মানুষ কি? – আইগর রশোকোভতস্কি
লেখক: আইগর রশোকোভতস্কি, বাংলা অনুবাদ - সুপ্রদীপ্তা মন্ডল
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
(দ্বাবিংশ শতাব্দীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দর্শন শিক্ষাকক্ষের সংক্ষিপ্ত শর্টহ্যান্ড প্রতিবেদন)
প্রথম পাঠ
আবিষ্ট মানুষটির কথা
(তথ্যাবলীঃ সেই সময় সপ্তর্ষিমণ্ডলে একটি নতুন নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছে। সারা পৃথিবী সেই সংবাদে উত্তাল। যন্ত্রের হিসাব অনুযায়ী, এটি সুপারনোভা প্রকৃতির নক্ষত্র নয়। বিকিরণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য রকম কম, সাধারণ যন্ত্রপাতিতে তা সহজেই ধরা পড়ে। তথাপি, কণার সংখ্যা এতই কম, সেই হিসেবে নির্ণীত দুরত্বের নক্ষত্রের খালি চোখে দৃশ্যমান হওয়ার কথা নয়। যন্ত্রের পরিসংখ্যান অনুসারে, এই রহস্যময় নক্ষত্রটি একটি দৃষ্টিবিভ্রম মাত্র। এক লক্ষ কোটি পৃথিবীবাসীর চোখে এটি একইসঙ্গে ধরা পড়ে, এবং আটশো কোটি ক্যামেরা নিরন্তর এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখে।
এর দুদিন পরের একটি আলোকচিত্রে প্রথম নক্ষত্রটির স্পন্দিত হওয়ার প্রমাণ ধরা পড়ে। একইসাথে সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে সংকেত ভেসে আসে। বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্রে তা ধরা পড়ে, ইংরেজি বর্ণমালার পি অক্ষরটি তিনবার ফুটে ওঠে।)
***
“বাচ্চারা, শান্ত হয়ে বস, তারপর আমরা আজকের আলোচনা শুরু করব,” শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে শিক্ষক মহাশয় বলে ওঠেন। শুধু তিনি নন, কোনোও এক অজ্ঞাত কারণে বেশ কয়েক প্রজন্ম আগেও তাঁর পেশাগত পূর্বসূরিরাও এই একই ধাঁচের বাক্যবন্ধ দিয়ে তাঁদের পাঠদানের সূচনা করতেন।
সচকিত হয়ে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা সবাই একইরকম একরাশ বিরক্তি নিয়ে শিক্ষকের দিকে তাকায়। তাদের আলোচনার তালভঙ্গকারী ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে সকলে অসম্ভব বিরক্তি প্রকাশ করে। তাদের ভাবখানা এইরকম, “এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় এমন রসভঙ্গ ভালো লাগেনা মোটেও। দেখছেন না, আজ আমরা সব্বাই সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে আগত এই অত্যাশ্চর্য মহাজাগতিক ঘটনা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত রয়েছি!” তাদের অভিব্যক্তি ও দেহভঙ্গিমা দেখে মনে হয়, কোনোভাবেই এই ক্লাসটির জন্য তাদের মত পরিবর্তন করা নিতান্তই অসম্ভব, এবং কিছুক্ষণের জন্য তাদের এই আলোচনায় নিয়োজিত থাকতে দেওয়াই বুঝি শ্রেয়!
শিক্ষকমহাশয় হয়ত ছাত্রছাত্রীদের মন বুঝেই বলে উঠলেন, “তোমরা আজ সকলে একটি বিশেষ বিষয়ে চিন্তায় আছো বুঝতে পারছি। চলো আজ তবে এই তিন পি এর ধাঁধা নিয়েই কথা বলা যাক।”
মুহূর্তের মধ্যে শ্রেণীকক্ষের আবহাওয়া বদলে গেল। বিরক্ত, নিষ্প্রাণ মুখগুলি উৎসাহে ঝকঝক করে উঠলো। বিষয় পরিবর্তনের ব্যাপারটা পছন্দ হওয়ায় তারা বেশ একটু নড়েচড়ে বসলো।
শিক্ষকমশাইকে বললেন, “আজ তো আমাদের মানবজাতির অস্তিত্ব সম্পর্কে দার্শনিক আলোচনা করার কথা ছিল, তাইতো?”
অধৈর্য ছাত্রীটি বলে উঠলো, “হ্যাঁ তা ঠিকই, কিন্তু আপনি যে বললেন, নক্ষত্রের সিগন্যাল নিয়ে কথা বলবেন?”
শিক্ষক মহাশয় স্মিত হেসে বলেন, “মনে করানোর জন্য ধন্যবাদ, যদিও আমি ভুলিনি। আমরা সপ্তর্ষিমণ্ডলের ধাঁধা নিয়ে আলোচনা শুরু করেই এই দার্শনিক প্রসঙ্গে আসবো। আজ আমি তোমাদের একটি গল্প শোনাব। এমন এক মানুষের গল্প, যাকে তোমরা সবাই চেন, কিন্তু তাঁর আসল নামে নয়, তাঁকে সবাই চেনে আধপাগলা বিজ্ঞানীর পরিচয়ে। ছোটবেলায় তিনি একবার স্কুলের ফিজিক্সের গবেষণাগারে নিজেকে আটকে ফেলেছিলেন যাতে স্কুল কর্তৃপক্ষ জোর করে তাঁকে বাড়ি না পাঠাতে পারে। তার কিছুদিন পরেই তিনি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় না করা অব্দি তিনি জলস্পর্শ করবেন না। এরপরেই লোকজন তাঁকে পাগলাটে বিজ্ঞানী নামে ডাকতে থাকে।
অধৈর্য ছাত্রীটি বলে উঠলো, “তারপর কি হল?”
“কিন্তু তাঁকে নিজের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করতে হয় কারণ তিনি অনাহারে বা অনিদ্রায় প্রাণত্যাগ করলে আখেরে বিজ্ঞানের লাভ কিছুই হয়না। সেই অর্থহীন মৃত্যুর পথ থেকে তাই তিনি নিজেকে সরিয়ে আনেন। তাঁর পরিবর্তে তিনি দুমাস ব্যয় করে অভিকর্ষজ ক্ষেত্র সম্পর্কে বিশদে অধ্যয়ন করেন। এ বিষয়ে অন্যেরা কে কি বলেছেন সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি এটুকু সময় ব্যয় করতে মনস্থ করেন।,” শিক্ষকমহাশয় বলে চলেন।
“তা ঠিক, এসবের জন্য একটু সময় তো দিতেই হয়, সবটা তো ঠিক করে বুঝতে হবে” একগুঁয়ে ছাত্রটি মন্তব্য করে।
শিক্ষকমহাশয় ছাত্রটির উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে সম্মতিপ্রকাশ করে (তিনি সাধারণত কখনই এই ছাত্রটির সাথে তর্ক জুড়তেন না) তিনি বলে উঠলেন, “তোমরা বলতেই পারো অন্য সকলের মতই ছিলেন তিনি, শুধু একটি বিষয় ছাড়া…”, এটুকু বলে তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তাকালেন।
অধৈর্য মেয়েটি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, “তিনি অন্যদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছিলেন!”
একগুঁয়ে ছাত্রঃ “তিনি নিশ্চয় অন্যদের থেকে অনেক বেশি অধ্যাবসায়ী ছিলেন!”
অন্য একটি ছেলে বলে উঠলো, “তিনি অনেক বেশি সাহসী ছিলেন!”
না না, তা নয়,” শিক্ষকমহাশয় বুঝিয়ে চলেন, “এসব ব্যপারে তিনি অন্যদের মতই ছিলেন, খালি একটি বিষয় ছাড়া। এই একটিমাত্র বিষয়ের জন্য লোকজন তাঁকে ক্ষ্যাপাটে বলে ডাকতে শুরু করে। দেখো, আমরা সকলেই কখনো না কখনো জীবনে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই, আমরা কেন জন্মাই? জীবনের অর্থ কি? মৃত্যুই বা কেন আসে? এই মহাজগতেরই বা সৃষ্টির কারণ কি? উদ্দেশ্য কি? জন্মমৃত্যুর রহস্য আমাদের সকলকেই কখনো না কখনো ভাবিয়ে তোলে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশদে ভাবতে ভয় পাই কারণ মৃত্যুসংক্রান্ত চিন্তা আমাদের দুঃখের স্মৃতিগুলিকে জাগিয়ে তোলে। অন্যেরা ভাবে, তাদের আগেও শত শত বুদ্ধিমান মানুষ এই নিয়ে ভেবে বোকার মত নিজেদের জীবন নষ্ট করেছেন, খামোখা এই চিন্তায় নিজেকে জড়ানো অর্থহীন। কেউ ভাবেন একটি জীবন এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের জন্য যথেষ্ট নয়, তাই এই জীবনের ওপারে কি আছে তাই নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। তারপরেও, এমন অনেকেই আছেন, যারা নিজ নিজ বৃত্তের মধ্যে থেকেই সাধ্যমত এই রহস্যের সমাধানের চেষ্টা করতে থাকেন। মৃত্যুচিন্তা তাঁদেরও শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত বইয়ে দেয় ঠিকই, তবুও তাঁরা সাধ্যমত ছিন্ন সুত্রের সন্ধানে থাকেন, যা তাদের উত্তরসূরিদের একদিন এর উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে। তাঁরা নিজেরাও জানেন হয়তো এই জীবনকালের মধ্যে এই রহস্যভেদ হয়ত সম্ভব নয়, কিন্তু তাঁদের আবিষ্কৃত সূত্রের সাহায্যেই হয়ত পরবর্তী প্রজন্ম জন্মমৃত্যুর জটিল তত্ত্বের স্বরূপ খুঁজে পাবে। কিন্তু এই খ্যাপাটে বিজ্ঞানীর চিন্তাভাবনা অন্য খাতে বইত। অন্যেরা এই সন্ধানে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সে ব্যপারে তিনি সম্যকরূপে অবহিত ছিলেন, একইসঙ্গে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে বের করবেনই, এবং তা এই জীবনেই করবেন। অন্তিম ও সার্বিক উত্তরের সন্ধানে তিনি নিজের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেন।
কালক্রমে তিনি একজন পরীক্ষামূলক দার্শনিক হিসেবে প্রসিদ্ধিলাভ করেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের জন্য একের পর এক গবেষণামূলক পরিকল্পনা ও প্রকল্পের প্রস্তাব আনতে থাকেন। নানাবিধ অপ্রতুলতার কারণে তাঁর মধ্যে বেশিরভাগই বাতিল হতে থাকে।অবশেষে তাঁর একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প শিক্ষায়তনের অনুমোদন লাভ করে। খ্যাতিমান গবেষক অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁর বিখ্যাত বেগবর্ধক যন্ত্র আবিস্কার করেন, যা পরবর্তীকালে স্পেস-টাইম সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পরীক্ষানিরীক্ষা গুলি অতিরিক্ত বিপজ্জনক হওয়ার কারণে একটিও পরীক্ষা হাতেকলমে করার অনুমতি তিনি পাননি। তবুও সেই মহান গবেষক নিজের উদ্দেশ্যের প্রতি এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, যেনতেনপ্রকারেণ কয়েকটি পরীক্ষা তিনি করেন। অন্যদের জন্যে বিপদের সম্ভাবনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিজের জন্য বিপদের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলেন।
“ভাগ্য কখনও চিরকাল মানুষের অনুকূলে থাকে না। এমনই এক সময় তাঁর একটি পরীক্ষার মারাত্মক পরিসমাপ্তি ঘটে। ল্যাবরেটরি থেকে তাঁকে যখন মৃত অবস্থায় বের করে আনা হয়, তাঁর পকেটের মধ্যে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত আধারের মধ্যে একটি নোট পাওয়া যায়, যাতে তিনি নির্দেশ দিয়ে যান, “যদি কোনো কারণে আমার মৃত্যু হয়, সম্ভব হলে আমার মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করা হোক, আমার ইচ্ছে পরবর্তীকালে প্রথম যন্ত্রমানব নির্মাণে আমার মস্তিষ্ক ব্যবহৃত হোক।”
“দেখা গেল, তিনি ভবিষ্যতের কথা আঁচ করে যন্ত্রনিয়ন্ত্রক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্বলিত কৃত্রিম দেহ প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। অক্সিজেনের অভাবে স্নায়ুকোষের মৃত্যু ঘটার আগেই বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে কৃত্রিমভাবে নির্মিত সেই দেহে তাঁর মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপিত করা হল।”
শিক্ষকমহাশয় এরপর ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “তোমাদের কি মনে হয়, সেই বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রমানব প্রথমে কি করবে?”
“এক্সপেরিমেন্ট করবে!” অধৈর্য ছাত্রীটি ও একগুঁয়ে ছাত্রটি একসঙ্গে বলে উঠলো।
“রাইট! যে এক্সপেরিমেন্ট চলাকালীন তিনি মারা যান, সেই এক্সপেরিমেন্টটি!”, শিক্ষকমহাশয় বলে চলেন, “এই নতুন যন্ত্রনির্মিত দেহের কল্যাণে তাঁর আর অতি উচ্চচাপ বা অতিনিম্ন তাপমাত্রাকে ভয় করার কিছু রইল না। এর কল্যাণে তিনি একের পর এক অতি বিপজ্জনক এক্সপেরিমেন্ট গুলি করতে শুরু করলেন। কোনোভাবেই এর মধ্যে একটিও তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যের কাছাকাছিও পৌঁছে দিতে পারল না। তাঁর সেই অন্তিম উত্তরের সন্ধান শেষ হল না।”
“এরপর একদিন সেই মহান খ্যাপাটে বিজ্ঞানী তাঁর তৈরি একটি চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে সুরক্ষিত বাহনে চড়ে একটি লাল বামন তারার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ইতিমধ্যেই নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের মত বেশ কয়েকটি যন্ত্রপাতি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, সেইসব যন্ত্রাদি নিয়ে তিনি অন্য তারামণ্ডলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু এত সাবধানতা সত্ত্বেও তিনি একটি মারাত্মক ভুল করেন। তিনি মাধ্যাকর্ষণ বলের অভিঘাত হিসেবের মধ্যে ধরেননি। ফলত, মহাকাশে তাঁর বাহন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
“গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ হয়ে গেল?” একগুঁয়ে ছেলেটি আঁতকে ওঠে।
“বলতে ভুলে গেছি যে তিনি যাত্রা শুরু করার আগে এযাবৎ তাঁর সমস্ত স্মৃতি কঠিন স্ফটিকের মধ্যে তড়িৎচুম্বকীয় পদ্ধতিতে এনকোড করে মস্তিষ্কের আরেকটি রেপ্লিকা বানিয়ে রেখে যান। দ্বিতীয়বার যন্ত্রমানবের দেহ ধ্বংস হওয়ার পরে সেই স্ফটিক থেকে তাঁর মস্তিষ্কের রেপ্লিকা আর একটি কৃত্রিম দেহে প্রতিস্থাপিত করে পুনরায় আর একটি যন্ত্রমানবে প্রাণসঞ্চার করা হয়। এ সবই তিনি আগে থেকে ইচ্ছাপত্রে লিখে গেছিলেন। ফলে, মহান বিজ্ঞানীর ব্যক্তিত্ব, চিন্তাশক্তি ও জ্ঞান সমস্তই সংরক্ষিত হয়। ফলে দ্বিতীয়বার মৃত্যুর পরেও তিনি পুনরুজ্জীবিত হন এবং কৃত্রিম মানুষে পরিণত হন।
“এবারেও তাঁর প্রথম কাজ হয় পূর্বের অসমাপ্ত কাজটিকে সাফল্যের সাথে পরিণতি দেওয়া। কৃত্রিম ভাবে দেহপ্রাপ্তির পরেই তিনি আগের ভুলত্রুটি সংশোধন করে লাল বামন নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে আবার রওনা দেন, অভিযান সফল হয়, এবং তারপর প্রতিবস্তুর উদ্দেশ্যে আরও দূরের পথ পাড়ি দেন। এসময় তিনি তাঁর সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও সাধনের তথ্য তাঁর প্রতিষ্ঠানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ রাখতে শুরু করেন। বেতারে তিনি পৃথিবীর উদ্দেশ্যে সংবাদ প্রেরণ করতে থাকেন, সেগুলি কখনো কয়েকমাস পরে পৃথিবীত পৌঁছত, কখনও বা কয়েক বছর কেটে যেত। তিনি আরও জানান, বাহ্যিক পরিবেশের সাথে তিনি তাঁর বর্তমান দেহকে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। সূত্র অনুসারে বোঝা যায়, তিনি পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুসারে তাঁর জৈবিক সত্ত্বাকে সংশ্লেষিত শক্তিক্ষেত্রে পরিবর্তন করে নিতেন, এর ফলে অনায়াসে সংগৃহীত তথ্য সংরক্ষণ, পুনর্গঠন, বা পরবর্তী সঞ্চালন ও ব্যবহার করা যেত।
“এরপর তিনি অন্তিম উত্তর খুঁজে পেলেন?” অধৈর্য ছাত্রীটি বলে উঠলো।
“না, তিনি এখনও তার স্বরূপ উন্মোচনে সক্ষম হননি,” শিক্ষক মহাশয় বলতে থাকেন, “কিন্তু এই সন্ধানে ব্যাপৃত থাকাকালীন তিনি অমরত্ব অর্জন করলেন, এবং একইসঙ্গে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠলেন। এর গুরুত্ব তোমরা নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছ।”
“তার অর্থ এই যে এতকিছুর পরেও অন্তিম উত্তরের কোনও অস্তিত্বই পাওয়া গেল না?” একগুঁয়ে ছাত্রটি গজগজ করে উঠলো, তাহলে আপনি এতক্ষণ ধরে সেই বিজ্ঞানীর গল্প বললেন কেন?”
“আর তাছাড়াও আপনি বলেছিলেন সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে আগত সঙ্কেতের ব্যপারে বলবেন”, অধৈর্য ছাত্রীটি ভয় পাচ্ছিল পাছে শিক্ষকমহাশয় ভুলে যান।
“ঠিক এইটেই বলতে যাচ্ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি সঙ্কেতে যে তিনটি পি আসছে সেটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই সঙ্কেতের বক্তব্য বুঝতে বেতার-দূরবীক্ষন যন্ত্রের এতটুকু অসুবিধে হয়নি। তোমরা হয়ত জানো না, এটি মহান বিজ্ঞানীর পূর্বনির্দিষ্ট সঙ্কেত। হয়ত তিনি একটি নতুন নক্ষত্রের প্রজ্জ্বলন ঘটিয়েছেন, অথবা অন্তিম উত্তরের সন্ধানে নিজের শক্তিক্ষেত্রকে একটি নক্ষত্রে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁর পাঠানো রিপোর্ট থেকে শীঘ্রই এ ব্যপারে বিশদে জানা যাবে।”
দ্বিতীয় পাঠ
ইচ্ছাপত্র
তথ্যাবলীঃ পৃথিবীতে এক মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে। জ্ঞানীগুণী বিজ্ঞানী, স্থানীয় আবিষ্কারক, প্রতিভাশালী বা উন্মাদ ব্যক্তি, উচ্চশিক্ষিত হোক বা একগুঁয়ে মূর্খ ব্যক্তি, প্রতিভাশালী পরিশ্রমী ব্যক্তিই হোক বা নিরেট মূর্খ, সবাই এতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়াসুদ্ধ লোক তাঁদের শ্রম, বুদ্ধি, প্রতিভা, ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়োজিত করে এক অত্যাশ্চর্য যন্ত্রনির্মাণের উদ্দেশ্যে, এমন এক যন্ত্র যার কোনও ক্ষয় নেই, আদি অনন্তকাল ধরে যা অক্লান্তভাবে চলতে থাকবে। এই অক্লান্ত চেষ্টার ফলস্বরূপ তাদের প্রাপ্তির ঝুলিতে আসে ধ্বংস, হতাশা, পাগলামি, আত্মহত্যা ইত্যাদি। একাধারে মানবসম্পদের অর্থহীন ধ্বংস হতে থাকে, অন্যধারে এই বিরামহীন উদ্দেশ্যহীন যজ্ঞে যোগ্য অযোগ্য নির্বিশেষে মানুষের আহুতি পড়তে থাকে। সারা পৃথিবীজুড়ে মানবজাতি প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইতে মেতে ওঠে।
এমন সময় আবির্ভাব হয় এক মহান তার্কিক ব্যক্তির।
***
এই তার্কিক ব্যক্তির জ্যেষ্ঠ সহোদর ছিলেন এক বিখ্যাত প্রতিভাবান কুশলী যন্ত্রবিদ। তিনি তাঁর অন্যান্য সব কাজ ফেলে, সমস্ত প্রতিভা সামর্থ্য একাগ্রতা দিয়ে অক্ষয় যন্ত্র নির্মাণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কালের নিয়মে তিনি সমস্তই হারান একে একে। তিনি নিজে নিঃশেষ হয়ে যান, তাঁর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে যান।
অবশেষে তিনি একটি যন্ত্র নির্মাণে সাফল্যলাভ করেন। এতে দুটি আলাদা পাত্রে উচ্চচাপে দুই ধরনের বায়বীয় পদার্থ রাখা হয়। এই দুটির মিলিত টানের ফলে একটি চাকা অক্লান্ত ভাবে ঘুরতে থাকে। উত্তেজিত যন্ত্রবিদ তাঁর ভাইকে ডেকে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সৃষ্ট যন্ত্রটি দেখিয়ে বললেন, “কেমন বুঝছ?”
তাঁর বলিরেখাঙ্কিত চেহারাটি আনন্দে উৎসাহে ঝকঝক করছিল। তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে ভাই বললেন, “দেখেছি, কি বোঝাতে চাইছ?” তিনি ইতিমধ্যেই ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তার আঁচ পেয়েছিলেন। এই ভয়ঙ্কর হতাশা থেকে নিজের প্রিয়জনকে কিভাবে রক্ষা করবেন সেই চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তিনি নিতান্তই অনিচ্ছার সাথে শব্দ কটি উচ্চারণ করলেন।
যন্ত্রী বলে উঠলেন, “এটি অনন্ত যন্ত্র! যার ক্ষয় নেই, শেষ নেই! তুমি বলেছিলে এই যন্ত্র তৈরি করা অসম্ভব! মনে পড়ে?”
যুক্তিবাদী তার্কিক ভাইটি অর্ধস্ফুট ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “এখনও তাই বলছি।”
যন্ত্রী ঈষৎ রুষ্ট হয়ে বললেন, “তোমার সামনে প্রমাণ, এর পরেও দাবি করবে যে এ যন্ত্র তৈরি অসম্ভব?”
“এটি যন্ত্র ঠিকই। কিন্তু অক্ষয় অনন্ত নয়। ঘর্ষণের জন্য কিছু শক্তিক্ষয় হচ্ছে, এই মডেলের মাধ্যমে সেটুকু সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।”
এই অকস্মাৎ প্রতিযুক্তিতে যন্ত্রীর মুখ আচমকা রক্তশুণ্য হয়ে গেল। ক্রুদ্ধস্বরে তিনি বলে উঠলেন, “তোমাদের মত অবিশ্বাসীরা খালি সমালোচনা করতে ওস্তাদ! তোমরা কিচ্ছু বিশ্বাস কর না, কিচ্ছু সৃষ্টি কর না, তোমরা কোনও কাজের নও।”
কনিষ্ঠ ভ্রাতা শান্তভাবে এই দোষারোপ মেনে নিলেন, বললেন, “কিন্তু এটুকু মানো যে আমরা ভুলত্রুটির দিকে আগে নজর দিই বলে তোমাদের মত আবিষ্কারকদের কাজ সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সমালোচকদের মন্তব্য তোমাদের ভুল পথে পা বাড়ানোর হাত থেকে রক্ষা করে। রেগে যেওনা দয়া করে, এই পরিস্থিতিতে তোমাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবতে হবে। রাগ তোমার পরম শত্রু! আমি তোমাকে দোষ দিই না যদিও, নিজের জেদের জন্য তুমি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছ। দুর্ভাগ্যক্রমে, মানুষ যেটা বিশ্বাস করতে চায় সেটুকুই শুধু বিশ্বাস করে। মানুষ অসুস্থ হয়, তবুও বিশ্বাস করে যে শারীরিক অসুস্থতার হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তারা মরণশীল তবুও বিশ্বাস করে একদিন তারা মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠবে। এই জাতীয় যুক্তিহীন বিশ্বাস দুর্বলতার প্রকাশমাত্র, এর থেকে বেরোনোর দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। হয় তারা সেখানেই আজীবন থেকে যায়, অথবা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ করতে বাধ্য হয়।”
“যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কাছ থেকে এ ব্যাপারে আর একটাও কথা শুনতে চাইনা। তুমি আমাকে শেখাতে এসেছ? কি যোগ্যতা তোমার? তুমি তো নিজের যোগ্যতায় যন্ত্রী অব্দি হতে পারনি। সারাজীবন সামান্য আজ্ঞাবহক হয়েই থেকে গেলে।”
“আমি তোমার ভাই এবং তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তুমি যে পথে চলেছ তা মোটেও তোমার মঙ্গল ডেকে আনবে না।”
“এই পথ আমি নিজে বেছে নিয়েছি। আমাকে বাধা দেওয়ার ঔদ্ধত্য তোমার আসে কোথা থেকে?” দেওয়াল থেকে চাবুক খুলে নিয়ে আছড়ে মেরে বললেন, “এইমুহূর্তে বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”
যুক্তিবাদী ভাইটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যন্ত্রী এরপরে শহরে প্রচার করলেন যে তিনি অক্ষয় যন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, এবং সহগবেষকদের উদ্দেশ্যে জানালেন, শীঘ্রই টাউন হলে যন্ত্রটির একটি ডেমনস্ট্রেশন দেওয়া হবে।
পরের দিন তার ঘরে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। তিনি বিষ পান করে আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে একটি নোট পাওয়া গেল, “ভাই তোমার যুক্তি অভ্রান্ত। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
মৃত যন্ত্রীকে শহরের একটি অতি সাধারণ সমাধিস্থলে সমাহিত করা হল। তাঁর একপয়সাও সঞ্চয় ছিল না, তাঁর ভাই টাকা তুলে সমাধিতে প্রস্তরফলক বসানোর ব্যবস্থা করলেন।
কিছুদিন পরেই তার্কিক ভাই প্যারিস চলে যান, সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। এর কিছুকাল পরে তিনি একজন প্রসিদ্ধ অঙ্কবিদ হিসেবে নিজের শহরে ফিরে আসেন। তাঁকে সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেক্টরের পদ নিতে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তিনি তাঁর দাদার পুরনো বাসস্থানটি কিনে নেন, তারপর দীর্ঘ গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে অনেকগুলো বছর কেটে গেলো…
কুড়ি বছর পরে তিনি তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার আলোচ্য বিষয় ছিল “কেন অক্ষয় যন্ত্র তৈরি করা বাস্তবে অসম্ভব?” তিনি প্রমাণ করলেন যেকোনো কার্যকারী যন্ত্রে, তা সে চাকাজাতীয় হোক, বা ভাসমান চেইন হোক বা ক্যাপিলারি উইক হোক বা সাইফন বা পারদসংক্রান্ত যন্ত্র হোক, বা চৌম্বকীয় বা গোলোকসংক্রান্ত হোক, আবশ্যিকভাবে কিছুটা শক্তি তাপে রূপান্তরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। অক্ষয় যন্ত্র তৈরি করতে গেলে এর একটি বিকল্প বের করা প্রয়োজন। তিনি এই তত্ত্ব শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ না রেখে সংখ্যার দ্বারা প্রমাণ করেন।
তাঁর এই গবেষণালব্ধ ফল পরবর্তী অনেক গবেষকদের দীর্ঘ শ্রম ও সময় বাঁচিয়ে দেয়। তিনি তাঁর দাদার সাথে বাকবিতণ্ডার কথা জনসমক্ষে আনেননি। তাঁর দাদা যে প্রকৃতির সাথে অসম লড়াইতে নেমে হার মেনেছিলেন এ ব্যাপারে তিনি ঘুণাক্ষরেও কাওকে জানতে দেননি।
তার্কিক ব্যক্তিটির বয়স বাড়ে, কিন্তু তাঁর মানসিকতার বিশেষ পরিবর্তন হয় না। এখন লোকজন তাঁকে বৃদ্ধ জ্ঞানী তার্কিক ব্যক্তি হিসেবে চেনে। সারা পৃথিবী থেকে লোকজন তাঁকে চিঠি লেখে, গবেষণারত ছাত্রেরা আসে তাদের হাইপোথিসিস নিয়ে তার খুঁত বের করার জন্য। তিনি তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি ও যুক্তি প্রয়োগ করে সেই উপপাদ্যের ত্রুটি বুঝিয়ে দিতেন। অর্থ ও প্রতিপত্তি তাঁর কাছে খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল। যে অর্থ তাঁর দাদা অক্ষয় যন্ত্র তৈরির চেষ্টায় আজীবন নিয়োজিত থেকেও অর্জন করতে পারেননি, তাঁর ভাই তার অবাস্তবতা প্রমাণ করে সেই অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জনে সক্ষম হন।
সময়ের সাথে সাথে এই সুবিশাল হিসেবের জগত ধীরে ধীরে তাঁর দাদার স্মৃতি জনমানস থেকে মুছিয়ে দিতে থাকে। প্রকৃতির অদম্য ও অনন্ত শক্তির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন অংশে যে কয়েকটি বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ মুখর হচ্ছিল, যারা এখনও এই গবেষণায় কালাতিপাত করছিল, এই তাত্ত্বিক প্রমাণের ভারে তারা কোথায় তলিয়ে যেতে থাকে।
বৃদ্ধ তার্কিক ব্যক্তি সাফল্যের শিখরে থাকাকালীন দেহত্যাগ করলেন। না, তাঁকে তাঁর অভাগা দাদার মত দীনহীনভাবে সমাহিত করা হয়নি। তিনি নিজের জন্য পৃথক স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করিয়েছিলেন। তাঁর পরিচিত ব্যক্তিদের তাঁকে দেওয়া শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে নয়, এটি তিনি স্বয়ং তৈরি করিয়েছিলেন। তিনি নিজের ইচ্ছাপত্রে এর উল্লেখ করে যান।
এতটা একটানা বলে শিক্ষক মহাশয় একটু থামলেন, ছাত্রছাত্রীদের থেকে উত্তরের আশায়। সর্বজনবিদিত এই ইচ্ছাপত্রের কথা শিক্ষার্থীরা হয়ত জানতে পারে, ভাবলেন তিনি। তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়েছিলেন যে পদার্থবিদ্যার এই শাখা শিক্ষার্থীদের কাছে এখনও অবধি অপরিচিত।
“তাঁর ইচ্ছাপত্রে কয়েকটি মাত্র শব্দের উল্লেখ ছিল,” শিক্ষকমহাশয় বলে চলেন, একই সাথে শ্রেণীকক্ষের ভিডিও-স্ক্রিনে লাইটপেনের সাহায্যে লেখেন, “আমার গণনা পুনঃপাঠ করো।”
“এই কথাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এগুলি মনে রেখো। এগুলির জন্যেই অক্ষয় গতির বিরুদ্ধে প্রকৃতির যে বিরূপতা, তা একদিন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে,” যোগ করেন তিনি।
তৃতীয় পাঠ
নতুন গ্রহের নাম দেওয়া হল “প্রাচুর্য”
তথ্যের কলামে লেখাঃ “আমি জানি না কোন মহাকাশচারীরা এর নামকরণ করেছেন,” শিক্ষকমহাশয় আর একটি কাহিনীর সূত্রপাত করেন। “কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা প্রথম গ্রহটিকে দেখেন, এর অসম্ভব স্বচ্ছ হ্রদ, তাতে সাঁতার কেটে বেড়ানো মাছের দল, এর অত্যন্ত অনুগত পশুর দল, ফল ও ফুলের ভারে নুয়ে পড়া গাছের ডাল, তাঁদের এই বিশেষ নামটি দিতে বাধ্য করে। এই গ্রহের সুমিষ্ট তরতাজা বাতাস যেন অভিযাত্রীদের দেহ থেকে শ্রান্তির শেষ বিন্দু হরণ করে নিচ্ছিল।
***
গ্রহটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই মহাকাশযাত্রীরা এমন কিছু লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন যাতে বোঝা যায় গ্রহটিতে উন্নত শ্রেণির প্রাণীর বসবাস আছে, এবং তাঁরা আধুনিক সভ্য জীবনযাপন করেন। চারধারে কৃত্রিম উপগ্রহ গ্রহটিকে পরিক্রমা করছে।
কম্যান্ডার আদেশ করলেন, “আমাদের উপস্থিতির সঙ্কেত পাঠানোর ব্যবস্থা কর”।
মহাজাগতিক ভাষাবিদ সঙ্কেত তৈরি করে রেডিওকন্ট্রোলার কে পাঠিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাকাশযান থেকে অজানা গ্রহের দিকে সঙ্কেত ভেসে গেল।
উল্টো দিক থেকে কোনো উত্তর এলো না।
মহাকাশযানটি উত্তরের অপেক্ষায় নতুন গ্রহের চারধারে একের পর এক চক্কর কাটতে থাকল। ইতিমধ্যে রেডিওকন্ট্রোলার গ্রহে সম্প্রচার হওয়া রেডিও ও টিভির সঙ্কেত বিশ্লেষণ করে ল্যাতিন ভাষার সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান। এরপরে ভাষাবিদ এই ভাষায় সঙ্কেত তৈরি করে পুনরায় গ্রহে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করেন। গ্রহের থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে মহাকাশযানের ডিসপ্লে সিস্টেমে নতুন গ্রহের পৃষ্ঠতলের ছবি ফুটে উঠছিল। তাতে দেখা গেলো এই গ্রহেও পৃথিবীর মত সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট। গ্রহের বাসিন্দারা নিজেদের মত কাজে ব্যস্ত, অন্যগ্রহের মানুষদের দেখে এদের বিশেষ কোনো হেলদোল হল না।
মহাকাশযানটি জনবসতি থেকে দূরে এক নির্জন এলাকাতে ল্যান্ড করলো। পাঁচজন নভোচর সেখান থেকে আন্তঃজগত বাহকযন্ত্রে চেপে নিকটস্থ শহরের অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন।
দেখা গেলো, এ গ্রহের সাথে পৃথিবীর অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু বিল্ডিং গুলির গড়ন বেশ একঘেঁয়ে ধরনের। বাঁধাধরা একটি বা দুটি ধরণে সেগুলি বিন্যস্ত, বিশেষ বাহ্যিক অলঙ্করণও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাগুলি সব একটি গোলাকার এলাকায় গিয়ে মিশছে, সেখানে একটি বর্গাকৃতি বিল্ডিং। বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে এই গ্রহের অধিবাসীরা এই বিল্ডিং এর মধ্যে ঢুকছে। প্রাচুর্যবাসীদের সাথে বাহ্যিকভাবে পৃথিবীবাসীদের দৃশ্যত তেমন কোনো পার্থক্যই নেই।
একটু এগিয়ে এসে পৃথিবীবাসীদের যানটি থেমে গেলো। প্রথমেই বেরিয়ে এলেন মহান দার্শনিক, তাঁর পরে এলেন জৈব-যন্ত্রবিদ ও কম্যান্ডার। কক্ষপথে থাকাকালীন গ্রহের রেডিও সম্প্রচার শুনে তাঁরা স্থানীয় ভাষা কিছুটা আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন। সেই ভাষা ব্যবহার করে কম্যান্ডর এক প্রাচুর্যবাসীর থেকে জানতে চাইলেন, “এই বিল্ডিং এ কি আছে?”
“সবাই জানে এতে কি আছে,” উত্তর দিয়ে সে একটুও না থেমে হনহনিয়ে চলে গেলো।
এর পরে মহান দার্শনিকের পালা। তিনি অপর এক ব্যক্তিকে থামিয়ে বললেন, “আপনার দিনটি শুভ হোক।” প্রত্যুত্তরে সেই ব্যক্তি যথোচিত প্রতিসম্ভাষণ করলেন। “দেখে বড় খুশি হলুম যে আপনি কুশলে আছেন এবং অযাচিত কোনো বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন না,” এইটুকু বলে তিনি পুনরায় নিজের পথে এগিয়ে যেতে উদ্যত হলেন।
“ক্ষমা করবেন,” দার্শনিক তাঁকে আরও কিছুক্ষণ আটকানোর উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “আপনার কয়েক মুহূর্ত সময় নিতে পারি?”
“নিশ্চয়ই!” প্রাচুর্যবাসী মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “কিন্তু মনে রাখা দরকার যে মুহূর্তের সমষ্টিতে আমরা একঘণ্টা সময় পাই, কয়েক ঘণ্টার সমাবেশে পাই একটি দিন, এবং আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমরা এই গ্রহের কল্যাণসাধনে ব্যয় করা উচিত।
দার্শনিক তাঁকে আশ্বস্থ করতে চাইলেন, “আমাদের এই কথোপকথন নিঃসন্দেহে আপনার গ্রহের মঙ্গলসাধন করবে। আমরা অন্য সৌরজগৎ থেকে এখানে এসেছি। আমরা জ্ঞান বিনিময় ও বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী।”
“অনুশাসন মেনে চলা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, নিয়ম ব্যতীত আর সবকিছুই অপ্রয়োজনীয়,” যান্ত্রিক হাসি মুখে নিয়ে গম্ভীরস্বরে প্রাচুর্যবাসী মন্তব্য করলেন।
“নতুন জ্ঞান বা তথ্যের ব্যপারে আপনার কি অভিমত?” জৈব-যন্ত্রবিদ জানতে চাইলেন।
“স্মৃতি অসীম নয়, একে অকারণে অতিরিক্ত ভারাক্রান্ত করা উচিত নয়। আমাদের সন্তুষ্টি অনুভব করার জন্য যতটুকু জ্ঞান প্রয়োজন আমরা সেটুকুই গ্রহণ করি, আমাদের প্রথম নিয়ম আমাদের তাইই শেখায়।”
“তাই নাকি?” ভুরু কুঁচকে জৈব-যন্ত্রবিদ আবার প্রশ্ন করেন, “আর দ্বিতীয় নিয়ম কি?”
“ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমরা নির্বাচিত করি না, যেমনটা আমাদের অভিভাবকদের করিনা ঠিক তেমনই। এবং তৃতীয় নিয়ম হল, আদেশের বা নিয়ম সংক্রান্ত আলোচনা নিষ্প্রয়োজন, আদেশ পেলে অবিলম্বে তা পালন করা দরকার” নির্বিকারভাবে এতটা বলে প্রাচুর্যবাসী নিজের পথে এগিয়ে চলেন।
দার্শনিক কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে আপন মনে বিড়বিড় করে ওঠেন, “আমি হয়ত এর কথা আগেও ভেবেছি।” তারপর তিনি আচমকা দ্রুতবেগে কিছুদুর এগিয়ে, আবার ফিরে সেই প্রাচুর্যবাসীর উদ্দেশ্যে সম্ভাষণ করলেন, “আপনার দিনটি শুভ হো্ক”, তাঁদের কথোপকথন শুনে মনে হল এই প্রথমবার একে অপরের সাথে কথা বলছেন।
“আপনার দিন শুভ হোক। দেখে বড় খুশি হলুম যে আপনি কুশলে আছেন এবং অযাচিত কোনো বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন না।”
“ক্ষমা করবেন, আপনি কি ভিনগ্রহী অভিযাত্রীদের আসার ব্যাপারে কিছু শুনেছেন?”
একইরকম মৃদু হাসি মুখে রেখে তিনি উত্তর দিলেন, “না তো, তেমন তো কিছু কানে আসেনি।”
“কিছু জানতে পারলেন?” কম্যান্ডার দার্শনিককে জিজ্ঞেস করলেন।
“চলুন, এই বিল্ডিং এ ঢুকলে হয়ত কিছু জানতে পারব।”
তাঁরা প্রাচুর্যবাসীদের সাথে মিশে সেই বিল্ডিং এর প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রবেশপথের সামনেই একটি বিশাল বর্গাকার হলঘর। প্রত্যেকটি দেওয়ালে একটি মানুষের অগণিত ছবি টাঙ্গানো। ছবির মানুষটির বর্গাকৃতি চেহারা, বুলডগের মত মুখ ও সেই মুখে একই ধরণের যান্ত্রিক মাপা হাসির আভাস, প্রতিটি ছবির নিচে লেবেলে লেখা, মহান পরিচালক। লেবেল এর নিচে ছোটো ছোটো বোর্ডে ছবির ব্যক্তির কিছু উদ্ধৃতি লেখা। গ্রহবাসীদের মতে এই বাণীগুলি তাঁদের জীবনে শান্তি, সুখ, আত্মতুষ্টি ও সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছে।
কম্যান্ডারের দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি এর মধ্যে চেনা কাওকে খুঁজে পেয়েছেন। মহান দার্শনিক বুড়ো আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি বোর্ড এর অপরে লেখা বিশেষ একটি উদ্ধৃতির প্রতি তাঁর সহযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তাতে লেখা, “অর্জনের প্রচেষ্টা থেকে অর্জন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পথিক, নিজের চারদিকে দেখুন। আপনি অনেক দূরে চলে যাননি তো? এমন নয়তো যা খুঁজছেন তা অবহেলাভরে আগেই ফেলে এসেছেন কোথাও…”
আর একটিতে লেখা, “গন্তব্যে পৌঁছলেই জয় সুনিশ্চিত হয় না, নিজের উপস্থিতির সুদৃঢ় প্রমাণ রাখতে হয়!”
প্রবেশপথের হলটি থেকে এরপর তাঁরা ওপর একটি হল এ প্রবেশ করলেন, এটি আগেরটির থেকেও বড়, এটির দেওয়ালগুলি ঝকঝক করছে। মাপা হাসি নিয়ে একজন স্থানীয় অধিবাসী এঁদের দিকে এগিয়ে এলেন, বোঝা গেল তিনি এখানে পথপ্রদর্শক। আগত অতিথিরা অন্য গ্রহের অভিযাত্রী শুনেও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র হেলদোল বা চমক দেখা গেলো না।
কম্যান্ডার বললেন, “মহান পরিচালক সম্পর্কে আমাদের বিশদে জানান।”
“নিশ্চয়ই!” পথপ্রদর্শক প্রাচুর্যবাসী দেওয়ালের ওপরে একটি প্যাডেল এ চাপ দিলেন। দেওয়ালটি অজস্র রঙে ভেঙ্গে সরে গেল। সামনে দেখা গেল একটি বর্গাকৃতি জনবহুল এলাকা। বক্তৃতামঞ্চ থেকে ছোটখাটো এক ব্যক্তি সামনের জনসমাগমকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখছেন। বক্তার চেহারার সাথে প্রবেশপথের অবয়বগুলির সাযুজ্য প্রচুর। সেই একই ক্ষমতাপ্রিয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেহারা।
তিনি জনতার উদ্দেশ্যে উত্তেজিতভাবে বলে যেতে থাকেন, “সেই মহান দিন আজ সমাগত। আমরা আজ সভ্যতার শিখরে পৌঁছেছি। অনেক মহান আত্মার আশীর্বাদে আমরা আজ এতদূর পৌঁছতে পেরেছি। এখনও অব্দি একটিই মাত্র জিনিস আমরা সম্পূর্ণ করায়ত্ত করতে পারিনি, তা হল অনন্ত জ্ঞান। কিন্তু যতই জ্ঞান আমরা সঞ্চয় করি না কেন, তা কখনই সম্পূর্ণ হবে না। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা এর পথ বের করেছেন। তাঁরা অনেক আগেই বংশগতির রহস্য সমাধান করেছেন। আমরা এখন জানি কিভাবে অর্জিত গুণাবলীর মধ্যে ইচ্ছেমত রদবদল ঘটানো সম্ভব।এই আবিষ্কারের কিছু বাস্তব প্রয়োগ আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি সকলকে বুঝিয়েছি, গুটিকয়েক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত ব্যক্তি বাদে প্রায় সকলেই এর সুফলের ব্যপারে সহমত হয়েছেন। আজকের পর থেকে কাউকে তিল তিল করে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে না। বংশগতির মাধ্যমে যেভাবে আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি নির্ধারিত হয়, সেভাবেই আমারা জ্ঞান অর্জন করব। পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর আগের প্রজন্মের চারিত্রিক ধারার পাশাপাশি তাঁর জ্ঞান, অধীত বিদ্যা, সামাজিক অবস্থান, স্মৃতি সকলই উত্তরাধিকারসুত্রে পাবে। পরবর্তী প্রজন্মকে পেশার সন্ধানে আকুল হতে হবে না, সে শুধু পূর্বনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যাবে। আমাদের জাতি এক মহান অনুপ্রেরণায় কয়েকগুণ বেগে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।”
এক প্রাচুর্যবাসী ভিড় থেলে এগিয়ে এসে বাকিদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলো, “যদি নিজের ধ্বংস না চাও, মহান পরিচালকের এ প্রস্তাবে সহমত হয়ো না। তাঁর যুক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও তা অন্তঃসারশূন্য। আমাদের স্মৃতিশক্তি অসীম নয়। কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই তা পূর্ণ হয়ে যাবে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নতুন কোনো সমস্যা এলে তা সমাধানে অপারগ হয়ে পড়বে। যে জ্ঞান থাকবে তাঁর কোনো বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হবে না। কিছুদিনের মধ্যেই এই অসীম জ্ঞানভাণ্ডার বাতিল হয়ে যাবে। আমাদের সভ্যতার গতি হ্রাস পেতে পেতে একদিন রুদ্ধ হয়ে যাবে। আর এই থেমে যাওয়া মৃত্যুর সমতুল!”
“শুনতে পাচ্ছ তোমরা?” মঞ্চ থেকে জলদগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো, “তোমাদের মৃত্যুভয় দেখানো হচ্ছে। এর উত্তর কিভাবে দেবে তোমরা?”
পিছনে কোথাও থেকে লম্বা ব্যারেল বেরিয়ে এলো, মুহূর্তের জন্য আলোর ঝলকানি দেখা গেলো, পরমুহূর্তেই বিদ্রোহীর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
দার্শনিক এই দৃশ্য দেখে কম্যান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এই গ্রহে আর কোনো উন্নতমস্তিষ্কের জীব অবশিষ্ট নেই। আমরা ঘটনাচক্রে বায়ো-অটোমেটনের দেশে এসে পড়েছি।”
“ছিঃ, এই নাহলে মহান পরিচালক!” কম্যান্ডারের কথায় তিক্ততা ঝরে পড়ে। তাঁরা সেখান থেকে প্রস্থানপথের দিকে এগিয়ে যান।
পথে পৃথিবীবাসীদের সাথে পুনরায় আগের প্রাচুর্যবাসীর দেখা হয়। এরই সাথে কিছুক্ষণ আগে দার্শনিক দুবার কথা বলেছিলেন। আবার দেখা হতেই দার্শনিক বলে উঠলেন, “তরুণ বন্ধু, আপনার দিন শুভ হোক।”
“শুভ দিন, দেখে ভাল লাগলো যে আপনি কুশলে আছেন এবং অযাচিত কোনো বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন না,” এইটুকু বলে প্রাচুর্যবাসী নিজের পথে এগোনোর উপক্রম করেন।
জৈব-যন্ত্রবিদ স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে পড়েন। কম্যান্ডার তাঁর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেন, “চলুন ফিরে যাওয়া যাক।”
জৈব-যন্ত্রবিদ বিড়বিড় করতে শুরু করেন, “শুভ দিন। শুভ দিন। শুভ দিন। দেখে ভাল লাগলো যে আপনি কুশলে আছেন এবং …”
এতদূর বলে শিক্ষকমহাশয় নিস্তব্ধ ক্লাসের দিকে একনজর দেখে অধৈর্য ছাত্রীটির দিকে তাকিয়ে বলেন, “এরপরে আমি কম্যান্ডারের দিনলিপি থেকে কিছুটা অংশ তোমাদের পড়ে শোনাবঃ ‘আমাদের মহাকাশযান এরপরে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে এগিয়ে চলে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে আমাদের আরো দুটি গ্রহে যাওয়ার কথা আছে। কিন্তু আমি অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি, পরিস্থিতির চাপে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছি বলা চলে। অভিযাত্রীরা এক সাংঘাতিক মানসিক চাপে আছেন, তাঁদের সুস্থ করে তোলা এই মুহূর্তে আমার প্রথম কর্মসূচী। এই মহাবিশ্বে এমন একটিই জায়গা আছে যা এঁদের পূর্বের মানসিক স্থৈর্য ফিরিয়ে দিতে পারে।
“আমার সহকর্মীরা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কাজ করে চলেছেন, স্বাভাবিক বাক্য বিনিময়টুকু অবধি প্রায় বন্ধ। মহাকাশযান যাতে দ্রুত চালানো যায় তার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে দ্বিগুন পরিমাণ কাজ করে চলেছেন।
আমি তাঁদের প্রত্যেকের চেহারায় এখনো পর্যন্ত এক অদ্ভুত পার্থক্য লক্ষ্য করছি, প্রত্যেকের মুখে এক অদ্ভুত অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব। রেডিওকন্ট্রোলার উত্তেজনায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন, জৈব-যন্ত্রবিদ কম্পিউটার প্যানেলের ওপর মাথা নিচু করে বসে আছেন। আন্তঃজগত বাহনের ড্রাইভারের চোখে যুগপৎভাবে অভিযোগ এবং হতাশার ছায়া, দার্শনিকের অবশ দৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে তাঁর ভেতরটা কেমন ভেঙ্গেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষগুলি আমার অত্যন্ত আপন, এঁরা যদি এভাবে নিজেদের শেষ করে দেন এই মহাশূন্যের মাঝে, আমার জীবনের কি অর্থ থাকবে? কিসের জন্য এই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, এত উন্নতি কিসের জন্য? যদি আমি এঁদের জন্য কিছু নাই করতে পারি? কিভাবে আমি এঁদের সাহায্য করতে পারি?
বারবার পর্যবেক্ষণ-স্ক্রিনের দিকে অজান্তেই দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। যদি কোনোভাবে বাইরের গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে আমাদের চিরচেনা সূর্য ভেসে ওঠে। আমি জানি বর্তমান অবস্থানের সাপেক্ষে অন্তত একমাসের আগে তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এদের চোখে কোনোভাবে ধুলো দিতে হবে। সকলের অগোচরে ডিসপ্লে স্ক্রিনে একটি পুরনো ফিল্ম স্ট্রিপ চালিয়েছি, অন্য গ্রহের উন্নত শ্রেণির জীবের সাথে যোগাযোগ সাধনের উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়। ফিল্মটা ততক্ষণ চালাই যতক্ষণ না তাতে সৌরজগৎ দৃশ্যমান হয়। এর পরে উপযুক্ত সময় বুঝে স্ক্রিন এ ফ্রেমটা স্থির করে বাকিদের উদ্দেশ্যে ডাক দিই, “দ্যাখো সবাই!”
“তাঁরা সকলে স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। দূরে কিনারার দিকে একটি সবুজাভ গ্রহ দেখা যায়। আমি বাকিদের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি। আমাকে কে কি ভাবলো তাতে আমার বিন্দুমাত্র কিছু যায়-আসে না। তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি বিষণ্ণ মুখগুলি পুনরায় উজ্জ্বল হয়ে আসছে। যে যাই ভাবুক, আমি আমার কৃতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপ করি না…’”
শিক্ষকমহাশয় এখানেই থেমে ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকালেন।
“তাহলে তাঁরা প্রাচুর্যবাসীদের উদ্ধার করেননি? তাঁদের সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেননি?” অধৈর্য ছাত্রীটি আতঙ্কিতভাবে চিৎকার করে উঠলো।
“তাঁরা মহাজাগতিক ত্রানকেন্দ্রে যোগাযোগ করলেন না কেন?” বুদ্ধিমান ছাত্রটি জানতে চাইল।“ক্যাসিওপিয়া তারামণ্ডলে একটি নক্ষত্রে বিস্ফোরণের পরেও তো সমস্ত উন্নত শ্রেণির প্রাণী বিলুপ্ত হয়নি। আপনিই তো আমাদের একাধিকবার বলেছেন…”
শিক্ষকমহাশয় সন্তুষ্টচিত্তে ছাত্রছাত্রীদের রুষ্ট মুখগুলি ভালোভাবে দেখলেন। তিনি এতদিন ধরে তাদের যা শিখিয়েছেন, তারা সব মনে রেখেছে। এরপরে তিনি বলে উঠলেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলেছিলামঃ যুক্তিবোধ যেকোনো বিপদ জয় করতে পারে,” এইটুকু বলে তিনি আবার কিছুক্ষণ থামলেন, বাকি বাক্যাংশটি শিক্ষার্থীদের আত্মস্থ করতে এই সময়টুকু দিলেন তিনি, “যদি যুক্তি সময় থাকতে বিপদের আভাস পায়, এবং তাঁকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে পারে, তবেই তা সম্ভব।”
চতুর্থ পাঠ
মানুষ কি?
(বিজ্ঞান একাদেমির বৃহৎ কম্পিউটারে পাওয়া উত্তরগুলি নিম্নরূপ)
মানুষ একটি প্রাণী। ব্যকরণগতভাবে মানুষের জন্য ‘কি’ এর পরিবর্তে ‘কে’ ব্যবহৃত হয়। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, প্রশ্নটি ভুল। প্রশ্নটি ‘মানুষ কি’ এর পরিবর্তে ‘মানুষ কে’ এরূপ হওয়া উচিত ছিল।
মানুষ অজস্র পরস্পরবিরোধী নীতির সমন্বয়ে সৃষ্ট। তাঁর কাছে কোনো প্রাপ্তি বা অর্জনই যথেষ্ট নয়। এর ভাল খারাপ দুই দিকই আছে। খারাপ, কারণ এই অস্থিরতার কারণে সে কখনো কখনো অপরিনামদর্শী আচরণ করে। অপরপক্ষে, ভাল, কারণ তা মানুষকে কখনো আত্মতুষ্ট হতে দেয়না। এর জন্যই মানবজাতি আজও অস্তিত্বরক্ষা করে চলেছে, কারণ স্থবিরতা যেকোনো জাতির জন্য মৃত্যুর সমান।
মানুষ অনন্তকাল ধরে কিসের সন্ধানে চলেছে তা তাঁর নিজের কাছেও তেমনভাবে বোধগম্য নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ মরীচিকার মত এর পেছনে ছুটে চলেছে। এর জন্য তারা বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে থাকে, আমার মত যন্ত্রের জন্য তা বোধগম্য নয়, আমাকে সেভাবে তৈরি করা হয়নি। এই মরীচিকার নাম মানবিকতা। এর সন্ধানেই মানুষের যাত্রা ও তাঁর সাফল্য।
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ
ইগর রসোখোভাৎস্কি (Ігор Маркович Росоховатський) (Igor Markovich Rosokhovatsky) ইউক্রাইনীয় কবি, লেখক, ভাষা-সাহিত্য স্নাতক, বিজ্ঞান-সাংবাদিক, বহু পত্র-পত্রিকা-সংবাদপত্রের সম্পাদনাও করেছেন। জন্ম ৩০ আগস্ট ১৯২৯ চেরকাসি অঞ্চলের শ্পোলা শহরে। মৃত্যু ৮ জুন ২০১৫। প্রভূত গ্রন্থ ও একশরও বেশি জনপ্রিয় বিজ্ঞান নিবন্ধের লেখক। তাঁর কল্পবিজ্ঞান রচনাগুলি বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে সম্মানীত। ১৯৫৮ তে প্রথম কল্পবিজ্ঞান গ্রন্থ প্রকাশ। মানুষের অপূর্ণতার কারণ অনুসন্ধান ও উত্তরনের খোঁজ তাঁর প্রায় সব রচনার মূলসুর। তাঁর ‘সিগোমাস’ সিরিজের গল্পগুলিতে (বর্তমান গল্পটিও যার অন্তর্ভূক্ত) এছাড়াও মহাবিশ্ব, মানুষ থেকে তৃণাঙ্কুর – জীবিত বা অচেতন প্রকৃতি – জাগতিক অস্তিত্বের এই সমস্ত কিছুর মধ্যেকার এক অবিচ্ছেদ্য সংযোগের কথাও রণিত হয়েছে।
বর্তমান গল্পটি ১৯৭১ সালে রচিত। উইলিয়াম কেন্ডাল কৃত ইংরেজি অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে সোভিয়েত লিটারেচার পত্রিকার বিশেষ কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা #১(৪০৬)তে। সেখান থেকেই বর্তমান অনুবাদটি করা হয়েছে। ১৯৯০ তে এ. এন. প্যানাসাইয়েভা-র ইংরেজি অনুবাদে ‘অ্যান্ড ম্যান ক্রিয়েটেড সাইহোম’ নামক রসোখোভাৎস্কি-র গল্প সংকলনেও এটি অন্তর্ভূক্ত ছিল।
সুপ্রদীপ্তা মন্ডল এক বইপোকা, আড্ডাবাজ, সিনেমাপ্রেমী ও সিরিজখোর। পড়তে ভালোবাসে, প্রিয় বই লোকজনকে ধরে পড়াতে আরো ভালোবাসে। রহস্য-রোমাঞ্চ, মিথলজি, সাই ফাই ও ঐতিহাসিক গল্পের সাংঘাতিক ভক্ত। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী, পেশাগতভাবে কোলকাতার একটি কলেজে ইংরেজি বিভাগে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে কর্মরতা, ও বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্য নিয়ে গবেষণারতা।
কৃতজ্ঞতা: ইগর রসোখোভাৎস্কি, উইলিয়াম কেন্ডাল, সোভিয়েত লিটারেচার পত্রিকা।
Tags: আইগর রশোকোভতস্কি, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, রাশিয়ান অনুবাদ গল্প, সুপ্রদীপ্তা মন্ডল