মূষিক আতঙ্ক – এইচ পি ল্যাভক্রাফট
লেখক: সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: সূর্যোদয় দে
শেষ মিস্ত্রীটা কাজ খতম করে যেদিন বিদায় নিল, ১৯২৩ সালের সেই ১৬ই জুলাই, আমি এক্সাম প্রায়োরীতে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করলাম। পুরো বাড়িটাই প্রায় নতুন করে সংস্কার করতে হয়েছিল। একটু শামুকের খোলার মত ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর বাড়িটার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না বিশেষ। কাজটা কিন্তু বেশ ঝক্কির গেল কদিন। তবুও হাজার হোক, পূর্বপুরুষের ভিটে বলে কথা – তাই অর্থের ব্যাপারে কোনরকম কার্পন্য করিনি আমি। প্রথম জেমস –এর আমল থেকেই এই বাড়িতে আর কেউ বাস করে না। এই দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত থাকার পেছনে নাকি এক রহস্যময় ঘটনা দায়ী, যার কোনোরকম যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। শোনা যায়, এই বাড়ির ভূতপূর্ব মালিকের সাথে এক রহস্যময় পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল যার ফলস্বরূপ শুধু এই বাড়ির মালিকই নন, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে এবং সাথে চাকরবাকর গুলো অবধি সেই ভয়ানক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। একটু ভুল বললাম, একমাত্র তাঁর তৃতীয় সন্তানটিই সেই বীভৎস ঘটনার নাগপাশ কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। ভাগ্যচক্রে তিনিই আমার পূর্বপুরুষ।
এই নারকীয় হত্যালীলার দায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই তৃতীয় সন্তানের উপর বর্তায়। কিন্তু দুভার্গ্যক্রমে, তাঁর পক্ষে সাক্ষী দেবার মত কেউই বেঁচে ছিল না। পিতৃহন্তার দায় মাথায় নিয়ে তিনি তাঁর নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন, এবং আইনানুসারে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তৎকালীন রাজাবাহাদুর বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই ঘটনার বহুদিন পরেও ইনি নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার না কোনো উৎসাহ দেখিয়েছেন, না তাঁর হৃত সম্পত্তি পুনুরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন। উল্টে সদা সর্বদাই চেষ্টা করে গেছেন এই “অভিশপ্ত” বসতবাড়িকে আর কোন এক ভয়ংকর স্মৃতিকে তাঁর মন এবং দৃষ্টিসীমানার বাইরে রাখতে। মনে হয় আইনের চোখরাঙানির চেয়েও অজানা কোনো এক প্রচন্ড আতংকের প্রভাব তাঁর ওপর প্রবল ছিল।
এঁর নাম, ওয়াল্টার ডে লা পোর। ইনিই এককালে এক্সাম অঞ্চলের এগারোতম ব্যারন এবং আমার প্রপিতামহ। ওই ঘটনার পর ইনি ভার্জিনিয়াতে পালিয়ে আসেন এবং অতীত দুঃস্বপ্নকে পিছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মই, পরের শতাব্দীতে, ডেলাপোর বংশ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এক্সাম প্রায়োরী কিন্তু এই পুরোটা সময় খালিই পড়ে ছিল – যদিও পরবর্তীকালে এটিকে নরিস পরিবারের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। অট্টালিকাটির গঠনের মধ্যে বহুপুরাতন এক মিশ্র স্থাপত্যরীতি লক্ষ্য করা যায়। সেজন্য, কেউ বসবাস না করলেও অনেকদিন ধরে এটা রিসার্চের এবং তদুপরি অ্যাকাডেমিক আগ্রহের একটা বিষয়বস্তু ছিল। কিংবদন্তী অনুযায়ী এই বাড়ির গথিক ঘরানার বড় বড় উঁচু মিনার, বাড়ির নীচের দিকে স্যাক্সন বা রোমানিয়ান টাইপের গঠন, তার ওপর ড্রুইডিক এবং সিমরিক স্থাপত্যের মিশ্রনে তৈরী এর ভিত যেন একে মহাকালের স্রোতে অটুট দন্ডায়মান এক সুপ্রাচীন ও স্থবির প্রস্তরখন্ডের রূপ দিয়েছিল। প্রায়োরীর নীচের অংশটি একভাবে সোজা উঠে গিয়ে মিশে গেছে কঠিন চুনাপাথরের তৈরী এক উঁচু বাঁধের সাথে – যার মাথায় উঠলে অদূরের অ্যানচেস্টার গ্রামটির তিন মাইল পশ্চিমে বিস্তৃত ভগ্ন উপত্যকাটি পুরোপুরি দেখা যায়। স্থপতি এবং প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খুব আগ্রহের সাথে শতাব্দী প্রাচীন এই ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কিন্তু এখানকার মানুষজন কেন জানিনা জায়গাটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। তবে একশ বছর আগে আমার পূর্বপুরুষেরা যখন এখানে বাস করতেন, তখনও লোকজন এটিকে এড়িয়েই চলত আর এখন তো শ্যাওলা আর অবহেলার অন্ধকার জায়গাটার ওপর একটা ছায়ার মতো নেমে এসে আশেপাশের লোকজনদের কাছে একে আরও ভীতিপ্রদ করে তুলেছে। তাই পারতপক্ষে কেউ এদিক বিশেষ মাড়ায় না। অ্যানচেস্টারে এসেছি একদিনও হয়নি, এরই মধ্যে জেনে গেছিলাম যে আমি এক “অভিশপ্ত” ইমারতের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছি। এসবের মাঝে, সপ্তাহের শুরুতেই মিস্ত্রী লাগিয়ে পুরোদমে এক্সাম প্রায়োরী সংস্কারের কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম আর ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এই অট্টালিকার সাথে জুড়ে থাকা শতাব্দী প্রাচীন প্রবাদের ভিত্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করতে।
আমার পরিবারের অতীত ইতিহাস বেশ অদ্ভুত। খুব রহস্যজনক ভাবে আমার পূর্বপুরুষ সুদূর অ্যানচেস্টার থেকে ভার্জিনিয়ার কলোনীতে এসে নতুন ভাবে জীবন শুরু করেন। এবং এইক্ষেত্রে ডেলাপোর বংশ কিন্তু নিশ্ছিদ্র মন্ত্রগুপ্তি বজায় রেখে চলেছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই রহস্যের বিশেষ কিছু উদ্ধার করে উঠতে পারিনি। আমাদের পাড়া প্রতিবেশীদের মত আমরা কিন্তু নিজেদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করা বা বহুবছর আগে তাদের নায়কোচিত কার্যকলাপের বিবরণ দিয়ে ছাতি দশহাত করে ফেলার মত কিছুই করিনি বরং, নিজেদের পরিবারের ইতিহাসের ব্যাপারে বিষয়ে কিছু বিশেষ না জানার জন্য চুপ করে থাকতে হয়েছে অধিকাংশ সময়েই। বংশানুক্রমে কিছু সংস্কার, আদব কায়দা বা আচার বিচার ইত্যাদি আদিপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষের উপর হস্তান্তরিত হয়, কিন্তু সেখানেও ভাঁড়ে মা ভবানী! কেবল আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বাধার সময়ে, আমার পূর্বপুরুষ সেই রহস্যময় ভদ্রলোক, একটি মুখবন্ধ খামে কিছু লিখে তাঁর বড় ছেলের হাতে সঁপে যান এবং নির্দেশ দিয়ে যান, খামের মুখ যেন তাঁর মৃত্যুর পরেই খোলা হয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের বংশের গৌরবের সূচনাই ঘটেছে, আমার পূর্বপুরুষের এই দেশান্তরকরনের পর থেকেই। তবে এটা ঠিক যে পরবর্তীকালে এক সম্মানজনক বংশের মর্যাদা আমরা লাভ করেছিলাম, তবুও সবাইকে এড়িয়ে চলার মত অসামাজিকতা এবং তদুপরি চাপা স্বভাবটা যেন আমাদের বংশের রক্তের মধ্যে ভীষনভাবে ঢুকে গেছিল – যতই তাতে ভার্জিনিয় মিশ্রন থাকুক না কেন।
যাইহোক, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ভাগ্যদেবতা আরও একবার আমাদের ওপর বিমুখ হলেন। কারফ্যাক্স পতনের সাথে সাথে আমাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিল। আমাদের বাড়িটা ছিল, জেমস নদীর ধারেই। উন্মত্ত জনতা যখন সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তখন সেখানে আমার দাদু উপস্থিত ছিলেন। সেই ভয়ানক অগ্নিকান্ডের তিনি বলি হন আর সেই সাথে তাঁর বাবার দেওয়া বিশেষ খামটি, যা ছিল এক আমাদের পরিবারের রহস্যময় অতীতের এক চরম গোপনীয় দলিল – সম্পূর্ন ভস্মীভূত হয়। আজ, এতদিন পরেও সেই দিনটির কথা আমার স্মরণে আছে। তখন আমার সাত বছর বয়স। পুলিশের চিৎকার, মহিলাদের বিলাপ, নিগ্রোদের বুকফাটা প্রার্থনা সব মিলিয়ে সে রাতটা আমার মন থেকে কোনোদিনই মুছে যাবার নয়। আমার বাবা তখন মিলিটারিতে, রিচমণ্ডের হয়ে লড়ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি আর মা, শেষপর্যন্ত বাবার সাথে যোগ দিতে পেরেছিলাম। যুদ্ধ শেষ হবার পর আমরা সপরিবারে উত্তরের দিকে যাত্রা করি। এভাবেই আমি বড় হলাম, মধ্যবয়সে পৌঁছলাম এবং শেষ পর্যন্ত এক কর্তব্যপরায়ন ইয়াংকিতে পরিণত হলাম। না আমার বাবা, না আমি – কেউ জানতে পারলাম না, সেই খামের মধ্যে কি লেখা ছিল। এরপর আমিও ম্যাসাচুসেটস এ এসে নিজের ব্যবসার ব্যাস্ততায় ডুবে গেলাম, আর রূঢ় বাস্তবের সাথে প্রতিদিন মুলাকাতের ফলে, সুদূর অতীতে কোন একসময়ে আমার পরিবারের এক প্রাচীন রহস্যের প্রতি আগ্রহ আমার মন থেকে ক্রমশ হারিয়ে গেল। যদি সেইসময় কোনোভাবেও আন্দাজ করতে পারতাম!! তাহলে এক্সাম প্রায়োরীকে এরকম ইঁদুর বাদুড়ের আস্তানাই থাকতে দিতাম – জীবনে কোনোদিনই এই অভিশপ্ত জায়গায় পা রাখতাম না।
১৯০৪ সালে আমার বাবা মারা গেলেন। না আমার জন্য না আমার মা–হারা ছেলে অ্যালফ্রেডের জন্য, আমাদের পরিবারের এই প্রাচীন রহস্যের উপর তিনি কোন সূত্রই রেখে গেলেন না। আমার ছেলেই কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের প্রায় বিস্মৃত পরিবারের আদি ইতিহাস ঘেঁটে বের করেছিল। আমি ওকে বানিয়ে বানিয়ে কিছু গল্প বলেছিলাম বটে ওর ছোটবেলায়, তবে সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল আমার কল্পনা। ১৯১৭ সালে আমার ছেলে এভিয়েশন অফিসার হয়ে লণ্ডনে যায়। আর সেখান থেকে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে খুব আশ্চর্যজনক কিছু খবর আমাকে লিখে পাঠিয়েছিল। পড়ে জানতে পারলাম, ডেলাপোর দের জীবন একসময় যেমন বর্নময় ঠিক ততখানিই অভিশপ্ত ছিল। আরও জানলাম, আমার ছেলের এক বন্ধু, ক্যাপ্টেন নরিস, আমাদের পুরাতন ভিটের নিকটবর্তী গ্রাম আনচেস্টারের বাসিন্দা, তার থেকেই এসব খবরের সন্ধান পেয়েছে আমার ছেলে। তাছাড়া সে নরিসের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও থেকেছে। সেখানে আমাদের আদি পরিবারের ব্যাপারে গ্রাম্য লোকমুখে যা কুসংস্কার এবং কিংবদন্তী যুগ যুগান্তুর ধরে ছড়িয়েছে, সেটা বড় বড় লেখকদের গল্প উপন্যাসকেও হার মানাবে। যদিও নরিস নিজেও এসব গালগল্পের খুব কমই বিশ্বাস করে, তবুও এই গল্পগুলি আমার ছেলে অ্যালফ্রেডের কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক লেগেছিল সন্দেহ নেই। বলতে দ্বিধা নেই, এই জনশ্রুতিগুলিই কিন্তু সুদূর অতলান্তিক পারের পারিবারিক ঐতিহ্যর প্রতি আমার আকর্ষন বাড়িয়ে তুলেছিল।
অ্যালফ্রেড বলেছিল যে নরিসের কাকা–ই এখন ওই সম্পত্তির মালিক এবং আমার ছেলের পরিচয় জেনে তিনি খুব কম দামে ঐ জমিবাড়ি আমাকে বিক্রি করে দিতে রাজি হলেন। অদম্য কৌতুহলে, আমিও নরিস ছেলেটির সাহায্যে আমাদের হৃতসম্পত্তি পুনুরুদ্ধারে সচেষ্ট হলাম।
১৯১৮ সালে এক্সাম প্রায়োরী আমি কিনে নিলাম। কিন্তু সংস্কারের কাজে নামা তখনই সম্ভব হলো না। যুদ্ধ থেকে আমার ছেলে পঙ্গু হয়ে ফিরে এলো আর আমার সমস্ত মনোযোগ ধাবিত হলো আমার ছেলের শুশ্রুষার উপর। পরবর্তী যে দুটি বছর অ্যালফ্রেড বেঁচেছিল, আমি ওর সেবা ছাড়া আর কিছু ভাবিনি, নিজের ব্যবসার কাজও আমার পার্টনারদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আলফ্রেড মারা যাবার বছরখানেক পর, ১৯২১ সাল নাগাদ, নিজেকে এতটাই রিক্ত এবং লক্ষ্যহীন মনে হতে লাগল, যে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে নতুন কেনা সম্পত্তির সাথে কাটানোই মনস্থ করলাম। মনে হলো, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হয়ত এই চরম একাকীত্ব আর দুঃখ ভুলে থাকা যাবে। অ্যানচেস্টারে এসে উপস্থিত হলাম ডিসেম্বর নাগাদ। ক্যাপ্টেন নরিস আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। গোলগাল হাসিখুশি একটি ছেলে, সারাদিন অ্যালফ্রেডের কথাই বলতে থাকতেন। দেখলাম বহুদিন ধরেই দুই বন্ধু মিলে অনেক তথ্য, নানা আশ্চর্য জনশ্রুতির সম্ভার আর প্ল্যান জোগাড় করে রেখেছে এই জায়গাটির ব্যাপারে – যেগুলো আমাকে এই অট্টালিকার সংস্কারসাধনে প্রচুর সহায়তা করবে। এক্সাম প্রায়োরীকে আমি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখলাম – ভাঙাচোরা, মধ্যযুগীয় ধ্বংস্তুপের গাদা জঞ্জালের মধ্যে অশ্বত্থ, ফার্ন গজিয়েছে। জায়গায় জায়গায় মৌচাক আর ঘুঘুর বাসা বিপজ্জনকভাবে এক এদিক সেদিক থেকে ঝুলে আছে। ঘরের মেঝে এবং আসবাবের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে স্থানে স্থানে পাথর উঠে গিয়ে।
কয়েকদিন ভালো করে সরেজমিনেপরীক্ষা করার পর, আমার কাছে জায়গাটা প্রায় তিন শতাব্দী আগে কিরকম দেখতে ছিল সে ব্যাপারে একটা ছবি মোটামুটি স্পষ্ট হল যে। সেইভাবে হিসেব কষে আমি সংস্কারে নামলাম। মিস্ত্রী, শ্রমিক জোগাড় করা শুরু করলাম। প্রত্যেকটি জিনিসের ব্যপারে আমাকে লোকালয়ের বাইরে যেতে হচ্ছিল, কারণ অ্যানচেস্টারের লোকজনদের মধ্যে দেখলাম জায়গাটার প্রতি এক অপরিসীম ভীতি এবং অবিশ্বাস্য ঘৃণা এখনও বর্তমান। এই আবেগটা এত তীব্র ছিল, যে মাঝে মাঝে বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয়ে পড়ত আর যতরাজ্যের গন্ডগোল সৃষ্টি হয়ে কাজে বাধা পড়ে যেত। যত কুসংষ্কার আর গুজব শুনতাম সবই কিন্তু এই বাড়িটা এবং তাতে একদা বসবাসকারী আমার পূর্বপুরুষদের ঘিরেই।
আমার ছেলে একসময় আমাকে বলেছিল, যে সে যখনই এখানে আসত, ডেলাপোর পরিচয় জেনে সবাই তাকে নাকি কেমন এড়িয়ে চলত। এহ বাহ্য – আমাকে তো এখানে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিল লোকজন। আমি অতিকষ্টে ব্যাটাদের বুঝিয়েছিলাম যে আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি বাইরে থাকতাম, নেহাত পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মত পূর্বপুরুষদের জমি জায়গা হাতে এসেছে, তাই সংস্কার করে নিচ্ছি। দিনকাল যা পড়ছে – বলা তো যায়না, ইত্যাদি। এসব বোঝানোর পরও ওরা খুব যে আমাকে বিশ্বাস করেছে তা নয় –থেকে থেকেই সন্দেহের চোখে দেখে। তাই যা কিছু জোগাড়পাতি করতে হয়েছে সবই নরিসের মধ্যস্থতায়। পরে বুঝেছিলাম ওদের রাগের কারন অন্য। আমি এমন এক স্থান সংস্কার করতে এসেছি, যেটার থেকে বেশী অভিশপ্ত এবং বিভীষিকাময় স্থান ওদের কাছে ও তল্লাটে কিছু নেই। পিশাচ এবং রক্তপায়ী শ্বাপদের বিচরনভূমি হিসাবেই ওরা জায়গাটাকে দেখে এসেছে এতদিন – দূরে থেকেছে অপরিমিত ঘৃণা এবং আতঙ্কে।
বাড়িটা সম্বন্ধে যেসব গ্রাম্য গল্প বা কিংবদন্তি গুলো নরিস জোগাড় করে রেখেছিল, সেগুলোকে নিয়ে বসলাম। গল্পগুলোকে জুড়ে জুড়ে আর সেইসাথে এই ধ্বংস্তুপের ওপর নানা পণ্ডিতের লেখায় চোখ বুলিয়ে একটা থিয়োরী খাড়া করলাম। আমার যুক্তি অনুযায়ী, এখন যেখানে এক্সাম প্রায়োরী অবস্থান করছে, আগে সেইখানে একটা প্রাগৈতিহাসিক মন্দির ছিল। মন্দিরের বয়স বোধকরি স্টোনহেঞ্জের সমসাময়িক হবে। শোনা যায় বেশ কিছু কুহেলিকাময় সুপ্রাচীন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ওখানে হতো, যা নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর রটনাও আছে। কথিত আছে, সেই সব আচার অনুষ্ঠান নাকি শেষ অবধি মহাদেবী সিবেলের আরাধনার রূপ নেয়। অট্টালিকার নীচের ঘরের চোরাকুটরিগুলিতে এখনও খোদাই করা আছে সেই সব পূজার মন্ত্র – “DIV…..OPS…..MAGNA.MAT….” মহাভৈরবী রূপিনী মহাদেবীর স্তুতি। রোমান আক্রমনের পর, এই সব ভয়ঙ্করী দেবী আরাধনা জোর করে বন্ধ করা হয়। কিন্তু গোপনে গোপনে এই ভয়ানক আদ্যাশক্তির তন্ত্রসাধনা চলতেই থাকে। যতদূর জানা যায়, জুলিয়াস সীজারের আমলে অগস্টাস সেনাবাহিনীর তৃতীয় শাখাটি এই অ্যানচেস্টারেই শিবির স্থাপনা করেছিল। আরও কথিত আছে যে দেবী সিবেলের অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরের পুরোহিতরা নাকি কোনো অজানা, গোপন তন্ত্রানুষ্ঠান করতেন এক ফ্রিজিয়ান প্রধান পুরোহিতের নেতৃত্বে। পরবর্তীকালে মূল ধর্মের মধ্যে নানা পরিবর্তন এলেও, ঐ বিশেষ মন্দিরের আচার অনুষ্ঠান সেই প্রাচীন গোপনীয় এবং মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ীই হত। রোমানদের পতনের পরে, এই মন্দিরও নাকি কোনোভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে পরে স্যাক্সনদের প্রচেষ্টায় এর পুনঃসংস্কার ঘটে – আর এই স্থানটি হয়ে ওঠে সপ্তসাম্রাজ্যের সবচাইতে ভয়াল অঞ্চল। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের এক প্রাচীন পত্রিকায় দেখতে পেলাম, এই জায়গাটি নাকি পিশাচসিদ্ধ তন্ত্রসাধকদের এক আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল – আর এর চারপাশে ছিল ঘন গাছপালায় ঘেরা এক বাগান। পাথরে ঘেরা এই স্থানটিকে বেড়া দিয়ে কোনো পাঁচিল না থাকলেও, এই অঞ্চলের শতহস্তের মধ্যে কেউ পা দিত না – এমনই কোনো এক অজানা আতঙ্কে মোড়া স্থান ছিল এটি। ড্যানিশদের আমলেও কেউ এই স্থানটির কোনো ক্ষতিসাধন করেনি, কিন্তু নরম্যানদের আগমনে স্থানটির মাহাত্ম্যের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। রাজা তৃতীয় হেনরি শেষ অবধি জায়গাটি আমাদের ঊর্ধ্বতন আদিপুরুষ গিলবার্ট ডে লা পোরের হাতে তুলে দেন, ঘটনা চক্রে তিনিই ছিলেন এক্সাম অঞ্চলের প্রথম ব্যারন – আর সালটা ছিল ১২৬১।
এর পূর্বে আমাদের পরিবারের ওপর কোনো অশুভ অপচ্ছায়ার প্রাদুর্ভাব ছিল না, কিন্তু এখানে আসবার পর থেকেই অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল। ১৩০৭ সালের আর একটা লেখায় দেখতে পেলাম, জনৈক ডে–লা–পোর কে “ঈশ্বরের অভিশাপ” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রাম্য প্রবাদ এবং জনশ্রুতিতে সেই পুরানো মন্দিরের ভগ্নস্তুপের ওপর গড়ে ওঠা এই অট্টালিকাকে চূড়ান্ত অশুভ এবং শয়তানের স্থান আখ্যা দেওয়া হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত গল্পগুলি তো আরও ভয়ানক – প্রতিটি জনশ্রুতি মোটমাট ভয়ঙ্কর সব বর্ননায় পরিপূর্ন। ভয়ের নানা রূপের প্রকাশ সেসব গল্পে প্রকট ভাবে বিদ্যমান কিন্তু এই বিপুল আতঙ্কের কারন হিসাবে কোথাও সেরকম কিছু লেখা নেই। ঠিক কি কারনে এতগুলো মানুষ এত বছর ধরে ভয়ে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে এই স্থানকে পরিত্যাগ করে চরম ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তা নিশ্চিতভাবে কোথাও খুঁজে পেলাম না। উল্টে আমাদের পূর্বপুরুষদের, বলা ভালো আমার আদি পরিবারকে এমন পৈশাচিক আতঙ্ক এবং ঘৃনার পাত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, যার বর্ননার কাছে বড় বড় অত্যাচারী শাসকের নিষ্ঠুরতার বিবরণও নেহাতই ছেলেভুলানো বলে মনে হতে পারে। গ্রামের কিছু মানুষের হঠাৎ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিবারকেই দায়ী করা হয়েছে সর্বতভাবে।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত, ব্যারন আর তাদের ছেলেপুলেরাও কিছু কম রহস্যময় ছিলেন না। কানাঘুষো শোনা যায়, যে এই ব্যারন নির্বাচনেও নাকি এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটত। উত্তরাধিকাররা যদি ঠিক ঠাক না হতো – তাহলে তারা এক অজ্ঞাত কারনে অপঘাতে মৃত্যুবরন করত – যাতে পরের বিশেষ গুনাবলী সম্পন্ন সন্তান “ব্যারন” এর সেই জায়গাটি নিতে পারে। এটা কিরকম যেন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠেছিল – যা পরিচালিত হত পরিবারের ততকালীন যিনি মাথা থাকতেন, তাঁর অধীনে। এখানে বংশপরম্পরাগত ভাবে উত্তরপুরুষ নির্বাচনের থেকে লোকটির মেজাজ এবং তার প্রকৃতি বেশী প্রাধান্য পেত। যে সমস্ত পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত, তারাও এই অদ্ভুত প্রথার অঙ্গ হয়ে যেত। কর্নওয়েলের লেডি মার্গারেট ট্রেভর, যিনি কিনা পঞ্চম ব্যারনের দ্বিতীয় সন্তানের স্ত্রী ছিলেন, তিনি তো বহুদিন এই অঞ্চলে শিশুদের ত্রাস বলে পরিচিত ছিলেন। ওয়েলস সীমানার কাছে এখনও তাঁর নামে এক লোকগাথা আছে – কি ভয়ানক তার কথাগুলি, পড়লেই বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশিরানি জাগে। এরকম আরও এক চরিত্র ছিলেন, লেডি ম্যারি ডেলা পোর। তিনিও নাকি সমান কুখ্যাত ছিলেন – কিন্ত আর্ল অফ শ্রেউসফিল্ডের সাথে বিবাহের কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি খুন হন। খুনের দায়ে তাঁর স্বামী এবং শ্বাশুড়ী নাকি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু চার্চে গিয়ে প্রধান পাদ্রীর কাছে তাঁরা নাকি নিজেদের দোষ স্বীকার ও পুরো ঘটনা খুলে বলেছিলেন। এই ঘটনার অনতিবিলম্বেই তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং পুরো বিষয়টা এমনভাবে চেপে যাওয়া হয় যাতে কাকপক্ষীও না জানতে পারে।
এই লোককথা এবং জনশ্রুতিগুলো, বলাই বাহুল্য, আমাকে বিলক্ষন বিচলিত করেছিল। নানা বই, খবরের কাগজ, পুঁথির পাতায় পাতায় এইসব ভয়ানক ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বারংবার আমার বিভিন্ন পূর্বপুরুষের নাম জড়িয়ে আতঙ্কের এক আবওহাওয়া সৃষ্টি হওয়া –আমার খুবই বিরক্তিকর লেগেছিল। এইসব আধিভৌতিক ঘটনা পরম্পরার চলচ্ছবি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গেল আমার খুড়তুতো দাদা, র্যাডলফ ডেলাপোরের কথা। আমরা যখন কারফ্যাক্সে থাকতাম, তখন র্যাডলফ নিগ্রোদের সাথে ভীষনভাবে মেলামেশা শুরু করেছিল। শুনেছিলাম পরবর্তীকালে, মেক্সিকান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর সে নাকি কালাজাদু চর্চা করে এক ভুডু বিশারদ হয়ে উঠেছিল।
যাইহোক, এক্সাম প্রায়োরীর লাগোয়া যে চুনাপাথরের উঁচু বাঁধটা আছে, তার অপর পার থেকে শুরু হয়েছে এক বিস্তীর্ন উপত্যকা – সেকথা আমি আগেও বলেছি। এই উপত্যকাকে নিয়ে এক অদ্ভুত গল্প পড়লাম। উপত্যকার কাছেই যে কবরস্থান আছে, বসন্তের ঝিরঝিরে বৃষ্টির এক রাতে স্যার জন ক্লেভের ঘোড়া অদ্ভুত সাদা কিছু একটাকে মাড়িয়ে ফেলে – আর সেই জিনিসটার তীক্ষ্ণ চিৎকারে সচকিত হয়ে, ক্লেভের চাকর প্রায়োরীর দিকে মুখ তুলে চেয়েছিল। চাঁদনি রাতের মায়াবী জ্যোৎস্নাতে সে প্রায়োরীতে এমন কিছু দেখেছিল যাতে সে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যায়। তবে এসব গাঁজাখুরি গপ্প হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। এটাকে আমার চোখের ভুল ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। রাতের বেলায় কবরস্থানে দাঁড়িয়ে এসব ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আমি সেই সময়ে ভীষণ সন্দেহবাদী ছিলাম। গ্রামের চাষিদের মাঝে মাঝে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়াটা যদিও সন্দেহজনক, তবুও মধ্যযুগীয় সামাজিক পরিবেশে এসব খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। এখন বিলুপ্ত হলেও, আগে নাকি এক্সাম প্রায়োরীর এদিক ওদিকে মানুষের কাটা মুন্ড ঝুলিয়ে রাখা হত – শুধু বোঝানোর জন্য যে অতিরিক্ত কৌতুহলের অর্থ মৃত্যু।
এই গল্পগুচ্ছের মধ্যে এমন বেশ কিছু গল্প ছিল যেগুলো কাহিনী হিসাবে বেশ ভালো। তুলনামুলক পৌরানিক কাহিনী নিয়ে কেন আগে একটু পড়াশোনা করিনি ভেবে রীতিমত আফশোষ হতে লাগল। এরকমই কিছু গল্প যেমন, এই প্রায়োরীতে নাকি রাতের বেলা পিশাচ এবং ডাইনীদের রীতিমত জমায়েত হত এবং বাদুড়রূপী শয়তানের এক বিরাট বাহিনী সেই জমায়েত পাহারা দেওয়ার জন্য নাকি চারপাশ ঘিরে থাকত। প্রায়োরীকে ঘিরে থাকা বিরাট বাগানটিতে যেসব অদ্ভুত ধরনের খড়খড়ে খোসার ফল চাষ হত, সেইসব নাকি ওই শয়তান বাহিনীর ক্ষুন্নিবৃত্তিতে কাজে লাগত। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ইঁদুর নিয়ে এক নাটকীয় কাহিনী। পূর্বে বর্ণিত সেই কালান্তক ঘটনায় প্রায়োরী পরিত্যক্ত হবার প্রায় মাস তিনেক পর এক রাতে নাকি কিলবিলে জঘন্য এই প্রানীগুলোর এক বিরাট বাহিনী প্রায়োরী থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এদিক সেদিক। এই নোংরা, হিংস্র এবং বুভুক্ষু শয়তানের দল নাকি পথে যা পেয়েছিল, সব কিছু গোগ্রাসে আত্মসাৎ করতে করতে এগোতে থাকে। মুরগি, শুয়োর, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল এমনকি দুটি হতভাগ্য মানুষও এই রাক্ষুসে বাহিনীর পৈশাচিক খিদের শিকার হয় সেই অভিশপ্ত রাতে। এই ইঁদুরবাহিনীর নারকীয় কার্যকলাপের উপর স্বতন্ত্রভাবে রচিত বা কথিত প্রচুর ভয়ানক গল্প কথা ছড়িয়ে আছে এই গ্রামের ঘরে ঘরে।
এতসব গল্পকথা, গ্রাম্য প্রবাদ, ভয়ানক ইতিহাসের সারি আমাকে কদিন বেশ ভালোভাবেই ঘিরে রেখেছিল। তবে এসবের মধ্যে দিয়েই দীর্ন শতাব্দীপ্রাচীন আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটের এই ধ্বংসাবশেষের সংস্কারের কাজ প্রায় সমাপ্ত করে এনেছিলাম। তবে এটা ভাববেন না যে এত ধরণের পৌরানিক কাহিনীগুলি আমার মনের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে বসেছিল। বরং তার উলটো – ক্যাপ্টেন নরিস এবং তার সাঙ্গপাঙ্গো পুরাতত্ত্ববিদরা আমাকে প্রতিমুহুর্তে উৎসাহ যুগিয়েছিল এই প্রাচীন ইতিহাস পুনুরুদ্ধারের কাজে। দু বছরের ক্রমাগত পরিশ্রমের পর যখন কাজটা শেষ হল, তখন আমি প্রানভরে পুরো বাড়িটা দেখলাম। খাঁজকাটা কাঠের দেওয়াল, ধনুকের মত বাঁকা সিলিং, পাথরের গোবরাট বসানো জানলা, চওড়া সিঁড়ি – সবমিলিয়ে এক প্রাচীন আভিজাত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নিজের পরিশ্রম এবং খরচকে সার্থক বলে মনে হল। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের প্রতিটা অংশে নিঁখুতভাবে প্রান প্রতিষ্ঠা করে ফেলা গেছে। যে জায়গাগুলো নতুনভাবে বানাতে হয়েছে, সেগুলোর স্থাপত্যও বেশ চমৎকারভাবে পুরাতনের সাথে খাপ খেয়ে গেছে। এখন আমার কাজ হলো, পরিবারের হৃতগৌরব পুনুরুদ্ধার করা, কারণ আমার পরিবারে শেষ পুরুষ বলতে কেবল আমিই অবশিষ্ট রয়েছি। এখানে বাস করে আমার বাপ–দাদাদের নামে যেসব অভিশাপ আর ঘৃণা ছড়িয়ে আছে – সেগুলি ভুল প্রমানিত করা এবং ডে–লা–পোর যে শয়তানের আর এক নাম নয়, তা প্রতিষ্ঠা করাই আমার মূল কর্তব্য বলে ঠিক করলাম। আমার নিশ্চিন্ত হবার আরও বড় কারণ ছিল এই যে, যদিও বাইরের চাকচিক্যে এক্সাম প্রায়োরী সেই পুরানো সময়কেই ধরে রেখেছে, তবুও তার ভিতরের অনেক কিছুরই খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছে, আধুনিক করে ফেলা হয়েছে এই প্রাচীন অট্টালিকার বেশ কিছু অংশ। তাই ভূত টুত কিছু থাকলেও তারা এতদিনে পাততাড়ি গুটিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
হ্যাঁ – যা দিয়ে শুরু করেছিলাম – ১৬ই জুলাই ১৯২৩ সালে আমি প্রায়োরীতে পাকাপাকি ভাবে উঠে এলাম। আমার এখন পরিবার বলতে, সাতটা চাকর আর ন’টা বেড়াল, যার মধ্যে শেষোক্তদের প্রতি আমার ভালোবাসা একটু বেশি। সবচেয়ে বয়স্ক বেড়ালটা, আমার আদরের কালো–মানিক, আমার সাথে সাত বছর ধরে আছে। আর, ক্যাপ্টেন নরিসের সাথে এখানে এতদিন থাকার সুবাদে বাকি বেড়ালগুলোকে আমি জোগাড় করেছিলাম।
দিন পাঁচেক একরকম শান্তিতেই কেটে গেল। নিজের পরিবারের ব্যাপারে তথ্যাদি নথিভুক্ত করতেই আমার দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হত। যে রাতের ভয়ানক ঘটনায় আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মৃত্যুবরন করেছিল, সেই বিশেষ রাতের ব্যাপারে বিশদে জানার জন্য আমার কৌতুহল ছিল অদম্য। সে ব্যাপারে আমি প্রচুর তথ্যাদি নাড়া ঘাঁটা করেছিলাম। শেষে মনে হল, যেন কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাপার আমি ধরতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, এই ঘটনার কথাই লিখে সেই চিঠি মুখবন্দী খামে পুরে আমার দাদুকে রাখতে দিয়ে গেছিলেন আমার প্রপিতামহ, যা কারফ্যাক্সে থাকার সময় ভস্মীভূত হয়ে যায়।
যা জানলাম– তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমার প্রপিতামহ নাকি নিজের হাতে, চারজন চাকরের সাহায্যে, পরিবারের বাকি সদস্যদের ঘুমের মধ্যেই হত্যা করেন। এই ঘটনার হপ্তাচারেক আগে, তিনি নাকি এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেন, যাতে তাঁর স্বাভাবিক চাল–চলনে আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর এই পরিবর্তন নাকি শুধু ওই চারজন চাকরের কাছেই তিনি নিজে প্রকাশ করেছিলেন – বাকিদের সামনে তিনি স্বাভাবিক আচরনই করে বেড়াতেন। হতে পারে, এই কারনেই চাকরগুলো রক্ষা পায়, এবং সেই ঘটনার পরদিন থেকে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি – যেন তারা হাওয়াও মিলিয়ে গেছিল। এই সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ডের বলি হয়েছিল এক বাবা, তিন ভাই এবং দুই বোন – যাদের গ্রামবাসীরা খুব একটা সুবিধের চোখে কোনোদিনই দেখত না। এবং হতে পারে সে কারনেই, আইনের ফাঁস আমার প্রপিতামহের ওপর সেভাবে চেপে বসতে পারেনি, বা ইচ্ছে করেই হয়ত বসেনি। বিচার এমনভাবেই হয়েছিল, যাতে এই “হত্যাকারী” নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে এবং দিনের আলোয় এই অভিশপ্ত ভিলা ছেড়ে ভার্জিনিয়ায় পালিয়ে যেতে পারে। কানাঘুষো এমন পর্যায়ে চলেছিল, যে তিনি নাকি এই জায়গাটিকে সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসা এক নারকীয় অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছিলেন। আমার প্রপিতামহ এমন কি আবিষ্কার করেছিলেন যা তাঁকে ঠান্ডা মাথায় এই ভয়ানক হত্যাকান্ড করতে প্রলুব্ধ করল, সেটা আমি কিছুতেই ভেবে পেলুম না। ওয়াল্টার ডেলাপোর তো এই পরিবারেরই মানুষ ছিলেন, এবং নিজের পরিবারের ব্যাপারে কানাঘুষো, জনশ্রুতি, লোককথা সবই ওঁর অবগত ছিল। তাই সেসব গল্পকথা, বা ভয়ানক ঘটনার বিবরন তাঁর উপর হঠাৎ এতটা প্রভাব নিশ্চই ফেলেনি, যার প্ররোচনায় তিনি নিজের পরিবারকে হত্যার মত এরকম বীভৎস পদক্ষেপ নেবেন! তাহলে তিনি কি কিছু দেখে ফেলেছিলেন – কিছু প্রাচীন রীতিনীতি? যা ভয়ানক গোপন কিন্তু সাংঘাতিক? নাকি কিছু গোপন সঙ্কেত রহস্য উদ্ধার করেছিলেন, যার থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ভয়ঙ্কর পৈশাচিক সত্য? ওয়াল্টার কিন্তু তাঁর নরম স্বভাব এবং মৃদুভাষ্যের জন্য পরিচিত ছিলেন সারাজীবন। ভার্জিনিয়াতে যখন ছিলেন, তখনও চুপচাপ এবং শান্তিপ্রিয়ই ছিলেন। কিন্তু এমন কি ঘটে থাকতে পারে তাঁর সঙ্গে যে এই শান্তস্বভাবের মানুষ হঠাৎ রক্তপিপাসু জল্লাদ হয়ে উঠে এহেন নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত করতে পারলেন?
২২শে জুলাই থেকে আমার চারপাশেও এমন কিছু ঘটতে আরম্ভ করল, যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। প্রথমে অত পাত্তা না দিলেও, এই ছোটখাট ব্যাপারগুলিই পরে এমন কিছু ঘটনার সুত্রপাত ঘটাল, যেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে আমি অপারগ।
ঘটনাটা খুবই অকিঞ্চিৎকর – এতটাই যে নজরেই পড়ে না। এত বড় বাড়িতে একপাল চাকর বাকর সমেত আছি, বড় বড় পাথরের নতুন রঙ করা দেওয়াল, নতুন কাঠের আসবাব, এক আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে বাস করছি। চাকর বাকররা সারাক্ষণ আমার খিদমত খাটার জন্য মুখিয়ে রয়েছে –এই পরিবেশে ভয়ডর বিশেষ লাগে না। তবুও, পরে মনে হয়েছিল, আমার বুড়ো বেড়ালটা যেন বিনা কারনে খুব উত্তেজিত এবং সতর্ক। কালো–মানিকের মুড আমি খুব বুঝি, কিন্তু এ পরিবর্তনটার কোনো বিশেষ কারণ খুঁজে পেলাম না। সে সারা ঘর বাড়ি ছটফট করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগল আর বিশেষ করে পাথরের দেওয়ালগুলো, যেগুলো বাড়িটার স্থাপত্যে একটা গথিক চেহারা দিয়েছে – সেগুলোকে শুঁকতে লাগল। বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা কিরকম একটা ক্লিশে হরর মুভির মতো শোনাচ্ছে। ওইসব সিনেমাতে সাধারনত একটা কুকুর থাকে, যে মনিবের সামনে থাকা অদৃশ্য কিছু দেখে চিৎকার করে ওঠে। আমার মার্জার–পর্বও অনেকটা সেরকমই লাগতে পারে, কিন্তু কি করব – ব্যাপারটা না বলেও থাকতে পারছি না।
পরেরদিন এক চাকর এসে অভিযোগ জানালো যে, সবকটা বেড়ালই নাকি এরকম উত্তেজিত আচরন করা শুরু করে দিয়েছে। আমার স্টাডিরুমটা বাড়ির দোতলায়। বাঁকানো খিলানের ছাদ, কালো ওককাঠের কড়িবরগা, বড়ো বড়ো পুরোনো আমলের গথিক জানলা – যা দিয়ে বাইরে তাকালে চুনাপাথেরর টিলা আর পরিত্যক্ত উপত্যকাটিকে স্পষ্ট দেখা যায় – সব মিলিয়ে ঘরটির মধ্যে এক প্রাচীন আভিজাত্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। এই ঘরে ঢুকে চাকরটি যতক্ষন আমাকে মার্জার কুলের গতরাতের ছটফটানির কাহিনীর বিবরন দিচ্ছিল, আমি খেয়াল করলাম – কালোমানিক কাঠের কালো প্যানেলগুলোর কাছে গুটিসুটি মেরে বসে কি শুঁকছে আর মাঝে মাঝে কাঠের প্যানেলগুলোকে আঁচড়ে চলেছে। অট্টালিকার প্রাচীন পাথরের দেওয়ালের ওপর আস্তরন হিসাবে জায়গায় জায়গায় কাঠের প্যানেলিং ব্যাবহার করা হয়েছে – কিন্তু কালোমানিকের তার ওপর এত আক্রোশ কেন? আমি চাকরটাকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে পুরোনো পাথরের স্তরে কিছু অদ্ভুত গন্ধ থাকে, কাঠের স্তর ভেদ করে যা হয়ত আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় কিন্তু কোনো কারনে তা মার্জারকুলের সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে। আমার এই ব্যাখ্যা মনে হলো আমার ভৃত্যের ঠিক মনঃপুত হল না। সে চটপট বলে উঠল, “আচ্ছা কত্তা – ইঁদুর বা ছুঁচোও তো থাকতে পারে?” আমি হেসে ওকে জানালাম যে গত তিনশ বছরে এই অট্টালিকাতে কোনো ইঁদুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বাইরে মেঠো ইঁদুর হয়ত থাকতে পারে, কিন্তু কোনো পথভ্রষ্ট মেঠো ইঁদুরও এখানে কোনোদিন ঢুকেছে বলে জানা যায়নি। যাইহোক, সেদিন দুপুরে আমি ক্যাপ্টেন নরিসকে ডাকলাম। তিনি সোজা বলে দিলেন, যে মেঠো ইঁদুরের পক্ষে এত কম সময়ের মধ্যে সুবিশাল অট্টালিকাতে ঢুকে এর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব।
সেদিন রাত্রে, খাওয়া দাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে বিশ্রামের আয়োজন করছিলাম। অট্টালিকার পশ্চিম মিনারের একটা ঘরে আমি থাকতাম। আমার স্টাডি থেকে শোয়ার ঘরে পৌঁছানোর জন্য একটা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট গ্যালারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সিঁড়িটা যদিও একইরকম আছে, তবে গ্যালারিটা পুরোপুরি সংস্কার করা হয়েছিল। আমার শোয়ার ঘরটি আকৃতিতে গোলাকার, এবং দেওয়ালে বেশ কারুকার্যময় পর্দা ঝোলানো। ঘরটা সাজাব বলে, আমি নিজে পর্দাগুলো লন্ডন থেকে বেছে বেছে কিনে এনেছিলাম। এই ঘরের দেওয়ালগুলোতে সেইজন্য কাঠের প্যানেলিং রাখা হয়নি। যাইহোক, কালোমানিককে সাথে নিয়ে আমি ঘরের বিরাট দরজাটায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম আর দেওয়ালে মোমবাতিদানের মত লাগানো ইলেকট্রিক আলো বন্ধ করে সুবিশাল পালঙ্কের নরম গদিতে ডুবে গেলাম। বাধ্য ভৃত্যের মত, কালোমানিক আমার পায়ের কাছটিতেই শুয়ে থাকল। তবে জানলার দিকের পর্দাটা পুরোপুরি টানলাম না। পর্দার ফাঁক দিয়ে রাতের কালো আকাশের এক অদ্ভুত ফ্যাকাশে আলো এসে আমাকে যেন আরও তন্দ্রাবিষ্ট করে তুলল। জানলার উপরে চকমকি পাথরের কালো সিল্যুয়েট, সেই মায়াবী আলোয় একতাল জমাট অন্ধকারের মত থম মেরে রইল।
বেশ ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্নের ঘোরেই বুঝতে পারলাম, বেড়ালটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছে। চোখে খুলে সেই আধো অন্ধকারে দেখতে পেলাম, কালোমানিক তার সামনের দুটি পা আমার গোড়ালির ওপর রেখে আর পেছনের পা দুটো টানটান করে ঘরের পশ্চিমদিকের দেওয়ালের দিকে সোজা ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। সেদিকে চেয়ে যদিও আমার চোখ কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু তবুও সেদিকেই স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানিনা মনে হলো, কালোমানিকের উত্তেজনা অমূলক নয়। পর্দাটা কি একটু নড়ল? হতে পারে – খুব সামান্য নড়ে উঠল। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, পর্দার পিছনে কিছু একদল প্রাণীর চলে ফিরে বেড়ানোর আওয়াজ অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। ইঁদুর না ছুঁচো? কালোমানিক ততক্ষনে খাট থেকে এক লাফে নেমে পড়েছে এবং সেই বিশেষদিকের ঝোলানো পর্দার ওপর আক্রমন শানিয়েছে। ওর শরীরের ভারে এবং দাঁতের টানে সাজানো পর্দা ছিঁড়ে নেমে এল মাটিতে আর উন্মুক্ত হয়ে গেল পর্দার পিছনের স্যাঁতস্যাঁতে প্রাচীন পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে এদিক ওদিক সংস্কারের ছাপ – পাথরের দেওয়ালে কোনো ফাঁকফোঁকরও নেই। তাই ইঁদুর বা ছুঁচো এসে ঘরে ঢুকে পড়বে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু কালোমানিকের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে চরম আক্রোশে কাঠের মেঝে আর পাথরের দেওয়ালের সংযোগস্থলে পা দিয়ে আচঁড়াতে থাকল, যেন ওখানে সে কিছুর সন্ধান পেয়েছে। বেশ কিছুক্ষন এরকম চলার পর, হতোদ্যম হয়ে সে ফিরে এসে আবার আমার পায়ের কাছে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। আমি একই রকম ভাবে শুয়ে শুয়ে সব দেখলাম – একচুলও নড়িনি। আমার বেড়ালটা ঘুমিয়ে পড়লেও সে রাত্রে আমার আর ঘুম এল না।
সকালে উঠে সবকটা চাকরকে জড়ো করে জেরা করতে লাগলাম – তারা গতরাত্রে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে কিনা। বাকি সবাই মাথা নেড়ে সরে পড়লেও, রাঁধুনি জানালো তার ঘরের বেড়ালটা কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছে কাল রাত্রে। বেড়ালটা ঘরের জানলায় কাঠের গোবরাটটার ওপর শুয়ে ছিল চুপচাপ। কিন্তু মধ্যরাতের কোনো এক সময়ে তার গরগর আওয়াজে রাঁধুনির ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখতে পায় বেড়ালটা খোলা দরজা দিয়ে তীরবেগে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে।
দুপুরের দিকে আবার নরিসকে ডেকে পাঠালাম। ঘটনাটা শুনে নরিস এবার বেশ কৌতুহলী হয়ে পড়ল। খুব আহামরি কিছু না হলেও ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিশেষত্ব যে আছে, সেটা নরিস স্বীকার করতে বাধ্য হল। কিন্তু ইঁদুরের উপস্থিতির ব্যাপারটা আমাদের দুজনকেই বেশ ভাবিয়ে তুলল। ঠিক করা হলো, ইঁদুর ধরার কল পাতা হবে বিশেষ কিছু জায়গায়। চাকরবাকর গুলোকে কল কেনার নির্দেশ দিয়ে দুপুরের দিকে একটু বেরোলাম।
সে রাতে বেশ ক্লান্ত থাকায় একটু তাড়াতাড়িই শুতে গেলাম। কিন্তু বিধি বাম। এমন মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখলাম যে আমার শরীর কেমন করতে লাগল। স্বপ্নে দেখলাম – আমি অনেক উঁচু থেকে নীচে এক আবছায়া গুহামুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। তবে গুহামুখটা বেশি গভীর না, আবর্জনায় ভরে উঠে তার গভীরতা খুব বড়জোর পায়ের গোড়ালি ডোবাতে পারে। সেই গুহামুখের সামনে দিয়ে এক অপদেবতার মত অবয়ব কিছু থলথলে ফাঙ্গাসের মত জিনিসকে চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রানিগুলো এতটাই বিশ্রী এবং ভয়ংকর যে দেখেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। এবার সেই অবয়ব হঠাৎ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নেড়ে কিছু একটা ইশারা করতেই, কোথা থেকে স্রোতের মত একপাল কালো কুচকুচে ইঁদুর বেরিয়ে এসে ওই সমস্ত জীবগুলো মায় মানুষটাকে অবধি খেয়ে শেষ করে ফেলল।
এরকম একটা আতংকের স্বপ্নদর্শনে ছেদ পড়ল কারন গতরাতের মত কালোমানিকের উত্তেজিত ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সে বেশ ভয় পেয়েছে। তার সামনের পা দুটি আমার গোড়ালির ফাঁকে ঢুকিয়ে সে কান খাড়া করে বসে আছে দেওয়ালের দিকে চেয়ে। তবে আজ আর কষ্ট করে শব্দের উৎসের খোঁজ করতে হল না। ঘরের প্রতিটি দেওয়াল যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক ঘিনঘিনে শব্দে। লোলুপ বিশালাকায় ইঁদুরের দলের গড়্গড়িয়ে চলার আওয়াজে পূর্ন হয়ে উঠেছে আমার ঘর। জানলা দিয়ে ঘরে আজ একফোঁটা আলোও ঢোকেনি যে কালকের ছিঁড়ে যাওয়া পর্দাটার দিকে তাকাতে পারব। আমি লাফিয়ে উঠে ঘরের ইলেক্ট্রিক আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম।
ঘর আলোকিত হওয়ার সাথে সাথে দেখতে পেলাম – নতুন পর্দাটা বিপজ্জনকভাবে নড়ে চলেছে একটা নির্দিষ্ট দিকে। যেন ঢেউ খেলছে তার ওপর – ভয়ংকর মৃত্যুমাখা সেই তরঙ্গ। কিন্তু পরমুহুর্তেই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল – সঙ্গে সেই ঘিনিঘিনে শব্দটাও থেমে গেল নিমেষে। খাট থেকে নেমে আমি ফায়ারপ্লেসের শিকটা তুলে নিয়ে পর্দার ওই অংশটাতে একটু খোঁচালাম –তারপর পর্দাটাকে একটু সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম ওর পেছনে আছেটা কি? পাথরের নিরেট দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। বেড়ালটাও এখন অনেক স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছিল। মনে হয় অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতির ভীতিটা সে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এতক্ষণে। এবার আমি ইঁদুর ধরার কলগুলো ভালো করে পরীক্ষা করলাম যেগুলো আমার ঘরে রাখা ছিল। প্রত্যেকটি কলের মুখ বন্ধ – তার মানে কিছু তো এদের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তা অক্ষতভাবে কলের মারন ফাঁস উপেক্ষা করে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
আর ঘুমানোর প্রশ্ন আসে না। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি গ্যালারি অতিক্রম করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমার স্টাডিতে বসা স্থির করলাম। কালোমানিকও আমার পায়ে পায়ে চলল। সিঁড়ির কাছে পৌঁছানোর মুখেই সে আমাকে অতিক্রম করে একছুটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। কয়েক ধাপ নামার পরেই বুঝলাম নীচের বড়ঘরে একটা কিছুর আওয়াজ হচ্ছে – এমন একটা শব্দ যা চিনতে ভুল হওয়ার নয়। দেওয়ালে লাগানো ওক কাঠের প্যানেলগুলো যেন চলমান হয়ে উঠেছে মুষিকদলের দ্রুত এবং খড়খড়ে চলাফেরার আওয়াজে। কালোমানিক ফোঁসফোঁস করতে করতে এক দিশাহীন শিকারীর মত সারাঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরে ঢুকেই আমি আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম – কিন্তু আশ্চর্য, এবারে আলো জ্বলে ওঠার সাথে সাথে শব্দ কিন্তু আগেরবারের মত থেমে গেল না। মূষিকদের প্রচন্ড গতিতে চলাফেরা চলতেই থাকল। তবে অদৃশ্য এই ধাবমান মূষিকদল যে একটি নির্দিষ্ট দিকেই চলেছে, তার আন্দাজ পাওয়া গেল। বুঝলাম, এই সংখ্যায় অগণিত মুষিকশ্রেনী, কোনো এক সুউচ্চ স্থান থেকে নীচের কোন এক অকল্পনীয় গভীরতায় প্রচন্ড গতিতে কোনো এক অজানার আকর্ষণে অবিশ্রান্ত গতিতে ছুটে চলেছে।
এই সময় হলঘরে পদশব্দ শোনা গেল আর পরমুহুর্তেই দেখলাম দুজন ভৃত্য স্টাডির দরজা ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওরা বলল, সারা বাড়িতে এমন কিছু একটা ঘটছে যার ফলে বাড়ির সমস্ত বেড়ালগুলো উন্মত্তের মত ছোটাছুটি শুরু দিয়েছে এবং প্রত্যেকটি বেড়াল সিঁড়ির পর সিঁড়ি অতিক্রম করে বাড়ির একদম নীচে অবস্থিত চোরা কুঠুরির দরজার সামনে গিয়ে বসে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম – ইঁদুরের খড়খড়ানি তারা শুনেছে কিনা। কিন্তু তারা মাথা নেড়ে না বলল। আমি যখন ঘরের দেওয়ালের ভিতর চলতে থাকা ধাবমান মূষিকদলের শব্দ তাদের শোনাতে গেলাম, বুঝতে পারলাম সেই আওয়াজ অনেকক্ষণ আগেই থেমে গিয়েছে। অগত্যা দুই ভৃত্যকে সাথে নিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেই চোরা কুঠুরি অভিমুখে রওনা দিলাম। যতক্ষন সেখানে পৌঁছলাম, মার্জারকুল ততক্ষণে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। পরে অবশ্য এই কুঠুরির তত্ত্বতল্লাশ আমি করেছিলাম, কিন্তু এখন আপাতত এর আশেপাশে ঘুরেই আমি ক্ষান্ত দিলাম। এই ঘরের চারপাশেও বেশ কিছু ইঁদুর ধরার কল পাতা ছিল দেখতে পেলাম, আর সেগুলোও যথারীতি বন্ধ। কলে আটকা পড়া কোনো জীবের চিহ্নমাত্র নেই। তবে ইঁদুরদের উপস্থিতিটা যে কেউ আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনি, সেটা জেনে একটু নিশ্চিন্ত লাগছিল। নিজের স্টাডিতে ফিরে আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। এই বাড়ি এবং এই পূর্বতন বাসিন্দাদের ব্যাপারে যা কিছু পড়েছিলাম, যতরকম গল্প, লোককথা জেনেছিলাম – এক এক করে মনে করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
সকালের দিকে একটু চোখ লেগে গেছিল। দুপুরে জেগে উঠে ক্যাপ্টেনকে ফোন লাগালাম। তিনি আসার পর দুজনে মিলে সেই চোরাকুঠুরির ভেতরে ঢুকে খোঁজ চালালাম, কিন্ত অস্বাভাবিক কিছুই পাওয়া গেল না। তবে রোমানদের আমলে তৈরী এই কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। ঝুঁকে পড়া প্রতিটি খিলান, প্রতিটি থাম যেন সিজারের সময়কার বিশুদ্ধ এবং সর্বোত্তম রোমান স্থাপত্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। দেওয়ালে বেশ কিছু খোদিত লিপি প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে আগ্রহের বিষয় ছিল – যেমন P.GETAE. PROP….TEMP…DONA…” এবং L. PRAEC…VS…PONTIFI….ATYS….” অ্যাটিয়াসের নাম শুনে কেমন জানি শিউরে উঠেছিলাম। ল্যাটিন কবি ক্যাথুলুসের লেখা আমার পড়া ছিল, আর সেই সুবাদে আমি প্রাচ্য দেবদেবীদের বীভৎস পূজাপদ্ধতি একটু হলেও জানতাম। দেবী সিবেলের আরাধনার সাথে এর বেশ কিছু মিল লক্ষনীয়। আমি এবং ক্যাপ্টেন নরিস মিলে লন্ঠনের আলোয় খোদিত লিপি এবং ছবিগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। অধিকাংশই প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু ঘরের মাঝে পাথরের মসৃণ বেদি দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না, এটা নরবলি বা ওই জাতীয় কিছু দেব–উৎসর্গে ব্যবহার করা হত।
মনে আছে, দেওয়ালগুলো পরীক্ষা করার সময় কিছু আঁকা ছবিতে সূর্যের বিচ্ছুরিত রশ্মি দেখেছিলাম, যেটা নিশ্চিতভাবেই রোমান ভাষ্কর্য নয়। মনে হয়, রোমান পুরোহিতরা এসব জায়গা থেকে কিছু আরও প্রাচীন পূজা পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিলেন। কিছু কিছু পাথরে বাদামী রঙের দাগ দেখে চমকে উঠলাম। ঘরের মাঝবরাবর পাথরের যে চওড়া বেদিটা রাখা ছিল, তার উপরিতল পরীক্ষা করে মনে হল, এর সাথে আগুনের কিছু সম্পর্ক ছিল, কারন তার ওপর কালো মোটা দাগ বেশ ঘন হয়ে ফুটে রয়েছে। হয়ত এখানে আগুনে দগ্ধ করে বলিদান দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল।
ঠিক করলাম, আমি আর নরিস আজ এখানেই রাত্রিযাপন করব, এই চোরাকুঠুরির মধ্যে বসেই। সোফা–টোফা নামিয়ে আনা হলো। চাকর–বাকরদের বলে দিলাম, রাত্রে যাই ঘটুক কেউ যেন পাত্তা না দেয়। কালো–মানিক আমাদের সাথেই থাকল। ঘরের বিশাল ওক কাঠের দরজাটা চেপে বন্ধ করা হলো – যদিও কাঠের মধ্যে এমন কিছু ছিদ্র করা ছিল যা দিয়ে হাওয়া – বাতাস ঢুকতে পারে অবাধে। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে আমরা একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে সোফাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
প্রায়োরীর পেটের গভীরে, মাটির বেশ খানিকটা নীচে এই কুঠুরিটার অবস্থান। সেক্ষেত্রে হয়ত খলবলে ইঁদুরদের জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা হতে পারে, কিন্তু ঠিক কি ওরা সবাই এদিকেই ধেয়ে আসে, সেটা বলতে আমি অপারগ! বসে পাহারা দেওয়ার অবস্থায় যদিও জেগে থাকার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, তবুও ঘুম ও জাগরনের মধ্যবর্তী এক স্বপ্নালু তন্দ্রাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম মাঝে মাঝেই। পায়ের ওপর দিয়ে বেড়ালের উত্তেজিত চলাফেরা আমার এই আচ্ছন্ন অবস্থা হঠাৎ হঠাৎ ঘুচিয়ে দিচ্ছিল। স্বপ্ন যেটা দেখছিলাম, সেটাও ছেঁড়া ছেঁড়া, কিন্তু এটাকেও আমার আগের রাতে দেখা ভয়ঙ্কর স্বপ্নটারই জুড়িদার বলা যেতে পারে। সেই আলোছায়ায় মেশা গুহামুখ, সেই ঘৃন্য, থকথকে ছত্রাকময় জীবগুলির নোংরার মধ্যে গড়াগড়ি দেওয়া। আমি যতই দেখতে থাকলাম, জীবগুলো যেন ততই কাছে আসতে থাকল – আর…আর…তাদের অবয়ব স্পষ্টতর হতে থাকল আমার কাছে। এতটাই যে তাদের প্রতিটা অঙ্গ আমি আলাদা করে চিনতে পারছিলাম। এদের মধ্যে একটার চেহারা দেখে এতটাই ভয়ে পেয়ে গেলাম যে ঘুমের মধ্যেই প্রচন্ড চীৎকার করে উঠলাম। কালো–মানিক চমকে উঠে দাঁড়াল আর ক্যাপ্টেন নরিস, যে কিনা একফোঁটাও ঘুমায়নি, হো হো করে হেসে উঠল। কি ভয়ানক দৃশ্য যে আমি স্বপ্নে দেখেছি, সেটা জানলে হয়ত নরিস হয়ত এরকম আচরন করতে পারত না – বা হয়ত বা এর থেকেও বেশি হাসত। কিন্তু এরপর বহুক্ষন আমি আমার মধ্যে ছিলাম না – প্রচন্ড ভয় মাঝে মাঝে মানুষের স্মৃতিকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে দেয়।
ব্যাপারটা শুরু হতেই নরিস আমাকে ঠেলে তুলল। সেই বীভৎস স্বপ্নের মাঝেই বুঝতে পারলাম, নরিস আমাকে হাল্কা হাল্কা ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে বেড়ালগুলোর সমস্বরে গরগর আওয়াজ শুনতে। কান পেতে শুনলাম, ভারী ওককাঠের দরজার বাইরে বেড়ালদের গজরানি আর দরজার উপর তাদের নখের খড়খড় আচঁড়। আর কালো–মানিক দরজার বাইরে তাদের বন্ধুদের উপস্থিতি সম্পূর্ন বিস্মৃত হয়ে পাথরের দেওয়ালগুলোর কাছে উত্তেজিত ছোটাছুটি করতে লাগল বারংবার – আর আমি শুনতে পেলাম দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে খলবল করতে থাকা মূষিকদের আওয়াজ যা কাল রাতে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
আতঙ্ক ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল – ব্যাখ্যার অতীত অতিপ্রাকৃত ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম। এই উন্মত্ত মুষিকের দল নিশ্চিতভাবেই এই দেওয়ালের ভিতর দিয়েই চলাচল করছে – যেটাকে আমি এতদিন কঠিন চুনাপাথরে তৈরি বলেই জানতাম। সম্ভবত সাতেরোশ বছরের মধ্যে এই দেওয়ালের ভেতরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঢুকে সেটাকে এমনভাবে ক্ষইয়ে দিয়েছে, যা দিয়ে পরবর্তীকালে এই ধেড়ে ইঁদুরের দল ঢুকে বাকি এবড়ো খেবড়ো অংশগুলো কেটে মসৃণ করে ভেতর দিয়ে চলাচলের দিব্যি রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। এ ব্যাখ্যা সত্ত্বেও চারপাশের ভৌতিক আবহাওয়া কিন্তু একচুলও হাল্কা হল না। যদি, এই মূষিকের দল সত্যি সত্যি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করছে, তাহলে নরিস সেটা শুনতে পাচ্ছে না কেন? কেন কেবল আমার নশ্বর কানেই ইঁদুর–দৌড়ের এই খড়বড়ে আওয়াজ শ্রুতিগোচর হচ্ছে? কেন নরিস কেবল কালো–মানিকের অদ্ভুত আচরন এবং দরজার বাইরে বিড়ালদের ক্রমাগত গজরানিতে অবাক হয়ে গিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাইছে? কেন সে এখনও সমঝে উঠতে পারছে না মার্জারকুলের এই নিশাচর উত্তেজনা ও আক্রোশের কারন?
যতক্ষনে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে যথেষ্ট যুক্তিপূর্নভাবে নরিসকে আমার শোনা আওয়াজের কথা এবং বেড়ালদের আচরনের সম্ভাব্য কারন নিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছি, ততক্ষনে, দেওয়ালের মধ্যে ইঁদুরদের চলাচলের আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। শব্দের তীব্রতা ধীরে ধীরে নিচের দিকে অর্থাৎ এই কুঠুরির থেকেও আরও গভীরে হয়ত বা পাতালে প্রবেশ করল। মনে হতে লাগল, এই পুরো বাড়িটার ভিতের নীচে অতল গভীরে ঘিনঘিনে ইঁদুরের দল চরম আক্রোশে খলবল করে বেড়াচ্ছে।
নরিসকে যতটা অবিশ্বাসী ভেবেছিলাম, বাস্তবে দেখলাম সে ততটা নয়। আমার ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনে যে যেন কিছুটা চমকেই গেল। আমাকে আঙুল তুলে দেখাল, যে দরজার বাইরে বিড়ালদের তর্জন গর্জন অন্তর্হিত হলেও, কালোমানিকের উত্তেজনা তিলমাত্র কমেনি। সে একই ভাবে এখনও আঁচড়ে চলেছে – ঘরের মাঝের সেই পাথরের বেদির নীচের অংশটা।
ঠিক এই মুহুর্তে কি এক অজানা আতঙ্কের প্রতি অকথিত ভয়ে আমি অবশ হয়ে গেলাম। যেন কিছু একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটেছে। ক্যাপ্টেন নরিসের দিকে তাকালাম – আশ্চর্যজনকভাবে ক্যাপ্টেনের মত হাট্টাকাট্টা, সাহসী, প্রানোচ্ছল এবং চটপটে যুবকের মধ্যেও আমার আতঙ্কের অনুভুতি সঞ্চারিত হয়ে পড়েছে। হতে পারে অট্টালিকাকে জড়িয়ে এইসব গেঁয়ো প্রবাদ এবং কিংবদন্তীর প্রভাব হয়ত এতদিনে ফলতে শুরু করেছে তাঁর উপর। আমরা নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, কালোমানিক সমানে সেই বেদীর তলদেশ আঁচড়ে চলেছে, এবং মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ শব্দ করছে। সাধারণত, যখন সে আমার থেকে সাহায্য চায়, তখনই এরকম আচরণ করে থাকে।
নরিস এবার লন্ঠনটা তুলে নিয়ে বেদির ঠিক সেই অংশটার দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে কালোমানিক তার থাবা দিয়ে কিছু একটা খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে। হাঁটুমুড়ে বসে, পাথরের বেদি এবং মেঝের সংযোগস্থলে পড়ে থাকা কিছু টুকরো ভগ্নাবশেষ সরিয়ে ফেলে সেখানে আলো ফেলেও নরিস কিছু দেখতে পেল না। আলোটা ঘুরিয়ে সে ফিরেই আসছিল, হঠাৎ আমি এমন কিছু দেখতে পেলাম, যেটা দেখার পর আমার হাত–পা ঠান্ডা হয়ে গেল। নরিসকে আমি ব্যাপারটা দেখালাম এবং দুজনেই সেই অস্পষ্ট কিন্তু অপূর্ব আবিষ্কারের উত্তেজনায় স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। লন্ঠনটা বেদির যেখানে বসানো ছিল – সেখানে তার শিখাটা যেন মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠিছিল কিসের এক তাড়নায়। ভালো করে দেখে বোঝা গেল, বেদির কোনো এক ফাঁক–ফোঁকর দিয়ে হাওয়া বেরোচ্ছে, আর সেই হাওয়াতেই লন্ঠনের শিখার এই অস্বাভাবিক আচরন।
হাওয়া বেরোচ্ছে বেদি এবং কুঠুরির মেঝের জোড়ের অংশটা থেকে যেখানে এতক্ষণ নরিস বসে বসে আবর্জনা সরাচ্ছিল।
বাকি রাতটা আমার বড়সড় স্টাডির উজ্জ্বল আলোতে বসে আলোচনা করেই কেটে গেল। আমাদের দুজনের মনেই প্রশ্ন – এবার কি কর্তব্য? আমরা এমন এক গুপ্তকুঠুরি আবিষ্কার করে ফেলেছি, যা গত তিন শতকে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজ পায়নি। এই প্রায়োরীতে প্রচুর মানুষ নিছক অ্যাকাডেমিক আগ্রহে এবং প্রত্ন–সন্ধানে এসেছিলেন বহুদিন ধরে। আমরা যে কুঠুরিতে আজ রাতে ছিলাম, সেটিই এখানকার সবথেকে গভীরতম স্থান হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এরও নীচে কিছু একটা আছে, সেটা জানার পরে যেন আমাদের মত অ–গবেষক মানুষও যেরকম উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, তাতে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক যে উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবেন সেটা বলাই বাহুল্য।
এই ঘটনার পর দুটি সম্ভাবনা উদয় হল। এক, এই প্রায়োরী ছেড়ে চিরতরে পালিয়ে যাওয়া। এই অট্টালিকাকে জড়িয়ে যে সব গা–ছমছমে কু–সংস্কার এবং প্রবাদ আছে, তাতে এরকম একটা গুপ্ত কুটুরির কথা বলা আছে বটে। আর দুই, সাহসে ভর করে, একটা রোমাঞ্চকর অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া – দেখাই যাক না আর কত গভীরে যাওয়া যেতে পারে, আর সেখানে কি রহস্যই বা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সারারাত আলোচনা চালিয়ে, ভোরবেলা এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, যে লন্ডনে ফিরে গিয়ে কয়েকজন প্রত্নতাত্ত্বিক এবং কিছু বিজ্ঞানীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা যাক। তাতে অন্তত এই ঐতিহাসিক আবিষ্কার স্বীকৃতি পাবে। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গুপ্ত–কুঠুরির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা দুজনে সেদিন ওই পাথরের বেদীটাকে সরানোর প্রচুর বিফল প্রচেষ্টা করেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যে ওই বেদিটাই হল কোনো অজানা গভীরতায়, বিপুল রহস্যময় এক দুনিয়াতে প্রবেশের একমাত্র পথ।
লন্ডনে গিয়ে আমি আর নরিস আমাদের প্রাপ্ত প্রমাণ মায় প্রায়োরীর ইতিহাসের দলিল, তাকে ঘিরে গল্প–কথা, প্রবাদ, কিংবদন্তী সবকিছুই পাঁচজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, বিজ্ঞানবিদদের সামনে উপস্থিত করলাম। এমন পাঁচজন, যাদের উপর আমাদের পরিবারের গুপ্তকথা বিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায় এবং এঁরা এসব ব্যাপারে আগ্রহ নিয়ে অনুসন্ধান কাজও চালিয়ে থাকেন।
দেখলাম, এঁরা ব্যাপারটাতে বেশ আগ্রহী। হেসে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কারুর ভিতরেই বিশেষ দেখা গেল না বরং বেশ সহানুভুতি নিয়েই এঁরা আমাদের কথাগুলো শুনলেন। এঁদের সবার নামোল্লখ প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু তবু বিশেষ করে স্যার উইলিয়াম ব্রিন্টন এর নাম না নিলে অবিচার করা হবে। ইনি ততদিনে ট্রোড উপদ্বীপে (তুর্কি দেশের অন্তর্গত) খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে বেশ নাম কিনেছেন। এঁরা সকলেই আমাদের সাথে প্রায়োরীতে গিয়ে খননকার্য চালাতে রাজি হলেন। ব্যবস্থা সম্পূর্ন করে যেদিন সবাই মিলে অ্যানচেস্টারের ট্রেনে চেপে বসলাম, সেদিন মনটা যেন কেমন এক অশুভ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তারওপর শুনলাম দুনিয়ার অপরপ্রান্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে খুন হয়েছেন। খবরটা আমার চারপাশের আবহাওয়াকে আরও বিষণ্ণ করে তুলে এক অশুভ পরিনতির দিকে ইঙ্গিত করতে লাগল। কেন জানি মনে হতে লাগল – এ যাত্রা মোটেই সুখকর হবে না।
অগষ্টের সাত তারিখ নাগাদ আমরা এক্সাম প্রায়োরীতে পৌঁছলাম। ভৃত্যেরা জানাল এ–কদিনে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। কালোমানিক সমেত আমার বাকি পোষ্য মার্জারশ্রেনী বিলকুল ঠান্ডা হয়ে ছিল। ইঁদুরধরা কলের একটা স্প্রিং–ও বাঁকা হয়নি। ঠিক হলো, পরেরদিন থেকেই অনুসন্ধান শুরু হবে। আমার অতিথিদের বসবাসের জন্য সবথেকে ভালো ঘরগুলোর ব্যবস্থা করা হল। সবকিছু মিটে যাওয়ার পর, ক্লান্ত আমি নিজের ঘরের নরম বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কালোমানিক অভ্যাসমত পায়ের কাছটিতে শুয়ে রইল।
শোয়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এবং বীভৎস দুঃস্বপ্নের করাল ছায়া আমায় নিমেষে গ্রাস করল। স্বপ্নে রোমানদের এক ভোজসভার দৃশ্য দেখতে পেলাম – খাবারের প্রাচুর্য্যে ভরপুর সেই ভোজসভা। কিন্তু প্রতিটি প্লেট ঢাকা দেওয়া – যেন কি এক অজানা আতঙ্ক সেই সব ঢাকা দেওয়া প্লেটের ভেতরে লুকিয়ে আছে। তারপর আবার সেই জঘন্য স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই শুয়োরের পাল ঘষটাতে ঘষটাতে আলো–আঁধারিতে মোড়া আবর্জনাময় গুহার অন্ধকারে প্রবেশ করল। এসব দেখে যখন আমি চরম অস্বস্তি নিয়ে জেগে উঠলাম, দেখি চারদিকে ফটফটে দিনের আলো। আশেপাশে পরিবেশের স্বাভাবিক শব্দ – কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। ইঁদুর বা বেড়াল কেউই উৎপাত করছে না। কালোমানিক পায়ের কাছে ঘুমিয়ে কাদা।
ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম। চতুর্দিকে নিরালম্ব নিস্তব্ধতা। আমার এই অনুসন্ধান দলের এক বিজ্ঞানী – তিনি আবার কিছুটা আধ্যত্মবাদীও বটে – আমাকে বলেছিলেন, এখানে নাকি কিছু অশুভ শক্তি আছে – তারা আমাকে দিয়ে যা দেখাতে চেয়েছে আমি নাকি তাই এতদিন দেখে এসেছি।
সবাইকে ঘুম থেকে তুলে প্রাতরাশ খেয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। তারপর আমাদের সাতজনের দলটা হাতে বড় বড় টর্চলাইট এবং খোঁড়াখুড়িঁর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সমেত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে চললাম। সেই রোমান স্থাপত্যে ঠাসা চোরাকুঠুরিতে পৌঁছে কাঠের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া গেল। কালোমানিক আমাদের সাথেই ছিল। অনুসন্ধানকারীরা তাকে না নিয়ে যাওয়ার কোনো কারন খুঁজে পাননি, তাছাড়া তার আচরণও অত্যন্ত স্বাভাবিক। কুঠুরির দেওয়ালে রোমানদের শিলালিপি এবং আরাধনা বেদীর নানা বৈচিত্রময় নকশা খুব সামান্য সময়ের জন্য দেখেই তাঁরা ঘরের কেন্দ্রস্থলে থাকা পাথরের মূল বেদীর দিকে অগ্রসর হলেন। দলের দু এক প্রত্নবিজ্ঞানী এই অট্টালিকাতে আগে এসে থাকার সুবাদে রোমান শিলালিপির বিষয়ে তাঁরা আগেই পরিচিত ছিলেন। তাই সেসব বাদ দিয়ে সবার আকর্ষনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠল, ঘরের মাঝের সেই রহস্যময় পাথরের খন্ডটি।
অনেক কায়দা কানুনের পর, স্যার ব্র্যান্টন, বেদির পাথরটাকে পেছনে হেলিয়ে দিতে সক্ষম হলেন। হাজার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসা সত্ত্বেও, সেই রন্ধ্রপথের গহীন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে আমাদের শ্বাসরোধ হয়ে আসার উপক্রম হল। চৌকো করে কাটা সেই সুড়ঙ্গপথের মুখের কাছে পাথরের সিঁড়ি এঁকে বেঁকে নেমে গেছে অজানা কোন অন্ধকারে। আর সেই সিঁড়িঁর ধাপে ধাপে একটা বিশাল স্তুপের মত বীভৎস নর–কঙ্কাল বা মানুষের মত কিছুর হাড়গোড়ের রাশি ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে যেগুলোকে মানুষের বলে চিহ্নিত করা গেল সেগুলো বাদে বাকি বিভিন্ন রকমের খুলির উপস্থিতিও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তাদের মধ্যে অতি প্রাচীনকালের মানুষের মাথার খুলিও যেমন আছে, তেমনি আছে বামনগোত্রের মানুষের করোটি। তাছাড়া ইঁদুরে খাওয়া মনুষ্য শরীরের কঙ্কালময় ভুক্তাবশেষও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে। সিঁড়ির ধাপগুলো দেখেই বোঝা গেল কেউ পাথর কেটে মসৃণ করে সেগুলিকে তৈরি করেছে, আর সেই ধাপের পাশে দেওয়ালের খাঁজ দিয়ে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাসের স্রোত।
না – না, এ বহুকালের সুড়ঙ্গ খুলে বেরিয়ে আসা বিষাক্ত বা কটু বাতাস নয়। এ বাতাস তাজা, ফুরফুরে। আমরা বেশিক্ষণ সেখানে অপেক্ষা না থেকে দুরুদুরু বুকে সেই সিঁড়ির ধাপ বয়ে নামতে থাকলাম। স্যার উইলিয়াম সুড়ঙ্গের পাশের দেওয়ালের গায়ে কাটা খাঁজগুলো দেখতে দেখতে অগ্রসর হচ্ছিলেন আর তখনই তিনি হাড় হিম করা আবিষ্কারটি করলেন – “ছেনি বা পাথরকাটার যন্ত্রের ঘা দেখে মনে হচ্ছে, এই সুড়ঙ্গ ওপর থেকে নীচের দিকে কাটা হয়নি। বরং কেউ বা কারা এটা নীচ থেকে কাটতে কাটতে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে এসেছে।“
ছড়িয়ে থাকা হাড়গোড় এবং করোটির স্তুপ সরিয়ে কিছুটা নামার পর দূর থেকে একটা আলোর ক্ষীণ রেখা দেখতে পাওয়া গেল। টিমটিমে কোনো মায়াবী আলোর বিচ্ছুরন নয় –এ রীতিমতো সুর্যের আলো যা কেবল প্রায়োরীর পশ্চিমের উপত্যকার দিকে মুখ করে থাকা উঁচু বাঁধের কোনো অজ্ঞাত ফাটল দিয়েই আসা সম্ভব। কিন্তু সারা বাড়ি সংস্কার করার সময় এই ফাটলটা চোখে পড়ল না, এটা বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার! তবে ওই পশ্চিম উপত্যকাতে শুধু মানুষ থাকে না তাই নয়, উঁচু বাঁধটাও এমন লম্বা এবং খাড়াই যে বেলুনে চড়েই কেবলমাত্র ওর ওপর উঠে পরীক্ষা করা সম্ভব।
আর কিছুটা এগিয়েই এমন দৃশ্য দেখতে পেলাম যে আতঙ্কে আমাদের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে আমাদের দলের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানী সেই থ্রনটন ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে তার ঠিক পিছনের লোকটির কোলের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। নরিসের গোলগাল মুখ ফ্যাকাসে হয়ে চুপসে গেল আর সে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠল। হয়ত আমিও সেরকমই কিছু একটা শব্দ করে চোখ চাপা দিয়েছিলাম। আমার পেছনে থাকা দলের সদস্যটির গলা দিয়ে বেরিয়ে এল বহুশ্রুত সেই শব্দবন্ধটি – “হে ভগবান।“ সাত সাতটা আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া পুরুষদের মধ্যে, কেবল স্যার উইলিয়াম ব্রিন্টন বুক চিতিয়ে খাড়া রইলেন। তিনি যেহেতু পুরো দলের নেতা, তাই তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ শোভা দেয় না আর তাছাড়া, দলের পুরোভাগে থাকার জন্য, তিনি হয়ত আমাদের আগেই দৃশ্যটি দেখেছিলেন, তাই তাঁর দ্বিতীয়বারের প্রতিক্রিয়া এতটা ভয়াবহ হয়নি।
আমাদের সামনে আলো–আঁধারিতে ঘেরা এক বিশাল গুহামুখ– অকল্পনীয় উঁচু তার প্রাকার। কতটা গভীর যে তার বিস্তৃতি চোখে দেখে তার কোনো আন্দাজও পাওয়া যায় না। ভূগর্ভস্থ এই দুনিয়া যেন রহস্যের খাসমহল, ভয়ংকরের অভয়ারন্য! এদিক ওদিক নানা স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। একঝলক তাকিয়ে দেখলাম, প্রাচীন সমাধিস্তুপের সারি – এক অদ্ভুত বিন্যাসে সাজানো। রোমানদের গম্ভুজাকার স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, স্যাক্সন স্থাপত্যের ছড়িয়ে থাকা টুকরো, কাঠের তৈরি প্রাচীন ও বিশালাকার ইংরেজ স্থাপত্য– কিন্তু এসব ছাপিয়ে এক হাড় হিম করা পৈশাচিক দৃশ্য মেঝের ওপরেই ছড়িয়ে রয়েছে। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম তার ফুটখানেক দূরেই বীভৎসভাবে জট পাকানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে মানুষের হাড়। শয়ে শয়ে – স্তুপের মত। মানুষ এবং মনুষ্যেতর কোনো দু’পেয়ে জন্তুর, যাদের হাড় আমরা সুড়ঙ্গের মুখেও দেখে এসেছি। ফেনিল সমুদ্রের মত সামনে পড়ে রয়েছে সেই সফেদ চকচকে হাড়ের সারি। কঙ্কালের সারি দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয়, এদের কেউ কোনো মাংসাশী দানবের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কেউবা আরও কোনো ভয়ঙ্করের হাতে প্রান দিয়েছে।
ডঃ ট্রাস্ক – যিনি আমাদের দলের মধ্যে নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন – ঝুঁকে পরে কিছু করোটি তুলে নিলেন ভালোভাবে নিরীক্ষনের জন্য। করোটিগুলির অদ্ভুত বৈশিষ্ট তাঁকে হতবাক করে দিল। এ যে পিল্টডাউন মানুষের (বানর থেকে মানুষে অভিযোজনের মিসিং লিংক এই পিল্টডাউন ম্যান) চেয়েও পুরাতন করোটি, কিন্তু হাড়ের সমুদ্রের মধ্যে অধিকাংশই মানব কঙ্কাল। অনেক কংকালের বৈশিষ্ট দেখে বোঝা গেল, তারা কিছুটা উন্নত শ্রেনীর মানুষ, তাছাড়া অতি উন্নত শ্রেনির মানুষের কিছু কঙ্কালও খুঁজে পাওয়া গেল। এদের অধিকাংশ হাড়গুলোই চিবোনো, ছিবড়ে করে ফেলা। হয় কোনো ছোট প্রানীর দ্বারা আর না হলে মানুষের মত দেখতে এমন কোনো মনুষ্যেতর প্রানীর দ্বারা। অনেক ইঁদুরের হাড়গোড়ও এদের মধ্যে মিশে রয়েছে দেখা গেল। হয়ত এরা সেই প্রাণঘাতী মূষিক বাহিনীর হতভাগ্য সদস্যরা যাদের মৃত্যু এ প্রাচীন পৈশাচিক মহাকাব্যের উপর যবনিকা টেনে দিয়েছে।
এই সব দৃশ্য দেখার পর মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ভাষায় বা অনুভুতিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয় কি অবিশ্বাস্য রকম জান্তব, পৈশাচিক, ঘৃণ্য, বিকৃত বর্বরতার চুড়ান্ত রূপ দেখেছিলাম আমরা সাতজন সেই আলো–আঁধারি ভূগর্ভস্থ গুহার সামনে। প্রতিটা মুহুর্তেই কিছু না কিছু আবিষ্কৃত হচ্ছিল – আর সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে সাজাতে চেষ্টা করছিলাম, তিনশ বছর আগে, বা হাজার বছর পূর্বে – না না, দু হাজার বছর, তাও হয়ত নয় – দশ হাজার বছর আগে এখানে ঠিক কি ঘটেছিল। এটা যেন নরকের গর্ভগৃহ, যার মৃত্যুর গন্ধে ম–ম করছে।
এসব কিছু মাঝে থ্রনটনের জ্ঞান এসেছিল বটে, কিন্তু ডঃ ট্রাস্ক যখন তাঁকে শোনালেন যে স্তুপের কিছু কঙ্কালের নমুনা হাজার দুহাজার বছর পুরানো চতুস্পদের নমুনার সাথে মিলে যাচ্ছে, তখন তিনি আবার আতংকে জ্ঞান হারালেন।
স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষগুলো পরীক্ষা করে আমাদের আতঙ্ক যেন দ্বিগুন হয়ে উঠল। চতুস্পদ জীবগুলির মাঝে দ্বিপদী প্রানীরাও পাথরের বড় বড় ঘরগুলোর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকত। জেগে ওঠার পর হয় তারা ক্ষুধায় প্রানত্যাগ করত বা মূষিক–আতঙ্কে মারা পড়ত। এখানে চতুষ্পদের একটা পুরো পাল ছিল – তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রচুর শাকসব্জি রাখা থাকত পাথরের একটা বিশাল কোটরে। সেইসব জাবনার বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ এখনও সেখানে পাওয়া গেল। সেই পাথরের তৈরী বিশাল পাত্রটিরই বয়স দেখা গেল রোমান সাম্রাজ্যের থেকেও বেশি। এখন বুঝলাম, আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাড়ির সামনে বিরাট শাকসব্জির বাগান কাদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য বাজিয়েছিলেন।
রোমান স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যার উইলিয়াম। তিনি টর্চ হাতে দেওয়ালে খোদাই করা লিপি থেকে পাঠ করলেন এমন এক তন্ত্রপদ্ধতি যা আমি কোনোদিন শুনিওনি। খ্রীষ্টপূর্বোক্ত যুগের কিছু ধর্মবিশ্বাস এবং খাদ্যভ্যাসের বিবরন পড়ে শোনালেন তিনি, যার সাথে পরবর্তীকালে দেবী সিবেলের পুরোহিতরা নিজেদের কিছু উপাদানও মিশিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন নরিস, যে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্রেঞ্চে বীরের মত চলাফেরা করেছে, ইংরেজ স্থাপত্যের অংশটি দেখে এসে আর সোজা হয়ে হাঁটতে অবধি পারছিল না। বাড়ির মধ্যে যুগপৎ কসাইখানা এবং রান্নাঘর দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন ইংরেজ নিদর্শন ছাড়াও দেওয়ালে খোদাই করা প্রচুর শিল্পরীতি তার কাছে বেশ পরিচিত লেগেছিল। কিন্তু আমি জানতাম, এ সব কিছুই ১৬১০ সালের কাছাকাছি প্রাচীন। ওখানে ঢোকার প্রবৃত্তি হলো না আমার – কারন আমি জানতাম ওই বাড়ির শয়তানী কার্যকলাপ আমার প্রপিতামহ ওয়াল্টার ডে–লা–পোর এর ছুরিকাঘাতে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছিল।
আমি বরং স্যাক্সন স্থাপত্যের মধ্যে প্রবেশ করলাম। অট্টালিকার ওক কাঠের দরজা ভেঙে খুলে গেছে। ভেতরে ঢুকেই দেখলাম খান দশেক অন্ধকার কুঠুরি, ঠিক জেলখানার মত। সামনের লোহার শিকগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। তিনটে কারাগারে একটা করে কংকাল শায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এদের মধ্যে একজনের হাড়ের আঙুলে একটা আঙটি দেখলাম যার উপরে খোদিত মোহরটি আমাদের বংশে এখনও ব্যবহৃত হয় নানা সরকারি কাজে। স্যার উইলিয়াম, রোমান প্রার্থনাকক্ষের নিচের অংশে এরকমই আরও একটা কারাগার আবিষ্কার করলেন। সেগুলো যদিও আরও প্রাচীন – তবে সবই খালি। ডঃ ট্রাস্ক একটা প্রাগৈতিহাসিক সমাধিস্তুপ ভেঙে পরীক্ষা করতে লাগলেন। সেখান থেকে পাওয়া খুলিটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, গরিলার থেকে সামান্য উন্নত মানের মানুষ্যেতর জীবের মাথার খুলি সেটি – তাতে আবার অদ্ভুত সব প্রাচীন চিত্রলিপি খোদাই করা আছে।
এত ঘটনা এবং নিরন্তর নব–নব আবিষ্কারে মধ্যে ডুবে থাকলেও আমি আড়চোখে কালোমানিকের দিকে নজর রেখেছিলাম। এতকিছুর মধ্যেও আমার বেড়াল কিন্তু নিরুত্তাপ থেকেছে। মাঝে একবার একছুটে উঠে গিয়েছিল হাড়ের স্তুপের একদম চূড়ায়, সেখানেই ছিল কিছুক্ষন। ওখান থেকে নীচে তাকিয়ে তার হলুদ চোখের চাহনি দিয়ে হয়ত বা বুঝতে চাইছিল এই জায়গার রহস্য।
আলো–আঁধারির জায়গায় এই ভয়ানক সব অভিজ্ঞতা লাভের পর, আমরা গুহার একটু ভেতরে ঢুকতে গেলাম, যেখানে বাঁধের ফাটল দিয়ে আসা কোনো আলোর রশ্মি এখনও ঢুকতে পারেনি। আমার স্বপ্নে বারবার দেখা এই স্থানের প্রতিচ্ছবি আমাকে কেমন যেন বিবশ করে দিয়েছিল। এও সম্ভব – আমাকে কি তাহলে এতদিন এই ভয়ানক রহস্যময় জায়গা হাতছানি দিয়ে এসেছে? আলোর সীমানা অতিক্রম করে আমরা ক্রমশ নিবিড় অন্ধকারের রাজ্যে ঢুকে চললাম। এর ভেতর আরও কি রহস্য তার মায়াজাল বিস্তার করে আছে, সে বিষয়ে জানার কৌতুহল তীব্র হয়ে উঠেছিল, যদিও জানতাম, একসঙ্গে এতকিছু জেনে ফেলা, মানুষের পক্ষে মোটেই উচিত কাজ নয়।
তবে বেশিদূর যেতে হল না – টর্চের আলো গিয়ে পড়ল গুহার গভীরে অভিশপ্ত ছোট বড় অসংখ্য গর্তের মধ্যে। দেখে বোঝা গেল এখানেই এই মাংসাশী মূষিকশ্রেণী তাদের শিকারকে ছিঁড়ে খেত। খাদ্যের অভাব – কেবল খাদ্যের বিপুল অভাবেই তারা তাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। প্রথমে শেষ করেছিল পোষা চতুস্পদের পালকে এবং তারপর তাদের বিশ্বগ্রাসী, জিগাংসা ও রক্তলোলুপ পৈশাচিক ক্ষিদে নিয়ে তারা প্রায়োরী থেকে বেরিয়ে পড়েছিল একদিন রাত্রে।
হে ঈশ্বর। একি দৃশ্য। প্রতিটি গর্ত কেবল শুকনো মাংস এবং হাড়ের স্তুপে পরিপূর্ন। হাড়ের টুকরো এবং খুলির অংশগুলো অবধি ঠুকরে খাওয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পৈশাচিক শয়তানের দল তাদের বিকৃত ক্ষুধা মিটিয়ে এসেছে নানা ধরনের মানুষদের শিকার বানিয়ে। তাদের হাড় গোড়ে পূর্ন করেছে এই অন্ধকার গর্ত। এক একটা যে কত গভীর তা টর্চের আলো ফেলেও পরিষ্কার অনুমান করা সম্ভব নয়। কত শতাব্দী ধরেই না জানি এই হতভাগ্য মূষিকের দল কৃমিকীটের মত উঠে আসছে এই নরকের কুম্ভীপাক থেকে।
হঠাৎ আমার পা পড়ে গেল একটা হাঁ করে থাকা কঙ্কালের উপর – কিছুটা পিছলে গেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের ভেতরটা অজানা এক ভীষণ আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। আমি নির্ঘাত একটু বেশীই ভাবনায় ডুবে গেছিলাম, কারন টর্চ ফেলে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না আর। কেবল একটু দূরে ক্যাপ্টেন নরিস দাঁড়িয়ে ছিল। পরমুহুর্তেই সেই পরিচিত শব্দটা কানে এল – যেন কোন অসীম থেকে ভেসে আসছে সেটা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। দেখতে পেলাম আমার কালো বেড়ালটা মুহুর্তে আমার পাশ দিয়ে তীরের মত ছুটে বেরিয়ে গেল। আমিও তড়িৎগতিতে ফিরবার রাস্তা ধরলাম। কিন্তু একটু কি দেরী হয়ে গেছে? খড়মড় করে বীভৎস শব্দে, খলবলে নারকীয় মুষিকেদলের ছুটে আসার আওয়াজ ক্রমশই তীব্র হয়ে উঠতে লাগল। এই পৈশাচিক জন্তুগুলো প্রতি মূহুর্তেই নতুন আতঙ্কের জন্মদাতা, আর এরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে, টেনে নিয়ে যাবে সুদূর নরকে যেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে আনন–হীন এক কিলবিলে শয়তান, নায়ারলাথোটেপ – যার মোহন বাঁশির মত ভয়ংকর আর্তনাদে মোহিত হয়ে ছুটে আসে রক্ত–খদ্যোতের দল।
আমার টর্চের আলো নিভে গেছে কিন্তু তবু আমি দিশাহীন ভাবে ছুটে চলেছি উন্মাদের মত। দূরে কোথায় যেন কারুর গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি, কেউ যেন আর্তনাদ করে উঠছে – সেই আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে সেই বিশাল ভূগর্ভস্থ নরকের প্রাকারে প্রাকারে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আরও তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে সেই শব্দ – রক্তলোলুপ ইঁদুরের দলের এগিয়ে আসার কুটিল, ভয়ঙ্কর, ঘৃণ্য শব্দ – সেটা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। ছুটতে ছুটতে কিছুতে একটা যেন হোঁচট খেলাম – কিরকম নরম আর তুলতুলে একটা জিনিস। নিশ্চই সেই রক্তলোলুপ শয়তানের দল গায়ের ওপর এসে গেছে। ঘিনঘিনে থকথকে কি কদাকার সেই পিশাচেরা –যারা মড়া এবং জ্যান্ত এই দুই ধরনের প্রাণীকেই মহানন্দে ভোজন করে। বিদ্যুতচমকের মত আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল – তাহলে ইঁদুরগুলো ডে–লা–পোর দের ভক্ষন করল না কেন? ডে–লা–পোরেরা নিষিদ্ধ কিছু খেত বলে? যেমন যুদ্ধটা আমার ছেলেকে খেয়েছে? মর শালারা!! ইয়াংকিগুলো কিনা কারফ্যাক্সের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল – শয়তানগুলো দাদুকে কিনা জ্বালিয়ে মেরে দিল!!
না না – এসব কি বলছি আমি? আমি সে নই, আমি আমার স্বপ্নে দেখা সেই শয়তানরূপী কদাকার অবয়ব নই –!! ছত্রাকে পূর্ণ ঐ বীভৎস থলথলে মুখটা এড নরিসের হতে পারে না!!
কে বলেছে আমি ডে–লা–পোর? শালা নরিস বেঁচে রইল, আর আমার ছেলে মরে গেল?? কে নরিস? সে কিনা ডে–লা–পোরের সম্পত্তি দখল করে থাকবে? ওহে থ্রন্টন – এটা ভুডু, বুঝলে – সাপের ছোবল – হিস্স্স্!!! অজ্ঞান হবে নাকি?? হও হও ভালো করে হও। আমি তোমাকে দেখাব, কিভাবে আমাদের পরিবারের প্রাচীন কাজকর্মের প্রভাবে চিরকালের মত অজ্ঞান হওয়া যায়!!
রক্ত চাই রক্ত, বুঝলি ইতর!! তোর রক্ত চাই। কিভাবে ছোবল মারবি, আমি দেখাচ্ছি দ্যাখ!! ম্যাগনা মাতের! ম্যাগনা মাতের!! আতিয়াস – দিয়া আদ আওদান – আগুস বাস দুনাত ওরট – আগুস লেট সাআআআআআআ – উররর – রাআআআহহ – সসসসস!!!!!
প্রায় তিনঘণ্টা পর ওরা যখন আমাকে এই অন্ধকার কুঠুরির তলা থেকে উদ্ধার করে, তখন নাকি এই শব্দগুলো আমি ক্রমাগত আউড়ে যাচ্ছিলাম। ওরা আরও বলে, আমি নাকি ক্যাপ্টেন নরিসের আধখাওয়া দেহের উপরে হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম –যখন আমার নিজের বেড়াল আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল। ওরা এক্সাম প্রায়োরীকে বন্ধ করে দিয়েছে চিরকালের জন্য, কালোমানিককে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, আর আমাকে পুরে দিয়েছে হ্যানওয়েলের এই ছোট্ট ঘরে। আমি বুঝতে পারছি, আমার পরিবার নিয়ে, এবং আমাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটানো হচ্ছে আমার চারপাশে। প্রায়োরীর সব রহস্য চেপে দেওয়ার চেষ্টা করছে এরা!! বেচারা নরিসের কথা জিজ্ঞেস করলে আমার ওপর বীভৎস সব আরোপ লাগাচ্ছে, কিন্তু তাদের জানতে হবে এসবের জন্য আমি দায়ী নই!! ওদের জানতে হবে, ওই ইঁদুরগুলোর কথা। সেই ঘিনঘিনে মুষিকের দল, যাদের খড়খড়ে চলাফেরা, ক্রমাগত উল্লম্ফন, আমাকে একটুও ঘুমোতে দেয় না। শয়তানের দল, সারাক্ষন এই ঘরের দেওয়ালের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমাকে ডাকছে – মাটির গভীরে, আরও নিবিড় আতঙ্কের যাত্রাতে তাদের সাথে সামিল হতে!
ওরা কোনোদিন এদের ডাক শুনতে পাবে না, কেবল আমি পেতে থাকব, চিরজীবন! ওই ইঁদুরের দলের আওয়াজ – ঘিনঘিনে, যা ভেসে আসছে ওই দেওয়ালের ভেতর থেকে।
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ মূল গল্পটি ১৯২৩ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে লেখা এইচ পি লাভক্র্যাফটের ছোটগল্প “দ্য র্যাটস ইন দ্য ওয়ালস”। গল্পটি ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে Weird Tales ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, এইচ পি ল্যাভক্রাফট, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বড় গল্প, মূষিক আতঙ্ক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সূর্যোদয় দে
লাভক্রাফট এর ভাষায় যে ভয়ের লিরিক্যাল বর্ণচ্ছটা আছে তাকে বাংলার গদ্যে বিনির্মাণ একটা গভীর অনুধ্যান আর মুন্সিয়ানার দাবী রাখে। সন্দীপনের অনুবাদে সেই তন্নিষ্ঠ ব্যঞ্জনা এক অনায়াস চলনে উঠে এসেছে। চরৈবেতি …
Thanks dada…
আরে খুড়ো, জাস্ট ফেসবুক আইকনে ক্লিক কর, তাহলেই লগ ইন আর কমেন্ট হবে।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম । অনুবাদের কোন তুলনা হবে না, সোজা কথায় লাভ ক্রাফটের যে এমন দারুন অনুবাদ হতে পারে সেটা লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন। (Y)