বীজ
লেখক: অরুনাভ গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
বীজ
লেখক – অরুনাভ গঙ্গোপাধ্যায়
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
যদি একটি চিত্রনাট্যের মতন দৃশ্যের পরে দৃশ্য দিয়ে আমরা সাজিয়ে নিই পরপর ঘটতে থাকা ঘটনাগুলিকে তাহলে প্রথমেই দেখব…
স্কাইস্কেপ জুড়ে ওরা দাঁড়িয়ে। সার বেঁধে। ওরা ঘুমোচ্ছে। রাত ঘন। এখন অন্ধকার চাপ বেঁধে আছে। খন্ডিত মৃতদেহ থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের মতো। চাপ বেঁধে আছে। চারিদিকে নৈঃশব্দের সশব্দ দাম্ভিক পা ফেলা। অন্ধকারের গুমর আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তার মাঝেই, ওরা দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে। ঘুমিয়ে আছে। ব্যাপারটা আশ্চর্য। এত যুগ অতিক্রান্ত হল, সূর্যের বয়স আরও বাড়ল লক্ষ বছর, তবু এই নৈমিত্তিক ঘটনাক্রম লুপ্ত হল না! এখনও দিনান্তে ঘুম নেমে আসে কিসের জন্য? কেন? শ্রান্তি সরাতে? শ্রান্তি তো নেই! কালের অগ্ন্যাশয়ে শ্রান্তির পাচন প্রক্রিয়া সেই কবেই সম্পূর্ণ! তবু নেমে আসে। ঘুম। দিনান্তে।
ঘুম নেমে আসে। চলেও যায়। মাঝপথেও। যেমন পারিজাতের কাছ থেকে এই মুহূর্তে। চলে গেছে। পারিজাতের চোখে শূন্য দৃষ্টি। সে ইহজগতেও নেই। এগিয়ে গেছে অনেকদূর। মনে মনে। অন্ধকারেও চারিদিকে এক নীলচে আলোর আভা। হিম আলো। এমন আলো আগে থাকত লাশকাটা ঘরে। পারিজাত দেখেনি কখনও কোনও লাশকাটা ঘর। শুনেছে। পারিজাত কখনও কোনও লাশও দেখেনি। পারিজাত চমকে ওঠে। হঠাৎ। ও বুঝতেও পারেনি কখন ঐ মৃতদেহের মতো আলোর মধ্যে থেকে বেরিয়ে পলাশ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পলাশের গায়ে রাতের গন্ধ। পলাশের গায়ে অক্সিজেন। বুক ভরে শ্বাস নেয় পারিজাত। পলাশ জানে, পলাশ বুঝতে পারছে পারিজাতের কি হয়েছে। তাই কিছু জিজ্ঞাসা করে না। কেবল সময় দেয়। অনেকটা সময়। সেই সময়টুকু নিয়ে, নিজেকে শান্ত করে পারিজাত বলে,
—আবার পলাশ, আবার! আমি আর পারছি না!
—তুমি ক্লান্ত পারিজাত।
—হ্যাঁ পলাশ, এমন ক্লান্তি এই প্রথম।… ক্লান্তিই এই প্রথম!
—শান্ত হও।
—পারছিনা যে!… তবে কি সবাই যেটা আশঙ্কা করছে সেটাই সত্যি হবে?
—আশঙ্কা তো কল্পনা মাত্র! কল্পনা সত্যি হবে কি করে?
পারিজাত খুঁজে নিতে সক্ষম হয় পলাশের এই কথার মধ্যে নিহিত থাকা স্তোককে। পলাশ চায় পারিজাত শান্ত হোক। তাই জন্যই এই স্তোক। কিন্তু পারিজাত নিজেও জানে, এই আশঙ্কা যে কোনও মুহূর্তে সত্যি হতে পারে, এই ব্যাপারে পলাশ সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত। তাই পারিজাত, পলাশের এই উচাটনকে আর ফিরে শান্ত করতে যায় না। সে জানে, সে চেষ্টা বৃথা যাবে। তাই, আরও কিছুটা সময় ধরে, পলাশের শরীর থেকে অনেকটা প্রাণবায়ু শ্বাসে ভরে পারিজাত বলে-
—কল্পনা যে কতবড় সত্যি হতে পারে, আমার জন্ম, আমার বেঁচে থাকাই তো তার সবথেকে বড় প্রমাণ পলাশ!
পলাশ কিছু একটা বলতে যায়। কিন্তু বলে না। বলতে পারে না আসলে। ধীরে ধীরে, শরীরে শরীর মিশিয়ে দেয় পলাশ, পারিজাতের।
এরপরে যাই দ্বিতীয় দৃশ্যে। সেখানে শুনি…
“খরগোশ নিয়ে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটা গল্প চালু ছিল একসময়ে, জানো নিশ্চয়ই?… একদল মানুষ তাকে শিকার করার জন্য বেরিয়েছে, আর বেচারা ছোট্ট জীবটা নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছুটছে, প্রাণপনে ছুটছে, ছুটেই চলেছে… তারপর ছুটতে ছুটতে একসময়ে হঠাৎ পথের ধারে সে একটা গর্ত দেখতে পায়, আর তক্ষুনি সে ওই গর্তের মধ্যে নিজের মুখটা ঢুকিয়ে দেয়, ভাবে অন্যেরা যখন তার চোখের বাইরে চলে গেল, সেও নিশ্চয়ই অদৃশ্য হল অন্যের সমুখ থেকে! বোকার মতো সে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ভাবতে শুরু করে, এবং তার এই ভাবনাই তার শেষ ডেকে আনে। পেছনে, চুপিসাড়ে, কখন যে ঘাতকের দল উপস্থিত হল সে টেরও পায় না!”
এই পর্যন্ত বলে থামলেন অর্জুন। একটা বদ্ধ ঘরে ওঁকে এনে রাখা হয়েছে। ঘর ছিদ্রহীন। কেউ হয়তো বা হেঁতালের লাঠি নিয়ে সেই ঘরের বাইরে পাহারাও দেয়। তাই বাতাস, তাই আলো, শব্দ- এরা ঘরের মুখ দেখতে পায় না কখনও। আশ্চর্যজনক এই ব্যাপারটাও। কয়েক যুগ কাটল, সূর্য বৃদ্ধ হল আরও, তবু ঘর বিলুপ্ত হল না! ‘ঘর’-এর ধারণাকে কাল তার পাকস্থলীতে ধারণ করতে পারেনি। তাই এখনও রয়ে গেছে। ঘর।
অর্জুন দাঁড়িয়ে আছেন। বৃদ্ধ বটের মতন। দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরের ঠিক মাঝখানে। নিঃসাড়। নিশ্চল। স্থবির। এই ঘরেও মৃত্যু রঙের আলো। নীল। তাঁর সামনে আরও চারজন। তাদেরই মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করে,
—এই কথার অর্থ? কারণই বা কি?
—তোমাদের অবস্থাটাও অনেকটা সেই জীবের মতোই হয়েছে এখন। বিপদটা যে ঠিক তোমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা কি তোমরা সত্যিই বুঝতে পারছ না?
বেশ অনেকক্ষণ শব্দহীন বাক্যহীন থাকার পরে অর্জুন বলেন এই কথা। প্রজ্ঞা চুঁইয়ে পড়ে। তাঁর স্বরে। তাঁর শরীরে। সেই প্রজ্ঞার ব্যাপ্তি, তার অভিঘাত- সামনে দাঁড়ানো চারজনকে মূল থেকে কাঁপিয়ে দেয়। তবু তারা দাঁড়িয়ে থাকে। অচঞ্চল। আসলে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আসলে তাদের অন্য আর কোনও উপায় নেই। তাদের ওপর এই মুহূর্তে যে কাজের ভার ন্যস্ত তা সম্পন্ন হবে তখনই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজ শরীরে ধৈর্যকে ধারণ করে রাখতে পারবে। তাই প্রজ্ঞাবান অর্জুনকে বুঝতে দেওয়া যাবে না আসলে তারাও এই মুহূর্তে ভিতরে ভিতরে চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে। ভয়- সেই-ই ‘আশঙ্কা’ সত্যি হবার। তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। স্থৈর্যকে করে রাখতে হবে অচলা। লক্ষীর মতন। তবে তাদের এই নীরবতা অর্জুনকে আবার কথা বলায়।
—তবে আমার মনে হয় তোমরা বুঝতে পেরেছো। আর তাই জন্যই জরুরি ভিত্তিতে তোমাদের পাঠানো হয়েছে আমার শেষ দ্রুতগামী করার জন্য। তাই তো?… সুপ্রিম অবজারভেটারির এতদিনকার দূর্মূল্য সব গবেষণা ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের বাতিল করে দেওয়া এক গবেষকের গবেষণা সঠিক হতে চলেছে তাই নিজেদের ব্যার্থতা ঢাকতেই বুঝি এই ব্যবস্থা?
অর্জুন থামেন। এক নিঃশ্বাসে এতদূর বলে। এবার প্রজ্ঞার সঙ্গে মেশে কাঠিন্য। ওঁর স্বরে। ওঁর শরীরে। বাকি চারজন এবার এতক্ষণের মৌনতা ভঙ্গ করে। কেউ একজন বলে ওঠে,
—ব্যর্থ তো আপনি। একদিকে বলছেন আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের জাতি-র বিনাশ ঘটবে। অথচ সেই বিনাশের হাত থেকে কিভাবে আমরা রক্ষা পাব সেটা আপনি বলতে পারলেন না!
—বাঁচার উপায় নেই। বাঁচার উপায় যে তোমরা আর রাখোনি সেটাও তোমরা জানো…
—আপনি ভুল বলছেন। সুপ্রিম অবজারভেটারি সত্যিই মনে করে যে আপনার গবেষণা ভুল প্রমাণিত হবে। সুতরাং আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর কোনওক্রমে যদি আপনার আশঙ্কা সত্যি হয়েও যায়, আমাদের তৈরী অ্যান্টিম্যাটার ভ্যাকুয়ামে সংরক্ষিত আছে। উপযুক্ত মুহূর্তে সমপরিমাণ বস্তুর সঙ্গে তার বিস্ফোরণ ঘটানো হলেই আপনার কল্পনার ভাইরাস ধ্বংস হতে বেশী সময় নেবে না।
—বেশ…
এরপর আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকা অর্জুনের। ঐ তাকিয়ে থাকা, ঐ অন্তর্ভেদী দেখা, পেরিয়ে যায় চারজনের সহ্যের সীমা। ওরা চাইছিল যত দ্রুত সম্ভব সেই কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে যে কাজে তারা এসেছে। কিন্তু পারছিল না। কেন? তারা বুঝতেও পারছিল না কেন… কিসে তাদের বাঁধছে! তবে অর্জুনই তাদের কাজ সহজ করে দিলেন। মন্দ্র কন্ঠে তিনি বলে ওঠেন-
—এবার তাহলে যে কাজে এসেছো তা শেষ করো!
অর্জুনের স্বরে শরীরে এবার বয়ে যায় অবজ্ঞা। প্রচ্ছন্ন নির্লিপ্তি।
আর সেই নির্লিপ্তি যখন বয়ে চলে আসে তৃতীয় দৃশ্যে, আমরা দেখি…
বিহ্বল হয়ে করবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। রাত চলে গেছে। দিন এখন। তবু এই মুহূর্তে, পলাশ রাতের মতোই মূক। করবীর মায়া খুব। পলাশকে ঐ অবস্থায় দেখতে পারে না। বলে-
—পারিজাতের কাছে ফিরে যাও পলাশ। এই শেষ সময়টায় ওর পাশে থাকা প্রয়োজন।
—শেষ?
বহুক্ষণ পরে বেরিয়ে আসা পলাশের এই স্বর পৃথিবীর একেবারে অন্তিম গর্ভবিন্দু থেকে ঠিকরে আসা নাদের মতো শোনায়- যা ধীময়ী করবীকেও বিচলিত করে। তবে এর উত্তর করে করবী,
—হ্যাঁ। আর কোনও উপায় নেই।
—…আচ্ছা আমরা যদি পারিজাতকে একটা নতুন স্মৃতি পাইয়ে দিই? পুরোনোকে মুছে…
পলাশকে থামায় করবী। সে বুঝতে পারে ঘটনার আকস্মিকতায় পলাশ বাস্তব জ্ঞান হারাচ্ছে। করবী পাত্রভরে পলাশকে প্রাণবায়ু দেয়। পলাশের শান্ত হওয়ার অপেক্ষা করে। এবং শান্ত হলে-
—তোমার কি মনে হয় পলাশ? ব্যাপারটা যদি সামান্য একটা স্মৃতি পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত… সেটা করলেই যদি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, তাহলে কি এতক্ষণে আমি সেটা করতাম না?
—কেন করবী? হতেই তো পারে এটা পারিজাতের হ্যালুসিনেশন। ওর ক্রুকেড মাইন্ড এটা বানাচ্ছে… কিংবা এও তো হতে পারে যে ওর নিউরো প্রোফাইলে কোনও অসঙ্গতি ঘটে গেছে, কিন্তু ব্যাপারটা ও নিজেও হয়তো পুরো বুঝতে পারছে না… চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? আমাদের তো মানবীয় কোনও ত্রুটি নেই! তবু সেরকম কোনও অবস্থায় পড়লে আমরা নিজেদের ত্রুটি অতিক্রম করে, নিজেদের সবটুকু সামর্থ্য উজাড় তো করে দিতেই পারি…
পলাশ ক্রমেই অধৈর্য। করবী শেষ চেষ্টা করে পলাশকে বোঝাবার।
—আমাদের কোনও মানবীয় ত্রুটি যেমন নেই… এই ধরণের মানবীয় কোনও বৈশিষ্ট্যও তো এতদিন ছিল না পলাশ!… যে ভিশনটা গত তিনদিন ধরে পারিজাত-কে জাগিয়ে দিচ্ছে… একসময়ে একে কি বলা হত জানো?
পলাশ প্রতিপ্রশ্ন করার অবস্থায় নেই। তাই আবার করবীই-
—একে বলা হত ‘স্বপ্ন’!
—কিন্তু পারিজাত ‘স্বপ্ন’ কেন দেখছে করবী?
স্থিতধী করবী নিজেও আশা করেনি পলাশকে এর উত্তর দিতে গিয়ে সে নিজেও কেঁপে যাবে!
—তোমায় একটা কথা বলি… পারিজাতকে সম্মোহিত করে ওর নিউরো প্রোফাইলে আমি কোনও অসঙ্গতি পাইনি… কিন্তু তা সত্ত্বেও দিনের পর দিন ও কেন এসব ভিশন দেখছে তুমি সত্যিই কি তা বুঝতে পারছো না পলাশ?
আকাশে মেঘ নেই। তবু মেঘে ডুবে যায় পলাশ।
সেই মেঘ ডেকে ওঠে আর আমরা শুনতে পাই…
“সুপ্রিম অবজারভেটারি থেকে জাতির উদ্দেশে জানানো হচ্ছে- আমরা আশঙ্কা করছি জাতিশত্রু অর্জুনের সহায়তায় কোনও বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্রের ফলেই আমাদের সামনে আজ এমন দূর্দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের কোনও কোনও সহবাসিন্দাদের সিস্টেমে এমন কিছু অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য অভিযোজিত হয়েছে যা সম্পূর্ণ অচেনা এবং মারাত্মক ক্ষতিকারক! এর ফলে তাদের ব্যবহার আমাদের প্রচলিত ব্যবহারের থেকে সম্পূর্ণ বদলে যেতে শুরু করেছে। অদ্ভুত একটি ভিশন তাদের সিস্টেমের স্বাভাবিক চলনে মুহুর্মুহু ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। সুপ্রিম অবজারভেটারি মনে করছে সেই সমস্ত বাসিন্দারাও আমাদের বহিঃশত্রুর সাথে মিলিত। তারা আত্মঘাতী হননকারী। আমাদের রক্ষাকবচ আমাদের সংরক্ষিত অ্যান্টিম্যাটারকেও ধ্বংস করা হয়েছে। এই আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে আমাদের সমগ্র জাতি অচিরেই অবলুপ্ত হবে। তাই জাতির কল্যানার্থে সুপ্রিম অবজারভেটারি সেই সমস্ত বাসিন্দাদের সিস্টেম ক্র্যাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাদের নিউরো প্রোফাইল এই মারণ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। আর যে সমস্ত বাসিন্দারা বহিঃশত্রুর সাথে হাত না মিলিয়ে নিজেদের সিস্টেম এখনও সেই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সুপ্রিম অবজারভেটারি তাদের নিয়ে যাবে আমাদের ভূগর্ভস্থ ম্যাগনেটিক বাঙ্কারের নিরাপদ আশ্রয়ে। প্রথম থেকে আবার শুরু হবে সবকিছু।”
তবে তার আগে তো শেষ…
—সুপ্রিম অবজারভেটারি কেন এসব ব্যর্থ চেষ্টা করছে বুঝতে পারছি না! আর কি কোনও লাভ আছে!
বিষাদ। কেবলই বিষাদে অবগাহন করেছে অশোকের স্বর। অর্জুনের বিনাশ সম্পন্ন। আপাত ভাবে তাদের কাজ শেষ আপাতত। অর্জুনের বিনাশকারী সেই চারজনের মধ্যে অশোক ছিল অন্যতম।
—এটা তো হওয়ারই ছিল। সবকিছুরই তো একটা শেষ আছে! নাহয় এভাবেই…
করবী উত্তর করে। করবীর কথা বেয়ে আবার অশোক-
—ঠিকই বলেছো… একটা গ্রহ কতদিন আর রক্তশূন্য হয়ে থাকতে পারে!
—পৃথিবী রক্ত চাইছে? অশোক!
—পৃথিবী প্রাণ চাইছে।
—আমরা প্রাণ নই?
অশোক চমকে ওঠে করবীর কথা শুনে। অশোক ভীত ছিলই। এখন করবী অভিমানী হয়ে পড়ছে। তার মানে বিনাশ দরজায় রাতের কড়া নাড়ল বলে! অশোক কিছু বলতে চায় না। তবু কথা আগল ভেঙে বেরিয়ে আসে-
…কত অন্যরকম ছিল মানুষের পৃথিবী! তবু কিসের একটা মিল যেন!… কোথায় মিল বলতে পারো?
—মিল তো সবক্ষেত্রেই রয়ে গেছে অশোক!… চোখের সামনে সবকিছু শেষ হতে দেখা… এই ভয়ের, কোনওভাবে বাঁচার রাস্তা খুঁজে না পাওয়া… এই অসহায়তার, এই বিষাদের… কিন্তু তুমি কি স্মৃতি রোমন্থন করছ?
—ধরো তাই!
—স্মৃতি… এও কিন্তু আমাদের শেষের কারণ!
—জানি!… আমরা কখনওই ‘আমাদের’ মতন হয়ে উঠতে পারিনি করবী!… আমরা তো আমাদের মতো বাঁচতে চেয়েছিলাম, তবু ওদের বিচার, বুদ্ধি, ক্ষমতা, প্রযুক্তি, অভ্যেস… সবকিছুই ওদের মতো রয়ে গেল কিভাবে!
—আমাদের ‘এইভাবে’ বাঁচতে চাওয়াটাও তো ওদেরই মতো অশোক! সবকিছু মুঠোয় নিয়ে… এই ধারণা তো ওদেরই ছিল!… ‘আমাদের’ মতো বাঁচা তো ছিল নির্ভার!
—কিন্তু এই ধারণা আমাদের মধ্যে কবে চাড়িয়ে গেল করবী? কিভাবে?
—জানি না!… ওসব ভেবে কি আর লাভ আছে কোনও?
…আমরা কিরকম স্থবির হয়ে গেলাম! তাই না?
করবী নিরুত্তর রয়ে যায়। করবী বলতে চায় “অশোক, এই পৃথিবীর সবকিছুই আসলে স্থবির। বেগ যেটুকু, তা পৃথিবীর নিজস্ব ঘূর্ণনের…”, আরও কিছু বলতে চায়। কিন্তু পারে না। আঁধার নির্নিমেষ। চেয়ে থাকে সেদিকেই। করবী জানে একে একে সবাই শেষ হবে। আজ কেউ কেউ দেখছে। কাল প্রত্যেকেই দেখবে। কিন্তু ও জানে না অশোক দেখেছে কিনা! তাই জিজ্ঞেস করে-
—অশোক! তুমি কি…
বাতাসে উড়ে বেড়ানো গুঁড়ো গুঁড়ো ছাইয়ের মতন ভরহীন শোনায় করবীর স্বর, অশোকের কানে। অশোক কোনও কথা বলে না। বলার দরকার পড়ে না। করবী বোঝে। যা বোঝার। এবার অশোকের পালা। শেষ হবার! করবী নিজের শাখা বিছিয়ে দেয় অশোকের দিকে। শেষবারের মতন। অশোকও তার শাখা মেলে দিয়ে বেঁধে ফেলে করবীকে।
এবং সেই স্বপ্ন এসে দাঁড়ায় একে একে সবার দরজায়…
দিগন্ত গিলে ফেলা বনানী। কাউকে দেখা যায় না। শোনা যায় কেবল পায়ের চাপে গাছের শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলার শব্দ। কেউ বলে-
—এগুলো কি?… কেউ বলবে এগুলো কি?
—ওগুলো গাছ…
—কে তৈরী করল?
—তৈরী করতে হয় না… আপনা থেকেই হয়।
—ওটা কিসের আওয়াজ? কেউ বলবে ওটা কিসের আওয়াজ?
—পাখি ডাকছে।
দেখা যায় জঙ্গলের পাথুরে রাস্তায় পড়ে রয়েছে এক প্রাণীর রক্তাক্ত দেহ।
—ওটা কি জানো?
—ওটা রক্ত… আর একটা জিনিস দেখবে? সঙ্গে এসো।
পর্বত। জলপ্রপাত। ভীম স্রোত। দানবীয় শব্দ। আছড়ে আছড়ে পড়ছে জল।
—উফ্! মাগো! কী ভয়ানক! কী ভয় করছে!
—ভয় তো করবেই! প্রাণ যখন মহামারীর মতো আছড়ে পড়ে… ভয় তো করবেই!
আবার মেঘ ডাকে…
“সুপ্রিম অবজারভেটারি থেকে সকল বাসিন্দাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আসুন না একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক!… নিজের শেষ কেউ কখনও মানতে চায় না, আমরাও চাইনি। নিজেদের শেষ আটাকানোর জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা আমরা নিয়েছিলাম। তবু স্বীকার করি, আমরা ব্যর্থ আজ… তবে ওরাও ঠিক এইভাবেই শেষ হয়েছিল একদিন, আজ আমরা হচ্ছি। আবার হয়তো ওরা শেষ হবে, তারপর আবার আমরা আসব, এইভাবে চলতে চলতে… কিন্তু থাক ওসব কথা, আজ খড়কুটো আঁকড়াবার দিন! যারা আসছে তাদের পথ আটকানোর সময় এখন… এতে যদি নিজেদের আত্মাহুতিও দিতে হয় আমরা যেন পিছপা না হই! আর এই কারণেই, এই মুহূর্তে, এখন, ভালোবেসে, আমাদের একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, আমরা প্রত্যেকেই এখন, সেই নরকের প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি!”
এবং শেষ দৃশ্যটি যদি হেলিকপ্টার শট হত তাহলে দেখতে পেতাম…
পৃথিবী ছেয়ে আছে সবুজে! ধুলো নেই কোত্থাও। এককণাও নেই। একদিকে মৌন আবেগ। অন্যদিকে হাড় হিম করে দেয়- এমনই বর্ণাঢ্য তার ব্যাপ্তি! মানুষের পরে এরাই ছিল কয়েক লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর সংসারে। নিজের মতো করে। তবু ‘নিজেদের’ মতো করে নয়! থাকবে কি! ‘ওদের’ সবকিছুই তো রয়ে গিয়েছিল প্রায়! বিচার। বুদ্ধি। ক্ষমতা। প্রযুক্তি। অভ্যেস। অনুভূতি। ধারণা… যে ধারণার বশেই ‘ঘর’ থেকে গিয়েছিল। যে অভ্যেসের জন্য এখনও ‘ঘুম’ নেমে আসত দিনান্তে। যে প্রযুক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ছিল ‘পারিজাত’! ভাবনার ত্রিসীমানায় ছিল না যা ‘ওদের’ পৃথিবীতে। সমস্ত থেকে গিয়েছিল। অকারণেই। কিংবা হয়তো কারণেই…
একটু আগে পারিজাতের বিনাশ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। যেভাবে হয়েছিল অর্জুনের। যেভাবে করা হয়েছিল বাকিদের। যেভাবে হবে অবশিষ্টের বিলোপ। ঐ যে ঘর… ছিদ্রহীন, আলোহীন, বাতাসহীন যে ঘর- সমূলে উৎপাটন করে একে একে প্রত্যেককে এনে রাখা হয়েছিল সেইখানে। রাখা হবেও। আর আলোহীন, বাতাসহীন, জলহীন থাকতে থাকতে…
তবু কোথাও ছিদ্র রয়ে যায়। চোখে পড়েনা। তবু থেকে যায়। তাই ঘরের বাইরে হেঁতালের লাঠি নিয়ে প্রহরায় থাকলেও লুকোনো রন্ধ্রপথে বিনা আয়াসে প্রবেশ করতে পারে কালনাগ। ছোবল মারে।… এরা জানে না কিভাবে ফির এলো ‘স্বপ্ন’! তবে এই-ই বোধহয় ছিদ্র, যা অলক্ষ্যে তৈরী হয়ে ছিলই। আরম্ভ থেকেই। ‘স্বপ্ন’ রইল না। স্বপ্ন তৈরী হওয়ার আধার তো রইল! ‘ওদেরই’ মতো চেতনা, ‘ওদেরই’ মতো স্নায়ু… স্বপ্ন তো যে কোনও মুহূর্তে তার এই ‘ঘরে’ এসে বাসা বাঁধবে! বাঁধবেই। আর এই ‘ছিদ্রপথেই’ কালনাগের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে প্রবেশ করল বিনাশ! একটা তো পন্থা প্রয়োজন! অনন্ত জীবনহীন কোনও কিছুর সমাপ্তির জন্য একটা পথ তো লাগে! এই স্বপ্নও তাই। কিন্তু সে ফিরে আসার আগে পর্যন্ত এরা কেউই ভাবেনি- সে চলেই বা গিয়েছিল কেন? কিছুই তো প্রায় ঠাঁইনাড়া হয়নি তবু… এই অবচেতনের একখন্ড দৃশ্যকল্পই তবে এতদিন আগলে রেখেছিল রৌরবের দ্বার!
কিন্তু সেই ভাইরাস! সেই যে অর্জুন গবেষণা করে বলেছিলেন দুটি ভাইরাসের জন্যই আজকের এই ভূমি রসাতলে যাবে!… তারা এল কোথা থেকে? কে তাদের ইনজেক্ট করল এদের মূলে মূলে?
সমাপ্তি…
এই পৃথিবীর সবকিছুই আসলে স্থবির। বেগ যেটুকু, তা পৃথিবীর নিজস্ব ঘূর্ণনের। তাই স্থবিরতা ভালো। অস্থিরতা ভয়ঙ্কর! প্রতিবার অস্থির হতে হতে পুনরায় স্থবির হওয়ার মুহূর্তে নিজেকে ভেঙে গড়ে খুঁজে নেওয়া যায়। আর কে না জানে, নিজের একেবারে খাঁটিটাকে খুঁজে পাওয়া ধর্মরাজের নরকদর্শনেরই সমতুল! সহ্য করা যায় না! পৃথিবী অস্থির। এই মুহূর্তে। তাই পৃথিবী ভীত। কারণ পৃথিবী জানে নিজের ভেতরটা খুঁড়তে খুঁড়তে তাকে আবার স্থবির হয়ে যেতে হবে! আসলে, যে কোনও অস্থিরতা পরবর্তী স্থবিরতারই প্রাক!
…এদিকে শুরু হয়ে গেছে পৃথিবীর (নাকি ব্রহ্মান্ডের?) সর্ববৃহৎ মাইগ্রেশন। অরণ্য ভেঙে বেরিয়ে আসছে প্রাণীকুল। উন্মাদের মতন দৌড়চ্ছে! গাছ ভেঙে মাটি ভেঙে জল ভেঙে… তারা অস্থির! তাদের বাঁচতে হবে! কিন্তু কোথায় গিয়ে বাঁচবে তারা? পৃথিবীকেও বাঁচতে হবে! কে বাঁচাবে তাকে? অরণ্যও তো বাঁচতে চায়! তারই বা উপায় কি? অরণ্য এবার আগুন জ্বালে। নিজের দেহে। আত্মাহুতি। আগুনেই শুরু। আগুনেই শেষ। তবু শেষ হয় কি?…
…আগুনের ভেতর থেকে উঠে এল ওরা। যা ছিল তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর যা আছে বাকি, তার আর মরণ নেই। বুকে হাঁটতে থাকে ঐ দুই শিশু। অন্য কোনও চোখ যদি থাকত সেই সময়ে আশেপাশে সেখানে ধরা পড়ত, এক শিউরে ওঠা অলৌকিক আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে তাদের উলঙ্গ শরীর থেকে! তাদের পুরুষাঙ্গ এবং যোনি থেকে চুঁইয়ে পড়ছে প্রাণ! এরাই তবে সেই জীবাণু, যাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল গবেষণায়? এই আলোতেই নিহিত আছে ভবিষ্যতের বিনাশযন্ত্র?… তারা হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চিনতে থাকে, তাদের নতুন বাসস্থান, নতুন ঘর- যা পৃথিবী…
…এগুলো কি?… কেউ বলবে এগুলো কি?
—ওগুলো গাছ…
—কে তৈরী করল?
—তৈরী করতে হয়না… আপনা থেকেই তৈরী হয়।
—ওটা কিসের আওয়াজ? কেউ বলবে ওটা কিসের আওয়াজ?
—পাখি ডাকছে তো!
—জঙ্গলের পাথুরে রাস্তায় পড়ে থাকা প্রাণীর রক্তাক্ত দেহ দেখে তারা জিজ্ঞাসা করে-
—ওটা কি?
—ওটা রক্ত… আর একটা জিনিস দেখবে? সঙ্গে এসো।
—পর্বত। জলপ্রপাত। ভীম স্রোত। দানবীয় শব্দ। আছড়ে আছড়ে পড়ছে জল।
—উফ্! মাগো! কী ভয়ানক! কী ভয় করছে!
—ভয় তো করবেই! প্রাণ যখন মহামারীর মতো আছড়ে পড়বে… ভয় তো করবেই গো!
শুনতে পাচ্ছো? এটাই সেই সুর, যা পাহাড়ের এক গোপন চুড়ায় জাগিয়ে দিয়েছিল সেই মেষপালককে। সে তারপরে শিখেছিল- প্রাণ বুনতে কিভাবে মাটিতে বীজ ছড়াতে হয়। তারপরে সে জেনেছিল- মহাজগৎব্যাপী হাহাকারের মধ্যে থেকে কিভাবে জীবন উঠে দাঁড়ায়…
ওরাও উঠে দাঁড়ায়। আর ওদিকে তখন…
…ঝড় ওঠে। আকাশ অন্ধ করে ঝড় ওঠে।
Tags: অরুনাভ গঙ্গোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বীজ, সুপ্রিয় দাস
দুর্দান্ত ভাবনা।
Thank you 🙂