নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
লেখক: পার্থ সেন
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
[১]
প্রায় আট নয় বছর পরে নির্ঝরকে দেখে সেদিন আমার চিনতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। নির্ঝরকে আমি লাস্ট দেখেছি সেই জেলাস্কুল থেকে ও যখন পাশ করে বেরোল, তারপর ও কলকাতা চলে গেল এগারো বারো ক্লাস পড়তে আর সেই থেকে সব যোগাযোগ সব বিছিন্ন। তখন মোবাইল বা আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়ার এই আধিপত্যও ছিল না, সুতরাং বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গুলোকে নদীতে বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। কিছু সম্পর্ক অবশ্য ভাঁটার টানে আবার ফিরে এসেছে তবে বেশীর ভাগ গুলোই জোয়ারের স্রোতে কোথায় হারিয়ে গেছে এখন আর খুঁজে পাই না। যাই হোক, আমি তখন স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা দিয়ে সবে মাত্র বীরভূমের এক স্কুলে চাকরী পেয়েছি। আমি ছিলাম ইতিহাসের শিক্ষক, মানে এখনো আছি, তো সেখানেই নির্ঝরকে আমি ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে আমি জয়েন করার এক মাসের মধ্যে হেডস্যার আমাকে ক্লাস এইটের কোন এক সেকশনের ক্লাস টিচারের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন, আর সেখান থেকেই নির্ঝরকে কাছে থেকে চিনেছিলাম। আমার বারো তেরো বছরের প্রফেশনাল লাইফের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যে কারনেই হোক স্কুলে ইতিহাস বা ভূগোল এই সব বিষয় গুলো একটু অবহেলিত থাকে। কারণ বেশীর ভাগ ছাত্রের বাবা মার তাকে ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার করবার একটা সুপ্ত বাসনা থাকে। সুতরাং ম্যাথস, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজির গুরুত্ব অনেক বেশী ধরে নেওয়া হয়। এতো কিছু করবার পর ইংরাজী এবং বাংলার চাপ, ভূগোল, ইতিহাস পরীক্ষার আগে দুদিন ছাড়া বেশীরভাগ ছাত্রের পড়া হয়ে ওঠে না। সুতরাং মহাত্মা গাঁধির ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আকবরের শাসন ব্যবস্থার উত্তর লেখার সময় অনেক কাল্পনিক ঘটনা বা ব্যাখ্যার অবতারনা ছাত্রদের উত্তরপত্রে হয়েই থাকে, আমার মতো ইতিহাসের শিক্ষকেরা তাতে কিছু মনে করেন না।
যাহোক, আমার এখনো মনে আছে, ২০০৩ কি ২০০৪ হবে, পুজোর আগে পরীক্ষা হয়ে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমরা শিক্ষকেরা ছাত্রদের উত্তরপত্র বগলদাবা করে বাড়ি এলাম। স্কুল খোলার আগে সব কারেকশন করে মার্ক্স বসাতে হবে। আগেই বলেছি ইতিহাস পরীক্ষা মানেই ছাত্রদের মনগড়া কিছু কাহিনী থাকবেই খাতায়, আর ছাত্রদের দোষ দেওয়া যায় না। পাঁচ নম্বর মার্ক্স থাকলে দু লাইন লিখে তো আসা যায় না! বেশ চোদ্দ পনের টা খাতার দেখার পর একটা খাতা এসেছিল। হাতের লেখা মুক্তোর মত আর প্রতি কটা উত্তর একেবারে যথাযথ! কোন অতিরিক্ত কথার ব্যঞ্জনা নেই, কোন বাহুল্য নেই, ঠিক বইয়ে যেমন থাকে একেবারে হুবুহু সেই রকম। আশ্চর্য লাগল, জেলা স্কুলে জয়েন করার আগেও আমি দু তিন বছর শিক্ষকতা করেছি, আর আমি নিজেও একদিন ছাত্র ছিলাম। কিন্তু এইরকম ‘ইতিহাস পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখা তো দূরের কথা, আমি কোনদিন শুনিওনি। প্রথম পাতায় নামটা দেখলাম, নির্ঝর গুপ্ত, রোল নম্বর – ২। আমার সেকশনের ছাত্র যদিও মুখটা ঠিক মনে পড়েনি। রোল নম্বর ২ মানে ক্লাসের প্রথম দিকের ছাত্র, হয়তো ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়, সুতরাং কোন অসৎ উপায়ে অন্য কোথাও থেকে নকল করেছে সেটা ভাবার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এত যথাযথ উত্তর সে দিল কি করে? নম্বরগুলো যোগ করে দেখলাম আশিতে সাতাত্তর এসেছে। তিন নম্বর কাটতেও বেশ কষ্ট হল। পরের নম্বর উনষাট, জানি এই নম্বর দেখে হেড স্যার আমাকে ডেকে পাঠাবেন কিন্তু ন্যায্য নম্বর না দিয়ে থাকি কেমন করে?
পুজোর পর স্কুল খোলার সাথেই সাথেই চিনলাম ছেলেটিকে, টিফিনের সময় ছেলেটিকে দেকে পাঠালাম আমাদের টিচারর্স রুমে। রোগা পাতলা চেহারা, বেশ বেশ আস্তে কথা বলে, ক্লাস ওয়ান থেকেই সে এখানে পড়ছে, আমার অনুমান সঠিক। শুরু থেকেই সে ক্লাসে ফার্স্ট, সেকেন্ডের মধ্যে থাকে, অন্য সাবজেক্টেও তার মার্ক্স খুব ভালো থাকে। ছেলেটির বাবা গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর হল, বাবা মায়ের এক ছেলে, মায়ের সঙ্গে সে থাকে সিউড়ী সদর হাসপাতালের কাছে। মা কম্পেন্সেটারি গ্রাউন্ডে বাবার চাকরীটা করেন। নিজের সন্দেহ দূর করার জন্য ওর সঙ্গে একটা মেমারি গেম খেললাম। ‘বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম মনে রাখা’আমরা ছোটবেলায় খুব খেলতাম, এগারো রাউন্ডের পর তার কাছে আমাকে হার স্বীকার করতেই হল। এবারে আরো একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম এবারে উল্টো করেও সে সব কটা নাম বলে দিল, মানে লাস্টে যে নামটা বলেছি সেটা প্রথমে আর যেটা ফার্স্টে বলেছি সেটা সব শেষে। বইয়ের পাতা থেকে একটা দুটো প্রশ্ন করলাম, ইচ্ছে করে বেশ শক্তপ্রশ্ন, আমিও হয়তো উত্তর করতে পারতাম না, খুব সহজে সে উত্তর দিল। আমার দশ পনের মিনিটের সাক্ষাতে যেটা বুঝলাম, ভগবানদত্ত স্মৃতিশক্তি তার, সে যেটা একবার শোনে বা পড়ে সেটা তার মাথা থেকে আর বেরোয় না। নির্ঝরের বন্ধু হতে আমার বেশী সময় লাগেনি। আর আমিও তখন বাড়িতে একাই থাকতাম, সদ্য বীরভূমে পৌঁছে আমার তেমন কোন বন্ধুও হয়নি বা ছিল না, আস্তে আস্তে ক্লাস এইটের এই ছাত্রটি আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। খুব যে বুদ্ধি ছিল তা নয় কিন্তু স্মৃতি শক্তি ছিল বটে, একেবারে গল্প করার মত। আর সেটাকে মূলধন করে স্কুলের ফার্স্ট বা সেকেন্ড হওয়া টা তার কাছে খুব একটা শক্ত হতো না। ছিল নতুন জিনিস জানার আগ্রহ। আর একটা কথা না বললেই নয়, সায়েন্সের ছাত্র হয়েও, সেই বয়সে পড়াশোনার বাইরে তার ইহিহাস পড়ার বা জানার যা আগ্রহ দেখেছিলাম আমি আজও খুব স্বল্প মানুষের মধ্যে দেখেছি। অনেক ভালো ছাত্র আমি পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি, ভবিষ্যতেও পাবো, কিন্তু নির্ঝর কে আমি ভুলতে পারি নি।
ইতিমধ্যে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, আমি স্কুলের চাকরী ছেড়ে কলেজে চাকরী পেয়েছি, মডার্ন হিস্ট্রি নিয়ে আমার পি এইচ ডি ও শেষ হয়ে গেছে, এখন নামের আগে ডঃ টা দেখতে বেশ লাগে। মানুষ জন আমাকে বেশ সমীহ করেন, হয়তো সেটা আমার নামের আগে ডক্টরেট দেখে। যাহোক, ইউনিভার্সিটিতে ‘ইতিহাসের অধ্যাপক’ হলেও এখন আমি যথেষ্ট সম্মানীয় ব্যক্তি। সাড়ে চারটের ক্লাস শেষ হয়ে গেলে আমাকে বাইরে একবার বেরোতেই হয়, সেই সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত সিগারেট না খাওয়ার তৃষ্ণাটা তখন খুব তীব্র ভাবে হাতছানি দেয়। বাইরে বেরিয়েছি দেখি চেনা মুখ। এত গুলো বছর পেরিয়ে গেলেও নির্ঝরের মুখখানা আমার মনের ভেতরে গেঁথে ছিল। কয়েক সেকেন্ড লেগেছিল, “তুমি সেই বীরভুম জেলা স্কুলের নির্ঝর না!”
পোশাক নিতান্তই সাধারণ এবং আমার ওকে প্রথম দৃষ্টিতে দেখে কেমন যেন বেশ দুর্বল লাগছিল।
“হ্যাঁ স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
“নিশ্চয়ই পেরেছি, তুমি এখানে?”
“স্যার, এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। জানতাম না আপনি এখানে আছেন! আপনি এখন এখানে পড়ান?”
সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়লাম, “তা তোমার চেহারাটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে! তোমার শরীর ঠিক আছো তো?”
“হ্যাঁ, স্যার, সব ঠিক আছে”
“তোমার সেই মেমারি, সেটা আগের মতো আছে?”
সে হাসল, তারপর বলল “স্যার, সেই ক্লাস এইটে আপনি টিচারস রুমে আমার সঙ্গে মেমারি গেম খেলেছিলেন মনে আছে? দশ নম্বর রাউন্ডে আমি বলেছিলাম ডঃ কালাম, আর এগারোতে আপনি বলেছিলেন ভানুসিংহ, তারপর বারোতে আমি বলেছিলাম রাজা রামমোহন রায়। আপনি দশ নম্বর থেকে আর বলতে পারেন নি। আমার কিন্তু সব কটা নাম এখনো মনে আছে।” বলে সে বেশ প্রাণ খুলে হাসল।
“তুমি এখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করো?” বেশ মনে আছে, সঞ্চয়িতার কত কবিতা যে মুখস্থ বলতে পারতো, আর সেই বাচ্ছা বয়সে কি সুন্দর গলা ছিল তার!
“স্যার, সে ভুলি কি করে? আপনি তো শিখিয়েছিলেন!”
“একেবারেই নয়। জানো নির্ঝর, কেউ কাউকে কিছু শেখাতে পারে না, মানুষ নিজে নিজেই শেখে, আমি খালি গাইড করেছি মাত্র, সব কৃতিত্ব তো তোমার!”
কথায় কথায় জানলাম সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বারো ক্লাস পাশ করে নির্ঝর কেমিস্ট্রি নিয়ে অনার্স করে প্রেসিডেন্সী থেকে, তারপর রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এমটেক করে। প্রথমটায় রিসার্চ নিয়ে মেতেছিল, কিন্তু সেভাবে সফল না হয়ে এখন একটা চাকরী করে তবে সেও তেমন ভালো নয়। কোন এক বিশেষ কাজের সূত্রে আমাদের কলেজের এক সিনিয়র প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। প্রায় মিনিট দশেক কথা বলার পর আমি তাকে আমার ফোন নম্বর দিলাম, বাড়িতে আসার একটা নিমন্ত্রনও দিলাম, কিন্তু আমার যেটা মনে হল, সে বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। আমি চলে আসছিলাম কিন্তু পারলাম না, জিজ্ঞাসা করলাম “নির্ঝর তুমি কি কিছু বলবে আমাকে?”
“স্যার একটা কথা বলার ছিল, আপনার একটু সময় হবে?”
“নিশ্চয়ই হবে, বলো” আমার ক্লাস আর ছিল না, সুতরাং পুরোনো ছাত্রের সাথে রিইউনিয়ন না হোক আর একটু লম্বা সময়ের জন্য হোক, আপত্তির কিছু ছিল না।
“স্যার, আমি রিসার্চ টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি, একটা পেপার লিখেছি, আসলে একটা ফর্মুলা বানানোর চেষ্টায় আছি। মানে আমাকে একটা ট্রায়াল মেডিসিন বানাতে হবে অথবা কোন মেডিক্যাল ইকুপমেন্ট, যাইহোক আর তার জন্য আমার কিছু টাকা পয়সা লাগবে, সেটা ছাড়া আমি ঠিক এগোতে পারছি না, তো সে নিয়েই আপনার সঙ্গে একটু আলোচনার দরকার ছিল। আসলে মা ও চলে গেছেন পাঁচ বছর হল, মানে ঠিক পরামর্শ করার কাউকে পাচ্ছি না”
নির্ঝরকে সাহায্য করতে পারলে আমি সত্যিই খুশী হতাম, স্কুলে থাকতে সে আমার প্রিয় ছাত্র ছিল, আর আজ সে একটা পরামর্শ চাইছে আমি সেটা করবো না? ওকে নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে এসে বসলাম। প্রায় এক ঘন্টা কথা হল, যেটা বুঝলাম নির্ঝরের রিসার্চ বায়োকেমিস্ট্রি, রেডিও ফিজিক্স এবং ম্যাথস এই তিন বিষয়ের সংমিশ্রণ। মূল বিষয়টা অনেকটা এই রকম, আমাদের শরীরের প্রতিটা অঙ্গ একটা বিশেষ তরঙ্গ মানে ফ্রিকোয়েন্সি তে কাজ করে, সে হার্ট হোক, ব্রেন হোক, কিডনী হোক এমনকি আমাদের হাড় হোক। এবারে মানুষের শরীর কখন খারাপ হয়? যখন কোন বিশেষ অরগ্যান সঠিক ভাবে কাজ করে না। কেন কাজ ঠিক করে করতে পারে না? হয়তো কোন ইনফেকশন হলে অথবা ঠিক ভাবে কাজ না করতে পারলে অথবা ড্যামেজ হলে। আলট্রা সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সির সাহায্যে আমরা ছবি তুলে দেখি সেটা কে কি সমস্যা? এবারে নির্ঝর এক ধাপ এগিয়ে ভাবছে। সে চাইছে বিশেষ অরগ্যানের ফ্রিকোয়েন্সি রিজেনারেট করতে। আমি এসব কিছুই জানতাম না, সেই বলব হার্টে পেসমেকার নাকি সেই কাজই করে। এবারে এই সঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতে যদি একটি অরগ্যান কাজ করার সুযোগ পায় তাহলে তার বিশ্বাস মানুষের রোগ ব্যাপারটা অনেকটাই কমে যাব। সে যেটা করতে চাইছে সেটা সফল হলে নিঃসন্দেহে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেটা এক নতুন দিশার সূচনা করতে পারে, শুধু ভারতে নয়, সারা দুনিয়ায়, পৃথিবীর নানা দেশে। কিন্তু সেটা করতে গেলে বেশ ভালো পরিমান মূলধন দরকার। সে একটা থিয়োরী লিখেছে এবং সে প্রমান করে দেখিয়েছে এটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু এটা খালি সম্ভাবনার কথাই বলতে পারে। কারণ প্র্যাক্টিক্যাল দুনিয়াটা নাকি থিয়োরীর থেকে অনেক আলাদা। অর্থাৎ তার রিসার্চ সফল না হওয়ার একটা চান্স আছে, হয়তো তাই কেউ রিস্ক নিতে চাইছে না। নির্ঝর এমনকি এই রকম শর্তেও রাজী যে যিনি ওকে স্পনসর করবেন তিনি ওর পেটেন্টটাও নিয়ে নিতে পারেন, তার জন্য সে টাকাও চায়না। কিন্তু তাতেও সে রকম কাউকে পায়নি। সারা দিন চাকরীর পর সে আরো কিছু কাজ করে, দুটো টিউশানি করে আবার একটা বায়োকেমিক্যাল ল্যাবে কি রকম অস্থায়ী কাজও করে। উদ্দেশ্য যেভাবে হোক টাকাগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসা, সেই ভাবেই চলছে গত দু বছর ধরে প্রচেষ্টা। কিন্তু যা লাগবে তার থেকে সে বহু দূরে। বিভিন্ন কলেজে বা ইউনিভার্সিটি তে ঘোরে যদি কোন প্রফেসর সদয় হয়ে তাকে কোন যোগাযোগ করিয়ে দেন।
নির্ঝর এই ব্যাপারটা প্রথম শুনেছিল আজ থেকে প্রায় নয় – দশ বছর আগে। সে কলেজ থেকে কোন সেমিনারে গেছিল, জার্মানির কোন সায়েন্টিস্ট এই ব্যাপারে কিছু কথা বলেন। নির্ঝরের মনে ধরেছিল আর সেই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে, তারপর এই রিসার্চ। বলেই ফেলল একবার,“আসলে স্যার কিছুই ভুলতে পারিনা, সব কিছু মাথায় আছে, খালি ইনফ্লো কোন আউট ফ্লো নেই”। নামী কলেজের ভালো ছাত্ররা মাঝে মাঝেই যায় নানা সেমিনারে। কলেজ লাইফে সেমিনার ব্যাপারটা বেশীর ভাগ ছাত্রের কাছেই পড়াশোনা থেকে একটা বিরতি। কিন্তু নির্ঝরকে দেখে সত্যি প্রশংসা করতেই হয়!
নির্ঝরের রিসার্চকে সাপোর্ট করার মত অর্থনৈতিক সামর্থ্য আমার নিজের নেই তাই তাকে আশ্বস্ত করা ছাড়া আর কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু দিব্যেন্দু মিত্র আমার দূর সম্পর্কের এক দাদা হন, উনি নিজে ইঞ্জিনিয়ার তারপরএখন ওনার বিশাল বিজনেস, এই বায়োকেমিক্যাল লাইনেই কাজ করেন, কানাডা তে অনেকদিন ছিলেন, এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং আশার একটা আলো দেখছিলাম। সেই রকমই ঠিক করলাম, নির্ঝর কে বললাম তুমি দেখা কর, আর আমিও দিব্যেন্দুদা কে নির্ঝরের ব্যাপারে একটু ব্রিফ করে দিয়েছিলাম, “নির্ঝর আমার ছাত্র ছিল বীরভুম জেলা স্কুলে, ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বা সেকেন্ড হত সব ক্লাসে, ও এখন একটা রিসার্চ করছে যার জন্য ও কিছু অর্থনৈতিক সাহায্য চায়, যদি কিছু করা যায় সেই জন্য তোমার কাছে পাঠালাম। আর ওর রিসার্চের বিষয়টাও তোমার লাইনের সঙ্গে মেলে, তাই ভাবছিলাম হয়তো এই ব্যাপারে তুমি ইন্টারেস্টেড হব।”
তিনদিন বাদে সে সেখানে যাবে সেই রকমই ঠিক হল। নির্ঝরকে বলে দিয়েছিলাম সব রিসার্চ পেপার এবং অন্যান্য ডিটেল নিয়ে যেতে।
[২]
দিব্যেন্দুদার সঙ্গে নির্ঝরের দেখা করার ছিল শনিবার। আমি শনিবার করে আমার গ্রামের বাড়ি যাই, সুতরাং আমার সঙ্গে নির্ঝরের বা দিব্যেন্দুদা কারুর কথা হয়নি। কিন্তু দুদিন বাদেও যখন নির্ঝরের কোন ফোন এলো না, আমাকে একবার ফোন ঘোরাতেই হল। কিন্তু আশ্চর্য, তার ফোন সুইচড অফ, দু দিনের ব্যবধানে তিন বার ফোন করলাম, প্রতিবারেই শুনলাম “মোবাইল ফোন সুইচড অফ রয়েছে”। শেষে এস এম এস করলাম, কিন্তু তার ও কোন উত্তর এল না। নির্ঝরকে আমি ছোট থেকে চিনি, সে তো এরকম ছেলে নয়। সেই ছোট বয়স থেকে খুব দায়িত্বপরায়ন, সে এরকম করল কেন? একবার তো ফোন করে জানানো উচিত ছিল। আর ভদ্রতারও একটা ব্যাপার আছে! আমার সেই মফস্বলের জেলা স্কুলের ছাত্র কি প্রেসিডেন্সী বা সায়েন্স কলেজে পড়াশোনা করে বদলে গেল? যেতেই পারে, যা দিনকাল পড়েছে! আমরা সেই পুরোনো জেনারেশন, এখনো ভদ্রতার দোহাই দিয়ে নিজেদের ইনারসিয়াকে কনট্রোল করি। এরা নতুন জেনেরেশন, হয়তো সেসবের ধার ধারে না। আবার অন্য একটা চিন্তাও মাথায় এল, হয়তো কোন কারনে ফোন করতে পারছে না! তা নাহলে ফোন সুইচড অফ থাকবে কেন?বরং দিব্যেন্দুদাকেই কাল একবার ফোন করব সেই রকম ঠিক করলাম।
নানান কাজে সকালে ফোন করার কথা ভুলে গেছিলাম, লাঞ্চ সেরে ফোন করলাম। দিব্যেন্দুদার সেক্রেটারি চিন্ময় সাহা, আমাকে চেনেন ফোন ধরলেন –
“দিব্যেন্দুদা আছেন? আমি রাহুল সোম বলছিলাম।”
চিন্ময়বাবুর উত্তরটা একেবারে আমি আশা করিনি, “আপনি কিছু জানেন না? স্যার, তো গত তিন দিন ধরে হসপিটালাইসড!”
“কি হয়েছে?”
“বলছে নাকি টোটাল ব্রেন ফেলিওর।”
“মানে? কোন সেরিব্রাল অ্যাটাক?”
“হয়তো তাই? গত রবিবার দুপুরে হয়েছে, আমার তো ছুটি ছিল। বাড়িতে সবাই ধরাধরি করে হসপিটালে নিয়ে যান, তারপর থেকে তো সেখানেই। মেমারি ফেল করছে,শুনছি কাউকে চিনতে পারছেন না”
“কোমার মতো?”
“ঠিক কোমা নয়, তবে শুনলাম জ্ঞান আছে?”
“কথা বলতে পারছেন?”
“না, কথা তো কেমন যেন কথা জড়িয়ে গেছে। তবে ডাক্তার বলছেন শরীরের অন্য কোথাও প্যারালিসিসের মতো কিছু হয়নি।”
“কোন হসপিটালে আছেন?”
বিধান নগরের একটা হাসপাতালে নাম বললেন চিন্ময়দা, আমি চিনি। দিব্যেন্দুদা আমার সেই রকম কাছের মানুষ নন, তবে এই রকম একটা বিপদে আমাকে যেতেই হত। এক সপ্তাহ আগেই কথা হল, আর বয়স ও বেশী নয়, পঞ্চাশের নীচে, এতো তাড়াতাড়ি সেরিব্রাল হওয়া তো উচিত ছিল না! কি যে হবে কার সাথে কখন? সাড়ে তিনটের ক্লাস টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, আমার এখান থেকে সল্টলেক যেতে প্রায় এক ঘন্টা লাগে, আর দেরী করলাম না।
দিব্যেন্দুদার ভাই আর বৌদি মানে ওনার স্ত্রীর সাথে কথা বলে পুরো ব্যাপার টা বুঝলাম। রবিবার সকাল থেকে সব কিছু ঠিকঠাক ছিল, পরপর ফোন আসছিল, সব কটাই অ্যাটেন্ড করছিলেন।ব্রেকফাস্টের পর হঠাৎ কেমন একটা মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, এই সাড়ে দশটা মতো হবে। প্রথমটায় প্যারাসিটামল দিয়ে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে, তারপর কেমন এক জায়গায় তিনি চুপ করে বসে পড়েন, আর কথা জড়িয়ে যায়। অজ্ঞান হননি, আর পড়েও যান নি, তাই ডাক্তার বলছেন সেরিব্রাল হয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে হয়েছে, কিন্তু কোন রক্তক্ষরন হয়নি। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট এসে গেছে, সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি। ইন্টারনাল কোন ব্লাড ক্লটও নেই। হার্ট, কিডনি সব কিছুই ঠিকঠাক আছে, শরীরের সমস্ত অঙ্গও ঠিক মতো কাজ করছে, আগাগোড়া জ্ঞানও আছে। সমস্যা খালি একটাই এখন, ওনার স্মৃতি একেবারে চলে গেছে, কাউকে চিনতে পারা তো দূরের কথা, নিজের নামটা পর্যন্ত মনে নেই। এমনকি বেসিক মেমারি মানে ঘড়িতে টাইম দেখা কি দুই আর তিন যোগ করলে কত হয় সে উত্তর ও তিনি দিতে পারছেন না! যতোটা বুঝলাম ঘরে তেমন কোন গন্ডগোলও হয়নি, কখনো সাইলেন্ট অ্যাটাকেও মেমারি লস হয়ে থাকে। তবে সেই রকম কোন কারণ ও হয়নি। যদিও আমি ডাক্তার নই তবে এই সেরিব্রাল ব্যাপারটা নিয়ে আমার একটু আইডিয়া আছে। আমার বাবা চলে গেছিলেন এই সেরিব্রাল অ্যাটাকে, তারপর আমার নিকট এক আত্মীয়ও সেরিব্রাল স্ট্রোকের পর আর ফিরে আসেন নি। আমি আইসিইউতে দিব্যেন্দুদাকে এক ঝলক দেখলাম, দেখে আমার একবার ও মনে হয়নি ওর সেরিব্রাল হয়েছে। দেখলাম উনি হাঁটাচলাও করতে পারছেন, খাওয়াদাওয়া ও ঠিকঠাক, খালি কথাটা খুব জড়ানো, একেবারে বোঝা যাচ্ছে না।
আগেই বলেছি দিব্যেন্দুদা আমার তেমন নিকট কেউ নয়, তবু ওঁর অসুস্থতা টা আমাকে কেমন যেন খুব বেশী রকম বিব্রত করছিল। হয়তো আর একটা কারণ ও ছিল, নির্ঝরকে আমি পাঠালাম আর তার ঠিক পরেই ব্যাপার টা হল। হঠাৎ করেই আমার ফোন টা বাজল, একটা অজানা নম্বর থেকে, ধরলাম – “ডঃ সোম বলছেন?”
মুহূর্তে চিনতে পারলাম সে গলা, নির্ঝরের গলা, “কি নির্ঝর? তুমি? তোমায় কতবার ফোন করলাম তোমার ফোন সমানে সুইচড অফ আসছিল, আমি তো ভাবল……”
আমাকে শেষ করতে দিল না সে, “স্যার আর বলবেন না, মোবাইল ফোনটা গেছে। খারাপ হয়ে গেছিল, কিছুতেই অন হচ্ছিল না, কত চেষ্টা করলাম। তারপর আজ ঠিক হতে ফোন করছি, কেমন আছেন স্যার?”
“এমনি তে ভালো তবে জানো কি মিঃ মিত্র হসপিটালাইজড! গত চারদিন ধরে, ডাক্তার সাসপেক্ট করছে সেরিব্রাল মতো হয়েছে, মেমারিটা ফেল করছে, কথাও কেমন জড়িয়ে গেছে।”
“সেকি?”
“তুমি সেদিন দেখা করেছিলে ওনার সঙ্গে?”
“হ্যাঁ স্যার, সেদিন তো সব ঠিকঠাক ছিল! আপনাকে জানানো হয়নি, তবে তেমন কোন কাজ হয়ন।”
“টাকা পয়সার কথা হয়েছিল?”
“উনি দিতে চাননি, বরং আলোচনার পর খুব একটা কনভিন্সড ছিলেন না, বলছিলেন এই রকম রিসার্চের ব্যাপারে তিনি খুব একটা আশাবাদী নন, তাই টাকাপয়সা লাগাতে চাননি!”
আমি চুপ করেই ছিলাম, সে বোধহয় আমার থেকে কিছু প্রশ্ন আশা করছিল, কয়েক সেকেন্ড বাদে নিজেই বলল, “তবে স্যার ওনার প্রশ্ন গুলো আমার ভালো লাগেনি।”
“কেন? তোমাকে কিছু ইনসাল্ট করেছেন?”
আবার কয়েক সেকেন্ডের বিরতি, তারপর আবার বলল, “স্যার, ছাড়ুন, সত্যি আমি তো কিছু প্রমাণ করতে পারবো না, আমি তো খালি থিয়োরীটাই বলছি, ওঁরা গুণী মানুষ, প্রমান না পেলে বিশ্বাস করেন কি করে? আর এখন উনি অসুস্থ, কি হবে আর সে সব ডিসকাস করে?”
বুঝলাম দিব্যেন্দুদা নির্ঝরকে আজে বাজে নিশ্চয়ই কিছু বলেছে, যতই ইঞ্জিনিয়ার হোক, এখন তো পুরোপুরি বিজনেসম্যান! টাকাপয়সা ছাড়া আর কি বুঝবে? এখন মনে হচ্ছে নির্ঝরকে না পাঠালেই হত! ঘোর ভাঙ্গল নির্ঝরের গলার আওয়াজে, “স্যার, আপনার একটা হেল্প লাগবে!”
“বলো।”
“অপরেশ রায়, ইনিও একজন বিজনেসম্যান, ফুড বা মেডিসিন ট্রায়ালের অনেক কাজ করেন, বায়োকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে এখন খুব নামী একজন ব্যক্তিত্ব। উনি আবার এখন আপনাদের ইউনিভার্সিটির ডিন, ডঃ প্রতীক রায়ের কাজিন হন। অপরেশবাবু হয়তো আমার রিসার্চ টাতে ইন্টারেস্টেড হতে পারেন, আপনি যদি একটু ডঃ রায় কে বলে একটু অপরেশবাবুর সঙ্গে আমার যদি একটা দেখা করার সুযোগ করে দেন।”
আর বেশী বলতে হয়নি, ডঃ প্রতীক রায়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো রিলেশন। সার্ভিসে আমার দাদার মতো, খুব অমায়িক। নির্ঝর ঠিক বলেছে, অপরেশবাবু ডঃ রায়ের মাসতুতো ভাই হন। ওনাকে বলে অপরেশবাবুর কাছ থেকে নির্ঝরের জন্য এক ঘন্টা সময় নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ডঃ রায় কে একবার বলতেই উনি রাজী হয়ে গেলেন, গুনী মানুষ, ভালো ছাত্রের রিসার্চে কেনা খুশী হন। তবে আমাকে একটু সতর্ক করে রাখলেন, “দেখো রাহুল, একটা কথা বলে রাখি, অপরেশ কিন্তু পাক্কা বিজনেসম্যান, সিওর না হলে টাকা পয়সা লাগাবে না, তবে তুমি কথা বলো”। ঠিক করাই ছিল, এবারে আমি নির্ঝর কে আমি একা ছাড়ব না! আমিও যাব সঙ্গে, সেই রকম ঠিক হল।
অপরেশ বাবুকে সংক্ষেপে আমি ব্যাপার টা বলে রেখেছিলাম, নির্ঝরও দেরী করেনি, আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেছিলাম। মিনিট পনের কুড়ি প্রাথমিক আলোচনার পর আমিই প্রসঙ্গে এসেছিলাম,
অপরেশবাবু পুরো ব্যাপারটা নির্ঝরের কাছে শুনলেন প্রায় মিনিট দশ ধরে। নির্ঝর খাতায় ছবি এঁকে বোঝাচ্ছিল যথেষ্ট ডিটেলে, আর আমি দেখছিলাম কতটা প্যাশন থাকলে ব্যাপার গুলোর মধ্যে এতটা ঢোকা যায়! কিন্তু অপরেশবাবুর প্রথম প্রশ্নটা আমার যেন কেমন লাগল, “কি নিয়ে রিসার্চটা হচ্ছে শুনি?”
যদিও প্রশ্নটা খুবই দরকারি, আমার কিন্তু কেমন একটা ব্যঙ্গাত্মক ছাপ লাগল, তাহলে এতক্ষন ধরে উনি কি শুনলেন? নির্ঝর আবার চেষ্টা করল বোঝাতে, এবারে বইয়ের পাতার কোন রেফারেন্স ও দেখালো। যদিও কেমিস্ট্রি বা বায়োলজি কোনটাই আমার সাবজেক্ট নয়, কিন্তু বেসিক ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছিলাম, আরো প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে নির্ঝর বোঝানোর চেষ্টা করল, মিঃ রায় কিন্তু কোন প্রশ্ন করেননি। নির্ঝরকে মাঝপথে থামিয়ে এবারে তিনি বললেন, “দেখো এই সব ট্রায়ালের কাজ তো অনেক হয়েছে, আর হচ্ছেও, এই সব করার জন্য হাজার হাজার ওষুধের কোম্পানি আছে! আমার কোম্পানি এই সব কাজ করে না, আর এছাড়া এসব ব্যাপারে এত টাকা খরচা করার কি আছে?”
“না স্যার, এটা তো ঠিক ট্রায়াল নয়, আমি মেডিসিন বা মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের সাহায্যে হিউম্যান অরগ্যানের ফ্রিকোয়েন্সি রিজেনারেট করতে চাইছি, এই রকম কাজ কি ওষুধের কোম্পানি করে?”
অপরেশবাবু মাথা নাড়লেন, সে মাথা নাড়ার অর্থ অবশ্য আমিও বুঝিনি, এবারের প্রশ্নটা আরো অব্যর্থ, “তা কত টাকা লাগবে তোমার এই রিসার্চ শেষ করতে?”
“স্যার, আমি অতোটা হিসেব এখনো করিনি, প্রাথমিক কাজটা হয়ে গেলে হয়তো কোন কোম্পানি বা বিদেশে এই রিসার্চের কাজ শুরু হতে পারে। আমার যেটা প্রথম লক্ষ্য, ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেটারটা তৈরি করা। আর দেখা থিয়োরী মতো কাজ হচ্ছে কিনা! আমার হিসেব মতো পাঁচ ছয় লাখ টাকা মতো লাগবেই”
“আর তারপর যদি রিসার্চটা ফেল করে? তার দায়িত্ব কে নেবে? আমি যে ছয় লক্ষ্ টাকা লাগাবো, তারপর যদি পুরো লস করি! তোমার কনটিনজেন্সি প্ল্যান আছে?”
“স্যার সেই রকম তো এখন ভাবিনি! মানে ভাবতে পারিনি!”
“না ভাবলে চলবে কি করে?”
নির্ঝর খানিকটা মরিয়া হয়ে উঠল “স্যার, আর এটা যদি সাকসেস হয় আমি পেটেন্ট পুরো ছেড়ে দিতে রাজী আছি”
“সাকসেস? এই আজগুবী জিনিসের তুমি সাকসেস দেখছো? এই সব ফ্রিকোয়েন্সি ট্রিটমেন্ট রামায়ন, মহাভারতে হত, সেখানে আজগুবী কিছু সাধু থাকত, সেই গল্পে পড়েছি, তাঁরা এনার্জি রে পাঠাতেন। সেই রে পেয়ে মানুষের রোগ সেরে যেত! তুমি সেই সব গ্যাঁজা গপ্প আমাকে শোনাতে এসেছ?”
অপরেশবাবুর কথা ঠিক কি ভুল সে তর্কে আমি কখনোই যেতাম না, তবে নির্ঝরের রিসার্চ পেপার নিয়ে এই কথা গুলো কিন্তু আমার বেশ কটু শোনাল, রিসার্চের বিষয় আমার মনোমত নাই হতে পারে। কিন্তু সেটা তো অন্যভাবেও তো বলা যায়! আবার অপরেশ বাবুর গলা শুনলাম, “কবে লিখেছো তোমার এই পেপার?”
“লাস্ট ইয়ারের জানুয়ারী।”
“তার মানে প্রায় পনের ষোল মাস হয়ে গেল, কোন জায়গা থেকে রেসপন্স পেয়েছ কি? দেখো সত্যিটা বোঝ, সায়েন্স আর মিথোলজিকে এক করতে যেও না, সায়েন্স হচ্ছে কঠোর বাস্তব, কোন কাল্পনিক, ফালতু ব্যাখ্যা তার মধ্যে পাবে না, আর মেশাতেও যেও না”
“স্যার, আমি কিন্তু কিছু মেশাই নি, আমি খালি ফ্রিকোয়েন্সি জেনেরেশন আর কনট্রোল করতে চাইছি, এখন তারপরে সেটা দিয়ে রোগ চিকিৎসা হবে কি অন্য কিছু হবে সেটা তো পরের কথা!”
“দেখো তুমি কি চাইছো সেটা বড় কথা নয়, তুমি আমার কাছে এসেছো টাকার জন্য। সুতরাং আমি কি চাইছি সেটা মোর ইম্পপরট্যান্ট! এবারে আমাকে বুঝতে হবে এর মধ্যে কোন কন্টেন্ট আছে নাকি?”
আমাকে এবারে কথা বলতেই হল, “অপরেশবাবু, নির্ঝর একটা হেল্প চাইছে, আমাদের খালি এই টুকু ঠিক করতে হবে আমরা ওকে সাহায্য করছি কি না? এখন ওর রিসার্চ মেটিরিয়ালকে চ্যালেঞ্জ করার মত কোন কারণ হয়েছে কি?”
“দেখুন আপনি ওর স্কুলের টিচার ছিলেন, আপনার কথা আলাদা! কিন্তু আমার কাছে এই রিসার্চের কোন ভ্যালু নেই।”
“ঠিক আছে, চলো নির্ঝর” আমি আর কথা বাড়াই নি, আমি উঠে পড়েছিলাম এমন সময়ে নির্ঝরের গলা শুনলাম “স্যার আপনার যদি একটু সময় হয় একটা জিনিস একটু দেখবেন প্লিজ, এটা একটা মোবাইল অ্যাপ, আমি লিঙ্কটা এখানে লিখে দিয়ে গেলাম, পারলে স্যার এটা একটু দেখবেন। এই অ্যাপটা ডাউনলোড করে নেবেন, বাকিটা আপনি বুঝতে পারবেন” দু – এক সেকেন্ড পরে সে আবার বলল, “পুরোটা কিন্তু আমি বোগাস বলছিলাম ন।”
“কি আছে এতে? তোমার থিয়োরি?”
“আপনি দেখুন স্যার, হয়তো এটা দেখলে আপনি একটু কনভিন্সড হতে পারেন। ঠিক আছে স্যার আমরা আজ আসি। যদি কখনো আপনার মনে হয় আমার রিসার্চে একটু সাহায্য করা যেতে পারে আমি এই ফোন নম্বরটা রেখে গেলাম, আমাকে একটা কল করলেই আমি চলে আসব, আজ আসি স্যার।”
অপরেশ বাবুকে দেখলাম তীক্ষ্ণ চোখে নির্ঝরকে পরীক্ষন করছেন, নির্ঝর আর জবাবের অপেক্ষায় থাকেনি, আমাকে বলল “চলুন স্যার।”
আমিও সাথে সাথে বেরিয়ে এলাম, নির্ঝরের সাথে আর কথা বলিনি, তবে মনে মনে ঠিক করলাম ডঃ রায়কে আমি সব বলব। নির্ঝর এক সম্ভাবনাময় ছাত্র, তার সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলে? ভদ্রলোক কি টাকার দম্ভে বেসিক ভদ্রতাটুকুও ভুলে গেলেন?
[৩]
পরের দুদিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ ছিল, খুলল ৪ জুলাই, যেদিনটা হয়তো এই জীবনে কোনদিনই ভুলতে পারবো না। আমি সাধারনত সাড়ে নটার মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে যাই। কলেজে ঢুকছি ঠিক সময়ে আমার মোবাইল ফোন বাজল, দেখি আমাদের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের ফোন, উনি এখন কলকাতার বাইরে, সাথে সাথেই ধরলাম “বলুন সন্দীপদা”
“খুব ভালো খবর রাহুল”
“কি ব্যাপার?”
“তোমার পেপারটা এবারে ত্রিভান্দ্রামের কনফারেন্সে সিলেক্টেড হয়েছে, আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে ঐ একটা পেপারই মনোনীত হয়েছে, আর তোমায় সশরীরে এসে পেজেন্ট করতে হবে, সামনের বারো তারিখ সম্ভবত তোমার স্লটটা পড়বে, তুমি আজকেই টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেলো! আর ঠিক করে রাইট-আপ আর ব্রিফ টা করে ফেলো, কাল একবার বিকেলের দিকে ফোন করো। ঠিক করে প্রিপেয়ার কর, এর মতো ভালো সুযোগ আর পাবে না! এটা কিন্তু ইউটিলাইজ করতেই হবে তোমাকে, আর শোনো,আমি একটা ইমেল করে দিচ্ছি, সেখানে বাকি সব ডিটেল থাকবে”
সত্যি বলতে এটা আমার কাছে একটা বিরাট খবর, ইতিহাসের অধ্যাপক হয়ে আমি কোনদিন কোন সেমিনারে যেতে পারব এ আমার ভাবনার অতীত ছিল, আর ত্রিভান্দ্রামে প্ল্যানিং কমিশনের এই সেমিনার আরো অনেক দূরের ব্যাপার। সকালে আমি সিগারেট খাইনা, কিন্তু এই উত্তেজনায় আমি আজ আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। মনের সব জানলা খুলে পাখির মতো চারদিকে ভাসছে, ঠিক এই সময়ে আমার ফোন টা আর একবার বাজল। তাকিয়ে দেখি আমাদের ডিন ডঃ প্রতীক রায়ের ফোন, নিশ্চিত ছিলাম আমাকে অভিনন্দন জানানোর ফোন, ডঃ রায় কে কথা বলতে না দিয়ে নিজেই বললাম, “হ্যাঁ স্যার, এই মাত্র সন্দীপদা ফোন করেছিলেন, সব জানালেন, আমি সত্যি এটা এক্সপেক্ট করিনি”
“সন্দীপ? ও কি করে জানলো?”
“কেন? আপনি কিসের কথা বলছিলেন?”
“অপরেশ, আমার পিসতুতো ভাই মানে গত শুক্রবার যার সাথে তুমি তোমার ছাত্রকে নিয়ে দেখা করতে গেলে, শুনেছ কিছু ওর ব্যাপারে?”
“না! কি হয়েছে ওনার?”
“কাল রাত থেকে হসপিটালাইজড! কথা জড়িয়ে গেছে আর মনে হচ্ছে মেমারি ফেল করছে! ডাক্তার সাসপেক্ট করছে সেরিব্রাল”
আমার সারা শরীরের রোম যেন খাড়া হয়ে উঠল, আমার দু আঙ্গুলের ফাঁক থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা কখন মাটিতে পড়ে গেল আমি বুঝিনি। আমার মুখে কোন কথা আসেনি। আবার সেই কথা জড়িয়ে যাওয়া আর মেমারি লসের কেস? ঘোর ভাঙল ডঃ রায়ের গলার শব্দে, “রাহুল তুমি লাইনে আছো?”
বলার চেষ্টা করলাম, শোনা গেল কিনা জানিনা, “হ্যাঁ স্যার, বলুন”
“সেদিন তোমাদের আলোচনায় কোন উত্তেজনা কিছু হয়েছিল কি?”
আমার মুখে কথা আসতে সময় লাগছিল, আবার ডঃ রায় বললেন, “সেরিব্রালটা হঠাৎ করে হলো কেন?”
এবারে সমস্ত শক্তিকে এককরে কথা আমায় বলতেই হল, “একেবারেই না, উনি তো রিসার্চ স্পনসর করতে চাননি, তারপরে আমরা চলে আসি। আর সেই রকম রাগারাগি তো কিছু হয়নি, উনি তো একতরফা কথা বলে গেলেন! ইনফ্যাক্ট নির্ঝরকে উনি কোন কথাই বলতে দেননি”
ডঃ রায়ের সঙ্গে আমার প্রায় আরো মিনিট কুড়ি কথা হল, যেটা বুঝলাম গতকাল সন্ধ্যেবেলা, হঠাৎ শরীরে অস্বস্তি শুরু হয়, তারপর অসহ্য মাথা যন্ত্রণা, চুপ করে নিস্তেজ হয়ে এক জায়গায় বসে পড়েন, প্রথমটায় মনে হয়েছিল অজ্ঞান হয়ে গেছেন, হলেও খুব স্বল্প সময়ের জন্য। তারপর পারিবারিক ডাক্তার আসেন, তখন তিনি নিস্তেজ হয়ে আছেন তবে জ্ঞান ছিল। ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে এসে দেখা যায় অপরেশ বাবুর কথা জড়িয়ে গেছে এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। আমি দিব্যেন্দুদার কথা বলিনি, কিন্তু আমার মনে একটা কাঁটা বিঁধে আছে, পরপর দুবার মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে নির্ঝর দুবার দুজন ভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করল, কিন্তু দুজনের এক পরিনতি হয় কি করে? কোনভাবে কি নির্ঝর এর মধ্যে আছে? কিন্তু কথা জড়িয়ে যাওয়া, মেমারি লস হওয়া এই সব তো মানুষের শারীরিক সমস্যা, নির্ঝরের কিই বা অবদান থাকতে পারে তার মধ্যে? হয়তো পুরোটাই কাকতালীয়! তবু নির্ঝরের সাথে কথা একবার আমায় বলতেই হবে।
নির্ঝরকে ফোন করে আমার কাছে আসতে বললাম। অবশ্য আর একটা উদ্দেশ্য ছিল, আমি জানি ত্রিভান্দ্রামের কনফারেন্সে আমার সঙ্গে দেশের এমনকি বিদেশেরও প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সাথে দেখা হবে। আমি নির্ঝরের রিসার্চ পেপারটা সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই, ওঁদের কাউকে যদি পড়াতে পারি। যদিও নির্ঝরের রিসার্চ পেপার আমি কিছুই বুঝিনি, কিন্তু আমার মন বলছে এর মধ্যে অনেক মেটিরিয়াল আছে। ঠিক জায়গায় পৌঁছলে ও অনেক দূরে যাবে!
নির্ঝর যখন আমার বাড়িতে পৌঁছল তখন প্রায় রাত সাড়ে নটা, স্বাভাবিক সারা দিন অফিস করে তারপর আমার এখানে আসা, একেবারে শহরের অন্য প্রান্তে। রিসার্চ পেপার গুলো বুঝে নিলাম, আমি বলেছিলাম কপি করে আনতে, সে যথাযথ ভাবে সব কিছু এনেছে। বুঝলাম এই জিনিস সে অনেকদিন ধরেই করছে। দুচারটে এদিক ওদিক কথা বলার পর আমি অপরেশবাবুর প্রসঙ্গটা নিয়ে এলাম, একটু সংকোচ ছিল কিন্তু তবু বললাম, “তুমি জানো অপরেশ বাবু ও দিব্যেন্দুদার মতো হসপিটালাইজড! সেই এক প্রবলেম কথা জড়িয়ে যাওয়া আর মেমারি লস”
নির্ঝর এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি আবার বললাম, “কি হচ্ছে বলত? তোমাকে দুজনের সঙ্গে দেখা করতে পাঠালাম, দুজনেই এক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন?”
বেশ কয়েক সেকেন্ড নির্ঝর চুপ করে রইল, তারপর বলল “স্যার, ওঁদের শরীর খারাপের জন্য আপনি কি আমাকে সন্দেহ করেন?”
“না নির্ঝর, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, আসলে ব্যাপারটা বড্ড বেশী অবভিয়াস লাগছে তো, তাই বলছিলাম।”
“স্যার, আপনি তো ছিলেন সেখানে! আমি কি এমন কিছু করেছিলাম যাতে ওঁদের শরীর খারাপ হতে পারে। আর যদি বা হয়ও সঙ্গে সঙ্গে তো হতে পারত, এত দিন পরে হল কেন?”
নির্ঝরের কথায় যুক্তি ছিল, আমি আবার বললাম, “প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। দেখো আমাকে ডঃ রায় জিজ্ঞাসা করেছেন আমাদের কথাবার্তা কি হয়েছিল, কোন উত্তেজনা হয়েছিল কিনা ইত্যাদি, ইত্যাদি। মানে একটা সন্দেহ যে কারোর মনে আসতে পারে! তার ওপর আমি তো দিব্যেন্দুদার ব্যাপারটা ওনাকে বলিনি। তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে তোমার এই কথাটা মনে হত না কি?”
নির্ঝর কোন উত্তর দিল না, বরং সে উঠে দাঁড়াল, “স্যার, এই সন্দেহ দূর করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বরং আসি আজ! আপনি দেখুন যদি এই পেপারগুলোর কোন গতি হয়, আর আমার নম্বর তো আপনার কাছে আছেই! যখন দরকার ডাকবেন, চলে আসব! আর স্যার এবার থেকে রেফারেন্স পেলে খালি ফোনেই কথা বলব, মুখোমুখি সাক্ষাৎ না হলে আমার জন্য কারুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়তো হবে না”
বেশ বুঝতে পারছিলাম নির্ঝরের মনের অবস্থা। আমার কাছ থেকে এই রকম অপ্রস্তুতকারক প্রশ্ন নিশ্চয়ই তার জন্য আনন্দের ছিল না, ওর মুখের ভাষা আমাকে বলে দিচ্ছিল সে খুশী হয়নি সেইসব প্রশ্নে, বরং দুঃখই পেয়েছে। কিন্তু তবু সন্দেহের যে দানাটা মনের মধ্যে বেঁধে উঠেছিল সেটার অবসান হয়নি।
ত্রিভান্দ্রামের কনফারেন্স আর সেমিনার দারুন গেল, আমার লেখা পেপার যে বেশ উচ্চমানের হয়েছে অনেকেই বললেন। সন্দীপদা নিজেও ছিলেন, মুক্তকণ্ঠে আমার প্রশংসা করলেন, ডিনারের সময় বলে গেলেন “তুমি যে এতো ভালো ইংরাজী বলো সে তো জানতাম না”। আর হ্যাঁ, তিনজনকে নির্ঝরের পেপারটার কপি দিয়ে এসেছি, এর মধ্যে একজন তো লন্ডনে থাকেন, পেপারের জিস্টটা পড়ে খুব আগ্রহ দেখালেন। এভাবে রেডিও ওয়েভের সাহায্যে চিকিৎসার যা কথা বলেছে সেটা খুব ইন্টারেস্টিং, একটু হয়তো অনুমান আছে কিন্তু ব্যাপারটা একেবারে মৌলিক। এই রকম মৌলিক চিন্তাভাবনা আজকের দিনের ছাত্রদের মধ্যে দেখা যায় না, বললেন দু চারদিনের মধ্যে যোগাযোগ করবেন। তাছাড়া অপরেশবাবুর সঙ্গে নির্ঝরের কথোপকথন আমার জন্য সত্যি খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। সেখানে এতো ভালো ভালো কথা, সত্যি আমার শুনতে ভালো লাগছিল।
যাই হোক, চারদিন বাদে কলকাতা ফিরলাম সেদিন আবার খুব বৃষ্টি, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে বসেছি, বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আমার হাতের মোবাইল বেজে উঠল, অজানা নম্বর
“ডঃ রাহুল সোম বলছেন?”
“হ্যাঁ, আপনি?”
“আমি অনিন্দ্য বসু, লালবাজার থেকে বলছি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ।”
“কি ব্যাপার বলুন!”
“আপনি আজ সেমিনার থাকে ফিরলেন তো?”
“ফিরিনি এখনো ফিরছি, এই তো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েছি”
“একটা রিকোয়েস্ট আছে, তাহলে একটু লালবাজার ঘুরে যান, এখানে এসে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেবেন”
“আমার লাগেজ?”
“সে সব নিয়ে চলে আসুন, আধা ঘন্টা ম্যাক্সিমাম। আবার বাড়ি যাবেন, আপনার বাড়ি তো সেই সোনারপুর, এতোটা রাস্তা আবার আসতে হবে! সব নিয়ে চলে আসুন, আমরা পৌঁছে দেব আপনাকে, কোন চিন্তা নেই”
“কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো ? আমার থেকে কোন গন্ডগোল হয়েছে?”
“নানা আপনার দিক থেকে কোন প্রবলেম নয়, আসলে আপনার সাথে একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে হবে। ডিটেলটা ফোনে বলা যাবে না, আপনি আসুন, দরকারটা একটু আরজেন্ট! আপনার ইউনিভার্সিটিতে কথা বলে জানলাম আপনি সেমিনারে ছিলেন তাই আর ডিস্টার্ব করিনি, তবে আজকের দেরী আর করতে চাই না। লালবাজারে পৌঁছে এই নম্বরে ফোন করবেন, আমি নিজে এসে আপনাকে নিয়ে যাব।”
[৪]
লালবাজারে যখন পৌঁছলাম তখন বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। আমার সঙ্গে একটা লাগেজ ছিল, ফোন করে দিয়েছিলাম অনিন্দ্য বাবুকে, তিনি গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমার লাগেজ নিজেই নিয়ে নিলেন, আমাকে দোতলায় ওনার অফিসে নিয়ে গেলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আসছি বলে আমাকে সিঙ্গারা, মিষ্টি সহযোগে চা ও খাওয়ানো হল। প্রাথমিক দু চারটে কথার পর আমি নিজেই প্রসঙ্গতে এলাম, “কি ব্যাপার বলুন তো! এই রকম করে আমাকে ডেকে আনলেন কেন?”
বেশ কাটা কাটা গলা অনিন্দ্যবাবুর, কথা বলার ভঙ্গীটাও বেশ অন্যরকম “নির্ঝর গুপ্ত আপনার ছাত্র?”
“হ্যাঁ, ও স্কুলে থাকতে আমার ছাত্র ছিল, তারপর এই দু সপ্তাহ আগে ওর সাথে দেখা হয়েছিল।”
“কি কথা হল?”
মিনিট দশেক লাগল নির্ঝরের সঙ্গে আমার এই কদিনে যা যা কথা হয়েছে সেই গুলো বলতে, সেই ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে গল্প করা থেকে ত্রিভান্দ্রাম যাওয়ার আগে তার রিসার্চ পেপার নেওয়া পর্যন্ত সব বললাম।
“মাঝখানে কতদিন যোগাযোগ ছিল না?”
“প্রায় আট-নয় বছর।”
“দিব্যেন্দু মিত্র এবং অপরেশ রায়ের কাছে আপনি তাকে পাঠিয়েছিলেন, রিসার্চে ফাইনান্স করার জন্য, তাই তো?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
“তারপর তাঁদের কি হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন তাই তো?”
বুঝলাম সমস্যায় পড়েছি, স্বীকার করতেই হল, এসব ব্যাপারে শুধু শুধু মিথ্যে বলার মানে হয় না, “হ্যাঁ, জানি, দুজনেরই কথা জড়িয়ে গেছিল আর মেমারি ফেল করছিল, হ্যাঁ একটা সন্দেহ মনে ছিল কিন্তু আমি কোন প্রমান ছাড়া নির্ঝরকে দায়ী করতে চাইনি। তাই আমি কাউকে কিছু বলিও নি।”
“ডঃ সোম, আমি খালি জিজ্ঞেস করছি আপনি জানেন কি না? আপনার জায়গায় আমি থাকলে আমি ও হয়তো কাউকে খবর করতাম না! আচ্ছা যাক সেসব কথা।”
একটু স্থিত হওয়া গেল, “তারপর?”
“আচ্ছা, তাহলে আপনার ছাত্রটিকে আপনি স্কুল পাশ করার পরে আর দেখেন নি, তাই তো?”
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
“তাহলে আপনি বোধহয় এটাও জানেন না, মাস্টার ডিগ্রী করার পর ইউনিভার্সিটিতে নির্ঝর রিসার্চ শুরু করে অন্য একটা টপিকে। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য, ওর রিসার্চ পেপার ক্যান্সেল হয়ে যায়। তারপর সম্পূর্ণ একটা নতুন বিষয়ে সে আবার রিসার্চ শুরু করে।”
এই গুলো আমার কিছুই জানা ছিল না, একটা প্রশ্ন তথন থেকে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, করেই ফেললাম “নির্ঝর কি তাহলে ফ্রড? আমাকে মিথ্যে বলেছে?”
“না না, একেবারে ফ্রড নয়। সে রিসার্চ করছিল পুরোদমে, রিসার্চের বিষয়ে সে যা যা বলেছে সব সঠিক!কিন্তু রিসার্চের সাথে সাথে আরো একটা জিনিস সে করছিল। একটা মারণ ফাঁদ বানিয়েছিল সে। টাকা পয়সা নেই, রিসার্চ এগোচ্ছে না, তাই যাদের টাকা পয়সা আছে কিন্তু তাকে সাহায্য করতে নারাজ, সেই রকম মানুষের ওপর সেই চরম অস্ত্রের প্রয়োগ হত। সতের জনকে সে এই ভাবে ঘায়েল করেছে আর প্রতি ক্ষেত্রে ভিকটিমের মেমারি লস হয়েছে। আর সেই অ্যাটাক এত ভয়ঙ্কর, সব ক্ষেত্রে ভিকটিমের মেমারি কিন্তু আর ফিরে আসেন।”
“কিন্তু সেটাকে সে অ্যাপ্লাই করল কি করে? অপরেশ রায়ের সঙ্গে যখন কথা বলছিল আমি সেখানে উপস্থিত, তাকে তো ফিজিক্যালি কিছু করতে দেখিনি।”
“আসলে মেমারি লস কিন্তু হয়নি, হয়েছে এক অন্য জিনিস। আর সে অস্ত্রও ভারী অদ্ভূত, তাতে ফিজিক্যালি কিছু করতে হয় না। অনেক পড়াশোনা করে অনেকজনের সাথে আলোচনা করে জিনিসগুলো জানলাম। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এই রকম, আমাদের ব্রেন যখন কাজ করে সেটা করে একটা তাৎক্ষণিক প্রেরনার জন্য, যেটাকে বিজ্ঞানে ব্রেনওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি বলে থাকা হয়। এই ব্রেনওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি পাঁচ রকমের হয়। আমরা যখন কোন ক্লাসে যোগদান করি বা ধরুন অফিসে কোন মিটিং এ থাকি,মানে খুব সজাগ হয়ে কোন কাজ করি তখন সেই ব্রেনওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি থাকে ৭০ এর আশে পাশে, সেটাই হয়ে ৪০ এর আশে পাশে এসে যায় যখন আমরা অন্য কোন কাজ করি, টিভি দেখি বা বই পড়ি, গান শোনা বা খাওয়ার সময় সেটা হয়ে যায় ২০ বা ২৫, নিতান্ত আলস্য বা আমাদের তন্দ্রার সময় এটা হয়ে যায় ১০ এর আশে পাশে আর ঘুমোনোর সময় সেটা হয়ে যায় ৪ বা ৫ বা আরো কম। সেই অদ্ভুত অস্ত্রের প্রয়োগে মানুষের নরম্যাল ব্রেনওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সিকে কমিয়ে সে ১০এর কমে আনতে পেরেছিল। আর সেটা যখন হবে, ব্রেনওয়েভ সিগন্যাল এতটাই দুর্বল হয়ে পড়বে যে ভিকটিম আর নিজের মেমারি থেকে আর কিছু মনে করতে পারবে না! মেমারি তে কিন্তু সব আছে, কিন্তু আক্রান্ত সেই মানুষটির পক্ষে সেটাকে রিকল করে সম্ভব নয়। বুঝছেন কি ভয়ঙ্কর অস্ত্র!”
“এই জিনিস নির্ঝর বানিয়েছিল?”
“শুধু বানিয়েছিল তাই নয়, এর প্রয়োগ মানে অ্যাপ্লিকেশন সে যেটা বার করেছিল, সেটা আরো বিস্ময়কর এবং ভয়ংকর। সে একটা মোবাইল অ্যাপ বানিয়েছিল, সেটাকে সে ভিকটিমের মোবাইলে ইন্সটল করাচ্ছিল” মনে পড়ল নির্ঝর অপরেশবাবুর ফোনে কিছু একটা ইন্সটল করতে বলেছিল। অনিন্দ্য বসু বলে চলেছিলেন, “আঙ্গুলের ছাপ ছাড়া সেই সফটওয়্যার ইন্সটল হত না। আর যে মুহূর্তে আপনি সেটাকে ইন্সটল করলেন, অ্যাপ আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে ভিকটিমের শরীরের ফ্রিকোয়েন্সির সাথে নিজেকে শ্রেণীবদ্ধ করে ফেলত। আর সেই ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সফার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যেত, ঘন্টা চার, পাঁচেকের এক্সপোজার হলেই হল, সেটাই যথেষ্ট ভিকটিমের ব্রেনওয়েভ কমিয়ে করে দেওয়ার জন্য। এবারে বুদ্ধি কতোটা লাগিয়েছিল দেখুন, সংক্রমণ বা আক্রমণ যাই বলুন সেটা সঙ্গে সঙ্গে হবে না, একদিন বা দুদিন বাদে হতে পারে, এক মাস বাদেও হতে পারে, আবার একেবারে নাও হতে পারে। বাড়িতে অন্য কেউ কিন্তু তার দ্বারা আক্রান্ত হবে না, সুতরাং সন্দেহের কোন কারণ থাকবে না। নেহাত নির্ঝর সব কিছু স্বীকার করেছে নাহলে এই ব্যাপারটা প্রমান করা আমাদের পক্ষে খুব শক্ত হতো।”
মিনিট খানেক লাগল আমার পুরোটা ডাইজেস্ট করতে, মনের ভেতর থেকে প্রশ্নটা এল, “নির্ঝর এখন কোথায় আছে?”
“এখানেই আছে”
“কেমন আছে?”
“আপনি নিজেই দেখুন” দু তিন সেকেন্ডের বিরতির পর তিনি আবার বললেন, “কাল ওকে আমরা এখান থেকে শিফট করে দিচ্ছি, সেজন্যেই আপনাকে ডাকলাম।”
“কোথায় শিফট করাচ্ছেন?”
“বলছি, আগে ওর সাথে দেখা করে নিন।”
নির্ঝরকে অনিন্দ্য বসু কোন জেলের ভেতরে রাখেন নি, ওনার কাছেই শুনলাম লালবাজারে ছোট একটা অফিস ঘরে সে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। অনিন্দ্য বসু দরজা টা খুলে দিলেন, লম্বা একটা ঘর, কোন আসবাব নেই, ঘরের শেষ প্রান্তে বসে নির্ঝর কি সব লিখছে, আমি নাম ধরে ডাকলাম ও সাড়া দিল না, এমনকি তাকালোও না আমার দিকে। কাছে এগিয়ে গেলাম, দেখি সারা দেওয়ালে লেখা নানান অপ্রাসঙ্গিক কথা, কোন জায়গায় টিপু সুলতানের ওপর কিছু লেখা, এক জায়গায় অ্যালজেবরার প্রবলেম সলভ করা রয়েছে, কোন জায়গায় ইংরাজীতে ডাইরেক্ট, ইনডাইরেক্ট বাক্য লেখা, কোন জায়গায় আবার অরগ্যানিক কেমিস্ট্রির সেই কার্বন বন্ডের ছবি আঁকা, এক জায়গায় নিউটনের দ্বিতীয় গতিসুত্র লেখা, শেষটা পড়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, প্রথম পিরিয়ড – বাংলা, দ্বিতীয় পিরিয়ড – ভৌতবিজ্ঞান, তৃতীয় পিরিয়ড – ইতিহাস এই ভাবে একটা সাতদিনের একটা রুটিন লেখা। নিশ্চয়ই নির্ঝরের নিচু ক্লাসের রুটিন! সে কথা আজকে লেখার মানে কি?
আমার মনে হচ্ছে আমি বুঝতে পেরেছি! সে নিজেই বলেছিল “কিছুই ভুলতে পারিনা, সব কিছু মাথায় আছে, খালি ইন ফ্লো কোন আউট ফ্লো নেই”। আর আজ ইন ফ্লো বলে কিছু নেই, তাই মেমারিতে ভরে থাকা সব ইনফরমেশেন ভীড় করে বেরিয়ে আসছে। পাশ থেকে অনিন্দ্য বসুর গলা শুনলাম, “সারাক্ষণ এইসব পুরোনো কথা লিখে যাচ্ছে” আর দেখতে পারলাম না, বেরিয়ে আসছিলাম হঠাৎ করে শুনলাম সেই গলা, সেই শব্দ, যে গুলো সেই আজ থেকে দশ এগারো বছর আগে শুনেছি
“কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ –
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে, চারি দিকে মোর, এ কী কারাগার ঘোর –
ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা, আঘাতে আঘাতে কর।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি
এসেছে রবির কর!”
স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী ছিল, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ সে আবৃত্তি করতে চায়নি, বলেছিল, “আমার স্বপ্ন ভঙ্গ হবে না”। তাহলে আজ এই শব্দ গুলো তার মুখে কেন? এই নির্ঝরকে তো আমি চিনি না? পাশ থেকে অনিন্দ্য বসুর গলা শুনলাম আবার “দশ তারিখে যখন অ্যারেস্ট করলাম তখন সব ঠিক ছিল, অবশ্য মাঝে মাঝেই মেন্টাল ব্রেক ডাউন হচ্ছিল, চোদ্দর সকাল থেকে একেবারে এই রকম, গ্র্যাজুয়ালী গেটিং ওয়ারসার, পঞ্চশীল মানসিক চিকিৎসালয়ে ওকে শিফট করানো হবে কাল সকালে। বাড়ি আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। শুনলাম নির্ঝরের আত্মীয় স্বজনও কেউ ওর দায়িত্ব নিতে চাননি, তাই জানি না কি হবে শেষ পর্যন্ত!
চারদিন বাদে ডঃ কুট্টি রামাচন্দ্রনের ফোন এসেছিল সুইনডন থেকে, নির্ঝরের রিসার্চ পেপার নাকি ওঁদের ইউনিভার্সিটিতে খুব পছন্দ হয়েছে, ওঁরা নির্ঝরকে স্পনসর করে নিয়ে যেতে চান। মিথ্যে কথা বলে এড়িয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে।
নির্ঝরের কথা মনে হলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, প্রতি রবিবার করে একবার যাই ব্যারাকপুরে ‘পঞ্চশীল মানসিক চিকিৎসালয়ে’। আর দেখি কেমন করে, রোজ কুড়ি বছরের স্মৃতি এখনো উপচে পড়ছে, খাতার পাতায়, ঘরের দেওয়ালে, বিছানার চাদরে, এমনকি পরণের জামায়, শেষই হয় না!
******************
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, তৃষা আঢ্য, পার্থ সেন
লেখককে অকুণ্ঠ ভালোবাসা এরকম একটা স্তব্ধতার মাঝে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য। চিন্তাশক্তির কি অসাধারণ বুনন, কল্পনার বিস্তার।আর মিশ্রণ, আর সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাসের নিখুঁত মেলবন্ধন। আবার লেখককে সাধুবাদ।