পূর্ণিমা
লেখক: অদিতি সরকার
শিল্পী: সুমন দাস
একটা লালচে ধুলোর ঝড় পেছনে নিয়ে জিপটা চলে গেল বিশাল একটা অশ্বত্থের নিচে তাদের দুজনকে আর তাদের দুটো সুটকেস, এক ক্রেট জলের বোতল আর শুকনো খাবারের প্যাকেটে ঠাসা একটা কার্টন নামিয়ে দিয়ে।
জিপের শব্দটা মিলিয়ে যেতেই এক মুহূর্তের জন্য রাহুলের ভেতরটা ছমছম করে উঠল। একটা অজানা শঙ্কা পলকের জন্য তাকে ছুঁয়ে গেল যেন। এই গহন ঝিম জঙ্গলে আগামী সাত দিনের জন্য তারা একা। একদম একা। সঙ্গী বলতে শুধু সামনের ওই আপাতত দরজা বন্ধ কটেজের কেয়ারটেকার। কটেজও ঠিক নয়, সবুজ বাদামি ক্যামোফ্লেজ পেইন্ট করা ইস্পাতের প্রিফ্যাব্রিকেটেড কেবিন। মিনিমাম কমফর্ট।
-জায়গাটা কিন্তু খুব নির্জন, না? শুধু আমরা দুজন। কিছু হলে টলে মুশকিলে পড়ে যাব কিন্তু। ফোনের সিগন্যালও তো নেই।
উত্তর না পেয়ে শর্মির দিকে তাকাল রাহুল। অদ্ভুত চকচকে চোখে শর্মি তখন চারদিক দেখছে। গোলাপি দু ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক। ওই মুখ দেখে সব অস্বস্তি মিলিয়ে গেল রাহুলের। তার জায়গায় অন্য, অনেক বেশি জোরালো অনুভূতি শিরশির করে উঠল রক্তে। ওই গাছতলায় দাঁড়িয়েই এক হাতে শর্মির নরম শরীরটা বেড় দিয়ে ধরল সে।
-ভালো লাগছে?
সেই চকচকে চোখেই শর্মি তাকাল তার দিকে। আরও একটু কাছে ঘেঁষে এল যেন।
-ভীষণ। থ্যাংক ইউ।
রাহুল এই তুলতুলে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করবে কি না ভাবছিল, কিন্তু এই মোক্ষম সময়েই মূর্তিমান রসভঙ্গের মত কটেজের দরজাটা খুলে গেল।
-আপ লোগ?
দীর্ঘকায় প্রৌঢ়ের পরনে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খাকি উর্দি, মুখে প্রগাঢ় বিস্ময়।
শর্মির কোমর থেকে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয় রাহুল। মুখে গাম্ভীর্য আনার সচেতন চেষ্টা করে।
-কেন, কোনও খবর আসেনি এখানে আমাদের আসার?
-নহি সাব। এখানে তো ট্যুরিস্ট আসে না, পারমিশন নেই।
রাহুল পকেট থেকে একটা খাম বার করে।
-আমাদের আছে। আইজি সাহেবের স্পেশাল পারমিশন। সাতদিন থাকব এখানে।
খামটা বাড়িয়ে ধরে রাহুল। সরকারি অশোক স্তম্ভের ছাপমারা লম্বা খাম।
-দেখুন। হিন্দিতেও লেখা আছে।
লোকটি সামান্য ইতস্তত করে খামটা নেয় রাহুলের হাত থেকে। তার ভাবভঙ্গিতে অসন্তোষ স্পষ্ট। খাম ছিঁড়ে যে চিঠিটা বার হয় তার বয়ান কতটা সে উদ্ধার করতে পারে সে-ই জানে, তবে তলার সই ও স্ট্যাম্প চিনতে তার কোনো অসুবিধে হয় বলে মনে হয় না। নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে পুরো চিঠিটা পড়ে সে। কাঁচাপাকা ভুরুর মধ্যের খাঁজটা আরও গভীর হয়।
-আপনার নাম রাহুল চৌধুরি? কলকাত্তা থেকে আসছেন?
বিরক্তিতে কণ্ঠস্বর কঠিন হয় এবার রাহুলের। সারাদিন হটরানির পর ক্লান্ত শরীরে এত জবাবদিহি করতে তার ভালো লাগছিল না।
-হ্যাঁ। লেখাই তো আছে চিঠিতে। আইজি সাহেব আমার আত্মীয়। তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এখানকার। আপনি কে? এই কটেজের কেয়ারটেকার?
রাহুলের ছুঁড়ে দেওয়া তাচ্ছিল্য সম্ভবত বুঝতেও পারে না প্রৌঢ়। তার মাথা আপত্তিতে ডান থেকে বাঁয়ে নড়তেই থাকে।
-ঠিক করেননি সাব আপনারা। এই সময়টা ঠিক নয় সাব। বাঘের মিলনে কা টাইম চলছে এখন। এখন এত ডিপ জঙ্গলে থাকা সেফ নয় সাব। কিছু উলটাসিধা হয়ে গেলে এই ফেকুরামের ওপরেই তো সব দোষ আসবে।
শর্মি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে কথা বলে।
-অন্তত আজকের রাতটুকু তো থাকতে দিন। দেখছেনই তো আমাদের ছেড়ে দিয়ে গাড়ি চলে গেছে। সেই আট দিনের দিন আমাদের নিয়ে যেতে আসবে আবার। ইচ্ছে করলেও তো আমরা এক্ষুনি এখান থেকে যেতে পারব না ।
ফেকুরামের চেহারা শর্মির কথায় আরওই অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। তার চোখজোড়া রাহুল আর শর্মির মুখের ওপর ঘোরাফেরা করে কয়েকবার।
-উচিত হয়নি। একদম উচিত হয়নি। আমার সঙ্গে কথা না বলেই ড্রাইভারকে ছেড়ে দিলেন আপনারা। যদি আমি না থাকতাম? কী করতেন তখন। এই গাছতলায় রাত কাটাতেন? জঙ্গলকে বারে মে কুছ নহি জানতে, চলে আতে হ্যায় শহরসে সব। আইজি সাব কা চিটঠি। হুঃ! শের তুলে নিয়ে গেলে চিটঠি বাঁচাবে?
দু হাতে দুটো সুটকেস তুলতে তুলতে বেশ উঁচু গলাতেই বিড়বিড় করতে থাকে ফেকুরাম।
-আসুন, ঘর খুলে দিচ্ছি। কী আর করা।
ঘরে ঢুকে নেহাত খারাপ লাগল না রাহুলের। ফাইভ স্টার নয় অবশ্যই, তবে একেবারে আদিমও নয়। শর্মি বাথরুম দেখতে গিয়েছিল, গিজার দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল।
-এখানে ইলেকট্রিক আছে? না কি জেনারেটরে চলে?
-না মেমসাব। জঙ্গলের ভেতরে জেনারেটর চালানোর নিয়ম নেই। সূর্যের তেজে চলে সব। গরম পানির মেশিন, আপনাদের ঘরের আলো পাখা।
-ও আচ্ছা, সোলার ইলেক্ট্রিসিটি।
রাহুল পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল ওদের কথার মধ্যে। সেই মন্তব্যটা করে। তার মাথায় এখন আরেকটা চিন্তা ঢুকেছে।
-সবই তো হল, কিন্তু রাতে খাওয়াদাওয়া কী হবে শর্মি? ওই চানাচুর আর চিপস খেয়ে রাত কাটাতে হবে নাকি? একটু চা হলেও হত তো এখন।
শর্মি ফেকুরামের মুখের দিকে তাকায়। সে মুখে এবার স্পষ্ট রাগ আর অসহায়তা মাখামাখি।
-কী করি বলুন তো। খবর নেই কিছু নেই একেবারে এসে পড়লেন আপনারা। ফেকুরাম কি হোটেল চালায়? চা রে, বিস্কুট রে, রাত কা খানা রে। আজ রাতে রোটি ভাজি ছাড়া আর কিছুই হবে না। এদিকে ধারে কাছে গ্রাম বাজার কিচ্ছু নেই। সন্ধেও হয়ে গেল, যাব যে কিছু আনতে তারও তো উপায় দেখি না। কাল সকালে যাব খন। মুর্গা আণ্ডা যা মেলে নিয়ে আসব।
বাইরে অন্ধকার সত্যিই এই কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক ঘন হয়ে এসেছে। যখন ওরা নেমেছিল এখানে তখনও আকাশে কিছুটা আলো ছিল। অনেক পাখির ঘরেফেরা কিচিরমিচির কানে আসছিল বেশ। রাহুলের চোখের সামনেই তো পরপর দুটো ময়ূর তাদের বিশাল পেখমসম্ভার ঝুলিয়ে অশ্বত্থগাছের মাঝামাঝিতে উড়ে বসল। কেঁয়া কেঁয়া করে দু চারটে তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাকও দিয়েছিল। এখন শুধু সে গাছের নিচেই নয়, ঝাঁকড়া মাথাতেও সুনিবিড় ছায়া। পাখির ডাকের জায়গা নিয়েছে নানারকম পোকার আওয়াজ। একঘেয়ে টানা ক্রি ক্রি ক্রি ক্রি শব্দ বেজে চলেছে চারদিক ঘিরে। আবারও কেন যেন বুকের ভেতর এটা অস্বস্তি টের পায় রাহুল। কী একটা অজানা অচেনা রহস্য যেন লুকিয়ে রয়েছে ওই ছায়ার আড়ালে, সুযোগের অপেক্ষায়। গা শিরশির করে ওঠে হঠাৎ তার, কাঁটা দেয়।
ফেকুরামের আচরণও তার বিরক্তির আর একটা কারণ হয়ে উঠছিল। লোকটা প্রত্যেকটা কথায়, প্রতিটি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে তার দুজন এখানে অবাঞ্ছিত। শর্মির দিকে ফেরে রাহুল।
-লোকটা কী রকম রুড, দেখলে?
-হবে না? আরামে থাকে, কোনও কাজকর্ম নেই। এখন আমাদের জন্য একটু নড়াচড়া করতে হবে যে। তাই অত রাগ। ছাড়ো তো।
সত্যিই। একটা অশিষ্ট অশিক্ষিত লোকের দুর্ব্যবহারে এই নিবিড় একলা সময়টাকে নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। এই উত্তপ্ত প্রতীক্ষাতেই তো উদগ্রীব কেটেছে এ ক’টা দিন। শর্মির সদ্য জলের ঝাপটা দিয়ে আসা ভেজা ভেজা চোখের পাতায়, গালের টোলে সেই তৃষ্ণা নিবৃত্তির অকুণ্ঠ আহ্বান দেখতে পায় রাহুল। নেশা চড়ে, রিমঝিম রিমঝিম।
-খানা লায়া সাব। ফেকুরামের কর্কশ আবির্ভাব এই সময়ে আদৌ আশা করেনি রাহুল।
-খানা? এত তাড়াতাড়ি? সাতটাও তো বাজেনি।
ফেকুরাম উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। তার মুখ এখনও ভারি হয়ে রয়েছে। হাতের থালা দুটো টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখে সে। মোটা মোটা চারটে করে রুটি, আলু পেঁয়াজের একটা লালচে মতন তরকারি, সঙ্গে বোধহয় আচার গোছেরই কিছু একটা, আর কাঁচা পেঁয়াজ কাটা খানিকটা।
-খেয়ে পিলেট ঘরেই রেখে দেবেন। সকালে নিয়ে নেব। টর্চ আছে আপনাদের কাছে?
-টর্চ? না তো।
ফেকুরাম কিছু বলে না, তবে তার মুখ দেখেই বোঝা যায় এই দুটি শহুরে বালক বালিকা সম্বন্ধে তার ধারণা।
-এই নিন, রাখুন। রাতে টর্চ না জ্বালিয়ে খাট থেকে নামবেন না।
-কেন? রাহুলের মুখ থেকে প্রশ্নটা না বুঝেই বেরিয়ে যায়।
ফেকুলাল তাকায় শুধু একবার। অপার তাচ্ছিল্য সেই দৃষ্টিতে।
-সাপ থাকতে পারে, কি বিচ্ছু। কামড়ালে ধারে কাছে হাসপাতাল ডাক্তার কিছু পাবেন না।
রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থেমে যেতে হয়। অরণ্যের স্থির বাতাসকে মথিত করে ঠিক সেই মুহূর্তেই দূর থেকে গম্ভীর শব্দতরঙ্গ ভেসে আসে। আউংঘ্। আহ্-উংঘঘ্।
শর্মি কেঁপে ওঠে। গভীর সেই গর্জনধ্বনি তাকে আমূল নাড়িয়ে দেয় যেন।
-ও কীসের শব্দ, ফেকুরাম?
-টাইগার মেমসাব। বাঘ। বাঘ ডাকছে দূরে। মেটিং কল। বাঘিনীকে খুঁজছে। সারা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে। বলেছিলাম তো আপনাদের।
রাহুলের এবার সত্যি গলা শুকিয়ে আসে। সুন্দরী নতুন বউয়ের আবদারে ভুলে এই ঘোর জঙ্গলে মধুচন্দ্রিমা ব্যাপারটা করতে আসাই তার উচিত হয়নি।
-এই দিকে আসবে নাকি?
-কী করে বলব সাব। রাতে ভালো করে দরজা জানালা বন্ধ করে শোবেন। আর আলো ফোটার আগে বাইরে আসবেন না।
রাহুলের মুখের ভেতরটা তেতো লাগে হঠাৎ।
সকালে কিন্তু আশপাশের চেহারা পুরো অন্যরকম। রাতের সেই গা ছমছমে ভাবটা একেবারেই নেই। বরং ঝাঁপালো গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে আসা রোদের তির্যক সোনালি রেখা সবকিছুকে একটা আশ্চর্য সুন্দর আলোছায়ায় স্নান করিয়ে রেখেছে। দরজা খুলেই মনটা কিছুটা হলেও ভালো হয়ে গেল রাহুলের। খুব বিরক্তি নিয়েই ঘুম ভেঙেছিল যদিও।
কালকের সেই বহু প্রতীক্ষিত রাত ব্যর্থ গেছে। বাঘের ওই ডাক শোনার পর থেকেই শর্মি কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রাহুলের কোনও চেষ্টাই কোনও কাজে লাগেনি। বার বার ব্যগ্র হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে শর্মি, রাহুলের সন্ধানী ঠোঁট এড়িয়ে বার বার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে পাশে। শরীর কাঠের পুতুলের মত সাড়হীন।
-কী হল? কিছুটা অবাক হয়েই শেষটায় প্রশ্ন করেছিল রাহুল।
-আজ থাক। ভালো লাগছে না।
-লাগবে, ঠিক লাগবে। দ্যাখো, আমি ভালো লাগাব। শর্মির শীতল সুগন্ধি বুকের খাঁজে নিজের তপ্ত মুখ নামিয়ে এনেছিল রাহুল।
-নাঃ। প্লিজ, আজ না। আজ বড্ড টায়ার্ড। নিজেকে আলতো ছাড়িয়ে নেয় শর্মি। পাশ ফিরে শোয়। এত কিছুর পরেও তার শ্বাসের ছন্দে কোনওরকম বেতাল নেই।
অগত্যা। টানটান স্নায়ুশিরাকে অগ্রাহ্য করতে হয়, জোর করেই থামাতে হয় রক্তের রুদ্রমাদলকে।
অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি রাহুলের। তার উপর কটেজের আশেপাশে নানারকম অচেনা শব্দ তাকে নিশ্চিন্ত ঘুমে যেতেও দিচ্ছিল না।
সকালে বাইরে বেরিয়ে অবশ্য নিজেকেই হদ্দবোকা মনে হচ্ছিল তার। এই রোদধোওয়ানো পাখিমুখর প্রকৃতিতে ভয়ের কিছু থাকতে পারে এই ভাবনাটাও অবিশ্বাস্য লাগছিল তার কাছে। ওই হতভাগা ফেকুরামের আচরণই তাদের ওরকম ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আসলে।
ভাবতে ভাবতেই রাহুলের চোখে পড়ল স্বয়ং ফেকুরাম। কটেজের বাঁ দিকে কী যেন দেখছে মাটিতে ঝুঁকে। রাহুলও এগোল পায়ে পায়ে।
-কী দেখছ ফেকুরাম? ইচ্ছে করেই আপনি বলে না রাহুল।
ফেকুরাম চোখ তোলে না। তার স্বর ভারি, নিচু।
-কাল শের এসেছিল সাব, রাতে। কটেজ ঘিরে চক্কর দিয়েছে।
রাহুলের বুকের স্পন্দন এক লহমার জন্য থেমে যায় যেন। তারপরেই দ্বিগুণ বেগে দৌড়তে শুরু করে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে তার এই এক মুহূর্তেই। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজায় সে।
-কী করে বুঝলে?
-থাবার দাগ পড়েছে সাব মাটিতে। এই দেখুন। তাজা পাগমার্ক।
গোল গোল কীসের যেন ছাপ দেখায় ফেকুরাম। বাঘের পায়ের ছাপ আগে কখনও দেখেনি রাহুল। তা দেখে চেনার মত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাও তার ছিল না। তাই তার প্রথমেই যে চিন্তাটা মনে এল সেটা হল ফেকুরাম সত্যি কথা বলছে না। আসলে সে তাদের ভয় দেখিয়ে এখান থেকে তাড়ানোর জন্য ডাহা মিথ্যে চালাচ্ছে।
একটু রুক্ষভাবেই তাই ফেকুরামের সতর্কবাণীর উত্তর দেয় রাহুল।
-কী সব আজেবাজে বলছ ফেকুরাম। মানুষের এত কাছে বাঘ চুপচাপ এসে ঘুরেফিরে চলে গেল? তাই হয় কখনও? অত বড়ো একটা জানোয়ার বাইরে হাঁটছে, আর ভেতরে তিন তিনটে লোক কেউ কিচ্ছু টের পেলাম না। এ কি অদৃশ্য বাঘ নাকি?
ফেকুরামের চোখের ওপরে হঠাৎই একটা পর্দা নেমে আসে। কী যেন বলতে গিয়ে থেমে যায় সে।
-ভুল হয়েছে হয়তো সাব। পুরোনো দাগ হবে।
-আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই ফেকুরাম। সাত দিনের জন্য এসেছি, সাত দিনই থাকব। সে তোমার যতই অসুবিধে হোক।
-জী সাব।
ফেকুরামের গলা আজ একেবারে অন্যরকম। মাথা নিচু। মনে মনে হাসে রাহুল। ব্যাটা খুব রোয়াব নিচ্ছিল কাল থেকে। এক ধমকেই মিনমিন করছে এখন। এই ক্লাসটাকে খুব ভালো চেনা আছে তার। এরা নরম মাটি দেখলেই আঁচড়ায়। শক্তের ভক্ত সব।
-সাব?
-বলো।
-আমি এখন হাটে যাচ্ছি আপনাদের জন্য বাজার করতে। আপনারা কিন্তু দূরে যাবেন না। কটেজের কাছাকাছিই থাকবেন সাব। আমি না ফেরা পর্যন্ত।
-কতক্ষণ লাগবে তোমার?
-দুপুর তো হয়েই যাবে সাব। এখানে তো নয়। সাইকেলে যাব আসব। তাও যেতে দেড় ঘন্টা আসতে দেড়ঘণ্টা। তার সঙ্গে কেনাকাটার টাইম ধরুন সাব।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। যেতে হলে দেরি করে লাভ নেই।
-হ্যাঁ সাব। আমি ফিরে আপনাদের আশপাশ ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। নিজে নিজে জঙ্গলের ভেতরে যাবেন না সাব। আপনারা চেনেন না এ জঙ্গল, কিছু হয়ে গেলে ফেকুরামের বদনাম সাব।
উঃ! কী ধান্দাবাজ লোক রে বাবা। কেবল নিজেকে নিয়েই ভেবে মরছে।
-আচ্ছা বেশ। তুমি যাও তো এখন।
শর্মি যখন চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে এল ততক্ষণে সূর্য বেশ কিছুটা উঁচুতে।
-এই, চা খাবে?
-কী করে খাব?
-আরে ভুলেই গেছিলাম। সঙ্গে ইলেকট্রিক কেটলি আছে তো। টি ব্যাগও আছে। কাল আসলে ওই লোকটার ওরকম কথাবার্তায় সব গুলিয়ে গেছিল।
ঘুমভাঙা এলোমেলো শর্মিকে দেখে আবারও রক্ত তাততে থাকে রাহুলের। চায়ের তৃষ্ণা ছাপিয়ে ওঠে অন্য তৃষ্ণা। বড়ো বড়ো দুটো পদক্ষেপে দুজনের মধ্যের দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে ফেলে সে। কেউ নেই এখন ধারে কাছে তৃতীয় ব্যক্তি। এ সুযোগ নষ্ট করবে এত বড় মূর্খ রাহুল নয়।
ফেকুরাম সাড়ে এগারোটার মধ্যেই ফিরে এল। ততক্ষণে শর্মির স্নান সারা। রাহুলেরও সব রকম ক্ষিদেরই পরিপাটি নিবৃত্তি হওয়ায় সে ঘরে শান্তিতে ঘুমোচ্ছিল। শর্মি কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কতক্ষণ আর একা একা গাছপাতার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যায়। ফেকুরামকে দেখে তার কিছুটা স্বস্তি হল। হোক না খিটখিটে, তাও একটা মানুষ তো। দুটো কথা বললেও তো সময় কাটে।
-ও ফেকুরাম, কী রান্না করবে আমাদের জন্য?
ফেকুরামের স্বভাবগম্ভীর মুখের রেখার কোনো হেরফের হয় না। তবে সে যথাসাধ্য নরমভাবেই জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে।
-এবেলা আণ্ডাকারি আর চাওল বানিয়ে দিচ্ছি মেমসাব। বিকেলে মুর্গা কাটব।
শর্মি আলগোছে তাকিয়ে দেখল বারান্দার কোণায় একটা জালের খাঁচা নামিয়ে রেখেছে ফেকুরাম। ভেতরে গোটা পাঁচেক দেশি মুরগি দানা খুঁটছে। চট করে চোখ সরিয়ে নেয় শর্মি।
-চলো না, তুমি রান্না করবে আর আমি তোমার সঙ্গে গল্প করব।
এবার একটু হাসির মতই কিছু একটা দেখা যায় ফেকুরামের গোঁফের নিচে।
-আমার সঙ্গে কী গল্প করবেন মেমসাব। আপনারা কত কী জানেন। আমি আনপড় গাঁওয়ার জংলি।
-আচ্ছা বেশ তাই হল। তোমার জঙ্গলের গল্পই নয় শুনব।
কাল দেখেনি শর্মি, কটেজের ভেতরটা দুটো ইউনিটে ভাগ করা, মাঝখান দিয়ে একটা করিডর। করিডরের একদিকে তারা রয়েছে। অন্যদিকটাও হুবহু একই রকম। একটা বড়ো ঘর, সঙ্গে বাথরুম। অন্য ঘরটা তাদের দিকে চেয়ার টেবিল দিয়ে সাজানো, এদিকে সেটা রান্নাঘর। ফেকুরাম তার থলে থেকে বাজার বার করে গোছাতে থাকে। শর্মি এদিক ওদিক চেয়ে একটি দড়ির মাচিয়া দেখতে পেয়ে সেটাকেই টেনে এনে বসল।
-এখানে তুমি কত দিন আছ ফেকুরাম?
-অনেকদিন হয়ে গেল মেমসাব, সে কি আর গুনে রেখেছি?
-এখানকারই লোক বুঝি তুমি?
-হ্যাঁ মেমসাব। এই জঙ্গলের বাইরেই আমার গ্রাম।
-গ্রামে কে আছে?
-কেউ নেই মেমসাব। একলা মানুষ আমি।
-ওমা সেকি? বউ বাচ্চা? বাপ মা? ভাই বোন?
-বাপ মা ছিল, এখন নেই। দুটো বোন ছিল, অন্য গ্রামে চলে গেছে বিয়ে হয়ে। আর বউ? কোন ছোটোবেলায় তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মেমসাব, মনেও নেই। সেয়ানি হয়ে আমার ঘর করতে আসার আগেই সে ওপরে চলে গেল। আমিও ফরেস্টে নৌকরি নিয়ে চলে এলাম। ব্যস্।
-আহা রে। শর্মির সত্যিই কষ্ট হয়।
-আহা টাহা কিছু না মেমসাব, সব ওপরওয়ালার মর্জি। যা ঠিক করে রেখেছেন তাই তো হবে।
ফেকুরাম কাজ করতে করতে দু একবার আড়চোখে তাকায় শর্মির দিকে।
-গল্প শুনবেন বলছিলেন না মেমসাব?
-হ্যাঁ তো।
-একটা বাঘের গল্প শুনবেন?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনব। বলো। উৎসাহে নড়ে চড়ে বসে শর্মি।
-অনেকদিন আগের গল্প এ মেমসাব। আমার বাবা শুনেছিল তার ঠাকুদার কাছে, সে আবার শুনেছিল তার ঠাকুরদার কাছে। কত পুরোনো গল্প কেউ জানে না। কিন্তু বংশের পর বংশ ধরে এখানকার লোক এ গল্প শুনে এসেছে, বিশ্বাস করে এসেছে।
-বিশ্বাস করে এসেছে মানে? তোমার গল্প কি ইতিহাস? না রূপকথা?
-সে আপনিই শুনে বিচার করবেন না হয়। ফেকুরাম কড়ায় তেল ঢালে।
-এই যে জঙ্গল মেমসাব, এই জঙ্গলের আরও গভীরে গেলে একটা মস্ত খাদ আছে। এখন পাথরভরা খাদ, কিন্তু আগের কালে ওটা ছিল জলভরা একটা ঝিল। সেই ঝিলের খাদের একদম পাশেই একটা ছোট্ট টিলার ওপরে ভাঙাচোরা মন্দির আছে একখানা।। যখনকার গল্প তখন অবশ্য আস্তই ছিল। মন্দির ছিল, দুর্গ ছিল, প্রাসাদ ছিল, একটা গোটাগুটি রাজ্যই ছিল। সব গিয়ে এখন শুধু ওই মন্দিরটুকুই টিঁকে আছে কোনোরকমে।
-কোন ঠাকুরের মন্দির ফেকুরাম?
-আমরা তো জন্মে থেকে কোনো মূর্তি দেখিনি কখনও মন্দিরে, আমাদের বাপদাদারাও দেখেনি। তবে চিরকাল শুনে এসেছি নাকি মাতারানির মন্দির ছিল ওটা। শেরাওয়ালি মাতা, বাঘে চড়া দুর্গা মাইয়া। সেই হারিয়ে যাওয়া রাজ্যের রাজা মা দুর্গার ভক্ত ছিলেন।
শর্মি দুটো পেঁয়াজ টেনে নিয়ে খোসা ছাড়াতে শুরু করে।–আমিও তোমায় একটু হেল্প করি ফেকুরাম, কাজ তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তুমি গল্পটা বলতে থাকো।
-তো সেই রাজা আর রানি ছিলেন মায়ের সত্যিকারের ভক্ত। মায়ের আশীর্বাদ ছিল তাঁদের বংশের ওপর।
-কী আশীর্বাদ? হাজার হাজার বছর রাজত্ব করবেন? না বংশে শুধু ছেলেই জন্মাবে? শর্মির গলায় হালকা ব্যঙ্গের সুর।
-আমাদের বিশ্বাসের গল্প এটা মেমসাব। বলেছিলাম তো আগেই। আপনাদের পড়ালেখা করা মনে ভালো লাগবে না। ফেকুরামের গলায় বেশ ক্ষুব্ধ সুর।
-না না, সরি সরি। তুমি বলো। আমি এমনিই বললাম। শর্মি সত্যিই লজ্জা পায়।
ফেকুরাম কিছুক্ষণ চুপ করে খুন্তি নাড়ে। তারপর আবার আস্তে আস্তে গল্পে ফিরে আসে।
-মাতারানির আশীর্বাদে রাজা রানি ইচ্ছে করলেই রূপ বদলাতে পারতেন মেমসাব।
-মানে?
-মানে মানুষ থেকে মাতার বাহনের রূপ।
-মাতার বাহন তো বাঘ। মানুষ ইচ্ছে করলেই বাঘ হয়ে যেত? শর্মি কষ্ট করে হাসি চাপে।
-হ্যাঁ মেমসাব। মায়ের সেরা ভক্তদের মা এই আশীর্বাদই তো দ্যান। তো এই রাজা আর রানিকেও দিয়েছিলেন। সারা দিন মানুষ বেশে রাজ্য শাসন করে রাতে তাঁরা দুজন মন্দিরে মায়ের চরণ ছুঁতে আসতেন ওই রূপে। জঙ্গলে ঘুরতেন ফিরতেন আনন্দে মেতে থাকতেন।
শর্মির দিকে একবার তেরছা তাকিয়ে গলাটা একটু নিচু করে ফেকুরাম।
-পেয়ার ভালোবাসাও করতেন দুজন ওই রূপেই। কিন্তু তাঁদের এই সুখের ওপর যে কারো নজর পড়েছিল এটা রাজা টের পাননি। পেলে হয়তো একটু সাবধান হতেন।
-কেন? কী হল ওঁদের?
-এই জঙ্গলে যে দুটো বিরাট বাঘ আছে এ খবর অনেক শিকারির কাছেই পৌঁছেছিল মেমসাব। বাঘের চামড়ার ওপর মানুষের লোভ এখনও যেমন, তখনও তেমনই ছিল তো। বরং বেশি ছাড়া কম না। নিখুঁত বাঘছালের জন্য বড়ো বড়ো রাজা মহারাজা তো দূর, সাধু সন্ন্যাসীরাও মোটা দাম দিতেন। বাঘছালে বসে ধ্যান লাগালে নাকি সোজা শিবজির কাছে পৌঁছনো যায়।
-ইস। তুমিও তাই মানো নাকি?
-আমার কথা তো হচ্ছে না মেমসাব, হচ্ছে লোভী শয়তানদের কথা।
-তারপর?
-তারপর একদিন পুরণমাসীর রাতে, পুরণমাসী জানেন তো মেমসাব?
-হ্যাঁ রে বাবা। পূর্ণিমা তো।
-হ্যাঁ। পূর্ণিমা। তো এক ফাগুনি পূর্ণিমার রাতে, ফাগুন মানে আপনাদের আংরেজিতে-
-আমি ফাল্গুন জানি, তুমি বলো না। এই তো, ফেব্রুয়ারি মার্চ। এখনও ফাল্গুনই চলছে তো।
-ফাগুনি পূর্ণিমায় সেদিন মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছিল মেমসাব। চাঁদের আলোয় জঙ্গলের যে কী রূপ খোলে না দেখলে বিশ্বাস যাবে না। সেই মায়াবী আলোছায়ার দুনিয়ায় রাজা আর রানি বাঘের শরীর নিয়ে জঙ্গলে খুব আনন্দে ভালোবাসায় নিজেদের মধ্যেই মেতে ছিলেন। অন্য দিকে খেয়াল ছিল না, ভাবেনওনি কখনও মাতারানির মন্দিরের আশেপাশে তাঁদের কখনও কিছু বিপদ হতে পারে।
-বিপদ হল?
-হল মেমসাব। ভিনরাজ্যের এক শিকারি অনেকদিন ধরে এঁদের পেছনে পড়ে ছিল। সত্যিকারের বাঘ ভেবেই পড়ে ছিল। মাতারানি নিজে আর এঁরা দুজন ছাড়া কেউ তো গোপন কথা জানত না। সেই ফাগুনের জ্যোৎস্নার ফটফটে আলোয় মন্দিরের চাতালের তলায় শিকারির বাণ এসে সোজা বিঁধল রানির বুকে। নির্ভুল লক্ষ, এক বাণেই সব শেষ। রাজা হাহাকার করে উঠলেন। গর্জনে হুঙ্কারে চাঁদনি রাত খানখান হয়ে গেল।
-শিকারিকে মেরে ফেললেন না রাজা?
-না মেমসাব। বাঘ রূপে রাজা কোনওদিন নরহত্যা করেননি। তাহলে মায়ের আশীর্বাদ আর থাকত না তাঁর উপর। আর মারবেনই বা কাকে? শিকারি তো কাণ্ড দেখেই দিয়েছে দৌড়। মারল বাঘিনীকে তাক করে, মরল মানুষ। এর পরে আর সে থাকে ওখানে?
সে রাত তো শোকে কান্নায় রাজার কী করে যে গেল। তারপরে আরও তিনদিন তিনরাত্রি রানির দেহ পাশে নিয়ে রাজা ওই চাতালেই পড়ে ছিলেন। বাঁচার ইচ্ছেই চলে গিয়েছিল তাঁর। তৃতীয় রাত যখন প্রায় ভোর, তখন রাজার স্বপ্নে এলেন মাতারানি স্বয়ং।
-রানিকে বাঁচিয়ে দিলেন তো?
-না মেমসাব। তাই কি হয়। প্রাণ একবার দেহ ছেড়ে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা স্বয়ং মাতারানিরও সাধ্য নয়। রাজা তা চানওনি। রাজা চেয়েছিলেন নিজের প্রাণও বিসর্জন দিতে, যাতে মরণপরের জীবনে রানির সঙ্গে গিয়ে মিলতে পারেন।
কিন্তু মাতারানি রাজি হলেন না। রানি তাঁর কর্মফলে এই মৃত্যু পেয়েছেন এই জন্মে, তবে রাজার সময় নাকি এখনও শেষ হয়নি। রানিকে ফিরে পাবেন রাজা, ঠিকই পাবেন। কিন্তু সময় হলে। এখনও অনেকবার জন্ম নিতে হবে রানিকে, অনেক বার। সব কর্মের ভোগ শেষ হলে তবেই আবার দুজনের মিলন। ফাগুন পূর্ণিমায় যা ভেঙেচুরে শেষ হয়েছিল, আবার ফাগুনের পূর্ণিমাতেই তা নাকি জুড়ে যাবে বরাবরের মতো। এতদিন পরে কী করে চিনবেন রানিকে তার একটা রাস্তাও বুঝি বলে দিয়েছিলেন মাতা।
-কী করে চিনবেন?
-সে আমার জানা নেই মেমসাব। হবে কোনো লক্ষণ, কোনো গন্ধ। মানুষ চেনে চেহারায়, বাঘ চেনে গন্ধে। মাতারানি কী ইশারা দিয়ে গিয়েছিলেন সে তো রাজাই কেবল জানেন। এইটুকু জানি, রাজা আর সে রাতের পরে থেকে নিজের ইচ্ছেয় বাঘ থেকে মানুষ হতে পারেননি। অপেক্ষায় থেকে থেকে রাজ্য চলে গেল, দুর্গ প্রাসাদ মন্দিরের চূড়া সব ভেঙেচুরে মাটির তলায় চলে গেল। রাজা ওই বাঘ শরীরেই রয়ে গেলেন যুগের পর যুগ। কিন্তু মাতা শেরাওয়ালি তাকে এই ক্ষমতাটুকু দিয়েছিলেন, যাতে প্রতি ফাগুন পুরণমাসীর সাত দিন আগে থেকে রাজা মানুষ শরীর ধরতে পারেন। ওই সাতটা দিন রাজা দিনে মানুষ, সূর্য ডোবার পরে আবার বাঘ। রানিকে খুঁজতে সারা জঙ্গল তোলপাড় করে ফেলেন রাজা ওই সাতটা দিন।
-এখনও রাজা রানির দেখা হয়নি?
-না মেমসাব, রাজা এখনও তাঁর রানিকে খুঁজেই চলেছেন।
-যত্তো গাঁজাখুরি।
রাহুল কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছিল শর্মি বা ফেকুরাম কেউই খেয়াল করেনি। হঠাৎ মন্তব্যটা কানে আসতে দুজনেই চমকে উঠল।
-মানুষ বাঘ হয়ে যাচ্ছে, বাঘ মানুষ হয়ে যাচ্ছে, পাঁচশো বছর বেঁচে আছে। লিমিটলেস গুল, মাই গড। ইম্যাজিনেশন ছিল বলতে হবে সেকালের লোকজনের!! হু!
ফেকুরাম রাহুলের ছুঁড়ে দেওয়া মন্তব্যের পরেই চুপ করে গিয়েছিল। এখনও সে কোনও কথাই বলে না। শুধু তার চোখের ভেতরে কী যেন ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে যায়।
মাঝরাতে নিবিড় ঘুমের মধ্যে হঠাৎ রাহুলকে প্রাণপণে খামচে ধরল শর্মি। নখ বিঁধে গেল রাহুলের কাঁধে।
– আহ্। কী হল? অমন করে উঠলে কেন? বাজে স্বপ্ন দেখলে নাকি? রাহুল কিছুটা ব্যথায় আর কিছুটা বিরক্তিতে চমকে জেগে উঠল। -এই মাঝরাতে কী হলটা কী তোমার।
-গন্ধ পাচ্ছ না? শুয়ে শুয়েই নাক উঁচু করে কুকুরের মত বাতাস শোঁকে শর্মি।
-কীসের গন্ধ?
-আমি পাচ্ছি যে। বুনো বুনো, ঝাঁজালো গন্ধ একটা। পাচ্ছ না? কেমন একটা জড়ানো গলা শর্মির। পুরোপুরি জাগেনি সে।
-আমি তো কোনও গন্ধই পাচ্ছি না শর্মি।
-আমি পাচ্ছি। আমি পাচ্ছি। আছে, আছে, কাছাকাছিই আছে। গন্ধ পাচ্ছি আমি। গন্ধ।
বিড়বিড় করতে করতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে শর্মি। গজগজ করতে করতে রাহুলও। খাসা হানিমুন হচ্ছে তার!
সকালে দরজা খুলে চমকে ওঠে রাহুল। একটা ঘুমন্ত মানুষ কুণ্ডলী পাকিয়ে ঠিক দরজার সামনেটায় শুয়ে। দরজা খোলার শব্দেই বোধহয় মানুষটার ঘুম ভেঙে যায়। রাহুলের দিকে না তাকিয়েই বেড়ালের মত আড়মোড়া ভাঙে লোকটা। চকচকে তামাটে চামড়ার নিচে পেশিগুলো ঢেউ খেলে যায়।
-এ কী। কে তুমি? এখানে কী করছ? ফেকুরাম কোথায়?
লোকটা ধীরে সুস্থে শোওয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের মুখের ওপর দু হাত বোলায় একবার। একমাথা কটাশে চুলের মধ্যে আঙুল চালায় চিরুনির মত। তারপর সটান চোখ রাখে রাহুলের চোখে। সেই দৃষ্টির সামনে কেন যেন একটু কুঁকড়ে যায় রাহুল। কোনওই কারণ নেই, তাও।
অমার্জিত জংলি হলে কী হবে, অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব লোকটার। লম্বা চওড়া পেশল গড়ন। পরনে শুধু একটা ক্যামোফ্লেজ প্রিণ্টের বার্মুডা ছাড়া আর কিছুই না থাকায় সেটা আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হাত পায়ের মোটা মোটা হাড়গুলো দেখলেই বোঝা যায় শরীরে কী অপরিসীম শক্তি। ধারালো চোয়াল, কাটা কাটা নাক চোখ। এইরকম রাজকীয় চেহারা এখানে আশা করেনি রাহুল। নিজের অপ্রতিভ ভাব ঢাকতেই বোধহয় গলায় চেষ্টাকৃত রুক্ষতা আনে রাহুল।
-কী হল, জবাব দিচ্ছ না যে? কে তুমি?
লোকটা তার অদ্ভুত স্বর্ণাভ পিঙ্গল দৃষ্টি রাহুলের দিক থেকে ঘোরায়নি। অন্তর পর্যন্ত ভেদ করে দেখে নেওয়া অস্বস্তিকর তীব্র দৃষ্টি। ওইভাবেই উত্তর দেয়। নিরুত্তাপ গম্ভীর স্বর।
-ফেকুরামের শরীর খারাপ। পা মচকে গেছে। দাঁড়াতে পারছে না। বাড়িতে শুয়ে আছে তাই। ওর জায়গায় আমিই আসব এ ক’দিন। আমার নাম নওশের।
-এভাবে এখানে শুয়ে ছিলে কেন। কখনই বা এলে।
-রাতেই এসেছি। আপনারা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলেন তাই আর ডাকিনি।
-এই খোলা বারান্দায় শুয়ে রইলে সারা রাত। জানো না বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হালকা হাসে নওশের। মাটিতে শোওয়ানো চকচকে বল্লমটা এতক্ষণ লক্ষ করেনি রাহুল। নওশের সামান্য ঝুঁকে সেটা হাতে তুলে নিতে চোখ পড়ল। চওড়া পাঞ্জায় দু বার নাচিয়ে সেটার ওজন পরখ করল যেন নওশের।
-জানি। বাঘ আমার কিছু করতে পারবে না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎই নওশেরের দৃষ্টি আরও ধারালো হয়ে ওঠে। রাহুলের সামান্য পেছনে ছুরির মত বিঁধে যায় তার দু চোখ। তাকে অনুসরণ করে রাহুলও পেছনে তাকায়।
শর্মি। তাদের কথার আওয়াজ পেয়ে উঠে এসেছে বোধহয়। শর্মির শর্টসটা যে এত ছোটো আর টিশার্টটা যে এত আঁটো আগে খেয়াল করেনি রাহুল। নওশেরের নির্লজ্জ চাউনি তাকে বাধ্য করল লক্ষ করতে। চোখ দিয়ে শর্মির আপাদমস্তক যেন চেটে নিচ্ছে অসভ্য জানোয়ারটা।
-আঃ, শর্মি। তুমি আবার বাইরে এলে কেন? যাও, ঘরে যাও।
রাহুল ভীষণ অবাক হয়ে দেখল শর্মি তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছে। শুধু যে অগ্রাহ্য করছে তাই নয়, নিজের সম্পদগুলো যাতে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে সেই ভাবে উদ্ধত হয়ে দাঁড়াচ্ছে বেরিয়ে এসে। রাহুল পরিষ্কার দেখতে পেল নওশেরের চোখে পুরুষালি তারিফ, আর ঠোঁটে খুব আবছা একটা হাসি। এবং আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল, শর্মির চোখেও ঠিক একই রকম যাচিয়ে নেওয়া চাউনি চিকচিক করছে।
রাগে মাথা জ্বালা করে ওঠে রাহুলের।
আগামী তিন দিনে সে জ্বালার আঁচ বেড়ে বেড়ে আশপাশের বাতাসকে লালচে করে ফেলল। শর্মির ভ্রূক্ষেপ নেই। রাহুলের আগেই তার ঘুম ভেঙে যায় আজকাল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জঙ্গল দেখে বেড়াচ্ছে সে নওশেরকে গাইড বানিয়ে। আর রাতে হাক্লান্ত ঘুম। এই ছাড়া ছাড়া দিনযাপনের জন্যেই কি এত নির্জনের অন্বেষণ করেছিল তারা। রাহুলের কীরকম বিভ্রান্ত লাগে।
প্রথম দিন ঘুম ভেঙে শর্মিকে পাশে না পেয়ে বিশেষ কিছু মনে হয়নি। হয়তো স্নানে গেছে, কিংবা রান্নাঘরে। কিন্তু বেলা গড়িয়ে সূর্য প্রায় মাথা বরাবর চড়ার পরেও যখন শর্মি বা নওশের কাউকেই দেখা গেল না, তখন স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তার পারা ওপরের দিকে উঠছিল রাহুলের। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা অঘোর জঙ্গল, কাউকে চেনা নেই জানা নেই, কারো সঙ্গে যোগাযোগের একটা উপায় পর্যন্ত নেই। শর্মির কিছু একটা হয়ে গেলে কলকাতায় গিয়ে কী জবাবদিহি করবে সেই ভেবেই তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।
বেলা প্রায় বারোটা পার করে সহাস্যবদনে শর্মি যখন ফিরল তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই রাহুলের পক্ষে নিজেকে সামলে রাখা সম্ভব হয়নি।
-কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
প্রশ্নটা সাধারণ হলেও জিজ্ঞাসার তির্যক ধরনটা শর্মির কানে ঠিকই ধরা পড়ে। যে হাসিখুশি ভাবটা এতক্ষণ তার মুখে লেগে ছিল সেটা লহমায় মিলিয়ে যায়। একবার রাহুলের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয় সে।
-নওশেরকে নিয়ে পুরোনো মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি ঘুমোচ্ছিলে, তাই বলা হয়নি।
-আমি উঠলে একসঙ্গে যাওয়া যেত না বুঝি?
-তোমার জন্য অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যেত। মন্দির এখান থেকে বেশ দূর। সরো। স্নান করব।
রাহুলের অসন্তোষকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শর্মি ঘরে ঢুকে যায়। নওশের দূরে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার সেও রান্নাঘরের দিকে পা চালায়। তার ঠোঁটে লেগে থাকা সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাসিটা রাহুলের চোখ এড়ায় না যদিও।
একবার ভাবে রাহুল, নওশেরকে ডেকে শাসিয়ে দেবে নাকি। কিন্তু লোকটার সামনে সে যেন কেন কিছুতেই সহজ হতে পারে না। ওই উগ্র অলজ্জ পৌরুষের কাছে নিজের নাগরিক ব্যক্তিত্বকে বড়োই স্তিমিত লাগে তার। আর ওরই বা কী দোষ। ঘরের বউই যদি শালীনতার সীমা ভুলে যায়।
কিন্তু তার পরের দিনও শর্মি রাহুলকে না বলেই বেরোল। তার পরের দিনও।
তারপরের দিন নওশের এল না। এল ফেকুরাম।
তাকে দেখেই এতদিনের জমে থাকা সবটা রাগ উজাড় করে দেয় রাহুল।
-এই তোমার ফরেস্ট ডিউটি হচ্ছে ফেকুরাম? আমি ফিরেই আইজি সাহেবকে বলে তোমার চাকরি শেষ না করেছি তো আমার নাম নেই।
-হ্যাঁ সাব। খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আমি এই তিনদিন ধরে শুধু ভাবছি একা একা এখানে আপনাদের কত জানি তকলিফ হচ্ছে। কী করব সাব, এমন ভাবে সিধা রাস্তায় পড়ে গেলাম যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। পাথর নেই, গর্ত নেই, সমান সিধা রাস্তায় পড়ে পা মচকে গেল সাব। কিছু বুঝতেই পারলাম না কী যে হল। ভগবান দেখিয়ে দিলেন সাব, বয়েস হচ্ছে আমার।
এখনও খুব একটা ভালোভাবে ডানপায়ে ভর দিতে পারছে না ফেকুরাম। গোড়ালির গাঁটে একটা চুনহলুদ লেপা ফেট্টি জড়ানো।
-আর বদলি পাঠালে দেখেশুনে পাঠাবে তো। কী একটা অসভ্য জানোয়ারকে পাঠিয়েছ?
ফেকুরামের কাঁচাপাকা ভুরুদুটো বিস্ময়ে কপাল ছাড়িয়ে প্রায় চুলের মধ্যে ঢুকে যায়।
-বদলি? বদলি কাকে পাঠাবো সাব? ক্যায়সে পাঠাব? আমার ওয়াকিটকি তো খারাপ হয়ে পড়ে আছে। অফিসের সঙ্গে তো কথাই করতে পারছি না। আপনাদের আসার খবরও তো ওইজন্যেই পাইনি।
গলা কাতর হয়ে যায় ফেকুরামের।
-আমার খুব দোষ হয়ে গেছে সাব। ব্যথা নিয়েও আমার চলে আসা উচিত ছিল।
রাহুল পরের কথাগুলো শোনে কিনা সন্দেহ।
-বদলি পাঠাওনি তুমি? ঠিক বলছ?
-ঝুট কেন বলব সাব? কাউকে পাঠাতে পারিনি আমি।
-তবে এই তিনদিন ধরে যে তোমার জায়গায় কাজ করে গেল সে কে?
-কে কাজ করে গেল সাব?
-নওশের। নোংরা অসভ্য লোক একটা। মেয়েদের দিকে কী করে তাকাতে হয় তা পর্যন্ত জানে না।
-কী নাম বললেন সাব, নওশের? ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে থাকে ফেকুরাম। ও নামে কাউকে তো আমি চিনি না সাব।
এ দিন কিন্তু সন্ধে পেরিয়েও শর্মি ফিরল না।
কখন বেরিয়ে গেছে রাহুল জানে না। দুপুর পর্যন্ত ছিল, সেটা জানে। খে’লও একসঙ্গে বসে। যদিও উদাসীন, গম্ভীর।
বিকেলে ঘুম ভেঙে আর তাকে দেখেনি রাহুল।
দুবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াল রাহুল। ফেকুরাম রাতের খাওয়াদাওয়ার জোগাড়ে ব্যস্ত ছিল, রাহুলকে দেখে হাত থামাল।
-মেমসাবকে দেখেছ ফেকুরাম?
না, ফেকুরামও জানে না শর্মি কোথায়। একা একা কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল মেমসাব, এ তো ভারি চিন্তার কথা। তার মতোই কোথাও পা মচকে টচকে পড়ে থাকলে তো সর্বনাশ। নিজে নিজে পথ চিনে ফিরতেও তো পারবে না। তাতে অন্ধকার নেমে গেছে সেই কখন।
অবিশ্বাস্য অবাস্তব কিছু চিন্তা রাহুলকে তোলপাড় করে দিচ্ছিল। এও হতে পারে? শর্মির রুচি এতটা নিচেও নামতে পারে? তবে যাক সে যেখানে গেছে স্বেচ্ছায় সেই নরকেই নেমে যাক। শিক্ষিত নাগরিক সুন্দরী যদি শুধু শরীরের মাতনে মেতে নিজের বিয়ে করা বরকে ছেড়ে দুদিন দেখা একটা অক্ষরপরিচয়হীন লোকের সঙ্গে চলে যেতে পারে তো যাক। রাহুল ছেড়ে দিল তাকে তার নিয়তির কাছে।
কিন্তু এই ছেড়ে দেওয়াটা অত সহজ হচ্ছিল না। আজন্ম শেখা সমস্ত সংস্কার, সমস্ত ভদ্রতার পালিশের তলায় যে আদিম পুরুষ সত্ত্বা রাহুলের ভেতরে বসে ছিল সে এত সহজে অধিকার ছেড়ে দিতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। চিনচিনে একটা ক্রোধ, তীব্র ঈর্ষার অসংখ্য বিষাক্ত বৃশ্চিকদংশন রাহুলের শিরায় শিরায় নীল জ্বালা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল।
ফেকুরাম উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল রাহুলের কাছে। তার দিকেই সহসা ফিরল রাহুল।
-ফেকুরাম, তুমি ওই ভাঙা মন্দিরটা চেনো?
-চিনি তো সাব, কিন্তু সেখানে তো এখন এই রাতে যাওয়া মুশকিল।
ফেকুরামের উদ্বেগ রাহুলকে স্পর্শ করে না। সে তখন অন্য চিন্তায় একাগ্র।
-তোমার বন্দুক আছে না ফেকুরাম?
-আছে তো সাব। কিন্তু বন্দুক দিয়ে কী হবে?
-চলো দেখি আমার সঙ্গে। বন্দুকটা নিয়েই চলো।
-এই রাতে? শিউরে ওঠে ফেকুরাম। এখন কোথায় যাবেন সাব পায়ে হেঁটে! ভোর না হলে বেরোনো ঠিক হবে না সাব।
-ভয় করছে। বিদ্রূপে ঠোঁট বেঁকে যায় রাহুলের। ফরেস্টে চাকরি করতে এসেছ আর রাতে বেরোতে পারবে না!
-ভয় না সাব। ফেকুরাম বিদ্রূপ গায়ে মাখে না। সাবধানি। আলোওয়ালা জিপ থাকত, সঙ্গে আরও চারটে লোক থাকত, এক্ষুনি বললে এক্ষুনি যেতাম। এই আলোআঁধারিতে আপনাকে নিয়ে ওই বনে পায়ে হেঁটে যাওয়া মানে মরণকে নেমন্তন্ন দেওয়া।
-আঁধার নেই তো। দেখছ না? পূর্ণিমার চাঁদ ফটফট করছে।
-কী বললেন সাব? পূর্ণিমা? আজ পূর্ণিমা? কেমন যেন আঁতকে ওঠে ফেকুরাম। স্বভাববিরুদ্ধ নির্বন্ধে রাহুলের হাত চেপে ধরে সে।
-আজ রাতে ঘর থেকে বেরোবেন না সাব। ভোর হোক, আমি সারা জঙ্গল চিরে ফেলব, মেমসাব যেখানে থাক, যেমন অবস্থায় থাক আমি খুঁজে নিয়ে আসব, মাতারানির কসম সাব। আজ না। আজ রাতে না। আজ ফাগুনি পূর্ণিমা সাব, আজ যা কিছু হয় হোক আপনি ঘরে থাকুন সাব।
-হট্ শালা কাওয়ার্ড। হাত ছাড়িয়ে নিতে অসহিষ্ণু একটা ঝটকা দেয় রাহুল। অন্য সময় হয়ত এত সামান্য ঝটকায় কিছুই হত না, কিন্তু ফেকুরামের কমজোর ডান গোড়ালি এই আচমকা ঝাঁকুনিটা আশা করেনি। ফেকুরামের শরীরের ভার তার আহত পা আর বহন করতে পারে না। দীর্ঘ দেহটা নিয়ে ফেকুরাম সটান চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ে মাটিতে। মাথার পেছনটা সজোরে ঠুকে যায় ইস্পাতের দরজায়। একবার শুধু অস্ফুটে ‘আহ্’ বলেই চুপ হয়ে যায় ফেকুরাম। নিস্পন্দ শরীর থেকে প্রাণরক্ত ধীরে ধীরে বেরিয়ে জমতে থাকে, জমাট বাঁধতে থাকে তার অসাড় ঘাড়ের নিচে।
কতক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে অন্ধ এলোমেলো হেঁটেছে জানে না রাহুল। কতবার কাঁটালতায় চামড়া ছিঁড়ে গেছে, কতবার হোঁচট খেয়ে পড়ে আবার উঠেছে তার হিসেব নেই। এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে কী করে যে এতক্ষণ অনাক্রান্ত বেঁচে আছে সে সেটাও বুদ্ধির বাইরে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র সে। কোথায় যাচ্ছে তাও জানা নেই। শুধু একটাই যুক্তিহীন ধারণা তাকে দিগভ্রান্ত তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে । পুরোনো মন্দির। তাকে সেখানে পৌঁছতেই হবে যে করেই হোক। কে যেন তার মাথার মধ্যে বসে তাকে বলে চলেছে, সব রহস্যের শেষ ওখানেই।
ক্লান্তিতে আর পা চলছিল না রাহুলের। কটেজ থেকে ছুটে বেরোনোর সেই ঊর্ধ্বশ্বাস গতি এখন এসে দাঁড়িয়েছে কোনও রকমে একটার পরে একটা পা তোলা আর ফেলায়। ঘষে ঘষে চলায়। তবুও সজোর হোঁচটটা খেল রাহুল। আর খেল বলেই বুঝতে পারল সে ঠিক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
তার সামনে অনেকগুলো চৌকো চৌকো পাথরের একটা অগোছালো স্তূপ। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চৌকো নয়, মানুষের হাতে কেটে করা চৌকো। প্রাচীন কোনো সৌধের বর্তমান ভগ্নপ্রায় অবশেষ। ভাঙাচোরা পাথরের খণ্ডগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে পড়ে কোথাও গুহা তৈরি করেছে, কোথাও বা প্রশস্ত চাতাল।
নিজেকে আর টানতে পারছিল না রাহুল। তবু কোনোমতে প্রাণপণ চেষ্টায় ক্লান্ত ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে হিঁচড়ে সবথেকে উঁচু পাথরটার উপর নিয়ে ফ্যালে সে। কোনওরকমে ভোর হওয়া পর্যন্ত বাকি রাতটা এখানে কাটিয়ে দিতে পারলে সে বেঁচে যায়। পিপাসায় আকণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ তার। মাথাটা ইটের মত ভারি। নিচু হয়ে শিশিরভেজা ঠাণ্ডা পাথরই নিরুপায় চাটতে থাকে সে জন্তুর মতো। এবং কিছু একটা দেখতে পায়।
তার ঠিক মুখোমুখি ওই চাতালটার ওপরে, ওই ঝুঁকে আসা গাছটার তলায় ওটা কী নড়ছে? একটা মানুষের শরীর না? একটা তো নয়, দুটো। দুটো মানুষ, দুটো শরীর। এতদূর থেকেও বুঝতে পারে রাহুল, ওর মধ্যে একটা তার খুব চেনা নারীশরীর, আর একটা সামান্য চেনা পুরুষ শরীর।
শর্মিকে এতদিনের মধ্যে এমন উৎসুক, উন্মুখ কখনও দেখেনি রাহুল। এমন আগ্রাসী। দু চোখ বিস্ফারিত করে রাহুল দেখতে থাকে দৃশ্যটা। পাথরের চাতাল বিছিয়ে রয়েছে শুকনো পাতায়। তার ওপর আদিম ছন্দে ওলটপালট খাচ্ছে দুটো স্বেদপিচ্ছিল নির্বসন শরীর। পশুভঙ্গিতে মিলিত হচ্ছে ওরা। জান্তব শীৎকার বেরোচ্ছে দুটো গলা থেকেই। ঢলে আসা পূর্ণিমার আলোছায়ায় বিচিত্র সাদাকালো ডোরা পড়েছে দেহদুটোর ওপর। হঠাৎ দেখলে কেমন যেন দৃষ্টিভ্রম হয়। মানুষই তো, না অন্য কিছু।
সামান্য শব্দ বেরিয়ে গিয়েছিল বোধহয় রাহুলের গলা থেকে। চাতালের ওপর নড়াচড়া থেমে যায় অকস্মাৎ। আলগ্ন শরীরদুটো ধীরে ধীরে বিযুক্ত হয়। কয়েক পলের অপেক্ষা। রাহুলের বুকে হাতুড়ি পড়তে থাকে অসহ্য যন্ত্রণায়। শর্মির পেছনে নওশেরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ দেখাটা থাকে না। ছায়ার ভেতরেই বুকে হাঁটতে হাঁটতে আরও গভীর ছায়ায় মিশে যায় নওশের।
শর্মি এতক্ষণে মুখ তুলে তাকায়। নিজের অজানতেই কয়েক পা পিছিয়ে আসে রাহুল। এই ম্লান হয়ে আসা জ্যোৎস্নাতেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে শর্মির চোখের মণির রঙ। সে চোখ হলুদ। জ্বলজ্বলে, পাকা লেবুর মত হলুদ। কুচকুচে কালো তারার চারপাশ ঘিরে ওই অনৈসর্গিক হলুদ চোখের বিভীষিকা রাহুলকে তার এই প্রায়োন্মাদ অবস্থাতেও আপাদমস্তক নাড়িয়ে দেয়। মস্তিষ্কের যেটুকু সুস্থতা অবশিষ্ট ছিল সেখান থেকে সংকেত আসতে থাকে অবিরল- পালাও, পালাও। এ জায়গা তোমার জন্য নয়। আর থেকো না এখানে, পালাও। অথচ তার পা দুটো যেন গেঁথে আছে মাটিতে। চরম বিপদ আসন্ন বুঝেও কী এক বীভৎস আকর্ষণে সে নিজেকে এই ভয়ংকর দৃশ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।
জ্বলন্ত হলুদ দৃষ্টি মেলে সম্পূর্ণ নগ্ন শর্মি পাথরের চাতাল থেকে অদ্ভুত গুঁড়িমারা ভঙ্গিতে রাহুলকেই দেখতে থাকে। তার গলার গভীর থেকে চাপা গরগর শব্দ উঠছে বিরক্তির। রাহুল বাকরুদ্ধ হয়ে দেখে শর্মির পাতলা গোলাপি ঠোঁটের দু পাশ হিংস্রভাবে কুঞ্চিত হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ তীক্ষ্ণ ঝকঝকে শ্বদন্ত।
শর্মি নয় ওটা। রাহুল যাকে শর্মি বলে চিনত সেই মানুষটা নেই আর ওখানে। আলোছায়ার ডোরা নয়, সত্যিকারের ডোরা এখন ওই শরীরটা ঘিরে। ওটা অন্য কেউ, অন্য কিছু। রাহুলের দিকে চেয়ে চেয়ে গুরুগুরু গর্জাচ্ছে, ল্যাজ আছড়াচ্ছে সে এখন
তীব্র আতংকে স্তূপের চূড়া থেকে পিছিয়ে যেতে যেতে রাহুল দ্যাখে ছায়ার গহন থেকে আরও একটা গাঢ়তর ছায়া ওই বাঘিনীশরীরের পাশে এসে জড়ো হয়েছে কখন যেন। সে ছায়ার মালিক রোমশ, আলোআঁধারের ডোরাকাটা পেশল একটা শরীর। নিজের সমস্ত শক্তি একত্র করে একটা প্রকাণ্ড লাফ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে বিশাল প্রাণীটা। তার ব্যাদিত মুখ থেকে বেরোনো প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হুংকার মধ্যরাতের অরণ্যকে ফালাফালা করে দেয়।
প্রাণভয়ে পেছোতে থাকে রাহুল। আরও, আরও পেছনে। তার দুর্ভাগ্য, অথবা হয়তো নিয়তিই, সে জানত না এই স্তূপের আয়তন কতটুকু। পেছোতে পেছোতে হঠাৎই সে অনুভব করে তার পাথরঘেরা আশ্রয়ের সীমা শেষ হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগেই ভগ্নস্তূপের কিনারা থেকে পা ফসকে যায় রাহুলের। উলটেপালটে বহু নিচে খাদের দিকে পড়তে পড়তে সে নিজেও টের পায় না কখন যে তার ঘাড়ের কশেরুকা মট শব্দে ভেঙে গিয়েছে। শুধু তার মর্মান্তিক আর্তনাদটুকু আকাশ বাতাস শিউরোতে শিউরোতে মাঝপথেই আচমকা ফুরিয়ে যায়।
Tags: অদিতি সরকার, অলৌকিক গল্প, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সুমন দাস