প্রত্যাবর্তন
লেখক: সহস্রাংশু গুহ
শিল্পী: ইন্টারনেট
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, রাত দুটো
‘ওয়াটসননন’। এক ঝটকায় বিছানার উপর উঠে বসে পড়ল দীর্ঘদেহী শরীরটা। ঘরে আলো আঁধারী। একটি মাত্র বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো। উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে লাগল ঘরের প্রতিটি কোনা। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বন্ধনমুক্ত করতে পারছে না দীর্ঘদেহী। অসংখ্য তার জালিকার মতো ঘিরে রয়েছে তার দেহ। মাথায় অজস্র স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে ফিরে আসছে। শত চেষ্টা করেও একচুল নড়ছে না হাত-পা। অনুভব করতে পারছে শুধু কোমরটুকু। প্রচণ্ড এক ঝটকায় নিজেকে জালিকা মুক্ত করার চেষ্টা ব্যর্থ হল। ঘরের মধ্যে ইতিমধ্যে লাল আলোর দপদপানি শুরু হয়েছে। চাপা অথচ বিরামহীন ভাবে ঘোরলাগা ছন্দে শব্দ শুরু হয়েছে বিপ বিপ বিপ বিপ। আবার একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি তারের জালিকায়। ‘ওয়াটসনননন’। চেষ্টা করেও আর কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না দীর্ঘদেহীর মুখ দিয়ে। জিবটা ব্যর্থ চেষ্টায় ছট ফট করছে মুখবিবরে। থর থর করে জালিকাবেষ্টিত শরীর কাঁপছে। মাথার মধ্যে শলাকার মতো বিঁধছে বিপ বিপ শব্দ। হাজার স্মৃতির দল যেন একজোট হয়ে ঘিরে ধরেছে মস্তিষ্কের ধূসর অংশটিকে। তীক্ষ্ন তপ্ত শলাকার ন্যায় শব্দ ক্ষণে ক্ষণে মাথায় আঘাত হেনে চলেছে। হাত দুটো প্রাণপণ চেষ্টা করছে কান ও মাথার রগ টিপে ধরার কিন্তু একটুও সরছে না। তবে কি পক্ষাঘাত হয়ে গেল দীর্ঘদেহীর। কিন্তু এই তো মুহূর্ত আগে উঠে বসল সে। সমস্ত শক্তি একত্রিত করে কোমর দিয়ে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিল বিছানায়। হৃৎপিণ্ডের শব্দ এবার বাজতে শুরু করেছে কানে। প্রচণ্ড দ্রুততায় হাপরের মতো বুক ওঠানামা শুরু হয়েছে। মাথাটা অবশ হয়ে আসছে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা ভাবটা যেন বেশি করে জাঁকিয়ে আসছে। বিছানার পাশেই একটা বোর্ডে আলোকরশ্মির আনাগোনা চলছিল। প্রচণ্ড বেগে উপর নিচে ছটফট করা আলোক বিন্দু এবার লাল থেকে কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। ছটফটানির বিস্তার কমে আলোকবিন্দুর পথ সরলরৈখিক হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। অবশ দেহটা আবার এলিয়ে পড়ল বিছানার উপর। ঘরের লাল আলোর দপদপানি শান্ত হয়ে এল এবার। বিপ বিপ আওয়াজটাও ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। মাথার কাছে এখন সবুজ আলোর বিন্দু সরলরেখায় আনাগোনা করছে বোর্ডের মধ্যে। চোখ বুজল দীর্ঘদেহী। চোখ থেকে উপচে পড়ল জলের ধারা। গড়িয়ে গেল কানের পাশ দিয়ে। বুকটা শান্ত হয়ে এসেছে। অল্প চেষ্টাতেই এবার নিজের হাত দুটো অনুভব করতে পারল সে। আবার চোখ খুলল। অন্ধকার ঘরে দৃষ্টি এবার সয়ে এসেছে কিছুটা। শুয়ে শুয়েই নিজের উদ্যত হাতের সঙ্গে লাগানো তারের জালিকা অনুভব করতে পারছে এখন। পা দুটো কেঁপে উঠলো একবার, এখনও নাড়াতে পারছে না সেগুলো। আরেকটু বিশ্রাম দরকার। ঘরটা এবার হালকা সবুজ আলোয় ভরে উঠছে। চোখের পলক কুঁচকে গেল আলোর পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। এখন অনেকটা ভালো লাগছে। মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তার রাশ দূরে সরিয়ে মৌলিক চিন্তা প্রকট হয়ে আসছে এখন। কোথায় আমি? কোথায়? এই ঘর কোথায়? আমি বিছানায় শুয়ে কেন? আমার সারা শরীর এরকম তারের জালিকায় মোড়া কেন। ঘরের দরজাটা এবার দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। দরজার ওপাশে সাদা উজ্জ্বল আলো। এই ঘরের মধ্যেও কিছুটা এসে পড়েছে সেই আলো। ঘরের ভিতরটায় প্রচণ্ড ঠান্ডা হওয়াতে ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা হাওয়ায় ভর করে দরজার সাদা আলোর দিকে এগোচ্ছে। মানুষের মতো কে একজন এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। দীর্ঘদেহী এবার অবলীলায় ঘাড় ঘোরাতে পারল। কে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে? উচ্চতা দেখে মানুষ মনে হলেও আগন্তুকের সর্বাঙ্গ বর্ষাতির মতো পোশাকে ঢাকা। এমনকি মুখও। হাতে গ্লাভস, ঠিক যেমন হাসপাতালে নার্সদের থাকে। আগন্তুক এগিয়ে আসছে বাইরের সাদা আলোর গণ্ডী পেরিয়ে, ঘরের সবুজ আলোর চৌহদ্দি অতিক্রম করে তার বিছানার দিকে। কিন্তু না, দীর্ঘদেহীর কাছে এল না সে, মাথার কাছে চলে গেল। খুট খাট করে টাইপ রাইটারের বোতাম টেপার মতো শব্দ হতে শুরু করল। চোখ খুলে রাখতেও যেন কষ্ট হচ্ছে এখন। আবার চোখ বুজে ফেলল দীর্ঘদেহী। অত্যন্ত পরিশ্রান্ত লাগছে নিজেকে। আর সব চিন্তা দূরে সরে যাচ্ছে যেন। অবশ মস্তিস্ক শুধু প্রাণপনে খুঁজতে চাইছে সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে, বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠছে একটা মুখ। লম্বা কালো হ্যাট টুপি পরে ওয়াটসন ডাকছে। ‘শার্লক’। ‘শারররর্লক’।
(২)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর রাত তিনটে তিরিশ
ভ্রূর ভ্রূর। হাতের সঙ্গে আটকানো ব্যান্ডটা কেঁপে কেঁপে উঠছে ডক্টর বোসের। এমনিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে তবেই শুধু ব্যান্ড অ্যাক্টিভ রেখে ঘুমাতে যান ডাক্তার। কিন্তু এই যে কাজে তিনি লিপ্ত হয়েছেন বিগত কয়েকদিন ধরে তার গোপনীয়তার নিয়ম অনুযায়ী অষ্টপ্রহর তাঁর হাতে আটকানো রয়েছে এই ব্যান্ড। এই ষাট বছর বয়েসে এখনও একটানা রাত জেগে কাজ করার ক্ষমতা ধরেন তিনি। বিগত তিন রাত চার দিন দু-চোখের পাতা এক করেননি। খাবার খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে একবারের জন্যও বেরোননি কাজের ফ্লোর ছেড়ে। কাল রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ যখন ল্যাবেরটরি ফ্লোর থেকে বেরচ্ছেন তখন তিনি একরকম নিশ্চিতই হয়েছিলেন এবারের কাজের সাফল্য নিয়ে। নিজের হাতে সব কিছু পরিচালনা করেছেন তিনি। প্রায় তিনশো জন বৈজ্ঞানিকের সমারোহে যে কাজ শুরু হয়েছিল ঠিক তিনদিন আগে – তার অন্যতম পুরোধা তিনি। যদিও কাজ হচ্ছিল খাতায় কলমে অন্য ভিজিল্যান্স অফিসারের নামে, কারণ ল্যাবেরটরির কাজ ছাড়াও এইসব কাজের আরও অনেক দিক থাকে যেগুলোতে ডক্টর বোস কোনওভাবে ইনভল্ভড হতে চাননি। বিজ্ঞানের কাজে অন্ত-প্রাণ যিনি তাঁর প্রকৃতি বুঝেই সরকার থেকে ল্যাবরেটরির পুরো দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বলতে গেলে এই পুরো প্রজেক্টের এ টু জেড শুধু তাঁর মাথাতেই থাকার কথা। কিন্তু বিচক্ষণ বিজ্ঞান তপস্বীর মতোই ডক্টর জানেন তাঁর সীমাবদ্ধতা। বয়স হয়েছে। যদিও তাঁর স্বাস্থ্য শুধু তাঁর ছাত্রদের কাছেই নয়, দেশের যে কোনও তরুণের কাছেই ঈর্ষণীয়; তবু প্ল্যান-বি হিসেবে নিজের সব থেকে কাছের ছাত্র সিদ্ধার্থকেও গবেষণার সমস্ত কিছুর সঙ্গী করেছেন তিনি। কাল রাত্রে বেরোনোর আগে সিদ্ধার্থকেই সব দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন। এটাও বলা ছিল গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকলে যেন সময় নির্বিচারে তাঁকে জানানো হয়। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড কব্জি কাঁপার পর ঘুম ভাঙল ডক্টরের। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে উঠল তাঁর সমস্ত স্নায়ু। হাতের ব্যান্ডে সবুজ আলোয় লেখা ভাসছে আর্জেন্ট। ক্ষিপ্র গতিতে বেড সাইড সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালালেন ডক্টর। কোমরের কাছে স্লিপিং গাউনের রিবনটা বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে গেলেন ঘরের সেন্টার টেবিলটার কাছে। মোবাইলটা হাতে তুলতেই দেখলেন ভার্চুয়াল কনফারেন্স করতে চাইছে সিদ্ধার্থ। কল রিসিভ করা মাত্রই ঘরের ছাদে বসানো হলোগ্রাফিক ডিসপ্লে ইউনিটটা জ্বলে উঠল।
সফটওয়্যার গ্লিচ না নেটওয়ার্ক প্রবলেম কিনা জানা নেই কিন্তু ডক্টরের নিজস্ব ফ্ল্যাটের এই হলোগ্রাফিক ইউনিটে প্রথমে রিসিভারের ডিসপ্লে দেখানো আর শব্দ শোনানো শুরু হয়। তারপর এদিকের ভিডিও কিছুক্ষণ পর থেকে ওদিকে যাওয়া শুরু করে। ডাক্তার চোখে চশমা পরে রেডি হতে হতে ঘরের মধ্যে আলোর বলয়ে চেয়ারে বসা সিদ্ধার্থের শরীর স্পষ্ট হয়ে উঠল। পাশে বসে রয়েছে একই ইউনিটের নার্স সোমা।
‘এই তুমি কিন্তু আগে স্যার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কিনা জিজ্ঞেস করবে। তোমার তো আবার ভদ্রতা জ্ঞানটা ভগবান ভুলে গেছেন দিতে। আমি যা বলবো তাই করবে কিন্তু।’ মিষ্টি গলায় ভৎসর্না, সঙ্গে সিদ্ধার্থের গায়ে আলতো খোঁচা দেয় সোমা।
ডক্টরের হলোগ্রাফিক ডিভাইস গ্লিচের কথা ওদের অজানা। তাই এই বাছুরে প্রেমের একটু আভাষ যে এদিকে ডক্টর পেয়ে গেলেন সেটা ওদের বোঝার কোনও উপায় নেই। ডক্টরের অবশ্য এসব নিয়ে আগ্রহ কিংবা মাথা ব্যথা কোনটাই নেই। সোমা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এবং মেধাবী ছাত্রীর অন্যতম। পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত না হলে সোমাও সিদ্ধার্থের মতো সফল সার্জন হতে পারত বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। সমবয়সী নার্সদের থেকে সোমা যে কত অ্যাডভান্সড সেটা অপারেশন থিয়েটারে তার হাবভাবেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে। ২৩ বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে তাই ডক্টর নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।
‘হ্যালো? স্যার, হ্যালো’ সিদ্ধার্থের গলায় উত্তেজনা স্পষ্ট। ‘শুনতে পাচ্ছেন স্যার’
‘হ্যাঁ পাচ্ছি, বলো’
‘সাবজেক্ট এ রেডি স্যার। জ্ঞান এসেছে। একটু ক্যালিব্রেট করছিল মাসলগুলো কিন্তু এখন সব ঠিক।’ গড় গড় করে বলে ফেলল অ-সহিষ্ণু ছাত্র। ডিসপ্লেতে ডক্টর দেখলেন সোমা একটু খোঁচা দিল সিদ্ধার্থকে। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপই নেই তখন তাঁর।
‘সব ওকে স্যার। ঘরের লাইট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্নিয়া অ্যাডজাস্ট হয়ে যাচ্ছে। হার্ট-বিট, লাংস সব ফাংশনিং অলরাইট।’
আনন্দে চোখে জল চলে এল ডক্টরের। তিন রাত না ঘুমানোর ক্লান্তি কোথায় মিলিয়ে গেছে তখন। চশমা খুলে চোখের জল মুছলেন প্রফেসর। ঠোঁটে হাসিটা অমায়িক এখন। ডিসপ্লের ওদিকে সিদ্ধার্থ, সোমারও চোখে জল। এ যেন নতুন ভোরের সূচনার শুভক্ষণ।
‘এখন কি অবস্থা সাবজেক্টের? মস্তিষ্কের বিশ্রাম দরকার কিন্তু মাংসপেশি শিথিল হতে দেওয়া চলবেনা।’ যত যাই হোক না কেন ডক্টর বিজ্ঞান ভিক্ষু, আবেগ পিছনে ফেলে মস্তিষ্কে কর্তব্য অধিগ্রহণ করতে দেরি হয় না।
‘মাইল্ড স্লিপিং গ্যাস অ্যাপ্লাই করে দিয়েছি স্যার। আপনাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। সবকিছু মনিটরিং চলছে। আসলে এত মেমারি তো, সাবজেক্ট এখন স্বপ্নের জগতে রয়েছে। মাঝে মাঝে হাত-পাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে যেটা খুব ভালো লক্ষণ। ব্রেনের নার্ভে স্পার্কের সঙ্গে সঙ্গে মাসলগুলোও যে ঠিক ঠাক কাজ করছে এটাই তার প্রমাণ। আর ঘণ্টা চারেক ঘুমিয়ে থাকলেই সব কিছু রেডি হয়ে যাবে স্যার।‘
পরিতৃপ্তির হাসি প্রতিফলিত হয় ডক্টরের মুখে। ‘সোমা এবার কিন্তু তোমার কাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই চার ঘণ্টায় এক সেকেন্ডের জন্যও যেন সাবজেক্টের থেকে তোমার চোখ না সরে। সব রকম ইন্সিডেন্ট রেকর্ড করবে দায়িত্ব নিয়ে। এই চার ঘণ্টার উপরেই কিন্তু পরীক্ষার চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করছে।’
‘আপনাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আমি সবসময় সাবজেক্টের কাছে বসে থাকব।’ মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় প্রাণবন্ত মেয়েটা।
হাত দিয়ে নিজের চিবুক ঘষতে ঘষতে একটু সিরিয়াস হয়ে পড়েন ডক্টর। ‘সিদ্ধার্থ?’
‘বলুন স্যার।’
‘তিন দিন আগে শেষ খোঁজ নিয়েছিলাম সাবজেক্ট বি-র, এখন কি স্ট্যাটাস?’
‘আমি কালকেই নিজে কথা বলেছি সাবজেক্ট বি-র সঙ্গে। সবকিছু ওকে স্যার। কাল সকাল থেকেই সাবজেক্টকে ল্যাবের বাইরে বের হতে দেওয়া হয়েছে। খাবারও খেয়েছে ঠিকঠাক। বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা আমাদের তরফে কিছু ইনফরমেশন দিয়েছি গল্পচ্ছলে। অনেক বই মানে কাগজের বই তারপর ইন্টারনেট সমেত ল্যাপটপ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’
‘সে কি এতো কিছুর সামনে ফেলে দিয়েছ? মেন্টাল ব্রেক-ডাউন হয়ে যায়নি তো?’ ডক্টরের গলায় উদ্বেগ ফুটে ওঠে।
‘না না স্যার। সাবজেক্টের ইম্প্রুভমেন্ট দেখেই এক এক করে সব দেওয়া হয়েছে। আসলে খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন তো, আর মিলিটারি ব্যাকগ্রাউন্ড। চাপ নেবার ক্ষমতা আছে মস্তিষ্কের। একদম স্বাভাবিক আছেন। মেন্টাল টেনশন হলেই নিজেই কন্ট্রোল করছেন নিজেকে। আমাদের সঙ্গে কাল তো প্রায় ঘণ্টাদুয়েক আড্ডার ছলে কত গল্প করলেন। সিরিয়াস আলোচনা, হাসি ঠাট্টা, সবকিছুতে সাবলীল স্যার আপনার সাবজেক্ট বি।’
ডাক্তারের মুখের উদ্বেগ কেটে গিয়ে হাসিটা ফিরে আসে ‘না না সিদ্ধার্থ। আমার বলো না। খাতায় কলমে আমি থাকলেও সাবজেক্ট বি-র সমস্ত দায়িত্ব তোমার ছিল। এ কৃতিত্ব পুরোপুরি তোমার।’ অনন্য মেধাবী ছাত্রের প্রতি ভালোবাসা উগরে দিতে ভোলেন না ডক্টর।
‘কি যে বলেন স্যার, আপনিই তো অনুপ্রেরণা।’ হাসি ভরে ওঠে সিদ্ধার্থের মুখে।
‘ঠিক আছে তাহলে, আমি আরেকটু বিশ্রাম করে নিচ্ছি। সকালে ল্যাবে দেখা হবে সাবজেক্ট এ-র সঙ্গে। আচ্ছা সোমা কোথায় গেল ওকে আর দেখছি না।’
‘ও সাবজেক্টের কাছে ফিরে গেছে স্যার। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। ও ঠিক সব লগ করে রাখবে।’ সিদ্ধার্থের এখনও ধারণা প্রফেসর কিছুই জানেন না ওর আর সোমার ব্যাপারে। তাই একটু উসখুস করেই কথাটা বলে ফেলে। ‘ও খুব ভালোভাবে সবকিছু লগ রাখছে স্যার। সব ক-টা ভাইটাল নার্ভ আর মাসলের প্রতিটা এক্টিভিটি ও ঠিক লগে স্টোর করছে আমি নিজে চেক করেছি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, যাও তাহলে তুমি এবার একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও ’ মুখে হাল্কা হাসি এনে কনফারেন্স কেটে দিলেন ডক্টর।
(৩)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর রাত সাড়ে চারটে
মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ডক্টর মুখার্জির। এই কয়দিন কাজের মধ্যে দ্বিতীয় স্বত্বাটা অ্যাগ্রেসিভ হতে পারেনি মাথার মধ্যে। আজ যেই একটু রিল্যাক্স করতে চাইছেন সঙ্গে সঙ্গে মাথায় জেগে উঠেছে। টলতে টলতে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন ডক্টর। পায়ের ছন্দ মিলছে না। দরজাটা খুলেই আবার বন্ধ হয় অধৈর্য্য ভঙ্গিতে। গ্রিন রুমের দিকে এগোতে যান ডক্টর।
‘গুডনাইট স্যার।’ হিউমান রিসার্চ ল্যাবের ভিতরের দরজায় দাঁড়ানো সিকুরিটি উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে ভোলে না ডক্টরকে।
হঠাৎ সম্বোধন শুনে একটু চটকা ভাঙে। মাথার ভিতরে যেন বিস্ফোরণ হয়ে যাচ্ছিল একের পর এক। গার্ডের কথায় চটকা ভাঙতে যেন এক ঝটকায় মাথা থেকে উড়ে যায় কালান্তক দ্বিতীয় স্বত্বাটা। সঙ্গে সঙ্গে হাল্কা বোধ করেন ডক্টর। একটু টলে ওঠে পা দুটো। মাথায় হাত দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন।
‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে স্যার’। ডক্টরকে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে আসে সিকুরিটি।
‘না না, সেরকম কিছু নয়। এত প্রেশার যাচ্ছে কাজের। একটু স্ট্রেসড লাগছে। হাতে বসানো বিপি মনিটরের লাল আলোর দপ দপানি অন্য হাত দিয়ে ঢেকে জবাব দেন ডক্টর। কাউকে বলা যাবে না তাঁর এই অস্বস্তির কথা। কাউকে না। কবে যে এর থেকে তিনি মুক্তি পাবেন ভগবান জানে।
‘ওকে স্যার, গুডনাইট’ বিনয়ী হয়ে হাসিমুখে বলে সিকুরিটি গার্ড।
‘না না, গুডনাইট কি, আমি বাড়ি ফিরছি না। কেউ খোঁজ করলে বোলো আমি গ্রিইই–’ কথাটা শেষ করতে পারেন না ডক্টর। যেমন এক ঝটকায় দ্বিতীয় স্বত্বাটা উবে গেছিল মস্তিষ্ক থেকে তেমনি আচমকা প্রত্যাবর্তন ঘটে তার। কথা আটকে যায়। ‘উফফ’ দুহাতে রগ টিপে ধরেন ডক্টর। এবার সিকুরিটি দৌড়ে এসে তাকে ধরে না ফেললে মনে হয় পড়েই যেতেন মেঝের উপর। পরক্ষণেই আবার হাল্কা হয়ে যায় মাথাটা। বেফাঁস কথা আটকে দিতেই স্বত্বার আবির্ভাব হয়েছিল। কথা বন্ধ হতেই সে আবার হারিয়ে যায়। সিকিউরিটির হাত ছাড়িয়ে নিজেকে একটু স্টেডি করেই কোনও কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে যান। লক্ষ্য গ্রিন রুম।
(৪)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর চারটে
সকালের এই সময়টা ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয় ডক্টর বোসের। নিজের শহরে দিনের বেলায় আজকাল আকাশ দেখতেই পাওয়া যায় না। সিদ্ধার্থের কনফারেন্স কলটা পেয়ে হাত-মুখ ধুতেও ভুলে গেছিলেন। এবার হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ কফি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তার ব্যালকনিতে। বিগত চারদিন হিউমান রিসার্চ ল্যাবের থেকে একটুও বেরননি। যন্ত্র পরিবেষ্টিত হয়ে সারাক্ষণ থাকতে থাকতে মনটা উথালি-পাথালি করতে থাকে ভোরের আকাশে সূর্যোদয়টা দেখার জন্য। কলকাতার আকাশ এখন এই সূর্যোদয়ের সময়টুকু শুধু অনাবৃত থাকে। দূষণ আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাড়তে বাড়তে বছর দশেক আগেই দিল্লী, মুম্বইয়ের মতো শহর মানুষ বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষিত হয়েছিল। এখন সেখানে রেস্টোরেশন প্রকল্পে উদয়াস্ত কাজ চলছে। শেষ হতে হতে আরও বছর পাঁচেক বেরিয়ে যাবে। ওই সব শহরের সমস্ত বড় কার্যালয় সরিয়ে আনা হয়েছিল কলকাতায়। রাস্তার ধার বরাবর সার দিয়ে বসানো হয়েছিল গাছের সারি। গাছ বাঁচানোর জন্য নূন্যতম করে ফেলা হয়েছিল কাগজের ব্যবহার। তাতেও যখন হয়নি তখন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত কলকাতার মেট্রোপলিটন এলাকার আকাশ ঢেকে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরেকটু পরেই সুবিশাল ভাসমান চাকতির মতো ব্রিজলুমিনো পিউরিফায়ার ঢেকে ফেলবে পুরো আকাশ। সূর্য রশ্মি ফিল্টার হয়ে ততটুকুই মাটি স্পর্শ করবে যেটুকু উজ্জ্বলতা মানুষ খালি চোখে সহ্য করতে পারে। ঠিক একইরকমভাবে অতবড় ভাসমান চাকতির ন্যায় যন্ত্রটা নিচের বাতাস থেকে শুষে নেবে ক্ষতিকারক কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, ধোঁয়া, ধুলো। আর বদলে চারশো ফুট উপর থেকে শহরের মাথায় ঠান্ডা বিশুদ্ধ বাতাস হওয়ার পরশ বুলিয়ে যাবে। যন্ত্রের মধ্যে এমন ব্যবস্থা থাকে যে মানুষ উপরের দিকে তাকালে আকাশ দেখতে না পেলেও সূর্যের অবস্থান বুঝতে পারবে। নীল চাদরের মতো কৃত্রিম এই আকাশ শহরকে ঘিরে রাখবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সন্ধের মধ্যে বাতাসের আর্দ্রতা আর তাপমাত্রা রাতের জন্য সহনীয় করে বিশ্রামে যাবে কৃত্রিম আকাশ। তারপর রাতের জন্য চালু হবে উত্তরে শ্যামবাজার, দক্ষিণে সাউথ সিটি, পূর্বে হাওড়া ব্রীজ, পশ্চিমে রাজারহাটে বসানো দৈত্যাকার এয়ার পিউরিফায়ার। উদয়াস্ত বাতাস পরিষ্কার না করলে এই শহরও এতদিনে মানুষ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত। তাও তো ডক্টরবাবুকে বেরতে হয় না সেরকম মেট্রোপলিটনের বাইরে। মফঃস্বলে তো এখন বাইরে বেরলেই মানুষকে বাতাস পরিশুদ্ধ করার সরকার প্রদত্ত মুখোশ পরে বেরোতে হয়। অন্তঃপুরিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ আর বাতাস পরিষ্কারের জন্য সরকার থেকে স্বল্প দামে মেশিন সরবরাহ করা হয়। সেদিক দিয়ে দেখলে এই মেট্রোপলিটন কলকাতা এখন ভারতবর্ষের স্বর্গ।
কফির কাপটা মুখের কাছে নিয়ে যেতেই হাতে বসানো অল-ইন-ওয়ান সেন্সর ব্যান্ডটা সজোরে একবার ভাইব্রেট করে উঠল। একটু বিরক্ত হয়ে কব্জি ঘুরিয়ে ডক্টর দেখলেন ক্যাফিন ওয়ার্নিং দেখাচ্ছে ব্যান্ডের স্ক্রিনে। ধূমায়িত ব্ল্যাক কফির কাপের ধোঁয়া বিচার করেই বুদ্ধিমান সেন্সর বুঝে নিয়েছে আবার শরীরে ক্যাফিন ঢোকাতে চলেছেন ডক্টর। এই কদিনে তাঁর রক্তে ইতিমধ্যেই খুব বেড়ে গেছে ক্যাফিনের পরিমাণ। আরও বেশি হলে লিভার ব্রেক-ডাউন হওয়ার সম্ভাবনাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বিরক্ত হয়ে ওয়ার্নিংটাকে ক্যানসেল করে দিলেন ডক্টর। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নীলচে-ধূসর আকাশে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়ার মানসিক শান্তি কোনও সেন্সর দিয়ে মাপা যাবে না।
খুব আয়েশ করে কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন ডক্টর। এখন আর ছোটবেলার সেই নীল আকাশ, হিমালয় ছাড়া কোনও জায়গায় দেখা যায় না। কলকাতা শহরে এই সূর্যোদয়ের সময়েও আকাশের রং ধূসর। নীলচে একটা আভা রয়েছে কেবল, ব্যাস। ব্যালকনি থেকে নিচের রাস্তা দেখা যায়। মানুষের হাঁটার রাস্তা আলাদা। সেটা অপেক্ষাকৃত সরু। আর তার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বেশ চওড়া গাড়ি চলার রাস্তা। বিজ্ঞাপন ভর্তি বৈদ্যুতিন ডিসপ্লে ইউনিট দিয়ে দুটো সমান্তরাল রাস্তা পৃথক করা। পাশে গাড়ি চলার রাস্তা দিয়ে আরেকটু পরেই সারে সারে বৈদ্যুতিক গাড়িগুলো লাইন ধরে আনাগোনা শুরু করবে নিঃশব্দে। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে মেট্রো-সিটির অন্তর্বর্তী সমস্ত জায়গা এখন নো-হর্ন জোন। সব গাড়ির ড্রাইভারদের এখন বাধ্যতামূলক ভাবে মাথায় বিশেষ হেলমেট লাগিয়ে গাড়ি চালাতে হয়, পিছনের গাড়ির হর্ন (মানে বিশেষ ফ্রিকুয়েন্সির বৈদ্যুতিক পালস) ওই হেলমেটের জন্য শুধুমাত্র গাড়ির ড্রাইভারদেরই শ্রুতিগোচর হয়। অন্য কেউ তা সে আরোহীই হোক আর আশপাশের মানুষজনই হোক সেই শব্দ শুনতে পায় না। মেট্রো সিটির অন্যতম বিরক্তি উদ্রেককারী ওই প্যাঁ প্যাঁ গাড়ির হর্ন এখন পুরানো সিনেমায় শোনা যায় শুধু। ওদিকে আকাশে আগুনের গোলার মতো সূর্যটা সবেমাত্র একটু উঁকি দিচ্ছে দিগন্ত থেকে। ডক্টরের মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় তাদের নদীয়ার গ্রামের বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার কথা। আজকের দিনে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ কাশ্মীর, সিকিমের মতো জায়গায় গেলে কেবল সূর্যাস্ত দেখতে পায়। কলকাতায় এই জানুয়ারি মাসেও বিকেলের দিকে সূর্যের তাপমাত্রা থাকে ৫৫ ডিগ্রীর বেশি। তাই ব্রিজলুমিনো পিউরিফায়ার সূর্যাস্তের পরেও কিছুক্ষণ ব্যোম বিচরণ করে। সেইজন্যই কলকাতায় বসে মানুষ কেবল সূর্যাস্তের রেকর্ডেড ভিডিও দেখতে পায় কম্পিউটারের পর্দায়। রাতের বেলা আবার তাপমাত্রা নেমে যায় দশের কোঠায় তাই ভোরের দিকে কিছুক্ষণ অবধি, মানে ওই ঘণ্টাখানেক গরমটা সহনীয় থাকে। তারপরেই আকাশ ঢেকে যায় কৃত্রিম আকাশে। প্রকৃতির সুন্দর নীল আকাশ অধরা হয়ে গেছে কলকাতার মানুষের কাছে প্রায় বছর ছয়েক হল আজ।
হলুদ গোল সূর্য এখন পুরোটা দৃশ্যমান হয়েছে পূর্ব দিগন্তে। আর বড়জোর ঘণ্টাখানেক তারপরেই সূর্যের তেজ অসহনীয় হয়ে উঠবে। একটা লম্বা চুমুক দিয়ে কফির কাপটা নামিয়ে রাখলেন প্রফেসর। এইটুকু সময়ে যেন তাঁর বিগত কয়দিনের সমস্ত ক্লান্তি জুড়িয়ে গেল। আর তা ছাড়া সিদ্ধার্থের মতো শিক্ষানবিশ বিশেষ ভাগ্যবলে পেয়েছেন ডক্টর। সাবজেক্ট এ এবং বি-র সাফল্যের পর ডক্টরের ধারণা এবার থেকে ও নিজেই এ ধরণের কর্মকাণ্ডের সকল দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারবে। ছাত্রের গুণ স্মরণ করে মনটা খুশিতে ভোরে ওঠে শিক্ষাগুরুর। মনে পড়ে মাত্র দু-বছর আগে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় সিদ্ধার্থের। সদ্য লন্ডন থেকে হিউম্যান রিসার্চে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করা ছেলেটার বুদ্ধিদীপ্ত আচার আচরণ দেখেই তুষ্ট হয়েছিলেন ডক্টর। মাত্র পঁচিশ বছরের যুবকের মধ্যে এহেন বুদ্ধিমত্তা সত্যিই বিরল। মাথায় উইগ পড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যুবক সেই সময় থেকেই হিউম্যান রিসার্চ ল্যাবে ডক্টর বোসের সর্বক্ষণের সঙ্গী। লন্ডনে থাকাকালীন সিদ্ধার্থ একবার ব্রেন সার্জারি করিয়েছিল বলে শুনেছেন তিনি। তবে তা যে কি কারণে হয়েছিল বা আদৌ ঠিকঠাক হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে আর কিছু কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। এই দুই বছরে ডক্টর বোসের সান্নিধ্য যে তাকে ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অধুনা শ্রেষ্ঠ হিউম্যান রিসার্চ বৈজ্ঞানিক তথা সার্জেনে পরিণত করেছে তার সবথেকে বড় প্রমাণ সাবজেক্ট এ এবং বি-র সাফল্য। এমনকি ব্রেন রিপ্লেসমেন্টের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে ধাপ মেমরি রেস্টোরেশন – যেখানে মেমরির ডিজিটাল কপি থেকে সুনিয়ন্ত্রিত স্ট্রিমিং পদ্ধতিতে একটু একটু করে মেমরি সাবজেক্টের ব্রেনে পুশ করা যায়, সে পদ্ধতি আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওই সিদ্ধার্থের। তার আগে একবারে সমস্ত মেমরি পুশ করে দেওয়া হতো সাবজেক্টের মগজে তাতে সময় কম লাগলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাবজেক্টের ব্রেন এতো মেমরির ধাক্কা সামলাতে গিয়ে ব্রেন স্ট্রোক হয়ে কোমায় চলে যেত। বিগত একবছর ধরে সারা পৃথিবীতে সিদ্ধার্থের দেখানো পথ ধরেই ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট এবং মেমরি রেস্টোরেশন চলছে। সময় বেশি লাগলেও সাফল্যের হার ১% থেকে ৮৫% হয়ে গেছে এই নতুন পদ্ধতিতে। লাজুক গোছের ছেলেটা আবার এত কম বয়েসে নিজের টাকটা মেনে নিতে পারে না, অষ্ট প্রহর তাই উইগ পরে থাকে। ভাবলেই হাসি পায়।
পরম তৃপ্তিতে কফির শেষ ফোঁটাটুকু পাওয়ার জন্য কাপটা মুখে উপুড় করে দিলেন ডক্টর বোস। কাপটা নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কব্জি কেঁপে উঠল আবার। খুব স্বল্প বিরতি রেখে নাগাড়ে কেঁপে চলেছে হাতের ব্যান্ড। ফোন কল। কব্জি উল্টে দেখেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল ডক্টর বোসের। হাত কাঁপতে শুরু করল। পা ভারী হয়ে এল। ধপাস করে বসে পড়লেন রেলিং ধরে ব্যালকনির মেঝেতে। আবার সেই ফোন কল। ঠিক এক সপ্তাহ আগে এই নাম্বার থেকে শেষবারের মতো ফোন এসেছিল। আবার। কাঁপা কাঁপা আঙুল পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে কলটা রিসিভ করলেন ডক্টর।
‘হ্যালো?’
(৫)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর চারটে তিরিশ
কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট কাচের ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা মাথা খোলা ক্যাপসুলের ভিতর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রয়েছে সাবজেক্ট “এ”। শিডিউল অনুযায়ী এখনও আরও প্রায় ঘণ্টা তিনেক সাবজেক্টকে ঘুমাতে দিতে হবে বলে গেছে সিদ্ধার্থ। ক্যাপসুলের বাইরে থেকে অসংখ্য সূক্ষ্ম তার প্রথিত রয়েছে সাবজেক্টের গায়ে। প্রতিটা মাসল, প্রতিটা নার্ভের প্রতি মুহূর্তের ক্রিয়াকলাপ পর পর ছাপা হয়ে চলেছে পাশেই রাখা লগ কম্পিউটারের মনিটরের স্ক্রিনে। সেই মনিটরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে রয়েছে সোমা। এখন অবধি সাবজেক্টের তরফে কোনরকম উদ্বেগজনক কিছু ঘটেনি তবু দায়িত্ববান নার্সের মতোই এক মুহূর্তের জন্যও সাবজেক্টকে চোখের আড়াল করছে না সে। কলকাতার ল্যাংগুয়েজ, আর কিছু বেসিক তথ্য সমেত ডিস্ক রেডি করে দিয়ে গেছে সিদ্ধার্থ। ঠিক আর আধ ঘণ্টা পরে সেই ডিস্ক দিয়ে মেমোরি রেস্টোরেশন কম্পিউটারটা কাজ শুরু করবে। প্রিয়তম সিদ্ধার্থের সঙ্গে থেকে থেকে এই প্রজেক্টের অনেক খুঁটিনাটি এখন জানে সে। রেস্টোরেশন কম্পিউটার চালানও তার নখদর্পণে। সিদ্ধার্থ এতক্ষণ তার সঙ্গেই ছিল। মাথা ধরেছে বলে একটু আগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ঘরের মধ্যে হালকা সবুজ একটা আলো জ্বলছে। ক্যাপসুলের ভিতর হালকা সাদা আলোর মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ দীর্ঘদেহী যুবকের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু ভয় করে উঠল সোমার। সে জানে এই মানুষ দেহটা নিয়ে আসা হয়েছে লন্ডন থেকে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কারণে শুধু ওদেশে নয় এদেশেও এখন স্বেচ্ছামৃত্যু বা ব্রেন রিপ্লেসমেন্টের জন্য সুস্থ সবল জীবিত দেহদানের প্রকল্প চালু হয়েছে। জীবনের প্রতি হতাশ, নির্গুণ, বৃদ্ধ, পঙ্গু যে কেউ অ্যাপ্লাই করতে পারেন এই স্বেচ্ছামৃত্যুর ডিপার্টমেন্টে। সরকার থেকে সমস্ত তথ্য যাচাই করে সব শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভিকটিমকে স্বেচ্ছামৃত্যু দেওয়া হবে, না ব্রেন রিপ্লেসমেন্টের জন্য নির্বাচিত করা হবে, নাকি রিহ্যাবে পাঠিয়ে নতুন ভাবে বাঁচার শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রথম প্রথম অবশ্য শুধু স্বেচ্ছামৃত্যুরই ব্যবস্থা ছিল সরকারের এই ডিপার্টমেন্টে, তারপর বছর খানেক আগে যখন সিদ্ধার্থের আবিষ্কার করা পদ্ধতিতে মেমোরি রেস্টোরেশন সাকসেসফুল হতে শুরু করল – তখন ব্রেন রিপ্লেসমেন্টেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তথাকথিত উন্নত ব্রেনগুলির সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল আগের শতাব্দীর গোড়া থেকেই। সংরক্ষণ বলতে অবশ্য তখন যা হত তা নগণ্যর পর্যায়ে পড়ে। রাসায়নিক তরল ব্যবহার করে মাংসল মস্তিষ্কটিকে পচনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হতো কেবল, তাতে আজকের দিনে মস্তিষ্কটিকে মুটামুটি অক্ষত ভাবে পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মেমোরি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না। আসলে প্রাণীদের ব্রেন কীভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে গবেষণা তো শতাব্দীপ্রাচীন। একটি মানুষের মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি বা সেই মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাকে আলাদা ভাবে হিত কাজে ব্যবহার করার যে পদ্ধতি, তা আয়ত্ত হয়েছে সবে মাত্র বছর দশেক হল। বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই বোধহয় ধারণা করা হয়েছিল অদূর ভবিষ্যতে মানুষের মস্তিষ্ক এত বেশি টেকনোলজি নির্ভর হয়ে পড়বে যে মাস্টার-মাইন্ড শব্দটা কেবল ডিকশনারিতেই পড়ে থাকবে। তাই যেনতেন প্রকারেণ মস্তিষ্ক সংরক্ষণ শুরু হয়ে যায়। এখন তো মেমোরি ফুটপ্রিন্ট সমেত ব্রেনের ক্ষুদ্র অংশ থেকে ক্লোনিং পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ ব্রেনটাও তৈরি করে নেওয়া যাচ্ছে। যাতে করে শতাব্দী প্রাচীন কোনও সংরক্ষিত মাস্টার-মাইন্ড ব্রেনের অংশবিশেষ পাওয়া গেলেও তা থেকে সম্পূর্ণ ব্রেন তৈরি করে নতুন ভাবে হোস্ট শরীরে প্রতিস্থাপন করে অন্তত মানসিক ভাবে একদম সেই আগের মানুষটিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হচ্ছে। শারীরিক, মানে দেহের গঠনগত সাদৃশ্যের অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করছে কীরকম হোস্ট পাওয়া যায় তার উপর। একটু আধটু পরিবর্তন করে নেওয়া চলে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে কিন্তু কুস্তিগীরের মস্তিষ্ক যদি রুগ্ন হোস্টের শরীরে স্থাপন করা হয় তাহলে বলাই বাহুল্য যে অচিরেই সেই মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাবে এবং নিঃসংশয়ে বলা চলে যে সেই হোস্টও পুনর্জীবন লাভের পর ক্ষণজন্মা হতে বাধ্য। এর মূল কারণটিও কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে সেই মস্তিষ্কের মধ্যেই। একটি বহু আগে সংরক্ষিত মস্তিষ্ক যার মধ্যে মোমোরি ফুট প্রিন্টের পরিমান শূণ্য বা নগণ্য তাকে তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে রিপ্লেসমেন্টের সময় সেই রকম স্মৃতিই কৃত্রিম ভাবে ফিড করানো হয় যেরকম স্মৃতিতে সে কিছুটা হলেও অভ্যস্ত নাহলে অযথা সেই মস্তিষ্কের কোষে এরম চাপ বেড়ে যায়, যাতে সেই মস্তিষ্ক স্বাভাবিক ভাবে কর্মক্ষমতা হারানো তো বটেই, বিকল অবধি হয়ে যাওয়া আশ্চর্যের নয়। প্রথম জীবদ্দশায় ব্রেনটি যেরকম শরীরে থাকতে অভ্যস্ত, পুনর্জন্মের পর অন্যরম শরীর পেলে যা হয় আর-কি। ব্রেন বডি সিঙ্কিং বা চলতি ভাষায় যাকে খাপ খাওয়ানো বলা চলে, তারই সমস্যা প্রকট হয় সেক্ষেত্রে। পরিস্থিতি বিশেষে ব্যতিক্রম যে একেবারে করা হয়নি তা নয়, কিন্তু সাফল্যের হার সেক্ষেত্রে অত্যন্ত কম। দেখা গেছে শারীরিক সাদৃশ্যের শতাংশ যদি আশির বেশি হয় তবে ব্রেন রিপ্লেসমেন্টের পর সিঙ্কিং প্রসেসটা হয়ে পড়ে একদম মসৃণ, ফলে ব্যর্থতার সম্ভাবনাও কমে যায় উল্লেখযোগ্য ভাবে। এসবই এখন সোমা জানে সিদ্ধার্থের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ থেকে কাজ করার সুবাদে।
সোমার সামনে ক্যাপসুলে শায়িত শ্বেতাঙ্গের ব্যাপার অবশ্য সবদিক দিয়ে স্বতন্ত্র। যে মস্তিষ্কটি এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি যদিও একশো বছরের আগে সংরক্ষণের আওতায় আসে তবু সোমা শুনেছে যে এই বিশেষ মস্তিষ্কের সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নিত্য নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে। বোঝাই যায় যে কত মূল্যবান সম্পদের মতো এতদিন ধরে লালন করে রাখা হয়েছে সেটিকে। তবুও সিদ্ধার্থকে সে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছে এই বলে যে মেমারি ফুটপ্রিন্ট যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা নাকি পাওয়া যায়নি শেষমেশ এই ব্রেন থেকে। হোস্ট শরীর নির্বাচনের ক্ষেত্রে তো ধুন্ধুমার হয়ে গেছিল এই কেসে। লন্ডনে রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল দৈহিক খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে। কোনও ভারতীয়র শরীর নাকি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা চলবে না, ইউরোপীয় মাঝবয়েসী শরীরই দরকার। দৈহিক বর্ণনার সঙ্গে যে ক্যান্ডিডেটের দেহ যত বেশি মিলবে সে তত বেশি অগ্রাধিকার পাবে এটাও বলা ছিল বিজ্ঞাপনে। শেষমেশ প্রায় এক পক্ষকাল অন্বেষণের পর পাওয়া গেল ছ’ফুট লম্বা টিকালো নাক উন্নত চিবুক কালো কোঁকড়া চুল এবং নীল চোখের মণিসমেত এই যুবক। অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি তরফে রীতিমতো যাচাই করা হয় ভিক্টিমের সমস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু সোমা জানে এই ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে পরিবারের থেকে রীতিমত ছিনিয়ে আনা হয়েছে এই যুবককে ব্রেন রিপ্লেসমেন্টের জন্য। দৈহিক সাদৃশ্যের উপর যে এতটা জোর দেওয়া হয়েছে তার একটি কারণ তো অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত। চূড়ান্ত গোপনীয় এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই ব্রেন প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটিকে যতদূর সম্ভব ততদূর ঝুঁকি মুক্ত করা, কোনভাবেই এই প্রজেক্টকে ব্যর্থ হতে দেওয়া চলবে না কারণ ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট একবার ব্যর্থ হলে সেই ব্রেনকে পুনরায় প্রতিস্থাপন একরকম অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আবার নাকি মেমারি ফুটপ্রিন্টের পরিমাণ নগন্য না হলেও কমের দিকে। অতএব প্রথম থেকেই এক্সট্রা ঝুঁকি নিয়ে চলতে হচ্ছে। আর আরেকটি কারণ রাজনৈতিক। ভারত সরকারের সঙ্গে এই পরীক্ষার ব্যাপারে সবরকম দিক দিয়ে সাহায্য করে বিশেষ মাত্রার মৈত্রী বজায় রাখতে চায় ব্রিটিশ সরকার। কারণ পৃথিবীর সব থেকে বেশি তাজা বাতাসের সম্ভার এখন ভারতের উত্তরে হিমালয় অঞ্চল। ঠিক কি আপৎকালীন দরকারে ভারতে এই যুবকের ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট করে উনবিংশ শতকের শেষের এক ব্রেন ঢোকানো হচ্ছে সে ব্যাপারে অবশ্য সোমা কিছু জানে না। শুধু এটুকু সে বোঝে যে চূড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে এই গবেষণা করা হচ্ছে। হিউমান রিসার্চ ল্যাবের চৌহদ্দি কোনও কারণে ছেড়ে বেরতে হলে, তাদের হাতে অল ইন ওয়ান সেন্সর ব্যান্ড চামড়ার সঙ্গে লক করে বসিয়ে দেওয়া হয় যা কেবল খোলা যাবে এই ল্যাবের মধ্যেই। যতদিন না সমস্ত কাজ শেষ হচ্ছে কারোর তাই এক মুহূর্ত নজরদারি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
বিপ বিপ বিপ। এত কিছু ভাবতে ভাবতে একটুক্ষণের জন্য তন্দ্রা মতো এসে গেছিল সোমার। আধ ঘণ্টাটাক কি চল্লিশ মিনিট হয়েছে কি হয়নি মৃদুস্বরে অ্যালার্মের শব্দে মুহূর্তে চটক ভেঙে গেল। রেস্টোরেশন কম্পিউটারে অ্যালার্ম বাজছে। দায়িত্ববান সিদ্ধার্থ সমস্ত কিছু সোমাকে বুঝিয়েও শেষ মুহূর্তে একটি অ্যালার্ম সেট করে দিয়ে গেছে। এবার স্থানীয় জ্ঞানের ডিস্কটি ঢুকিয়ে শেষ মুহূর্তের মেমারি রেস্টোরেশনের জন্য। সিদ্ধার্থের বিচক্ষণতার মনে মনে তারিফ না করে পারেনা সোমা। এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি ডিস্কটায় ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে লেখা ‘বেঙ্গলি লাঙ্গুয়াগেজ এন্ড এবিসিডি অফ কলকাতা’। রেস্টোরেশন কম্পিউটার অন করাই ছিল। মনিটরের নিচে ছোট ট্রেতে ডিস্কটা বসিয়ে দিতেই চালু হয়ে গেল প্রোগ্রাম। সাবজেক্ট এ এবার ঘুমের মধ্যেই বাংলা ভাষা পড়া লেখা ও উচ্চারণের পদ্ধতি শিখে যাবে। আর জেনে যাবে এই কলকাতা শহরের অতি প্রয়োজনীয় কিছু খুঁটিনাটি। একটু হাসি পেয়ে গেল সোমার। কারণ এই যে, সিদ্ধার্থের কাছে সে শুনেছে কলকাতার যে খুঁটিনাটি তথ্য ওই ডিস্কে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল কলকাতার অলিগলির ভূত বর্তমান সমেত একটা ডিটেল ম্যাপ। কি উদ্দেশে যে এই কর্মকাণ্ড চলছে তা কিছুই জানা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আদপেও কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা এই কর্মযজ্ঞের, বিজ্ঞানীদের পাগলামি আর কি।
রেস্টোরেশন কম্পিউটারে প্রোগ্রাম চালু হতেই ওদিকে লগ মনিটরে এক্টিভিটি রেকর্ড শুরু হয়ে গেছে। রেস্টোরেশনের সব কিছুই কম্পিউটার কন্ট্রোল্ড। এখানে সোমার কোনও হাত নেই। তাই সোমা আবার এগিয়ে গেল লগ মনিটরের সামনে রাখা তার চেয়ারের কাছে। প্রতি সেকেন্ডে সাবজেক্টের ব্রেন নার্ভের স্পার্ক লগ হয়ে চলেছে। ডিজিটাল মাধ্যম থেকে ইলেকট্রিক পালসের মাধ্যমে জলজ্যান্ত সাবজেক্টের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তথ্যসমূহ। তবে লগ মনিটর দেখে বোঝার উপায় নেই এই মুহূর্তে ঠিক কোন তথ্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করল। সেটা বুঝতে গেলে রেস্টোরেশন প্রোগ্রামিং জানা লোক দরকার। হুড় হুড় করে লাইনের পর লাইন সবুজ রঙে লগ ছাপা হয়ে চলেছে মনিটরের পর্দায়। সাবজেক্টের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনও পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়নি এখনও অবধি। এই ছোট্ট ডিস্ক থেকে কয়েক মিনিটের প্রোগ্রাম সাবজেক্টের ব্রেনে যত তথ্য সুবিস্তৃত ভাবে ঢুকিয়ে দেবে কম্পিউটার, বাস্তবে সাবেকি ভাবে চোখ দিয়ে পড়ে সেই তথ্য কণ্ঠস্থ করতে সাবজেক্টের খুব কম করেও মাসছয়েক লাগত। কি অপার মহিমা বিজ্ঞানের। কিন্তু তবু কিছু রিস্ক থেকেই যায়। তথ্যের মধ্যে এমন অনেক তথ্য থাকে যেগুলো সাবজেক্টের মস্তিষ্কে ঘুমের মধ্যেও উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সেই সময় ঠিক টাইম বুঝে রেস্টোরেশনের গতি কমিয়ে দেওয়ার প্রোগ্রাম চালু না হলে মস্তিষ্ক গরম হতে শুরু করে সাবজেক্টের। নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বেশি গরম হয়ে গেলে বিপুল সম্ভাবনা থাকে সাবজেক্টের ব্রেন স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার। তাই সোমার ছুটি নেই। নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে তাকে লগ দেখে যেতে হচ্ছে।
পিঁপ পিঁপ পিঁপ পিঁপ। এবার সাবজেক্টের মাথার কাছে রাখা হার্ট রেট মনিটরটা হঠাৎ এলার্ম দিতে শুরু করল। ক্ষিপ্র গতিতে সোমা চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল সাবজেক্টের কাছে। একি! হার্ট রেট রাইস করছে কেন হঠাৎ। পিঁপ পিঁপ। এবার এলার্ম লগ কম্পিউটার থেকে। তাতে সবুজের পরিবর্তে এবার লাল লাইন। একের পর এক লাল লাইন পর পর হু হু করে উপরে উঠে যাচ্ছে। প্রতিটা লাইনে একটাই শব্দ কেবল পড়তে পারছে সোমা। ডিলিটেড। তবে কি সাবজেক্টের ব্রেনে মেমোরি পুশ করার বদলে মেমোরি ডিলিট করতে শুরু করেছে প্রোগ্রাম? তা কি করে সম্ভব। যতটুকু জ্ঞান আছে সোমার তাতে সে জানে এভাবে প্রোগ্রাম দিয়ে অটো মোডে ব্রেন থেকে ডেটা ডিলিট করা হয় না। নেগেটিভ ইমপালস ব্রেন টিস্যু ড্যামেজ করে দিতে পারে। অপ্রয়োজনীয় তথ্য আগে থেকেই ডিলিট করে তবে রেস্টোরেশন ডিস্ক বানানো হয়। কিন্তু কি হচ্ছে এসব? সাবজেক্টের হাতে পায়ে হাল্কা খিঁচুনি শুরু হয়ে গেছে। ব্রেনের তাপমাত্রা উর্ধমুখী। ক্ষিপ্র হস্তে রেস্টোরেশন কম্পিউটারে স্পিড কন্ট্রোলের প্রোগ্রাম অন করে দিল সোমা। এখুনি সিদ্ধার্থকে খবর দেওয়া দরকার। এখুনি। সাবজেক্টের কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কানের পাশ দিয়ে। চোখের পলক কাঁপছে তির তির করে। আর দেখতে পারল না সোমা। এক ছুটে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। এখুনি সিদ্ধার্থকে দরকার এখানে। আর এক মুহূর্ত নষ্ট করা যাবে না।
(৬)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪ ভোর চারটে পনেরো, হিউম্যান রিসার্চ ল্যাবের গ্রিন রুম
হুড়মুড় করে দরজার সামনে এসে পড়লেন ডক্টর মুখার্জী।
“গুড মর্নিং স্যার“ দরজায় দাঁড়ানো বিনিদ্র প্রহরী উঠে দাঁড়িয়ে সম্বোধন করতে এগিয়ে আসে।
‘মর্নিং’। ক্ষিপ্রহস্তে সিকুরিটি কি-প্যাডে এন্ট্রি করতে করতে একটু ব্যস্ত গলায় বলেন ডক্টর। ‘আমাকে যেন নেক্সট এক ঘণ্টা কেউ বিরক্ত না করে। যেই আসুক লগ নিয়ে রাখবে।‘ কি-প্যাডে এন্ট্রি শেষে এবার বায়োমেট্রিকে চোখ দেখার পালা। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক সময় লেগে যায় রেটিনা স্ক্যান হতে হতে। ডক্টরের চাল চলনে ছটফটে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘ধুত্তেরি’ অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে হাত ঝাড়েন ডক্টর। মাথা স্ক্যানার থেকে তখনও সরাননি কারণ রেটিনা স্ক্যান চলছে। ডক্টর হাত নাড়া মাত্রই সেন্সর ব্যান্ডের লাল আলো নজরে পরে যায় সিকিউরিটির।
‘আপনার কি কিছু সমস্যা হচ্ছে স্যার? কাউকে ডাকব?’
‘নাঃ , কাউকে দরকার নেই। ও কিছু না।’ এতক্ষণে স্ক্যান কমপ্লিট হয়ে দরজা খোলে।
‘আর শোনো,‘ ডক্টরের সুর এতক্ষণে একটু নরম হয়। মাথার মধ্যে দ্বিতীয় সত্ত্বা বলে উঠেছে এত বেশি বিরক্তি অযথা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়েন দরজা ধরে। ‘প্লিজ আমাকে একটু রেস্ট করতে দাও হ্যাঁ। বুঝতেই তো পারছ চারদিন ধরে যা চলছে-’
এইটুকু নরম সুরে শুনেই স্বাভাবিক হয়ে যায় সিকুরিটি। ‘ওকে স্যার। কেউ ডিস্টার্ব করবে না আপনাকে। কোন কল এলে আমি লগ করে রাখব।’
একচিলতে হাসি মুখে এনে গ্রিন রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন ডক্টর।
দরজা বন্ধ হতেই মাথার মধ্যে আঘাত হানে সে। দুহাতে সজোরে মাথা টিপে ধরে মাটিতে বসে পড়েন ডক্টর।
‘কেন এরকম করছেন, কেন কেন, বাঁচতে দিন আমায়’ মরিয়া চিৎকার ডক্টর মুখার্জির।
হিমশীতল ঠান্ডা গলায় মাথার মধ্যে থেকে কথা বলে ওঠে দ্বিতীয় স্বত্বা।
‘আঃ, হচ্ছেটা কি। অযথা ওপেন গ্রিন রুমে চিৎকার না করে নিজের পডে ঢোকো।’
ডক্টর জানেন বিরোধিতা করে কোনও লাভ নেই। দ্বিতীয় সত্তার অধীনে এখন তাঁর দেহের অধিকাংশ মাংসপেশি। নিজের ইচ্ছে, সে যত তীব্রই হোক না কেন তার উপর আর নিজের কোনও কন্ট্রোল নেই। কোনওরকমে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিজের পার্সোনাল পডটার মধ্যে ঢুকে পড়েন ডক্টর। এখানে তিনি সম্পূর্ণ একা। সাত ফুট বাই পাঁচ ফুট এই ক্যাপসুল আকৃতি পডের মধ্যে থেকে একটুও আওয়াজও বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।
‘তুমি জানো কী করতে হবে এবার মুখার্জী’ কথাটা বেরোল ডক্টরের মুখ দিয়ে কিন্তু কণ্ঠস্বর আলাদা। এ কণ্ঠের মালিক মস্তিষ্কে অধিগ্রহণ করে থাকা নিষ্ঠুর পিশাচ সম দ্বিতীয় সত্ত্বা।
‘কেন, কেন, কেন আমাকে দিয়ে করাচ্ছেন এসব? কী ক্ষতি করেছিলাম আমি আপনার?’ এবার শুধু গলার স্বর বদলে গেল। হাহাকারের মতো শোনাচ্ছে মুখার্জির নিজের মনের কথা।
‘ক্ষতি? ক্ষতির প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? মাথাটা টাক হয়ে যাওয়া ছাড়া তোমার আর কি ক্ষতির কথা বলতে চাও তুমি? তুমি কি ভুলে যাচ্ছ তুমি কি ছিলে? বাবার পয়সা ছাড়া আর কোন যোগ্যতা ছিল তোমার? লন্ডনে আমার ব্রেন না পেলে তুমি নিজের মাথা খাটিয়ে শুধু পারতে আজ দেশের সব থেকে বড় হিউম্যান রিসার্চার হতে? আমার থেকে পজিটিভ পালসের সূত্র না পেলে তুমি পারতে তোমার ওই কি বলে, ডিজিটাল মেমারি ট্রান্সফার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে? ক্ষতির কোনও কথাই নেই এখানে। তিন বছর ধরে আমি তোমাকে যা দিয়েছি তার বদলে এখন আমি যা করতে বলব তাই করতে হবে তোমায়।’
ডক্টরের ডান হাত চলে যায় পকেটে। বেরিয়ে আসে মুঠোফোন সমেত। এটা ডক্টরের নিজের ফোন নয়। সেই লন্ডন থেকে ওরা যে ফোনটা দিয়েছিল – প্লাষ্টিক বডি, একশো শতাংশ ধাতুবিহীন, আনট্রেসে–এইইই… আর ভাবতে পারলেন না। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডক্টর বাম হাত দিয়ে ডান হাত আটকাতে। কিন্তু একি, একচুল সরছে না বাম হাত। মস্তিষ্ক থেকে হাজার ভোল্টের কারেন্ট যেন ঠিকরে পড়ছে দেহের সমস্ত পেশির উপর। মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়েও নিজের হাত আটকাতে পারছেন না ডক্টর। তবে কি তাঁর সমস্ত শরীরটাই চলে গেল ওই নর পিশাচ দ্বিতীয় স্বত্বার অধীনে। মোবাইলের ডায়াল প্যাডে নাম্বার ডায়াল হয়ে গেছে ততক্ষণে। ওপাশে রিং শুরু হচ্ছে। গলা চিড়ে চিৎকার করতে গেলেন ডক্টর কিন্তু বৃথা আস্ফালনে জিবটা কেবল ঝাপটা মারতে লাগল মুখের ভিতর। ওপাশের রিং বেজেই চলেছে। যে কোনও মুহূর্তে ওপাশ থেকে আওয়াজ শুনতে পাবেন ডক্টর।
(৭)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর চারটে তিরিশ
‘হ্যালো’ কাঁপা কাঁপা গলায় ফোনটা রিসিভ হয়।
ওপাশের খিল খিল হাসির শব্দে কেঁপে ওঠে ফোনের স্পিকারটা
‘কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার ওল্ড ডক।’
‘আ আপনি কি, মানে আপনি কি করে।’
‘আমি যে সব জানি ডক্টর।’
‘কিন্তু এ, এ অসম্ভব! রিসার্চ ল্যাবে এত সিকুরিটি, আমরা শুধু তো নিজেরাই কথা বলতে পারি একে অন্যের সঙ্গে। আপনি এখন কি করে আমায় এই ফোনে…?’
‘ফু, সব কিছুতে তোমরা নির্ভর ইন্টারনেট নেটওয়ার্কিং মাধ্যম দিয়ে, তোমরা আবার করছ সিকিউরিটির বড়াই। ফু।’
‘কিন্তু না, এ–এ যে অসম্ভব!’
‘রাখো তোমার অসম্ভব!,’ এতক্ষণের শ্লেষ মিশ্রিত ব্যঙ্গাত্মক ধ্বনি এক লহমায় কাঠিন্যে বদলে যায়। ‘আজ তুমি যা করছ, দশ বছর আগে সেটাও অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ত। কোথায় তুমি এখন? সূর্যোদয় তোমার খুব প্রিয় – রাইট? ধরে নিচ্ছি তুমি এখন তোমার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছ। পাঁচ বছর আগেও ভেবেছিলে কলকাতার মানুষ ভবিষ্যতে আর কোনদিন নিজের বাড়িতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে পাবে না? তোমার ওই প্রিয় ছাত্র? সিদ্ধার্থ। সে যা আবিষ্কার করেছে সেটা দুবছর বছর আগেও প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়তো। এই পৃথিবীটা শুধু তোমার আর তোমার ছাত্রকে নিয়ে নয় শুধু মাই ডিয়ার। আরও অনেক মাথাওয়ালা মানুষ রয়েছে যাদের আবিষ্কারের কাছে তোমার নিজের মস্তিষ্ক নেহাতই পক্ষীসম ক্ষুদ্র।’
ডক্টর বোসের সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে এতক্ষণে। বাইরের গরমও বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। ফোনের ওদিকের কথাগুলো ছুরির মতো বিঁধছে তাঁর কানে। এত কিছু সিকুরিটি, এত কিছু প্রটোকল সব ভেঙে এই এক্সপেরিমেন্টের কথা বাইরে বেরিয়ে গেল? তবে কি সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে? সিদ্ধার্থ? সোমা? ওরা কি কেউ কিছু খবর বাইরে বের করছে। নাঃ, তা হতেই পারে না। এত কাছের ওরা ডক্টর বোসের। ওদের কিছু খারাপ প্রবণতা থাকলে তা তাঁর চোখ এড়াত না এতদিন।
‘ভাবা বন্ধ কর ডক্টর’ হিমশীতল আওয়াজটা মুহূর্তে কালো পর্দা টেনে দেয় ডক্টরের চিন্তায়। ও কি তবে ডক্টরের চিন্তাও পড়ে ফেলতে পারছে।
‘যাও, আর কিছুক্ষণ পরেই জেগে উঠবে তোমার সাবজেক্ট ‘এ’। বিজ্ঞানের সাধক তুমি ডক্টর আর এটাও জানো না বিশাল এই জ্ঞানের পরিধি কতদূর? আর এই বিশাল জ্ঞানের প্রয়োগ যে আরও কত সুদূরপ্রসারী তা তোমার মাথায় ঢুকবে না। আর আমি তোমায় ফোন করবো না ডক্টর। আজকের দিনটা খুব কষ্টে কাটবে তোমার। যেটুকু জীবন তোমার বাকি আছে তার গতিপথ বলে দেবে আজকেরই দুটো ঘটনা। যাও যাও, আর দেরি করো না। ল্যাবে ফিরে যাও।’
পিক পিক আওয়াজ তুলে শেষ হয়ে গেল ভয়েস কল। ফোনটা রেখেও খিঁচুনি কমছেনা ডক্টরের। বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা। প্রথম বার যেদিন কলটি পেয়েছিলেন সেদিন ফোনে বেশ তম্বি দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন ডক্টর বোস। পাত্তাও দেননি ফোনের ওপারের মানুষটিকে। কাউকে কিছু জানবারও প্রয়োজন মনে করেননি। বড় কাজ করতে নামলে বন্ধুর সঙ্গে দু-একটা শত্রুও জোটা কিছুমাত্র যে বিরল নয়, ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে অনেক। এই ভেবেই উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু বাধ সেধেছিল ওই বরফের মতো ঠান্ডা গলাটা। কিছুতেই যেন মাথা থেকে সরাতে পারছিলেন না ফোনে শোনা কথাগুলো। শয়নে স্বপনে ওই গলাটা মনে পড়লেই একটা শিরশিরে অনুভূতি নেমে যেত শরীর বেয়ে। শেষমেশ নিজের গরজেই সিকুরিটিকে জানান সবকিছু। আসল চিন্তার কারণ ঘটল এরপর। এতোদূর আজ এগিয়েছে বিজ্ঞান কিন্তু সামান্য একটি ফোন কলকে কোনভাবেই ট্রেস করা গেল না। সারাদিন চেষ্টার পরেও সিকুরিটি ডিপার্টমেন্ট শুধু এটুকু তথ্যই দিতে পারলো যে ফোন কলটা করা হয়েছে কোনও সাবেকি মোবাইল থেকে নয়, বিশেষ ভাবে তৈরি কোনও আনট্রেসেবেল কমিউনিকেটর ডিভাইস থেকে। লন্ডন অবধি খবর পাঠানো হয়েছিল এই ফোন কলের, কিন্তু সেখান থেকেও যখন কোনও যথাযথ উত্তর এল না তখন থেকেই ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছিল ডক্টরের মনে। তারপর বিগত কয়দিনে আর কিছু খারাপ না হওয়াতে দুশ্চিন্তাটা একটু যেন কেটেছিল। কিন্তু আজ আবার ফিরে এল সেই হিমশীতল গলার মালিক। দুর্ভেদ্য কোন মেঘের আড়াল থেকে তার গলার আওয়াজ যেন ছুরির মতো আঘাত হেনে গেল। কি হতে চলেছে আজকে? প্রথম দিন ফোনেই লোকটা নিজের পরিচয় দিয়েছিল ডক্টরকে। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন তিনি। কিন্তু আজকের পর তো কিছুই আর অসম্ভব মনে হচ্ছে না। তবে কি সত্যি ফিরে এসেছেন অপরাধের নেপোলিয়ন সেই প্রফেসর?
বাইরে চাপা মেঘ ডাকার মতো আওয়াজে চিন্তায় ছেদ পড়ল ডক্টরের। কিন্তু এ আওয়াজ মেঘের নয়, বৃষ্টি এখন আর হয় না এখানে। চারশো ফুট উপরে কৃত্রিম আকাশ ঢেকে দিচ্ছে কলকাতাকে। হিসেব করা জলীয় বাষ্প ভরা বাতাস কিছুক্ষণের মধ্যেই শীতল পরশ বুলিয়ে যাবে সবকিছুর উপর দিয়ে।
(৮)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর পৌনে পাঁচটা
‘ডক্টর মুখার্জী কোথায় গেছে জানো?’ ঝড়ের বেগে রিসার্চ ল্যাবের দরজা খুলে বেরিয়ে এল সোমা। সামনেই সিকুরিটি এসে দাঁড়িয়েছে বিনীত ভঙ্গিতে।
‘বোধহয় গ্রিন রুমে ম্যাডাম, ব্যান্ড লক তো করেননি, কমপ্লেক্সের মধ্যেই আছেন কোথাও।’
‘উফফ, এই সময়েই’ ক্ষিপ্র পদে সোমা দৌড়ল গ্রিন রুমের দিকে। ‘জুলিয়া ম্যাডামকে কল দাও এখুনি, বলো আমি বলেছি সাবজেক্ট এর উপর নজর রাখতে।’
গ্রিন রুম যেতে গেলে এই ল্যাবের ফ্লোরের উপরের ফ্লোরে যেতে হবে। এলিভেটরের জন্য ওয়েট না করে এমার্জেন্সি স্টেয়ার দিয়ে ছুটল সোমা। দুড়দাড় করে এসে উপস্থিত হল গ্রিন রুমের দরজায়। এখানেও অষ্টপ্রহর তটস্থ সিকুরিটি।
‘ডক্টর মুখার্জীকে দেখছ?’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম। গ্রিন রুমে আছেন।‘
‘কল দাও, কল দাও এখুনি, ভীষণ দরকার।‘
‘কিন্তু ম্যাডাম?’
‘কিন্তু কি, বলছি না ভীষণ দরকার। এখুনি এমার্জেন্সি কল কর।’
‘কিন্তু ম্যাডাম স্যার নিজে আমায় বলে গেলেন যে যতই এমার্জেন্সি হোক তাঁকে বিরক্ত না করতে।’
‘আরে এমার্জেন্সি তুমি কি বুঝবে।’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে এবার সোমা। ‘তোমার স্যার নিজেই লাফিয়ে আসবেন, তুমি কল করো আগে, সাবজেক্ট এ ডিটোরিয়েট — সিদ্ধার্থ !’
ওদের কথা-কাটাকাটির মধধেই সজোরে খুলে যায় গ্রিন রুমের দরজা। দরজা ধরে টলতে টলতে বেরিয়ে আসেন ডক্টর মুখার্জী। দরজা ধরে বাইরে বেরিয়ে এসে কোনওরকমে দেওয়াল ধরে দাঁড়ান। চোখ লাল, দর দর করে জল পড়ছে চোখ দিয়ে।
‘কি হয়েছে তোমার?’ দৌড়ে আসে সোমা। তাকে ধরে দাঁড়াতে না পেরে এবার মেঝের উপর বসে পড়েন ডক্টর মুখার্জি। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে তিনি লড়াই করছেন দ্বিতীয় সত্ত্বার সঙ্গে। কিন্তু কিছুই যে তার কথা শুনছে না।
‘আ, আমি’ মুখ খুলতেই ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোতে থাকে, চুপ হয়ে যান ডক্টর। কিছুতেই পারছেন না তিনি নিজের শরীরে কর্তৃত্ব করতে। অক্টোপাসের মতো সবকিছু জড়িয়ে বসে আছে কালান্তক। প্রচণ্ড ভাবে ভাইব্রেট করছে হাতে লাগানো বিপি মনিটরিং ব্যান্ড। হাত-পা এদিকে ওদিকে আছাড়ি পিছাড়ি শুরু করতেই সোমা জড়িয়ে ধরে তাঁকে। দু-হাত দিয়ে ডক্টর সজোরে চেপে ধরেন তাঁর কপাল। প্রচণ্ড মানসিক চাপে যেন ফেটে যাচ্ছে মাথা। হৃৎপিণ্ড মনে হচ্ছে উপড়ে বেরিয়ে আসবে বক্ষপিঞ্জর থেকে। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে সমস্ত শরীর। ‘ও আঁ আঁ আঁ’। নিজের গলায় প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলেন ডক্টর। নিজের হাত যে কখন নখ দিয়ে কপাল বরাবর চামড়া মাংস চিড়তে আরম্ভ করেছে নিজেও বোঝেননি। বোঝার কথা নয় অবশ্য। কারণ অবস্থা এখন এতটাই ভয়ানক যে শরীরের সমস্ত ঐচ্ছিক পেশীই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আরও ভয়ানক এই যে, ব্যথা দুঃখের মতো একান্ত নিজস্ব অনুভূতিগুলি কিন্তু শরীরের মধ্যে বসবাস করা কৃতান্তের অরুচি। তাই ব্যথায় ডক্টর চিৎকার করে উঠলেও পরক্ষণেই মনের মধ্যে সেই ঠান্ডা কণ্ঠস্বর আঘাত হানে।
‘এই হল তোমার কথা বলতে চাওয়ার পুরস্কার। নাও নাও এবার দেখো কপালটায় হাত দিয়ে। দেখ, দেখ কি গভীর আমার আশীর্বাদ।’ খিল খিল করে অসহ্য হাসিটা শরীরের প্রতিটি কোষে প্রতিফলিত হয়ে ডক্টরের মাথায় ফুটতে থাকে। বদলে শুধু অশ্রু ধারা নেমে আসে চোখ দিয়ে। তা মুছিয়ে দেবার জন্য নিজের হাত দুটো ও যে অকেজো এখন। ছটফট করতে করতেই হঠাৎ স্থির হয়ে যায় তার শরীরটা।
‘সিদ্ধার্থ’ চিৎকার করে ওঠে সোমা।’ সিকুরিটি, এমার্জেন্সি – ডাক্তার, কুইক’, কপাল থেকে রক্ত বেরিয়ে মাখিয়ে যাচ্ছে সোমার হাত, বুক। একহাতে সিদ্ধার্থের নিথর শরীর সবলে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে রক্ত মুছতে লাগে সোমা।
নাঃ, মারা যাননি ডক্টর। দু-চোখ দিয়ে ব্যর্থতার অশ্রু ঝরে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। শেষ বারের মতো মনে পড়ে যায় তিন বছর আগের সেই সময়গুলোর কথা। বাবার বড় ইচ্ছে ছিল তাঁকে বিজ্ঞান সাধক বানানোর। পড়াশোনায় সে খুব খারাপ ছিল না ছোটবেলায়। যার জন্য কেমব্রিজে হিউম্যান রিসার্চ নিয়ে পড়াশোনা করার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কোনওরকমে উৎরে যায় সে। কিন্তু লন্ডনে পৌঁছে সে যতটা না কলেজকে আপন করতে পেরেছিল তার থেকে বেশি আপন হয়ে উঠেছিল লন্ডনের অন্ধকার জগৎ। সামান্য নেশার দ্রব্য সংগ্রহে যে জগতে তিনি পা বাড়িয়েছিলেন ছয় মাস ঘুরতে না ঘুরতে সেই জগৎ গ্রাস করে নেয় তাঁর সবকিছু। তারপর? অন্ধকার জগতে ভবিষ্যৎ বলে কারো কিছু থাকে না, কিন্তু মুখার্জি পেয়েছিলেন এক অন্য ভবিষ্যতের স্বাদ। যখন তাঁর কাছে বাইরের বাস্তব জগত প্রায় অলীক হতে বসেছে, সেই সময় এক কুখ্যাত অপরাধী গোষ্ঠী তাঁকে বাধ্য করায় একটি ব্রেন সার্জারি করতে। জীবনের মায়া বড় মায়া। একরকম প্রাণে বাঁচার তাগিদেই তখন একবারও তিনি জানতে চেষ্টা করেননি কুখ্যাত অপরাধী গোষ্ঠীর আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে কেন রক্ষিত রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক মস্তিষ্ক। সাবেকি প্রথা, অপর্যাপ্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনওরকম আপৎকালীন ব্যবস্থা ছাড়াই তিনি বাধ্য হন তরলে চুবানো সেই মাংস পিন্ডকে নিজের মস্তিষ্কের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে প্রতিস্থাপনে। অত্যাশ্চর্য ভাবে সেই মস্তিষ্কের বয়েস শতাব্দী প্রাচীন হলেও কি কর্মক্ষমতা কি মেমোরির ফুটপ্রিন্ট সব দিক দিয়ে সেটি ছিল রিপ্লেসমেন্টের জন্য আদর্শ। ফলে কিছুটা হাতুড়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপারেশন হলেও তা সাকসেসফুল হয়। অন্ধকার জগতের মানুষের কাছে যে কি করে এই ব্রেন এতদিন এত ভালোভাবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের দ্বারা রক্ষনাবেক্ষনের মধ্যে ছিল, তা সত্যি আশ্চর্য। ডক্টর মুখার্জি এটুকু শুনেছিলেন যে কোনও অজ্ঞাত সোর্স থেকে এই ব্রেন সংরক্ষণের জন্য সমস্ত রকম প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সাহায্য আসত। বেশি কৌতূহল ভয়ঙ্করী হতে পারে ভেবে ও নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাননি তিনি। তবে তারপর আর ফিরে দেখতে হয়নি ডক্টরকে। এটুকু তিনিও বোঝেন তাঁর নিজের আজ যা কিছু উদ্ভাবনী শক্তি, যা কিছু আবিষ্কার সবই ওই প্রতিস্থাপিত সমান্তরাল মস্তিষ্কের জোরে। একটু অভাব ছিল সেই মস্তিষ্কের, সেটা হল আধুনিক জ্ঞানের। যা অনায়াসে পুষিয়ে দিয়েছে মুখার্জির নিজের ব্রেন এবং অবশ্যই ইন্টারনেট। প্রথম যখন পরিচয় জানতে পেরেছিলেন ওই দ্বিতীয় সত্ত্বার, তখন একবার ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল ডক্টরের। কিন্তু তারপর নিজেকেই বুঝিয়েছেন তিনি। আসলে সাফল্যের বন্যায় একবার প্লাবিত হয়ে গেলে অনেক বিপদকেই তুচ্ছ জ্ঞান করার মানসিকতা চলে আসে। ঠিক সেটাই হয়েছিল এই ক্ষেত্রে। বরং মাঝে মাঝে গর্ব অনুভব করতেন তিনি ওই ব্রেনের পূর্বতন মালিকের কথা ভেবে। সত্যি কতটা অর্গানাইজড ছিলেন তিনি। এতটাই বেশি বিচক্ষণ ছিলেন যে নির্ভুল ভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন মে মাসের সেই সকালে রেইনবার্ক ফলসের নিকট নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা। এটাও বুঝেছিলেন যে তার মৃতদেহ থেকে যদি শুধুমাত্র তাঁর ব্রেনটিকে সংরক্ষন করা যায় তবে আজ হোক কি কাল হোক কি শতাব্দী পার করে হোক, তিনি আবার ফিরে আসতে পারবেন এই দুনিয়ায়। সত্যি কতটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হলে একটা মানুষ এত তীক্ষ্ণ ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হতে পারে।
দেড় শতাধিক বছর সেই অন্ধকার বাঙ্কারে বোতল বন্দি হয়ে রক্ষিত থাকার পর অবশেষে সেই মস্তিষ্ক ঠিকানা পায় ডক্টর মুখার্জির শরীরে দ্বিতীয় সত্বা হিসেবে। তারপর দুই বছর ধরে তিলে তিলে পুষ্ট হয়েছে সেই কালান্তক ধূসর মাংস পিণ্ড। আজ যখন ডক্টর মুখার্জি পৃথিবীর শুধু অন্যতম নয়, একেবারে শ্রেষ্ঠ মেমোরি রিপ্লেসমেন্ট কারিগর হয়েছেন ঠিক সেই সময় থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সে। নিজের ইচ্ছে, নিজের শরীর, নিজের জন্য কাজ কিছুর উপরেই আজ যেন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই ডক্টরের। কোনভাবে একবার যদি সুযোগ আসত নিজেকে শেষ করে দেবার, তবে এই যমের হাত থেকে মুক্তি পেতে স্বেচ্ছায় নিজেকে শেষ করে দিতেন ডক্টর।
সেই শরীর কিন্তু আর মুক্তি পেল না, শেষ হয়ে গেল মস্তিষ্কের মধ্যে সিদ্ধার্থের নিজস্বতাটুকু। মগজ থেকে সবটুকু সিদ্ধার্থ হারিয়ে গেছে এক ঝটকায়। এখন আর তিনি ডক্টর সিদ্ধার্থ মুখার্জী নন। সোমার সস্নেহ আগলে সিদ্ধার্থের শরীরের আড়ালে জেগে উঠেছে প্রফেসর জেমস মরিয়ার্টি।
(৯)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর সাড়ে পাঁচটা
প্রফেসর মরিয়ার্টির ফোন পাওয়ার পর স্বাভাবিক হতেই প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেছিল ডক্টর বোসের। এত ঠান্ডা গলায় কথা বলে লোকটা, কথার মধ্যে দিয়েই যেন শ্রোতার স্নায়ুগুলোকে অকেজো করে দেয়। ব্যালকনিতেই বসে পড়েছিলেন ডক্টর। হাত পায়ের খিঁচুনি যেন থামতেই চায় না আর। শেষমেশ ব্রিজলুমিনো পিউরিফায়ারের কৃত্রিম বৃষ্টি যখন হাল্কা কুয়াশার মতো পরশ বুলিয়ে সর্বাঙ্গ সিক্ত করে তুলেছে, তখন চমকে উঠলেন ডক্টর। কলকাতায় এখন সবথেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায় যে পাখি, একগুচ্ছ কাক তখন ব্যালকনির আশপাশ দিয়ে সার বেঁধে বসে ঠান্ডা কুয়াশার পরশ মাখছিল। একযোগে কাকা শব্দে উড়ে গেল তারা।
নাঃ, কোনওভাবেই এই এক্সপেরিমেন্টের কোনও ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। সমগ্র ভারতবর্ষ, শুধু ভারতবর্ষই বা কেন, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র কলকাতা এখন সব থেকে বড় শহর যেখানে এই ধরণের পরীক্ষানিরীক্ষা করবার মতো উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি রয়েছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, মানুষ এখানে নির্দ্বিধায় নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। দিনের পর দিন এত মানুষ মফঃস্বল বা অন্যান্য বড় শহর থেকে এদিকে আসছে যে বছরখানেকের মধ্যে জন-বিস্ফোরণ হতে বাধ্য। এর মধ্যে সব থেকে বেশি যা প্রয়োজন তা হল শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই আজ শহরে অষ্টপ্রহর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সবার প্রায় সব কিছুই ডিস্টপিয়ার মতো আজ নজরবন্দী। তবু কিসের যে অভিশাপ নেমেছে বিগত কিছুকাল ধরে যে সব কিছু ব্যর্থ হচ্ছে এই শৃঙ্খলা সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে। এই শহরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সাবজেক্ট এ-র উপর। কোনোভাবেই একে নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। কলকাতার দিকে আজ তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। ব্রিটিশ সরকার আর ভারত সরকারের সবটুকু বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা উজাড় করে দেওয়া হয়েছে যে পরীক্ষার পিছনে মানব জাতীর স্বার্থে তা কোনওভাবেই ব্যর্থ হতে দিলে চলবে না।
ঝড়ের বেগে প্রস্তুত হয়ে নিলেন ডক্টর বোস।
প্রায় একরকম ছুটতে ছুটতে গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। কৃত্রিম বৃষ্টি শেষ হয়ে তখন বেশ একটা মোলায়েম আবহাওয়া বিরাজ করছে কলকাতায়। সকালের সদ্যস্নাত পাখিরা কলরব জুড়েছে।
‘স্যার স্যার।’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাক পেয়ে পিছনে ঘুরতে হয় ডক্টরকে। তাঁর ঘরের কেয়ার টেকার।
‘স্যার, কিছু খেয়ে নিন স্যার – স্যান্ডুইচ, কফি।’
এক চিলতে ভালোলাগা মন ছুঁয়ে যায় ডক্টরের। এতো উদ্বেগের মধ্যেও সামান্য একটু খুশির ছোঁয়ায় মনটা ভালো লাগে কয়েক পলকের জন্য। প্রফেসরের ফোন পাওয়ার পর একরকম দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়েই গায়ে পোশাক জড়িয়ে বেরিয়ে আসছিলেন তিনি। খাবার কথা মনেও পড়েনি। খেয়ালি কেয়ারটেকার বুদ্ধি করে খাবারটা প্যাক করে নিয়ে এসেছে যাতে গাড়িতে যেতে যেতে কোনওরকমে খেয়ে নিতে পারেন একটু। হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে নিয়ে নিলেন খাবারের প্যাকেট আর কফি সমেত কভার করা গ্লাসটা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুললেন না। আক্ষরিক অর্থেই কেয়ার টেকার তাঁর।
ইতিমধ্যেই অফিস ক্যাব বলা হয়ে গেছে, যে কোনও মুহূর্তে চলে আসবে গাড়ি। ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। কৃত্রিম আকাশেও আজ ধূসর রং। হয়ত বা প্রকৃতই আকাশ মেঘলা হয়ে রয়েছে, তাই পিউরিফায়ারের সুবিশাল ডিসপ্লে ইউনিট ধূসর রংয়ের আকাশ দেখাচ্ছে শহর বাসীকে। ক্ষণিকের ভাল লাগা ভাবটা কেটে গিয়ে আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন প্রফেসর। কফির গ্লাসের উপরের কভার খুলে সবে চুমুক মারতে যাবেন ডক্টর, সহসা চমকে উঠলেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কান্নার শব্দে।
একটা মানুষ। যৌবন উত্তীর্ণ কিন্তু চোখে মুখে বিহ্বল শিশুর দৃষ্টি। খিদে পাওয়া শিশুর মতো জিব বার করে সলোভে তাকিয়ে রয়েছে ডক্টরের খাবারের দিকে।
(১০)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর পৌনে ছটা
‘সিদ্ধার্থ, সিদ্ধার্থ, শুনতে পাচ্ছ?’ কান্না ভেজা গলায় শরীরটা চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিতে থাকে সোমা।
ইতিমধ্যে ডক্টর মুখার্জীকে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে সাবজেক্ট বি-র কেবিনে। গ্রিন রুমের পাশেই এই কেবিনটা হাতের কাছে ফাঁকা পাওয়া গিয়েছিল। সাবজেক্ট বি বেরিয়েছেন তাঁর প্রাতঃকালীন ভ্রমণ সারতে। ডক্টর মুখার্জির শরীরে খিঁচুনি শুরু হতেই তড়িঘড়ি তাকে নিয়ে পাশেই সাবজেক্ট বি-র ঘরের বেড শুইয়ে সমস্ত রকম অবসার্ভেশন সেন্সর অন করে দেয় সোমা। এমার্জেন্সি কোনও ডক্টরকে পাওয়া যায়নি অতএব আরেক জুনিয়র নার্স তাকে অ্যাসিস্ট করতে থাকে। সেন্সর বলছে এখন মুখার্জির শরীরের সব কিছু স্টেবল। কিছুক্ষণ আগে অবধি ব্রেন থেকে প্রচণ্ড উত্তেজক পালস পাওয়া যাচ্ছিল। হাতের সেন্সর ব্যান্ডও কিছুক্ষণ আগে অবধি লাল আলোয় দপ দপ করছিল। এখন যদিও স্বাভাবিক, কিন্তু সিদ্ধার্থ চোখ খুলছেন না দেখে সোমার উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
‘ম্যাডাম?’
জুনিয়র নার্সের কথায় বেডের মাথার দিকে হার্ট রেট মনিটরের দিকে তাকাল সোমা। হার্ট রেট বেশির দিকে, কিন্তু উদ্বেগজনক নয়। চোখের পলক কেঁপে কেঁপে উঠছে সিদ্ধার্থের। যে কোনও মুহূর্তে জ্ঞান ফিরে আসবে। নাওয়া খাওয়া ভুলে নাগাড়ে কাজ করার ফলেই বোধহয় এই কনকাশন। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে সোমা। আলতো হাত সিদ্ধার্থের মাথায় কপালে বোলাতে বোলাতেই চোখ মেলেন ডক্টর মুখার্জী।
‘আঃ’ মুখ দিয়ে স্বস্তির আওয়াজ করে বেডে উঠে বসলেন প্রফেসর মরিয়ার্টি। সিদ্ধার্থের শরীরের মধ্যে এতদিন থাকলেও কেমন যেন নিজেকে পরাধীন মনে হত তাঁর। তিল তিল করে হোস্টের পুষ্টিতে ভাগ বসিয়ে নিজেকে পুষ্ট করেছেন বিগত বছর খানেক ধরে। আধুনিক ভারতীয় ছেলের মোটামুটি মেধাবী মস্তিষ্কটিকে ছিবড়ে করে তিনি জেনে নিয়েছেন আধুনিক পৃথিবীর হাল হকিকত। ভাগ্য ভালো যে ছেলেটি ব্রেন ট্রান্স-প্লান্ট নিয়ে কাজ করে, যার তার শরীর হোস্ট হিসেবে পেলে তাঁর পক্ষে এতটাও সহজ হত না সব কিছু গুছিয়ে নেওয়া। সব থেকে কঠিন ছিল হোস্টের ঐচ্ছিক পেশী গুলোর উপর কর্তৃত্ব করা। যতক্ষণ সেটা না হচ্ছিল কিছুতেই তিনি ইচ্ছেমতো সবকিছু করাতে পারছিলেন না শরীরটাকে দিয়ে। দলের অনেকের সাহায্যে আসলে ভয়টা একদম রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন সিদ্ধার্থের। নেশাখোর যারা হয় তাদের জীবনে নেশা যতক্ষণ না থাকে ততক্ষণ থাকে কেবলমাত্র ভয়। সেই ভয়টাকেই সুন্দরভাবে ব্যাবহারে সমর্থ হয়েছে তাঁর অনুরাগীরা। হাসি পায় সিদ্ধার্থ ছেলেটার বছর দুয়েক আগেকার অবস্থার কথা ভাবলে। নেশা যদি ওর জীবনে না আসত, তাহলে হয়তো চেষ্টা চরিত্র করে মোটামুটি একটা ভালো কিছু করতে পারত। যদিও ছেলেটার মাথা গ্যাদগেদে ইমোশনে বেশি ঠাসা ছিল তবুও একদম ফেলনা ছিল না। বরং এই দেশের ভাষা, রাজনীতি, মানুষের আদব কায়দা বুঝতে বুঝতে মাঝে মাঝে ছেলেটার চিন্তা শক্তি অবাক করেছিল প্রফেসরকে। যাকগে যাক। এখনও তার শেষ কাজ বাকি। এই শরীরের থেকে মুক্তি নিয়ে তাঁকে পাড়ি জমাতে হবে অসীমের দিকে।
‘কি হল, কথা বলছ না কেন ?’ অধৈর্য সোমার ঝাঁকুনিতে ওর দিকে মুখ ফেরান প্রফেসর। যতদিন সিদ্ধার্থের মগজ প্রাইমারি হিসেবে কাজ করছিল ততদিনে প্রফেসর খুব ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছিলেন ওর দুর্বলতাগুলো। এখন তাঁর সামনে যেই মেয়েটা গালে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ নিয়ে অধীর আগ্রহে চেয়ে রয়েছে এটি হল সেই দুর্বলতা গুলির মধ্যে সবথেকে বেশি স্পর্শকাতর।
‘কি হয়েছে বলবে?’ আবার অবাধ্যের মতো ঝাঁকুনি দেয় সোমা।
‘না না সব ঠিক আছে‘ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে নিজের গলায় বলে ওঠেন প্রফেসর। মনের কোণে ঝিলিক মেরে যায় কৌতুক। মেয়েটির ধারণাই নেই যে তার প্রিয়তম এখন ইতিহাস।
‘ম্যাডাম আমি তাহলে..’
‘হ্যাঁ যাও, সাবজেক্ট এ-র কাছে জুলিয়া আছে, ওকে অ্যাসিস্ট কর।’ একদম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সোমা এখন। বা-বাঃ, যা ভয় পেয়ে গেছিল সে সিদ্ধার্থের অবস্থা দেখে! এতক্ষণ মাথায় আসেইনি যে ওদিকে জুলিয়াকে সাবজেক্ট এর কাছে রেখে চলে এসেছে।
‘তুমিও যাও না, শুধু জুলিয়াকে দিয়ে কি সব হবে?’ বিছানার থেকে পা দুটো নামিয়ে বুক, হাত আর মাথা থেকে সেন্সর গুলি খুলতে খুলতে যতটা সম্ভব হাল্কা মুডে বলেন প্রফেসর। আসলে একটা কাজ এখন করতে হবে যার সাক্ষী রাখতে চান না তিনি।
‘আমি গেলে তোমাকে কে দেখবে শুনি?’ মিষ্টি হাসির জলতরঙ্গ ভেসে বেরোয় সোমার শিশুসুলভ মুখ থেকে। খুনসুটি করে প্রফেসরের কলার ঠিক করতে করতে জবাব দেয় সোমা। জুনিয়র নার্স ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে ঘর ছেড়ে।
‘শেষ অবস্থা কিরকম দেখেছিলে সাবজেক্টের? সব ওকে ছিল?’ মুখে হাল্কা হাসি এনে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করেন প্রফেসর।
‘আরে সেটাই তো তোমায় বলার জন্য ডাকতে গেছিলাম,’ ঘনিষ্ঠ হয়ে এন্টিসেপটিক লোশন দিয়ে কপালের ক্ষতটা পরিষ্কার করতে করতে জবাব দেয় সোমা।
‘কি ব্যাপার?’
‘কিছু একটা ভুল হয়ে যাচ্ছিল জান, অটোমেটেড প্রোগ্রাম দিয়ে মেমোরি পুশ করার সময় ডিলিট তো কিছু করা হয় না। আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছি লগ কম্পিউটারে ডিলিটেড ডিলিটেড মেসেজ আসছিল। ওই প্রোগ্রামের ডিস্কটা তো তুমিই নিজের হাতে–‘
‘উঃ’ চকিতে মুখ সরিয়ে নেন প্রফেসর। যতটা না অ্যান্টিসেপ্টিকের জ্বালায় তার থেকে বেশি বিরক্তিতে।
‘জ্বালা করছে, না?’ আরও বেশি মমতায় প্রফেসরের মাথাটা কাছে টেনে নিতে চায় সোমা। একটু বিরক্তির বশে সামান্য ঝটকায় সোমার হাত সরিয়ে দেন প্রফেসর।
একটু শুধু ভুল হয়ে গেছে তাঁর। এতদিন অবধি সব কাজ প্রায় নিজের হাতে করে সবরকম উদ্বেগজনক তথ্য প্রমাণ নিকেশ করেছেন তিনি। শুধু এই শেষ সময়ে এই একটিমাত্র সাক্ষী জুটে গেল। সাবজেক্ট এর মেমোরি থেকে কিছু জিনিস ইচ্ছাকৃত ভাবেই ডিলিট করতে চেয়েছিলেন তিনি যাতে খেলাটা আবার শূন্য থেকে শুরু করা যায়। সেই ১৮ শতকের শেষ ভাগের মতো। সব কিছু যা জানার জানবে সাবজেক্ট-এ শুধু জানবে না মরিয়ার্টি কে, মরিয়ার্টি সম্বন্ধীয় তথ্যগুলি সাবজেক্টের মাথা থেকে ডিলিট হয়ে যাবে মেমোরি পুশ করার শেষ ধাপে একটি বিশেষ অটোমেটেড প্রোগ্রামের মাধ্যমে। সবটা জানবেন শুধু তিনি নিজে, সাবজেক্ট-এ তাঁর ব্যাপারে জানা শুরু করবে একদম গোড়া থেকে। মেমোরি রিপ্লেসমেন্ট করার সময় মেমোরি ডিলিট করাটা বেশ রিস্কি। নেগেটিভ পালস দিয়ে ব্রেন সেল থেকে কিছু ডিলিট করার সঙ্গে সঙ্গে সেই সেলের কর্মক্ষমতা সাধারণের তুলনায় বেশ কিছুটা কমে যায় বেশ কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু অটোমেটেড প্রসেসে মেমোরি পুশের মানেই হল কম সময়ে অতিরিক্ত তথ্য ব্রেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। সেক্ষেত্রে মেমারি পুশ করার সময় ডিলিট করলে একটা চান্স থাকে যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সেলের মধ্যে মেমারির পজেটিভ পালস চলে যাওয়ার। এর ফলে সেই সেলের ড্যামেজ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তবু এই ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন তিনি। ভয় ছিল রিপ্লেসমেন্টের সময় কিছু করলে যদি সাবজেক্টের জীবন মরণ সমস্যা দেখা দেয়, তাই সেকেন্ড ফেজে লোকাল মেমরি পুশ করার সময় প্রোগ্রাম দিয়েই কিছু ইনবিল্ট মেমরি ডিলিটের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন প্রফেসর। নিজের হাতেই মানে সিদ্ধার্থের হাত দিয়েই সব সেট করে রেখেছিলেন, শুধুমাত্র সময়ের একটু ভুল হয়ে যাওয়াতে এই মেয়েটা জেনে ফেলল ডিলিট করার কথা।
একটা সময় তো শুরু করতেই হবে মানুষের জীবন নিয়ে নিজের হাতে ছিনি মিনি খেলা। তাই বলে আজ থেকেই? বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে ওঠে প্রফেসরের। এক পলকের জন্য তাকাতে গিয়েও চোখটা আটকে যায় সোমার মুখে। এই মিষ্টি মেয়েটাকে হত্যা করেই নিষ্ঠুর জীবনটার সূচনা করতে হবে। হা ঈশ্বর, কি পরিহাস তোমার। কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রফেসরের মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের বস্তা পচা ইমশানের কথা। যে মমতা নিয়ে মেয়েটি তাঁর সেবা করছিল তা-তো মিথ্যে নয়। নিষ্পাপ মেয়েটা তো জানেও না ডক্টর সিদ্ধার্থ মুখার্জির আর কোনও অস্তিত্ব নেই। নাঃ ধুর, কিসব ভাবছেন তিনি। ইমোশন নিয়ে পড়ে থাকলে তাঁর দ্বারা এই পুনর্জন্ম লাভ যে সম্ভবই হত না। সাক্ষীর শেষ রাখতে নেই। আর ধরা পড়ার তো কোনও ভয়ই নেই তাঁর। কাজ ঠিকমতো শেষ হলে সিদ্ধার্থের শরীরটা যে অবস্থায় থাকবে তাতে তার থেকে আর কিছুই আদায় করা যাবে না, বরং মেয়েটাকে বাঁচতে দিলে ও ফাঁস করে দিতে পারে যে সিদ্ধার্থই মেমোরি ডিলিট করিয়েছে। এতদিন রয়েছেন তিনি শরীরটার মধ্যে এই শেষ সময়ে তিনি হারিয়ে যাবার পর কেউ যদি সিদ্ধার্থের ছিবড়ে শরীরটাকেও দোষ দেয় তা কিকরে মেনে নেন প্রফেসর। ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে তাঁর মুখে। না করলেও হয়তো চলবে খুনটা, কিন্তু হাতেরও তো একটা মকশো দরকার নাকি? রক্তের দাগ যখন লাগাতে হবেই হাতে একদিন তখন তা আজই হোক। শুভষ্য শিঘ্রম।
‘না:, লাগছে না,’ মুচকি হেসে বিছানায় বসে থেকেই হাত প্রসারিত করে সোমাকে কাছে টেনে নেন প্রফেসর। একটু আগের উদ্বেগ হারিয়ে গিয়ে মুহূর্তে সরল লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে মেয়েটির গাল। দু-হাত দিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ করে নেন প্রফেসর সোমাকে। মেয়েটির উত্তেজিত গরম নিঃশ্বাস এসে লাগে প্রফেসরের মুখে। টানা টানা চোখ দুটো ঈষৎ বুজে কম্পিত রক্তাভ ঠোঁট এগিয়ে আসে প্রফেসরের মুখের কাছে। একটু মাথা উঁচু করে প্রফেসর একবার দেখে নেন রুমের সামনেটা। সাবজেক্ট বি বেরিয়ে যাওয়ার পর রুমের সার্ভালান্স ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নিথর শরীরটা নিয়ে যখন সোমা, সিকুরিটি গার্ড আর সেই নার্সটা এই রুমে আসছিল তখন সবাই তাঁকে নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে ক্যামেরা অন করার কথা কারোর মাথায় আসেনি। ঘাড় বেঁকিয়ে নিচু হয়ে রয়েছে দরজার উপর বসানো সার্ভালান্স ক্যামেরা দুটো। আলতো ভাবে একটা হাত সোমার পিঠে আরেকটা হাত ঘাড়ের কাছে নেমে আসে। মেয়েটির কপালের উপর লুটিয়ে থাকা চুলগুলো এখন প্রফেসরের নাকে মুখে লাগছে। সময় উপস্থিত। কেমব্রিজের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হবার সুবাদে ঘাড়ের কাছের দুর্বল অংশটা খুব চেনা প্রফেসরের। সোমার উষ্ণ ঠোঁট মমতার পরশ বুলিয়ে চলেছে প্রফেসরের কপালে, চোখের উপর ঠোঁটের কাছে। নিজের মাথাটা একটু বামদিকে সরিয়ে আনেন প্রফেসর। ঠোঁট এখন পরশ বুলাচ্ছে তাঁর ডান গালে , বাম কাঁধ দিয়ে সোমার গ্রীবায় সাপোর্ট দিয়ে ডান হাত অল্প উদ্যত করে সজোরে আঘাত হানেন প্রফেসর ওর ঘাড়ে। খুট করে স্বল্প শব্দে সঙ্গে সঙ্গে ডিসলোকেট হয়ে যায় সুষুম্না কাণ্ডের গোড়ার হাড়। একটু ছটফটিয়ে মুহূর্তে এলিয়ে পরে মেয়েটির শরীর।
এক ঝটকায় খাট থেকে নেমে পড়েন প্রফেসর। আর দেরি করা যাবে না। মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে রয়েছে মেয়েটির নিথর শরীর। নাক-মুখ দিয়ে কিছুটা রক্ত এসে ভিজিয়ে দিয়েছে রুমের মেঝে। ঘাড় ভেঙ্গে গেলে এটা স্বাভাবিক হওয়া। একবার মাত্র মুখ দিয়ে অনুকম্পা সূচক চুক চুক শব্দ করেই প্রফেসর দৌড়ে যান বেডের মাথার কাছে কম্পিউটারের দিকে। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ কাজটি সেরে ফেলতে হবে। সিদ্ধার্থের শরীরের প্রয়োজন ফুরিয়েছে এবার, এই শরীর ব্যবহার করেই তাঁকে হারিয়ে যেতে হবে অন্তর্জালের দুনিয়ায়। শেষ প্রায় দুই বছর ধরে তিনি তৈরি করেছেন নিজের ব্রেনের প্রতিলিপি স্বরূপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামটিকে। এবার সেই প্রোগ্রাম আর নিজের মেমোরির ডিজিটাইজড ভার্সনের দৌলতেই তিনি অমর হয়ে বিরাজ করবেন পৃথিবীর লক্ষ কোটি কম্পিউটার সার্ভারের মধ্যে এক বিশেষ ঠিকানায়। পিছনে পরে থাকবে শুধু ডক্টর সিদ্ধার্থ মুখার্জির শরীরটা, না প্রাণহীন নয়। প্রাণ থাকবে, কিন্তু মস্তিষ্কে স্মৃতি বলে আর কিছু থাকবে না। একটি সদ্যজাত শিশুর অনুভূতি টুকু নিয়ে পৃথিবীতে ফেলে রাখবেন প্রফেসর তাঁর হোস্টকে। অন্তর্জালের অসীমের আড়াল থেকে মেঘনাদের ন্যায় নতুন করে খেলাটা শুরু করতে চান তিনি সাবজেক্ট এ-র সঙ্গে। অনেক, অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, হিসেবের অঙ্কটা মিলানোর তাগিদে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান এখন, পটভূমিটি তিনি ইতিমধ্যেই বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন নতুন এই শহরে আসল খেলা শুরু করার আগে এবার তাকে নতুন রূপে আত্মগোপন করতেই হবে অন্তর্জালের আড়ালে।
(১১)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর সাড়ে ছটা
‘গুড মর্নিং ডক্টর বোস।’
রিসার্চ ল্যাবের গেট দিয়ে ঢুকে সিকুরিটি ক্লিয়ারেন্স টপকে এলিভেটরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডক্টর বোস। উদ্বেগে এতটাই অন্যমনস্ক যে পাশেই সাবজেক্ট বি দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেটা খেয়ালই করেননি।
‘আপনি কি কিছুতে চিন্তিত ডক্টর?’ সাবজেক্ট বি এগিয়ে আসেন ডক্টর বোসের দিকে।
‘হ্যাঁ ? ও, ডক্টর ওয়াটসন, আপনি।’ সামনে সুস্থ সবল সাবজেক্ট বি কে দেখে আত্মতুষ্টিতে একটু উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন ডক্টর। ‘প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ ওই আর কি, সকালের আকাশটা যেরকমই হোক না কেন এখনও দেখলে মন ভোরে যায়।’ মুখে হাসি এনে উত্তর দেন ডক্টর ওয়াটসন। ‘কিন্তু আপনাকে কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। ইজ এভরিথিং অলরাইট ডক্টর ?’
‘না, মানে ওই আর কি, সাবজেক্ট-এ কে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছে।’ কিছুতেই প্রফেসরের ফোনের কথা বলা যাবে না কাউকে। কিছুতেই না। উদ্বেগ সামাল দিতে প্রসঙ্গ পরিবর্তনে উদ্যোগী হন ডক্টর। ‘আপনার বাংলা ভাষার জ্ঞান যে বেড়েছে সেটা সম্বোধনেই বুঝেছি। কিন্তু এখনও একটা টান রয়ে গেছে দেখছি। আসলে হোস্ট বডিটা বিদেশি তো, মুখের মাসল মুভমেন্ট নিয়ে একটু অভ্যাস করতে হবে মনে হচ্ছে।’ কথার মাঝেই নিঃশব্দে এলিভেটর এসে দাঁড়ায়।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে অটোমেটেড ভয়েস মিষ্টি সম্বোধনে ডেস্টিনেশন জিজ্ঞেস করে।
‘আমি তো সোজা সাবজেক্ট এ র কাছে যাবো। এইট্থ ফ্লোর। আপনি, ডক্টর ওয়াটসন?’
‘হ্যাঁ ? ও আচ্ছা , আমিও এইট্থ।’ সাবজেক্ট এর কথা চিন্তা করে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন ডক্টর ওয়াটসন। কাল থেকেই আর তর সইছে না তাঁর। ‘সাবজেক্ট এ-র কথা কি বলছিলেন?’ প্রায় ১০০ বছরের অপেক্ষা। আবার যে কোনওদিন বন্ধুকে ফিরে পাবেন তা জীবদ্দশায় স্বপ্নেও ভাবেননি ডক্টর। আর সত্যিই তো। জীবদ্দশায় তিনি কতটুকুই বা টেকনোলজিক্যাল এডভান্সমেন্ট দেখে গেছেন। এই একশো বছরে আমূল বদলে গেছে দুনিয়াটা। নতুন দেহে পুনর্জন্ম লাভের পর যদি কম্পিউটারাইজড ভাবে তাঁর মস্তিষ্কে এ যুগের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না ভোরে দেওয়া হতো তাহলে হয়তো নতুন দুনিয়াটা বুঝতেই তাঁর বছর কয়েক লেগে যেত। ডক্টর সিদ্ধার্থের হাত ধরে নতুন জীবন পেয়েছেন তিনি, হলোই বা শরীর বা আলাদা, মনের মধ্যে তো সেই তিনি ই, মধ্যে শুধু ১০০ বছরের ফারাক। তবে মানতে হবে নতুন এই শরীর পছন্দের সময় খুঁটিনাটির উপর খুব নজর রাখা হয়েছে। চুলের রংটি যদিও কৃত্রিম এবং মুখেও কিছুটা সার্জারি করা হয়েছে তবে ডাক্তারের চোখ ছাড়া বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা সম্ভব নয়। প্রথম দিন জ্ঞান ফেরার সময়টা বেশ অদ্ভুত ছিল, হাজার হাজার স্মৃতির ভিড়ে প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন তিনি, কিন্তু শেষ অবধি কোনও সমস্যা হয়নি। দিব্বি মানসিক ধকল কাটিয়ে উঠেছেন। যবে থেকে স্বাভাবিক হয়েছেন তবে থেকেই মুহূর্ত গুনে চলেছেন আজকের জন্য। শেষমেশ সাবজেক্ট এর কোনও সমস্যা দেখা দেবে না তো? হে ভগবান তা যেন না হয়। এই পৃথিবীতে ওর মতো বন্ধু সঙ্গে না পেলে যে এ জন্ম ব্যর্থ।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই ওয়াটসনের নজর পরে ডক্টর বোসের দিকে। বৃদ্ধ ঋজু শরীরটা টান টান করে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন এলিভেটরের ক্রম বর্ধমান সংখ্যার দিকে। দুটো হাতই পকেটে ঢোকানো এবং সেই অবস্থাতেও বোঝা যাচ্ছে যে তিনি ক্রমাগত কব্জি নাড়িয়ে চলেছেন। একজন বালক ও বুঝতে পারবে যে কোনও কারণেই হোক না কেন ডক্টর প্রচণ্ড অস্থির রয়েছেন। ওদিকে এলিভেটরের নম্বর আটে এসে স্থির হয় মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে।
‘হ্যাভ এ গুড ডে ডক্টর বোস’ যন্ত্রের কাছে এখনও আপডেটেড নয় ডক্টর ওয়াটসনের তথ্য। তাই ডক্টর বোসকে সম্বোধিত করেই ক্ষান্ত হয়।
ফ্লোরে ঢুকতেই এগিয়ে আসে সিকুরিটি, ডক্টর বোসের হাতের ব্যান্ড থেকে এন্ট্রি লগ করে নিতে ব্রতী হয়।
‘সাবজেক্টের খবর কি?’
‘জুলিয়া ম্যাডাম আর আরেকজন জুনিয়র নার্স আছেন স্যার সাবজেক্টের কাছে, আপনি যান, দেখুন। তবে ঠিকঠাকই আছে মনে হয় সব।’
‘জলদি করো’ ডক্টরের আর তর সয় না ভিতরে যাওয়ার জন্য। অসহিষ্ণু ভাবে তাড়া লাগান সিকুরিটিকে। ‘ব্যান্ড আনলক করতে এতো সময় লাগালে চলে?’
‘এই তো , হয়ে গেছে স্যার। কিন্তু ?’
‘কিন্তু আবার কি ?’
‘মানে স্যার , আপনি ওকে। কিন্তু এঁর তো ক্লিয়ারেন্স নেই স্যার ভিতরে যাওয়ার।’ সিকুরিটি অঙ্গুলিনির্দেশ করে ডক্টর ওয়াটসনকে দেখায়।
‘তাহলে উনি বাইরে অপেক্ষা করবেন। কি ডক্টর, প্রবলেম নেই তো?’
‘না , ইটস ওকে। আই উইল ওয়েট হেয়ার অনলি।’ মনঃক্ষুণ্ণতা লুকিয়ে বলেন ওয়াটসন।
আর সময় নষ্ট করা যাবে না। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়েন ডক্টর বোস।
(১২)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর পৌনে সাতটা
পনেরো মিনিট আগে যে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়েছিলেন ডক্টর বোস সেই দরজা দিয়েই তার স্মিত হাস্যময় মুখের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
‘আপনি ভিতরে আসতে চান ডক্টর ওয়াটসন ?’
এতক্ষণ দরজার মুখেই বসার ডিভানে হাঁটুর উপর হাত রেখে বসে চাপা উত্তেজনায় হাঁটু নাচাচ্ছিলেন ডক্টর ওয়াটসন। হাজার দুশ্চিন্তা ভিড় করে আসছিলো তাঁর মাথায়। খুব ভালো করেই তিনি জানেন যে তাঁকে পুনর্জন্ম দেওয়া হয়েছে কেবলমাত্র একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। শার্লক হোমসকে যোগ্য সঙ্গী দেওয়ার জন্য। ডিজিটাল মেমোরি যত বেশি সাবজেক্টে ইনসার্ট করা হয় তত বেশি রিস্ক বেড়ে যায় ব্রেন ফেলিওয়ের। তাই শার্লকের মস্তিষ্কে শুধু যেটুকু তথ্য না দিলে নয় সেটুকুই কম্পিউটারাইজড ভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে বাকি তথ্য তাঁকে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তেছে স্বয়ং ডক্টর ওয়াটসনের। এলিভেটর থেকে ভিতরে প্রবেশ করা অবধি ডক্টর বোসের মধ্যে যে অস্থিরতা আর উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ লক্ষণ করেছেন তাতেই তাঁর দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে বহুগুণ। তিনি জানেন এই পঞ্চাশের দশকে সমগ্র পৃথিবী তাকিয়ে আছে এই এক্সপেরিমেন্টাল ব্রেন রিপ্লেসমেন্টের সফলতার দিকে। লন্ডনের মতো শহরেও এখন মানুষকে বাস করতে হয় যান্ত্রিক প্রকৃতির কৃত্রিম ছায়ার আচ্ছাদনে। উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে গঙ্গার মতো স্রোতস্বিনীর প্রভাবে কলকাতা শহর এখন মানুষের কাছে স্বর্গ স্বরূপ। যদিও এখানেও এখন যান্ত্রিক ভাবে বাতাস পরিশোধিত করতে হচ্ছে আর দিনের তাপ প্রবাহকে রুখতে কৃত্রিম আকাশের তলায় থাকতে হচ্ছে মানুষকে তবু সূর্যোদয়ের সময়টুকু তো তবু একটু প্রকৃত আকাশের দেখা মিলছে। যেটুকু প্রাকৃতিক উপাদান এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তা নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লড়াইয়ের এই চরম সীমায় এসে মানুষের এখন সবথেকে বেশি যেটা দরকার তা হল শৃঙ্খলা। প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীর বড় শক্তিধর দেশ গুলির এখন দুশ্চিন্তা কখন বাঁচার তাগিদে অন্য দেশের মানুষ তাঁদের পানযোগ্য জল আর শ্বসনযোগ্য হওয়ার ভাণ্ডারে হাত বসায়। প্রতি পদক্ষেপে হিসেবে করে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার না করলে আগামী এক শতাব্দীতেই না ধরিত্রী মাতা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে লালনে অপারগ হয়ে যায়।
এমত পরিস্থিতিতে কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে যা শুরু হয়েছে বিগত মাস-খানেক ধরে তাতে কপাল কুঁচকেছে সব রাষ্ট্রনায়ক দেরই। আজ যা কলকাতায় হচ্ছে কাল তা পৃথিবীর যে কোনও বড় শহরে হতে পারে। প্রথম প্রথম অন্যান্য অনেক ব্যাপারের মতো এই ব্যাপারেও বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই তো সবে মাসতিনেক আগের ঘটনা। কলকাতার এক নামি হসপিটালে সকাল সকাল এক পেশেন্টকে নিয়ে আসা হল। পেশেন্ট কলকাতা উনিভার্সিটিতে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের কেউকেটা একজন। তার আগের দিনও নাকি তিনি বক্তিতা দিয়েছেন কোনও এক সেমিস্টারে। সেখান থেকে ফেরার পথে ঘণ্টাদশেকের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি। ড্রাইভারটিও বেপাত্তা। পুলিশ যখন তাঁকে উদ্ধার করে বাড়ির লোকের কাছে সমর্পণ করে তখন তিনি কথা বলার অবস্থাতে ছিলেন না। কিন্তু আসল সমস্যা বোঝা যায় তারও কিছুক্ষণ পরে। খিদে পেলে কান্না, আর ব্যথা পেলে কান্নার অনুভূতিটুকু বাদ দিয়ে তাঁর আর কোনও বোধজ্ঞান নেই। কাগজে লেখালিখি হয়েছিল একটু কিন্তু বিষয়টিকে কেউ হঠাৎ আঘাতে মেমোরি লস ব্যতীত অন্য কিছু ভেবে গুরুত্ব দিতে চায়নি। সেই গুরুত্বটাই দিতে হল যখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে শহরের সব ক-টি হসপিটাল ও নার্সিংহোমে এই একই সিম্পটম নিয়ে রোগীর সংখ্যা এক মাসের মধ্যে কুড়ি টপকাল। পরের মাস নাগাদ রোগীর সংখ্যা যখন মহামারীর মতো হাজার পেরিয়ে গেল, তখন তড়িঘড়ি পৃথিবীর সব রাষ্ট্র মিলে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়। কোনওরকম কোনও আঘাত, পূর্বাভাস ব্যতীত রাতারাতি একটা পূর্ণ বয়স্ক মানুষ কিভাবে সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে একটা বাচ্চায় রূপান্তরিত হতে পারে তা কলকাতার পুলিশ গোয়েন্দার তো দূরে থাক তাবড় তাবড় ডক্টরেরও বোধগম্য হচ্ছিল না। প্রথম প্রথম কয়েকটা কেস তাও সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষদের মধ্যে কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ মহামারী সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। মাস দুয়েকের মধ্যেই এই শহরের জনগণের মধ্যে সরকারের অপারগতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে এবং সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই বন্ধ অবরোধ শুরু হয়ে যায়। আমজনতার ক্রোধ বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ। চিকিৎসা বিদ্যা দিয়ে এই মহামারীর কোনও প্রতিকার না করতে পেরে সরকার ব্রতী হয় এক অনবদ্য প্রচেষ্টায়। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত সরকার হাত দেয় ‘পুনর্জন্ম’ প্রজেক্টে যার অন্যতম সাবজেক্ট হলেন ডক্টর ওয়াটসন নিজে এবং সব থেকে গুরুত্ব পূর্ণ ডক্টরের আদি অকৃত্রিম সঙ্গী শার্লক হোমস। এই প্রজেক্টের সফলতার দিকে আপাতত তাকিয়ে গোটা দেশ তথা পৃথিবী, অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দার মগজাস্ত্রই লাগবে এই রোগের মূল অন্বেষণে। আজ ৬ জানুয়ারি। হোমসের জন্মদিনেই তাঁর পুনর্জন্মের দিন ঠিক হয়ে রয়েছে।
ডক্টর বোসের গলায় চমকে উঠলেন ডক্টর ওয়াটসন।
‘কি হল ডক্টর, কি ভাবছেন এতো, ভিতরে আসুন ’।
‘কিন্তু, আমার ক্লিয়ারেন্স?’
‘আরে রাখুন আপনার ক্লিয়ারেন্স। সিকুরিটি, সিকুরিটি?’ বাচ্চা ছেলের মতো আনন্দে যেন টগবগ করছেন ডক্টর বোস। তাঁর এই অবস্থা দেখে ওয়াটসনের মনের দুশ্চিন্তার মেঘও যেন কেটে যায় একটু। অধৈর্য আহ্বানে এগিয়ে আসে সিকুরিটি।
‘বলুন স্যার।’
‘ডক্টর ওয়াটসনের এন্ট্রি আমার নামের পাশে লগ করে দাও। যা কিছু হবে তা ব্যক্তিগত ভাবে আমার দায়বদ্ধতাতেই ঘটবে। আপনি আসুন ডক্টর ওয়াটসন’।
(১২)
৬ জানুয়ারি ২০৫৪, ভোর পৌনে সাতটা
‘শার্লক হোমস????’
আবেগে গলার স্বর আটকে যায় ডক্টর ওয়াটসনের। এও তবে সম্ভব হল? সেই এক বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, উন্নত নাসিকা, প্রশস্ত ললাট। একদম যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা সেই চিরকালীন শার্লক হোমস। ওয়াটসনের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে চোখের জলে। সত্যি রূপকথা বাস্তব হল আজ তবে। ঝাপসা চোখের পটভূমিকায় ভেসে থাকে শুধু সাদা পোশাক পরিহিত পা মুড়ে খাটের উপর বসে থাকা দীর্ঘদেহী এক যুবক। যার হাত দুটো জোর করা রয়েছে চিবুককে সাপোর্ট দিয়ে। শতাব্দী প্রাচীন ঘুম ভেঙ্গে উঠেও সে যেন গভীর চিন্তা মগ্ন।
‘আরে, আরে করছেন কী, করছেন কী’ হা-হা করে জুলিয়া আর জুনিয়র নার্স দৌড়ে আসে ওয়াটসনের দিকে। ডক্টর ততক্ষণে তারের জালিকা সমেত দীর্ঘদেহী হোমসের শরীর আলিঙ্গন করে ফেলেছেন সজোরে। দু-চোখের জল আর বাঁধ না মেনে ভাসিয়ে দিচ্ছে তাঁর গাল ও হোমসের কাঁধ।
‘থাক, বাঁধা দিয়ো না। ভয় নেই ’। ডক্টর বোসের গলার স্বরেও কান্নার আভাস। এক শতাব্দী প্রাচীন এই বন্ধুত্বের আবেগ-ঘন বহিঃপ্রকাশ মুহূর্তটিকে তিনি কোনওরকম বাধা প্রদান করতে চান না।
‘হোমস, হোমস। চোখ মেলে তাকাও, দেখো আমি ওয়াটসন। সেই তোমার ওয়াটসন। দেখো হোমস দেখ।’
ইতিমধ্যে কখন যে হোমসের হাত দুটোও ওয়াটসনকে আলিঙ্গন করেছে তা ডক্টর ওয়াটসন নিজেও টের পাননি আনন্দের আতিশয্যে। এবার টের পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান ডক্টর ওয়াটসন। হাসি মুখে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতেই হোমসও চোখ মেলে তাকায় বন্ধুর দিকে। জুলিয়া আর অন্য জন নার্সেরও চোখের কোনায় জলের আভাষ। যদিও এই পরীক্ষার খুব গভীরের কথা ওদের অজানা কিন্তু মিলনান্তক দৃশ্যের অনুভূতিটুকুই খুশির অশ্রুর জন্য যথেষ্ট তাঁদের কাছে।
পিঁপ পিঁপ পিঁপ পিঁপ
মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে চশমা খুলে চোখের জল মুছতে গেছিলেন ডক্টর বোস, চমকে উঠলেন মৃদু অ্যালার্মের শব্দে। অ্যালার্ম দিচ্ছে লগ কম্পিউটার থেকে। কি হল ব্যাপারটা? হোমসের মাথা আর শরীর থেকে ইতিমধ্যেই সব সেন্সর খুলতে আরম্ভ করে দিয়েছিল জুলিয়া। তাঁকে অ্যাসিস্ট করছিলো সঙ্গের ওই জুনিয়র নার্স। কিন্তু সেন্সর যদি বন্ধই থাকবে তবে অ্যালার্ম কিসের? এক লাফে প্রায় ডক্টর ওয়াটসনকে ধাক্কা মেরে লগ কম্পিউটারের কাছে পৌঁছে গেলেন ডক্টর।
না, লগ কম্পিউটারের অর্ধেক স্ক্রিন বরাদ্দ সাবজেক্ট এর জন্য, সেখানে এখন শুধু হার্ট রেট আর ব্রেন পালস রেকর্ড হয়ে চলেছে সবুজ রেখায়। কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বাকি অর্ধেক? তিনি নিজে সাবজেক্ট এ-কে কখনও নজর ছাড়া করতে চাননি বলে এই লগ কম্পিউটারেই একটা সেকশন রাখা ছিল যা দিয়ে তিনি সাবজেক্ট বি-র ভাইটাল স্ট্যাটাস সব পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। যেহেতু সাবজেক্ট বি-র সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিল সিদ্ধার্থ তাই একরকম নিশ্চিন্ত থেকেই কম্পিউটারের এই সেকশনটা এতদিন দেখেও না দেখার মতো করে ফেলে রেখে দিয়েছিলেন ডক্টর। কিন্তু আজ সেই সেকশনেই অ্যালার্ম বাজছে। কেন কেন কেন? উদ্ভ্রান্তের মতো একবার পিছনে তাকালেন ডক্টর বোস। সাবজেক্ট বি অর্থাৎ ডক্টর ওয়াটসন আর শার্লক হোমস দুজনেই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নার্স দুজনও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়। ক্ষিপ্র হস্তে কিছু বোতামে চাপ দিতেই সম্পূর্ণ লগ ভেসে ওঠে কম্পিউটারের পর্দায়। একি? লগ বলছে কোনরকম সেফটির তোয়াক্কা না করেই সাবজেক্ট বি-র মাথা ও শরীর থেকে ভাইটাল সেন্সর খুলে ফেলা হয়েছে এই কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু, কিন্তু তা কি করে সম্ভব, ডক্টর বোস নিজেই তো ডক্টর ওয়াটসনের সঙ্গে রয়েছেন বিগত প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে। না: এখানেই লগ শেষ নয়। অ-সহিষ্ণু ভঙ্গিতে পাগলের মতো লগ স্ক্রল করতে থাকেন ডক্টর। অনেক অনেক ডেটা ইন্টারনেটে আপলোড হয়েছে। প্রায় শতাধিক টেরাবাইট ডেটা আপলোড হয়ে গেছে ইন্টারনেটের মাধ্যম দিয়ে কোনও অজানা সার্ভারে। কিন্তু কি ডেটা? রুমের ঠান্ডার মধ্যেও ডক্টর বোসের কানের পাশ দিয়ে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে পড়ে। লগ কম্পিউটারের ডেটা এনালাইজ রিপোর্ট বলছে এ হল মেমোরির ডিজিটাইজড রূপ। সর্বনাশ। হিউম্যান মেমোরির এই ডিজিটাইজড রূপ দিতে পারে এরকম একজনই এখন বর্তমান হিউম্যান রিসার্চ ল্যাবে। তবে কি সিদ্ধার্থ কিছু করছে।
‘সিকুরিটিইই’, চিৎকার করতে গিয়ে থমকে যান ডক্টর বোস। ঘরের আলোয় লাল আভা। এবার যে অ্যালার্ম বাজছে সেটা হচ্ছে সমগ্র ফেসিলিটিতে। কি হচ্ছে আজকে এসব। ডক্টর ওয়াটসন এবার এগিয়ে আসেন লগ কম্পিউটারের কাছে।
‘ডেটা অ্যানালাইসিস রিপোর্টে কিছু কমন ওয়ার্ড দেখাচ্ছে ডক্টর বোস। আর, আর শুধু ডিজিটাইজড মেমোরি নয় কিছু একটা প্রোগ্রাম লোড হয়ে গেছে থ্রু ইন্টারনেট। আর ইউ লিসনিং বোস? অ্যানালিসিস বলছে সেল্ফ ইন্টেলিজেন্ট কিছু প্রোগ্রাম।’
মাথা কাজ করছে না ডক্টর বোসের। ঘরের মধ্যে সতর্কতা সূচক অ্যালার্ম তারস্বরে বেজে চলেছে। এত কিছুর মধ্যেও শার্লক কিন্তু নির্বাক, নিশ্চল। চোখ খোলা রেখে ধ্যানে মগ্ন।
‘একটা নাম, একটা নাম রয়েছে মেমোরি ডেটায়, সেটাই আসছে বার বার ঘুরে ফিরে। প্রফেসর ম—‘
‘স্যার স্যার’ শব্দ করে প্রচণ্ড ধাক্কায় খুলে গেল রুমের দরজা। সাবজেক্ট বি-র রুমের সিকুরিটি। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে এবার।
‘স্যার, সোমা, সোমা ম্যাডাম–’
‘কি, কি হয়েছে সোমার?’ ডক্টর বোস দৌড়ে এগিয়ে যান সিকিউরিটির দিকে।
‘সাবজেক্ট বি-র ঘরে, ম্যাডাম পড়ে রয়েছেন, নাক -খ দিয়ে অনেক ব্লিডিং হয়েছে স্যার, মেঝে ভিজে গেছে পুরো, ডাকলেও সাড়া দিচ্ছেন না।’
হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে ডক্টর বোসের, পড়ে যাবেন যে কোনও মুহূর্তে। এই কি তবে প্রফেসরের সেই সতর্ক বার্তা। মাথা ঘুরে ওঠে ডক্টর বোসের। সশব্দে পড়ে যান মাটিতে। নার্স দুজন দৌড়ে যায় তাঁর কাছে।
‘কি নাম বলছিলে ?’ ঘরের অ্যালার্মের শব্দ ছাপিয়ে এবার একটি নতুন কণ্ঠ শোনা যায়। এক মুহূর্তের জন্য সবার দৃষ্টি ঘুরে যায় হোমসের দিকে। কথা বলছে , কথা বলেছে শার্লক হোমস। মুখ ওয়াটসনের দিকে।
‘মরিয়ার্টি, প্র-প্রফেসর মরিয়ার্টি , হি ইজ ব্যাক’ কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে যায় ডক্টর ওয়াটসনের। ঠান্ডা মাথার মানুষটিরও কপাল বেয়ে নেমে আসে উত্তেজনার ঘাম। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটা ইতিমধ্যেই অবগত হয়েছেন তিনি। মরিয়ার্টি ফিরে এসেছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধরে, আপাতত সারা বিশ্বব্যাপী অন্তর্জালের দুনিয়াতে কোনও অজ্ঞাত সার্ভার তাঁর ঠিকানা।
‘কে?’ চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে আসে হোমসের।
‘প্রফেসর মরিয়ার্টি হোমস? তোমার মনে পড়ছে না সেই রেইনবারক ফলস?’
অবাক দৃষ্টি মেলে ওয়াটসনের দিকে তাকিয়ে থাকেন শার্লক হোমস। সত্যই তাঁর কিচ্ছু মনে পড়ছে না। এত কিছু রয়েছে তাঁর মস্তিষ্কে এখন, নতুন পৃথিবী, নতুন যুগ, নতুন দেশ, নতুন শহর, এমনকি নতুন ভাষা অবধি, শুধু ওই, ওই ‘প্রফেসর মরিয়ার্টি’ নামটি শুধু প্রথমবার শুনছেন হোমস।
‘ওয়া য়া য়া য়া’ পূর্ণবয়স্কের গলায় বাচ্চার মতো কাঁদুনি শুনে চমকে ওঠে ঘরের সবাই। দরজা। দরজার সামনে মাটিতে বুক ঘষে ঘষে এগিয়ে আসছে একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষ। উপরের তলা থেকে সিকুরিটির সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এসেছে বোধহয়। এতজনকে একসঙ্গে দেখে আবার কেঁদে ওঠে সে। চিৎ হয়ে শুয়ে পেটের উপর হাত বোলাতে থাকে। খিদে পেয়েছে। ক্ষিদের ব্যাথায় আবার কঁকিয়ে ওঠে সিদ্ধার্থের শরীরটা ‘ওয়া য়া য়া য়া’। মাথাটা তো ফাঁকা হয়ে গেছে তাঁর তবু ক্ষিদের জ্বালাটা ছেড়ে যায়নি।
লেখক: প্রত্যাবর্তন গল্পের শেষ টানছি এখানেই, তবে ইন্টারনেটের অসীম সমুদ্রে হারিয়ে যেতেই যে শুধু ফিরে আসেননি প্রফেসর মরিয়ার্টি তা তো বলাই বাহুল্য। এতো মানুষের ব্রেন থেকে সমস্ত স্মৃতি অপহরণ করে নিয়ে, পূর্ণবয়স্ক মানব শরীরে শিশুর বুদ্ধি করে দিয়ে কি খেলা খেলতে চাইছেন তিনি? নাকি এ সবে খেলার শুরু? তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এখন রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন। তবে প্রথম চালেই কিন্তু একধাপ এগিয়ে গেছেন প্রফেসর নিজে, মানব শরীরে তাঁর বুদ্ধিমত্তার এখন আবদ্ধ নয়, পৃথিবীব্যাপী ইন্টারনেটের সুবিশাল জালিকায় কালো ছায়ার মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রূপে এখন তাঁর অবাধ বিচরণ, অপরদিকে হোমস সব কিছু জেনে সব কিছু বুঝেও কেবল তুচ্ছ মানুষ মাত্র, আর হুঁ, সে তো এখন মনেও করতে পারছে না প্রফেসর মরিয়ার্টি কে ছিলেন? অতএব দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি সংঘর্ষ কি বাঁধছে খুব শীঘ্রই? এবার কি তবে শুধু মগজাস্ত্র সম্বল করেই হোমসকে লড়তে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে?
Tags: ইন্টারনেট, উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সহস্রাংশু গুহ
Dada
Moriarti ki jite galo? Sorolakkho babu kichu korte parlenna?
Odvoot kolpona sokti ar opurbo lekhan vongi.
Apnar Sonar doat kolom hok. Thuri. Sonar laptop hok.
এরপর কি হয়েছিল। আমি জানতে চাই। প্লিজ সুযোগ টা করে দিন
ব্যক্তিগত মত, কিন্তু এই কাহিনী যে একটা সিকয়েলের জোরালো দাবি রাখে।
Pore ki hoyachilo. Jante chai.