ভূতগ্রহের বিজ্ঞানীরা
লেখক: সুদীপ দেব
শিল্পী: ধ্রুবজ্যোতি দাস
অনেকদিন পর ওভারনাইট জার্নি করছি ট্রেনে। ছোটবেলায় প্রায় প্রতি বছরই দু’রাত্তির ট্রেনে কাটিয়ে মামার বাড়ি যেতাম। ট্রেনের দুলুনি আর আওয়াজে ঘুমটা এখনও আমার বেশ ভালই হয়। তখন তো সবসময় স্লিপারেই চড়তাম, এখন বরং এসির ঠাণ্ডায় আরও জমাটি ঘুম হয়। বরং কোন ষ্টেশন বা সিগন্যালে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলেই ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম নিয়ে এতো কথা বলার কারণ গল্পটা ঘুম নিয়েই।
পত্রিকার পাতায় কোন গল্পের শুরুতে যেমন গল্পটার একটা আভাস দেওয়া থাকে, যেমন ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, রূপকথার গল্প – এটা আমার খুবই অপছন্দের। কারণ এতে তো গল্পের অর্ধেক মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়। পাঠক বরং পড়তে পড়তেই আবিষ্কার করুক না, কিসের গল্প।
রাতের খাবারটা খেয়ে নিয়ে ডিসপোসেব্ল বাসনকোসনগুলো টয়লেটের কাছে ডাস্টবিনে গুঁজে দিয়ে এলাম। ছোটবেলায় মনে আছে ষ্টীলের খোপ খোপ করা থালায় ভাত, ডাল, তরকারি, আচার দিত। ওই থালাগুলো পরে প্যান্ট্রির লোকেরা নিয়ে যেত। আমার খুব লোভ ছিল থালাগুলির ওপর। একবার এক হরেক মাল সাড়ে ছ’টাকা-ওলার কাছে ওইরকম থালা দেখে আমার কি কান্না, “ট্রেনের থালা চাই।”
ভাবছেন আবার ফালতু বকছি। আরে মশাই আমি কি আর ঝানু লেখক? তাই একটু ভূমিকা করে হাত মকশো করছি। সলতেটা না পাকালে প্রদীপ জ্বলবে কেমন করে, শুনি?
থ্রি-টিয়ারের আপার বার্থটাই আমার বরাবরের পছন্দ। ব্রাউন প্যাকেট থেকে কম্বল আর সাদা চাদরটা বের করে ওপরে ছুঁড়ে দিলাম। বালিশটা ওপরেই রয়েছে দেখছি। এবার মই বেয়ে উঠে পড়ার পালা।
বড় বড় লেখকের সঙ্গে আমাদের মত অনভ্যস্ত লেখকদের পার্থক্যটা কোথায় খেয়াল করেছেন? এখনও পর্যন্ত আমার সহযাত্রীদের কোন বিবরণ দেওয়ার কথা মনেই আসে নি আমার। তা, গল্পে তাদের তেমন ভূমিকাও নেই বটে। মোট কথা এই খোপটা পুরোপুরি ভর্তিই আছে লোকজনে, আমি একা নই, এটুকু জানলেই চলবে। বাকিরাও সবাই ঘুমের তোড়জোড় করছে, তাই বড় আলোটা নিবিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম ওপরে।
কম্বলটা কোমর পর্যন্ত টেনে বালিশে মাথা দিতেই মাথার নিচে শক্ত মত কিছু একটা ঠেকল। মাথার কাছে ছোট আলোটা জ্বালিয়ে বালিশটা তুলতেই দেখলাম ছোট ট্রানজিস্টারের মত একটা বস্তু।
নিমেষে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল। বোমা! এ নির্ঘাত বোমা! ছুঁলেই ফাটবে, আর তারপর ছবি।
লাফিয়ে নীচে নামতে গিয়েও একটু থমকে গেলাম। জিনিসটার ওপর বালিশ রেখে শুয়ে পড়েছিলাম। তাতেও ফাটে নি যখন, একবার হাতে নিলেই কি ফেটে যাবে? অবশ্য বলা যায় না। টাইম বোমাও হতে পারে। সময় জিরো হলেই ফাটবে। ওরেব্বাবা রে! পিঁক পিঁক করে আবার আওয়াজও হচ্ছে দেখছি।
বারবার নামতে গিয়েও কেন নামতে পারছি না! এবারেও একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠতে দেখে আবার থমকে গেলাম। মানে কি সময় হয়ে এল? যাক বাবা! মৃত্যুটা যেন একবারেই হয়ে যায়। বেশী কষ্টটষ্ট পেয়ে মরতে ভাল্লাগে না।
এই রে! এ কি ওয়্যারলেস ফোন নাকি? কারা যেন কথা বলছে এটার ভেতরে!
বুকে একটু বলভরসা এল। জিনিসটার সামনে এগিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম কথাগুলো।
একদমই বোঝা যাচ্ছে না, কি বলছে। ভল্যুমটা একটু বাড়াতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এখনও অতটা সাহস আসে নি। নাহ্, রেলপুলিশকেই ডাকি বরং।
আবার নেমে আসার জন্য মনস্থির করতেই মনে হল আওয়াজটা একটু বেড়েছে। তবে ভাষাটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।
এবার স্পষ্ট বাংলা শুনতে পেলাম, একদম এফ.এম. রেডিওর সম্প্রচারের মত স্পষ্ট। কেউ ঘোষণা করার ভঙ্গিতে বলছে, “বিশ্বরূপবাবু, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন? বিশ্বরূপবাবু. . .”
এই রে! এ তো আমারই পিতৃদত্ত নাম ধরে ডাকছে! আমি বললাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।”
“আপনাকে কোন কথা বলতে হবে না। কেউ শুনে ফেললে অসুবিধা আছে। আপনি শুধু মনে মনে ভাবুন। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব।”
ভাবব? আচ্ছা ভাবলুম।
“আর চুপ করে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ুন। নাহলে অন্যরা সন্দেহ করবে। আপনার সাহায্য আমার মানে আমাদের খুব প্রয়োজন। বিনিময়ে আমরাও আপনাকে যে কোন রকম সাহায্যের জন্য প্রস্তুত।”
“কিন্তু আপনি মানে আপনারা কে?” বললাম, থুড়ি ভাবলাম, “আর কোথা থেকেই বা কথা বলছেন?”
“আপনি যাকে ট্রানজিস্টার বা বোমা ভাবছেন আমরা এর ভেতর থেকেই কথা বলছি।”
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু এর মধ্যে তো নিশ্চয়ই আপনি বসে নেই।”
“হ্যাঁ, এর ভেতরেই আমি আছি, আসলে আমরা তিনজন আছি।”
অ্যাঁ! বলে কি রে! পাগল না পেট গরম!
“দুটোর কোনটাই না, এটা আসলে একটা মহাকাশযান। আরও ভাল করে বলতে হলে মহাকাশযানের একটা অংশ।”
পাঠকরা ভাবছেন, এই তো বাবা পথে এসো। কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলবে তাতে আবার এতো ভ্যানতাড়া কিসের! আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলুম। মহাকাশে একটি ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র গ্রহ, তার বালখিল্য মানুষ বা প্রাণী।
“আপনি যা ভাবছেন তা ঠিক নয়। আসলে আমরা এই পৃথিবীরই মানুষ ছিলাম একদিন।”
“এখন কি তাহলে গ্রহান্তরিত হয়েছেন।”
“আসল কথাটা বললে ভয় পাবেন কি না ভাবছি।”
“নাহ, ভয় আর কিসের। এতো কিছুর পরও যখন টিঁকে আছি।”
“সঠিক ভাবে বলতে গেলে আমরা দেহান্তরিত হয়েছি।”
“মানে?”
“আরও সোজা বাংলায় বলি, আমরা ভূত।”
এ নির্ঘাত স্বপ্ন। গল্পের প্রথমেই বলেছিলাম না, গল্পটা ঘুম নিয়ে।
“স্বপ্ন নয়, তবে সেটা হলে আমরা খুশীই হতাম। কারণ এই প্রথম কোন রক্তমাংসের মানুষের কাছে আমাদের অস্তিত্বের কথা জানাতে হল।”
“হঠাৎ আমার ওপর এত সদয় কেন?”
“ঠিক আপনার ওপর নয়, আজ এই ট্রেনে এই বার্থে যিনিই থাকতেন তাকেই জানাতে হত।”
“কেন?”
“কারণটা বেশ গুরুতর। এবং ভজঘটও বটে। আপনি কি ঠিক বুঝবেন?”
“আহা নিজে যেন সবজান্তা! তাহলে আমার কাছ থেকেও সাহায্যের আশা ছাড়ুন।” মনে মনে ভাবলাম।
“ভূত হয়ে গেলে আপনিও সবজান্তা হয়ে যাবেন। এই যে জ্যান্ত বিজ্ঞানীগুলো কত খেটেখুটে আবিষ্কার টাবিষ্কার করছে। সব যে ভস্মে ঘি ঢালা মশাই। আরে মানুষের জীবন ক’দিনের? মরে গিয়ে ভূত ফ্রিকোয়েন্সিতে চলে এলেই তো কিছুই আর অজানা থাকে না।”
“বাপ্স! সব ভূতেরাই তাহলে বৈজ্ঞানিক নাকি!”
“তা একরকম বলতে পারেন। তবে জ্যান্ত লেখকগুলো একদম বোগাস। তারা আমাদের নিয়ে যে রকম হাড় হিম করা কাহিনী টাহিনী লেখে সেগুলো একদমই বাস্তবের ধারকাছ দিয়ে যায় না।”
“তাহলে বাস্তবটা কি শুনি?”
“বাস্তবটা হল আসলে ভূত ফ্রিকোয়েন্সি। মানুষ ফ্রিকোয়েন্সিটাই আসলে একটা স্বপ্নের মত ব্যাপার, অবাস্তব। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মানুষ যেমন স্বপ্ন দেখে, ভূতেরাও তেমনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা স্বপ্ন দেখে। মানে এই যে আপনি বিশ্বরূপবাবু, আসলে আপনার কোন অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই স্বপ্ন।”
“আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।”
“যাওয়ারই কথা। দেখুন, কোন একটা তুচ্ছ ঘটনা, ঘটার পর আপনার হঠাৎ মনে হয় না যেন সেই ঘটনাটাই হুবহু আগে ঘটে গেছে?”
“হ্যাঁ, হয় তো।”
“তার মানে আপনি আগেও এই একই স্বপ্ন দেখেছেন। অবচেতন থেকে সেটার কথাই আপনার মনে পড়ছে।”
“হুম।”
“যাক গে ওসব কথা। এখন যেটা বলছি মন দিয়ে শুনুন। আর পাঁচ মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ডের মাথায় ট্রেনটা একটা নদীব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে। ঠিক সেই সময় আপনি চেন টানবেন।”
“একদম সেকেন্ড ধরে হিসেব করে কি পারব?”
“তা দরকার নেই। ট্রেন ওই ব্রিজে ওঠার পর টানলেই চলবে। তাহলে ট্রেনটা মোটামুটি ঠিক জায়গামত গিয়ে দাঁড়াবে।”
“কিন্তু অকারণে চেন টানলে যে ফাইন হবে।”
“না, হবে না। কারণ ফাইন দেওয়ার জন্য আপনি থাকবেন না।”
“মানে?”
“মানেটা খুবই সহজ, আপনার ঘুম ভাঙার সময় হয়ে এসেছে। ট্রেন থামার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আপনাদের ভাষায় যাকে বলে অক্কা পাবেন।”
“অ্যাঁ?”
“হ্যাঁ, কারণ সামনে লাইনে ফিসপ্লেট খোলা। চেন টানার কারণে ট্রেনের গতি কমে এলেও এই বগিটি লাইনচ্যুত হবে। তবে সম্পূর্ণ ট্রেনটির মধ্যে একমাত্র আপনারই মাথায় আঘাত লেগে মৃত্যু হবে। চেন না টানলে আরও অনেক মানুষ মারা পড়বে।”
“তাহলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার কি দরকার? এখনই টেনে দিই।”
বলেই আমি চেনের দিকে হাত বাড়ালাম।
“উঁহু উঁহু! ভুলেও ও কাজটি করবেন না। এইজন্য মানুষদের ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা নেই। তারা জেনে গেলেই ভবিষ্যৎ পাল্টাতে চায়।”
“তা বলে আপনার কথা শুনে মরে যাব? বাড়িতে আমার বউ বাচ্চা আছে।”
“মরতে তো আপনাকে হবেই। তবে আমাদের কাজটাও যে বড় দরকারি। মরার আগে সেই কাজটাও যে আপনাকে করে দিতে হবে।”
“ক্-কি কাজ?”
“যে নদীব্রিজের ওপর ট্রেনটি উঠবে সেই ব্রিজের ঠিক নিচেই আমাদের মূল মহাকাশযান রাখা আছে। এর আগে যখন এই ট্রেনটি ওখান দিয়ে যাচ্ছিল তখন সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আপনারা পুণ্য অর্জনের জন্য নদীতে পয়সা ছুঁড়ে ফেলেন। বাচ্চা ছেলেদের দল ওই ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে সেই পয়সা কুড়িয়ে নেয়। এমনই একটি ছেলে আমাদের মহাকাশযানের এই অংশটি দেখতে পেয়ে কোন দামি জিনিস মনে করে কুড়িয়ে নেয়। তারপর কোন কাজে আসবে না বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের দরজার ভেতর ছুঁড়ে ফেলে। একজন যাত্রী তা দেখতে পেয়ে সেটি কুড়িয়ে নিয়ে এসে এই বার্থে রাখে। নামার সময় নিয়ে নামতে ভুলে যায়। এবং ভাগ্যিস রেলের লোকেরা ঠিকঠাক কামরা পরিষ্কার করে না, তাই সেটি এখানেই রয়ে যায়।”
“বুঝলাম। তা এর জন্য আমাকে মরতে হবে কেন?”
“এর জন্য মরবেন কেন? মরা তো আপনার ভবিতব্য। দেখুন পাঁচ মিনিট সময় অতিক্রান্ত। এবার আপনি চেনটা টানুন।”
ঝমঝম করে ট্রেনটা উঠে এল একটা ব্রিজের ওপর। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আমিও দিলাম চেনটা টেনে। কুপের সবাই ঘুমোচ্ছে। তাই কারো নজরে এল না। কিন্তু ট্রেনে একটা বিকট শব্দ হল যা এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরাতেও ভালভাবে শোনা গেল। আমি জানি কোথা থেকে চেন টানা হয়েছে তারও নির্দেশ ঠিক পেয়ে যাবে রেলের লোকেরা। কিন্তু এই সময় আবার সেই কণ্ঠ বলে উঠল, “আপনি মহাকাশযানটা নিয়ে দরজার কাছে চলে যান, তাড়াতাড়ি। ব্রিজ পেরনোর আগেই বাইরে ফেলে দিন। তাহলেই আপনার কাজ শেষ।”
যন্ত্রটা নিয়ে আমি বিদ্যুতবেগে ছুটে গেলাম দরজার দিকে। তড়িৎগতিতে চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা বলেছিল ওদের কাজ করে দিলে আমাকেও যে কোন রকম সাহায্য করবে।
“বলে ফেলুন, বলে ফেলুন আপনার মনোবাঞ্ছা বিশ্বরূপবাবু।”
“ইয়ে আমার যেন ঘুমটা না ভাঙ্গে। মানে আমি মানুষের ফ্রিকোয়েন্সিতেই থাকতে চাই আপাতত।”
“আমরা গবেষণা করে দেখব আপনার ঘুম দীর্ঘায়িত করা যায় কি না। কিন্তু আপনি আর চিন্তা করবেন না। ব্রিজ পেরিয়ে যাচ্ছে।”
জয় মা বলে দিলাম ছুঁড়ে দরজা দিয়ে যন্ত্রটা। সেই মুহূর্তে ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেন চলে এল আবার শক্ত জমিতে। কে জানে ওরা যন্ত্রটা মূল মহাকাশযানে জুড়তে পারবে কি না। ট্রেনের গতিও ইতিমধ্যে অনেক কমে এসেছে।”
হঠাৎ এক বিকট আওয়াজ। যেন বোমা পড়ল কোথাও। সঙ্গে একটা বিশাল ঝাঁকুনি। আমার মাথাটা ঠুকে গেল ট্রেনের দরজার সাথে। কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল মাথার ভেতরটা।
চারিদিক ধুলোয় ধুলোয় ছেয়ে গেছে। আমাদের কামরাটা কাত হয়ে পড়েছে লাইনের পাশে। দরজাটা খোলা। আমি এক লাফে নেমে এলাম নিচে। কপালে হাত দিয়ে দেখি চটচট করছে। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু বুঝলাম রক্ত। তবু কিসের এক অদৃশ্য টানে আমি ছুটে চললাম পেছনের নদীব্রিজটার দিকে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মরি নি তাহলে!
ঘুমন্ত ট্রেনের সব লোক জেগে উঠেছে। তাদের আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার যেন সব বাহ্যশক্তি লোপ পেয়েছে। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে। একটা ঘোরের মধ্যে আমি নেমে এলাম ব্রিজের নিচে।
বিশাল বালির চড়ার মাঝখান দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া নদী। একটু খুঁজতেই চোখে পড়ল একজায়গায় কয়েকটা ছোট ছোট লাল সবুজ বাতি জ্বলছে নিবছে। কাছে গিয়ে দেখলাম তিনফুট ব্যসের একটি গোল চাকতির মত মহাকাশযান। চিনতে কোন ভুল হল না, কারণ এইরকম ইউএফও-র ছবি বিস্তর দেখেছি কল্পবিজ্ঞানের বই বা সিনেমাতে।
“বিশ্বরূপবাবু আপনার কাছে আমরা অশেষ কৃতজ্ঞ। আপনার জন্যই আমরা আবার ভূতগ্রহে ফিরতে পারছি।” মাথার ভেতরে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর।
“আমার জীবনদানের জন্য আমিও আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
“আপনি ভুল ভাবছেন। আপনি কিন্তু এখন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছেন। মানে আপনিও এখন ভূত ফ্রিকোয়েন্সিতে। চাইলে আমাদের সঙ্গে ভূতগ্রহে এখনই যেতে পারেন। নইলে অনেকরকম নিয়মকানুনের বাধা টপকে যেতে হবে। মানুষেরা যেমন অন্য দেশে যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসা টিসা করে, অনেকটা তেমনই ব্যাপার স্যাপার।”
“অ্যাঁ? সে কি কথা? না না, আমি পৃথিবীতেই থাকতে চাই। মানুষ হয়ে।”
“আপনাকে কথা দিয়েছিলাম। আমরা চেষ্টা করে দেখব, আমাদের বিজ্ঞান যদি পারে…”
“কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, যদি ফ্রিকোয়েন্সি বদলই আসল কথা হবে তাহলে তার জন্য মহাকাশযানের কি দরকার? ভূত গ্রহটাই বা কোথায়? তাহলে সত্যিই কি আপনারা অন্য গ্রহের প্রাণী?”
“আপনি যে এখন বেঁচে নেই সেটা তো মানবেন? দেখুন তো আপনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন কি না।”
নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল – অবশ্য রক্ত মাংস যদি কিছু থাকে। কারণ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেখানে যে কিছুই নেই। দিব্যি বালির ওপরে চাঁদের আলো খেলা করছে।
“আমাদের বিজ্ঞানের পরিভাষা তো আপনি বুঝবেন না। মনে করুন পুরোটাই একটা স্বপ্ন। বা আসলে এটাই বাস্তব। আমাদের মহাকাশযান রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমাদের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন আপনার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে আমরা সক্ষম। আপনি আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
একটা মৃদু মনোরম আলো বিচ্ছুরণ করে ফ্লাইং সসারটা আকাশে উঠে কিছুক্ষণ ভেসে রইল। তারপর চোখের পলকে মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল।
আমার কেমন ঘুম ঘুম পেতে লাগল।
ঘুমটা ভাঙল, বরং বলা ভাল জ্ঞান ফিরে এল চোখে মুখে জলের স্পর্শ পেয়ে। অনেক লোকজনের কথাবার্তা কানে আসছে। চোখ মেলে বুঝলাম আমি শুয়ে আছি ট্রেনের আপার বার্থে। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে কোথাও। উঠে বসার চেষ্টা করতেই একজন বলল, “উঁহু, উঠবেন না। শুয়ে থাকুন। স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হবে।”
গলায় স্টেথো দেখে বুঝলাম ডাক্তার। সম্ভবত রেলের ডাক্তার। ট্রেনটা এমন কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কি হয়েছে আমার?
“ট্রেন বেলাইন হয়েছে। ফিসপ্লেট খোলা ছিল। আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু কেউ এই কামরা থেকেই কিছু আগে চেন টানায় তা এড়ানো গেছে। কোন সন্ত্রাসবাদীদের কাজ মনে হচ্ছে। তাদেরই কারো হয়তো শেষ মুহূর্তে মানবিকতাবোধ জেগে ওঠায় চেন টেনেছে। অনেকে আহত হলেও কেউ মারা যায় নি।” মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে ডাক্তারবাবু বললেন, “তবে আপনার কিন্তু ভালমত হেড ইঞ্জুরি হয়েছে। প্রথমে আপনার পাল্স পাওয়া যাচ্ছিল না।”
আমি তো সেটা ভালভাবেই জানি। ভূত হয়েই তো প্রথমে মাথায় হাত দিয়েছিলাম। হাতটা চোখের কাছে নিয়ে আসতে দেখলাম হাতের তালুতে রক্ত শুকিয়ে আছে।
Tags: ধ্রুবজ্যোতি দাস, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ভূতগ্রহের বিজ্ঞানীরা, সুদীপ দেব