নাট বল্টু বানাল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার – নিকোলাই নোসভ
লেখক: লেখক - নিকোলাই নোসভ, বাংলা অনুবাদ – শুচিস্মিতা দাশগুপ্ত
শিল্পী: ছবি - ইয়েভগেনি মিগুনোভ, শীর্ষচিত্র - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
যারা ‘আনাড়ির কাণ্ডকারখানা’ পড়েছ তারা আনাড়ির মতোই তার বন্ধু টুকুনদেরও তো চেনো। তাদের সেই দুই কারিগর নাট আর বল্টু, যারা কিনা নানান নতুন জিনিস বানানোয় ওস্তাদ, একবার ঠিক করল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বানাবে।
তারা দুই ভাগে দুটো গোল গোল ধাতুর বাক্স বানাল। একটা ভাগে পাখার সঙ্গে একটা ইলেকট্রিক মোটর বসালো আর অন্যটায় লাগাল রবারের নল। দু-ভাগের মাঝে আটকে দিল একটুকরো কাপড়ের পুরু আস্তরণ, যাতে ধুলো-টুলো সব ভেতরেই আটকে থাকে।
সারা দিন-রাত কাজ করে পরদিন ভোরবেলাতেই ওদের ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা তৈরি হয়ে গেল।
সবাই তখনও ঘুমোচ্ছে, তবু নাট-বল্টু ভাবল ক্লিনারটা পরখ করেই দেখা যাক। ‘প্রথমে শোয়ার ঘরের কার্পেটটা পরিস্কার করা যাক’ বল্টু পরামর্শ দিল।
ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা চালু করতেই কার্পেটের সব ধুলো উড়ে এসে নলে ঢুকতে শুরু করল। কিন্তু হাওয়ার বেগ এত বেশি ছিল যে বিছানার তলায় পড়ে থাকা ক্যাবলাকান্তের মোজা নলে এসে এঁটে গেল।
এরপর টেবিলের ওপর থেকে বটিকা ডাক্তারের হাতঘড়িটা এক ঝটকায় ছিটকে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ভেতরে চলে গেল। ঘুমচোখে নাট আর বল্টু এসব কিছুই লক্ষ্য করেনি। টেবিলের নীচে আঁকিয়ে তুলিবুলির এক বাক্স রং দাঁড় করানো ছিল। নাট টেবিলের তলাটা পরিষ্কার করার পর বাক্সের রঙের সংখ্যা বেশ অনেকখানি কমে গেল।
‘এবার জামাকাপড় সাফাই করা যাক’ বলে নাট ব্যস্তবাগীশের কোট পরিষ্কার করতে শুরু করল। কোটের ধুলোর সাথে সাথে বোতামগুলোও নলে এসে ঢুকল। এরপর ওরা পিঠেপুলির পাতলুন পরিষ্কার করতে গেল। পিঠেপুলির পকেটে সবসময়ই কিছু না কিছু মিঠাই থাকত। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা এতই জোরালো ছিল যে মিঠাইগুলো পকেট থেকে বেরিয়ে ওর ভেতরে ঢুকে গেল। শেষে চৌকসের কোট পরিষ্কার করতে গিয়ে বল্টু লক্ষ করল যে, কোটের পকেট থেকে চৌকসের ঝরনা কলমটা ছিটকে বেরিয়ে ভেতরে চলে গেছে। সে কাজ বন্ধ করে দিতে চাইছিল, কিন্তু নাট বলল : ‘আরে, বাদ দাও! ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা যখন খুলব তখন বার করে নেব।’
‘তাহলে এবার সোফাটা সাফা করা যাক’ বল্টু বুদ্ধি দিল।
ওরা সোফা পরিষ্কার করতে গেলে প্রথমেই কাঠামো থেকে পেরেকগুলো লাফিয়ে বের হয়ে এসে নলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। এতে পুরো কাঠামোটাই ধীরে ধীরে ধসে পড়ল। স্প্রিংগুলো ছিটকে বেরিয়ে এল, পেছনের হেলান দেওয়ার জায়গাটা টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়ল, গোটা সোফাটার স্প্রিংশুদ্ধু ভেতরের যত মালমশলা সব নলের ভেতরে ঢুকে গেল। শেষমেশ সোফার পায়াটা ভেঙে নলে আটকে যাওয়ায় ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা জিনিসপত্র শুষে নেওয়া বন্ধ করল।
‘ঠিক আছে’, নাট বলল, ‘এখন শুয়ে পড়া যাক। জেগে উঠে পেরেকগুলো বের করে সোফাটা মেরামত করে ফেলব।’ দুই বন্ধু শুয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্যাবলাকান্ত সবার আগে নিজের মোজাজোড়া খুঁজতে বসল। ও হামেশাই নিজের জিনিস হারিয়ে ফেলে বলে বাকি সকলে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল।
এরপর বক্কেশ্বর উঠে দাঁড়াতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেখল যে তার পাতলুনটাই হারিয়ে গেছে।
এদিকে হয়তোর জামায় একটাও বোতাম ছিল না। বোতাম ছাড়া ওগুলো জায়গামতো থাকছিল না বলে তাকে পাতলুনটা দুহাতে ধরে ধরে হাঁটতে হচ্ছিল।
মোদ্দাকথা সক্কলেরই কিছু না কিছু হারিয়েছিল।
একমাত্র আনাড়িরই কিছু খোয়া যায় নি।
ব্যস্তবাগীশ বলল : ‘নির্ঘাত এসব আনাড়ির কারসাজি, দেখছ না ওর কিছুই হারায়নি!’
‘ভাইসব এটা মোটেও আমার কীর্তি নয়!’ আনাড়ি চেঁচিয়ে উঠল, ‘কালকে আমি জামাকাপড় পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আসলে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে জামাকাপড় ছাড়তে বেজায় আলিস্যি লাগছিল।
শেষমেশ চৌকস ঘরের এককোনে সোফার-ভাঙা-পায়া-আটকানো-নলওয়ালা রহস্যজনক একটা যন্ত্র আবিষ্কার করল।
নিঃসন্দেহে এটা নাট আর বল্টুর কম্ম বুঝতে পেরে চৌকস ওদের ঘুম থেকে ডেকে তুলল।
নাট-বল্টু উঠে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা খুলতেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র বেরিয়ে পড়ল।
‘আসলে আমরা একটু বেশি জোরালো মোটর লাগিয়ে ফেলেছি’ বল্টু বলল, ‘ওটার জোর একটু কমালেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা বড়সড় জিনিসপত্র টানা বন্ধ করবে।’
এইবার ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের দিকে বিরাট লম্বা লাইন পরে গেল। যে যা হারিয়েছিল সবাই সব একে একে পেয়ে গেল। ক্যাবলাকান্ত – মোজা, হয়তো আর ব্যস্তবাগীশ – তাদের বোতাম, বক্কেশ্বর – তার পাতলুন। শেষে আনাড়ি নাট-কে বলল, ‘দোহাই তোর, দ্যাখ তো, গেলবার গরমকালে আমার যে হুইসিল বাঁশিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম সেটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে আটকে আছে কিনা?’
সক্কলে আনাড়ির কথায় বেজায় হাসতে লাগল। নাট কিন্তু অন্যান্য জিনিসের মধ্যে হঠাৎ আনাড়ির বাঁশিটা খুঁজে পেয়ে গেল। সবাই ভারি অবাক। কেউ বুঝতেই পারছিল না, গত বছরের হারানো বাঁশি ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে কেমন করে এসে ঢুকল। যা-ই হোক, গত বছর ভ্যাকুয়াম ক্লিনারই তো ছিল না!!
অনুবাদ প্রসঙ্গে:
নিকলাই নোসভ-এর (Николай Николаевич Носов) (Nikolai(y) Nikolaevich Nosov) জন্ম ২৩ নভেম্বর ১৯০৮ কিয়েভ-এ, মৃত্যু ২৬ জুলাই ১৯৭৬ মস্কো-য়। তিনি ১৯৩২-এ মস্কো ইউনিভার্সিটি অফ সিনেমাটোগ্রাফির স্নাতক। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রচুর জনপ্রিয় গল্প উপন্যাস লিখেছেন। ১৯৫৩-৫৪ সালে নোসভ তাঁর জনপ্রিয়তম চরিত্র আনাড়ি, রুশভাষায় নেজনাইকা (Незнайка) বা ইংরেজিতে ডান্নো (Dunno) ও তার বন্ধুদের কীর্তিকলাপ নিয়ে প্রথম শিশুপাঠ্য উপন্যাস ‘আনাড়ির কাণ্ডকারখানা’ (The Adventures of Dunno and His Friends) রচনা করেন। এই সিরিজের পরবর্তী দুটো উপন্যাস সূর্যনগরীতে আনাড়ি (১৯৫৮) ও চাঁদে আনাড়ি (১৯৬৪-৬৫) রচনার আগেই তিনি বর্তমান ছোটো গল্পটি লিখে ফেলেন ১৯৫৬ সালে। ১৯৬০ সালে এটির একটি চিত্রনাট্যও লেখেন তিনি যা পিটার নোসভের পরিচালনায় ২০ মিনিটের অ্যানিমেশন ফিল্ম হিসেবে প্রকাশ পায় ১৯৬০ সালেই।
গল্পটি ছবির বই হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ইয়েভগেনি মিগুনোভ-এর আঁকা ছবি সহ ১৯৬০ সালে। বর্তমান অনুবাদটি সেটির গুগুল ট্রান্সলেট কৃত ইংরেজি তর্জমা থেকে একজন আনাড়ি-ভক্তর করা। মূল রুশভাষার সাথে মিলিয়ে দেখে সংশোধন করে দিয়েছেন স্বয়ং অরুণ সোম। পরে ছবির বইটি ২০০০ ও ২০১৩ সালে পূণর্মুদ্রিতও হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: নিকোলাই নোসভ, ইয়েভগেনি মিগুনোভ, বইটির রুশি প্রকাশকগণ
Tags: অনুবাদ কমিকস, ইয়েভগেনি মিগুনোভ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, নাট বল্টু বানাল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, নিকোলাই নোসভ, রাশিয়ান অনুবাদ গল্প, রাশিয়ান কমিকস, শুচিস্মিতা দাশগুপ্ত
খুব ভাল লাগল।
খুব ভালো অনুবাদ। ভালো লাগল
খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।