বাতাসে মৃত্যুর ফাঁদ – অ্যালফ্রেড বেস্টার
লেখক: বাংলা অনুবাদঃ সৌমেন চ্যাটার্জি
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
যেদিন আমরা পালিয়েছিলাম প্যারাগন ৩ থেকে, ঠিক সেই সন্ধেবেলাই সেখানে হাজির হল এক সশস্ত্র সৈন্যর দল। এদের দেখলে মনে হবে যেন পাথর দিয়ে কোঁদা। একই ছন্দে চলেছে সবকটা। অথচ প্রত্যেকেরই অভিপ্রায় যেন এক। প্রত্যেক সৈন্যরই সঙ্গে আছে বন্দুক, ওয়াকি–টকি, কানে লাগানো স্পিকার বাটন, গলায় মাইক্রোফোন, হাতে চকচকে সবুজ ভিউস্ক্রিনওলা ঘড়ি।
কয়েকশো মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্যারাগন ৩ এর চকমেলানো ধানক্ষেতে তখন হাওয়ার জন্য শোনা যাচ্ছে মর্মরধ্বনি, সন্ধ্যের মুখে রাঙাভাঙা আকাশ থেকে সূর্য পাড়ি জমিয়েছে অস্তাচলের পথে, ধুসর মেঘগুলো কোন বাজিকরের ফুসমন্তরে গায়েব। এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখলে কেউ হয়ত দু চার লাইন কবিতা লিখে ফেলতেন, কিন্তু এই সৈন্যরা এইসব উপভোগ করার জন্য এখানে আসেনি। তাদের হাতের সবুজ ভিউস্ক্রিনওলা ঘড়িতে ফুটে উঠেছে ধানক্ষেতের মধ্যে অনেক রাস্তার ম্যাপ। সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো
– জেনসনের এদিকে তো কিছুই পাওয়া গেল না।
– তোমরা মনে হয় পশ্চিমদিকে অনেকটা বেশি চলে এসেছ।
– গ্রিমসনের জমির দিকটা কেউ কভার করেছে?
– হ্যাঁ, কিছুই পাই নি।
– মেয়েটা মনে হয়না এদ্দুর হেঁটে আসতে পারবে।
– হয়ত কেউ বয়ে নিয়ে এসেছে।
– কি মনে হয় বেঁচে আছে?
– খামোখা মরবেই বা কেন?
– কথা বলতে বলতে সৈন্যর দল সাপের মত এঁকেবেঁকে চলতে লাগলো।
– এদিকে তো কিছুই পাওয়া গেল না।
– এদিকেও।
– অ্যালেনের জমির দিকটা কেউ কভার করেছে?
– যাচ্ছি ওদিকেই।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর আবার শোনা গেল ওয়াকি–টকির শব্দমালা।
– অ্যালেনের এদিকেও সব ক্লিয়ার।
– আমাদের আবার গোড়া থেকে খুঁজতে হবে।
– সে তো সারারাতের মামলা।
– লাগুক সারারাত। মেয়েটাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
– সেক্টর সেভেন। টিউন ইন। মেয়েটাকে পেয়েছি।
সৈন্যর সারি এবার থামল। কিছুক্ষণ আবার সব চুপচাপ। সবাই যে যার নিজের হাতের ঘড়ির ভিউস্ক্রিন দেখে টিউন করতে লাগল সেক্টর সেভেনের দিকে। তারপর এগোতে লাগলো সেদিকে। কিছুক্ষণ এগোবার পর তারা এসে থামল তাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। ধানক্ষেতের একটা জায়গায় কাদাজলের মধ্যে ভেসে উঠেছে একটা বাচ্চা মেয়ের নগ্নদেহ। গলায় আঙুলের দাগ স্পষ্ট। নিষ্পাপ মেয়েটার মুখ ক্ষতবিক্ষত,শরীরও ছিন্নভিন্ন। চামড়ায় ইতিউতি জমাট বাঁধা রক্তের দাগ। মেয়েটার মৃতদেহের দিকে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সৈন্যর দল। এই হতভম্ব ভাব কাটল একজন সৈন্যর কথায়।
– দেখে মনে হচ্ছে তিন চার ঘণ্টা আগে মারা গেছে।
– কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করো, মেয়েটার মুখের ভেতরটা কিন্তু শুকনো।
– ডুবে মরে নি। আগে কোথাও মেরে এখানে এনে ফেলে দিয়েছে।
মেয়েটার লাশ যেখানে পড়ে ছিল, তার ঠিক পাশ থেকেই শুরু হচ্ছে ভ্যান্ডালেয়ারের ক্ষেতের সীমারেখা। তামার প্লেটে জ্বলজ্বল করছে ভ্যান্ডালেয়ারের নাম। সৈন্যরা আর কথা না বাড়িয়ে ধরাধরি করে মেয়েটার লাশ তুলে নিল।
হঠাৎ একজন সৈন্যর নজর পড়ল মেয়েটার হাতের নখের দিকে। সেখানে লেগে থাকা রক্ত তখনও জমাট বাঁধেনি। মেয়েটা যে তার খুনির বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্ত অব্ধি লড়েছিল, তার প্রমাণ রয়েছে তার নখে লেগে থাকা মাংসের টুকরো আর আর লাল টকটকে জমাট না বাঁধা রক্তে।
অবাক হয়ে সেই সৈন্য বলল – “আজব ব্যাপার, এতক্ষণে তো রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার কথা”
– উঁহু, ব্যাপারটা খুব একটা আজব অন্তত আমার কাছে ঠেকছে না। একটা কথা বলো তো দেখি, কোন ধরণের রক্ত জমাট বাঁধে না?
– অ্যানড্রয়েড।
– মনে হচ্ছে কোন অ্যানড্রয়েড রোবট মেয়েটাকে মেরেছে।
– ভ্যান্ডালেয়ার নিজেই তো একটা অ্যানড্রয়েডের মালিক।
– এবং মেয়েটার নখে অ্যানড্রয়েডের রক্তই লেগে আছে।
– পুলিশ এ ব্যাপারে তদন্ত টদন্ত করে ঠিক বলতে পারবে।
– কিন্তু যতদূর জানি অ্যানড্রয়েড তো খুন করতে পারে না।
– কিন্তু মেয়েটার নখে লাগা রক্ত যে অ্যানড্রয়েডের সেটা তো বুঝতে পারছ।
– কিন্তু অ্যানড্রয়েডদের যেভাবে তৈরি করা হয়, তাতে তো তাদের খুনি হওয়া সম্ভব নয়।
– দেখে মনে হচ্ছে নিদেনপক্ষে একটা অ্যানড্রয়েডকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছিল।
– সর্বনাশ!
সেদিন থার্মোমিটার অবশ্য তাপমাত্রা দেখিয়েছিল ৯২.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
এবার আসা যাক মেগাস্টার জেমস ভ্যান্ডালেয়ার ও তার অ্যানড্রয়েডের কথায়। প্যারাগন কুইন জাহাজের সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে বসে ভ্যান্ডালেয়ার তার পুঁজির হিসেব করছিল। হিসেব করতে গিয়ে তার পুঁজির হাল দেখে তো চোখ ফেটে জল বেরিয়ে যাবার জোগাড়! সেই সময় ভ্যান্ডালেয়ারের সাথে কেবিনে ছিল একটা অ্যানড্রয়েড। নানারকম কাজ করতে পারা অ্যানড্রয়েডটাকে দেখতেও ছিল বেশ জমকালো। নীল চোখওয়ালা এই অ্যানড্রয়েডের দাম ৫৭০০০ ডলার। কপালে আবার M আর A এই দুটো অক্ষর খোদাই করা। সে চুপচাপ বসে জুলজুল করে টাকা গোনার সাথে কান্নার রগড় দেখছিল।
ওদিকে ভ্যান্ডালেয়ার কাঁদতে কাঁদতে হিসেব করে চলেছে, ‘বারো, চোদ্দ, ষোলো… ষোলো হাজার ডলার। আমার বাড়ির দামই দশ হাজার ডলার। জমির দাম হাজার পাঁচেক, গাড়ি, দামি পেইন্টিং, আসবাব, আমার প্লেন, আমার ঠাঁটবাট সব মিলিয়ে কিনা ষোলো হাজার ডলার … হে ভগবান!’ মাথার মধ্যে যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে ভ্যান্ডালেয়ারের। সে এবার চামড়ার ব্যাগ থেকে একটা বেল্ট খুলে নিল। তারপর কষে এক ঘা লাগাল সামনে পেতলের রাধিকার মত বসে থাকা অ্যানড্রয়েডটাকে। কিন্তু নট নড়ন চড়ন!
অ্যানড্রয়েড এবার স্বকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই স্যার, আমার বর্তমান বাজারে দাম সাতান্ন হাজার ডলার। আপনি আবেগের বশে নিজেই নিজের সবথেকে দামি সম্পত্তির ক্ষতি করছেন স্যার’।
‘দামি সম্পত্তির একশো আট বার, শালা খুনে মেশিন!’ চিৎকার করে উঠল ভ্যান্ডালেয়ার। তার রাগ এখন সপ্তমে।
নিরুত্তাপ ভাবে অ্যানড্রয়েড উত্তর দিল, “আমি কোন মেশিন নই স্যার, রোবটরা মেশিন। অ্যানড্রয়েড হল রাসায়নিক ভাবে তৈরি করা কৃত্রিম কোষের যোগফল।”
‘নিকুচি করেছে রাসায়নিক যোগফলের” – ভ্যান্ডালেয়ার কষে আর এক ঘা লাগাল অ্যানড্রয়েডটাকে। ‘বল কেন এরকম করলি, জবাব দে।’
অ্যানড্রয়েড ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘প্রথমত আপনাকে বলি স্যার, অহেতুক তুই তোকারি শুনতে আমি অভ্যস্থ নই। দ্বিতীয়ত আপনার জেনে রাখা উচিত আপনি এভাবে আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না। আনন্দ দুঃখের এইসব অনুভূতি অ্যানড্রয়েডের ক্ষেত্রে খাটে না।’
‘তাহলে ওই মেয়েটাকে কেন খুন করলি বল?’ ভ্যান্ডালেয়ার চিৎকার করে উঠল।
‘আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই স্যার, জাহাজের এই সেকেন্ড ক্লাস কেবিনগুলো কিন্তু সাউন্ডপ্রুফ নয়’ ঠাণ্ডা গলায় বলল অ্যানড্রয়েড। এবার ওষুধে কাজ হল। ভ্যান্ডালেয়ার বেল্টটা ফেলে দিল মাটিতে। সে এখন হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতেই যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে ভ্যান্ডালেয়ার বলল, ‘তাহলে মেয়েটাকে খুন করলে কেন’? তুই উঠে এসেছে তুমিতে।
‘আমি জানি না’ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর এল অ্যানড্রয়েডের তরফ থেকে।
‘আমি জানতাম অ্যানড্রয়েডরা কোনরকম ধ্বংস আর ক্ষতি করে না, উফফ, প্রথম থেকে যদি এই ছোটোখাটো ঘটনাগুলো এড়িয়ে না যেতাম, আজ এই খুনটা হতই না’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার।
‘আবারও বলছি স্যার, আনন্দ দুঃখের এইসব অনুভূতি অ্যানড্রয়েডের ক্ষেত্রে খাটে না’ নিরুত্তাপ গলায় বলল অ্যানড্রয়েড। ‘রিগেলের সেই ইঞ্জিনিয়ারটাই সবকিছুর জন্য দায়ী। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল!’ নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগল ভ্যান্ডালেয়ার। ভ্যান্ডালেয়ারের কথা শুনেই অ্যানড্রয়েড বলল, ‘সার্কিটের সমস্যা বোঝার জন্য অ্যানড্রয়েডের মগজে কোন সেলফ চেক রিলের মত তড়িৎচুম্বকীয় সুইচের ব্যবস্থা নেই’।
ভ্যান্ডালেয়ারের মেজাজ আবার বিগড়েছে, ‘এই দুনিয়ার সব থেকে পয়সাওলা লোকের ছেলে হয়েও শুধু ষোলো হাজার ডলার নিয়ে বসে আছি জাহাজের এই সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে। শুধু তোমার জন্য আজ আমার এই হাল’।
ভ্যান্ডালেয়ার আবার বেল্টটা তুলেছিল মারার জন্য। কিন্তু কি মনে করে আবার রাগটাকে সামলে নিল। তারপর বেল্টটা ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এবার মন দিয়ে শোন, এখন থেকে আমার নাম জেমস ভ্যালেন্টাইন। আমি এই জাহাজে শুধু একদিনের জন্য এসেছি অ্যানড্রয়েডের লেনদেনের ব্যাপারে ভ্যান্ডালেয়ারের সাথে দেখা করতে। কিছু ব্যবসায়িক কাগজপত্রেরও লেনদেন হবে। এবার জলদি তোমার কাজ শুরু করো’। অ্যানড্রয়েড ব্যাগ থেকে ভ্যান্ডালেয়ারের পাসপোর্ট আর কাগজপত্র বের করল। তারপর নিখুঁত হাতে বানাতে লাগল ভ্যান্ডালেয়ারের নতুন পরিচয়।
ভ্যান্ডালেয়ারের জন্য নানারকম গয়নার ডিজাইন বানাত ডালাস ব্র্যাডি নামের এক মহিলা। বেঁটে– খাটো, তাগড়াই চেহারার এই মহিলার একটু কুখ্যাতি ছিল তার কামুক স্বভাবের জন্য। সে আবার ভ্যান্ডালেয়ারের নানারকম কাজে পারদর্শী অ্যানড্রয়েড রোবটকে কাজে লাগিয়েছিল নিজের কারখানায়। আপাতত সে শুয়ে আছে ভ্যান্ডালেয়ার ওরফে জেমস ভ্যালেন্টাইনের সাথে। বিছানা গরমের কাজ শেষ। ভ্যান্ডালেয়ার চোখ বুজে শুয়ে, হঠাৎ করেই ডালাস প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম তো ভ্যান্ডালেয়ার, তাই না?’ ‘হ্যাঁ’ বিড়বিড় করে ভ্যান্ডালেয়ার বলে উঠল। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, ‘না না, আমার নাম জেমস ভ্যালেন্টাইন’। সে কথায় কান না দিয়ে ডালাস জিজ্ঞেস করল, ‘প্যারাগনে ঠিক কি হয়েছিল বল তো? আমার তো ধারণা ছিল অ্যানড্রয়েডদের যে ভাবে তৈরি করা হয় তাতে কোনরকম ধ্বংসাত্মক খুনে প্রবণতা হবার কথা না, কোম্পানিগুলোও সেই গ্যারান্টি দেয়’। ‘ভ্যালেন্টাইন’ করুণভাবে আবার বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘উফফ, এক সপ্তাহ ধরে এক কথা শুনে শুনে কান পচে গেল। কি চাও এবার আমি পুলিশ ডাকবো?’ ডালাস ফোনটা হাতে নিয়ে বলল। ‘এরকম কোর না ডালাস’ ভ্যান্ডালেয়ার ডালাসকে বাধা দিতে গেল, তারপর অসহায়ভাবে বিছানায় আত্মসমর্পণ করল। তার হাল দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল ডালাস। ‘কি করে সব জানলে তুমি?’ ক্লান্তস্বরে ভ্যান্ডালেয়ার প্রশ্ন করল। ‘কাগজগুলোই তো সবথেকে বড় প্রমান সোনা। তাছাড়া ভ্যালেন্টাইন আর ভ্যান্ডালেয়ার নামদুটোর মধ্যে খুব বেশি ফারাক আছে কি? এতদুর যখন এগোলে, আর একটু বুদ্ধি খাটালেই তো পারতে’ বলল ডালাস। ‘কি আর করবো বলো, আমি কোনকালেই তেমন বুদ্ধিমান ছিলাম না’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘সে যাই হোক, তোমার অ্যানড্রয়েডের রেকর্ড তো সাংঘাতিক! প্রথমে হামলা, তারপর অগ্নিকাণ্ড, তারপর ধ্বংসলীলা– এবার বলো তো চাঁদু, ঠিক কি হয়েছিল প্যারাগনে?’ প্রশ্ন করল ডালাস। ‘অ্যানড্রয়েডটা একটা বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করেছিল। তারপর ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে খুন করে’ ভ্যান্ডালেয়ার বলল।
– ধর্ষণও তো করেছিল?’
– জানি না।
– সবাই তো তোমার পেছনে ফেউয়ের মত লেগেছে।
‘সেটা কি আমি জানি না?’ খিঁচিয়ে উঠল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘দু বছর ধরে সাতটা গ্রহ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি’।
‘আমার মনে হয় অ্যানড্রয়েডটা হঠাৎ কেন বিগড়োল, সেটা তুমি আগে খুঁজে বের করো’ বলল ডালাস।
আবার মেজাজ বিগড়োল ভ্যান্ডালেয়ারের, ‘কিভাবে? সারাইখানায় গিয়ে বলব, ও মশাই আমার অ্যানড্রয়েডটা বিগড়ে গিয়ে হঠাৎ করে খুনখারাপি শুরু করেছে, একটু সারিয়ে দিন তো! তারা তারপর পুলিশকে ফোন করবে, অ্যানড্রয়েডটাকে ভেঙ্গেচুরে সাইজ করতে সময় লাগবে বড়জোর একদিন। আর খুনে অ্যানড্রয়েডের মালিক হিসেবে আমার ঠাই হবে জেলে’ কাঁপতে কাঁপতে বলল ভ্যান্ডালেয়ার।
‘তাহলে খুন করার আগে তুমি ওটাকে সারিয়ে নাও নি কেন?’ প্রশ্ন করল ডালাস।
‘আমার পক্ষে সেটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে যেত ডালাস। কারণ কে বলতে পারে সারাইয়ের নামে হয়ত আরও বিগড়ে রেখে দিত অ্যানড্রয়েডটাকে। তখন আমার চলত কিভাবে?’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার।
‘তাহলে তুমি নিজেই সারিয়ে নিলে না কেন? তাহলে হয়ত এত সমস্যা তৈরি হত না’ ডালাস বলল।
ভ্যান্ডালেয়ারের মেজাজ আরও খারাপ হল, ‘তোমার কি মনে হয়, আমার মত একটা মাকাল ফলের পক্ষে এইসব অ্যানড্রয়েডের প্যাঁচ পয়জার বোঝা সম্ভব?’
‘তাও বটে’ ডালাস বলল।
‘সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলাম বুঢঢা বাপের সাথে। মরার আগে আমার জন্য মালটা রেখে গেল এই অ্যানড্রয়েড! এ নাকি আমার ভাগ্যই পাল্টে দেবে! পাল্টাচ্ছেই বটে! এখন আমাকে বাঁচতে গেলে এই অ্যানড্রয়েডের ভরসাতেই বাঁচতে হবে। আর কোন গতি নেই’ ভ্যান্ডালেয়ারের গলায় এখন হতাশা।
‘একটা কাজ করতে পারো। অ্যানড্রয়েডটাকে বেচে দিয়ে সেই টাকাটা অন্য কোথাও লগ্নি করতে পারো’ ডালাস বলল।
‘৩% হারে আমি যা কামাব, তার থেকে অনেক বেশি টাকা এ আমাকে দিতে পারবে। আমাকে এর সাথেই এগোতে হবে’ ভ্যান্ডালেয়ার বলল।
‘কিন্তু এর খুনে স্বভাবের জন্য কি করবে তুমি?’ ডালাস প্রশ্ন করল।
‘আমার শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই ডালাস। তা তুমি হঠাৎ এটাকে নিয়ে এত চিন্তা শুরু করলে কেন?’ ভ্যান্ডালেয়ার প্রশ্ন করল ডালাসকে। ডালাসের মুখে এক অদ্ভুত হাসি খেলে গেল। সে বলল, ‘আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজে আমার কোন লাভ নেই। তবে আমার মুখ বন্ধ রাখার জন্য কিছু দাবি আমি করতেই পারি, তাই না?’ “কি!!!” শিউরে উঠল ভ্যান্ডালেয়ার। ডালাস বলল, ‘অ্যানড্রয়েডটা এখন আমার হয়ে কাজ করবে ফ্রিতে। তোমার কাজের জন্য তুমি টাকা অন্য লোকের থেকে জোগাড় করতেই পারো, কিন্তু আমার কাজ হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে’ ।
তা ডালাস ব্র্যাডির কথাই রইল। অ্যানড্রয়েড কাজ করতে লাগল তার কারখানায়। পাশাপাশি ভ্যান্ডালেয়ারও নিয়মিত টাকা পেতে লাগল। তার হাঁড়ির হাল কেটে গেল অচিরেই। কিন্তু ডালাস যেটা খেয়াল করে নি, সেটা হল ভ্যান্ডালেয়ার ইতিমধ্যে নানারকম বিষয় আশয়, জমিজমার খোঁজ করতে লেগেছিল খুঁটি গাড়ার জন্য, ডালাস ব্র্যাডির লোভের পারদ আরও চড়বার আগেই। এদিকে ঘটল এক আজব কাণ্ড! এক গ্রীষ্মের সকালে ডালাস ব্র্যাডির কারখানায় অ্যানড্রয়েডটা হঠাৎ অদ্ভুত সুরে একটা মান্ধাতা আমলের গান থেমে থেমে গাইতে শুরু করল। গানের সাথে সাথে আবার সে তার আঙ্গুলগুলো মাথার পেছনে নিয়ে গিয়ে তালও দিতে লাগল। ডালাস ব্র্যাডি কারখানায় ঢুকে অ্যানড্রয়েডের কীর্তি দেখে হাঁ!
‘এত ফুর্তি কিসের?’ প্রশ্ন করল ডালাস।
ঠাণ্ডা গলায় অ্যানড্রয়েড উত্তর দিল, ‘আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি আনন্দ, ফুর্তি, দুঃখ – এইসবের সাথে অ্যানড্রয়েডের কোন সম্পর্ক নেই’।
তারপর আবার গান ধরল। এবার সে একজোড়া ইস্পাতের আঁকশি তুলে নিয়ে সেগুলো দিয়ে জ্বলন্ত চুল্লির দিকে ছুঁড়ে দিল, চুল্লির আগুন আর একটু উস্কে উঠল।
‘আরে মরতে চাও নাকি হাঁদারাম? সাবধানে কাজ করো’ – চেঁচিয়ে উঠল ডালাস।
‘আপনাকে মনে করিয়ে দি, আমার বর্তমান বাজারদর ৫৭০০০ ডলার। তাই দামি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন অমার্জনীয় অপরাধ’ বলেই অ্যানড্রয়েড ফের গান ধরল।
তারপরেই যেটা ঘটল সেটা অকল্পনীয়! অ্যানড্রয়েড একতাল গলানো সোনা ছিটিয়ে দিল ডালাস ব্র্যাডির মাথা লক্ষ্য করে। মৃত্যু চিৎকার করে উঠল ডালাস। প্রবল যন্ত্রণায় তার দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ল। তার মাথার চুল আর জামাকাপড়েও আগুন ধরে গেছে! চড়বড় শব্দে ফাটতে শুরু করেছে চামড়া, কিন্তু তখনও অ্যানড্রয়েডের কাজ শেষ হয় নি। সে আরও একতাল গলানো সোনা ছিটিয়ে দিল ডালাসের শরীরে। সঙ্গে চলল নৃত্যসহযোগে তার সেই বিচিত্র গান! যতক্ষণ না ডালাসের গোটা শরীর গলানো সোনায় পুরোপুরি মিশে গেল, তার এই কাজ চলতেই থাকলো। কাজ শেষ হলে সে রওনা দিল ভ্যান্ডালেয়ারের হোটেল স্যুটের দিকে। অ্যানড্রয়েডের আগুনে পোড়া জামা আর আঙুল অনেককিছুর সাক্ষী দিচ্ছিল। অ্যানড্রয়েডের হাল দেখেই ভ্যান্ডালেয়ার দৌড় লাগাল ডালাসের কারখানার দিকে। সেখানকার অবস্থা দেখে ভ্যান্ডালেয়ারের অবস্থা শোচনীয়! সে বমি করতে করতে জ্ঞান হারাল। তারপর আবার সেই পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। জিনিসপত্র গুছিয়ে আবার ভ্যান্ডালেয়ার ও অ্যানড্রয়েড ‘দুই মূর্তি’ রওনা দিল অজানার উদ্দেশ্যে। পুরোপুরি অজানা অবশ্য নয়, লায়রা আলফা নক্ষত্রগামী মেগাস্টার কুইন জাহাজের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ‘দুই মূর্তি’–র জায়গা মিলল। তারপর আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, ভ্যান্ডালেয়ারের পুঁজির হিসেব, কান্না, মাথা গরম ও অ্যানড্রয়েডকে বেল্টের ঘা!
আর একটা কথা, ডালাস ব্র্যাডির কারখানায় থার্মোমিটার তাপমাত্রা দেখিয়েছিল ৯৮.১ ডিগ্রি ফারেনহাইট!
লায়রা আলফায় ইউনিভার্সিটির পাশেই একটা ছোট হোটেলে তার ‘পুরাতন ভৃত্য’ করিতকর্মা অ্যানড্রয়েডকে নিয়ে আস্তানা গাড়ল ভ্যান্ডালেয়ার। এখন তার নাম জেমস ভেনিস। ভ্যান্ডালেয়ার অ্যানড্রয়েডের কপালের M আর A অক্ষরদুটো খুব সাবধানে উঠিয়ে দিল। এমনিতেই ওগুলো চটে গিয়েছিল, আপাতত মাসখানেকের আগে ওগুলো আর ফুটে উঠবে না। অ্যানড্রয়েড ইউনিভার্সিটির পাওয়ার প্ল্যান্টে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে যোগ দিল আর সেই অল্প আয়েই ভ্যান্ডালেয়ার ওরফে জেমস ভেনিসের দিন কাটতে লাগলো। হোটেলে ভ্যান্ডালেয়ারের দিনগুলো মন্দ কাটছিল না। হোটেলের বেশিরভাগ বাসিন্দাই ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। তাদের মধ্যে ওয়ান্ডা বলে একটা চুলবুলে মেয়ের সাথে ভ্যান্ডালেয়ারের বেশ দোস্তি হয়ে গেল। ওয়ান্ডা আর তার প্রেমিক জেড স্টার্কের আবার এই খুনে অ্যানড্রয়েডের ওপর ব্যাপক আগ্রহ! আগ্রহ হওয়াটা অবশ্য বিচিত্র কিছু নয়। বিশ্বব্রম্ভাণ্ডের সমস্ত খবরের কাগজে তখন এই খুনে অ্যানড্রয়েডকে নিয়ে খবরে খবরে ছয়লাপ। একদিন ভ্যান্ডালেয়ারের ঘরে বসে তার সাথে আড্ডা দিচ্ছিল ওয়ান্ডা আর জেড। এটা সেটা কথা হতে হতে কিভাবে যেন এসে পড়ল খুনে অ্যানড্রয়েডের প্রসঙ্গ, সেই সুত্রেই জেড বলল– ‘আমরা অনেকদিন ধরেই এই কেসটা স্টাডি করছি, বুঝলেন মিঃ ভেনিস। মনে হয় আমরা বুঝতে পেরেছি, অ্যানড্রয়েডটা হঠাৎ করে এরকম খুনে হয়ে উঠল কেন। আমরা তো ভেবেছি এটার ওপর একটা থিসিস পেপার রেডি করব’। ‘বল শুনি কেন এরকম হল?’ ভ্যান্ডালেয়ার ওরফে ভেনিস প্রশ্ন করল। ‘অবশ্যই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে না পারার জন্য। হয়ত সিন্থেটিক ক্যান্সারের মত কিছু’ বলল জেড। ‘ধুস, ওসব কিছুই নয়’ ওয়ান্ডা মুখে সবজান্তা হাসি নিয়ে বলল। এক্কেবারে অন্যরকম কিছু’ ওয়ান্ডা চুলবুলে চাউনি নিয়ে তাকাল ভ্যান্ডালেয়ারের দিকে। ‘তাহলে কি?’ ভ্যান্ডালেয়ার তার কৌতূহল আর চাপতে পারল না। ‘আসলে অ্যানড্রয়েডের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আমাদের সকলেরই জানবার খুব আগ্রহ’ ওয়ান্ডাকে ভজাবার চেষ্টা করল ভ্যান্ডালেয়ার। কিন্তু তার সেই চেষ্টা বিফল হল। ‘না মিঃ ভেনিস, আমি দুঃখিত এর বেশি আপনাকে বলতে পারব না। আমরা এই অভিনব বিষয়টার ওপর যে থিসিসটা লিখছি, সেটা আমাদের জীবন পাল্টে দিতে পারে। তাই যাতে আমাদের আইডিয়া কেউ চুরি না করে, আমরা সবসময় সেইদিকে নজর রাখছি’ বলল ওয়ান্ডা। ‘আরে গাছে তুলে মই কেড়ে নিলে চলে? একটু তো কিছু বলো’ একটু ন্যাকামি করার চেষ্টা করল ভ্যান্ডালেয়ার। জেড হয়ত কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওয়ান্ডা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল– ‘না জেড, আর একটি শব্দও নয়। শুধু একটা কথাই বলব মিঃ ভেনিস, আমি মনেপ্রাণে চাইব কখনো যেন এরকম অ্যানড্রয়েডের মালিক না হই’। ‘পুলিশের কথা বলছ?’ ভ্যান্ডালেয়ার প্রশ্ন করল। ‘না মিঃ ভেনিস আমি পুলিশ নয়, বলছি প্রতিচ্ছবির কথা, প্রতিচ্ছবি। আমরা যা দেখছি, আসল সত্যিটা হয়ত তা নয়, আর আসল বিপদটা লুকিয়ে আছে সেখানেই। আমার মনে হয় আমি আপনাকে যা বলার তার থেকে অনেক বেশিই বলে ফেলেছি’ থামল ওয়ান্ডা। ইতিমধ্যে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে ঢুকল অ্যানড্রয়েড। ইউনিভার্সিটির পাওয়ার প্ল্যান্টে আজকের মত তার কাজের ইতি। অ্যানড্রয়েড জিনিসটা ইউনিভার্সিটি চত্বরে তেমন অবাক হবার মতন ব্যাপার নয় অবশ্য। পয়সাওলা ছাত্রছাত্রীদের কাছে গাড়ি আর প্লেনের মতই নিজস্ব অ্যানড্রয়েডও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই অ্যানড্রয়েডটিকে দেখে ওয়ান্ডা একটু হলেও অবাক হল। কারণ অনেকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও ওয়ান্ডার তীক্ষ্ণ চাউনি অ্যানড্রয়েডের কপালের বেমানান রং চটা অংশটা ঠিক লক্ষ্য করল। কিন্তু চতুর ওয়ান্ডা এই ব্যাপারটা কাউকে বুঝতে দিল না। অ্যানড্রয়েডের আনা বিয়ার খেয়ে অল্প গুলতানি করে সে ও জেড ভ্যান্ডালেয়ার ওরফে ভেনিসকে বিদায় জানাল। ওপরতলায় নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে ওয়ান্ডা জেডকে বলল, ‘একটা ব্যাপার বলতো জেড, মিঃ ভেনিসের অ্যানড্রয়েডটার কপালের জায়গাটা ওরকম রং চটা কেন?’ ‘হয়ত পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করতে গিয়ে কোন ভারি জিনিসে লেগে ওরকমভাবে চটে গেছে’ বলল জেড। ‘শুধু কি তাই?’ প্রশ্ন করল ওয়ান্ডা। ‘আর কি হতে পারে?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্ন করল জেড। ‘আমার মনে হয় অ্যানড্রয়েডটার কপালে এমন কিছু খোদাই করা ছিল, যেটা ইচ্ছাকৃতভাবেই তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে’– দৃঢ়ভাবে বলল ওয়ান্ডা। ‘কিন্তু কেউ খামোখা এরকম করবে কেন? সবাই তো জানে ওটা অ্যানড্রয়েড’ প্রশ্ন করল জেড। ‘হয়ত কোন কারণে মিঃ ভেনিস তাঁর এই অ্যানড্রয়েডটাকে নিম্নশ্রেণীর অ্যানড্রয়েড হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন’ ওয়ান্ডা বলল। ‘কিন্তু তাতে তাঁর কি লাভ?’ আবার প্রশ্ন করল জেড। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জেডের দিকে তাকিয়ে ওয়ান্ডা বলল, ‘আচ্ছা ধরো, হয়ত এই অ্যানড্রয়েডটার কপালে লেখা ছিল “M” আর “A”’ জেডের এবার চক্ষু ছানাবড়া! সে বলল, ‘M আর A!! তার মানে Multiple Aptitude অ্যানড্রয়েড! তাহলে মিঃ ভেনিস এরকম সবকাজে পারদর্শী একটা অ্যানড্রয়েডকে শুধু শুধু ইউনিভার্সিটির পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করাচ্ছেন কেন, এর থেকে তো অনেক বেশি আয় …. এক মিনিট … এক মিনিট … তার মানে তুমি বলতে চাও ….. এটাই সেই ….’ ওয়ান্ডার চোখে এক অদ্ভুত কৌতুক। বিশ্বজয়ের হাসি হেসে সে মাথা নাড়ল। জেড এবার ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে বলল, ‘সর্বনাশ!, তাহলে এখন কি করব আমরা? পুলিশে খবর দেব?’ ‘শোন জেড, আমাদের হাতে এখনো কোন সলিড প্রমাণ নেই যে এটার কপালে M A খোদাই করা ছিল আর এটাই সেই খুনে অ্যানড্রয়েড। তবে আমাদের থিসিস পেপারের জন্য আমাদের কিছু পরীক্ষা করতে হবে। যদি এটাই সেই খুনে অ্যানড্রয়েড হয়, তবে আমি নিশ্চিত আমাদের পরীক্ষা বিফল হবে না’ বলল ওয়ান্ডা। ‘কিন্তু পরীক্ষাটা আমরা চালাব কিভাবে?’ প্রশ্ন করল জেড। ‘নো চাপ, ইনফ্রারেড ফিল্ম আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। ইনফ্রারেড ফিল্মেই ধরা পড়বে অ্যানড্রয়েডের কপালে কি খোদাই করা ছিল। এখন আমাদের তিনটে কাজ। এক, একটা ক্যামেরা জোগাড়– দুই, কিছু ইনফ্রারেড ফিল্ম কেনা– আর তিন, কাল দুপুরে একবার ইউনিভার্সিটির পাওয়ার প্ল্যান্টে চুপিচুপি ঢুকে কিছু ছবি তোলা। তাহলেই সব খোলসা হবে’ ওয়ান্ডা বলল। শুনে আনন্দে জেড তো প্রায় লাফিয়েই উঠল!
পরের দিন দুপুরেই ওয়ান্ডা আর জেড ইউনিভার্সিটির পাওয়ার প্ল্যান্টের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ইতিমধ্যে তারা ক্যামেরা আর ইনফ্রারেড ফিল্মের বন্দোবস্তও করে ফেলেছিল। ইউনিভার্সিটির পাওয়ার প্ল্যান্টের যেখানে অ্যানড্রয়েডটা কাজ করত, সেটা হল মাটির নীচের একটা ঘর। এমনিতে সবই আলোআঁধারিতে ভরা। শুধু চুল্লির আগুনে যেটুকু উজ্জ্বল হয়ে আছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, সকলের নজর এড়িয়ে তারা যখন মাটির নীচের ঘরটায় পৌঁছল, শুনতে পেল অ্যানড্রয়েডের হেঁড়ে গলায় সেই বিখ্যাত গান। মাটির নীচের ঘরে সেই গানের প্রতিধ্বনি এমন বিটকেল শোনাচ্ছিল যে ওয়ান্ডা আর জেডের একটু হলেও গা ছমছম করে উঠল। তারা চুল্লির আগুনের আলোআঁধারিতে দেখল হেঁড়ে গলার গানের সাথে সাথে অ্যানড্রয়েড এক অদ্ভুত ছন্দে নেচে চলেছে। ইতিমধ্যে জেড ইনফ্রারেড ফিল্ম ভরা ক্যামেরা নিয়ে তার লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছে– অ্যানড্রয়েডের কপালের অংশ! কিন্তু ঠিক এই সময়ই ঘটল একটা বিপর্যয়! চুল্লির আলোআঁধারিতে অ্যানড্রয়েডের সেই ভৌতিক নাচ দেখে ভয়ে ওয়ান্ডা চেঁচিয়ে উঠল, আর তখনই অ্যানড্রয়েড দেখতে পেল ওয়ান্ডা আর জেডকে। একমুহূর্তও দেরী না করে সে একটা ইস্পাতের বেলচা নিয়ে ধেয়ে এলো তাদের দিকে। জেড আর ওয়ান্ডা এতই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে পালাবার শক্তিও যেন তারা হারিয়ে ফেলেছিল। অ্যানড্রয়েড প্রথমেই বেলচার এক ঘায়ে গুঁড়িয়ে দিল ক্যামেরাটা। তারপর একে একে নিকেশ করল ওয়ান্ডা আর জেডকে। কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই প্রাণপাখী বেরিয়ে গেল প্রণয়ীযুগলের। জেড অবশ্য কিছুটা লড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বেচারি ওয়ান্ডা সে সুযোগটুকুও পেলো না। দুজনকে নিকেশ করার পর অ্যানড্রয়েড টেনে হিঁচড়ে তাদের লাশদুটোকে নিয়ে এলো চুল্লির কাছে। তারপর ছুঁড়ে দিল চুল্লির সর্বগ্রাসী আগুনে। আগুনের মধ্যে হারিয়ে গেল দুজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলেমেয়ের স্বপ্ন। এসবকিছুর সাথেই অবশ্য নেপথ্যসঙ্গীত হিসেবে চলছিল হেঁড়ে গলায় অ্যানড্রয়েডের সেই গান। কাজ শেষ হলে অ্যানড্রয়েড যথারীতি ফিরে গেল ভ্যান্ডালেয়ারের হোটেলে।
পাওয়ার প্ল্যান্টের থার্মোমিটারে সেইসময় তাপমাত্রা দেখাচ্ছিল ১০০.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট!
লায়রা আলফা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ভ্যান্ডালেয়ার তার অ্যানড্রয়েডকে নিয়ে এলো লায়রা কুইনের যাত্রীবাহী জাহাজের সবথেকে সস্তা কেবিনে। রুজিরুটির জন্য নানারকম টুকিটাকি কাজ তারা করতে লাগলো। একদিন সন্ধেবেলায় ভ্যান্ডালেয়ার একটা পোর্টফলিও দেখছিল। এটা সে ওয়ান্ডার ঘর থেকে ঝেড়ে এনেছিল। এতে তার অ্যানড্রয়েড সম্পর্কে ব্রম্ভাণ্ডের সমস্ত খবরের কাগজের কাটিং, মাইক্রোফিল্ম আরও কত কি! সবকিছুতেই বর্ণনা আছে অ্যানড্রয়েডের প্রত্যেকটা অপরাধের খুঁটিনাটি বিবরণ। এছাড়াও খেলা–আবহাওয়া–রাজনীতি–স্টক এক্সচেঞ্জ–ধাঁধা–প্রতিযোগিতা এইসবেরও কাটিং ছিল। এইসব দেখে এমনিতেই ভ্যান্ডালেয়ারের মাথা ঘেঁটে গিয়েছিল। জেড আর ওয়ান্ডা এমনকিছু জানত তার অ্যানড্রয়েডের ব্যাপারে, যেটা এই কাটিংএর গোলকধাঁধার মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে। কিন্তু ভ্যান্ডালেয়ার জানত তার বুদ্ধির দৌড় কতটা, তাই সে পোর্টফলিওটা সরিয়ে অ্যানড্রয়েডকে বলল– ‘টেরায় পৌঁছেই তোমাকে বেচে দেব। ওই ৩% না কত ওই চুক্তিতেই। যা পাব ওই ঢের হবে’। ‘‘আপনাকে মনে করিয়ে দি, আমার বর্তমান বাজারদর ৫৭০০০ ডলার’– বলল অ্যানড্রয়েড। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানা আছে। আর যদি বিক্রি করতে না পারি, তোমাকে পুলিশের জিম্মা করে দেব’– বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘আপনি কিন্তু এভাবে নিজের মূল্যবান সম্পত্তিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারেন না’ – বলল অ্যানড্রয়েড। এবার কেঁদে ফেলল ভ্যান্ডালেয়ার – ‘আমি তোমাকে সবসময় রক্ষা করব এটা জানো বলেই কি তুমি আমাকে এত ঔদ্ধত্য দেখাও?’ ‘আসলে কি জানেন স্যার, কারোর সম্পদ হতে পারাটাও কিন্তু কখনো কখনো খুব ভাগ্যের ব্যাপার’ নিজের শীতল চোখের চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে বলল অ্যানড্রয়েড।
লায়রা কুইন যখন ক্রয়ডনে এসে পৌঁছল, তখন সেখানকার তাপমাত্রা –৩ ডিগ্রি। ইতি উতি বরফ জমে আছে, হিমেল হাওয়া সশব্দে এসে আছড়ে পড়ছে লায়রা কুইনের গায়ে। যাত্রীরা কেউ কেউ কাস্টমসের দিকে, কেউ বা লন্ডন যাবে বলে এয়ারপোর্ট বাসের দিকে যাচ্ছে। ভ্যান্ডালেয়ার ও তার অ্যানড্রয়েড সেদিকে না গিয়ে দলছুট হয়ে অন্যদিকে হাঁটা লাগাল। প্রায় মাঝরাতে তারা এসে পৌঁছল পিকাডিলি সার্কাসে। ডিসেম্বরের বরফ ঝড় তখনও কমেনি। এরসের মূর্তিও বরফে ঢেকে গেছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে তারা ডানদিকে ট্রাফাল্গার স্কোয়ার পেরিয়ে ফ্লিট স্ট্রিটে এসে থামল। ভ্যান্ডালেয়ার দেখল সেন্ট পলসের দিক থেকে একা একজন আসছে। সে অ্যানড্রয়েডকে একটা গলিতে টেনে এনে একা লোকটাকে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল – ‘আমাদের টাকার দরকার। মনে হয় ওই লোকটার কাছে মালকড়ি আছে, হাতিয়ে আনো’ অ্যানড্রয়েড উত্তর দিল – ‘দুঃখিত, এটা আমি করতে পারবো না’ ভ্যান্ডালেয়ার আবার বলল – ‘যাও জলদি, দরকার পড়লে জোর করেই আনো। আমাদের আর কিছু করার নেই’ অ্যানড্রয়েড উত্তর দিল – ‘আমি দুঃখিত স্যার, এটা আমার প্রাথমিক নীতির বিরোধী। আমি কোনরকম সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করতে পারবো না’ ভ্যান্ডালেয়ার রেগে গিয়ে বলল –‘ওরে আমার নীতিবাগীশ রে! আগুন লাগানো, ভাঙচুর,খুন– কোনটা করতে তুমি বাকি রেখেছ হে? বেশি না বকে লোকটার থেকে টাকা বাগিয়ে আনো। দরকার পড়লে খুনও করো, কিন্তু আমাদের টাকার খুবই দরকার’ একইভাবে অ্যানড্রয়েড উত্তর দিল – ‘আমি দুঃখিত স্যার, এটা আমার প্রাথমিক নীতির বিরোধী। আমি কোনরকম সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করতে পারবো না’। ভ্যান্ডালেয়ারের আর ধৈর্যে কুলল না, সে অ্যানড্রয়েডকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটা বেশ লম্বা আর কাঠখোট্টা ধরণের। তবে অন্ধ তাই হাতে একটা সাদা ছড়ি নিয়েছে। ভ্যান্ডালেয়ারের শব্দ পেয়ে সে বলল– ‘আমি তোমার শব্দ শুনতে পেয়েছি। বল কি দরকার?’ ভ্যান্ডালেয়ার একটু ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, আমি খুবই মরিয়া হয়ে আপনার কাছে এসেছি’ লোকটা একটুও না ভড়কে বলল – ‘সেতো আমরা সবাই কমবেশি কিছু না কিছুর জন্য মরিয়া, তা কি চাও?’ ‘স্যার, আসলে … আমার কিছু টাকার দরকার’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার। অন্ধ লোকটা বলল– ‘ তা তুমি কি ভিক্ষা করছ না চুরি?’ ‘আমি দুটোর জন্যই তৈরি’ ভ্যান্ডালেয়ার বলল। ‘সে তো সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই আমরা সবাই এই দুটোর জন্য তৈরি’ মুখটা কাঁধের একটু ওপরে তুলে লোকটা আবার বলল, ‘আমি আগে সেন্ট পলসে ভিক্ষা করতাম, তবে আমি যা চাইতাম সেটা চুরি করা সম্ভব ছিল না। তা বলতো বন্ধু, কি এমন জিনিস যেটা তুমি চুরি অব্ধি করতে চাও?’ ‘টাকা’, বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘ তা টাকাটা তোমার দরকার কি জন্য? এক কাজ করি, আমি তোমাকে বলছি আমি কি জন্য ভিক্ষা করতাম। তুমিও চাইলে বলতে পারো, কেন তুমি চুরি করতে চাও। ও হ্যাঁ, আমার নামটাই তো বলা হয় নি। আমার নাম ব্লেনহেইম’। ‘আমার নাম…ভোল’– একটু ইতস্তত করে বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘তবে আমি কিন্তু শুধু দৃষ্টির জন্য ভিক্ষা করতাম না, আমি ভিক্ষা করতাম একটা সংখ্যার জন্য’, বলল ব্লেনহেইম। ‘একটা সংখ্যা?’ ভ্যান্ডালেয়ার অবাক হয়ে বলল। ‘হ্যাঁ, যৌক্তিক, অযৌক্তিক, কাল্পনিক, পূর্ণসংখ্যা, ভগ্নাংশ – সমস্তরকম সংখ্যা। তুমি ব্লেনহেইমের কুড়িটা শূন্যের ওপর বিখ্যাত বইয়ের ব্যাপারে তাহলে শোন নি। কিম্বা আয়তনের শূন্যতা?’ কেমন করুণভাবে হেসে বলল ব্লেনহেইম। ‘মিঃ ভোল, আমি হলাম সংখ্যাতত্ত্বের জাদুকর। আর সারাটা জীবন এই সংখ্যা নিয়ে ভোজবাজির খেলা দেখিয়েছি। পঞ্চাশ বছর ধরে এই ভেল্কি দেখাবার পর ভীমরতি ধরল, আর সেই ক্ষিদেটাই গেল হারিয়ে। তাই সেন্ট পলসে আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি শুধু একটু অনুপ্রেরণার জন্য। যদি ঈশ্বর থাকেন তিনি অবশ্যই আমার প্রার্থনা শুনে আমাকে একটা সংখ্যা পাঠাবেন’ একটানা বলে থামল ব্লেনহেইম। ভ্যান্ডালেয়ারের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে জেড আর ওয়ান্ডার সেই পোর্টফলিওটা ব্লেনহেইমের হাতে ধরিয়ে বলল, ‘এখানে একটা সংখ্যা আছে। একটা গুপ্তসংখ্যা। সবাই বুঝতে পারবে না, এমনভাবে লুকনো আছে। সংখ্যাটা একটা অপরাধের। তা আমরা কি একটা লেনদেন করতে পারি? সংখ্যার বদলে মাথা গোঁজার ঠাঁই?’ ব্লেনহেইম অবাক হয়ে বলল, ‘চুরি, ভিক্ষা – এসব ছেড়ে শেষমেশ লেনদেন? হয়ত সেই সর্বশক্তিমান কোন ঈশ্বর নন, ব্যবসায়ীই হবেন। যাই হোক, এসো আমার সাথে। চলো আমার বাড়িতে’।
ভ্যান্ডালেয়ার আর তার অ্যানড্রয়েড আস্তানা গাড়ল ব্লেনহেইমের বাড়ির ওপরের তলায় – দু বিছানাওলা একটা ঘরে। ইতিমধ্যে ভ্যান্ডালেয়ার আবার অ্যানড্রয়েডের কপাল ঘষে মেজে দিয়েছে নতুন করে কাজের খোঁজ লাগাবার জন্য। যখন তার অ্যানড্রয়েড বাইরে থাকত, ভ্যান্ডালেয়ার পোর্টফলিও থেকে এক এক করে সব কাগজ ব্লেনহেইমকে পড়ে শোনাত আর আলোচনা করত। ভ্যান্ডালেয়ার নিজের সম্পর্কে ব্লেনহেইমকে বলল, সে একজন ছাত্র। খুনে অ্যানড্রয়েডের ওপর একটা থিসিস লিখছে। এবং এই পোর্টফলিওতে সে বিভিন্ন সুত্র থেকে অ্যানড্রয়েডের অপরাধের ওপর তথ্য সংগ্রহ করেছে। এবং পোর্টফলিওর এই কাগজগুলোর মধ্যে নিশ্চয় কোন পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। সংখ্যা, পরিসংখ্যান – এমনকিছু যেটা সে বুঝে উঠতে পারছে না। ব্লেনহেইম খুবই আগ্রহী হয়ে রহস্যের মায়াজালে বুঁদ হয়ে যেত। ভ্যান্ডালেয়ার আর ব্লেনহেইম নিজেদের মত কাগজপত্রগুলো নিয়ে গবেষণা চালাত। ভ্যান্ডালেয়ার জোরে জোরে কাগজগুলো পড়ত আর ব্লেনহেইম খুব যত্ন সহকারে অন্ধদের জন্য বিশেষ লেখার পদ্ধতিতে সেগুলো টুকে নিত। সমস্ত খুঁটিনাটি সে নিজের মত করে সাজিয়ে নিত। তারপর একমনে সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করত। এইভাবে বেশ কয়েকদিন কাটার পর এক দুপুরবেলা ব্লেনহেইম ভ্যান্ডালেয়ারকে ডেকে পাঠাল তার পড়ার ঘরে। তারপর তার নোটসগুলো দেখিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় উত্তরটা আমি খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ ভোল।‘ ভ্যান্ডালেয়ারের বুকে হাতুড়ি পিটতে শুরু করল। ‘প্রায় পঞ্চাশটার ওপর কাগজ ঘেঁটে সেগুলোর মধ্যে একটা ব্যাপারেই মিল খুঁজে পেলাম। বলুন তো কি?’ প্রশ্ন করল ব্লেনহেইম। ভোলরূপী ভ্যান্ডালেয়ার বলল, ‘বলতে পারব না মিঃ ব্লেনহেইম’। ‘আবহাওয়া’– বলল ব্লেনহেইম। ‘কি!!!’ প্রায় চিৎকার করে বলল ভ্যান্ডালেয়ার। মাথা নেড়ে ব্লেনহেইম আবার বলল, ‘আবহাওয়া। সব কটা অপরাধই ঘটেছে এমন কোন দিনে, যেদিন তাপমাত্রা ছিল ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর’ ‘ধুর,অসম্ভব ব্যাপার। লায়রা আলফাতে যথেষ্ট ঠাণ্ডা ছিল’ – বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘আমরা কিন্তু লায়রা আলফাতে কোন অপরাধের রেকর্ড পাই নি, অন্তত এই কাগজগুলোতে তো সেরকম কিছু নেই’ ব্লেনহেইম বলল। ‘সেটা ঠিকই। আমি…’ কি একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ ভ্যান্ডালেয়ার চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। ফার্নেস রুমে যথেষ্ট গরম ছিল। ডালাস ব্র্যাডির ইলেকট্রিক ছুল্লি … প্যারাগনের ধানক্ষেত …. কিন্তু কেন??’ ঠিক সেই সময়ই পড়ার ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অ্যানড্রয়েডটা থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘরে ঢুকল। মনিবের পরবর্তী হুকুম তামিল করার জন্য। ব্লেনহেইম অ্যানড্রয়েডের উপস্থিতি টের পেল। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সে বলল, ‘এটাই তাহলে সেই অ্যানড্রয়েড, তাই না?’ ‘হ্যাঁ, এবং সেই রাতে যথেষ্ট ঠাণ্ডা ছিল, তাই আমার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও নিজের প্রাথমিক নীতি অনুযায়ী ও আপনাকে আক্রমণ করে নি’ – বলল ভ্যান্ডালেয়ার। তারপর একটা খুনে দৃষ্টি নিয়ে অ্যানড্রয়েডকে ইশারা করল ব্লেনহেইমকে আক্রমণ করার জন্য। অ্যানড্রয়েড মাথা নেড়ে জানান দিল প্রাথমিক নীতি ভুলে সে এবারেও আক্রমণ করতে অপারগ। অহেতুক কারোর প্রাণহানি সে করবে না। ধৈর্যচ্যুতি ঘটল ভ্যান্ডালেয়ারের। সে ব্লেনহেইমের কাঁধ ধরে এক ধাক্কায় ডেস্ক চেয়ার থেকে মাটিতে এনে ফেলল। ব্লেনহেইম চিৎকার করে উঠল। ভ্যান্ডালেয়ার এক হাত দিয়ে ব্লেনহেইমের মুখ চেপে ধরে অ্যানড্রয়েডকে বলল – ‘জলদি একটা হাতিয়ার আনো’ ‘অহেতুক কারও প্রাণহানি অন্যায়’ বলল অ্যানড্রয়েড। ব্লেনহেইম ছটফট করছিল, ভ্যান্ডালেয়ার নিজের সমস্ত ওজন দিয়ে তাকে চেপে ধরে আবার বলল– ‘এটা আত্মরক্ষার লড়াই, জলদি একটা হাতিয়ার নিয়ে এসো’ অগত্যা অ্যানড্রয়েড তার মনিবের হুকুম তামিল করল। সে জানত একটা আলমারিতে রিভলভার আছে। সে রিভলভারটা খুঁজে বের করল। পরীক্ষা করে দেখল এখনো পাঁচটা গুলি আছে। তারপর সেটা দিল ভ্যান্ডালেয়ারকে। ভ্যান্ডালেয়ার রিভলভারটা নিয়ে ব্লেনহেইমের কপালে তাক করল, তারপর ট্রিগার টেনে দিল, একবার চিৎকার করেই প্রাণ হারাল সংখ্যাতত্ত্বের জাদুকর। ভ্যান্ডালেয়ার হিসেব করে দেখল ব্লেনহেইমের রাঁধুনি আসতে আসতে আরও ঘণ্টা তিনেক। যা করার এর মধ্যেই করে ফেলতে হবে। দুজনে মিলে ব্লেনহেইমের টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, জামাকাপড় – আর যা যা দরকার সব নিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলল। ব্লেনহেইমের নোটসগুলো নিতেও ভুলল না। জেড আর ওয়ান্ডার পোর্টফলিওর সেই কাগজপত্রগুলো নষ্ট করল। তারপর ব্লেনহেইমের পড়ার ঘরে কিছু কাগজপত্র তাগাড় করে রেখে তারওপর একটা জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে দিল আর কার্পেটে ভালোকরে কেরোসিন তেল ঢেলে দিল। অগ্নিকাণ্ডের জন্য যথেষ্ট! অবশ্য শেষের কাজগুলো ভ্যান্ডালেয়ার একাই সারল, কারণ অ্যানড্রয়েড গোঁ ধরল, সে সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। অগ্নিসংযোগ করার পর ভালো করে দরজা এঁটে সে আর অ্যানড্রয়েড রওনা দিল নতুন দিশার দিকে।
তারা টিউবরেলে করে প্রথমে এলো লেস্টারে। সেখান থেকে ট্রেন বদলে গেল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের দিকে। রাসেল স্ট্রিটের কাছে একটা ছোট জর্জিয়ান বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তারা। জানলার কাছে একটা কাঠের ফলকে লেখাঃ ন্যান ওয়েব, মনস্তত্ত্ব পরিমাপ বিশেষজ্ঞ। ভ্যান্ডালেয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই জায়গাটা দেখে গিয়েছিল আর ঠিকানাটাও টুকে নিয়েছিল। তারা বাড়ির ভেতর ঢুকল। ভ্যান্ডালেয়ার ঢুকল ন্যান ওয়েবের অফিসে। অ্যানড্রয়েড অবশ্য ব্যাগ নিয়ে বাইরের হলঘরেই দাঁড়িয়ে রইল।
ন্যান ওয়েবের চেহারাটা ঠিক তথাকথিত ব্রিটিশদের মত নয়। পাকা চুলের মহিলাকে দেখলে মনে হবে ঠিক খ্যাংরা কাঠির মাথায় আলুর দম। সাদামাটা চেহারা হলেও তার চালচলন যথেষ্ট ঝকঝকে। সে ভ্যান্ডালেয়ারকে দেখে মাথা নাড়ল। তারপর একটা চিঠি লিখে সেটা একটা খামে পুরে মুখটা সিল করে দিল। তারপর আবার তাকাল ভ্যান্ডালেয়ারের দিকে। ‘আমার নাম জেমস ভ্যান্ডারবিল্ট’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘বেশ’ ন্যান ওয়েব বলল। ‘আমি লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছি’ ভ্যান্ডালেয়ার বলল। ‘বেশ’– একইভাবে পুনরাবৃত্তি করল ন্যান ওয়েব। এবার ভ্যান্ডালেয়ার একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল – ‘আসলে আমি খুনে অ্যানড্রয়েডদের ওপর গবেষণা করে একটা থিসিস লিখছি। তা এই ব্যাপারে আপনার সাথে একটু পরামর্শ করতে চাই। তা ম্যাডাম আপনার ফি কত?’
– তা আপনি কোন কলেজ থেকে পাশ করেছেন মিঃ ভ্যান্ডারবিল্ট?
– কেন বলুন তো?
– না আসলে ছাত্রদের জন্য একটা ছাড় আছে, তাই বললাম।
– মের্টন কলেজ।
– সে ক্ষেত্রে আমার ফি দু পাউন্ড।
ভ্যান্ডালেয়ার ব্লেনহেইমের নোটসের সাথে দু পাউন্ড এগিয়ে দিল ন্যান ওয়েবের ডেস্কে। তারপর বলল, ‘আমি গবেষণা করে দেখেছি আবহাওয়া … মানে তাপমাত্রার সাথে এই অ্যানড্রয়েডের অপরাধের পারস্পরিক যোগাযোগ আছে। যখনই তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হয়েছে, তখনই এই অপরাধগুলো হয়েছে। তা এ ব্যাপারে কি আপনি কোন মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন?’ ‘অবশ্যই পারব। এটা হল সিনেস্থেসিয়া’ বলল ন্যান ওয়েব। ‘কি!’ ব্যোমকে গিয়ে প্রশ্ন করল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘বেশ আপনাকে এই সিনেস্থেসিয়া ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি মিঃ ভ্যান্ডারবিল্ট’ একটু থেমে ন্যান ওয়েব আবার বলতে শুরু করল– ‘ সিনেস্থেসিয়া শব্দটা এসেছে দুটো গ্রীক শব্দ থেকে। সিন – অর্থাৎ একসাথে আর এস্থেসিস – অর্থাৎ অনুভূতি। যখন কোন সংবেদনশীল অনুভূতি এক ইন্দ্রিয় থেকে সঞ্চারিত হয় অন্য ইন্দ্রিয়তে, আবার অনেক ক্ষেত্রে একটা অনুভূতি অন্য অনুভুতিকে প্রভাবিত করে, তাকেই বলে সিনেস্থেসিয়া। কখনো কখনো কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দুটো অনুভূতিই একসাথে কাজ করে। আচ্ছা আর একটু বুঝিয়ে বলছি। যেমন ধরুন, কোন উদ্দীপক শব্দ আমাদের মনে কোন নির্দিষ্ট রঙের ধারণা তৈরি করল, বা কোন রঙ থেকে আমরা ভাবলাম কোন নির্দিষ্ট স্বাদের কথা। বা কোন আলো আমাদের ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করে আমাদের চিন্তনে সৃষ্টি করল অনেকটা আবহসঙ্গীতের মত কোন শব্দের অনুভূতির। স্বাদ,গন্ধ,যন্ত্রণা,চাপ,তাপমাত্রা সবই এইভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এই সিনেস্থেসিয়ার ক্ষেত্রে। বোঝা গেল?’ প্রশ্ন করল ন্যান ওয়েব। ‘হ্যাঁ কিছুটা’ – ভ্যান্ডালেয়ার বলল। ন্যান ওয়েব আবার বলল, ‘আপনার গবেষণার মাধ্যমে আপনি আবিষ্কার করেছেন যে ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রা হলেই অ্যানড্রয়েড প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আর একটু ব্যাখ্যা করে বলি। আমার মনে হয় তাপমাত্রার সাথে অ্যানড্রয়েডের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কোন যোগাযোগ রয়েছে। যে জন্য তাপমাত্রা বেশি হলেই ভয়, রাগ, উত্তেজনা, হিংস্র আচরণ এসবকিছু দেখা যায় অ্যানড্রয়েডের মধ্যে’ ‘আচ্ছা ধরুন যদি অ্যানড্রয়েডকে কোন ঠাণ্ডা জায়গায় রাখা হয়?’ প্রশ্ন করল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘সে ক্ষেত্রে কোনরকম উদ্দীপনাই হবে না, তাই কোন অপরাধই ঘটবে না’ ন্যান ওয়েব বলল। ‘আচ্ছা সে না হয় হল, এবার বলুন তো এই প্রতিচ্ছবি ব্যাপারটা কি?’ ন্যান ওয়েবকে প্রশ্ন করল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘মানে? ঠিক বুঝলাম না’ বলল ন্যান। ‘মানে আমি বলছি এই প্রতিচ্ছবির ব্যাপারটা কি অ্যানড্রয়েডের মালিকের জন্য খুব বিপজ্জনক কিছু?’ ন্যানকে জিজ্ঞেস করল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘হুম, বেশ ইন্টারেস্টিং। এই প্রতিচ্ছবি ব্যাপারটা আসলে একে অপরকে প্রভাবিত করা। আর কিছুই নয়। যেমন ধরুন কোন প্যারানয়েড রুগী, মানে এমন কোন মানসিক রুগী যে সারাক্ষণ মনে করে তার আশেপাশের লোকজন তার ক্ষতি করতে চায়। তা এই ধরণের মানসিক রুগীর সাথে থাকতে থাকতে তার আশেপাশের লোকেরাও কিন্তু পরোক্ষভাবে মানসিক অবসাদের শিকার হয়’ বলল ন্যান ওয়েব। ‘হ্যাঁ সে না হয় হল, কিন্তু এর সাথে অ্যানড্রয়েডের মালিকের বিপদের কি সম্পর্ক?’ প্রশ্ন করল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘সম্পর্ক এটাই, যে খুনে অ্যানড্রয়েডের সাথে থাকতে থাকতে তার খুনে মানসিকতার প্রভাবে আপনার নিজের স্বভাবটাও খুনে হয়ে উঠেছে মিঃ ভ্যান্ডালেয়ার’ মুচকি হেসে বলল ন্যান ওয়েব। ভয়ে ভ্যান্ডালেয়ারের পা দুটো কাঁপতে শুরু করেছে। ‘আপনি সত্যিই খুব বোকা মিঃ ভ্যান্ডালেয়ার, আপনার কি মনে হয় এই নোটসগুলো দেখে আমি বুঝতে পারি নি এগুলো কিংবদন্তি সংখ্যাতত্ত্ববিদ ব্লেনহেইমের হাতের লেখা? ইংল্যান্ডের যেকোনো শিক্ষিত ছেলেমেয়েই অন্ধদের জন্য বিশেষ এই লেখার পদ্ধতি দেখে ধরে ফেলবে লেখাগুলো কার। আর আপনার মত মূর্খ যে কিনা সিনেস্থেসিয়া কি জানে না, অথচ তাপমাত্রার সাথে সাথে অ্যানড্রয়েডের অপরাধপ্রবণতার ওপর গবেষণা করে ফেলেছে। রাবিশ!’ হাতে ব্লেনহেইমের নোটসগুলো ভ্যান্ডালেয়ারের দিকে নাড়িয়ে বলল ন্যান ওয়েব। ভ্যান্ডালেয়ারের বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। ন্যান ওয়েব আবার বলতে শুরু করল, ‘সবথেকে বড় কথা লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে মের্টন কলেজ বলে কোন কলেজই নেই। এই নামে একটা কলেজ অবশ্য আছে, তবে সেটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। তা এখন আপনিই বলুন মিঃ ভ্যান্ডালেয়ার, অ্যানড্রয়েডের থেকে সংক্রমিত আপনার এই খুনে স্বভাবের জন্য আমি কি করব, মেট্রোপলিটন পুলিশে খবর দেব নাকি হাসপাতালে?’ ‘আপনাকে কিছুই করতে হবে না ম্যাডাম, যা করার আমিই করছি’ বলে ভ্যান্ডালেয়ার রিভলবারটা বের করে গুলি করল ন্যান ওয়েবকে।
‘অ্যান্টারেস ২, আলফা অরিগ, অ্যাক্রাক্স ৪, পোলাক্স ৯, রিগেল সেন্টারাস সবকটা নক্ষত্রেই তাপমাত্রা মোটামুটি ৪০ ডিগ্রি থেকে ৭০ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। এগুলোর মধ্যেই আস্তানা গাড়া যায়, কি বল হে?’ ভ্যান্ডালেয়ার প্রশ্ন করল তার সবেধন নীলমণি অ্যানড্রয়েডকে। অ্যানড্রয়েড জবাব না দিয়ে নিপুণ হাতে গাড়ি চালাতে লাগলো। সূর্য তখন প্রায় ডুবে গেছে, কিন্তু এই দুই মক্কেল খেয়াল করল না যে একটা হেলিকপ্টার ঠিক তাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। ‘গরম থেকে বাঁচতে কিসের শরম?’ নিজের ছড়াতে নিজেই একটু হাসল ভ্যান্ডালেয়ার। তারপর বলতে লাগল, ‘সেরকম হলে কিছুদিন স্কটল্যান্ডে আস্তানা গেড়ে কিছু মাল কামিয়ে নেওয়া যাবে। তারপর সেখান থেকে কিছুদিন নরওয়েতে কাটিয়ে সিধে পোলাক্স। আর কোন ভয়ডর থাকবে না’– ভ্যান্ডালেয়ার হয়ত আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই হেলিকপ্টার থেকে ভেসে এল আকাশবাণী – ‘অ্যাটেনশন্ জেমস ভ্যান্ডালেয়ার আর অ্যানড্রয়েড। অ্যাটেনশন্ জেমস ভ্যান্ডালেয়ার আর অ্যানড্রয়েড’ ভ্যান্ডালেয়ার মাথা তুলে তাকাল ওপরের দিকে। তাদের গাড়ির ঠিক ওপরেই আছে হেলিকপ্টারটা। হেলিকপ্টার থেকে আবার আকাশবাণী ভেসে এল – ‘তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালানোর সব রাস্তা বন্ধ। এক্ষুনি গাড়ি থামিয়ে নিজেরা আত্মসমর্পণ করো। গাড়ি থামাও এক্ষুনি’ অ্যানড্রয়েড তার মনিবের দিকে তাকাল পরবর্তী নির্দেশের জন্য। ‘গাড়ি চালাতে থাকো’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার। হেলিকপ্টারটা আরও নিচে নেমে এল। আবার হেলিকপ্টার থেকে নির্দেশ ভেসে এল – ‘অ্যাটেনশন অ্যানড্রয়েড, যেহেতু গাড়িটা তুমি চালাচ্ছ, তাই বলছি এক্ষুনি গাড়ি থামাও। এটা আমার চূড়ান্ত নির্দেশ’ ভ্যান্ডালেয়ার খিঁচিয়ে উঠল, ‘আরে করছটা কি?’ ‘চূড়ান্ত নির্দেশ অবমাননা করতে পারব না স্যার। তাই আমি আপনাকে বলছি .. ’ অ্যানড্রয়েড হয়ত আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই ভ্যান্ডালেয়ার বলল, ‘স্টিয়ারিং ছাড়ো’ বলে ভ্যান্ডালেয়ার অ্যানড্রয়েডকে সরিয়ে স্টিয়ারিং কব্জা করল। গাড়িটা কিছুক্ষণের জন্য রাস্তায় থমকে গেল, তারপর আবার পাকা রাস্তা ছেড়ে পাশের মেঠো রাস্তা ধরল। আর মাইল পাঁচেক গেলেই একটা হাইওয়ে পাওয়া যাবে, ভাবল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘যেভাবেই হোক এদের আটকানো রাস্তাগুলো টপকাতে হবে’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি এগিয়ে চলল। ইতিমধ্যে হেলিকপ্টার আরও নিচে নেমে এসেছে। আবার সেখান থেকে নির্দেশ এলো– ‘অ্যাটেনশন জেমস ভ্যান্ডালেয়ার আর অ্যানড্রয়েড। এক্ষুনি আত্মসমর্পণ করো, এটা চূড়ান্ত নির্দেশ’।
‘ওর আত্মসমর্পণ করার ক্ষমতা নেই আর আমার ইচ্ছে নেই’ চিৎকার করে বলল ভ্যান্ডালেয়ার। ‘আর কোনো শালা আমাদের আটকাতে পারবে না’ আবার বিড়বিড় করে বলল সে। ‘কিন্তু আমি আপনাকে জানাতে চাই স্যার, আমার সমস্ত নির্দেশিকার ওপরে রয়েছে প্রশাসনিক চূড়ান্ত নির্দেশ। তাই সেটা মেনে আমাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে’ বলল অ্যানড্রয়েড। ‘কিসের প্রশাসনিক নির্দেশ? এরা সরকারের কুকুর, সরকার এদের যা শেখাবে এরা সেইমতো ঘেউ ঘেউ করবে। এরা আমাদের নাগাল পাবার আগেই আমরা সব বর্ডার টপকে যাব, তখন আর এদের কিস্যু করার মুরোদ নেই, মালগুলো চুক্কি দিচ্ছে বুঝতে পারছ না?’ বলল ভ্যান্ডালেয়ার। তারপর গাড়ি চালাতে চালাতেই একহাতে স্টিয়ারিং ধরে আর একহাত দিয়ে দেখে নিল রিভলবারটা ঠিকঠাক আছে কিনা। আর ঠিক এই সময়ই গাড়িটা ঝাঁকুনি খেয়ে গিয়ে ধাক্কা মারল একটা পাথরের ঢিপিতে। নিমেষে গাড়ির ভবলীলা সাঙ্গ হল। বেগতিক দেখে ভ্যান্ডালেয়ার নিচু হয়ে অ্যানড্রয়েডকে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর হেলিকপ্টারের সার্চলাইট এড়িয়ে দুজনে দৌড়তে লাগল জলার দিকে। দৌড়তে দৌড়তে ভ্যান্ডালেয়ারের মনে হচ্ছিল হৃদপিণ্ডটা বুঝি খুলে বেরিয়ে আসবে। হেলিকপ্টারটা ভাঙা গাড়ির ওপর চক্কর কাটতে লাগল। রাস্তা যারা ব্লক করেছিল, সবাই এবার এইদিকে ধেয়ে আসছে রেডিওতে নির্দেশ পেয়ে। ভ্যান্ডালেয়ার আর অ্যানড্রয়েড তখন ছুটতে ছুটতে জলা, খালবিল পেরিয়ে অনেকটা ভেতরের দিকে চলে এসেছে। রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, আবহাওয়াও বেশ ঠাণ্ডা। একটা হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করল, হাড় কাঁপিয়ে দিল ভ্যান্ডালেয়ারের। হঠাৎ চারদিক কেমন কেঁপে উঠল, ভ্যান্ডালেয়ার পেছন ফিরে দেখল জ্বালানিতে আগুন লাগার ফলে গাড়িটা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। আর সেই আগুনের শিখা প্রায় দশফুট উঁচু হয়ে উঠেছে, সেই আগুনের আলোতেই ভ্যান্ডালেয়ার দেখল একদল লোক ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। এরা এবার পুরো জলাটাই তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু করবে। ভ্যান্ডালেয়ারের আর মাথা কাজ করছে না, সে কেঁদে উঠল। কিন্তু বেশি ভাবার সময় ছিল না, তাই অ্যানড্রয়েডকে নিয়ে ছুটে চলল কোন নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। ছুটতে ছুটতেই ভ্যান্ডালেয়ার একবার পকেটে হাত ঢোকাল, রিভলবারটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু যা দেখল, তাতে তার মাথা আরও ঘেঁটে গেল। কখন যে পকেট ছিঁড়ে রিভলবারটা পড়ে গেছে, সে খেয়ালও করে নি। ভয়ে চিৎকার করে উঠল ভ্যান্ডালেয়ার। একদিকে প্রবল ঠাণ্ডা, অন্যদিকে নিশ্চিত সমাপ্তির আতঙ্ক তাকে গ্রাস করল। খানিকদুর ছোটার পর ভ্যান্ডালেয়ার খেয়াল করল, জলার লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। হেলিকপ্টারটাও অসহায়ভাবে সার্চলাইট জ্বেলে খোঁজার চেষ্টা করছে তাদের। ‘ওরা আমাদের টিকিও ছুঁতে পারবে না’ ফিসফিসিয়ে বলল ভ্যান্ডালেয়ার।‘শুধু চলতে থাকো, আমরা সার্চপার্টি, আগুন, ঠাণ্ডা, সবকিছুকে কলা দেখিয়েছি। আমরা…’ ভ্যান্ডালেয়ারের কথা শেষ হবার আগেই প্রায় একশো ফুট দুর থেকে বন্দুকের গুলির আওয়াজ ভেসে এল তিনবার। ভ্যান্ডালেয়ারের পকেট থেকে যেখানে রিভলবারটা পড়ে গিয়েছিল, জলার আগুন সেখানে পৌছনোমাত্র রিভলবারের শেষ তিনটে গুলি বিস্ফোরণ ঘটাল। আর রক্ষা নেই, এবার লোকগুলো এদিকেই ধেয়ে আসবে। কিন্তু ভ্যান্ডালেয়ার যা ভাবল তা ঘটল না। এই বিস্ফোরণটার ফলে আগুন হয়ে উঠল সর্বগ্রাসী। আর সেই সর্বগ্রাসী আগুনের শিখা ধেয়ে এল তার আর অ্যানড্রয়েডের দিকে। ভ্যান্ডালেয়ার জলার জলে ডুব দিল। দমবন্ধ করে রইল যতক্ষণ আগুনের শিখাটা অতিক্রান্ত না হয়। কিন্তু অ্যানড্রয়েড কানফাটানো চিৎকার করে কেঁপে উঠল। অসহায় ভ্যান্ডালেয়ার অ্যানড্রয়েডকে জলার ভেতর টেনে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই চেষ্টা বিফল হল। রাগের চোটে ভ্যান্ডালেয়ার অ্যানড্রয়েডের মুখে এক ঘুষি মেরে মুখটা গুঁড়িয়ে দিল। অ্যানড্রয়েডও পাল্টা এক ঘা লাগাল ভ্যান্ডালেয়ারকে। টাল খেতে খেতে উঠে দাঁড়াল ভ্যান্ডালেয়ার, তারপর পাল্টা মার দেবার আগেই সেই জ্বলন্ত সর্বগ্রাসী আগুনের শিখা গ্রাস করে নিল অ্যানড্রয়েডকে। সবথেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল সেই আগুনের শিখার মধ্যেও অ্যানড্রয়েড হাত পা নেড়ে তার সেই অদ্ভুত ভুতুড়ে নাচ নাচতে লাগল। তার এই ভুতুড়ে নাচ ততক্ষণ অব্ধি চলল, যতক্ষণ না সে পরিণত হল দলাপাকানো কৃত্রিম রক্তমাংসে। সেই রক্ত যা কখনো জমাট বাঁধে না।
কেউ যদি তখন থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখত, হয়ত দেখা যেত তখনকার তাপমাত্রা ১২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট!
নাহ, এ যাত্রায় ভ্যান্ডালেয়ার শেষ অব্ধি বেঁচেই গেল। যখন সার্চ পার্টি আর পুলিশের লোকজন অ্যানড্রয়েডের নৃত্যময় মৃত্যু দেখতে মগ্ন ছিল, সেই সুযোগে সেখান থেকে পালাল ভ্যান্ডালেয়ার। শেষ অব্ধি সত্যিই সে সবাইকে কলা দেখাতে পারলেও, নিজের সাথে যুদ্ধেই হেরে গেল। ন্যান ওয়েব ঠিকই বলেছিল, যদি তুমি কোন বিকারগ্রস্ত লোক বা মেশিনের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকো, তাহলে তার উন্মাদনা তোমার মধ্যেই সঞ্চারিত হবে। সেই চুলবুলে ওয়ান্ডাও তো ভ্যান্ডালেয়ারকে সাবধান করেছিল প্রতিচ্ছবির ব্যাপারে। এখন ভ্যান্ডালেয়ার আছে ঠাণ্ডা পোলাক্স নক্ষত্রে। তার অধীনে আছে একটা সস্তা শ্রমিক রোবট। সেই আগের অ্যানড্রয়েডের মত অতো কারিগরির বালাই নেই। কিন্তু সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেল যখন এই সস্তা রোবটটাও স্থানীয় একটা পাহাড়ি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিল অজানার পথে। পাড়ি দেবার আগে সেও গাইতে লেগেছিল সেই অদ্ভুত হেঁড়ে গলার গান, সাথে সেই ভুতুড়ে নাচ! কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। পোলাক্স তো যথেষ্ট ঠাণ্ডা নক্ষত্র! থার্মোমিটারও দেখাচ্ছে ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। ‘যদি তুমি কোন বিকারগ্রস্ত লোক বা মেশিনের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকো, তাহলে তার উন্মাদনা তোমার মধ্যেই সঞ্চারিত হবে’ – ভ্যান্ডালেয়ারের আরও একবার মনে পড়ে গেল ন্যান ওয়েবের সেই কথা! তাহলে কি…..!
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ অ্যালফ্রেড বেস্টারের লেখা মূল গল্প ‘Fondly Fahrenheit’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল অগাস্ট ১৯৫৪ সালে The Magazine of Fantasy & Science Fiction পত্রিকায়।
Tags: অ্যালফ্রেড বেস্টার, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বাতাসে মৃত্যুর ফাঁদ, সৌমেন চ্যাটার্জি
আহা, খুনি অ্যান্ড্রয়েড আর তার মনিবের এরকম গা হিম করা মনস্তাত্বিক গল্প বাংলায় অনীশ দেব ছাড়া কেউ লিখেছেন বলে মনে হয় না। স্বর্ণ যুগের এই গল্পটিকে ফিরিয়ে দেবার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমায়।
Osonkho dhonnonad. Dip.
সাধের মানব সভ্যতার প্রায় শেষযাত্রার ওডিসিতে সামিল হয়েছি। গতিময় বর্ণনা আর নির্মেদ নির্মিতিতে গল্পের ঘাত – প্রতিঘাত আর ভূয়ো -দর্শণ প্রায় একই ছন্দে এগিয়েছে। প্রতিবাদের মতো এবারেও সৌমেনের নির্মাণ লা – জবাব।
Dhonnonad
যেমন সুন্দর কাহিনী তেমনি জমজমাট অনুবাদ। একবারও মনে হয় নি যে অনুবাদ পড়ছি। অসাধারণ!
Dhonnonad