প্রতিবিম্ব
লেখক: জিৎ দত্ত
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
১
নতুন বাড়িটা বেশ ভালো লেগে গেল অভয়ের। অভয় একজন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, ও এই শহরে এসেছে ওর পি.এইচ.ডি কমপ্লিট করতে। ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে জায়গা না পাওয়ায় ও শেষ পর্যন্ত এই বাড়িটা ভাড়া নিতে বাধ্য হল। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক সুধীনবাবু বেশ অমায়িক। নিজে রিটায়ার্ড মানুষ, বাড়িতে বউ আর ছেলে;ছেলে চাকরি করে। ভদ্রলোক বেশ রসিক লোক, গল্প গুজব করতে খুব ভালোবাসেন। অভয় বিজ্ঞানের ছাত্র, আর এখানে লেখাপড়া করতে এসেছে শুনে এক রকম সস্তাতেই বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দিলেন অভয়কে। সুধীনবাবু দু তিনটে বাড়ি পরেই থাকেন। এই বাড়িটা ওনার পৈতৃক বাড়ি।
বাড়িটা একটু পুরানো হলেও বেশ ছিমছাম নিরিবিলি জায়গায়। সামনেই রাস্তা, দোকানপাট, একটু দুরেই বাজার, সব রকম সুযোগ সুবিধাই আছে। আর সবথেকে ভালো ব্যাপার হল অভয়ের ইউনিভার্সিটি এখান থেকে অটোতে মাত্র দশ মিনিট।
সুধীনবাবু ঘর দোর পরিষ্কার করে দিয়েছে। দুটো ঘর একটা বড়ো, আর একটা একটু ছোট, রান্না ঘর, আর বাথরুম। দোতলায় ঘর আছে ঠিকই, কিন্তু ওগুলো বন্ধ। সুধীনবাবু বললেন যে ওখানে নাকি আদ্যিকালের ভাঙাচোরা জিনিসপত্র আছে।
সুধীনবাবু অভয়ের ব্যাবহারের জন্য একটা তক্তপোশ, একটা বুক শেলফ, আর একটা চেয়ার টেবিল দিয়েছেন। অভয় ওর বই-পত্তর একটা ঘরে রেখেছে, অন্য ঘরে জামা কাপড়, প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিস এসব রেখেছে। বাজারে গিয়ে একটা রান্নার স্টোভ, চাল, ডাল, সব্জি, দেশলাই, মোমবাতি, শুকনো খাবার, থালা বাসন, অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, এসব কিনে এনেছে।
দুটো ঘরেই বড় বড় দুটো করে জানালা আছে। জানালাগুলো একটু সাবেকি আমলের, খুলে দিলে পুরো ঘরটা আলো হয়ে যায়। জানালার পাশেই একটু ফাঁকা জায়গা, সেখানে পাশাপাশি অনেকগুলো আম, ফলসা, আর সুপারি গাছ, এক কথায় খুব মনোরম পরিবেশ।
দুপুরবেলা স্নান সেরে জামাকাপড় পরতে পরতে অভয় খেয়াল করলো, এই যা!! আয়না তো আনা হয়নি, এখন চুল আঁচড়াবে কি করে? চিরুনিটা ও বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল, কিন্তু আয়না আনতে ভুলে গেছে। এই দুপুরবেলা তো দোকানপাঠও সব বন্ধ হয়ে গেছে, তাও একবার গিয়ে দেখা যেতে পারে।
কোন রকমে আন্দাজে চুলটা আঁচড়ে সবে বেরোতে যাবে, এমন সময়ে ওর বারিওয়ালা সুধীনবাবু এসে হাজির। এক গাল হেসে ভদ্রলোক বল্লেন-
— সব ঠিক আছে তো বাবা, কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো?
— এমনিতে সব ঠিকই আছে কাকু, সবই এনেছি, এদিকে একটা আয়না আনতে ভুলে গেছি। ওটা কিনতেই বেরচ্ছিলাম।
— আয়না! আমার কাছে একটা আয়না আছে বটে, কিন্তু!!
— কিন্তু কি?
— আসলে আয়নাটার একটা বদনাম আছে। লোকে বলে আয়নাটা নাকি ভূতুড়ে।
— কি, ভূতুড়ে আয়না! হা হা হা হা। বাহ বেশ ইন্টারেস্টিং তো। আমি কিন্তু ভূতে বিশ্বাস করি না কাকু। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, ওসব ভূত টুতের জন্য আমাদের বিজ্ঞানে কোন জায়গা নেই।
— যে ঐ আয়নায় ভূত দেখেছিল সেও তোমার মতনই বিজ্ঞানের লোক ছিল বাবা।
— তাই নাকি! শুনি একটু গল্পটা।
— তাহলে যে একটু বসতে হয় বাবা, না বসলে এ গল্প বলা যাবে না। তার আগে আমাকে একটু ঠান্ডা জল খাওয়াতে পারো বাবা।
অভয় সুধীনবাবু কে ঘরে এনে বসালো, এক গ্লাস জল এনে দিলো, সাথে একটু মিষ্টি, ও বাজার থেকে কিনে এনেছিল। জল মিষ্টি খেয়ে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে সুধীনবাবু বলতে শুরু করলেন,
“আমার দাদু মানে ঠাকুরদা আর কি, তার বাবা, মানে আমার প্রপিতামহ ছিলেন তখনকার দিনে বিজ্ঞানের প্রফেসর। সারা জীবন দেশ বিদেশের বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার পর, শেষ জীবনে দক্ষিণ ভারতের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহন করে নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসেন ও এসে এই বাড়িটা তৈরি করেন। শুনেছি তখন নাকি এই জায়গাটা আরও শুনশান, নিরিবিলি, আর সবুজে ঘেরা ছিল, আর এটাই নাকি ওনার খুব পছন্দের ছিল। আমার দাদুর মুখে শুনেছি উনি নাকি দেশি, বিলিতি মিলিয়ে আট দশ রকমের ভাষা গড়গড় করে বলতে পারতেন। একে বিজ্ঞান ঋষি, তার উপরে ছিল আড়ম্বরহীন জীবন, সুতরাং বুঝতেই পারছ মানুষটা কেমন ছিলেন। অবসরের পর এখানে এই উপরের একটা ঘরে নিজের একটা ল্যাবরেটরি মতো বানান। সারাদিন বসে পাতার পর পাতা অঙ্ক কষতেন, আর নিজের একটা ডায়রিতে খসখস করে কি সব যেন লিখতেন। সে ডায়েরির লেখা আধা বাংলা, আধা ইংরিজি, আধা হিন্দি, উদ্ভট সব অঙ্ক, সব মিলিয়ে সে এক খিচুড়ি খাতা। আমি একবার পড়েছি সে ডায়রি, মাথা মুণ্ডু কিস্যু বুঝিনি। আর একটা কাজ করতেন। কি সব যন্ত্রপাতি এনে এটা ঠুকে, ওটা ঘসে কি একটা বানাতেন। তখনো তো এ দেশে কারেন্ট আসেনি, শুনেছি উনি নাকি এমন একটা পিদিম বানিয়েছিলেন যেটা জ্বালাতে আগুন লাগতো না। আলাদীনের পিদিমের মতন সেটার গা ঘসে দিলেই নাকি জ্বলে উঠত। আমি নিজে অবশ্য সে সব জিনিস চোখে দেখিনি। আসলে বুঝতেই তো পারো এসব জিনিস যত না ঘটে, তার বেশি রটে।
তা একদিন কি হল জানো, সকালবেলা ওনাকে নিজের ঐ ঘরে অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে পাওয়া যায়। আয়নাটার দিকে পা করে উপুড় হয়ে উল্টে পড়ে আছেন। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওনাকে বিছানায় শোয়ায়। জ্ঞান আস্তেই আয়নাটার দিকে তাকিয়ে চীৎকার করতে থাকেন, ‘ভেঙে দাও এ আয়না, এ আয়না শয়তানের আয়না। ওই, ওই আমায় আবার ধরে নিয়ে যাবে, দাও ভেঙে দাও এ আয়না, ভেঙে দাও’, এইসব। কে বেরিয়ে আসবে? কে ধরে নিয়ে যাবে? এই কথা জিজ্ঞেস করাতে উনি কি উত্তর দেন জানো? বলে ‘প্রবীণ’, ‘প্রবীণ পাল’ ওনাকে ধরে নিয়ে যাবে। এখন সব থেকে মজার কথা হল ওনার নিজের নামই ছিল ‘প্রবীণ চন্দ্র পাল’।
এই ঘটনার পরই উনি সম্পূর্ণ পাল্টে যান। বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে দেন, বাড়ির মানুষদের সাথে বেশি করে সময় কাটাতে থাকেন, আগে কথায় কথায় বাড়ির লোকেদের খ্যাঁক খ্যাঁক করতেন, কিন্তু এখন সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলতেন। এক কথায় ওনার চরিত্রে একটা আমূল পরিবর্তন আসে ঐ ঘটনাটার পর থেকে। কেউ ওনার গবেষণা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘আমার যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। আর বেশি না জানাই ভালো। প্রকৃতি যাকে যেখানে রেখেছে সে সেখানেই ভালো আছে। সব সম্পর্কেই পর্দাটা খুব প্রয়োজনীয়’।
এই ঘটনার প্রায় মাস ছয়েক পরেই উনি মারা যান। ওনার সেই আয়নাটা কিন্তু আর ভাঙা হয়নি, কিন্তু সেটাকে ওনার নির্দেশ মতন একটা কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সেই আয়না আর ওনার ডায়রিটা এখনো আছে আমার কাছে”।
২
নিঃশ্বাস বন্ধ করে সুধীনবাবুর কথাগুলো শুনছিল অভয়। কথা শেষ হতে ও বলল, “বাঃ, বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। আমি কি ঐ জিনিসগুলো একবার দেখতে পারি?”
এতক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলতে বলতে একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলেন সুধীনবাবু, একটু থেমে এক বুক দম নিয়ে উনি বললেন, “সব কিছু ঐ দোতলার ঘরেই আছে। চল তোমায় নিয়ে যাই। ওখানে ঐ আয়নাটা ও আছে, দেখো তোমার যদি পছন্দ হয় তাহলে তুমি রেখে দিও, এমনিতেও জিনিসটা পড়েই আছে”।
দুজনে মিলে উপরের তলাতে যায়। সুধীনবাবু একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করেন। ঘরের দরজাটায় একটা পুরানো আমলের তালা ঝুলছে। সুধীনবাবু তালাতে চাবি পুরে বার কয়েক এদিক ওদিক ঘোরান। পুরানো তালা, জং ধরে গেছে। একটু কসরত করতেই তালাটা খুলে যায়। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করতে করতে দরজাটা খুলে যেতেই ভিতরে অনেকদিনের জমে থাকা একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে অভয়ের নাকে লাগে।
সুধীনবাবু আগে ভিতরে ঢুকে ঘরের জানালা গুলো খুলে দেন, ঘরটা এবার আলোতে ভরে ওঠে। ঘরের মেঝেতে বহু বছরের ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়ে আছে, ছাদ থেকে ঝুলছে ঝুল আর মাকড়সার জাল। নাকে রুমাল চেপে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে অভয়। ঘরটা হরেক রকম জিনিসে পরিপূর্ণ, চেয়ার, টেবিল, একটা ভাঙা ইজি চেয়ার, অনেকগুলো কাঠের তৈরি বইয়ের আলমারি আর তাতে ঠাসা নানান রকমের বই। টেবিলের উপর ছড়ানো একটা ভাঙা দেয়াল ঘড়ি, কাঁচের কাপ, চুম্বক, পেরেক, কিছু চকমকি পাথর, দিস্তা দিস্তা কাগজ, ফাঁকা কালির দোয়াত, আর একটা নিব ভাঙা ফাউন্টেন পেন ইত্যাদি।
একটু খকখক করে কেশে সুধীনবাবু বল্লেন, “এই হল গিয়ে আমার দাদুর বাবা, বা বাবার দাদু, যাই বল, সেই প্রবীণ পালের ঘর। এখন এটা একপ্রকার স্টোররুম হয়ে গেছে বলতে পারো, আর তেমন ব্যবহার করা হয় না, ভাঙা জিনিসপত্র রাখা হয়। ঐ যে ইজি চেয়ার খানা দেখছ, ওটা আমার দাদু কিনেছিলেন এক নিলামে। খাঁটি মেহগনি কাঠের জিনিস। আরও অনেক দামী, কমদামী জিনিস ছড়িয়ে আছে এই ঘরে”।
অভয় একটা বইয়ের আলমারির কাছে গিয়ে বইগুলো দেখতে লাগলো। শুধু বিজ্ঞান না, সাহিত্য, গনিত, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি নানা বিষয়ের, আর নানা ভাষার বই। একটা সংস্কৃতে লেখা মহাভারত ও চোখে পড়ল অভয়ের। এছাড়া আছে নানান বিদেশী বই, এসবের মধ্যে ‘জন মিলটন’ এর ‘প্যারাডাইস লস্ট’ এর চারটে খণ্ডও দেখতে পেল। ভদ্রলোক রীতিমত সাহিত্যমনস্ক ও ভাষাবিদ ছিলেন বলতে হবে।
বই দেখা হলে ও টেবিলের কাছে এসে কাগজগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। অনেক পুরানো কাগজ, কালি চটে গেছে। তবু এটুকু বুঝল ওগুলোতে নানান আঁকি বুকি কাটা, আর অঙ্ক করা।
“এই যে, এই সেই আয়না”, সুধীনবাবুর গলা পেয়ে অভয় পিছনে ফিরে দেখল উনি ঘরের কোনে একটা পুরানো আয়নার উপর থেকে একটা কালো কাপড় সরাচ্ছেন। আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল অভয়। অনেক পুরানো সাবেকি আমলের বড় আয়না। আয়নাটার চারপাশের ফ্রেমে কাঠ খোদাই করে অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য করা। এখানকার দিনে এমন বড় আয়না আর দেখা যায় না। আয়নাটার সামনে দাঁড়ালো অভয়, ওপাশে ওর আর সুধীনবাবুর প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। অনেক পুরানো হওয়ায় আর ধুলো পড়ে যাওয়ার জন্য কাঁচটা সামান্য ঘোলাটে, তবে মুখ ভালোই দেখা যায়। ঝাড়পোছ করলে আরও কিছুটা চকচকে হবে।
“এ-তো অ্যান্টিক জিনিস মশাই, এ জিনিস তো মিউজিয়ামে পেলে লুফে নেবে” – জিনিসটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল অভয়।
একটু হেসে সুধীনবাবু বল্লেন, “তা যা বলেছ। তবে কি জানো তো, বাপ, ঠাকুরদার আমলের জিনিস, কাছ ছাড়া করতে মন চায় না। আমার আবার এই সব ব্যাপারে একটু সেন্টিমেন্ট আছে। তা তোমার কি এটা দিয়ে কাজ চলবে?”
— চলবে মানে! দৌড়বে। এমন সুন্দর একটা আয়না ঘরে থাকলে তো ঘরের ভোল ই পাল্টে যাবে। তবে একটু ধুলো টুলো ঝেড়ে নিতে হবে। এতো সুন্দর একটা জিনিসকে আপনি ভৌতিক বলছিলেন হ্যাঁ!
— তা তোমার যখন অসুবিধা নেই, তাহলে চল দুজনে ধরে এটাকে নিচের ঘরে নিয়ে যাই।
দুজনে ধরাধরি করে জিনিসটাকে নিচের ঘরে নিয়ে এল। অভয় একটা কাপড় জলে ভিজিয়ে ভালো করে মুছে দিলো আয়নাটাকে। ধুলো বালি উঠে যাওয়ার পর সত্যি রূপ খুলেছে আয়নাটার। অভয়ের ঘরটাকে যেন আলো করে আছে জিনিসটা। আয়নাটার ঠিক সামনে একটা প্রদীপ বা পিদিম বসানোর জন্য সুন্দর একটা জায়গা করা আছে, নীচে একটা পাল্লা দেওয়া দেরাজ। যতই দেখছিল, ততই জিনিসটাকে ভালো লেগে যাচ্ছিলো অভয়ের।
“কাকু, আপনি একটা ডায়রির কথা বলছিলেন, কই সেটা তো দেখলাম না”, বলল অভয়।
সুধীনবাবু আয়নাটার নিচের দেরাজ খুলে একটা প্লাস্টিকের মোড়ক বের করে আনলেন। প্লাস্টিকের মোড়কটা থেকে ডায়রিটা বের করতে করতে সুধীনবাবু বললেন, “আসলে আমিই জিনিসটা প্লাস্টিকে মুড়ে রেখেছি, যাতে পোকামাকড়ে কেটে না দেয়”।
বাদামি রঙের চামড়ায় বাঁধাই করা ডায়রিটা। ভিতরে ইংরাজি হরফে তারিখ, মাস, ও বছর লেখা, সন 1870। প্রথম পাতাটা খুলল অভয়, বড় বড় করে ইংরাজি হরফে লেখা পি.সি.পাল, এক্স প্রফেসর, মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি। হাতের লেখা ঝরঝরে মুক্তোর মতন। ডায়রিটার পাতা উল্টোতে লাগলো অভয়, ভিতরে ইংরেজি, বাংলা, ও হিন্দি হরফে কি সব হাবি জাবি লেখা, আর উদ্ভট সব মাথামুণ্ডু হীন অঙ্ক করা।
ডায়রিটা তেইশে নভেম্বর অব্দি টানা লেখা, তারপর আবার চব্বিশে ডিসেম্বরের পাতায় বাংলায় কিছু লেখা। এই একমাস আর ডায়রিতে কিছু লেখা নেই। চব্বিশে ডিসেম্বরের পরের পাতাগুলো ও ফাঁকা।
ভালোভাবে পড়ে দেখবে বলে সুধীনবাবুর কাছ থেকে ডায়রিটা চেয়ে নিল অভয়। সুধীনবাবুও আপত্তি করলেন না, শুধু বললেন, “একটু যত্নে রেখো। বুঝতেই তো পারছ বাপ, ঠাকুরদার আমলের স্মৃতি”।
৩
সন্ধ্যাবেলা তাড়াতাড়ি সব কাজকর্ম সেরে ডায়রিটা নিয়ে বসলো অভয়। নামের পরের পাতাটা খুলতেই অভয় দেখল একটা কবিতার মতন কিছু লেখা-
‘ইংরেজদের তালে মিলে
বাংলায় আজও ফরাসি চলে।
হিন্দুস্থানী বা জার্মানি
বাঙালি, তাও অঙ্ক জানি।
দেশি বিলিতি যায় না বোঝা,
নিজেকে খোঁজা কি এতই সোজা?’
‘বাবা, ভদ্রলোক বেশ তাল মিলিয়ে পদ্য লিখতে পারতেন তো’ – মনে মনে ভাবল অভয়, যদিও লেখাটার মাথামুণ্ডু কিছুই মাথায় ঢুকল না ওর। আচ্ছা এটা কি কোনোরকমের সাংকেতিক কিছু, নাকি স্রেফ ভদ্রলোকের খামখেয়াল? এসব মানুষগুলো স্বভাবতই একটু তারকাটা হয়ে থাকে। আর একবার লেখাটা পড়ল অভয়, নাহ্, কিচ্ছু উদ্ধার করতে পারল না ও।
পরের পাতাগুলো ধীরে ধীরে উল্টাতে লাগলো অভয়। পাতাগুলোতে বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি মেশানো কি সব লেখা। লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করলো অভয়। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর ও বুঝতে পারল লেখাগুলোর কোনটাই বাংলা, ইংরাজি, বা হিন্দি ভাষা নয়। ভাষা গুলো অন্য কোন ভাষা, শুধু হরফ গুলো বাংলা, ইংরাজি, বা হিন্দি হরফ।
‘জিনিয়াস’- শব্দটা আনমনেই বেরিয়ে এলো অভয়ের মুখ দিয়ে। মনে মনে ভদ্রলোকের জ্ঞান ও বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না অভয়। সত্যি এমন প্রতিভাও যে এক সময়ে ভারতবর্ষে ছিল এটা ভেবেও ওর বেশ গর্ব বোধ হল।
অন্য লোক বা খারাপ কেউ যাতে বুঝে না ফেলে সেই জন্যই যে এই ভাষার কারিগরি সেটা বেশ বুঝতে পারে অভয়। তার মানে হতে পারে এই ডায়রিতে নিশ্চয়ই এমন কোন তথ্য আছে যেটা বিজ্ঞানের জগতে, বা মানবসভ্যতার ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান কিছু।
তেইশে নভেম্বরের পাতাটা খুললো অভয়, এই পাতার পর ডায়রিটা প্রায় ফাঁকা। এই পাতাটাতে বাংলা ইংরাজি মেশানো কিছু লেখা, লেখাটা এই রকম-
‘Irutiyaka oru inai pirapancattai uruvakka mutintatu. ফিনালেমেন্ট, লে পৌভোর দে লে গ্র্যান্ডে কাভিটে আ এটে ফেইট পৌ্র পেনেটেরের লে মোলিইল। Enakku pitittavaikali onru tan enakku teriyum. যে ভেস্ক জুসতে লে রেন কনটেরর উনে ফোইস। Avar anuvaraiyo allatu marravaraiyo parka ventum. জে না সাইস পাশ কুত্তই ফাইরে। Anal vinnanattirku inta katavu tirakka ventum’।
লেখাটা পড়ে মনে মনে হেসে ফেলল অভয়, ও এটার মাথা মুণ্ডু কিচ্ছু বোঝেনি। অভয় এতো ভাষা জানে না, ও কোন ভাষাবিদ নয়। তবে ওর এটুকু মনে হল এটা হয়তো ওনার পুরো কাজটার সিদ্ধান্ত বা উপসংহার জাতিও কিছু।
পুরো ডায়রিটা আরও একবার ভালো করে দেখল অভয়, অনেক জায়গায় বাংলায় কিছু সমীকরণ বা অঙ্ক করা। যেমন, ‘ড(কাল), ড(স্থান), আবার ৎ ড (কাল)= ধ্রুবক’, এই রকম।
কিছু কিছু জায়গায় এইরকম অঙ্কের শেষে কিছু গানিতিক মানের উল্লেখ আছে। এক্ষেত্রেও বাংলা হরফে গনিতের সংখ্যা গুলোই ব্যবহার করা হয়েছে, মানে ১, ২… এইসব।
ডায়রিটা বন্ধ করে টেবিলের উপর রেখে দিলো অভয়। উফ, ওর মাথা ধরে গেছে, এ জিনিস উদ্ধার করা ওর কম্মো নয়। জীবনে কক্ষনো ও এতো ঘাঁটা জিনিস দেখেনি।
কয়েকটা শব্দকে ও অনেকবার দেখেছে ডায়রির মধ্যে, শব্দগুলোকে ও একটা নোটবুকে টুকে রাখলো। শব্দগুলো হল ‘Inai, Nerem, মন্দ্রে’ ইত্যাদি কয়েকটা শব্দ, এগুলো ভদ্রলোক অনেকবার ব্যবহার করেছেন ওনার ডায়রিতে।
ডায়রিটা রাখার পর আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায় অভয়। সুন্দর আয়না, ধোয়া মোছার পর কাঁচটাও পরিষ্কার লাগছে। আয়নার ওপারে ফুটে উঠেছে অভয়ের প্রতিবিম্ব। অনেকক্ষণ নিজের প্রতিবিম্বের দিকেই তাকিয়ে থাকে অভয়, ওর মনে পড়ে কে যেন বলেছে যে মানুষের সব থেকে আপন হল তার প্রতিবিম্ব, কারন মানুষ যখন কাঁদে তার প্রতিবিম্ব ও তার সাথে কাঁদে। নিজের মাথার বাঁ দিকের কাটা দাগটায় হাত বোলায় অভয়, ছোটবেলায় স্কুলে এক বন্ধুর সাথে মারামারি করার সময় বন্ধুটা ইট দিয়ে ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল, সেই থেকে ঐ দাগটা ওর মাথায় আছে।
আয়নাটাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করেও এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই দেখল না অভয়। কেন যে সুধীনবাবুরা এটাকে ভৌতিক মনে করে কে জানে?
রাতে শুয়ে শুয়ে ডায়রিটার কথাই ভাবতে লাগলো অভয়। ইস, ও যদি ভাষাগুলো বুঝতে পারতো।
হঠাৎ একটা কথা ওর মাথায় আচমকাই খেলে গেল। ও উঠে আলো জ্বালিয়ে ডায়রিটা ফের খুলল। ডায়রিতে করা অঙ্ক গুলোকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো অভয়। ধীরে ধীরে একটা জয়ের হাসি ফুটে উঠলো অভয়ের মুখে। ইউরেকা, ইউরেকা, ও পেরেছে, পেরেছে অঙ্ক গুলোর পিছনের ধাঁধাটা ধরতে।
অঙ্কগুলোতে এক অভিনব বাঙালীয়ানা দেখিয়েছেন প্রবীণ পাল মহাশয়। অঙ্ক গুলতে ‘ড’ হল ডেরিভেটিভ বা অবকলন এর চিহ্ন, আর ‘ৎ’ হল ইন্টিগ্রেশন বা সমাকলন এর চিহ্ন। মানে ‘ড(কাল)’ হল আসলে dt, ‘ড(স্থান)’ অর্থাৎ dx ।
অসাধারন, সত্যি অসাধারন, এরকম চিন্তাভাবনা যে কোন মানুষের মাথায় আসতে পারে, এটা ভেবেই আশ্চর্য হল অভয়। অভয় ঠিক করল ও এই সমীকরণ গুলোকে বুঝে বুঝে আলাদা জায়গায় লিখবে, তারপর দেখবে কিছু বোঝা যায় কিনা।
পুরো ডায়রির সমীকরণ গুলোকে বুঝে বুঝে সঠিক গাণিতিক রূপ দিতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে গেল অভয়ের। মাঝে মাঝে কিছু কিছু চিহ্নের তাৎপর্য বের করতে বেশ মাথা খাটাতে হয়েছে অভয়কে। ভদ্রলোক শুধু ইংরেজি নয়, অঙ্কে ব্যবহৃত চলতি গ্রীক অক্ষর গুলোকেও বাংলা রূপ দান করেছেন, যেমন ‘থিটা’ হয়েছে ‘ষ’, ‘ফাই’ হয়েছে ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘টাও’ হয়েছে ‘ঢ’, ইত্যাদি। অনেক সময় ব্যাপারগুলো বুঝতে রীতিমতন নাজেহাল হতে হয়েছে অভয়কে। আবার অনেক চিহ্নের সমার্থক চিহ্ন ও এখনো বুঝতেই পারেনি।
শেষ অব্দি মোটামুটি যা ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে তা অনেকটা আইনস্টাইনের ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের সাথে মিল খায়। কিন্তু শুধু রিলেটিভিটি ই না, এখানে অন্য কোন একটা জিনিসেরও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ভদ্রলোক। কিন্তু কপাল খারাপ, সে সব জিনিস বোঝার উপায় নেই অভয়ের, কারন সমীকরণগুলোর সাথে যে ব্যাখ্যা গুলো আছে তা আবার সেই দুর্বোধ্য ভাষায়।
অভয় ওর ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির বই পত্তর ঘেঁটেও তেমন কিছুই বুঝতে পারেনি। ব্যাপারটা সম্বন্ধে বেশ একটা কৌতূহল জন্মে গেছে ওর। ওর মন বলে ডায়রিটার মধ্যে নিশ্চয়ই বড় কোন আবিষ্কারের সূত্র দিয়ে গেছেন প্রবীণ পাল মহাশয়। আর সত্যিই যদি ভদ্রলোক আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে অসামান্য কোন আবিষ্কার করে গিয়ে থাকেন তবে বাঙালি হিসাবে এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
সুধীনবাবু এখনো মাঝে মাঝে আসেন, অভয়ের সাথে গল্প সল্প করে যান। সেদিন জিজ্ঞেস করছিলেন যে ডায়রি পড়ে অভয় কিছু বুঝতে পারল কিনা? অভয় অবশ্য সেভাবে ভেঙে কিছু বলেনি, বলেছে, “ডায়রিটা বেশ ইন্টারেস্টিং, বোঝার চেষ্টা করছি”।
আয়নার ভিতর থেকে কোন ভূত আজ অব্দি বেরল কিনা জানতে চাওয়ায় অভয় মজা করে বলেছে, “ হ্যাঁ বেরিয়েছে তো। এই তো আপনার সাথে বসে গল্প করছে”। সুধীনবাবু কিছুক্ষন অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর হো হো করে হেসে উঠে, অভয়ের পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলেছেন, “ তুমি তো বেশ বদমাশ হে ছোঁড়া, বুড়ো মানুষকে ভয় দেখানো”।
৪
আরও মাস খানেক কেটে গেছে, অভয় এখনো ডায়রির লেখা কিছুই তেমন উদ্ধার করতে পারেনি। এছাড়া এই কদিন ও নিজের রিসার্চের কাজেও বেশ ব্যাস্ত ছিল। আজ অভয়ের জন্মদিন, সহকর্মী বন্ধুদের জোরাজোরিতে ও নিজের বাড়িতে একটা ছোট্ট খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা হলেন সুধীনবাবু এবং ওনার পরিবার আর অভয়ের তিন কলিগ প্রণব, গুরমিত, আর চন্দ্রাপ্পা। গুরমিত পাঞ্জাবী ছেলে, কিন্তু ছোটবেলা থেকে বাংলায় থাকায় ভালোই বাংলা বলে। আর চন্দ্রাপ্পা তামিলনাড়ুর ছেলে, ও ইংরাজি ছাড়া কথা বলতে পারে না।
সামান্যই আয়োজন করেছে অভয়, মাংস-ভাত, চাটনি, পাঁপড়, আর মিষ্টি। চন্দ্রাপ্পা সাউথ ইন্ডিয়ান হলেও ননভেজ খায়, ফলে অসুবিধা নেই।
অভয়ের বন্ধুরা আগে আগে চলে আসে ওকে সাহায্য করার জন্য। অভয়ের ঘরে ঐ সাবেকি আয়নাটা দেখে ওরা খুব আশ্চর্য হয়। সকলেই খুব তারিফ করে জিনিসটার। অভয় ওদের আয়নাটার পিছনের গল্প বল্লে ওরা সকলে একটু হাসাহাসি করে। গুরমিত বলে, “ভাই তোমার কপাল ভালো থাকলে বলা তো যায়না ভূত দেখতেও তো পারো”।
অভয় অবশ্য ডায়রির কথাটা ওদের কাছে চেপে যায়। সন্ধ্যাবেলা অভয়ের পার্টি বেশ জমে ওঠে। সুধীনবাবু মজার মজার গল্প বলেন, ভদ্রলোক একাই যে কোন মজলিস জমিয়ে দিতে পারেন, অভয়ের বন্ধু প্রণব গান করে, ওর সুন্দর গানের গলা, এসবে সত্যি বেশ জমে ওঠে সন্ধ্যেটা।
চন্দ্রাপ্পার বাড়ি থেকে ফোন আসতে ও পাশের ঘরে চলে যায়। অভয়কেও একটা দরকারে একটু পাশের ঘরে যেতে হয়। চন্দ্রাপ্পা নিজের বাড়ির লোকের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলছে। হঠাৎ চন্দ্রাপ্পার মুখে ‘Nerem’ শব্দটা শুনে চমকে ওঠে অভয়। এই শব্দটা ও অনেকবার দেখেছে ডায়রিতে। চন্দ্রাপ্পার ফোন শেষ হতেই অভয় ওকে শব্দটার মানে জিজ্ঞেস করলে ও বলে ‘Nerem’ মানে হল ‘Time’ বা সময়। অভয় মনে মনে ভাবল ‘সময়ের ব্যাপার যে আছে সেটা সমীকরণগুলো দেখেই বুঝেছি, কিন্তু এখন বুঝলাম কিছু কিছু শব্দ ওখানে তামিল’।
রাত্রে অতিথীরা সব বিদায় নিলে ফের ডায়রিটা নিয়ে বসলো অভয়। মনে মনে ও ডায়রির প্রথম পাতার ধাঁধাঁ টার একটা সমাধান বের করেছে-
‘ইংরেজদের তালে মিলে’- ‘তালে মিলে’ শব্দটা থেকে ‘লে’ বাদ দিলে থাকে তা মিলে, মানে ‘তামিলে’, অর্থাৎ ইংরাজি অক্ষরের লেখাগুলো সব তামিল ভাষায় লেখা।
‘বাংলায় আজও ফার্সি চলে’- ‘ফরাসি’ মানে ফরাসি শব্দ। তাহলে দাঁড়ালো এই বাংলা লেখাগুলো আসলে ফরাসি বা ফ্রেঞ্চ শব্দ।
‘হিন্দুস্থানী বা জার্মানি’- হিন্দুস্তানী দের ভাষা মানে হিন্দি ভাষা। তার মানে হিন্দিতে লেখা শব্দগুলো হল জার্মান শব্দ।
‘বাঙালি, তাও অঙ্ক জানি’- আরে হ্যাঁ তাই তো, অঙ্কগুলো তো সব বাংলাতেই করা।
‘দেশি বিলিতি যায় না বোঝা’- ঠিক, দেশি শব্দের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশী হরফ, যেমন তামিল এর জন্য ইংরিজি। আবার বিদেশী শব্দের জন্য দেশি হরফ, মানে ফ্রেঞ্চ এর জন্য বাংলা, আবার জার্মানির জন্য হিন্দি।
‘নিজেকে খোঁজা কি এতই সোজা’- এই লাইনটার মানে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি অভয়। এটা কি বুড়োর খামখেয়ালীপনা? নিজেকে খোঁজা মানে? নিজেকে আবার মানুষ খুঁজবে কিভাবে? শেষ লাইনে কি ফিলোজফি ঝেড়েছে নাকি বুড়ো?
তবে যাই হোক, ভদ্রলোকের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, আর জ্ঞানের সম্ভারে ফের একবার মুগ্ধ হয়ে যায় অভয়।
ডায়রিটা খাটে নিজের মাথার কাছে রেখে উঠে দাঁড়ায় অভয়। বাইরে এখন ঝিঁঝিঁ ডাকছে, চারিদিকে অপার নিস্তব্ধতা। মনে মনে বেশ শিহরিত হয় অভয়, একটা রোমাঞ্চ অনুভব করে নিজের মধ্যে। এতো দিনে ও ডায়রির ধাঁধাঁটার সমাধান করতে পেরেছে, আর তাও আবার নিজের থেকে।
ও ঠিক করে নিয়েছে, কাল কলেজের লাইব্রেরি থেকে ও একটা ফ্রেঞ্চ ডিকশেনারি তুলবে, তারপর সমস্ত ফরাসি লেখাগুলোকে অনুবাদ করবে ইংরাজিতে। তামিলের জন্য চন্দ্রাপ্পা তো আছেই। বাকি রইল জার্মান শব্দগুলো, ওগুলো নয় পরে দেখা যাবে, আগে এই অব্দি তো হোক।
ডায়রিটা রেখে বন্ধুদের দেওয়া জন্মদিনের উপহারগুলো নিয়ে বসে অভয়, সত্যি সবাই অনেক কিছু এনেছে ওর জন্য। এখন সমস্যা হল এই এতো জিনিস এখন রাখবে কোথায় অভয়? ওর ঘরে তো আলমারি বা তেমন কিছুই নেই। বইয়ের শেলফটাও বই দিয়ে ভর্তি।
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ওর চোখ পড়ল আয়নার নীচের দেরাজটার দিকে। হ্যাঁ ঐ তো ভালো জায়গা, ওখানে তো জিনিসগুলো রাখাই যায়।
বেশ বড়ই দেরাজ খানা, ভিতরে অনেকটা জায়গা, তবে অনেক দিন ব্যবহার না করার ফলে ভিতরে ধুলো পড়েছে। একটা কাপড় দিয়ে ভিতরের ধুলো মুছে দেয় অভয়। মুছতে গিয়ে হঠাৎ অভয়ের হাতে নরম কিছু একটা ঠেকে। আঙুল দিয়ে সেই নরম জায়গায় অল্প চাপ দিতেই ভিতরে আর একটা ছোট্ট দেরাজ মতন খুলে যায়।
দেরাজের অত ভিতর পর্যন্ত ঘরের আলো ঢুকছে না। অন্ধকার সেই কুঠুরিতে ভয়ে ভয়ে হাত ঢুকিয়ে দেয় অভয়। শক্ত একটা কিছু ঠেকে ওর হাতে। খুব আলতো করে ধরে জিনিসটাকে বাইরে বের করে আনে অভয়। জিনিসটা আর কিছুই না, একটা পুরানো, ময়লা, রং চটে যাওয়া, তেলচিটে, ঢাকনা দেওয়া পিদিম।
৫
পিদিমটাকে হাতে নিয়েই চমকে ওঠে অভয়। আরে, এটা সেই পিদিমটা নয় তো যার কথা সুধীনবাবু বলেছিলেন, সেই যে ঘসা দিলেই নাকি জ্বলে ওঠে!
পরীক্ষা করার জন্য জিনিসটাকে বাঁ হাতে ধরে ডান হাত দিয়ে ঘসতে থাকে অভয়। চিড়চিড় করতে করতে সত্যি সত্যিই একসময় জ্বলে ওঠে পিদিমটা। এবার বেশ ভয় পেয়ে যায় অভয়, কি অদ্ভুতুড়ে জিনিস রে বাবা। ও সত্যি এমন জিনিস কক্ষনো দেখেনি।
জিনিসটাকে আরও বার কয়েক পরীক্ষা করার পর ওটার মেকানিজম বুঝতে পারে অভয়। আসলে খুব ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায় পিদিমটার গায়ে খুব সূক্ষ্ম একটা বোতাম মতন আছে। পিদিমে ঘসা দেওয়ার সময় আসলে ঘসা লাগে সেই বোতামে। এখন এই বোতামটাকে যুক্ত করা আছে পিদিমের মুখে লাগানো দুটো চকমকি পাথরের সাথে। পিদিমের ঠিক মুখ থেকে বেরিয়ে আছে একটা সলতে, যা চোবানো আছে পিদিমের ভিতরে ভরে রাখা তেলের মধ্যে। বোতামে ঘসা দিলে ঘসা পড়ে মুখের চকমকি পাথর গুলতে, ফলে আগুনের ফুলকি তৈরি হয়, আর তাতেই জ্বলে ওঠে তেলে ভেজা সলতে। ব্যাপারটা অনেকটা আধুনিক দিনের গ্যাস লাইটারের মতন।
মনে মনে হেসে ওঠে অভয়, ও সত্যিই বেশ ঘাবড়ে গেছিলো। সত্যি বিজ্ঞানকে ভালো ভাবে না বুঝলে সব কিছুই ভোজবাজির মতন লাগে। জিনিসটাকে বাইরে রাখে অভয়, এটা ও সুধীনবাবুকে দেখাবে। বেশ খুশি হবেন ভদ্রলোক জিনিসটা পেয়ে।
গিফটগুলোকে দেরাজে ভরে, পিদিমটাকে হাতে করে উঠে দাঁড়ালো অভয়। আজ ওর মনে খুব আনন্দ। একই দিনে ও ডায়রির ধাঁধাঁটার প্রায় সমাধান করে ফেলেছে, আর এই একই দিনে ও খুঁজে পেয়েছে পিদিমটাকে। পিদিমটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো অভয়, একেবারে অ্যান্টিক জিনিস, আজকাল হাই টেকনোলজির যুগে এসব জিনিস আর দেখতে পাওয়া যায় না। রং বেশ চটে গেছে জিনিসটার। নাড়িয়ে দেখল অভয়, ভিতরে এখনো কিছুটা তেল অবশিষ্ট আছে।
সবে জিনিসটাকে রাখতে যাবে এমন সময় দপ করে নিভে যায় ঘরের বাতি গুলো, লোডশেডিং। এই পাড়ায় লোডশেডিং এমনিতে কমই হয়, কিন্তু ইদানিং এর দৌরত্ম বেশ বেড়েছে।
অন্যদিন অভয় এমন সময় মোমবাতি দেশলাই খোঁজার জন্য ছুটোছুটি করে, কিন্তু আজ আর সাধারন দিনের মতন হুরপার করতে হয় না অভয়কে। খুব শান্ত ভাবেই নিজের যাদু চিরাগে ঘসা দেয় অভয়, সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে পিদিমখানা। এক মোহময় আলো আঁধারিতে ভরে ওঠে অভয়ের সারা ঘর।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে অভয়, ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে, তারই ভিতর আশেপাশের বাড়ির জানালা দরজা দিয়ে ঠিকরে আসছে মোমবাতি বা এমারজেন্সির ল্যাম্পের আলো। একটা আলাদা রকমের অনুভূতি হয় অভয়ের, ওর মনে হয় ও যেন চলে এসেছে সুদূর অতীতের আরব্যরজনীর বাগদাদ শহরে, আর সেই শহরে ও যেন সেই আশ্চর্য চিরাগ হাতে আলাদীন।
আপন মনেই হেসে ওঠে অভয়। কি সব আলতু ফালতু ভাবছে ও আজ! পিদিমটাকে আয়নার সামনে যে প্রদীপ বা পিদিম রাখার জায়গা আছে সেখানে বসিয়ে দেয় অভয়, পুরো খাপে খাপে বসে যায় জিনিসটা, জায়গাটা যেন এটার মাপেই বানানো।
পিদিমটা রেখে, বিছানার কাছে এসে মাথার কাছ থেকে ডায়রিটা ফের তুলে নেয় অভয়। ও এখনো ধাঁধাঁটার শেষ লাইনটার মানে বোঝেনি।
নির্দিষ্ট পাতাটা খুলে সবে পড়তে যাবে, হঠাৎ একটা মৃদু ঝন ঝন শব্দে পিছনে ফিরে তাকায় অভয়। ওর মনে হয় ওর আয়নাটা যেন হঠাৎ থর থর করে কাঁপছে। ডায়রিটা হাতে নিয়েই আয়নাটার কাছে এসে দাঁড়ালো অভয়, কিন্তু কই আর কিছু কাঁপছে না তো, কোন শব্দ ও আর নেই! তাহলে কি এটা অভয়ের মনের ভুল?
মুখ তুলে চাইল অভয়, আয়নার ওপারে দাঁড়িয়ে অভয়েরই প্রতিবিম্ব। আয়নাটার ঠিক নিচের দিকে জ্বলছে পিদিমটা, এক রহস্যময় আলো ছায়া ফুটে উঠেছে অভয়ের চোখে মুখে। অভয়ের মনে হচ্ছে আয়নার ওপারের মানুষটা যেন সে নয়, অন্য কেউ।
হাতের ডায়রিটার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল অভয়, কিন্তু প্রায় আবার সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠে আয়নাটার দিকে তাকাল। ওর যেন মনে হল আয়নায় ওর যে প্রতিবিম্ব সে যেন মুখ ফেরাল না ওর মতন। প্রতিবিম্বটা যেন শান্ত, স্থির চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অভয়ের দিকে।
এইবার বেশ ভয় করতে থাকে অভয়ের, ও নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করে এ সবকিছু ওর মনের ভুল, নিছক কল্পনা মাত্র। আয়নাটার আর একটু কাছে এগিয়ে আসে অভয়, ওর সাথে সাথে ওর প্রতিবিম্বটাও এগিয়ে আসে। খুব ভালো করে নিজের প্রতিবিম্বটাকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে অভয়, কিছু তো একটা গলদ আছে, কিছু তো একটা আলাদা, এটা যেন ওর প্রতিবিম্ব নয় অন্য একটা মানুষ।
নিজের কপালের বাঁ দিকের কাটা দাগটায় হাত বোলায় অভয়, অনুকরণ হয় প্রতিবিম্বটাতেও। এইবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চমকে ওঠে অভয়। কি হল ব্যাপারটা! অভয়ের কপালের দাগটা বাম দিকে, কিন্তু প্রতিবিম্বের কপালে যে দাগটা আছে সেটা ডান দিকে। অভয় যখন ডান হাত তুলে বাঁ কপালে হাত বোলালো, ওর প্রতিবিম্ব বাঁ হাত তুলে ডান কপালে হাত বোলালো। এছাড়া অভয় ওর বাঁ হাতে ধরে আছে ডায়রিটাকে, ওর প্রতিবিম্ব সেটা ধরে আছে ডান হাতে।
এই সব মনে মনে ভাবছে অভয় হঠাৎ করে পুরো অন্ধকার হয়ে যায় আয়নার কাঁচটা, নিভে গেছে পিদিমের আলো। চমকে ওঠে অভয়, খেয়াল হতে দেখল, না ওর পিদিমটা তো জ্বলছে, পুরো ঘরে এখনো আলো। অভয় দেখল নিভে গেছে আয়নার ওপারে ওর পিদিমের যে প্রতিবিম্ব পড়েছিল সেটা। এ কি করে সম্ভব! প্রতিবিম্ব কি কখনো এভাবে বস্তুর থেকে আলাদা আচরণ করতে পারে?
আয়নার কাঁচটা এখন নিকষ কালো, ওটাতে এপারের কোন আলোই আর প্রতিফলিত হচ্ছে না। অভয় আর দেখতে পাচ্ছে না ওপাশের প্রতিবিম্বের অভয়কে। অভয়ের মনে হয় আয়নার কাঁচটা যেন আর কাঁচ নেই, তার জায়গায় ওখানে যেন এখন একদলা জমাট বাঁধা অন্ধকার, যেন কেউ একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে কাঁচটার জায়গায়, একটা কালো, অন্ধকারচ্ছন্ন পর্দা যা আড়াল করে রেখেছে কোন অলৌকিক, কোন মহাজাগতিক রহস্যকে।
গলা শুকিয়ে আসে অভয়ের। তবু ও বিজ্ঞানের ছাত্র, ভূত, প্রেত, অলৌকিক এসব ও মানে না।
খুব সন্তর্পণে অভয় হাত রাখে আয়নার কাঁচটাতে, আর ঠিক তখনই কোন অদৃশ্য শক্তির হ্যাঁচকা টানে হুড়মুড় করে সামনে দিকে এগিয়ে যায় অভয়। সেই টান অভয়কে টেনে নিয়ে যেতে চায় কোন অজানা, অচেনা পথের উদ্দেশ্যে। অভয় প্রান পনে চেষ্টা করতে থাকে সেই টান প্রতিরোধ করার, কিন্তু কি প্রচণ্ড, কি আসুরিক সেই টান। চীৎকার করতে যায় অভয়, কিন্তু ওর গলা দিয়ে এক ফোঁটাও শব্দ বের হয় না।
আয়নার কাঁচটা যেন এখন একটা চামড়ার পর্দার মতন হয়ে গেছে, আর সেই চামড়া ভেদ করেই একটু একটু করে ভিতরে ঢুকে যেতে থাকে অভয়। অভয়ের মনে হয় কোন এক অন্ধকার পথের মধ্যে দিয়ে কেউ যেন হিড়হিড় করে প্রচণ্ড বেগে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। চোখ মেলে তাকায় অভয়, ওর পথের সমান্তরালে যেন আর একটা আয়না বসানো। সেই আয়নার বুকেও ফুটে উঠেছে অভয়ের প্রতিবিম্ব। পার্থক্য শুধু একটাই এই প্রতিবিম্বের অভিমুখ সম্পূর্ণ অভয়ের বিপরীতে।
অনেক দূরে একটা ক্ষীণ আলো দেখতে পায় অভয়, যেন দূরে কোথাও পিদিম জ্বলছে, অভয়েরই সেই পিদিমটা, আর সেই দিকেই যেন ওকে টেনে নিয়ে চলছে এই অদৃশ্য শক্তি।
চলতেই থাকে অভয়, চলতেই থাকে, এ পথের যেন কোন শেষ নেই। মুহূর্তের পর মুহূর্ত পেরিয়ে যায়, বা হয়তো সবে এক মুহূর্ত পেরলো, সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় অভয়ের। হঠাৎ এক জোরালো আলো এসে লাগে অভয়ের চোখে, ব্যাস আর কিচ্ছু ওর মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতে অভয় দেখল চারিদিকে দিনের আলো ফুটে গেছে, আর ও ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ওর পা দুটো আয়নাটার দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অভয়, পিদিমটা আয়নার সামনে উল্টে পড়ে আছে, তেল শেষ হয়ে নিভে গেছে জিনিসটা।
আয়নাটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় অভয়, কিন্তু না অস্বাভাবিক তো কিছু নেই, সবই সাধারন দিনের মতন। তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিল অভয়? সেই আয়নায় পিদিমের ছায়া নিভে যাওয়া, প্রচণ্ড টানে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়া, সেই জোরালো আলো, সবকিছুই কি স্বপ্ন? হ্যাঁ স্বপ্নই হবে। কিন্তু কি বিদঘুটে স্বপ্নরে বাবা!
উঠে বসে অভয়, এদিক ওদিক চাইতেই চোখে পড়ে ওর ডায়রিটা কিছু দূরে ছিটকে পড়ে আছে। ডায়রিটাকে হাতে তুলে নিতে গিয়ে অভয় দেখে ডায়রিটার একটা পাতা খোলা। এটা সেই চব্বিশে ডিসেম্বরের পাতাটা যাতে বাংলায় কিছু লেখা। এই পাতাটা কোনদিনও খোলেনি অভয়। অভয় পড়তে থাকে লেখাটা, লেখা আছে-
‘ডায়রি আজ আমি লিখছি। আমি আজ অন্য আমি। সে আর আমি এক ঠিকই, তবু অনেক আলাদা। ও জ্ঞানী, আমি মূর্খ। ও ভাষা জানতো, বিজ্ঞান জানতো, আমি এসব কিছুই জানি না। আমাদের সব উল্টো, সব। তবু আমরা যেন একে অপরের পরিপূরক। একই পাতার এপিঠ আর ওপিঠ। ওর টুকরো হলে আমারও টুকরো হবে। ওর ধ্বংস মানে আমারও ধ্বংস। আসল কে আর নকল কে আমি জানি না। হয়তো সবই আসল, বা হয়তো দুজনেই নকল, হয়তো আমরা শুধু একে অপরের প্রতিবিম্ব মাত্র। ও হয়তো জানতো এসব, আমি জানি না। ও চলে গেছে না আমি চলে এসেছি কিছুই বুঝতে পারি না। কিন্তু আমি আর সেই পথে ফিরতে চাই না, উফ্ খুব যন্ত্রণা। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।
থাক, আমি আর কিছু জানতে চাই না, কিচ্ছু জানার দরকার নেই আর। যে যেখানে আছে সেখানেই থাক। বেশি জানা ভালো নয়’।
লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে অভয়, তারপর আসতে আসতে প্রথম থেকে উল্টাতে থাকে ডায়রির পাতা গুলো। এর আগেও অনেকবার লেখাগুলো পড়েছে অভয়, কিন্তু এবার যেন কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে ভাষাগুলো বুঝতে পারে ও। আসতে আসতে তেইশে নভেম্বরের উপসংহারের পাতাটাতে এসে পৌছায় অভয়। ওই পাতার লেখাটাকে বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-
‘আমি আজ শেষ অব্দি সক্ষম হয়েছি সমান্তরাল মহাবিশ্বের দ্বারোদ্ঘাটন করতে। শেষ অব্দি ভেদ করতে পেরেছি মহাবিশ্বের শক্তি সুড়ঙ্গ। আমি জানি ওপারেও আমার এক অনুরূপ প্রতিবিম্ব আছে। আমি শুধু তার সাথে একবার মিলিত হতে চাই। দেখতে চাই সে আর আমি একই কিনা। জানি না আমাদের দেখা হলে কি হবে, তবু বিজ্ঞানের স্বার্থে এ দরজা আমায় খুলতেই হবে’।
ডায়রিটা পড়ে অনেক কিছু বুঝতে পারে অভয়। বিজ্ঞানের জায়গাগুলো ভালো না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারে যে ওই শক্তি সুড়ঙ্গ খোলার জন্য এই পিদিম আর ওই আয়নার এক জায়গায় হওয়া প্রয়োজন।
অভয় তাড়াতাড়ি পিদিমটাকে তুলে দেরাজের ভিতর সেই গোপন কুঠুরিতে রেখে দেয়। না, আর ওই যন্ত্রণাময় পথে ফিরে যেতে চায় না অভয়। যা হওয়ার হবে, কিন্তু কোনোমতেই ওই পথে আর নয়।
পিদিমটা রেখে উঠে দাঁড়ায় অভয়। জানালা দিয়ে আসা দিনের আলোতে আয়নাটাতে ওর প্রতিবিম্ব পড়েছে। নিজের প্রতিবিম্বটাকে খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে অভয়। তারপর ওর কপালের ডানদিকের কাটা দাগটাতে হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে ভাবে, ‘নাহ, সব ঠিকই আছে’।
************
Tags: জিৎ দত্ত, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, সুপ্রিয় দাস
Last line eo chomok… Besh valo laglo.
mirrors চলচ্চিত্রটার শেষাংশের সঙ্গে খুব মিল পেলাম। oculus চলচ্চিত্রের সঙ্গেও প্রাথমিক ভাবে মিল রয়েছে। মৌলিকত্ব না থাকলেও গল্পটি মোটের উপর সুখপাঠ্য।
Kono mil thakle seta sompurno kaktalio… Apni je duto movie r name bollen kono tai Amar dekha Noy.. golpo ta sompurno Amar moulik chinta vabna..