ফাঁদ
লেখক: পৃথ্বীশ গজী
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
চারিদিক অন্ধকার। কিন্তু তার মধ্যেই তিনি দেখতে পেলেন এক নারীর অবয়ব। শুয়ে আছে চুপ করে।
দেখে মনে হয় সে মারা গেছে অনেকক্ষণ আগেই।
কিন্তু তাঁকে দেখে ছটফট করে উঠল সেই নারী। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল চারপাশের দৃশ্যপট। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন তাঁর প্রিয় রিভলভিং চেয়ারের উপরে।
বিচ্ছিরি স্বপ্নটা মাঝেমাঝেই তাড়া করে তাঁকে। বিশেষ করে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লে। নিজের শিরদাঁড়াটাকে টান করলেন তিনি। চেয়ারটা ঘরের এক কোণে রাখা। চেয়ারের সামনেই রয়েছে একটা টেবিল। একটা ল্যাপটপ রাখা আছে টেবিলে।
টেবিলটা থেকে একটু দূরে ঘরের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি ভাবে বসানো আছে একটা পরদা।
পরদাটা খালি চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। দেখলে গেলে বিশেষ লেন্স পরতে হয় চোখে। খালি চোখে এপাশ থেকে পর্দার ওপাশে কী আছে তা স্পষ্ট দেখা গেলেও ওপাশে গেলে…
হঠাৎ তাঁর মাথায় কিছু একটা খেলে গেল বিদ্যুৎ চমকানোর মতই। সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটে।
এতদিন এই ঘরে বসে কাজ করলেও কথাটা তো মনে আসেনি কখনও!
বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।
তারপর ডুব দিলেন ল্যাপটপে…
১
খালি হয়ে যাওয়া রামের বোতলটা রাখা আছে টেবিলে। গ্লাসটা তার পাশে। অর্ধেক খালি হয়ে যাওয়া থামস আপের বোতল আর চিপসের প্যাকেট দুটো পড়ে আছে গ্লাস থেকে খানিক দূরে টেবিলের একটা কোণে।
প্রতিদিনের মত আজকের সন্ধ্যেটাও এই সবকিছু নিয়ে কাটালেও কোথাও যেন তাল কেটে যাচ্ছিল কমলেন্দুর।
নেশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের আকাশে জড়ো হচ্ছিল টুকরো টুকরো মেঘ।
আজ থেকে ঠিক সাতাশ বছর আগে এই দিন সন্ধেবেলাতেই তো উত্তরপাড়া স্টেশনে একটা চলন্ত সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল তার মা।
তখন সবকিছু মাথায় না ঢুকলেও এখন বোঝে কমলেন্দু। আসলে মা আর সহ্য করতে পারছিল না বাবাকে। আরও ভালো করে বললে নারীদেহ আর অর্থলোভী ওই পিশাচটাকে।
কিন্তু তার জন্যে এইভাবে…!
অথচ তার প্রতি ভালোবাসায় কোনও খামতি ছিল না মায়ের। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও মায়ের স্মৃতি বলতে রয়ে গেছে সেই ভালোবাসার ছোঁয়াটুকুই। এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও ছোটবেলায় কমলেন্দুর খুব হাঁপানির অসুখ ছিল। রোগটার পোশাকি নাম অ্যাস্থমা। প্রতি সপ্তাহে এক-দুবার করে হাঁপের টান উঠত তার। সেই সময়, বাবা তার দিকে খুব একটা ফিরে না তাকালেও, মা বুকে আগলে রাখত তাকে।
মা নিজে চাকরি করত। চাইলেই অনায়াসে পেতে পারত খোরপোষও।
মা কি ওকে নিয়ে কি আলাদা হয়ে যেতে পারত না বাবার থেকে?
মায়ের প্রতি অভিমানটা একটু বড় হওয়ার পর জমাট বাঁধলেও, কমলেন্দুর জীবনের সবথেকে বড় ক্ষতটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখনই। সেটা আরও গভীর হয়েছিল বাবা আবার বিয়ে করার পর।
মামার বাড়ির দিকে বিশেষ কেউ ছিল না বলেই কয়েকদিন হাজতবাসের পর বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছিল বাবা। তারপর সম্পত্তির লোভে বাবাকে বিয়ে করেছিল ওই মাগিটা। দুশ্চরিত্র বাবার সঙ্গে মায়ের রোজ অশান্তি লেগে থাকলেও, এই নিয়ে কখনও মুখ খোলেনি তার দু’নম্বর বউ। তার বদলে নিজের হতাশা সে মেটাত কমলেন্দুর উপর দিয়ে।
কখনও গায়ে হাত তুলে, কখনও বা মানসিকভাবে অত্যাচার করে।
মেয়ে জাতটার প্রতি অবিশ্বাস আর ঘেন্নাটা জন্মেছিল ওই মাগিটার জন্যেই। আর সেইজন্যেই বোধহয় বাবার মত নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে নিজের বিছানা ভাগ করে নেওয়াটাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে ভাবতে শুরু করেছিল কমলেন্দু। কলকাতায় থাকতে হাজারটা কলগার্লের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তার। কিন্তু এরপরেও একজন এসেছিল তার জীবনে যে কিছুদিনের জন্যে হলেও তাকে শিখিয়েছিল ভালোবাসার মানে।
তার নাম তৃণা। কিন্তু কপাল বটে কমলেন্দুর। সেই মেয়েটাও…
নাহ্, কেউ ভাবেনি তার কথা!
কিন্তু এতদিন পর এসব ভেবে রক্তাক্ত হওয়ার কোনও মানে হয় না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কমলেন্দু। জ্বলতে থাকা টিউবটাকে বন্ধ করে দিয়ে সে এগিয়ে গেল জানলার দিকে।
মিশমিশে কালো অন্ধকার ঢেকে রেখেছে বাইরের পৃথিবীকে। মেঘের জন্যে আকাশে খুব একটা তারা দেখা না গেলেও অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা আলোকবিন্দু। ঘড়ি না থাকলে রাত কটা বাজে তা এখানে বোঝা দায়। সূর্য ডুবলেই একটু একটু করে ঝিমোতে শুরু করে পাহাড়। অন্ধকার একটু গাঢ় হলেই সন্ধ্যে সাতটা আর রাত বারোটার মধ্যে তফাৎ থাকে না কোনও।
নেশা মাখানো চোখে একমনে কিছুক্ষণ সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকল কমলেন্দু। আস্তে আস্তে থিতু হয়ে এলো তার মন। এখন দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু দূরে ওই আলোকবিন্দুগুলোর পিছনে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। খুব ভালো ভিউ পাওয়া যায় বলেই পুজোর পর থেকে মে মাস অবধি একদিনও খালি যায় না ওদের হোটেলের কোনও রুম।
বাবার সময়ে তৈরি হলেও হোটেলটাকে নিজের সন্তানের মত আঁকড়ে রেখেছে কমলেন্দু। হোটেলটা নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্বও আছে তার। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মেরেকেটে সাত বছর। তখনও বাবার জিম্মাদারিতে অবহেলায় পড়ে ছিল হোটেলটা। কিন্তু হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করে বসে থাকা বেকার ছেলেকে তৃণার ঘটনার পর বাবা জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছিল এখানে। কিন্তু পেলিং-এ এসে মন বদলাতে শুরু করে জীবনের প্রতি হতাশ আর কর্মবিমুখ কমলেন্দুর। হয়তো এখানকার অসাধারণ প্রকৃতিই বদলে দিয়েছিল তাকে। সে আঁকড়ে ধরেছিল হোটেলটাকে। তারপর ধীরে ধীরে কমলেন্দু পালটে ফেলেছে হোটেলের খোলনলচে। শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ-এর জন্য নয়, খাবার আর রুমের জন্যেও তার হোটেল দখল করে নিয়েছে পেলিং-এ ঘুরতে আসা টুরিস্টদের এক নম্বর পছন্দের জায়গাটা।
খাবারের কথা মনে হতেই ফের অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল কমলেন্দু।
একটু হলেও খিদে পাচ্ছে তার!
বছরের বেশিরভাগ দিন কমলেন্দু নিজের রুমেই খাওয়াদাওয়া করে। রিসেপশনে ফোন করে চেয়ে নেয় তার খাবার। টুরিস্ট সিজনে এই রুটিনের নড়চড় হয়না কখনও। কিন্তু ভরা বর্ষায় এখন খালি পড়ে আছে হোটেলটা।
কমলেন্দু ভাবল নীচে ডাইনিং স্পেসে বসেই সারবে আজকের ডিনার।
কিচেনে ফোন করে খাবার রেডি করতে বলে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো কমলেন্দু। ওর রুম হোটেলের টপ ফ্লোরে, মানে চারতলায়। রুম থেকে বেরিয়েই লম্বা করিডোর। সেটা পেরিয়ে এসে কমলেন্দু পৌঁছল লিফটের সামনে।
লিফটটা যেন অপেক্ষাতেই ছিল হোটেল মালিকের। কমলেন্দুকে নিয়ে নেমে এলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
রিসেপশন বাদ দিলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বেশিরভাগটা জুড়েই ডাইনিং স্পেস। হোটেলের মতই ঝাঁ চকচকে আর আভিজাত্য মোড়া। দেওয়ালের অয়েল পেন্টিংগুলো যেন জীবন্ত বন্দী করে ফেলেছে টুকরো টুকরো হিমালয়কে। সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা বিশাল ঝাড়বাতিটার আলো পৌঁছে গেছে ঘরটার প্রতিটি কোণায়। সঙ্গে হালকা ভলিউমে চলছে কেনি জি।
জায়গাটা এমন যে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে এসে ঢুকলেও নিমেষে তা দূর হয়ে গিয়ে ভালো হয়ে যায় মন।
নিজের তৈরি সেই স্বপ্নরাজ্যে ঢুকে কমলেন্দু দেখল বাঁদিকের একটা টেবিলে বসে একমনে ডিনার করেছে এক সুন্দরী।
চোখমুখের গড়ন আর গায়ের রঙই বলে দেয় সে হিমালয়েরই ভূমিকন্যা।
কমলেন্দুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। তার দু’চোখে সম্ভ্রম। নরম গলায় কমলেন্দুকে অভিবাদন জানাল সে, “গুড ইভনিং স্যার।”
মেয়েছেলে জাতটাকে যতই ঘেন্না করুক না কেন, মেয়েটাকে দেখেই আরও একবার নিজের শরীরে শিরশিরানি অনুভব করল কমলেন্দু।
মেয়েটার নাম রঞ্জিতা। আজকেই জয়েন করেছে তাদের হোটেলে।
রিসেপশনিস্ট হিসাবে।
২
দরজা খুলতেই অ্যালকোহলের বিচ্ছিরি গন্ধটা ধাক্কা মারল তার নাকে। চমকে উঠে রঞ্জিতা দেখল দরজার ওপারে একলা দাঁড়িয়ে আছে কমলেন্দু।
লোকটা যে তার শরীরে মজে যেতে পারে তা প্রথম রাত্তিরেই আঁচ করেছিল রঞ্জিতা। সেদিন ডিনার করতে এসে অন্য একটা টেবিলে বসলেও কমলেন্দুর মন খাবারে নয়, ছিল রঞ্জিতার দিকে। লোভী দৃষ্টি যেন গিলে নিতে চাইছিল তার শরীরটাকে। রঞ্জিতার শরীরের পরতে পরতে যে আবেদন লুকিয়ে আছে তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা হয়তো কোনও পুরুষেরই নেই। তবু কমলেন্দুর চোখ দুটো দেখে গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল তার।
পুরুষ মানুষের এরকম লোভী দৃষ্টি এর আগে আর কখনও দেখেনি সে!
‘দ্য ডটার অফ হিমালয়া’র মালিক কমলেন্দু বোস এমনিতে খুব করিৎকর্মা মানুষ হলেও মেয়ে বলতে যে শুধু শরীর আর বিছানা ছাড়া যে আর কিছু বোঝে না তা সেদিনই খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিল রঞ্জিতা।
বসের সামনে বসে মাথা নিচু করে খেয়ে গেলেও একটা তোলপাড় শুরু হয়েছিল তার বুকের ভিতরে।
কিন্তু কোনও বিকল্প রাস্তাও তো খোলা ছিল না তার সামনে…
তবে আজ রাতে না হলেও গত শনিবার রাতে রঞ্জিতা প্রায় নিশ্চিন্ত ছিল যে লোকটা হানা দেবে তার রুমে। সে প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল আগেভাগে। ছুটি নিয়ে ওইদিন সকালেই নিজেদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছিল এই হোটেলের বাকি দুই দুই মহিলা কর্মী জেরুপা আর নীলিমা।
ওদের সঙ্গে একটা রুম শেয়ার করে রঞ্জিতা।
একলা ঘরে একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে রাত কাটালেও তার হিসাব মেলেনি।
কিন্তু তাই বলে আজকে…
কিছুতেই মেলাতে পারছিল না রঞ্জিতা। মিংমা, মানে কমলেন্দুর ফাইফরমাশ খাটে যে ছেলেটা তাকে এই পনেরো দিনে ভালোই হাত করেছে সে। মিংমাই তো বলেছিল আজ সন্ধেবেলায় তার হাত দিয়েই কমলেন্দুর রুমে পৌঁছে গেছে দু’দুটো বড় হুইস্কির বোতল।
আর মিংমার দৌলতে রঞ্জিতা জানে রোজের মদ রোজ হাতে না পেলে মাথা গরম হয়ে যায় কমলেন্দুর।
মনে মনে প্রমাদ গুনল রঞ্জিতা। তবুও তার সতর্ক চোখ এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে জরিপ করে নিলো কমলেন্দুকে।
লোকটা টলছে। লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটোও যেন ঝিমিয়ে পড়েছে কিছুটা। দেখলেই মনে হয় উলটে পড়ে যাবে এখুনি।
তার মানে নেশাটা ভয়ঙ্করভাবে চেপে ধরেছে কমলেন্দুকে। মিংমার কথা মিথ্যা নয়। মনে মনে আশ্বস্ত হল রঞ্জিতা। নেশার এই অবস্থায় পৌঁছে গেলে মানুষ যেমন স্বাভাবিক বোধগুলো হারিয়ে ফেলে, তেমনই শরীরটাও চলে যায় নিজের আয়ত্তের বাইরে।
এই অবস্থায় উলটে পড়ে যাওয়া ছাড়া খুব বেশি হলে বমি আর পেচ্ছাপ করে তার রুম নোংরা করতে পারে লোকটা।
ভয়টা কেটে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। তবে চরম পেশাদারের মত মনের ভিতরে চলতে থাকা টানাপড়েনকে সম্পূর্ণ আড়াল করে হাসি মুখে সে কমলেন্দুকে বলল, “আরে স্যার, আপনি! ভিতরে আসুন।”
রঞ্জিতার মুখে আগেও বাংলা শুনেছে কমলেন্দু। মেয়েটা যেমন স্মার্ট তেমনই সুন্দর তার বাচনভঙ্গি। বাংলা ভাষটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছে সে। এত নেশার মধ্যেও তার মনে পড়ে গেল মেয়েটার ইন্টার্ভিউয়ের কথা। সিভি অনুযায়ী এর আগেও মুম্বাইয়ের একটা হোটেলে কাজ করেছে রঞ্জিতা। সেখানেই এক বাঙালি কলিগের কাছ থেকে বাংলা শিখেছিল সে। আসলে পাহাড়ের মেয়ে রঞ্জিতা ফিরতে চাইছিল পাহাড়েই। আর বাংলা না জানলে এখানকার হোটেলগুলোতে যে চাকরি পাওয়া অসম্ভব তা আগেই জানা ছিল তার।
তবে এ’সব শুনে কমলেন্দু যে মেয়েটাকে চাকরিতে নিয়েছে তা নয়।
প্রথমদিনই রঞ্জিতার শরীরটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল সে।
একরাশ ঘন কালো চুল, গভীর চোখ, ফরসা নরম টুকটুকে গাল, পালকের মত ঠোঁট এসব তো আছেই, তার সঙ্গে উদ্ধত বুক বেয়ে পাহাড়ি ঢালের মত নেমে যাওয়া পেট আর সামান্য চওড়া কোমর যেন কোনও অপ্সরা বানিয়ে দিয়েছে তাকে।
একটা সিল্কের শাড়ি পরে ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছিল রঞ্জিতা। আঁচলের ফাঁক থেকে উকি মারছিল তার ফরসা আর মেদহীন পেট আর গভীর নাভি। মেয়েটাকে বিছানায় পাওয়ার জন্য তখনই তার ভিতরে জেগে উঠেছিল পাহাড়ে এসে হারিয়ে যাওয়া সেই পুরনো মানুষটা।
আর তার বদলে চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল রঞ্জিতা।
তবে রঞ্জিতার শরীরটাকে ভোগ করার জন্যে মুখিয়ে থাকলেও ওর ঘরে রাত্তিরবেলা একলা হানা দেওয়াটা খুব সহজ হয়নি মানুষ কমলেন্দুর পক্ষে।
পুরনো স্মৃতিগুলো বারবার তাড়া করছিল তাকে।
আসলে তৃণার ঘরেও তো ঠিক এইভাবে একলা হানা দিয়েছিল সে।
তবে সেই ঘরটা রিয়েল নয়, ছিল ভারচুয়াল।
ম্যাসেঞ্জারের ইনবক্স।
সেগুলোকে ভুলতেই তো গত কয়েকদিন ধরে এত মদ খাচ্ছে কমলেন্দু!
নেশাটা জমে গেছে বেশ। তবুও রঞ্জিতার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ফের আনমনা হয়ে পড়ল কমলেন্দু। ফেসবুকে পরিচয় হওয়া অসম্ভব সুন্দরী, কিন্তু তার থেকে বছর তিনেকের বড় বিবাহিত একটা মেয়ের প্রতি সে যে কিভাবে মজে গিয়েছিল, তা এখনও মাথায় ঢোকেনি তার।
তবে সেইবারেও রঞ্জিতার মত তৃণার শরীরটাই ছিল কমলেন্দুর লক্ষ্য।
শরীরের ব্যাপারে কার্পণ্য না করলেও তৃণা ছিল যাদুকর।
শুধু শরীর নয়, অদ্ভুতভাবে বশ করে নিয়েছিল কমলেন্দুর মত একজন প্লেবয়ের মনটাকেও…
“কি হল স্যার, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন?” রঞ্জিতার কণ্ঠস্বরে হুঁশ ফিরল কমলেন্দুর। তৃণার কথা মনে পড়তেই শুকনো শুকনো লাগছে গলার ভিতরটা। সে রঞ্জিতাকে বলল, “রঞ্জিতা, আমাকে একটু জল খাওয়াতে পারবে?”
“নিশ্চয়ই স্যার। কিন্তু আপনি ভিতরে আসুন।”
মেয়েটার গলায় আন্তরিকতার অভাব নেই। তবুও ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল কমলেন্দুর, “হ্যাঁ…হ্যাঁ, চলো।”
রঞ্জিতার পিছন পিছন তার রুমে ঢুকল কমলেন্দু। হোটেলের বাকি রুমের মত এই ঘরে ঢুকে একটা লম্বা প্যাসেজ, যার একপাশে বাথরুম। প্যাসেজটা পেরিয়েই কমলেন্দুর চোখ পড়ল একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলের উপর রাখা রয়েছে জলের জাগ আর একটা কাচের গ্লাস। টেবিলের গায়েই একটা কাঠের চেয়ার। চেয়ারটার দিকে ইশারা করে রঞ্জিতা বলল, “স্যার, এখানে বসুন। আমি গ্লাসটা ধুয়ে নিয়ে এসে আপনাকে জল দিচ্ছি।”
মেয়েটা বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে তাকে। তৃণার স্মৃতিগুলোকে জোর করে দূরে সরিয়ে রেখে খুশি হল কমলেন্দু। বাথরুমের ভিতরে বেসিনের ট্যাপ থেকে জল পড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে এখন গ্লাস ধুচ্ছে রঞ্জিতা।
কমলেন্দুর ইচ্ছা হল পিছন থেকে গিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে।
কিন্তু হোটেলের মালিক হয়ে শেষ পর্যন্ত রেপ কেসে…
নিজের ইচ্ছাটাকে বাক্সবন্দী করে চুপচাপ বসে রইল কমলেন্দু।
কিছুক্ষণ পর রঞ্জিতা বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। নাইটির উপর সে একটা হাউজকোট চাপিয়েছে। খোলা চুলে রুমের হালকা আলোয় অপূর্ব লাগছিল তাকে। জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালার জন্যে প্রায় কমলেন্দুর গা ঘেঁষে দাঁড়াল সে।
তার শরীরে থেকে বেরোচ্ছে একটা পাহাড়ি গন্ধ।
জগ থেকে জল ঢেলে গ্লাসটা কমলেন্দুর হাতে তুলে দিল রঞ্জিতা, “নিন স্যার, খেয়ে নিন।”
ঢকঢক করে জলটা শেষ করল কমলেন্দু। ঘরের অন্য কোনায় পড়ে থাকা আর একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে এবার তার সামনে এসে বসল রঞ্জিতা, “হ্যাঁ স্যার বলুন। তবে আপনি কষ্ট করে এলেন কেন? আমাকে ডাকলেই তো পারতেন।”
ভিতরে ভিতরে সতর্ক হল কমলেন্দু। যা করার করতে হবে খুব সাবধানে। হাজার হোক, পাহাড়ে সে বহিরাগত। পুলিশ হাতে থাকলেও, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে সবকিছু তার বিরুদ্ধে চলে যেতে সময় লাগবে না খুব একটা।
কিন্তু কিভাবে শুরু করবে এই খেলা? ভেবেও খেই পেল না কমলেন্দু। বিশ্বাসী মস্তিষ্কটাও হঠাৎ বেইমানি করতে শুরু করেছে তার সঙ্গে।
ঈশ, কেন যে এত মদ খেল আজ!
এদিকে কমলেন্দুকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মুখ খুলল রঞ্জিতা, “স্যার একটা কথা বলব?”
মেয়েটার ঠোঁটে জমাট বাধতে শুরু করেছে একটুকরো হাসি। মিষ্টি হলেও যা রহস্যে মোড়া।
ফের ওর ইঙ্গিত পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল কমলেন্দু। কিন্তু তার সেই উৎকণ্ঠায় জল ঢেলে দিয়ে রঞ্জিতা বলল, “স্যার, আপনি আমায় বিশ্বাস করেন তো?”
হঠাৎ এই কথা বলার অর্থ কী? বুঝতে না পারলেও বোকার মত ঘাড় ঝাঁকাল কমলেন্দু, “হ্যাঁ।”
“কিন্তু স্যার,” ফের হালকা হাসল রঞ্জিতা, “আমি যদি বলি এই জলটায় বিষ মেশানো আছে।”
শেষের দিকে হঠাৎ কর্কশ করে উঠল রঞ্জিতার গলার আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল কমলেন্দুর শিরদাঁড়া বেয়ে, “মা… মানে?”
“মানে একটা বিষ যেটা পেটে গেলে দশ মিনিটের মধ্যেই সব শেষ।”
কথাটা সত্যি না মিথ্যা তা জানে না কমলেন্দু; তবুও একটা সাংঘাতিক ভয় আর অপরাধবোধ একসঙ্গে ওলটপালট করে দিল তাকে।
পেটের ভিতর জমে থাকা মদ হঠাৎ ধাক্কা মারতে শুরু করল গলার কাছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারল না কমলেন্দু।
রঞ্জিতার ঘরের মধ্যেই হড়হড় করে বমি করে ফেলল সে।
৩
হাতদুটো স্টিয়ারিং-এ থাকলেও কমলেন্দু ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল।
কখন… কখন সে পৌঁছবে তার গন্তব্যে?
গতকাল রাতে তাকে বিষ দেয়নি রঞ্জিতা। উলটে বমি করে ফেলার পর কমলেন্দুর থেকে বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল সে নিজেই, “কি…কি হল স্যার? সরি স্যার। আমি তো জাস্ট একটু মজা করছিলাম। বিশ্বাস করুন স্যার, জলে বিষ নেই। আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে স্যার? আমি আপনাকে রুমে পৌঁছে দেব?”
তারই এক মহিলা কর্মচারীর সামনে চূড়ান্ত বেইজ্জতি হয়েছে কমলেন্দুর। সেটা গায়ে মেখে রঞ্জিতার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। কিন্তু সেই বেইজ্জতির থেকেও কমলেন্দুকে বেশি তাড়া করছিল একটা ভয়।
তৃণাকে তো সে নিজেও…
সেও অনেক বছর আগের কথা। তখন কমলেন্দু হাবুডুবু খাচ্ছে তৃণার প্রেমে। এর মধ্যেই একদিন কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ দমদমের ফ্ল্যাট থেকে কর্পূরের মত উবে গিয়েছিল মেয়েটা।
বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার ফোনও।
শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে মায়ের তালগোল পাকানো শরীরটা দেখে যতটা না ধাক্কা খেয়েছিল বারো বছরের কমলেন্দু, তার থেকে অনেক বেশি ধাক্কা খেয়েছিল তৃণার এই আকস্মিক অন্তর্ধানে।
“তৃণা, তুমি কোথায়? প্লিজ উত্তর দাও।”- একই ম্যাসেজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পাঠালেও, সেই সময় না পাওয়া অথবা না দেখাই থেকে যেত কমলেন্দুর ম্যাসেজগুলো।
তারপর একদিন তৃণার একটা ম্যাসেজ এসেছিল কমলেন্দুর ফোনে। আর সেটাই বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিল তার সমস্ত অস্তিত্বের উপর দিয়ে, “আমাকে ভুলে যাও কমলেন্দু। এভাবে চলতে পারে না। আমি কেবল ঠকিয়ে যাচ্ছি ওই মানুষটাকে।”
অন্য ছেলে এই জায়গায় থাকলে হয়তো গলায় দড়ি দিত। কিন্তু কমলেন্দু অন্য ধাতুতে তৈরি। ক্ষোভটা জমতে শুরু করেছিল তৃণা গায়েব হয়ে যাওয়ার পর থেকেই। আর ম্যাসেজটা পড়ে প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠেছিল তার সমস্ত শরীর।
এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা!
যে করেই হোক, এর শোধ নিতে হবে তাকে।
তক্কে তক্কে ছিল কমলেন্দু। নজর রেখেছিল তৃণার ফ্ল্যাটের উপর। কিছুদিন পর তৃণা আবার ফিরে এসেছিল তার ফ্ল্যাটে। একলাই। সুযোগ বুঝে কমলেন্দু হানা দিয়েছিল সেখানে। অনেক অনুনয়-বিনয়, এবং শেষে কিছুটা ব্ল্যাকমেলিংয়ের পর তৃণা রাজি হয়েছিল কমলেন্দুর সঙ্গে আর একটা রাত কাটাতে।
সেদিন বিকেলে সবার অলক্ষ্যে তৃণাকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে কমলেন্দু পৌঁছে গিয়েছিল ঝাড়গ্রামে ওদের নতুন রিসোর্টে। রিসোর্টটা তখনও পাবলিকের জন্যে খুলতে কিছুদিন বাকি। সেই রাতে সবকিছু হয়ে যাওয়ার পর তৃণাকে আরও একটা ড্রিঙ্ক অফার করেছিল সে।
তৃণা সরল বিশ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে নিয়েছিল গ্লাসের মধ্যে রাখা রেড ওয়াইনটা।
এর কিছুক্ষণ আগে তৃণা যখন বাথরুমে গিয়েছিল তখন তরলটার মধ্যে কমলেন্দু মিশিয়ে রেখেছিল সাংঘাতিক একটা বিষ, যেটা পেটে গেলে দশ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু অনিবার্য।
কমলেন্দুদের নতুন রিসোর্টটা দেখভাল করার দায়িত্বে ছিল তার পরিচিত একজন লোক। বেশ খানিকটা টাকার বিনিময়ে তার মুখ বন্ধ করতে এবং তারই সাহায্য নিয়ে লাশটাকে রিসোর্টের পিছনে বাগানের এক কোণে পুঁতে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি কমলেন্দুকে।
খুনটা ঝোঁকের মাথায় করে ফেললেও পরে খুব ভয় পেয়েছিল সে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে কমলেন্দু শেষ পর্যন্ত শরণাপন্ন হয়েছিল তার বাবার। তৃণার মৃত্যু নিয়ে খুব একটা ঝামেলা হয়নি। ওর স্বামী ছিল আধপাগলা। নিজের অত সুন্দরী বউকে ছেড়ে পড়ে থাকত অন্য কোন এক শহরে। সেইজন্য পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী অমরকান্তি বোসের খুব একটা অসুবিধা হয়নি ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে।
ঝাড়গ্রামের সেই রিসোর্ট এখন গমগম করে টুরিস্টদের ভিড়ে। রিসোর্টের এক কোণে একটা বকুল গাছের তলায় তৃণা শুয়ে থাকলেও ওই রিসোর্টে ভূতের উপদ্রব আছে বলে নালিশ করেনি কেউ।
কিন্তু রঞ্জিতা হঠাৎ বিষের কথাটা বলল কেন তাকে?
ভয় পেলেও কিন্তু বুদ্ধি হারায়নি কমলেন্দু। রাত দেড়টা নাগাদ নিজের ল্যাপটপ খুলেছিল সে। সেখানেই লোড করা থাকে তার সমস্ত কর্মচারীদের ডিটেল।
ল্যাপটপ ঘেঁটে কমলেন্দু দেখেছিল মেয়েটার বাড়ি দার্জিলিং-এ।
সঙ্গে সঙ্গে সে ঠিক করে নিয়েছিল তার পরবর্তী গন্তব্য।
দার্জিলিং।
ওখানে গিয়েই খোঁজখবর নিতে হবে মেয়েটার সম্বন্ধে।
গুগুল বলছে বাঁদিকের রাস্তাটা। গাড়িটা ঘোরাল কমলেন্দু। রাস্তায় ঢুকতেই গুগুল জানিয়ে দিল সে পৌঁছে গেছে গন্তব্যে।
রাস্তাটা মোটেও চওড়া নয়। কায়দা করে কমলেন্দু তার মধ্যেই পার্ক করল গাড়িটাকে। রাস্তার দু’পাশে বাড়ি। একতলা বাড়িগুলো খুবই ছোট। খানিকটা উপরে উঠতেই কমলেন্দুর চোখে পড়ল একটু বড় আরও একটা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে পাঁচিল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তার সীমানা। আর গেটের পাশে একটা সোনালী প্লেটে জ্বলজ্বল করছে ঠিকানাটা।
ঠিকানাটা দেখেই আটকে গেল কমলেন্দু।
হ্যাঁ, এই ঠিকানাটাই তো দেওয়া ছিল রঞ্জিতার সিভিতে।
গেটের ওপাশের বাগানটা দেখেই মনে হয় পরিষ্কার করা হয়নি অনেকদিন। গেটে তালা না ঝুললেও বাড়ির মেইন দরজাটার সামনে ঝুলছে বড়সড় একটা তালা।
দুপুরবেলাতেও রাস্তাটা ফাঁকা। কোনও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। কী করবে তা বুঝতে পারছিল না কমলেন্দু। হঠাৎ সে দেখল পাশের বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে একজন।
লোকটা যে স্থানীয় তা বলে দেয় তার চোখ মুখই।
লোকটাকে দেখে হাতে চাঁদ পেল কমলেন্দু, “দাজু।”
অপরিচিত গলার আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে গেল লোকটা’ “জী বলিয়ে।”
“ইস ঘরপে কোই রহতা হ্যায় কেয়া?”
“ফিলাল তো নেহি। লেকিন কুছদিন পেহেলে এক বাঙ্গালিবাবু রহতে থে।”
বাঙ্গালিবাবু! চমকে উঠল কমলেন্দু, “কোউন?”
“নাম উসকা বিশ্বরূপ দত্ত।”
বিশ্বরূপ দত্ত! নামটা যেন চেনা চেনা লাগছে না।
হঠাৎ কয়েক হাজার ভোল্টের শক খেল কমলেন্দু।
লোকটা তৃণার স্বামী নয় তো?
তৃণাই তো তাকে একবার বলেছিল ওর বরের নামটা।
হাঁকপাঁক করে উঠল কমলেন্দু, “আভি ও কাহা হ্যাঁয়?”
“পাতা নেহি। উনকে সাথ এক লেড়কি ভি রহতি থি। ও ভি চলি গেয়ি উস আদমিকে সাথ।”
বিশ্বরূপ দত্ত আর তার সঙ্গে একটা মেয়ে!
দু’জনেই চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে!
একটা ব্যাখ্যাহীন ভয়ে সরে যেতে থাকে কমলেন্দুর পায়ের তলার মাটি।
তাহলে কি বিশ্বরূপ দত্ত জেনে গেছে তৃণার হারিয়ে যাওয়ার পিছনে আসল রহস্য?
থানা-পুলিশ এসব করে ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না বলেই অন্য কোনও অজানা উপায়ে সে শোধ নিতে চাইছে তৃণা দত্তর হারিয়ে যাওয়ার!
৪
এ কোথায় চলে এলো কমলেন্দু!
আবারও চারপাশে চোখ বোলাল সে। চেনা চেনা লাগলেও জায়গাটা ঠিক চিনতে পারছে না সে।
দার্জিলিং থেকে পেলিং-এ ফিরতে ফিরতেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। কিন্তু হোটেলের সামনে নিজের এসএউভিটা পার্ক করতে না করতেই কমলেন্দু পেয়েছিল রঞ্জিতার ফোন, “স্যার, দেখে এলেন বাড়িটা?”
একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল কমলেন্দুর শিরদাঁড়া বেয়ে। মেয়েটা কী করে জানল সে দার্জিলিং গিয়েছিল! কোনও উত্তর দিতে পারেনি কমলেন্দুর মস্তিষ্ক। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে ভেসে এসেছিল রঞ্জিতার গলার আওয়াজ, “স্যার, আমি জানি আপনি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গেই কথা বলতে চাইছেন। আপনার মনে হাজারো প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাকে দেব। কিন্তু হোটেলে নয়। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি সুইসাইড পয়েন্টে। আর হ্যাঁ, একলাই আসবেন। পুলিশে খবর দেওয়ার চেষ্টা করবেন না একদম। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না তৃণা দত্তর অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে পুলিশ ফের নড়েচড়ে বসে। অন্য কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে আসলেও আপনার বিপদ বাড়বে বই কমবে না।”
মেয়েটা তো ওপেন থ্রেট দিচ্ছে তাকে। নড়েচড়ে বসেছিল কমলেন্দু, “হ্যাঁ আসছি এবং একলাই।”
রঞ্জিতার ফোনটা কেটে দিয়ে কমলেন্দু পা বাড়িয়েছিল নিজের রুমের দিকে। ততক্ষণে সে ঠিক করে নিয়েছে তার পরবর্তী পদক্ষেপ।
সে একলাই যাবে; কিন্তু পকেটে থাকবে ছোট্ট হ্যান্ডগানটা।
আর যাই হোক, ওরকম একটা নির্জন জায়গায় ভর সন্ধেবেলায় কমলেন্দুর হাতে একটা হাতিয়ার থাকলে ভয় অন্তত পাবে মেয়েটা।
ট্রাউজার্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কমলেন্দু দেখল ঠিক জায়গাতেই রয়েছে তার হ্যান্ডগানটা। ছোটবেলা থেকেই শ্যুটিং-য়ের নেশা ছিল তার। বেশ কয়েকটা প্রতিযোগিতাতেও অংশগ্রহণ করেছে সে। বন্দুক চালাতে হাত কাঁপে না কমলেন্দুর। কিন্তু সেটা বার করার আগেই সে শুনতে পেল রঞ্জিতার কণ্ঠস্বর , “কোনও লাভ নেই স্যার। এখানে রঞ্জিতা ছাড়া এক’পাও নড়ার ক্ষমতা নেই আপনার।”
রঞ্জিতার গলায় ধমকির সুর স্পষ্ট। নির্মম সত্যটা অনুভব করতে খুব বেশি সময় লাগল না বুদ্ধিমান কমলেন্দুর। নিজেকে বড় অসহায় লাগল তার। কয়েক মিনিট আগেও সে দাঁড়িয়েছিল তাদের হোটেল থেকে বেশ খানিকটা উপরে যে চওড়া জায়গাটা আছে সেখানে। জায়গাটার একপাশে গভীর খাদ। এটাই এখানকার সুইসাইড পয়েন্ট। এর চারপাশে আর কোনও হোটেল নেই। শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, কয়েকজন টুরিস্টও নাকি এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেছিল। অতি উৎসাহী গুটিকয়েক টুরিস্ট মাঝে মাঝে এখানে চলে আসলেও স্থানীয় লোকজন থেকে শুরু করে হোটেলের কর্মচারী, সবাই এড়িয়ে চলে জায়গাটাকে। তবে লোকের মনের ভয় দূর করতে ইদানীং জায়গাটাকে সাজানো হয়েছে নতুনভাবে। প্রায় গোলাকার জায়গাটার চারপাশে বসানো হয়েছে রেলিং। রেলিং-এর মাঝখানে ছোট্ট একটা গেট। সেখানে পৌঁছে কমলেন্দু দেখেছিল পাহাড়ি অন্ধকার গায়ে মেখে গেটের ওপারে একলা দাঁড়িয়ে রঞ্জিতা।
“আসুন স্যার আপনার অপেক্ষাই তো করছিলাম।” কমলেন্দুকে দেখতে পেয়েই বিদ্রুপের হাসি হেসেছিল মেয়েটা।
“কী বলতে চাও বলো।” কথাগুলো বেশ জোর গলায় বলে গেট টপকেছিল কমলেন্দু।
সেই সময় হালকা কিছুতে যেন ধাক্কা খেয়েছিল সে।
আর তারপরেই কমলেন্দু বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা।
আর পাহাড় নয়, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সে পৌঁছে গেছে সমতলে।
আর সময়টাও রাত নয়, দিন।
সবকিছু বদলে গেলেও তখনও তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জিতা।
“কি স্যার জায়গাটা চিনতে পারছেন?” কথাগুলো বলতে বলতে তাকে পিছনে ফেলে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থামল রঞ্জিতা। হাত দিয়ে ঠেলে সরানোর মত করে সরিয়ে দিল অদৃশ্য কিছু একটা। তারপর ডানহাতের তর্জনী তুলে সে বলল, “স্যার, আমার আঙুলটাকে ফলো করুন। ওই বটগাছটা দেখতে পাচ্ছেন?”
রঞ্জিতার ইঙ্গিত পেয়ে ঘাড় ঘোরাতেই বটগাছটাকে দেখতে পেল কমলেন্দু। গাছটা দাঁড়িয়ে আছে একটা ভেঙ্গে পড়া মন্দিরের গায়ে। গাছটার সামনে একটা মাঠ। রঞ্জিতা ফের বলল, “স্যার। ওই গাছটার পিছনেই গঙ্গা। ছোটবেলায় আপনি বন্ধুদের সঙ্গে এখানে আসতেন ক্রিকেট খেলতে।”
জায়গাটা এখনও আছে। তবে গাছ কেটে, মন্দির ভেঙ্গে আর মাঠ বুজিয়ে এখন সেখানে সারি সারি অ্যাপার্টমেন্টের সারি। বহুবছর আগেই বদলে গিয়েছিল সবকিছু। সেই জন্যেই বোধহয় নিজের ছোটবেলার প্রিয় মাঠটা দেখেও চিনতে খানিক সময় লাগছিল কমলেন্দুর।
“কিন্তু এখানে আমরা এসে পৌঁছলাম কিভাবে?” চিৎকার করে উঠল কমলেন্দু।
“টাইম ট্র্যাভেল। গেট দিয়ে ঢোকার সময়েই আপনি পার করে ফেলেছেন অদৃশ্য পর্দাটা।” হিসহিস করে উঠল রঞ্জিতা।
কমলেন্দু দেখল সেই মাঠে ব্যাট, বল আর উইকেট হাতে জড়ো হচ্ছে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে। তাদের মধ্যে বুম্বা, টুবাই, রন্টু, বিলু সবাই থাকলেও কোথাও নেই সে।
এত বিপদের মধ্যেও হঠাৎ নিজের শৈশব ফিরে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও সবকিছু ভুলে গেল কমলেন্দু, “কিন্তু ওদের মধ্যে আমি কোথায়?”
“দেখতে চান। আসুন আমার সঙ্গে।”
রঞ্জিতার পিছনে কয়েক পা হাঁটতেই কমলেন্দু এসে পৌঁছল একটা বাড়ির সামনে।
বাড়িটা দেখেই চিনতে পারল সে।
দোতলা বাড়িটা তো তাদেরই।
বাড়িটার সদর দরজা খোলা। যেন তাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। দরজা দিয়ে সোজা ভিতর ঢুকল সে আর রঞ্জিতা। তারপরেই তার কানে এলো এক মহিলাকণ্ঠ, “বাবু, বাবু, বাবু! তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকে। ছোটবেলা থেকে ওই ঘরটাই বরাদ্দ ছিল কমলেন্দুর জন্যে। ঘরের দরজার পাশে গিয়ে কমলেন্দু যে দৃশ্যটা দেখল, সেটা অপরিচিত না হলেও, বিহ্বলতায় শিহরণ বয়ে গেল তার শরীর দিয়ে।
ঘরের বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছে একটা সাত বছরের ছেলে। তার তাকে বুকে আগলে রেখেছে বছর তিরিশের এক মহিলা।
“মা…!” নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল কমলেন্দু।
কিন্তু তাল কেটে গেল তারপরেই। ডাকটা শুনে মহিলা ফিরে তাকালেন কমলেন্দুর দিকে। তাঁর দু’চোখে বিস্ময়, “কে… কে আপনি?”
“মা… আমি তোমার কমল। আমি বড় হয়ে গেছি মা।”
একটু হলেও থমকে গেলেন সেই মহিলা। কুঁচকে গেছে তাঁর ভুরু দুটো। ঠিক এই সময় কমলেন্দুর কানে এলো রঞ্জিতার কণ্ঠস্বর, “উনি আপনাকে চিনতে পারবেন না। ওই রোগে ভোগা বাচ্চাটার সঙ্গে এই মদ খেয়ে ফুলে যাওয়া লোকটার কোনও মিল নেই।”
রঞ্জিতার কথাগুলো ধাক্কা মারল কমলেন্দুর বুকের ঠিক মাঝখানে। ততক্ষণে চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন ওই মহিলা, “এই বুলটির মা। তোমাকে কতবার বললাম দরজাটা বন্ধ করতে। তুমি করোনি। ছেলেটা হাঁপাচ্ছে, আর তার মধ্যে উলটোপালটা লোক ঘরে ঢুকে পড়েছে।”
কমলেন্দু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তার কানে আসে পাশে দাঁড়ানো রঞ্জিতার কণ্ঠস্বর, “মা আপনাকে দেখতে পাচ্ছেন, আমাকে নয়, কারণ টাইম ট্র্যাভেলে অদৃশ্য থাকতে হলে কিছু পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন। কিন্তু আপনি সেটা নেননি আর আমি নিয়েছি। ঠিক এইভাবেই আপনার সঙ্গে আমি দার্জিলিঙেও ঘুরে এসেছি। আপনি গাড়ি নিয়ে বেরনোর কিছুক্ষণ পরেই। তখন আপনি আমায় দেখতে পাননি। আর এখন আপনার চোখ ছাড়া বাকি সব চোখে আমি অদৃশ্য। কেউ শুনতেও পাচ্ছে না আমার গলার আওয়াজ।”
ততক্ষণে বুলটির মা, মানে ওদের বাড়ির সেই পুরনো ঝি এসে ঢুকে পড়েছে সেই ঘরে, “কি হয়েছে বৌদি? চেঁচাচ্ছ কেন? ওমা! এই লোকটা কে?”
পরিস্থিতি যে তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল তা বুঝতে পারছিল কমলেন্দু। তবুও নিজের বিপন্নতা আরও একবার মাকে বোঝাবার চেষ্টা করল সে, “মা… আমি আমি তোমার কমল। … তুমি আমায় চিনতে পারলে না…”
কথাটা শেষ করতে পারল না কমলেন্দু। তার আগেই চেঁচিয়ে উঠলেন সেই ভদ্রমহিলা, “কি উলটো পালটা কথা বলছেন। এখুনি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। আমি চিৎকার করলে পাড়ার লোক জড়ো হতে এক মিনিটও সময় লাগবে না। তার উপর পুলিশ তো আছেই।”
মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আর কোনও কথা খুঁজে পেল না কমলেন্দু।
এদিকে ঝামেলায় মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে তাকিয়েছে হাঁপাতে থাকা ছেলেটাও।
কমলেন্দু দেখল তার শৈশব অবাক চোখ তাকিয়ে আছে তারই দিকে…
এরই মধ্যে কমেলেন্দু শুনতে পেল রঞ্জিতার কণ্ঠস্বর, “বাপ মা মরা মেয়ে আমি। বড় হচ্ছিলাম দাদুর কাছে। তখন আমার বয়স সতেরো। হঠাৎ দাদু মারা যান। স্কুলের বেড়া টপকাতে না টপকাতেই একেবারে অনাথ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমার দাদু পাহাড়ি মানুষ হলেও ছিলেন বিশ্বরূপ স্যারের প্রফেসর। স্যার দাদুকে শ্রদ্ধা করতেন নিজের বাবার মতই। এদিকে দাদু ভালো চাকরি করলেও সারা জীবন এত খরচ করেছিলেন যে জমাতে পারেননি বিশেষ কিছুই। তাই দাদুর মৃত্যুর পর অতল জলে পড়েছিলাম আমি। এদিকে স্যার নিজের বোনের মত ভালোবাসতেন আমাকে। সেই সময় স্যারই আমাকে নিয়ে আসেন ওর বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে একটা এতবড় মেয়ের উপস্থিতি মানতে পারেননি তৃণা ম্যাম। স্যারকে সন্দেহ করতেন। বারবার বলতেন আমাকে কোনও হস্টেলে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু স্যার মানেননি। এই নিয়ে দু’জনের ঝগড়া এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যে রাগ করে একটা চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে যান ম্যাডম। সেই সময় আপনার পরিচয় হয় ওনার সঙ্গে। স্যার নিজের থেকে অনেক ছোট একটা মেয়ের সঙ্গে… সেই রাগেই হয়তো উনি বেছে নিয়েছিলেন আপনাকে। কিন্তু তারপর আসরে নামি আমি। ম্যামকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম দার্জিলিঙে। ততদিনে একটা বিয়ে ঠিক হয়েছে আমারও। ম্যামও বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ভুল। নতুন করে শুরু করতে চাইছিলেন স্যারের সঙ্গে। চাকরিটায় রিজাইন দিতে এবং পাওনা টাকাগুলো তোলার জন্যেই শেষবারের মত কলকাতায় ফিরেছিলেন উনি। ঠিক সেই সময়েই আপনি ম্যামকে ব্ল্যাকমেল করে এক রাত্তিরের জন্য রাজি করিয়ে খুনই করে ফেললেন!
ম্যাম হঠাৎ গায়েব হয়ে যেতে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন স্যার। তাই নিজের বিয়ে ক্যানসেল করে আমি থেকে যাই স্যারের সঙ্গে।
আপনি হয়তো ভাবছেন আমি এত কথা জানলাম কি করে? তার কারণ বিজ্ঞানী বিশ্বরূপ দত্তের শেষ আবিষ্কার। টাইম মেশিন। সেটাতে চড়েই কিছুদিন আগে আমরা দেখেছিলাম ম্যামের পরিণতি। তারপর একদিন দুপুরে স্যার হঠাৎ আমাকে ডেকে জানালেন নিজের প্ল্যানের কথা।
স্যারের অনুরোধেই আমি এসেছিলাম আপনার কাছে। জেল আপনাকে বন্দি করতে পারেনি। কিন্তু সময় বন্দি করেছে আপনাকে। এখান থেকে এগোনো বা পিছনো কিছুই সম্ভব নয় আপনার পক্ষে।”
কথাগুলো শেষ করে আর দাঁড়াল না রঞ্জিতা। ঝড়ের গতিতে বারিয়ে গেল ওদের বাড়ি ছেড়ে।
কিন্তু বেরোতে পারল না কমলেন্দু।
হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।
সঙ্গে সঙ্গে তার কানে এলো মায়ের গলার আওয়াজ, “বাবু, বাবু, বাবু। তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
এরপরেই চোখের পলকে ফিকে হয়ে গেল সেই অন্ধকার।
চারপাশে চোখ বুলিয়ে কমলেন্দু বুঝতে পারল রঞ্জিতা ছাড়া বাকি সবকিছু রয়ে গেছে একটু আগে দেখা দৃশ্যটার মতই।
ছোট কমলেন্দুকে বুকে আঁকড়ে বসে আছে তার মা…
কমলেন্দু ফের চিৎকার করে উঠল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে, “মা মা আমি তোমার কমল। ভালো করে দেখ। শুধু বড় হয়ে গেছি।”
তার ডাক শুনে চমকে উঠল মা। তারপর ফিরে তাকাল তার দিকে। ভদ্রমহিলার দু’চোখে আরও একবার ভর করছে দুনিয়ার বিস্ময়, “কে… কে আপনি?”
“মা… আমি তোমার কমল। আমি বড় হয়ে গেছি মা।” নিজের গলার স্বরই কেমন আত্ম চিৎকারের মত শোনাল কমলেন্দুর কানে।
কিন্তু মা তাকে চিনতে পারল না এবারেও।
ফের অন্ধকার হয়ে গেল কমলেন্দুর চোখের সামনেটা। তারপর তার কানে এল সেই পরিচত কণ্ঠস্বর, “বাবু, বাবু, বাবু। তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
তবে কি আর পালানো যাবে না এখান থেকে! একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল কমলেন্দুর শিরদাঁড়া বেয়ে। সে পালাতে চেষ্টা করল জায়গাটা ছেড়ে। কিন্তু হঠাৎ যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে গেছে তার পা দুটো।
সেগুলোকে নাড়াবার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে।
এখনও ছোট্ট কমলেন্দুকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে তার মা। কিন্তু এবার আর মাকে ডাকতে পারল না কমলেন্দু। একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা গ্রাস করতে শুরু করেছে তাকে। ছোটবেলায় মা আর বাবার সঙ্গে রাজগীর না কোথায় একটা বেড়াতে গিয়েছিল সে। সেখানে টাঙ্গার করে যাওয়ার সময় একটা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আনমনা হয়ে গিয়েছিল মা, “দেখ কমল, পাহাড়টা কত বছর ধরে, হয়তো গৌতম বুদ্ধের সময় বা তারও আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। কতকিছুর নীরব দর্শক ও। সময় কেবল নদীর স্রোতের মত বয়ে চলেছে ওর সামনে দিয়ে।”
তখন কমলেন্দুর বয়স কত! মেরেকেটে দশ। মায়ের কথাগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ছোট্ট কমলের পক্ষে। কিন্তু আজ তার মনে হল, সেও এক জায়গায় আটকে গেছে ওই পাহাড়টার মতই।
শুধু সময়টাই নদীর স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছে না তার সামনে দিয়ে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনও বদ্ধ জলাশয়ের মত!
হঠাৎ বুক ফেটে কান্না পেল কমলেন্দুর।
নিজেকে আর আটকাতে পারল না সে।
ফেলে আসা অতীতের সামনে দাঁড়িয়ে কমলেন্দু কেঁদে ফেলল হাউ হাউ করে।
তার কান্নার আওয়াজ শুনে চমকে মুখ তুলে তাকাল মা।
কিন্তু তারপরেই আবার অন্ধকার হয়ে গেল কমলেন্দুর চারপাশ…
খানিকবাদে ফের তার কানে এল মায়ের গলার আওয়াজ, “বাবু, বাবু, বাবু। তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
———–
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), পৃথ্বীশ গজী