বৃক্ষোভ
লেখক: লুৎফুল কায়সার
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
চুপচাপ বসে আকাশ দেখছিল সে। নীল আকাশটাকে খুবই অদ্ভুত লাগে তার। এইজন্য সময় পেলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ও। অবসর সময়ের কাজ আর কি!
তবে আজকের কথা ভিন্ন। অসুস্থতা, ক্ষুধা আর বিষন্নতাতে জর্জরিত হয়ে প্রায় আধমরা অবস্থাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বাস্তবকে ভুলতে চাইছে সে। সন্ধ্যা হতে চলেছে প্রায়। ক্রমাগত রক্তিম লাল রঙ ধারণ করতে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন নেশা নেশা একটা ভাব এসে গেছে তার মধ্যে!
গত দুইদিন ধরে একদমই কিছু না খাওয়ার ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, শরীরের কোথাওই তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছে না। কেমন যেন একটা অবসাদ চলে এসেছে সবকিছুতে।
এই খোলা প্রান্তরে সে এইভাবে আহত অবস্থাতে পড়ে রয়েছে প্রায় তিনদিন। অনেক চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সঙ্গে থাকা হালকা খাবারও শেষ হয়ে গেছে সেই প্রথম দিনই।
তবে উঠে দাঁড়াতে পারলেও খুব একটা যে সুবিধা হতো তা নয়। হাজার-হাজার মাইল হাঁটলেও যে খাবার পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
বর্তমান পৃথিবীতে খাবারের খুবই অভাব! অভাব রয়েছে পানিরও! গত তিনশো বছরে পৃথিবী পুরোপুরি বদলে গেছে!
সময়টা যে নিশ্চিত তিনশো বছর তা বলার কিন্তু অবকাশ নেই। কারণ গত কয়েক শতাব্দী ধরে পৃথিবীর বাসিন্দারা সময়ের হিসাব ঠিকমত রাখে না!
রাখার প্রয়োজনও হয় না। কারণ পৃথিবীর সভ্যযুগ বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে! যা টিকে আছে তাকে কোন সভ্যতা না বলে সভ্যতার কংকাল বললেই বোধহয় ভালো শোনায়! পুরোপুরি অনুর্বর হয়ে গেছে পৃথিবীর/মাটির উপরিভাগ, নষ্ট হয়ে গেছে সব প্রাকৃতিক সম্পদ! নির্জন অবস্থাতে পড়ে রয়েছে এককালের আলো-ঝলমলে শহরগুলো। সেগুলো এখন প্রেতপুরীর মতো জনহীন। গুটিকয়েক মানুষ যা বেঁচে রয়েছে তারা বাস করে মাটির নিচে। একটা ছোট কৃত্রিম নগরী বানানো হয়েছে সেখানে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘নোয়াহ’স ল্যান্ড’। কে এই নাম দিয়েছিল তা আর কারোই মনে নেই, তবে সম্ভবত আড়াইশো বছর আগে কেউ বানিয়েছিল ওই নগরীটি।
তবে কিংবদন্তী রয়েছে যে ভদ্রলোক এই নগরী বানিয়েছিলেন, তিনি বেশ ধার্মিক ছিলেন। মহাপ্লাবনের পর যেমন প্রফেট নোয়াহ’র নৌকা থেকেই আবার শুরু হয়েছিল মানবসভ্যতা, ঠিক তেমনি নগরী থেকেই আবার নতুন সভ্যতা জন্ম নেবে, এমনটাই আশা করেছিলেন তিনি। আর সেজন্যই এমন নাম।
তবে কাজের কাজ আসলে কিছুই হয়নি। গত কয়েকশো বছরে মানুষের সংখ্যা আরো কমেছে! মানুষের কাজ এখন অনেকটা খাদ্য সংগ্রাহক আর যোদ্ধার মত। মাটির ওপর রাজত্ব করে বেড়ানো বিভীষিকাগুলোর বিরুদ্ধে এখনও যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের! সংগ্রহ করতে হচ্ছে নিজেদের খাবার!
মাটির ওপরের বিভীষিকাগুলো! ওরা কারা? ওরা কী?
সেসব পরে বলব। শুধু এটুকু বলে রাখি যে এমন এক পৃথিবীর গল্প শোনাচ্ছি আজ, যা আপনি নিজের সবচাইতে খারাপ দুঃস্বপ্নেও দেখতে চাইবেন না!
কী ভাবছেন? পৃথিবীর এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? কেয়ামত? মহাপ্রলয়?
অনেকটা অমনই। তবে ধর্মগুলো যেমন বলে তেমন নয়! এই প্রলয় আরো ভয়াবহ!
তবে এসবের কিছুই জানে না সে। সে শুধু জানে, ‘বাঁচতে হলে খেতে হবে!’ আর খাবার সংগ্রহ করতে বের হয়েই শত্রুর হাতে এই অবস্থা তার।
চুপচাপ উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো সে। বিশ্রাম দরকার তার। গত কয়েকদিন ধরে তো শুধু বিশ্রামই নিয়ে যাচ্ছে ও। অপেক্ষা করছে সেই ক্ষণের, যখন সে মুক্তি পাবে সকল যন্ত্রনা থেকে আর চলে যাবে অনন্ত বিশ্রামে!
যাইহোক, বিশ্রাম নিক ও। ততক্ষণে আপনাদের শোনাই সেই গল্প, যার ফলে পৃথিবীর আজ এই অবস্থা!
***
শুরুটা হয়েছিল ২০৫৯ সালে।
ততদিনে যুদ্ধে যুদ্ধে একেবারে জর্জরিত হয়ে গেছিল পৃথিবী। শক্তিশালী দেশগুলো একে অপরের থেকে বেশী ক্ষমতাবান, এই প্রমাণ করার জন্য একের পর অস্ত্রের মহড়া দিতে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ছোট দেশগুলোর পক্ষে অনেক চেষ্টা করেও নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব ছিল না। কোন না কোন ক্ষমতাবান দেশের সঙ্গেসঙ্গে যোগ দিতে হলো তাদের। ফলে অহিংস অঞ্চলগুলোও হয়ে উঠলো ধ্বংস আর বিপর্যয়ের লীলাভূমি। হিংসার বলি হতে লাগলো শত-সহস্র নিরপরাধ মানুষ!
শুরু হলো পারমাণবিক আক্রমণ। একের জবাবে আরেক! মৃত্যুর জাল যেন ঘিরে ধরল গোটা পৃথিবীকে। কিন্তু মৃত্যুর ক্ষুধা যেন মিটছিলই না!
প্রতিদিন যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু হচ্ছিল অসংখ্য সৈনিকের। ব্যাপারটা বেশ বিচলিত করে তোলে পরাশক্তিগুলোকে। মানুষের জায়গাতে রোবট সৈন্য ব্যবহার করে কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে গেল তারা। প্রতিনিয়ত নতুন-নতুন ক্ষমতা সম্পন্ন ভয়াবহ সব রোবট আবিষ্কার করে চললেন বিজ্ঞানীরা।
এভাবেই কেটে গেল কয়েক বছর।
রোবট বানাতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হতে লাগল তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ল ক্ষমতাধর দেশগুলো। রোবট বাদ দিয়ে আবার মানব সৈন্যের দিকে ফিরে যেতে চাইল কিছু দেশ। কিন্তু ততদিনে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে! বেঁচে থাকা অধিকাংশ মানুষও যুদ্ধে যেতে আর আগ্রহী ছিল না।
সমাধান খুঁজে বের করতে নতুন প্রযুক্তির সন্ধান করতে লাগল পরাশক্তিরা। নতুন নতুন বিজ্ঞানীদের নিয়োগ করা হল এই কাজে।
ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশের প্রখ্যাত উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী ড. জাহিদ হোসেনকে নিয়োগ করেছিল এক অতি ক্ষমতাশালী দেশ। সেই পরাশক্তি কিংবা জাহিদ হোসেন কেউই হয়ত জানতেন না যে তাদের এই কাজ বদলে দেবে পৃথিবীর ভবিষ্যতকেই!
২০৫৫ সালের শেষের দিকে এক অদ্ভুত থিওরি দিয়েছিলেন ড. জাহিদ।
এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, “আমরা রূপান্তরিত হচ্ছি, প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত হয়েই যাচ্ছি। ঠিক সেভাবেই গাছেরাও কিন্তু রূপান্তরিত হচ্ছে, ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে তারা। চাইলেই কিন্তু এমন এক প্রজাতি সৃষ্টি করা সম্ভব যারা একই সঙ্গে প্রাণী এবং উদ্ভিদ।”
“প্রাণী এবং উদ্ভিদ একই সঙ্গে? বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা করেছিলেন একজন।
“আচ্ছা,” হাসিমুখে বলেছিলেন ড. জাহিদ, “আমি মূলত এমন এক প্রজাতির উদ্ভিদ সৃষ্টি করতে চাই যারা প্রাণীর মতো আচরণ করবে। প্রাণীর মতো চলাফেরা করতে পারবে , শিকার করবে আর প্রাণীর মতোই শক্ত খাবার গ্রহণ করবে! সর্বোপরি ওই প্রজাতির গাছের আচরণ হবে প্রাণীর মতো। আমি ব্যাপারটা নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছি। কিছু পতঙ্গভুক উদ্ভিদ নিয়ে প্রাথমিকভাবে শুরু করেছিলাম সবকিছু। বর্তমানে আমার কাজ বলার মতো একটা পর্যায়ে চলে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি হয়ত আপনাদের ফলাফল দেখাতে পারবো।”
“কিন্তু প্রাণীর মতো উদ্ভিদ সৃষ্টি করে লাভ? আর ওরা কী শিকার করবে? ওদের খাবার জোগাবে কে?” হাসতে হাসতে বলেছিলেন আরেকজন।
“আমরা সবাই জানি যে মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। মানুষের সেই অভাব রোবট দিয়ে পূরণ করছে উন্নত দেশগুলো, কিন্তু অনুন্নত দেশগুলোর সেই উপায়ও নেই। আমরা যদি এমন প্রজাতির গাছের জন্ম দিতে পারি যারা কাজ করবে এবং আমাদের আদেশ মেনে চলবে তবে সেগুলোকে আমরা আমাদের দেশের শ্রমবাজারে কাজে লাগাতে পারি। আমি বর্তমানে ভিনাস ফ্লাই ট্রাপ আর পিচার প্ল্যান্টের ওপর কাজ করে এমন এক ছোট প্রজাতির গাছের জন্ম দিয়েছি যা খুব তাড়াতাড়ি বংশ-বিস্তার করতে পারে এবং আমার আদেশে কম পরিশ্রমের কাজও করতে পারে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি বড় কোনও গাছের জন্মও দিতে পারব। খাবার? খাবার নিয়ে চিন্তা করবেন না। ওরা যদি আমাদের জন্য শ্রম দেয় তবে ওদের খাবার জোগাতে সমস্যা হওয়ার কথা না। কারণ দিনের শেষে ওটা তো আর মজুরী নেবে না, শুধু খাবারটাই খাবে আর কি!” গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন ডা. জাহিদ।
পরের দিন দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সায়েন্স ম্যাগাজিনটা প্রধান শিরোনাম ছিলো, “সায়েন্স ফিকশন বিলাসী ড. জাহিদের কথা!”
বলাই বাহুল্য পুরো আর্টিকেলটাতেই তাকে একেবারে ধুয়ে দেওয়া হয়েছিল!
ড. জাহিদের এই থিওরি নিয়ে প্রায় কয়েকমাস ধরে বিজ্ঞানীমহলে হাসা-হাসি চলেছিল। সায়েন্স ম্যাগাজিনগুলোও ওনাকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক কলাম লিখতে ছাড়ল না!
সবকিছু দেখে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ড. জাহিদ। নিজের কাজ নিয়ে আর কখনোই কথা বলতেন না তিনি।
তিনি যদি জানতেন যে তাঁর এই আবিষ্কারই বদলে দেবে পৃথিবীর চেহারা!
***
দেশের মানুষেরা কোনও মূল্যায়ন না করলেও ড. জাহিদ ঠিকই ওই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটির নজরে পড়ে গেছিলেন। ওরাই পরবর্তীতে তাঁর গবেষণার সকল খরচ যুগিয়েছিল। তবে তাদের শর্ত ছিল একটাই, আর সেটা হলো, ‘এমন এক প্রজাতির গাছের জন্ম দিতে হবে যাদেরকে সৈন্যের মত ব্যবহার করা যাবে।’
প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন ড. জাহিদ। মাত্র কয়েকমাসের প্রচেষ্টাতেই এক ভয়ানক রকমের গাছ সৃষ্টি করে ফেললেন তিনি। বিরাট আকৃতির এক ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপের জন্ম দিলেন তিনি। যেগুলো হাঁটতে এবং চলতে সক্ষম!
কিন্তু সবকিছুতেই একটা ফাঁক থেকে যায়! ড. জাহিদের কাজেও ছিল। উনার সৃষ্টি করা সেই ভয়ানক গাছটি ওনার আদেশ মান্য করা তো দূরে থাক, ওনাকে হত্যা করার মাধ্যমেই নিজের ধ্বংসলীলার সূচনা করেছিল!
আর সেখান থেকেই শুরু!
বংশবিস্তার করার ক্ষমতা খুবই প্রবল ছিল ওই গাছটার। অযৌন পদ্ধতিতে একদিনে নিজের মতোই প্রায় পাঁচশো দানবের জন্ম দেয় সে।
রাস্তায় নেমে হত্যা আর ধ্বংসে মেতে ওঠে তারা।
ভয়াবহ সেই দানবগুলোকে ঠেকাতে নিজেদের সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয় সেই ক্ষমতাধর দেশটি। সেনাবাহিনী গুলি, বারুদ আর বোমাতে মারা যায় অসংখ্য রাক্ষুসে গাছ। কিন্তু তাদের বংশবিস্তারের হার এতটাই বেশী ছিল যে এতে কিছুই যায় আসেনি! ওই দেশের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেশটাকে একদম নিষ্প্রাণ করে দেয় দানবগুলো।
এরপর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তারা! পৃথিবীর কোন দেশের সেনাবাহিনীই ওদের সামনে দাঁড়াতে পারল না। রক্তের নহর বইতে লাগল পৃথিবীর এককালের আলো-ঝলমলে শহরগুলোতে। পিশাচগুলোর ওই ধ্বংসযজ্ঞের কাছে ম্লান হয়ে গেল চেঙ্গিস, হিটলার এবং তৈমুরের মতো নরপিশাচদের হত্যালীলাও!
একটা সময়ে মানুষ হার মানতে লাগল। তারা বুঝতে পারলো যে এই দানবগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব।
আর সেখান থেকেই সৃষ্টি ‘নোয়াহ’স ল্যান্ড’ এর। অবশিষ্ট মানুষেরা সেখানেই বাস করতে লাগলো। মাটির উপরিভাগ আর নোয়াহ’স ল্যান্ডের মাঝখানে সৃষ্টি করা হলো একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রটি এতোই শক্তিশালী ছিল যে সেটা পেরিয়ে নোয়াহ’স ল্যান্ডে ঢোকা সম্ভব ছিল না গাছগুলোর পক্ষে।
মাটির নিচে স্থায়ী হয়ে পড়ল মানুষেরা। আর ওপরে চলতে লাগল সেই ভয়াবহ গাছগুলোর রাজত্ব।
কিন্তু মাটির নিচে টিকে থাকতে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে লাগল মানুষ। খাবার আর পানির মজুদ ফুরিয়ে গেল খুব তাড়াতাড়িই, অক্সিজেনের মজুদও শেষের দিকে চলে এল। অপর দিকে মাটির ওপর প্রায় সমস্ত গাছ-গাছালি এবং প্রাণীদের নির্মমভাবে শেষ করে দিয়েছিল ওই গাছগুলো।
খাবারের আর অক্সিজেনের দিশেহারা হয়ে পড়ল মাটির নিচের মানুষরা।
আর তারপরেই খাবার আর অক্সিজেনের জন্য এক অভিনব উপায় বের হয়ে এল। অস্ত্র নিয়ে মাটির ওপর উঠে আসতে লাগলো কিছু মানুষ অল্পকিছুক্ষণের জন্য, উদ্দেশ্য- অক্সিজেন আর খাবার সংগ্রহ। স্বয়ংক্রিয় মেশিন দিয়ে খুব তাড়াতাড়িই অক্সিজেন সংগ্রহ করে ফেলত তারা। কিন্তু খাবার? খাবারের জন্য ওই মানুষ বেছে নিল ওই দানবগুলোকেই! ওগুলোকে হত্যা করে মাটির নিচে নিয়ে যেতে লাগল তারা আর তাই দিয়েই চলতে লাগল মানুষেরা খাওয়া-দাওয়া! মাঝে মাঝে শিকারে গিয়ে শিকারীও শিকারে পরিণত হতে লাগল।
বদলে গেল মানব সভ্যতা। নোয়াহ’স ল্যান্ডে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মের পরই শেখানো হতে লাগল যুদ্ধবিদ্যা যাতে করে তারা শিকার করে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। মানুষের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো খাদ্য সংগ্রহ। অনেকটা আদিম কালের মতো! বদলে গেল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, হারিয়ে গেল সময়ের হিসাব!
সেই প্রযুক্তিগুলোই টিকে রইল যা মানুষকে শিকার ধরতে সহায়তা করতে পারে! বাকী সব হারিয়ে যেতে লাগল। রইল না বিনোদনের কোনও উৎস, কারণ নোয়াহ’স ল্যান্ডের বিষন্ন পরিবেশে কেউই বিনোদন চাইত না! সবাই শুধু একটা জিনিসই চাইত, আর তা হল ‘খাবার’।
মানুষের জন্য সময়ের হিসাব থমকে গেল দিন আর রাতে! আর কিছুই তারা হিসাবের মধ্যে আনতো না!
আর এভাবেই কেটে গেল কয়েকশো বছর!
***
মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকাল সে। হ্যাঁ, দুজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। দুজনেই হাতে দুটো ভয়াবহ চেইন’শ। একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে ওরা দুজন।
“বেঁচে আছে কি?” ডিকের দিকে তাকিয়ে বলল জন।
“তা আছে, তবে মৃতপ্রায়ই বলা চলে, চলো দেখি,” বলল ডিক।
জন আর ডিক এগিয়ে এল ওর দিকে।
“প্রায় মরেই গেছে, এই দিয়ে…”
কথাটা আর শেষ করতে পারল না ডিক। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজের শুঁড়গুলো দিয়ে ডিককে জড়িয়ে ধরল সে। চিৎকার করে উঠল ডিক। সঙ্গে সঙ্গে ওর একটা শুঁড়ের ওপর চেইন’শ চালিয়ে দিল জন। তীব্র ব্যাথাতে অবশ হয়ে পড়তে চাইল তার মস্তিষ্ক! তবে ওই মূহুর্তে যেন আসুরিক শক্তি ভর করেছিল ওর গায়ে, খুবই দ্রুত দুটো শুঁড় দিয়ে জনের চোখ বরাবর আঘাত করল সে, চিৎকার করে বসে পড়ল জন!
***
উষ্ণ রক্তের স্বাদে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে ওর শরীরে। সামনেই পড়ে রয়েছে জন আর ডিকের খুবলানো মৃতদেহ।
এখনো পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারছে না সে। তবে সামনের কয়েকদিনের খাবারের ব্যাবস্থা হয়ে গেছে, এটা নিয়ে সন্তুষ্ট সে।
আর ঠিক তখনই প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতে লাগল ও। জনের কেটে দেওয়া শুঁড়গুলোর জায়গাতে সৃষ্টি হয়েছে প্রকাণ্ড এক ক্ষত। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে।
তার জ্ঞান কি আর ফিরবে? কে জানে! ফিরতেও পারে!
সে একটা গাছ! ওর কোন নাম নেই! নেই কোন ঠিকানা। শিকার করেই বেঁচে থাকে, খিদে পেলে খায়!
বলেছিলাম না? এমন এক সময়ের গল্প আপনাদের বলছি, যা হয়ত নিজেদের সবচাইতে বাজে দুঃস্বপ্নেও দেখতে চাইবে না কেউ!
*****************
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, তৃষা আঢ্য, পাঙ্ক স্পেশাল, লুৎফুল কায়সার
চমৎকার ভাবনা। গেলর্ড সাবাতিনির বহু পুরোনো, কিন্তু অবিস্মরণীয় ভয়ের গল্প ‘ভর্টেক্স অফ হরর’ মনে পড়ে গেল পড়তে গিয়ে।
দারুণ লাগল