অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সাথে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা
লেখক: অনুলিখনঃ দীপ ঘোষ ও সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সবথেকে সফল ও ধারাবাহিক কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সাথে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা
অনুলিখনঃ দীপ ঘোষ ও সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
অলংকরণ – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
বাংলা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে সাম্প্রতিক একটা উৎসাহ বেশ চোখে পড়ছে। নানা ধারা উপধারার থিম বা প্লট নিয়ে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বা সিগনেচার সে খুঁজে পেয়েছে যেন। এই নিয়ে অগণিত পাঠকের নানা প্রশ্ন আমাদের নানা সময়েই ভাবিয়েছে। সেইসব প্রশ্নের বেশ কিছু আমরা রেখেছিলাম এক খোলা আলোচনায় যেখানে প্রায় অভিভাবকের মতো আলোচনার মূল সূত্র রচনা করছিলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানে অন্যতম সফল নাম শ্রী অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী। নানা পাঠক এবং লেখকের মনোজ্ঞ চিন্তার আদানপ্রদানে এই আলোচনা এক সংরক্ষণযোগ্য সন্দর্ভে পরিণত হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ বাংলায় কল্পবিজ্ঞান লেখা নিয়ে অনেক পোস্ট দেখি। অনেকে এ বিষয়ে আমার মতামত জানতে চান। এ বিষয়ে আমার সীমিত পাঠ-অভিজ্ঞতা ও নিজের লেখার অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করে প্রথমবার মতামত জানাচ্ছি। একই সঙ্গে জানাই কিভাবে ‘কল্পবিজ্ঞান’ গ্রুপ সাহিত্যের এ ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ কাজ কোন একজন লেখকের পক্ষে সহজ নয়। একটা নতুন সাহিত্যধারা তখনই সমৃদ্ধ হয় যখন তাতে বিভিন্ন চিন্তাভাবনার স্রোত এসে মেশে।
প্রথমেই জানাই আমি মনে করি না যে বাংলায় যাবতীয় কল্পবিজ্ঞানের লেখা শুধুই শিশুতোষ ছেলেভোলানো লেখা। তবে অবশ্যই একটা বড় অংশ সেই ধরণের। তার কারণ বাংলায় খুব বড় অংশের পাঠক, বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালে, সাহিত্যের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে। ভালো কল্পবিজ্ঞান সম্বন্ধে তাদের ধারণাও খুব সীমিত। এই ধরণের পাঠকের কথা মাথায় রেখে কল্পবিজ্ঞান লেখার সময় মনে রাখতে হবে সবার আগে তা যেন ভালো গল্প হয়। অন্যধারার গল্পের থেকে কল্পবিজ্ঞানে সাফল্য পেতে গেলে লেখককে সবার আগে ভালো গল্প বলিয়ে হতে হয়, বিশেষ করে এপার বাংলায়। ভালো গল্পের মূল শর্ত যে পাঠক একবার শুরু করলে যেন শেষ না করে থামতে না পারে। তাই হাতে গোনা যারা বাংলাসাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানে সাফল্য পেয়েছেন, তারা অন্য ধারার সাহিত্যেও একই রকম বা তার থেকেও বেশী সাফল্য পেয়েছেন। অন্যরা মূলধারার সাহিত্যের থেকে বাইরে থেকে শুধু কল্পবিজ্ঞানই লিখে গেছেন। এখন বাংলা সাহিত্যের সীমিত পাঠকের জন্য সবার কাছে কল্পবিজ্ঞানের মাধ্যমে পৌঁছনোর চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশী শক্ত। তবে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান সম্বন্ধে আগ্রহ তৈরি হয়। এখানেও সে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে কিছু ভালো লেখকও লিখছেন।
বাংলায় কল্পবিজ্ঞানে চার ধরণের লেখার সম্ভাবনা দেখি। প্রথমত অবশ্যই ছোটদের জন্য হাল্কা কল্পবিজ্ঞানের লেখা যেখানে বিজ্ঞানের শর্ত, লজিক কোনটাই থাকে না। লজিক ও বিজ্ঞান একটা বড় অংশ বাঙালীপাঠককে দূরে সরিয়ে দেয়। শীর্ষেন্দুদার (বনি বাদে) বা প্রফেসার শঙ্কুর প্রায় সব লেখাই এর মধ্যে পড়বে যা এ ধারার লেখার সেরা গল্পের উদাহরণ। আজও বেশীরভাগ লেখক যারা কল্প বিজ্ঞান লেখেন তারা এধরণের লেখাই লেখেন। আমি যা পড়েছি দেখেছি, ৯৯.৯ শতাংশ লেখাই অতি সাধারণ মানের। এধরণের লেখা বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণাই বেশী তৈরি করেছে।
এবার, দ্বিতীয় শ্রেনীর লেখায় আসি। এ ধরণের কিছু লেখা খুব কম সংখ্যায় হলেও আমরা শিশু কিশোর পত্রিকা গুলোতে পেয়েছি, যেখানে গল্পের মধ্যে বিজ্ঞান বা কল্পিত বিজ্ঞানে বড় কোন ভুল থাকে না। এ ধরণের লেখা অনেক বেশী শক্ত। ভিনগ্রহী, টাইম-ট্রাভেল, রোবট- এর বাইরে বেরিয়ে এসে অজস্র বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে লেখা যায়। গল্পের মূল স্রোতে বিজ্ঞান এক্ষেত্রে না থাকলেও চলবে। এধরণের লেখা রহস্য, থ্রিলার, মানবিক যা ইচ্ছে হতে পারে, খেয়াল রাখতে হবে গল্পের কনসেপ্ট যেন নতুন ধরণের হয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রর কিছু লেখা এর মধ্যে পড়বে। পড়ার পরে পাঠক হয়ত গল্পটাকে কল্পবিজ্ঞান হিসেবেও চিহ্নিত করবে না। গতবছরে শারদীয়া শুকতারায় আমার উপন্যাস ডাহোমা মূলত কল্পবিজ্ঞান হলেও ওই উপন্যাসটা পড়ে প্রায় কেউই কল্পবিজ্ঞান বলে ভাবে নি। এটা ছোটদের জন্য লেখা হলেও যেটুকু কল্পিত বিজ্ঞান আছে তাতে কিন্তু কোন ভুল নেই। এ ধরণের লেখার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় যেন বিজ্ঞান সামনে না আসে। এই সেগমেন্টে আমি আগামী দিনের কল্পবিজ্ঞানের লেখকদের কাছ থেকে অনেক লেখা আশা করব, কারণ এর মাধ্যমেই সবার মধ্যে কল্পবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা সম্ভব। যেকোনো প্রথম সারির নামী পত্রিকা এ ধরণের ভালো লেখার অপেক্ষায় থাকে।
এবার, তৃতীয় শ্রেনীর গল্পের ক্ষেত্রে আসি। শুধুই বড়দের জন্য লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। বাংলা সাহিত্যে এর একটা বড় অভাব আছে। অনীশ দেবের এই সেগমেন্টে অনেক ভালো লেখা আছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেনীর গল্পের মধ্যে একটা জায়গাতেই তফাত, তা হল এ লেখা শুধুই প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য। ধরা যাক, কোন একজন মা তার আক্সিডেন্টে মৃত ছেলের ক্লোন করল। সে ছেলে যখন বড় হল তার হাবেভাবে সে মহিলা তার স্বামীর এমন প্রতিফলন দেখল, যে তার সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। এরকম হাজারটা প্লট হতে পারে। আমি নিজে এ ধরণের লেখায় স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। কিন্তু এ ধরণের লেখা পাওয়ার জন্য বড়দের সব পত্রিকাই অপেক্ষা করে থাকে।
এবার শেষ বা চতুর্থ শ্রেনীর লেখার কথায় আসি। এক্ষেত্রে গল্পের কেন্দ্রে থাকে বিজ্ঞান, যেমন মার্স এর মতো লেখা। বাঙালী বড় অংশের পাঠক তার জন্য এখনও প্রস্তুত নন বলেই আমার ধারণা। সেটা এ বাংলায় আপাতত লিটল ম্যাগাজিনের পরীক্ষা- নিরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
শেষে একটা কথা বলব। ভালো কল্পবিজ্ঞান নিয়ে অনেক আলোচনার দরকার, বিশেষ করে যখন একটা খুব বড় অংশ অত্যন্ত নিম্নমানের লেখা হয়। পাঠক লেখার ভিড়ে হারিয়ে যায়, ঠিক মতো গাইডেন্স পায় না। আমি নিজে অনেক কল্পবিজ্ঞানের সেরা সংকলন দেখেছি, যার মধ্যে একটা বা দুটো গল্পের বেশী লেখা প্রায় পড়াই যায় না। নতুন কিছু ভাবা অনেক শক্ত। কিন্তু সে চেষ্টা করলে ও গল্প বলার ক্ষমতা থাকলে সাফল্য আসবেই।
সৌমেন চট্টোপাধ্যায়ঃ এখন নামটা মনে নেই তবে ক্লোনিং এর ওপর মা মেয়ের এমন একটি গল্প আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে এক স্যার লিখেছিলেন। অত্যন্ত ভালো গল্প ছিল। এই বিষয়টি হয়তো কমন কিন্তু লেখার স্পেস আছে প্রচুর। ধন্যবাদ জানাই আপনাকে এই আলোচনার জন্য।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ ক্লোনিং নিয়ে অনেক গল্প আছে। এটা একটা থিম। এর উপরে বিভিন্ন প্লট, সাবপ্লট থাকতে পারে।
সৌভিক কুমার গুহঃ অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের বাজপাখির ডানা আমার পড়া বাংলা কিশোর কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম অসাধারণ উদাহরণ। সম্ভবত এটি আপনার বর্ণিত দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে পড়বে। তবে ক্যাটাগরাইজেশনটা পড়ে বেশ ভালো লাগল, এবং আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। মৌলিক গল্প ছাড়াও অনুবাদ সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের প্রচারে একটা বড় ভূমিকা নিতে পারে, অবশ্যই যদি ভালো মানের অনুবাদ হয়। জুলস ভের্ণের গল্প গুলোর ভালো অনুবাদ আমায় ব্যক্তিগত ভাবে পাশ্চত্য কল্পবিজ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট করেছিল প্রথমে। পরিশেষে বলি, ডাহোমা পড়েও গতবছর বেশ ভালো লেগেছিল, গতবছর শুকতারায় আমার পড়া সেরা উপন্যাস ওটাই ছিল।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ ‘বাজপাখীর ডানা’ আমার পড়া নেই। ঠিক এ কারনেই আমাদের সবার আরও অনেক বই পড়া দরকার। অনেক ভালো লেখা হয়ত আমাদের আলোচনার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা গত তিরিশ বছরে বহুগুণ বেড়েছে কারণ একটা বড় অংশ বাংলা মাধ্যম ছেড়ে ইংরেজী মাধ্যমে পড়ছে। ‘ডাহোমা’- ভাল লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগল। উপন্যাসিকার মূলে আছে ক্রায়োনিক্স , ভবিষ্যতের সমাজের রূপরেখা। বিষয় শক্ত হলেও লেখার সময় খেয়াল রাখতে হয়েছে যাতে ১২+ যে কেউ গল্পটাকে পড়ে বুঝতে পারে।
পিয়াল চক্রবর্তীঃ প্রধানত আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখা পছন্দ করলেও আরেক ধরনের লেখাও খুব পছন্দ করি। কিছু কিছু লেখা যেখানে জীবন, সমাজ, মানসিকতা, বিপদ, রহস্য ইত্যাদি সব ধরনের উপাদান থাকলেও তার মূলে থাকে কল্পবিজ্ঞান। এই ধরনের লেখা আমার বেশি ভালোলাগে। তবে এই ব্যাপারে একটা কথা বলতে পারি, বাংলার পাঠকদের একটা বড় অংশের ধারণা যে কল্পবিজ্ঞান ছোটদের জন্যেই। এবং এই ধারণার পিছনে লেখকদেরও কিছুটা হাত আছে। বাংলায় ক’জন লেখক কালজয়ী বা সিরিয়াস কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস লিখেছেন, হাতে গুনে বলা যায়। আমি হয়ত ঠিক বোঝাতে পারছি না, কিন্তু এটাই বলতে চাইছি যে অন্যান্য অনেক মূল ধরার সাহিত্য, বিশেষ করে রোমান্টিক/সামাজিক সাহিত্যকেই সবথেকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বড় বড় লেখকরা তাঁদের লেখনীতে যেভাবে এই সাহিত্যকে সৃষ্টি করেছেন, সেভাবে কল্পবিজ্ঞান কে তৈরি করেননি। এর ফলেই সম্ভবত পাঠকদের মনেও কল্পবিজ্ঞানের প্রতি একটি বিশেষ জায়গা তৈরি হয়নি। হয়নি বলা ভুল, কম হয়েছে। হতে পারে যে আমি ভুল, কিন্তু আমার এটাই মনে হল। ভুল বললে ক্ষমা করবেন। আর একটি বিশেষ ধরনের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য বাংলার লেখকরা প্রায় লেখেননি ও লেখেননা বললেই চলে। যদিও সম্প্রতি সেই বিষয়টার ওপর অনেক পাঠক এবং দর্শকদের খুব আকর্ষণ দেখেছি।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ কিশোর পত্রিকায় লেখা মানেই যে তা হালকা কল্পবিজ্ঞান এটা কিন্তু সত্যি নয়। এর জন্য আরও পড়তে হবে। বাংলাতেও কিশোরসাহিত্যে কিছু লেখা হয়েছে যার মূলে কল্পবিজ্ঞান, কিন্তু আলোচনার অভাবে সবার নজরে আসে নি। যারা কিশোর সাহিত্য নিয়মিত পড়ে তাদের কাছে শুধু জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটা গত তিরিশ বছরের কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও বেশী করে সত্যি। এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। আমার ধারণা বাংলায় প্রায় সব লেখকই কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখার কথা ভেবেছেন। তবে কল্পবিজ্ঞান লেখার জন্য অনেক বেশী পড়াশোনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপরে খানিকটা দখল, পৃথিবী জুড়ে কি হচ্ছে তার সঙ্গে খানিকটা পরিচয় থাকা অত্যন্ত দরকার। এর জন্য অনেকে লিখে উঠতে পারেন নি। ঘটনাচক্রে বাংলায় কিশোর সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জায়গাটা বহুদিন আগে থে্কেই গড়ে উঠেছিল প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন, অনীশ দেব, সঙ্কর্ষণ রায়, সমরজিৎ কর, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ-এর মতো লেখকদের জন্য। এর আরেকটা কারণ আছে। কিশোর সাহিত্য ও কল্পবিজ্ঞান দুটোতেই কল্পনা, গল্পের প্লট, প্রেক্ষাপট, রহস্য-অ্যাডভেঞ্চার একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বড়দের সাহিত্যে সেটা সবসময় লাগে না। সেখানে শুধুই বড়দের সাহিত্যে বিচরণ এরকম অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের কাছে এটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। হুমায়ুন আহমেদ বা সুনীল গাঙ্গুলীর মতো লেখকরা সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছেন। সবাই পারেন নি। এ জন্যই তৃতীয় ধারায় একটা বড় ধরণের লেখার সম্ভাবনা আছে। শুধু লেখকের অভাব। দ্বিতীয় ধারার বেশ কিছু গল্প বা উপন্যাসের মূলেই কিন্তু কল্পবিজ্ঞান। চতুর্থ ধারার সঙ্গে তফাত হল সেখানে কিভাবে হল – বিজ্ঞানের কল্পনার সেই বিষয়টাকে খুব গভীরভাবে বোঝানো হয় না, যাতে বিজ্ঞানে আগ্রহী নয় এমন পাঠক তার আগ্রহ না হারায়।
পিয়াল চক্রবর্তীঃ একদম, একদম। কিশোরদের জন্যে লেখা হলেই হাল্কা লেখা এটা একদমই সত্যি নয়। কিন্তু মুস্কিল হল কিছুদিন ধরে দেখছি অনেকেই সেরকমটাই লিখছেন। বিশেষ করে আনন্দমেলার কয়েকটা সংখ্যায় যে কল্পবিজ্ঞান গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছে, পড়লে হতাশ হতে হয়। এবার কল্পবিজ্ঞান এমন একটা বিষয়, যেখানে জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা আপনা আপনি চলে আসে। নিত্যনতুন তথ্য, যন্ত্র, থিওরি আবিষ্কার হচ্ছে, অনেক থিওরি ভেঙে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে খোঁজ খবর না রাখলে লেখায় ফাঁক থেকে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুব খারাপ লাগে যে অনেকেই সেই দিকটা এড়িয়ে যান।
এবার অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্যের প্রয়োজনীয়তা কিশোর কল্পবিজ্ঞানে যেভাবে থাকে, বড়দের কল্পবিজ্ঞানে সেভাবে থাকে না ঠিকই, কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমি একটু হয় অ্যাডভেঞ্চার, নইলে রহস্য রাখার পক্ষপাতী, কারণ মূল আকর্ষণ তৈরি করতে পারে সেই রহস্য বা অ্যাডভেঞ্চার। অবশ্য মূল ধারার লেখার লেখনীর গুনেও সেই রচনা আনপুটডাউনেবল হতে পারে, কিন্তুু তবুও আমার একটু রহস্য থাকলেই ভালো লাগে। তবে এটা একেবারেই ব্যাক্তিগত মতামত।
আর, তৃতীয় ধারার কল্পবিজ্ঞান এখন খুবই দরকার। খুবই। এই ধরনের লেখা লিখতে গেলে অনেক বেশি নলেজ দরকার। তাই হয়ত বাংলায় একটু অবহেলিত। তবে ভবিষ্যতে নিশ্চই লেখা হবে।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ পিয়াল চক্রবর্তী অবশ্যই। বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা থাকা খুব দরকার!!
দীপ ঘোষঃ অভিজ্ঞান দা, অনুবাদ সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আপনার কি মনে হয় ?
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ দীপ ঘোষ অবশ্যই অনুবাদ সাহিত্যের অনেক দরকার আছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞান এর মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ হবে। তবে ভালো অনুবাদ দরকার। শ্রদ্ধেয় অদ্রীশ বর্ধনের বিশাল বড় অবদান আছে কল্পবিজ্ঞানের অনুবাদ সাহিত্যে। একই সঙ্গে মৌলিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের প্রয়োজন অনেক বেশী। যেকোনো কল্পবিজ্ঞান সেই স্থান, কাল, সমাজকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারে না। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের একটা নিজস্ব ধারা থাকতে হবে। অনেক অনুবাদ সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালী অনেক পাঠক নিজেকে রিলেট করতে পারবে না কারণ ইংল্যান্ড বা আমেরিকার সমাজ, ব্যক্তিগতজীবন অনেকটাই অন্যরকম। সেখানে সহমর্মিতা, পারিবারিক সম্পর্কের জায়গা অনেক কম। ভায়োলেন্স, প্রযুক্তি নির্ভরতা অনেক বেশী।
প্রতিম দাসঃ মাননীয় অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী … অনুবাদ ঠিক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? অদ্রীশ স্যারের মতো কাটছাঁট করে নিজের মতো লেখা নাকি মূল গল্পের সম্পূর্ণটা থাকা?
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ প্রতিম দাস, এটা অনেক কিছুর ওপরে নির্ভর করে। আমি অবশ্যই মূল গল্প অবিকৃত রেখে অনুবাদের পক্ষপাতী। কিছু ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। আমি দেশ বিদেশের সেরা কল্পবিজ্ঞান বলে একটা বই সম্পাদনা করেছিলাম। অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলাম কিছু গল্পের ক্ষেত্রে সাইজ অন্য গল্পের তুলনায় এতোটাই বেশী যে সেটা সম্পূর্ণ অনুবাদ করলে বইটার আকর্ষণ হারাবে।
সন্তু বাগঃ কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আপনার মতামত পেয়ে সত্যি খুব ভালো লাগল। যে কোনও রকম নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য কল্পবিশ্বের দরজা সব সময় খোলা আছে। আমরা কল্পবিজ্ঞানের বিভিন্ন থিম নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করে চলেছি। আমার মনে হয় গত সাড়ে তিন বছর ধরে নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান গল্পের প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের সামান্য একটু ঢেউ তুলেছে। তার ফলস্বরূপ একের পর এক পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে চলেছে।
দ্বৈতা গোস্বামীঃ কল্পবিশ্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে চলেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যারা কল্পবিজ্ঞান লিখতে এবং পড়তে ভালোবাসেন তাদের জন্য বিশেষ প্ল্যাটফর্ম বাংলায় এমনকী ভারতেও খুব কম। সম্প্রতি একটা গবেষণাধর্মী পত্রিকায় একটা প্রবন্ধে আমি কল্পবিশ্বের নাম উল্লেখ করেছি।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ বেশ কয়েক মাস আগে একটা অল ইন্ডিয়া রেডিও চ্যানেল থেকে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিল কল্পবিজ্ঞানের ওপরে। এটা রহস্য – গোয়েন্দা গল্পের ইন্টারভিউ এর আগে। আমি কল্পবিশ্বের কথা উল্লেখ করেছিলাম। কল্পবিশ্ব কল্পবিজ্ঞানের আইডিয়া এক্সচেঞ্জের একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠলে আরো পাঠক এ বিষয়ে জানতে পারবে। কিছু পত্রিকাও এ বিষয়ে বিশেষ সংখ্যার সাহস দেখাবে। সম্পাদকের যদিও একটা গুরু দায়িত্ব থাকে যাতে সেই সংখ্যার মান ভালো হয়। ১৫ দিনের মধ্যে কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা বার করার কথা ভাবলে, ভালো সংখ্যা কখনও হবে না। কল্পবিজ্ঞানের ভালো লেখার সংখ্যা খুব কম থাকায় অনেকে বিশেষ সংখ্যা করতে ভয় পান।
পিঙ্কি ভট্টাচার্যঃ প্রফেসর শঙ্কুকেও কি আপনি “অতি সাধারণ” গোত্রভূক্ত করছেন? যা পড়ে বিতৃষ্ণা জন্মায়? জানার আগ্রহ রইল।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ না। ওনার লেখা এই ধারার সেরা উদাহরণ আমি লিখেছি। আমার প্রিয় তিনজন কল্পবিজ্ঞান / ফ্যান্টাসি লেখকদের মধ্যে উনি পড়বেন। আমার প্রথম ৩ পছন্দ হল প্রেমেন্দ্র মিত্র, অনীশ দেব ও সত্যজিৎ রায়। তবে ওনার লেখা সবই ফ্যান্টাসি। প্রফেসর শঙ্কুর লেখায় উনি বিজ্ঞান ও লজিকের কথা প্রায় ভাবেন নি। সেটা বেশ কিছু পাঠকের মধ্যে কল্পবিজ্ঞান সম্বন্ধে ভুল ধারণা সৃষ্টি করেছে।
অতসী ফৌজদার বেরাঃ ঠিক এই লাইনটার জন্যই এই পোস্টটা আমার ভালো লেগেছে ।
শঙ্কুর কোন গল্পে এক পার্থিব প্রাণীজগৎ শুধু চিন্তার শক্তিতে সব করতে পারত । তাদের মস্তিষ্কের ওজন বেশী হওয়ার কথা । কিন্তু সেখানে সত্যজিৎ স্যার প্রাণীটির চেহারা দাঁত নখ সর্বস্ব করেছেন । দাঁত ও নখ তাদেরই থাকে যারা শিকার করে । অথচ সে প্রাকৃতিক নিয়ম মানা হয়নি । আর একটি গল্প ছিল ছোট্ট এক গ্রহে নাকি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ঋতু পরিবর্তন হয় । বাচ্চারাও জানে ঋতু কিভাবে পরিবর্তিত হয় । সেটা ছিল ভাইরাস সদৃশ জীবদের গ্রহ । তো তারা কক্ষচ্যুত হয়ে উল্কার মতো গতিতে পৃথিবীতে পড়লে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তারা জীবিত ও গ্রহ অটুট থাকে কিভাবে?
দ্বৈতা গোস্বামীঃ খুবই সমৃদ্ধ করলো এই আলোচনাটা। বিশেষ করে যখন এমন একটা কলম থেকে আলোচনাটা এসেছে যা আমাদের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য লিখতে ও পড়তে অনুপ্রাণিত করছে বহুদিন ধরে। দ্বিতীয় শ্রেণীর যে লেখাগুলোর কথা বলেছেন তা আমাদের ভাবায় বেশি। আপনার বহু গল্প ও উপন্যাসে তার ছাপ সুস্পষ্ট। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কিশোর কল্পবিজ্ঞান সমগ্র পড়ছি। আপনার আলোচনায় এই গল্পগুলোই মনে হয় প্রথম শ্রেণীর গল্প হিসেবে উঠে এসেছে।
এই ধরণের আলোচনা আরও হোক। আপনার প্রিয় বিশ্ব সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞান লেখা ও লেখকদের নিয়েও একদিন আলোচনা করুন।
দীপিকা মজুমদারঃ এপার বাংলায় কিন্তু আরো বেশি অনুবাদ সাহিত্যর প্রয়োজন আছে । এর কারণ একটা বিশাল পাঠকগোষ্ঠী ভাষার দুর্বলতার জন্যে বিদেশী সাহিত্য এড়িয়ে যান। এখন উন্নতমানের কল্পবিজ্ঞান পড়ার মানসিকতা তৈরির জন্যেও অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। আসলে কল্পবিজ্ঞান কনসেপ্ট তো বহিরাগত। ভৌতিক গল্পের চাহিদার সাথে কল্পবিজ্ঞান তুলনা করলে কল্পবিজ্ঞান পিছিয়ে আছে । ভৌতিক গল্প যতটা সাদরে গ্রহণ হয়, কল্পবিজ্ঞান ততটা নয়। তবে কল্পবিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম তফাতটাও লেখকদের ধরতে হবে।
সন্তু বাগঃ একটা কথা মনে পড়ল, অদ্রীশবাবু বার বার বলেন অনেকটা পড়লে একটুখানি লেখা যায়। নতুন কল্পবিজ্ঞান যারা লিখতে আসছেন তাদের এটা মাথায় রাখা খুব দরকার বলে মনে হয়।
সৌমেন দেঃ অনেকদিন ধরেই কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পড়ি। বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সংখ্যা কম বলে এবং যা আছে তার কোনো সম্পূর্ণ তালিকা হাতের কাছে না থাকায় বাধ্য হয়েই বিদেশী সাহিত্যের দ্বারস্থ হতে হয়। বেশ কিছু বিদেশী সাহিত্য (যার অনেকগুলোই মানোত্তীর্ণ নয়) পড়ার পর দেখলাম যে ভিনগ্রহীদের দ্বারা পৃথিবী বা অন্যান্য মানব উপনিবেশের অধিকার, মানবজাতির দাসত্ব এবং অন্য ভিনগ্রহীদের সাথে মানুষের জোট বাঁধার পর আক্রমণকারী ভিনগ্রহীদের বিনাশ বা বিতাড়ন একটা কমন থিম। এছাড়াও পৃথিবীতে কোন দুর্ঘটনার ফলে উন্নত প্রযুক্তির অবলুপ্তি এবং তারপর মানুষের বিভিন্ন দুর্দশা নিয়েও অনেক উপন্যাস লক্ষণীয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েও কিছু উপন্যাস চোখে পড়লো। আরো কিছু পরীক্ষামূলক নতুন ঘরানার লেখা দেখেছি। তবে একটা ব্যাপার প্রায় সবগুলির মধ্যেই রয়েছে, সেটি হল মাত্রাতিরিক্ত হিংস্রতা এবং রক্তপাত এবং অহেতুক যৌনতা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু তারা নগণ্য।
পল্লব রায়ঃ গত ৩০ বছরে বাংলায় প্রচুর “আধুনিক রূপকথা” লেখা হয়েছে বটে তবে কল্পবিজ্ঞান বলতে বাকি দুনিয়া যা বোঝে তার সাথে তুলনায় আসার মতন লেখা খুব কম চোখে পড়েছে। কল্পনা শক্তিতে ভাটার টান আর সেই সঙ্গে বিজ্ঞান এর নিত্য নতুন প্যাঁচ পয়জার এর সাথে মেলবন্ধন করানোর মতন লেখার আইডিয়া না আসা এর জন্য দায়ী (হয়তো!)।
সুমঙ্গল পণ্ডিতঃ কল্পবিজ্ঞানের প্রত্যেকটা ধারা সম্পর্কে সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কল্পবিজ্ঞানের গল্পের কেন্দ্রস্থলে বিজ্ঞানমনস্কতা বা বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকলাপ থাকলেও দরকার একটি নিটোল গল্পের। সেইজন্যই মনে হয় চতুর্থ শ্রেণীটি বিশেষ প্রচার পায়নি। আর ভালো গল্পের জন্যই প্রথম শ্রেণীটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। ক্লাসিক কল্পবিজ্ঞান লিখতে উচ্চ কল্পনাশক্তির প্রয়োজন আর কিছুটা বিজ্ঞান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অভিজ্ঞতাও।
পার্থ দেঃ অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, এই পোস্টটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। শ্রেণীবিন্যাসটিও বেশ ভাল লাগল। প্রফেসর শঙ্কু খুবই সুখপাঠ্য হলেও হয়ত তার স্রষ্টা স্বয়ং মানতেন যে শঙ্কু কল্পবিজ্ঞান নয়। বরং ফ্যান্টাসি। এখানে বর্ণিত দ্বিতীয় শ্রেণীটির কল্পবিজ্ঞান বাংলায় সার্থকভাবে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, বর্তমানে অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর মতো কয়েকজনই লিখেছেন। তৃতীয় শ্রেণীটিতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপভোগ্য করে সার্থকভাবে একজনই লিখেছেন— অনীশ দেব। তাকে বাংলার রে ব্র্যাডবেরী মনে করি! তবে বাঙালি পাঠকের শঙ্কু পড়তে ভাল লাগতেই পারে কিন্তু, মনে করি, তাকে ‘সেরা কল্পবিজ্ঞান’ আখ্যা দিয়ে ভাবের ঘরে চুরি করার কোনো মানে নেই। তবে মনে হয় বর্তমানে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের পাঠকরাও ধীরে ধীরে অনেক পরিণত হচ্ছে। এখন আরও অনেক সার্থক কল্পবিজ্ঞান বাংলায় লেখা প্রয়োজন।
আভাস চক্রবর্তীঃ সাধারণ একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয় কল্পবিজ্ঞানে বিশ্বমানের লেখা বাংলায় হতে গেলে লেখককে বায়োটেকনোলজি,ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি এবং ম্যাথের কিছু অ্যাপ্লায়েড জায়গা নিয়ে বেশ কিছুটা পড়াশোনা করে লিখতে নামা উচিত।
সাথে প্রচুর কল্পবিজ্ঞান পড়া উচিত। ইতিহাসের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের মিশেল অনেকের ভালো লাগে। আবার অনেকের তা পছন্দ নয়। ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে ঠিকঠাক রিসার্চও প্রয়োজন বিশ্বমানের কল্পবিজ্ঞান লিখতে গেলে।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ যার পড়াশোনার ব্যাপ্তি যতো বেশী, তা অবশ্যই তাকে ততো বেশী সাহায্য করবে। আমি নিজে প্রচুর বিষয় ভিত্তিক বই পড়ি আমার নিজের বিষয়ের বাইরে। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনটা খুব ভালো লাগে সারা পৃথিবীর ঘটনা ফলো করতে। তবে সব কিছুর ওপরে কল্পনা!!
দেবকুমার মিত্রঃ বাংলায় এস এফ মানে শঙ্কু, শীর্ষেন্দু এবং ঘনাদা এই আজগুবি কল্পবিলাস জঁর টাকে ধ্বংস করেছে। ওগুলো ফ্যান্টাসি বা অনেক ক্ষেত্রে সাইন্স ফ্যান্টাসি। অদ্রীশ বর্ধণ, অনীশ দেব, সিদ্ধার্থ ঘোষ ছাড়া খুব কম লেখাকে সার্থক সাই ফি বলা যায়। এর প্রধান কারণ, বেশীর ভাগ লেখা হয় বি গ্রেড সাইন্স ফিকশন ফিল্ম এর অনুসরণ বা অনুকরণে। সাইন্স ফিকশন লিখতে হলে সাইন্স, টেকনোলজি জানতে হয় নইলে ইগ্নোরেন্ট পাঠকের কথা মনে রাখলে ইনফ্যান্টাইল সাহিত্য তৈরি হয়।
যশোধরা রায়চৌধুরীঃ বাংলায় ছোটদের জন্য গল্প লেখার ক্ষেত্রটিও তো কতটাই অবহেলিত। সত্যজিৎ ঘরানার কিছুটা আবছায়া রাখা অপ্রাকৃতের গল্প লেখা হয়েই চলেছে হয়েই চলেছে আজো। ছোটদের মনস্তত্ব সম্পর্কে লীলাদির মতো অকাতর না হয়ে, তথাকথিত শিশুপাঠ্য কিছু মিষ্টি কথা, গোলা গোলা করে সুভাষিত বলা হচ্ছে। অথচ পোস্ট ডিজিটাল যুগে ছোটদেরও তো হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা। অত সহজ বাণী দেওয়া জ্ঞান দেওয়া গল্প তাদের হজম হবে কেন? বিদেশি মহিলা বা পুরুষদের ছোটদের জন্য লেখা তো পড়ছি, অনেক জায়গায় বাবা মায়ের ডিভোর্স , সৎ মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক, একা মায়ের লড়াই, বন্ধুদের সঙ্গে সংঘাত সব উঠে আসে সেখানে। সেই ম্যাচিওরিটি আমরা দেখাতে পারি কি?
সৌমেন দেঃ কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের থিম নিয়ে একটু আলোকপাত করবেন? বিশ্বসাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্যের থিমের পার্থক্য কতটা আছে এবং তার প্রয়োজনীয়তা কতটা এই বিষয়ে জানতে ইচ্ছে করে।
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীঃ সবার আগে বলি সবাইকে অনেক বেশী পড়তে হবে, বিশ্ব সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যও। আমি নিজে ক্রিকেট গত তিরিশ বছর দেখি নি বলে যদি বলি গাভাসকারের পরে আর কোন ভালো ব্যাটসম্যান হয় নি, সেটা বলা ঠিক হবে কি? একই সঙ্গে পড়তে হবে বিভিন্ন বিষয়। এখনকার দিনে কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেও বিজ্ঞানের সব বিষয় গভীরভাবে জানা সম্ভব নয়। এটা স্পেসালাইজেশনের যুগ। খুব কম বিজ্ঞানীই মিসিও কাকু বা অ্যালভা এডিশন হন যাদের বিভিন্ন বিষয়ের উপরে সমান দখল থাকে। এবারে থিম নিয়ে লিখি, যা অনেকের প্রশ্নে উঠে এসেছে। কল্পবিজ্ঞানের থিম সে বিদেশী সাহিত্যে হোক বা বাংলা সাহিত্য হোক আলাদা হওয়ার দরকার নেই। তবে এখানে আমাদের থিম আর প্লট এর মধ্যে তফাৎ বুঝতে হবে। থিম হতে পারে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্রেন মেশিন ইন্টারফেস, ক্লোনিং, ন্যানো টেকনোলজি, স্পেস ট্রাভেল, অ্যালিয়েন সভ্যতা, পারসোনালাইজড মেডিসিন, ক্রায়োনিক্স, রোবট, নিউ লাইফ ফর্ম, গ্লোবাল ওয়ারমিং, মহাজাগতিক বিপর্যয়ের মতো অনেক বিষয়। এ সব থিম নিয়ে থাকতে পারে অজস্র গল্প যার ভিত্তি হবে ভিন্ন ভিন্ন প্লট। গল্পের প্লটকে সে জায়গার আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, লাইফস্টাইল খুব বড়ভাবে প্রভাবিত করে। এজন্যই অনেক বিদেশী কল্প বিজ্ঞান আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায় কারণ সে সমাজটা অন্যরকম, দৈনন্দিন জীবনযাপন অনেকটাই অন্যরকম।
এটাই এবারের কলকাতা লিটারেচর ফেস্টিভালে আমাদের জঁর ফিকশনের উপরে আলোচনার বিষয় ছিল যেখানে স্কটল্যান্ডের সাহিত্যিক ভ্যাল ম্যাকডরমড, গরডন ব্রাউন ও দুজন ফ্রেঞ্চ সাহিত্যিকও আমার সঙ্গে আলোচনায় ছিলেন।এখানে থিম আর প্লট এর তফাৎ বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিই। আমার ‘মাঝে মাত্র চব্বিশ দিন’ উপন্যাসের মূল থিম ‘অ্যাস্টেরয়েড সংঘর্ষ’ – যা নিয়ে আরও কিছু গল্প বা উপন্যাস আছে। কিন্তু এখানে প্লট হচ্ছে একদম অন্যরকম যার মূলে দাঁড়িয়ে আছে হিউম্যান মাইগ্রেশন। আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা একটা ছোট গ্রুপ বা উপজাতির সুমাত্রার টোবা অগ্নুৎপাতের সময়ে আটকে পড়া ও সত্তর হাজার বছর ধরে সে উপজাতির অন্য ধরণের বিবর্তন, যার জন্য এই উপজাতি অ্যাস্টেরয়েড সংঘর্ষের পরবর্তী সময়ে বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। আমি নিশ্চিত এ ধরণের প্লট নিয়ে বিশ্ব সাহিত্যে আগে কোন লেখা হয় নি। এখানে বিবর্তনকে সাবথিমও বলা যেতে পারে। এবারেও শারদীয়া শুকতারায় যে উপন্যাস লিখছি তার মূল থিম আরটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (যেটা অনেকটাই আমার বিষয়) হলেও গল্পের প্লটে মেসিন লারনিং, কনশাসনেস,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রহস্য আরও অনেক কিছু জড়িত আছে যা উপন্যাসটাকে অন্য সব লেখার থেকে স্বতন্ত্র করে তুলবে বলে আমার ধারণা।
কোথায় কখন ঘটনা ঘটছে, কারা সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তার একটা বড় প্রভাব গল্পের প্লটে চলে আসে তা না হলে সে প্লট বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। যদি লিখতে গিয়ে লিখি মাদ্রিদের সিটি সেন্টারে রাত ন’টায় জনশূণ্য রাস্তা, বা যদি লিখি ফিনল্যানডে হেলসিঙ্কিতে নভেম্বর মাসে রাস্তায় রাত দশটায় কয়েকজন মিলে বসে আড্ডা মারছে, তা সঙ্গে সঙ্গে ভালো পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। অনেক সময় এ সব ছোট ডিটেলসও প্লটে বড় ভূমিকা পালন করে।আরেকটা জিনিসও মাথায় রাখতে হয় যাদের জন্য লিখছি সেই পাঠকরা ওই প্লটের সঙ্গে, ওই চরিত্রগুলোর সঙ্গে রিলেট করতে পারবে কিনা। এ জন্য কিছু ভারতীয় চরিত্র ও ঘটনা রাখার কথা আমাদের ভাবতে হয়। কল্পবিশ্ব’র কাছে একটা অনুরোধ আছে। বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের বিভিন্ন থিম ও প্লট নিয়ে কি কি উপন্যাস বা উপন্যাসিকা লেখা হয়েছে তার উপরে একটা ইন্ডেক্স তৈরি করা যেতে পারে। এটা একটা দারুণ কাজ হবে। নতুন লেখক ও পাঠকরা খুব ভালো গাইডেন্স পাবে।
এই আলোচনাটা বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের বর্তমানকে জানার পাশাপাশি ভবিষ্যতের একটা রূপরেখা বানানোতেও বিরাট ভূমিকা নেবে। আরও বেশি পাঠক এটা পড়ুন, এটুকুই চাইব।