা তারই খোঁজ সে চালাচ্ছে বিশেষ রকমের এক রাডার যন্ত্রের সাহায্যে। কাজ চলছে একটি ছোট টিলার উপর। টিলাটির ডাইনে-বাঁয়ে-পিছনে মেটে হলুদ রঙের অনুচ্চ পাহাড়, গায়ে গাছপালার আবরণ নেই বললেই চলে। তবে পাহাড়গুলির পাদদেশে কোথাও কোথাও গাছপালা চোখে পড়ে। টিলার পশ্চিমদিকে একটু দূরেই সমুদ্র। অনুসন্ধানের জন্য কাটা হয়েছে বিভিন্ন আকারের কতগুলো ছোট ছোট খাত। আজ সারাদিন এমনই একটি খাতেই ইশায়ুর সময় কেটেছে। এই খাতগুলি খুব সাবধানে খোঁড়া হয়। তারপর তার মেঝে ও দেওয়ালগুলো থেকে একটু একটু করে মাটি সরিয়ে উদ্ধার করা হয় বহুকাল চাপা পড়ে থাকা বিভিন্ন সামগ্রী।
এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পশ্চিমা হাওয়ায় কেটে গেছে দুপুরের গুমোট ভাব, হালকা আলোয় চারদিক বেশ মনোরম। সারাদিন কাজের পর এখন ওরা দুজনে টিলার ধারে এসেছে সময় কাটাতে। ডান দিকের পাহাড়টির পাদদেশের দিকে ইঙ্গিত করে ইশায়ু বলল,
‘আমার বার বারই কি মনে হয় জান? ওই পাহাড়টির নিচে হয়তো একটি গুহা আছে।’
‘কই কোন দিকটা বলত? আমি শুধু গাছপালাই দেখছি ওদিকে। কই দেখি তোমার দূরবীনটা।’
কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরাজিতে, স্বেতলানার ইংরাজিতে উক্রেনীয় টান।
‘ওই যে দেখ পাহাড়ের পাদদেশে যেখানে পাথরের স্তরগুলি একটু ভাঁজ খেয়েছে ওর ঠিক নিচেই। গাছপালায় ঢাকা পড়ে আছে। আমি সেদিন ওখানে এক ঝাঁক বাদুড় উড়তে দেখেছি।’
‘একবার জায়গাটা দেখে আসলে কেমন হয়?’
ইশায়ু তখনই রাজি হয়ে গেল। আজকাল সে মাঝে মাঝেই একঘেয়েমি কাটাতে কাজের ফাঁকে বেরিয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলো দেখতে। ওরা একটি ছোট্ট পিক-আপ ট্রাক নিয়ে রওনা হল। জায়গাটি টিলার থেকে মাইলখানেক হবে। গাছপালায় ঢাকা। গাছের মধ্যে রয়েছে প্রধানত আকাশিয়া ও অন্যান্য জাতের কাঁটা গাছ, খেজুর ও কিছু বৃক্ষ, এ ছাড়াও মাটি কামড়ে গজিয়েছে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটু ভিতরে যেতেই ওদের চোখে পড়ল গুহাটি। এর প্রবেশপথ খুব উঁচু নয়।
‘ওই তো, ওই দেখ গুহা। যাক তোমার অনুমানই তাহলে ঠিক।’
‘চল ভিতরটা একটু দেখি। গুহাতে অনেক সময় প্রকৃতির খেয়ালে অদ্ভুত সব আকৃতি তৈরি হয়। স্ট্যালাগমাইট স্ট্যালাকটাইটের কথা নিশ্চয়ই শুনেছ? এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার স্ফটিকেরও দেখা মেলে। আবার অনেক সময় এই সব গুহায় আদিম মানুষের বসবাসের প্রমাণ মেলে। যেমন ধর তাদের ব্যবহৃত সামগ্রী, গুহাচিত্র, বা অনেক ক্ষেত্রে তাদের দেহাবশেষ।
‘বাঃ! সেসব দেখতে পেলে তো বেশ হয়। চল দেখেই আসি ভিতরে কী আছে।’
গুহার প্রবেশপথ খুব উঁচু নয়। দীর্ঘাঙ্গিনী স্বেতলানার ঢুকতে একটু অসুবিধেই হল। ভিতরটা অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। টর্চ জ্বালিয়ে ওরা গুহার দেওয়াল, ছাদ ভালোভাবেই দেখল। কিন্তু অনেক খুঁজেও কোথাও তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। দেওয়ালে অস্পষ্ট জলের দাগ ছাড়া অন্য কোনো আঁকিবুঁকি বা লেখাজোখা কিছুই নেই। গুহার সিলিং থেকে একটিও স্ট্যালাগটাইট নামেনি, শুধু কতগুলি বাদুড় সার বেঁধে উলটো হয়ে ঝুলে আছে। গুহাটি শুধু ছোটই নয় বেশ অগভীরও বটে। তখন সন্ধে হয় হয়, আলো বেশ কমে এসেছে। বেশি সময় কাটিয়ে আর তেমন লাভ নেই। ওরা বাইরে বেরিয়ে এল।
বাইরে এখন পাখিদের ঘরে ফেরার পালা। রোলার, ল্যাপউইং, প্যারাকীট ইত্যাদি অনেক পাখিই ইশায়ু চিনতে পারল। সবুজ তোতা, ল্যাপউইংগুলোর কর্কশ ডাকে তখন চারদিক মুখরিত। এই ডাকগুলো সবই ইশায়ুর চেনা। সেই কলরব শুনতে শুনতে হঠাৎই তার কানে এল একটু অন্যরকম ডাক। অন্যরকম কারণ এই ডাক এত চড়া নয়, একটু যেন চাপা ধরনের, এর সুর খাদের সুর। এই ডাকের বিস্তারও সাধারণের চেয়ে বেশি। ঠিক “কা-কা-কা” বা “কুহু-কুহু”র মতো সরল আর ছোট নয়। ইশায়ু স্বেতলানাকে সেই ডাক শোনাল। স্বেতলানারও সেই ডাক অচেনা। তখন সূর্য ডুবে গেছে, কম আলোয় ঠিক কোন পাখিটি এই ডাক ছাড়ছে তা ঠিক ঠাহর করা গেল না। ইশায়ু ফোনে সেই ডাক রেকর্ডিং করে নিল। তারপর ওরা সমুদ্র তীরে খানিক সময় কাটিয়ে, নিকটবর্তী খসব্ শহরের দিকে রওনা হল। তীর ঘেষা চওড়া রাস্তায় মিনিট তিরিশের পথ, একদিকে পাহাড় অন্য দিকে বিস্তৃত সমুদ্র। গাড়ির সংখ্যা বেশ কমই। সন্ধের ম্লান আলোয়ও সেই পথ ওদের ভালোই লাগল।
দুপুরের একঘেয়েমি কাটিয়ে সন্ধেয় ইশায়ুর মন বেশ খুশি খুশি। কফির কাপে বিকেলের অভিজ্ঞতার কথা বার বারই ফিরে এল। স্বেতলানা ভূপদার্থবিদ হলেও আরও একটি শখ তার আছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম শব্দ শুনতে ও বিশ্লেষণ করতে সে ভালোবাসে। স্বেতলানার ফোনে একটি এ্যাপ্ ছিল, পাখির ডাক বিশ্লেষণ সেই এ্যাপ্ বলে দিল যে এই ডাক তোতাপাখির হতে পারে।
‘এই ডাক যে তোতাপাখির হতে পারে, এটা বিশ্বাস করা একটু কঠিন।’
‘হুম। আমিও তোমার সঙ্গে একমত, তোতাপাখি ওখানে আরও কত ছিল, ওরা তো এভাবে ডাকছিল না।’
‘আমার কী মনে হয় জান স্বেতলানা, এটা হয়তো ওদের প্রাকৃতিক ডাক নয়। এই ডাক যেন শব্দের সমাহার। ধর যদি এমন হয় যে এই ডাক ওদেরকে শেখান হয়েছে।
‘এই বনের পাখিদের কে আর কথা বলতে শেখাবে?’
‘তা ঠিক। তবে এমনও হতে পারে, হয়তো যে পাখিটি ডাকছে সেটি আগে কারোর পোষা ছিল, ঘটনাক্রমে ছাড়া পেয়ে গেছে।’
‘তা হতে পারে বটে। আচ্ছা যদি তাই হয়। তাহলে পাখিটি কী-ই বা বলছে, কোন ভাষায়ই বা বলছে?’
‘কঠিন প্রশ্ন। এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।’
‘তবে তুমি একটা কথা ঠিকই বলছ, এটা হয়তো একটা ভাষা। এই দেখ অ্যাপে এই ডাকের তরঙ্গ রূপ।’
স্বেতলানা তার মোবাইল অ্যাপে ইশায়ুকে ডাকের তরঙ্গ রূপ বা ওয়েভ ফর্ম দেখাল। সেই তরঙ্গ রূপ দেখতে খানিকটা ইসিজির মতো। যে ইসিজি হৃৎযন্ত্র সম্পর্কিত সমস্যা বোঝার জন্য ব্যাবহার হয়। পুরো ডাকটি মোট ছ-টি অংশে বিভক্ত। তৃতীয় ও ষষ্ঠ ভাগে মিল রয়েছে।
‘এটা বেশ ইনটেরেস্টিং। তুমি বলছ, এই তরঙ্গ রূপের মিল পাখির ডাকের তুলনায় মানুষের ভাষার সঙ্গেই বেশি, তাই কি?’
‘ঠিক তাই।’
এরপর ওরা দুজনেই ঠিক করল আগামী দিন আবার ওখানে যেতে হবে। ওরা দুজনেই অদ্ভুত ডাকের অধিকারী সেই পাখিটিকে দেখতে চায়, বুঝতে চায় তার ভাষা।
পরদিন ওদের কারোরই কাজে মন বসল না। ক্ষণে ক্ষণেই মনে হতে থাকল কখন বিকেল হয়। সেদিন ওরা একটু আগেই উপস্থিত হল সেই গুহার সামনে। ল্যাপ্উইং ও সবুজ তোতাগুলোর ডাকে জায়গাটি তখনও একইভাবে মেতে আছে।
‘আজকে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা গুহার সামনে বসব, কোনওরকম শব্দ না করে সেই পাখির অপেক্ষায় থাকব। তারপর সেই ডাক শুনলে তাকে অনুসরণ করব।’
স্বেতলানার এ ব্যাপারে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সে সম্মতি জানাল। গুহার সামনে গিয়ে বসল ওরা দু-জনে দু-দিকে। স্বেতলানা একটি বই খুলে তাতে ডুব দিল। ইশায়ু সঙ্গে করে এনেছিল একটি ড্রয়িং বোর্ড, পেপার ও চারকোল, সেই সব নিয়েই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্বেতলানার মন তার গল্পের বইটিতে নেই, বারে বারেই সে মুখ তুলে চারপাশের শব্দ শোনে। ওদিকে ইশায়ু আঁকতে ব্যস্ত থাকলেও বেশ সজাগ। মাঝে মাঝেই সে পাশে রাখা দূরবীনটি তুলে এদিক ওদিক দেখে। কিছুক্ষণ পর ইশায়ুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল।
‘কালকের রেকর্ডিংটা চালালে হয় না?’
‘বাঃ, সে তো খুব ভাল প্রস্তাব। হয়তো চেনা ডাক শুনে পাখিরা তাতে সাড়া দিলেও দিতে পারে।’
স্বেতলানার হাতব্যাগে ছিল একটা স্পিকার, সেটাকেই কাজে লাগানো হল। সেই রেকর্ডিং কয়েকবার বাজাতেই কাজ হল। কাছেরই একটা গাছ থেকে পাওয়া গেল উত্তর। আবার সেই ডাক শুনে, একটু দূরের আকাশিয়া গাছ থেকেও দুটি পাখি একই রকম ডাক ডাকল। ইশায়ুর চোখে দূরবীন উঠল। কিন্তু নলের ওপাড়ে সে যে পাখিটিকে দেখছে সেটি কি তোতাপাখি? কই গায়ের রং সবুজ নয়তো! কেমন যেন নীলচে-ধূসর ধরণের। স্বেতলানাও দেখল পাখিটিকে। ইতিমধ্যে আরও দুটি গাছ থেকে একই রকমের ডাক শোনা গেল। ওরা বুঝল একটি বা দুটি নয়, পুরো একঝাঁক পাখি ওই একই রকম ডাক ডাকে।
‘বুঝলে স্বেতলানা, আমি এদের এই ওমান দেশে দেখব সেটা আশা করিনি। এরা হল ধূসর তোতা বা গ্রে-প্যারট, মধ্য আফ্রিকার বাসিন্দা।’
‘হ্যাঁ, গ্রে-প্যারটদের সম্পর্কে আমি শুনেছি, এরা মানুষের ভাষা বেশ ভালোই নকল করতে পারে। অনেকেই এদের পোষে, তোমার গতকালের ভাবনার সঙ্গে সেটা খাপ খায় বটে। হতে পারে এরা হয়তো কারোর পোষ্যই ছিল। তবে দেখ এরা বেশ অনেকে আছে এই বনে।’
‘হুম, সেটাই আমারও প্রশ্ন, যদি এরা পোষাই হয় তবে এত বেশি সংখ্যায় কেন? হুট করে একসঙ্গে সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে? যে-ই এদের পুষে থাকুক সে একসঙ্গে এদের সবাইকে একই রকমের ডাক শেখাবে সেটা ভাবাও বেশ কষ্টকর।
‘একটা সম্ভাবনা আছে। ধর যদি এই পাখিদের মালিক নিজেই কোনও পাখি বিক্রেতা হন, তাহলে হয়তো সেটা হতে পারে। কথা-বলা পাখিদের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি পাওয়া যায়, তাই হয়তো পাখিদের বিশেষ এই ডাক শেখান হয়েছিল। তারপর কোনও সময় ঘটনাক্রমে এরা ছাড়া পেয়ে যায়।
‘হতে পারে। যদি কোনওভাবে পাখিরা কী বলছে তা বোঝা যায়, বেশ হয়। হয়তো এই ডাকেই লুকিয়ে আছে কোনও সংকেত, যা এই রহস্যের সমাধান করবে।’
সেদিনের বৈকালিক অনুসন্ধান ওদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিল, একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেও আরও দশটি অমীমাংসিত বিষয় এখন তাদের সামনে। একঝাঁক কথা বলা পাখি সম্পূর্ণ অবোধ্য ভাষায় তাদের যেন এই রহস্য ভেদ করতে আহ্বান করছে। ইশায়ু ভাবল আর মুসান্দমে নয়। সে মাস্কাট্ রওনা দিল। ইউনিভার্সিটিতে বিষয়টি জানালে হয়তো কিছু উদ্ধার হলেও হতে পারে। ইশায়ুর কাজ শেষের দিকে হলেও স্বেতলানার কাজ অনেকটাই বাকি। সে রয়ে গেল মুসান্দমেই।
ইশায়ু প্রথমেই গেল প্রোফেসর খালিলির কাছে। উনি আরবি সহ অনেক ভাষাই জানেন। সব শুনে বললেন আরব দুনিয়ায় অনেকেই তাদের পোষা পাখিদের কোর-আনের লাইন শেখায়। “আল্লহ আখবর” প্রভৃতি প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু উনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এই ডাক সেরকম কিছুই নয়, কোর-আনের লাইনও নয় বা আরবি ভাষা কোনওটাই নয়।
পাখির শেখানো ডাক শুনে মানে বোঝা অনেক সময়ই কঠিন হয়, কারণ মানুষের উচ্চারিত ধ্বনিগুলো পাখির ডাকে অনেকটাই পালটে যায়। আবার সেই ভাষা যদি অচেনা হয় তার ধ্বনিগুলো বোঝাও হয় কঠিনতর। শুধু প্রোফেসর খালিলিই নন ইশায়ু অনেকেরই পরামর্শ নিল। আফ্রিকান ভাষাবিদ ডঃ জেনাওয়ে ও বুঝতে পারলেন না যে পাখি কোন ভাষায় ডাকছে। প্রোফেসর নায়ার ও তার দলের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারাও শুনল পাখির সেই ডাক। অনেক বিচার বিশ্লেষণ সত্যেও তেমন কিছু উদ্ধার হল না।
এতে ইশায়ু একটু দমে গেলেও নিরাশ হল না। সে ভাবল যখন ভাষা বিশেষজ্ঞরাও এই ডাক বুঝতে পারলেন না হয়তো এই ডাক অন্তত কোনও চেনা ভাষা নয়। অথবা হয়তো এ এমন কোনও ভাষা যা আজ অবধি কেউ শোনেনি। হয়তো এই ভাষা কোনও অনাবিষ্কৃত উপজাতির যারা এই আরব জগতে বা আফ্রিকা মহাদেশের প্রত্যন্ত কোনও কোনায় বসবাস করে। যাদের খোঁজ হয়তো এখনও আমরা রাখি না। সে ঠিক করল, তাকে আবার বেরতে হবে। যদি এদেশের পাখিওয়ালাদের এই পাখির ছবি দেখিয়ে ডাক শোনান যায় তাতে হয়তো কিছু উদ্ধার হতে পারে। মাস্কাট্ শহরে ক-টি পাখির দোকান আছে। ও ভাবল ওখানে থেকেই শুরু করবে। সেখানে গিয়ে সে অনেককেই শোনাল সেই ডাক আর দেখাল পাখিগুলির ছবি। পাখিওয়ালারাও এরকম ডাক আগে শোনেনি। একজন তাকে বলল নিজওয়া শহরে খোঁজ করতে, সেখানে পাখির বড় হাট বসে। ইশায়ু তাই করল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। শুধু একজন তাকে বলল সে মুসান্দমে এক পাখি বিক্রেতাকে চেনে যে হয়তো এ ব্যাপারে কিছু জানলেও জানতে পারে। ইশায়ু ঠিক করল এবার তাকে ফিরতে হবে মুসান্দম।
ওদিকে মুসান্দমে স্বেতলানা বেশ একটা কাণ্ড করে বসেছে। এক স্থানীয় পাখিওয়ালাকে কাজে লাগিয়ে সেই বিশেষ ধূসর তোতাগুলোর একটিকে ধরে ক্যাম্পে এনেছে। সবাই ভাবছে স্বেতলানা এবার বুঝি পাখি পুষবে। কিন্তু পাখি পোষা স্বেতলানার উদ্দেশ্য নয়। তার ধারণা এই তোতাটিকে কিছু চেনা শব্দ শেখালে শব্দগুলি পাখির ডাকে কীরকম শোনাচ্ছে তা বোঝা যাবে। আর সেই সূত্র ধরেই উদ্ধার হবে অচেনা ডাকেরা রহস্য। একমাস সময়ে সে এই ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সাফল্যও পেয়েছে স্বেতলানা। মেশিন লার্নিং ব্যাবহার করে শব্দ বিশ্লেষণকারী একটি সফটওয়্যার সে বানিয়েছে। সেই সফটওয়্যার পাখির ডাক বিশ্লেষণ করে মানুষের গলায় তা শুনতে কেমন লাগবে সেটা বলে দিচ্ছে। এই কথা সে ইশায়ুকে লিখে জানাতেই সে ফিরে এল মুসান্দমে।
মুসান্দমে তার দেখা হল সেই পাখিওয়ালার সঙ্গে যার কথা সে নিজওয়াতে শুনেছিল। ঘটনাক্রমে তারই সাহায্যে স্বেতলানা তোতাটিকে ধরেছিল। তাকে ক্যাম্পে ডেকে আনা হল। সে স্থানীয় শিহু উপজাতির মানুষ। পরনে ওমানি আলখাল্লা, মাথায় পাগড়ি। সে জানাল তাদের পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে পাখি বিক্রেতা। ওরা এই বিশেষ পাখিগুলো আগেও দেখেছে। শুনেছে এই অদ্ভুত ডাকের কথা তার পূর্বসূরিদের মুখে। ইশায়ু একবার ভাবল তারাই বুঝি এই ভাষা শিখিয়েছে। কিন্তু পাখিওয়ালা জানাল যে সেই ডাক তাদেরও ঠিক ততটাই অচেনা। অনেক খোঁজার পর ইশায়ুর আশা করেছিল হয়তো এই রহস্যের সমাধান হতে চলেছে। কিন্তু পাখিওয়ালা ভাষা চিনতে অকপট অস্বীকার করায় সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই শেষ হল।
এই ঘটনার পর প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ওরা আর পাখি নিয়ে কোনও কথা বলল না। ইশায়ুকে অনুসন্ধান কাজের একটি রিপোর্ট বানাতে হবে। সেই নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওদিকে খননের কাজ শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। বড়জোর আর মাসখানেক। একদিন এক খনক এসে ইশায়ুকে দিয়ে গেল একটি ছোট্ট বর্গাকার বস্তু। বস্তুটি আকারে পাসপোর্ট ফোটোর মতো হবে, কিন্তু বেশ পুরু। ইশায়ু দেখেই বুঝতে পারল এটি হল একটি সীলমোহর, এক পিঠে রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার লিপি। সিন্ধু দেশের ব্যবসায়ীরা তাদের পাঠানো সামগ্রীতে নিজেদের পরিচয়ের ছাপ দিতে সীলমোহর ব্যাবহার করতেন। তা ছাড়াও পাওয়া গেল একটি গোলমরিচ ভরতি পোড়ামাটির বয়াম। বুঝতে অসুবিধে নেই যে সেই তাম্রপ্রস্তর যুগে এই অঞ্চলের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের যোগাযোগ ছিল, আদানপ্রদান করা হত বিভিন্ন সামগ্রী। এই নতুন আবিষ্কার ইশায়ুকে আরও ব্যস্ত করে তুলল। কিন্তু পাখির সেই ডাক কোনওভাবেই সে ভুলতে পারল না। মধ্যে মধ্যে আবার স্বেতলানার পাখিটা ওকে দেখলেই ডেকে উঠত আর যেন মনে করিয়ে দিত তার অসম্পূর্ণ কাজের কথা।
তারপর একদিন বিকেলে আগের মতোই ওরা বেড়াচ্ছিল সমুদ্রতীরে, ইশায়ু ভাবছিল সেই পাখিওয়ালার কথা। সে ভাষা বুঝতে না পারলেও নিজেরই অজান্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ওদেরকে বলে গেছে। কথায় কথায় ইশায়ু বলল,
‘তোমার কি মনে হয় না এই ভাষা বর্তমান কোনও ভাষা হতে পারে না?’
‘কেন?’
‘কারণ পাখিওয়ালা বলছে ওরা বহু প্রজন্ম ধরেই ওই ডাক শুনে আসছে, ঠিক কবে থেকে তার শুরু সে ব্যাপারেও সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া গেল না। তার ওপর এই ধ্বনিগুলো কোনও বর্তমান ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তা হলে ইউনিভারসিটিতে কেউ না কেউ তা বুঝতেন। আরেকবার শোনাও তোমার অ্যাপ্ থেকে পাওয়া লাইনগুলো।
“ইন-আন্যে রুবিতে উলিশীন
মেলুহারু হেতমা আরুমীন।”
স্বেতলানার ফোনেই ছিল অডিয়ো ক্লিপটি। সেটি ওরা আরেকবার শুনল। তৃতীয় ও ষষ্ঠ শব্দে মিল স্পষ্ট। পাখি যা বলছে তা হয়তো কোন কবিতা বা গানের লাইন। ক্লিপটি শুনতে শুনতে এবার ইশায়ু বুঝল রহস্যময় সেই ডাকের একটি শব্দ হতে পারে “মেলুহা”।
‘এই চতুর্থ শব্দটি যেন “মেলুহা”, কি বল?’ শব্দটি ইশায়ুর চেনা।
‘হ্যাঁ ঠিকই, ‘মেলুহা’ রয়েছে শব্দটিতে।’
‘কয়েক হাজার বছর আগে মধ্য প্রাচ্যের মানুষ এই সিন্ধু সভ্যতাকে এই নামে চিনত। প্রোফেসর জেনাওয়েকে ভাবছি আরেকবার শোনাবো লাইনগুলো। প্রাচীন অনেক ভাষা উনি জানেন, হয়তো কিছু বলতে পারবেন।’
সেদিনই সন্ধেয় প্রোফেসরকে পাওয়া গেল ভিডিয়ো কলে। উনি আগেই শুনেছিলেন পাখির ডাকের রেকর্ডিং, এবার সফটওয়্যার থেকে পাওয়া অডিও ক্লিপটি শুনলেন। খানিক গুনগুন করলেন, খানিক আওড়ালেন লাইনগুলো। তারপর চলে গেলেন লাইব্রেরিতে, ক-টি বই আনলেন। সেগুলি উলটেপালটে দেখলেন, তারপর বললেন মেলুহা শব্দটি নিয়ে তিনিও একমত, ভারতবর্ষের সঙ্গে এর যোগাযোগ থাকাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় লাইনে ‘আরুমীন’ শব্দটি দক্ষিণ ভারতীয় হতে পারে। বাকি শব্দগুলো তার অচেনা, তাই এখনই কবিতাটির মানে সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব নয়। উনি আরও বললেন,
‘আমরা শুনেছি চারণ কবিদের গানে, লোকগীতিতে প্রাচীন ভাষা লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় টুকরো ইতিহাসও থেকে যায় সেই সব ছড়ায় ও গানে। কিন্তু একদল বনের পাখিও বহুযুগ ধরে বংশানুক্রমে প্রাচীন কোনও কবিতা মনে রাখতে পারে এমনটা আগে শুনিনি। বড় অদ্ভুত তোমাদের এই আবিষ্কার।’
প্রোফেসরের কথাগুলো শুনে ইশায়ু খানিক শান্তি পেল। বিগত কয়েকমাস ধরে এই অবোধ্য ডাক ওদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। দুজনের অবিরাম জিজ্ঞাসায় ও অক্লান্ত প্রয়াসে আজ আর এই ডাক আর ততটা অবোধ্য নয়। এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আরও একটি সম্ভাবনা তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগাযোগের প্রমাণ সে আগেই পেয়েছে। ইশায়ুর মনে পড়ল প্রফেসর আস্কো পারপোলা এক সময় বলেছিলেন ‘আরুমীন’ শব্দটি সিন্দুসভ্যতার মানুষজন হয়তো ব্যাবহার করত। তারাই কি পাখি পোষ মানাত, শেখাত তাদের ভাষা? তারপর বিক্রি করতে আসত এই দেশে? পাখির এই গান কি তবে সিন্ধু সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া ভাষা বহন করছে? তাও কি সম্ভব?’
তবে আর যা-ই হোক দেশে ফেরার আগে বন্ধুদের বলার মতো একটি গল্প পেয়ে ইশায়ু খুব খুশি। স্বেতলানাও তোতা রহস্য ভেদ হওয়ার আনন্দ বারে বারেই সতীর্থদের জানাল। তার তোতাটিকে নিয়ে এখন কী যে করা যায়? আজকাল সে খাঁচার বাইরেই বসে বসে শেখান শব্দগুলি আনমনেই আওড়ায়। ওদিকে স্বেতলানারও দেশে ফেরার সময় এগিয়ে আসছে। এটিকে নিয়ে তো আর কীভ যাওয়া যায় না। সেখানকার আবহাওয়া একেবারেই আলাদা। একদিন ওরা ঠিক করল পাখিটিকে গুহার বনেই ছেড়ে দেবে। সেই মতো তাকে নিয়ে যাওয়া হল সেই বনে। প্রথমটা সে এদিক ওদিক তাকাল, ইতস্তত করল স্বেতলানাকে ছেড়ে যেতে। তারপর মানুষ আর পাখিদের মধ্যে সে বেছে নিল তার পুরানো পরিজনদেরই। বন্যেরা বনেই সুন্দর।
সীলমোহরের পিঠে সিন্ধু লিপির সঙ্গে দেখা যায় নানা রকম জীবের অবয়ব। যেমন হাতি, গণ্ডার, বলদ, এক শিঙা প্রভৃতি। ইশায়ু এতদিন বুঝতেই পারেনি অস্পষ্ট এই সীলমোহরটির উপরে রয়েছে একটি তোতাপাখি।
Tags: ইন্টারনেট, গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রদীপ্ত সাহা
Bhishon bhishon bhalo laglo Toton….
Aar o aar o emon lekha podte chayi…
Feeling so delighted to know this newly explored side of your talent ❤❤
সময় করে পড়ার ধন্যবাদ দিদি । চেষ্টা করব আরো লেখার ।
Duranto hoteche.
ধন্যবাদ ।
ভালো হয়েছে। ছোটবেলার কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার শখটা পূরণ করে ফেললি তাহলে
একটা চেষ্টা করেছি আর কি । তুই পড়েছিস দেখে ভাল লাগল।আরো দুএকটা লেখার ইচ্ছে আছে ।
বাহ! সুন্দর একটা প্লট। বিষয় বৈচিত্র্য! ভালো লাগল। আপনি আরও লিখুন।
ধন্যবাদ ।
শুধু একটা গল্প পড়ানো নয়, মাথায় অনেক নতুন ভাবনার সূত্রও দিয়ে দিলেন এটার মাধ্যমে। ভালো লাগল। চরৈবেতি।
এ আপনি আমাকে লজ্জা দিলেন । অনেক ধন্যবাদ পড়ে দেখার জন্য ।
কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করছেন কোন গল্পটি কোনো ঘটনা অবলম্বনে কি না । ব্যক্তিগত ভাবে এরকম কোন পাখির কথা শুনিনি । তবে এটেনবোরো সাহেবের এই ভিডিওটি আমাকে একসময় পাখিরা যে কতকিছু মনে রাখতে পারে সেই নিয়ে অনেকে কিছু শিখিয়েছিল ।এই পাখটিকে গল্পের ইন্সপিরেশন বলাই যায় ।
লিংক টি শেয়ার হয়নি দেখছি। এডমিন কে অনুরোধ করছি ভিডিও লিংক টি শেয়ার করার ।
Bhalo concept. Plot arektu interesting kara jeto.
আসলে বড় গল্প বা উপন্যাস করা যেত বলছেন কি ?
লেখক লিখেছেন-
আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন গল্পটি কোনো ঘটনা অবলম্বনে কি না ? বা আমার নিজস্ব কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে কি না । এখানে আমার বলার আছে যে এরকম পাখির কথা আমি শুনিনি । তবে এটেনবোরো সাহেবের একটি ভিডিও দেখে ছিলাম যাতে একটি পাখি আমাকে অনেক ইন্সপায়ার করে । https://youtu.be/mSB71jNq-yQ
ধন্যবাদ।
অসাধারণ toton । দারুণ রে।নতুন ভাবনা । কি ভালো লিখিস ।সাধু সাধু। আরো অনেক লেখ ।
খুব ভাল লাগলো তুই পড়েছিস দেখে । উৎসাহ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
বাহ্! বেশ ভালো লাগল পড়ে। এটা একটা পুরো size এর গল্প লেখার মতো প্লট তো! চালিয়ে যাও, আরো নুতন কিছু লিখলে জানাস্।
সত্যিই ভালো লেগেছে পড়ে, বৌ’কে পড়ে শোনাব।
ধন্যবাদ সুকা ।