নরকোচিত
লেখক: মোঃ নাবিদ নেওয়াজ
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
১
রোদের তীব্রতায় চোখ মেলে তাকানো যায় না। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে রাখতে হয়। আকাশ ভয়াবহ নীল। বউ বাচ্চা বাসায় রেখে পিঠে ছোট্ট কালো ব্যাগটাকে সঙ্গী করে এতো দূরে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু জীবিকার তাগিদে যেতেই হচ্ছে।
তাছাড়া আমাদের জীবনে নতুন অতিথি এসেছে। জীবন এখন আর আগের মত খামখেয়ালি করে চালানো যাবে না। এলিসাও এখনো সুস্থ হয়ে ওঠে নি। ওর জন্যেও ভালো মন্দ খাবার দরকার।পরিচর্যা দরকার।এই গ্রামে যা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ভাগ্যের সন্ধানে এই গ্রাম ছেড়ে পশ্চিমে আরিয়া ফিকো শহরে কাজের উদ্দেশ্যে যেতেই হচ্ছে।
১২৬৮ কি.মি এর ট্রেন যাত্রা। প্রায় দুইদিনের মত ট্রেনে কাটাতে হবে। যাত্রাপথটা কেমন কাটবে তা নিয়েও অসম্ভব ভয় লাগছে। আমি সাহসী হলেও দুঃসাহসী নই। গ্রাম থেকে এত দূরে যাই নি কখনো। তাছাড়া শহর সম্পর্কে লোকজনের কথাবার্তা বিভ্রান্তিকর। একজনের কাছে স্বর্গ, আরেকজনের কাছে নরক। তবে সবার মন্তব্য একটাই আরিয়া ফিকো টাকার শহর। কাজ মিলবে তাতেও কোন সন্দেহ নেই। তবে টাকা ধরে রাখাই সমস্যা। বেশ্যা, মদ, জুয়া কতো খাত পয়সা খরচ করার।
আমি এটা নিয়েও খানিকটা শঙ্কিত। আমার নারীঘটিত কিছু দূর্বলতা রয়েছে। তবে আশার কথা হলো বিয়ের পরে সেটা অনেক অংশেই কেটে গেছে। আর এখন এলিসা আর আমার বাচ্চার মুখ দেখে নিজেকে সামলে রাখার অসম্ভব একটা শক্তি হঠাৎ করেই পেয়ে গেছি যেন। সেই শক্তির বলেই এত দূরের পথ পেরোনোর সাহস পেয়েছি।
সকল শঙ্কাকে পেছনে ফেলে ট্রেনে উঠে পড়লাম।নীল দিগন্তের উদ্দেশ্যে যেন ঝকঝক করে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কেমন যেন একটা ক্লান্তিকর ছন্দ। এই ছন্দই নাকি কবি সাহিত্যিকদের মাতাল করে – পাগলছাগল সব!
জানালার পাশের সিটে বসে আছি। বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এখন আর অতটা গরম লাগছে না।
“এক্সকিউজ মি। জানালার পাশে বসতে পারি?” আমার পাশের ফর্সা মহিলার নাক ভিজে গেছে ঘামে। কোলে ছোট্ট বাচ্চা।সাত আট মাস বয়স হবে। মায়া লাগলো।
হাসি মুখে উঠে তার জায়গায় বসলাম সে আমার জায়গায় বসলো।
“কোথায় যাবেন?” মহিলাও হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো। গোলগাল মুখ। জীবনের কষাঘাতে চেহারায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। মুখের হাসিটা বিষণ্ণ। কোথায় যেনো এলিসার সঙ্গে মিল আছে। সাদা রঙের ফুলস্লিভ জামা পড়া। মাথায় রোদ থেকে বাঁচার জন্যে সস্তা হ্যাট।
“আরিয়া ফিকো। কাজ খুঁজতে যাচ্ছি শহরে।”
“আমি ভেলক্রিকে যাবো। ওর বাবা শহরে বাসা ভাড়া নিয়েছে। আমাদের নিয়ে এখন থেকে সেখানেই থাকবে।”
“বাহ! আপনাদের নতুন জীবনের সূচনা হতে যাচ্ছে। শুভকামনা আপনার আর আপনার ছেলের জন্যে।”
“আপনার ও তো নতুন জীবন শুরু হচ্ছে। আশা করি সফলতা পাবেন।”
“আমি সেবাস্তিয়ান রিক। শন ডাকতে পারেন।”
“আমি নিনা মার্লিন।” মহিলার হাসি সত্যিই সুন্দর। কেমন যেন একটা বিষণ্ণ হাসি।
মহিলা নিজের বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে শুরু করলো।
এরকম সহযাত্রী পেয়ে খানিকটা স্বস্তি লাগছে। যাত্রাটা সম্ভবত এতটাও খারাপ হবে না।এবার আশেপাশের সিটের যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
যাত্রার মাঝখানে চারবার ট্রেন থামবে। তখন খাওয়া দাওয়ার জন্যে নামতে হবে। অনেকেই সঙ্গে খাবার নিয়ে আসে। অনেকেই খাবার কিনে খায়। আমি খাবার নিয়ে আসার ঝামেলায় যাই নি। খাবার কিনেই খাবো।
মহিলা চেষ্টা করেও বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে পারছে না। অনবরত কেঁদে চলেছে সে। আমি নতুন নতুন বাবা হয়েছি। আমি জানি এই কান্না কিসের কান্না।
কিন্তু কিছু করার নেই। মহিলা এক্সট্রা একটা কাপড় দিয়ে বাচ্চাকে ঢেকে তারপর তার স্তন বের করে বাচ্চার মুখে দেয়ার পর বাচ্চাটা চুপ করলো। এই দৃশ্যে কোন কাম থাকার কথা নয়। মহিলার স্তন দেখা যায় নি। তবু আমি আমার পুরুষাঙ্গে পুরুষালি একটা অনুভূতির শিহরণ পেলাম।
লজ্জা লাগছে। আমি একজন বিবাহিত পুরুষ তবু নিজের উপর আমার সামান্যতম নিয়ন্ত্রণ নেই। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইলো।
বাইরে রোদ বাড়ছে।তবে ট্রেনের গতির কারণে গা জুড়ানো বাতাস ও লাগছে।মনোযোগ সরানোর জন্যে বাইরে চোখ রাখলাম। যতদূর চোখ যায় ধূসর মাঠ। এত বেশি ধূসর যে মরীচিকা দেখা যায়। চোখ জ্বালা করে দূরে তাকালে। দৃষ্টি আবার ভেতরে ফিরিয়ে আনলাম।
বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। মহিলাও ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহিলা বুকের দিকে চোখ চলে গেলো। বেশ বড়। সেই সঙ্গে পরিপুষ্ট। এলিসার বুকের মাপের মতই মাপ হবে। তবে এই মহিলার ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে। এলিসার ক্লিভেজ এতটা কখনোই বের হয়ে থাকে না।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে খারাপ চিন্তা মন থেকে দূর করে দিতে চাইলাম। এলিসা আর আমার বাচ্চার চিন্তা করা শুরু করলাম। এটা যে কোন খারাপ সিচুয়েশনে কাজে দেয়।
ছোট্ট একটা শহরে ট্রেন থামলেও মহিলা ঘুমিয়ে রইলো। আমি ডেকে তুললাম। এখানে এক ঘন্টার জন্যে ট্রেন থামবে। এই শহরের মানুষ ট্রেনের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। দিনে যে কয়েকবার ট্রেন এখানে থামে সে কয়েকবার শহর সরব হয়ে ওঠে। আমি মহিলাকে নিয়ে নামলাম।
সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। এস্টারভিলা। জনসংখ্যা ১১২। মাত্র একশো বারো জন নিয়ে একটা শহর। খুব চমৎকার।
বাড়িগুলো রোদের তাপে চকচক করছে। কেমন যেনো একটা উজ্জ্বল ধূসর সব কিছু।আমরা খাবারের দোকানে ঢুকে দুপুরের খাবার অর্ডার করলাম।
লাল চুলো ওয়েট্রেস এসে খাবারের সঙ্গে সুন্দর হাসি উপহার দিলো।
“তোমার স্ত্রী খুব সুন্দর।বাচ্চাটাও সুন্দর।তোমার মতই হ্যান্ডসাম হবে বড় হলে।”
আমি খানিকটা বিব্রত বোধ করলাম। কাস্টমার খুশি করার প্রাচীনতম ট্রিক। আমি আর যাই হই হ্যান্ডসাম না।মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে হাসছে।
“লজ্জা পাওয়ার কি আছে শন? আমি মেয়ে হয়ে লজ্জা পাচ্ছি না আপনি ছেলে হয়ে লজ্জা পাচ্ছেন।”
আমিও হাসার চেষ্টা করলাম।
“আরেহ না।” মহিলার আচার আচরণ দারুণ। কেমন যেন নিষ্পাপ নিষ্পাপ ভাব আছে। এই মহিলাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করার জন্যে আবার নিজেকে ধিক্কার দিলাম।
রাতে খাবার জন্যে কিছু খাবার আর আমার জন্যে কিছু তামাক কিনলাম। সারাদিন আমার তামাক না ফুঁকলেও চলে। কিন্তু রাত পাইপ টানতেই হয়।
ট্রেনে উঠে গল্প গুজব করতে করতে রাত হয়ে গেলো। আমি এখন জানালার কাছে বসেছি। চুরুটের ধোঁয়া খুব কৌশল করে বাইরে পাঠাতে হচ্ছে।
২
দিনের বেলা যেরকম অতিরিক্ত তাপমাত্রা ছিলো রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেমনি ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। জ্যাকেট গায়ে। চাদর দিয়েও কাজ হচ্ছে না।সব গুলো জানালা বন্ধ।চুরুট টানাও বন্ধ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম ঠিক বলতে পারবো না।
হঠাৎ চাদরের ভেতরে দিয়ে গায়ে একটা স্পর্শ পেলাম। প্যান্টের চেন খুলে কে যেন আমার যৌনাঙ্গ ধরে ফেললো। তারপর আন্ডারওয়্যার নামিয়ে হ্যান্ডজব শুরু করলো। পাশে বসা মহিলার হাতে বাচ্চাটা নেই।
মহিলার উষ্ণ হাত আরো উষ্ণ হতেই আমি ঝাঁকি দিয়ে উঠে পড়লাম।
মহিলার কোলে বাচ্চা। গায়ের সঙ্গে এমন ভাবে বাধা যাতে ঘুমের মাঝে পড়ে না যায়। মহিলা দিব্যি ঘুমোচ্ছে। আমি মাথা ঝেঁকে আবার মাথা ঠিক করার চেষ্টা করলাম। পুরুষ মানুষ হওয়ার বিড়ম্বনা টের পাচ্ছি। আমি ভালো মানুষ না হলেও খারাপ মানুষ নই। বউ বাচ্চা আছে এমন লোকের স্বপ্নদোষ হওয়া খারাপ মানুষের লক্ষণ। অবশ্য এলিসার প্রেগনেন্সির ছয়মাস থেকে এই পর্যন্ত গোটা দীর্ঘ সময়টাই সেক্স না করে থাকতে হয়েছে আমাকে। আমার মাঝে খানিকটা কামনা জেগে উঠা অস্বাভাবিক কিনা জানি না।
৩
চোখ মেলে তাকালাম। মাত্র ভোর হলো। এখনো ঠান্ডা ঠান্ডা দিন আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। আমি যে বোকামিটা করেছি তা হলো খাবার কিনেছি কিন্তু পানি কিনি নি। মহিলার কাছে পানি আছে কিন্তু ঘুম থেকে তুলে পানি খেতে মন সায় দিচ্ছে না। প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে।
জানালায় ঠক ঠক শব্দ হলো।কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে আমি হালকা করে জানালা খুললাম। যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।আকাশে হাজার হাজার চিল। গোল করে ঘুরছে। জানালায় শব্দটা কিসের হলো সেটা আর বুঝতে পারলাম না। তবে ট্রেন চলেছে পাহাড়ের উপর দিয়ে।পাহাড়ের খাড়াই এতো বেশি ঢালু যে আমি সিট থেকে খানিকটা উঠেও এই ঢালের শেষ দেখতে পেলাম না।
এরপরের দৃশ্যটা আরো অশুভ লাগলো আমার কাছে। সাতটা চিল নীল আকাশে একটা ছোট চক্র সৃষ্টি করেছে। আর ওদেরকে কেন্দ্র করে খানিকটা জায়গা বাদ রেখে আরো হাজার হাজার চিল উড়ছে। দৃশ্যটায় এমন কিছু ছিলো আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
ভেতরের দিকে তাকিয়ে আমি আরেকবার চমকে গেলাম। মহিলার সাত আট মাসের বাচ্চাটা চুপ করে তাকিয়ে আছে। যেনো কোন অশনি সঙ্কেত সে ও পাচ্ছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। তবে সে চোখে পরিণত মানুষের দৃষ্টি। সে ও যেন জানাল দিয়ে চিলগুলো দেখছে।
জানালা দিয়ে মাথা বের করে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম।
আর যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেপে গেলো। প্রত্যেকটা জানালায় বানরের মতো কুৎসিত দুটো তিনটে করে প্রাণী ঝুলে আছে। আকারে একটা বাচ্চা বানরের মতো হবে। তবে আমি নিশ্চিত জিনিসটা বানর নয়। বানরের মাঝে যে চঞ্চল চটপটে ভাব থাকে সেটা এদের মাঝে নেই। কেমন যেনো শান্ত সৌম্য একটা ভাব। যেন সবগুলোই মৃত। কোন শয়তান এদের চালনা করছে।
জানালায় শব্দের রহস্য ভেদ হয়ে গেল। আমার জানালার উপরে আর আশে পাশে তিন তিনটা প্রাণী দেখতে পেলাম।কি হচ্ছে এসব?
ভাবার সুযোগটাও ঠিক মত পেলামনা। বিকট শব্দ হলো। ট্রেন প্রচন্ড রকম ঝাকি খেলো। বগি ট্রেন থেকে ছিটকে পাহাড়ের তলদেশে পড়তে লাগলো। কেউই সিটে স্থির থাকতে পারলো না। একবার ছাদের সঙ্গে একবার সিটের সঙ্গে উথাল পাথাল ছিটকে যেতে লাগলো একেকজন। আশ্চর্যের ব্যাপার কারোর ঘুম ভাঙলো না। আমি কোন আঘাত পেলাম কিনা জানি না। তবে প্রচন্ড ঘুমে চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো।
৪
কতক্ষণ পরে ঘুম ভাঙলো আমি বলতে পারবো না। তবে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারলাম না আমি কোথায় আছি। বেঁচে আছি না মরে গেছি? নিজেকে আবিষ্কার করলাম ট্রেনের মাঝেই। তবে ট্রেন এমন ভাবে দুমড়ে মুচড়ে গেছে যে আগে থেকে না জানলে এটাকে ট্রেন বলার উপায় নেই। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই।আমি ডাকলাম।
“হেই….কেউ বেঁচে আছেন?” গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।শব্দ বের হতে চাইলো না। কেউ জবাব দিলো না। খুব সম্ভবত কেউ বেঁচে নেই। আমি কিভাবে বেঁচে আছি? ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন?
আবার ডাকলাম,
“হেই…..!”
এবার আমার মনে হলো আমার তো আগে নিজেকে চেক করা উচিত। উপুড় হয়ে যেভাবে মেঝের সঙ্গে লেগে পড়ে আছি তাতে সত্যিই বেঁচে আছি কিনা সন্দেহ হচ্ছে।
হাত ঠিক আছে।শরীরের হাড় গোড় প্রায় সব গুলোই ঠিক আছে। একটা বাদে। আর ওই একটা জিনিস এতোই ভয়াবহ যে আমি সেটা পরীক্ষা করার সাহস পেলাম না।
আমার ডান পা সামনের আর পেছনের সিটের চাপে হাটুর খানিকটা নিচে দুভাগ হয়ে গেছে প্রায়। তারপরেও কিছুটা আটকে আছে। আমি চুপ করে শুয়ে পড়লাম।
এতক্ষণ টের পাই নি। বাইরে ভয়াবহ রোদ। ট্রেইনের ভেতরটা এতো বেশি তাতিয়ে গেছে যে দোজখ মনে হচ্ছে। লোহাগুলো গরম হয়ে তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমি দেখলাম আমার গাল আর হাতের তালু মেঝের সঙ্গে লেগে আছে জন্যে সেখানে ফোসকা পড়ে গেছে। অজ্ঞান ছিলাম সেজন্যে টের পাই নি।
ছ্যাকা খেয়ে গাল তুলে ফেললাম। জ্যাকেটটা আছে জন্যে রক্ষা।তবে একবারে উঠতে পারলাম না। পা টা অল্প একটু আটকে আছে।
দাতে দাত চেপে টান দিয়ে আটকে থাকা মাংশ পেশি আর লিগামেন্ট ছিড়ে ফেললাম।
ব্যাথায় মাথা বন বন করে উঠলো। চিৎকার বেরিয়ে এলো আপনা আপনি।
গরম উপেক্ষা করেই পড়ে রইলাম কিছুক্ষণ। অসহ্য রকম ব্যথা।
ব্যথার ধাক্কা কমে আসার জন্যে অপেক্ষা। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে সদ্য হারানো পা টার দিকে তাকালাম।কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকলাম।
এখন পানি খুঁজতে হবে।আমার পানি আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।মহিলার পানির বোতল খুঁজতে লাগলাম। নেই।কোথায় উড়ে চলে গেছে কে জানে।
এক পায়ে হাটা খুব কষ্ট সাধ্য।তাছাড়া রক্তক্ষরণেও দূর্বল হয়ে গেছি।প্রতিবার নড়াচড়ায় অসহ্য রকম ব্যথার ঢেউ বয়ে যায় সারা শরীরে।
দুই কদম হেঁটেই আমি বুঝে গেলাম হাঁটা সম্ভব না।ঘষটে ঘষটে পানির খোঁজ করছি।কোথাও একটুও পানি মিললো না। যাত্রীদের বিকৃত লাশ দেখে আমার মাথা আবার বনবন করে ঘুরছে।আমি অনেক কষ্ট করে আরো কয়েক কদম হাঁটলাম। পানির চাহিদা সমম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চাহিদা।
খানিকটা যেতেই দেখলাম আমার পাশে যে মহিলা ছিলো সে পড়ে আছে। তার কাছে গেলাম। মহিলার সারা শরীরের ক্ষতের দাগ থাকলেও সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেয়েছে মাথায়। বাকিগুলো এতো গুরুতর নয়। মহিলার জ্ঞান নেই।তবে নিঃশ্বাস চলছে। তার মানে মারা যায় নি। তবে তার বাচ্চাটা একদম থেতলে গেছে।বাচ্চাটার শ্বাস চলছে না।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো দরজা দিয়ে বের হতে হবে কেন? জানালা কি দোষ করলো?সব জানালা বন্ধ জন্যে এই বুদ্ধি প্রথমেই মাথায় আসে নি।
উপায় খুঁজতেই উপায় পাওয়া গেছে।
একটা জানালা সুবিধাজনক মনে হতে সেটা দিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো উনুন থেকে চুলায় নেমে এসেছি। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে পানি তো দূরের কথা কোন সবুজের চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
পাহাড়টা এত বেশি ন্যাড়া যে অস্বস্তি লাগে।পাহাড়ের তলদেশ থেকে মরুভূমি চলে গেছে কতদূর কে জানে?
জায়গায় জায়গায় শকুন চিল উড়ছে মাথার উপর।বুঝলাম সে সব জায়গায় বাকি বগিগুলো পড়েছে।আমার মাথার উপর তাকাতেই দেখলাম কিছু চিল জমতে শুরু করেছে।পানির পাশাপাশি আরেকটা জিনিসের দরকার অনুভব করলাম – আগুন।
এখান থেকে কেটে পড়ে আগুন জ্বালতে হবে।
আমি আবার ভেতরে ঢুকলাম।আমার সঙ্গে যে মহিলা বসে ছিলো তাকে জাগানোর চেষ্টা করলাম।দুই তিন মিনিট পর খুব কষ্ট করে চোখ খুললো।
তারপর কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। ভালো করে শুনতেই বুঝতে পারলাম তার বাচ্চার কথা বলছে।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
মহিলা মাথায় আঘাত পেয়ে এখনো কোন কিছু ঠিক মত চিন্তা করতে পারছে না। এটা আমার জন্যে ভালোই হয়েছে। বাচ্চার শোকে পড়লে এই মহিলাকে নিয়ে কিছুই করা যাবে না।
এক পা হারানোর পর এখন আমার এই মহিলাকে দরকার – খুব দরকার। সে চেষ্টা করে উঠে বসলো। আমি একটা লাশের গা থেকে শার্ট খুলে তার মাথা বেঁধে দিলাম। আর আমার পা বাঁধলাম একটা মেয়ের গাউনের টুকরা দিয়ে।
মাপ মতো দুই টুকরা লোহার পাত নিলাম।
মহিলা তার বাচ্চা তার কোলেই বাধা আছে দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। বাচ্চা যে বেঁচে নেই এটা তার মাথায় ঢুকছে না।
আমরা বের হলাম আগের জানালা দিয়ে।প্রথমে সে বের হলো। তারপর আমাকে বের হতে সাহায্য করলো।মহিলার মানসিক অবস্থা খারাপ হলেও শারীরিক অবস্থা ভালো। অন্তত আমার চেয়ে ভালো। সে আমাকে হাঁটতে সাহায্য করলো।পাহাড়ের তলদেশের দিকে এদিকে একদম ন্যাড়া হলেও অপরদিকটা পাথুরে।
খুঁজতেই একটা গুহা পেয়ে গেলাম। সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত সেখানে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মহিলা শুধু আমার সঙ্গে হাঁটলো। কিচ্ছু বললো না।নিজের প্রবৃত্তির জোরে যা করার করছে।
গুহার মেঝেতে কিছু খড়কুটো ছিলো। সেগুলো দিয়ে আগুন জ্বাললাম।এতে লোহার পাতটা অবশ্য কাজে লাগলো না। কারণ আমার কাছে সিগারেট খাওয়ার দেশলাই ছিলো।খানিকটা ছায়া পেয়ে আমি মহিলাকে শুয়ে পড়তে বললাম।
সে বাধ্য ছেলের মত তার বাচ্চাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো।
আমি আগুন জিইয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানি না। ঘুম থেকে উঠেও দেখলাম ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে।
তবে বাইরে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে।বাইরে অজস্র শব্দ শোনা যাচ্ছে, যা আমি আগে শুনি নি। পিপাসায় আমার বুক থেকে শুরু করে সারা গলা শুকিয়ে গেছে।জিহ্বা অনুভব করতে পারছি না।
আগুনটা এখনো জ্বলছে।মহিলা এখনো ঘুমাচ্ছে।পানির পিপাসা এতো বেশি হতে পারে আমি ভাবতেও পারি নি।একবার মনে হলো নিজের পা থেকে যে রক্ত চুয়ে পড়ছিলো তা যদি পেতাম তাহলে তা ই খেয়ে ফেলতাম।তবে রক্ত শুকিয়ে গেছে।
আমার মাথায় হুট করেই একটা খেয়াল এলো।মানবমন এতো অদ্ভুত অদ্ভুত সমাধান বের করতে পারে কে জানতো? জিনিসটা অসম্ভব রকম খারাপ।আমি জানি জিনিসটা খারাপ।কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে আর কোন উপায় নেই।
আমি মহিলার কাছে গিয়ে দেখলাম এখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
তার বুকের কাপড় সরাতেই তার পরিপুষ্ট স্তন বেরিয়ে এলো।
মুখটা নামাতে যাবো এমন সময় আগুনের হালকা আলোয় দেখলাম থেতলে যাওয়া বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি আমার অসম্ভব শুষ্ক বুকেও কাঁপন ধরিয়ে দিলো।
******************
Tags: অলৌকিক গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, মোঃ নাবিদ নেওয়াজ, সুপ্রিয় দাস