বিজ্ঞানী ঘনাদা
লেখক: ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
লেখক – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
অলংকরণ – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
ঘ-না-দা!
ছোটদের কাছে একটা দারুণ নাম—যাঁর চলনে বলনে ছড়িয়ে আছে মজা—মজা—আর মজা! শুধু ছোটরা কেন, আমরা, বড়রাও কি তার রস থেকে বঞ্চিত? নিশ্চয়ই নয়।
কিন্তু শুধুই কি মজা? না, ভালো করে পড়লে দেখা যাবে ওই বিচিত্র চরিত্রটির মধ্যে এমন কতকগুলি জিনিস ছড়িয়ে আছে যা পড়ার পর মজা হয়তো ঠিকই পাওয়া যায় কিন্তু সেই সঙ্গে মনকেও বেশ একটু ভাবিয়ে তোলে।
৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের অর্থাৎ সেই সরু গলির মধ্যেকার মেস বাড়িটার ঠিকানাটাও আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে—যেখানে ওপরের টঙের ঘরে ঘনাদা আস্তানা গেড়েছেন আর আসর জমিয়ে তুলেছেন দোতলার আড্ডার ঘরে। এমনও শোনা গেছে, কোনও কোনও উৎসাহী পাঠক নাকি উত্তর কলকাতার ওই রাস্তাটি খুঁজে খুজে হয়রানও হয়েছে—৭২ নম্বরের বাড়ি খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু পাবে কি করে? ওই বনমালী নস্কর লেন নামটার অস্তিত্ব যে শুধু লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্রের মাথার ভিতর তা তো তারা জানে না!
বিখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের গল্পের অপূর্ব চরিত্র শার্লক হোমসের বাড়ি নিয়েও নাকি অনেকবার ঠিক এই রকম ঘটনা ঘটেছে। লণ্ডনের বেকার স্ট্রীটের ২২১বি নং বাড়িটা ছিল গল্পের শার্লক হোমসের ঠিকানা। গল্প পড়ে মনেও হত না যে শার্লক হোমস একটি কাল্পনিক চরিত্র এবং তার ঠিকানাটাও কাল্পনিক। তবু গল্প পড়ে কেউ কেউ হন্যে হয়ে ছুটত ওই ঠিকানার খোঁজে—যদি শার্লক হোমসকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।
রচনার মধ্যে কতখানি মুন্সীয়ানা থাকলে তবেই এরকম ব্যাপার সম্ভব হতে পারে ভাবলে অবাক লাগে। ঠিক এই রকম অসম্ভব মুন্সীয়ানার পরিচয় আমরা পেয়েছি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ঘনাদা’ চরিত্রের কল্পনার মধ্যে।
হ্যাঁ, ঘনাদা সত্যিই একটি বিচিত্র চরিত্র। এখানে একটা ‘অসাধু’ ভাষা ব্যবহার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। অসাধু, হলেও কথাটা বড়ই অর্থবহ। কী কথা? বলেই ফেলি তা হলে। ‘গুল মারা’। এই ঘনাদা গুল মারতে দারুণ ওস্তাদ। এমন সহজ ভাবে এমন অসম্ভব অসম্ভব গল্প তিনি বলে যান যা আদপেই যে সত্যি নয়,—সমস্তটাই তথাকথিত ‘গুল’,—একথা শ্রোতারাও বোঝে এবং তা সত্ত্বেও তাঁকে ছাড়তে চায় না। ঘনাদা খেতে ভালোবাসেন তাই তাঁর জন্য মেসের বাসিন্দারাই যোগাড় করে আনে নানা রসনা-মুগ্ধকর সুখাদ্য, খায় দামী দামী সিগারেটও। আর তারই আড়ালে বসে চলে ঘনাদার রাজা-উজীর-মারা গল্প। সত্যি না হলেও সে গল্পের রস এতই চিত্তাকর্ষক যে সেজন্য কেউ কিছু মনে করে না, ঘনাদাকে পারতপক্ষে চটাবার চেষ্টাও করে না কেউ—বিশেষ করে মেসের বাসিন্দা শিশির, শিবু, গৌর আর স্বয়ং ‘আমি’ তো বটেই।
পুরো নাম ঘনশ্যাম দাস। কিন্তু সে নাম কেউ ব্যবহার করে না, ঘনাদা নামটাই চালু হয়ে গেছে। রোগা, লম্বা, শুকনো হাড়-বার-করা চেহারা। বয়স? তা ৩৫ও হতে পারে ৫৫ও হতে পারে। অবশ্য দিনে দিনে প্রকৃতির নিয়মে নিশ্চয়ই বেড়ে চলেছে, কিন্তু ঘনাদার ওপর তার কোনও ছাপ পড়েছে বলে মনে হয় না।
এই ঘনাদার কথাবার্তা শুনলে মনে হবে, এবং আমরাও তা মেনে নিয়েছি, যে গত ২০০ বছর ধরে পৃথিবীতে হেন জায়গা নেই যেখানে তিনি যাননি, হেন বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তাঁর কোনও-না-কোনও রকম ভাবে যোগ নেই। ভূগোলকে তো তিনি প্রায় গুলে খেয়েছেন। ভূগোলকে যদি আমরা বিজ্ঞানের একটা বিভাগ বলে ধরি তা হলে এদিক দিয়েও হয়তো ঘনাদা একজন মস্ত বড় বিজ্ঞানী।
আফ্রিকার সেই দূর্ভ্যেদ্য জঙ্গল, যেখানে দিনের বেলাও এক ফোঁটা সূর্যের আলো ঢুকবার সাহস পায় না, নদী-জলা সব কুমীর আর হিপোপটেমাস দিয়ে ঠাসা, ঘাসবনের ভিতর দিয়ে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে দলে দলে সিংহ আর সিংহী ঘুরে বেড়াচ্ছে, বনস্পতির আড়াল দিয়ে দলবদ্ধ হয়ে চলেছে হাতির পাল, গোঁয়ারগোবিন্দ গন্ডার আর বুনো মোষ ছুটে চলেছে তীরবেগে, হরিণ, জেব্রা, জিরাফ ভয়ে দৌড়চ্ছে—সর্বত্রই ঘনাদার অবাধ গতি। পড়েছেন বুনো জংলী মানুষদের খপ্পরে, আবার নিজেও হানা দিয়েছেন কিভু উপত্যকায় পাহাড়ি গরিলার ডেরায়। শিকারে তাঁর জুড়ি নেই, যখন বন্দুক ধরেন তখন অব্যর্থ হাতের নিশানা। তার ওপর আছে তাঁর যুযুৎসু বা ক্যারাটের প্যাঁচ—অতি বড় পালোয়ানও যার খপ্পরে একবার পড়লে আর নড়েচড়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না।
শুধু কি জঙ্গলে? জলের ওপরে, সমুদ্রের তলায়, অস্ট্রেলিয়ার মরুপ্রান্তরে, আল্পস-এর তুষার ধবল চড়ায়—মায় উত্তর আর দক্ষিণ-মেরুর কনকনে শীতে কত দিন কত রাত কাটিয়েছেন তিনি! হ্যাঁ, এই আমাদের ঘনাদা।
বিজ্ঞানকে নিয়েও ঘনাদা কম মোচড় দেননি। তা হলে কি তিনি একজন বিজ্ঞানী? তা—তা,—হ্যাঁ বিজ্ঞানীও বটেন বৈকি! নিজের হাতে বিজ্ঞানের গবেষণা না করলেও নানা বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে এসে তিনি যে সব তথ্য পরিবেশন করেন তা কিন্তু সত্যি অস্বাভাবিক মনে হলেও মোটামুটি বিজ্ঞান-নির্ভর—বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্ৰ বা নিয়মকে মেনে নিয়েই তা রচিত। আর খুঁটি-নাটি সেই তথ্যগুলি এত নিখুঁত যে মনেই হয় না এ কোনও বিজ্ঞানীর নিজস্ব গবেষণালব্ধ ফল নয়। এ ব্যাপারে ঘনাদাকে অনন্য বলা যেতে পারে এবং এ জন্যই তাঁর ‘গুল-দেওয়া-কাহিনি’গুলোর মধ্যেও কেমন, একটা অনাস্বাদিত আনন্দ পাওয়া যায়। পড়ে ভাবতে হয় এবং ভেবে মনে হয়, আচ্ছা, এরকমটা তো সত্যিই অসম্ভব নয়! হতে পারে না কি ? আবার সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহ জাগে বাস্তবে কখনও এ জিনিস ঘটতে পারে?
ঘনাদার গল্প এক-একটা এক এক স্বাদের—যদিও ঘনাদার চাল মারার পরিচয় বহন করে আছে সব ক-টিই। লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র এমনভাবে চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন যে তার প্রত্যেকটা চালচলনে যেমন মজা লাগে তেমনি মাঝে মাঝে ভাবায়ও। লেখকের নিজের ভিতর যে একটা বিজ্ঞানমানসিকতা আছে সেটাই এ সব গল্পে ধরা পড়ে এবং লেখকের প্রতি অলক্ষ্যে একটা শ্রদ্ধাও জেগে ওঠে আমাদের মনে। প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রথম জীবনে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও নিজে বিজ্ঞানী নন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর কৌতূহল অদম্য আর তারই ছায়া এসে পড়েছে এইসব গল্পে।
ঘনাদা নিজেও, আগেই বলেছি, ঠিক যে অর্থে আমরা বিজ্ঞানী বলি সে অর্থে বিজ্ঞানী নন। কিন্তু তাঁরও একটা বিজ্ঞান মানসিকতা আছে যা ছড়িয়ে আছে তাঁকে নিয়ে লেখা অজস্র গল্পের মধ্যে।
কয়েকটা উদাহরণ দিলে হয়তো ব্যাপারটা আর একটু স্পষ্ট হবে।
মশার লালাকে রাসায়নিক পরিবর্তন করে সাপের বিষের মতো ভয়ংকর করা যায় কি? এ ধরনের কিছু কিছু পরিবর্তন এ যুগের বায়োকেমিস্টরা করবার চেষ্টা করেছেন এবং সে চেষ্টা সাফল্যের দিকেই এগিয়ে চলেছে। ঘনাদার গল্পে দেখেছি জাপানী বিজ্ঞানী নিশিমারাও এ রকম একটা চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন—যদিও উদ্দেশ্য ছিল তাঁর অত্যন্ত অসৎ এবং পৃথিবীর পক্ষে বিপজ্জনক তো বটেই। ঘনাদা তাঁর বিজ্ঞানমানসিকতার সাহায্যে ওই উদ্দেশ্য ধরে ফেলেন, তারপর ওই মশা দিয়েই নিশিমারারও ভবলীলা শেষ করে দেন। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি।
ইহুদী কীটতত্ত্ববিদ জ্যাকবের কাহিনিও এইরকম আর একটি রোমাঞ্চকর কাহিনি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ও ওই সময়ে নাৎসী জার্মান অর্থাৎ প্রাশিয়ানরা ইহুদীদের ওপর যে জঘন্য অত্যাচার করে চলেছিল তারই প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর। তিনি ঠিক করলেন সিসি বা সিস্টোসাকা গ্রিগেরিয়া নামে পঙ্গপাল জাতীয় একটি পতঙ্গের সাহায্যে ধ্বংস করে দেবেন সারা ইয়োরোপের শস্যভাণ্ডার। একমাত্র আফ্রিকাতেই এক বিশেষ অঞ্চলে এই জাতের পতঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। জ্যাকব সেইখানে গিয়ে এই পতঙ্গের বংশ বৃদ্ধি করিয়ে তাদের সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়াবার জন্য তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করলেন। কীটতত্ত্ববিদদের কাছে কিন্তু ব্যাপারটা নতুন নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যে পঙ্গপালের সৃষ্টি হল তা অভূতপর্ব। জ্যাকব মতলব করেছিলেন তিনি ইটালি থেকে তাঁর এই পঙ্গপালের আক্রমণ শুরু করবেন। কথাটা তিনি তাঁর ভাই আইজ্যাককে বললেন। আইজ্যাক ইহুদী হলেও প্রাশিয়ান সেজে নাৎসীদের আস্থাভাজন হয়েছিলেন—নাম নিয়েছিলেন ভরনভ্। দুজনে অনেকদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে গেল ট্রেনে। জ্যাকব চাইলেন ভরনভ্ ওরফে আইজ্যাক ইহুদী নির্যাতনের প্রতিশোধ গ্রহণে তাঁর সঙ্গী হোন। আইজ্যাক তখনকার মতো রাজী হলেও শেষ পর্যন্ত ওই নিদারুণ বিপর্যয়ে সারা ইয়োরোপকে জড়াতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি উলটে ওই পঙ্গপাল ধ্বংস করার জন্য গোপনে আবিষ্কার করলেন একরকম রোগবীজাণু, যা একটি পঙ্গপালের দেহে কোনও রকমে বিঁধিয়ে দিতে পারলে সে নিজে তো রোগাক্রান্ত হবেই সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পঙ্গপালের দলে ছড়িয়ে পড়বে সে রোগ মহামারী আকারে। নিজেকে গোপন রেখে তিনি একাজে তাঁর প্রতিনিধি ঠিক করলেন ঘনাদাকে এবং ঘনাদা কি কৌশলে একটি মাত্র পঙ্গপালকে ধরে তার ওপর এই ওষুধ প্রয়োগ করে গোটা ইয়োরোপকে শস্যহীন, দুর্ভিক্ষপীড়িত হবার বিপদ থেকে মুক্ত করলেন সে আর এক কাহিনি। নিজে আবিষ্কার না করলেও তার প্রয়োগ কৌশলে ঘনাদার কৃতিত্ব এই গল্পের একটা বড় উপাদান।
এমনি ধারা ভয়ংকর এক আগাছার চাষ করে জমির সমস্ত ফসলকে বিষিয়ে দিয়ে দেশকে দেশ শস্যহীন মরুভূমি করে দেওয়ার প্রচেষ্টা—তারও গল্প শুনতে পাই ঘনাদার কাছেই।
চাষীর ক্ষেতে আগাছার উপদ্রব এখন প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হলেও অনেকেই জানে না যে এমন অনেক আগাছা আছে যাদের বীজ মাটির তলায় ৩০/৪০ বছর ঘুমিয়ে থাকতে পারে, তার পর একদিন আলোয় বেরিয়ে এসে তারা শুরু করে দেয় তাদের বিষক্রিয়া। এমনি ধরনের কয়েকটা আগাছার চলতিনাম ‘ব্ল্যাক মাস্টার’, ‘ইভনিং প্রিমরোজ’। এইরকম আগাছার সাহায্যে সারা দেশের কৃষিব্যবস্থা বানচাল করার চেষ্টাকে কি করে ঘনাদা প্রতিহত করলেন সে গল্পও শুনতে মন্দ নয়। আর এর যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
এমনি আরও কত গল্প!
সমুদ্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। আসলে সেটা একটা নিবন্ত আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টির জল জমে জমে সেই পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়ে গেছে এক বিশাল হ্রদ। হ্রদের নিচে যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি রয়ে গেছে তা কেউ জানে না। কিন্তু ওই জলের মধ্যে যে হীরে ছড়ানো আছে সে খবর রাখত ঘনাদার ফরাসী বন্ধু পেত্রা। ওই পেত্রার সঙ্গে ডুবরীর পোশাক পরে জলে নামলেন ঘনাদা, তার পর একটা হীরে, যাকে দেখে ছোট একটা নীলচে কিন্তু জ্বলজ্বলে নুড়ি বললেও ভুল হয় না, শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে আলগা করে নিয়ে তুলে ফেললেন। দেখা গেল ওর তলায় একটা নলের মতো গর্ত রয়েছে আর নুড়ি তুলতেই তাই দিয়ে হুড় হুড় করে জল নেমে যাচ্ছে পাতালের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পেত্রা পাগলের মতো ঘনাদার হাত ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে এল হ্রদের এক কোণে, তারপর তরতর করে দড়ি বেঁধে নেমে গেল নীচে সমুদ্রের বুকে যেখানে একটা মোটর বোট আগেই লুকিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। বোটে উঠেই জোরে ছটিয়ে দিল সেটা। আর, খানিক পরেই শুরু হল প্রলয় কাণ্ড। হাজার বজ্রের মতো শব্দ করে গোটা পাহাড়টাই ফেটে চৌচির হয়ে গেল।
এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক। আপাতদৃষ্টিতে আজগুবি মনে হলেও ভূতত্ত্বের দিক দিয়ে ব্যাপারটা মোটেই অসম্ভব নয়। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বন্ধ হয়ে গেলেও অনেক গভীরে তার আগুন নাও নিবতে পারে–ধিকি ধিকি করে জ্বলছে তো জ্বলছেই। এখন, জ্বালামুখ বন্ধ হয়ে গেলেও একটা ছোট্ট গর্ত রয়ে গিয়েছিল তার গায়ে আর সেই গর্তের ওপর হীরেটা খুব চেপে বসে থাকায় সে গর্ত বন্ধ হয়েই ছিল। হীরের নুড়িটা খুবলে তুলে নিতেই সেই ছোট্ট গর্তের মুখটা গেল খুলে আর সেই গর্তের ভিতর দিয়ে ওপরকার জল তোড়ে গিয়ে পড়তে লাগল একেবারে তলাকার আধ-ঘুমন্ত আগুনে পাহাড়ের সেইখানটায় যেখানে ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল আগুন যার প্রচণ্ড উত্তাপের কথা ভাবা যায় না। ফলে চোঁয়ানো জল সেই প্রচণ্ড তাপে সঙ্গে সঙ্গে বাষ্পীভূত হয়ে আবার ঠেলে উঠতে লাগল ওপরে–সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করল প্রচণ্ড চাপের। বাষ্প ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে তো হচ্ছেই, তার চাপও ক্রমাগত বেড়ে চলছে তো চলছেই। আর ওপরে তো বেরিয়ে যাবার পথ ওই সবেধন একটি গর্ত! সেখান দিয়ে আর কতটা বাষ্প বেরিয়ে যেতে পারে? তার আশপাশে রয়েছে শিলাখণ্ড, কিন্তু তার সাধ্য ছিল না সে চাপ সহ্য করার। ফলে গোটা পাহাড়টাই ফেটে চৌচির করে দিল সেই প্রচণ্ড বাষ্পের চাপ। তার জন্য শব্দ তো হবেই।
গল্পের খাতিরে ব্যাপারটা হয়তো একটু ফাঁপিয়েই লেখা হয়ে থাকবে কিন্তু বিজ্ঞানের দিক দিয়ে দেখলে ব্যাপারটা মোটেই অসম্ভব নয়। ভিতরকার রহস্যটা অবশ্য ঘনাদা নিজে উদ্ধার করেননি, কিন্তু পেত্রার ব্যাখ্যা তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন তাঁর বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে।
কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে কি ঘনাদা কখনও বিজ্ঞানীর ভূমিকা নেননি? হ্যাঁ, তাও নিয়েছেন।
ইউরেনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় মৌল এবং এটি পাওয়া যায় পিচব্লেণ্ড নামক মিনারেল বা খনিজ থেকে। মাদাম কুরি তাঁর প্রথম তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরোনিয়াম, তার পর পোলোনিয়াম এবং শেষে রেডিয়ামও আবিষ্কার করেছিলেন এই পিচব্লেণ্ডেরই পরিত্যক্ত ছিবড়ে থেকে। বিজ্ঞানসচেতন ঘনাদা এ খবর ভালো করেই রাখেন এবং কি করে এই তেজস্ক্রিয়তার হদিস পাওয়া যায়, কি করে সেই তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ মাপা যায় সেই যন্ত্র গেপার বা গাইনার মুলার কাউন্টার এর সঙ্গেও বেশ পরিচিত। তাই নাৎসী জার্মানীর হয়ে প্যাপেন আর তার সঙ্গীরা যখন ইউরেনিয়ামের খোঁজে বিছে উপত্যকায় এসে পাহাড়ের ওপর ঘনাদাকে ওই যন্ত্র সম্মুখে রেখে ম্যাপ আঁকতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তখন ঘনাদার পক্ষে তাদের মতলব আঁচ করতে কষ্ট হল না। জার্মানী তখন অ্যাটম বোমা বানাবার চেষ্টা করছে। তার জন্য তার দরকার প্রচুর ইউরেনিয়াম জাতীয় তেজস্ক্রিয় মৌল। ঘনাদা সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে ফেললেন। তিনি ওদের বাধা দেবেন।
কিন্তু ওদিকে আফ্রিকান সর্দারের ভুল বোঝাবুঝির ফলে যখন জংলীদের হাতে প্রাণ হারাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, কুলিরা প্যাপেনকে পিছমোড়া করে বেঁধে তার জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়েছে, আর প্যাপেনের সঙ্গীরা প্যাপেনের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর তার যন্ত্রপাতি কেড়ে নিয়ে নিজেরাই চলে গেছে ইউরেনিয়ামের সন্ধানে, তখন ঘনাদা যে কাণ্ডটা করলেন তা শুনতে সামান্য হলেও অভাবিতপূর্ব। এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন তিনি। প্যাপেনের যে সঙ্গীরা যন্ত্রপাতি নিয়ে ইউরেনিয়ামের সন্ধানে বেরিয়ে গেছে তারা ইউরেনিয়াম খনির সন্ধান নিশ্চয়ই জেনে ফেলবে আর কি পরিমাণ ইউরেনিয়াম ওখানে আছে তারও আভাস ঘনাদা ইতিমধ্যেই জানতে পেরে গেছেন। তাদের বাধা দিতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরকেও মুক্ত করতে হবে।
বিহে উপত্যকাটা শুকনো ঘাসের জঙ্গলে ঢাকা আর সারাদিন সেখানে উত্তর-পূর্ব থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। সেই ঘাসবনে কোনও রকমে আগুন ধরিয়ে দিতে পারলেই কার্যসিদ্ধি হতে পারে। তার জন্য চাই একটা দিয়াশলাই।
কিন্তু না, দিয়াশলাই নেই। প্যাপেনের কাছে যে-টা ছিল তার শেষ কাঠিটাও সে চুরুট জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়েছে।
এখন কী করা? হঠাৎ ঘনাদার বিজ্ঞানী মনে ভেসে উঠল সেই লেন্সের কথা। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল তার দূরবিনের একটা লেন্স আচমকা খুলে পড়ে গিয়েছিল, তিনি সেটা পকেটেই পুরে রেখেছিলেন। তবে আর ভাবনা কি? চকিতে লেন্স বার করে নিয়ে তার ওপর সুর্যের আলো ফোকাস করে ঘাসবনের দিকে ধরলেন ঘনাদা। পরমুহূর্তেই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন সামনের একটা ঘাসের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল ঘাসবন,–না, যেন সমস্ত ঘাসবনটাই জ্বলন্ত রূপ নিয়ে সহস্র সাপের ফণা দুলিয়ে ছুটে চলল হাওয়ার সঙ্গে দিগ্বিদিকে।
যে জংলীরা আসছিল আক্রমণ করতে তারা প্রাণভয়ে কে কোথায় পালাল তার ঠিক নেই আর ইউরেনিয়াম-সন্ধানী নাৎসীদেরও আর ইউরেনিয়াম খনি উদ্ধার করা সম্ভব হল না।
এ ছাড়া আরও কত রকম গল্প! তুষার রাজ্যে তুষারমানব ইয়েতির সঙ্গে মোলাকাৎ, তিমি-ধরা জাহাজে করে মেরু অঞ্চলে গিয়ে মোম-তিমি শিকার, সেখানে পেঙ্গুইন পাখিদের হালচাল পরিদর্শন তার পর গিরিগহ্বরে আটকা পড়ে ছড়ির সাহায্যে জমে থাকা গরম গ্যাস বার করে নিয়ে পোর্টেবল তাঁবু দিয়ে বেলুন বানিয়ে সেই হালকা গরম গ্যাস বেলুনে পুরে বেলুনের সাহায্যে উড়ে গিয়ে উদ্ধার পাওয়া—এই রকম কত কি! কিছুটা আজগুবি মনে হলেও এগুলি সবই ঘনাদার বিজ্ঞান-মানসিকতার সাক্ষ্য বহন করছে। এমন কি বাইরের অজানা গ্রহ থেকে আসা উড়ন্ত চাকীর কাহিনিও বাদ যায়নি।
তাই বলছিলাম, ঘনাদা বিজ্ঞানী না হয়েও বিজ্ঞানী, নিজের হাতে আবিষ্কার না করেও আবিষ্কারের সবজান্তা। তাঁর সমস্ত গল্পই কল্পিত, কিন্তু তার ভিতরকার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগলি অস্বীকার করব কী করে?
কঃ সঃ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকার ঘনাদাকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যায়। এটি ওসিয়ার করে সাহায্য করেছেন দেবস্মিতা মিত্র এবং সন্তু বাগ।
Tags: ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, পূজাবার্ষিকী, প্রবন্ধ, বিজ্ঞানী ঘনাদা
আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক – ছোট বেলায় দেব সাহিত্য কুটিরের পূজা বার্ষিকী বেরোলে সবার আগে পড়তাম ঘনাদা আর ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের লেখা। খুবই ভাল লেগেছিল যখন কলেজে ওনাকে পেলাম প্রিয় শিক্ষক রূপে। পুরো দুবছর ওনার কাছে ইনর্গ্যানিক কেমিস্ট্রি পড়েছি।