শিশুটি – সাইমন রিচ
লেখক: অনুবাদ - শামীম আহমেদ
শিল্পী: সুমন দাস
এ তো জানাই ছিল, শিশুটি এলে বেনের অফিস খানা নার্সারি হয়ে উঠবে।
সাধের লেখালেখির রুমটিকে মিস করবে বেন, কিন্তু সে জানে, তুলনামূলকভাবে ওটা একখানা ছোট বলিদান। ওর স্ত্রী সু গত দু’বছর ধরে পেট ফাঁপিয়ে গ্যাস হওয়া সব ভিটামিন নিচ্ছে আর যোনিতে এক বুড়ো পোলিশ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের খোঁচাখুঁচি সহ্য করে যাচ্ছে। বেচারিকে এমনকী বেনাড্রিল আর ভোদকা মার্টিনিও ছাড়তে হয়েছে। অন্তত বেন তার উপন্যাস লেখার জন্য অন্য জায়গা খুঁজে নিতে পারবে।
এ ছাড়া, সু জন্ম দিতে দিতে ওর বইখানাও অবশ্যই শেষ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই সে শেষ অধ্যায়ে চলে এসেছে, এবং Pregnancy.com অনুযায়ী শিশুটি এখনও মাত্র একট ছোট্ট ওলকপি আকারের। প্রয়োজনমাফিক তার অনেকটা সময় হাতে রয়েছে।
নিজের কাস্টম রাইটিং চেয়ারে হেলান দিয়ে, বেন তার আসন্ন বইটির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে দিবাস্বপ্নে ডুবে গেল। তার উপন্যাসগুলি এ অবধি বেশ সাধারণভাবেই সমাদৃত হয়েছে। তবে সম্ভবত এই নতুন বইখানা তাকে প্রবাদপ্রতীম ‘নেক্সট লেভেলে’ নিয়ে যাবে। সে কল্পনা করল এক বিশ্বভ্রমণের, সু আর ওই ওলকপিকে সঙ্গে নিয়ে, একখানা গ্ল্যামারাস বুক ট্যুর। অনেকক্ষণ এই ফ্যান্টাসিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার পর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল, এই রে কোথাও যেন যাওয়ার কথা ছিল।
‘স্যরি, আমি দেরি করে ফেললাম!’ ছোট্ট সাদা কামরাটিতে সেঁধিয়ে যেতে যেতে বেন বলল। ‘আধঘণ্টা মেট্রোতে আটকা পড়েছিলাম।’
‘আহা রে সোনা, সত্যিই খুব অসুবিধা হয়েছে তোমার।’ সু বলে। তার কপালে চুমু খেলে বেন হেসে ওঠে, যাক গে বাপু, সে তার অজুহাত মেনে নিয়েছে।
‘তুমি ঠিক সময়ে এসেছ,’ সু-র পেটে চটচটে মলম ছড়িয়ে ডক্টর কোয়ালাস্কি বলেন।
সু বেনের দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে বলল, ‘কি, তুমি রেডি তো?’
‘হ্যাঁ, রেডি,’ বেন বলল। কাছের মনিটরে একটি সাদাকালো ছবি ফুটে উঠলে সে সু-এর হাত চেপে ধরল। সাদাকালো ছবিতে চোখ অভ্যস্ত হতে বেশ খানিকক্ষণ লাগল। কিন্তু এরই মধ্যে বেন শিশুর পা এবং ধড় চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।
‘ওটা কী?’ একটি ছোট্ট সাদা দাগের দিকে উত্তেজিতভাবে অঙ্গুলিনির্দেশ করল সে।
‘এটা পিনাস!’ যেন কোনও বিজয়ীর সুরে ডাক্তারবাবু বলেন। ‘এর মানে আপনাদের ছেলে হয়েছে!’
‘উরিব্বাস!’ বেন ও সুজান খুশিতে ফেটে পড়ে। ‘একটি ছেলে!’ বেন আরেকটি অস্পষ্ট আকারের দিকে ইশারা করে। ‘ওটা কী জিনিস?’
‘পেন্সিল,’ ডাক্তার বললেন।
বেনের হাসি শুকিয়ে যায়। ‘আপনি কি পেন্সিল বললেন?’
‘বা হয়তো কলম,’ ডাক্তারবাবু জানান। ‘এই স্টেজে জানতে পারাটা খুব তাড়াহুড়োর হয়ে যাবে।’
‘এর মানে কী?’ বেন ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
ডক্টর কোয়ালাস্কি মুচকি হাসেন।
‘এর মানে তোমরা একজন লেখককে পেতে যাচ্ছ।’
ওইদিন বিকেলে বেন Pregnancy.com-এ আরও কিছুটা সময় কাটাল। এটা জেনে সে অবাক যে গর্ভধারণের ষোলতম সপ্তাহের মধ্যেই সাধারণত একটি ভ্রূণের পেশা কী হবে তা প্রকাশ পেয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি সোনোগ্রামের মধ্যে কোনও একটি হুডি সনাক্ত করতে পারেন তবে সাধারণত আপনার শিশু যে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হবে তার ইঙ্গিত দেয়। যদি আপনার ভ্রূণ একটি ক্ষুদ্র পিচকারির ডাঁটাকে ধরে রাখে, তবে সে সম্ভবত একজন প্লাম্বার (জলের মিস্ত্রি) এবং একটি কাঠের হাতুড়ি প্রায় অবশ্যই বিচারক বোঝায়। পরিসংখ্যানগতভাবে, লেখকের সংখ্যা কম, যদিও বাবা-মায়ের মধ্যে কোনও একজন যদি আশকানাজি ইহুদি হয়ে থাকেন তবে সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। বেন পকেটে হাত ঢুকিয়ে ড. কোয়ালাস্কির দেওয়া সাদাকালো ছবিগুলোর স্ট্রিপখানা বের করে। ছবিগুলো বেশ আবছা (তারা ১৪০০ ডলারের গলাকাটা দামের ‘4-D’ আলট্রাসাউন্ড করায়নি)। কিন্তু বেন এর মধ্যেই একটি ছবিতে খোলা ক্যামলিন নোটবুকসহ বেশ কিছু ডিটেইলস খুঁজে বের করেছে। সে শিশুটির হাতের লেখা পড়তে পারেনি। তবুও, সে বুঝতে পারে যে ওই লেখার মধ্যে বেশ আত্মবিশ্বাসের ছাপ আছে। লেখা কাটাকুটি-মুক্ত এবং বেশ কিছু লাইন আন্ডারলাইন করা। পুরো দিন নষ্ট করার জন্য নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বেন ছবিগুলিকে একটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে সজোরে বন্ধ করে দিল। সে ল্যাপটপটি চালু করে, তার উপন্যাসটি খুলল, এবং স্ক্রিনের দপদপ করা ছোট্ট কার্সারটির দিকে তাকিয়ে রইল…
পরের দিন, সু-এর মা, জোন, স্কার্সডেল থেকে ড্রাইভ করে চলে এলেন। ওঁর পরনে একখানা ট্র্যাকস্যুট আর তাঁর পিছনে ঘুরছে একজোড়া মালপত্তর বহনকারী কমবয়েসি ছোকরা।
‘সবকিছু পরিষ্কার করতে শুরু কর!’ তিনি বেনের অফিস ঘরের দিকে নির্দেশ দিলেন।
‘আমাদের কি এখনই এই কাজটি করতে হবে?’ বেন তাকে আলতোভাবে জিজ্ঞাসা করল।
‘অপেক্ষা কেন?’ তিনি বললেন। ‘তুমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাচ্চাটি চলে আসবে।’
তিনি আঙুল দিয়ে ইশারা করতেই মালপত্তর গোছগাছ করা ছোঁড়াগুলো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বেনের ফাইলগুলি কার্ডবোর্ডের বাক্সে প্যাক করতে শুরু করল। বেন অনুভব করল সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। ওর বইখানা একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস—জেনারেল কাস্টারের শেষ লড়াই সম্পর্কে একটি পোস্ট-কলোনিয়াল মহাকাব্য, লিটল বিগহর্নের যুদ্ধ—যাকে কিনা আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা ‘পেছল ঘাসের যুদ্ধ’ হিসেবে চেনে। সে তার নোটগুলো ছাড়া এটি শেষ করতে পারবে না।
‘প্লিজ,’ সে তার শাশুড়িকে অনুরোধ করে। ‘তোমরা যা সরিয়ে ফেলছ তার সবকিছুই এখনও আমার ব্যবহারের জিনিস।’
জোন সুরেলা কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘তোমার এসবের অভ্যেস হয়ে যাবে, এখানে অনেক অদল-বদল হতে চলেছে।’
‘আমি জানি,’ বেন বলল।
‘ওই ডেস্কের বদলে, একটি চারপাশ-ঘেরা শিশুর বিছানা হবে। ওই প্রিন্টারের বদলে ডাইপার্স থাকবে, এবং তোমার উপন্যাসগুলির পরিবর্তে, তার উপন্যাসগুলি থাকবে…’
‘আরে, আরে, কী যে বললে,’ বেন শূন্যে হাত নাড়িয়ে বলল। ‘আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না যে শিশুটি কোনও ঔপন্যাসিক কি না। সে যে কোনও ধরনের লেখক হতে পারে। Pregnancy.com-এর মতে, তার শেষমেষ ব্লগার হয়ে ওঠার চল্লিশ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে।’
জোন চোখ ঠেরিয়ে মুচকি হেসে উঠল। ‘তুমি চাইলেই আর কি…’
‘তুমি কী বলতে চাইছ?’
তিনি তাকে খেলাচ্ছলে পাঁজরে খোঁচা দিলেন। ‘তোমার শিশুটির উপর ঈর্ষা হচ্ছে।’
বেন জোর করে হাসতে বাধ্য হল। ‘হাস্যকর, একদম নয়’।
‘রিল্যাক্স,’ সুসান বলে। ‘নতুন বাবাদের পক্ষে ঈর্ষা করা স্বাভাবিক। চিন্তা করো না। যখন সন্তানের জন্ম হয়, তখন তার দিকে একবার নজর বুলিয়েই জেনে ফেলা যায় কী করণীয়—’
‘আমি ঈর্ষান্বিত নই!’ বেন চেঁচিয়ে উঠল। সে বিব্রত বোধ করে। সে ভাবেনি তার প্রত্যাখ্যান এতটা আক্রমণাত্মকভাবে বেরিয়ে আসবে। সে শাশুড়ি আর বউয়ের দিকে একখানা পরিস্থিতি হালকা করা হাসি হাসলেও, তারা দুজন কিন্তু পাত্তাই দেয় না।
‘দেখুন, আমি দুঃখিত,’ সে বলে। ‘আমি একটি অধ্যায়ের ঠিক মাঝখানে রয়েছি। আমাদের কি দয়া করে ঠিক এই মুহূর্তে এই কাজটি না করলেই নয়?’ মুভার্সরা অনুমোদনের জন্য জোনের দিকে ফিরল।
নাটকীয়ভাবে কর্কশ ভঙ্গিমায় শূন্যে হাত ছুঁড়ল জোন। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি,’ সে বলল। ‘তবে আমরা ফিরে আসব।’
বেন অপেক্ষা করল যতক্ষণ না তারা সবাই চলে যায়, তারপর একঝটকায় ডেস্কের ড্রয়ারটি খুলে সোনোগ্রামটি আলোর দিকে ধরে রাখল। তার মনে একটাই চিন্তা: বাচ্চাটি কী লিখছে?
‘আমার মনে হল তুমি বলেছিলে, কত যেন, চৌদ্দোশো ডলার?’ বেন ওর পেটে আলমন্ড অয়েল ঘষতে শুরু করলে সু জিজ্ঞাসা করে। সে হাস্যোজ্বল হয়ে জবাব দেয়, ‘আসলে একটু কমই।’ ‘এই যেমন, তেরশো আশি।’
‘আমি জানি না,’ সে বলল। ‘একটুখানি বেশি ডিটেইলড সনোগ্রামের জন্যই এই দাম বেশি বলেই মনে হচ্ছে। মানে, এটি পাঁচ হাজার ডাইপারের সমান দাম।’
‘দুচ্ছাই!’ বেন খেঁকিয়ে ওঠে।
‘আরে!’ সু বলে, ‘কী হয়েছে সোনা?’
বেন একমুহূর্ত ভাবে।
‘আমার মনে হচ্ছে আমি প্যারানোয়েড’, বেন মিথ্যে বলে। ‘আমি ওকে দেখতে চাই—বাস্তবে দেখতে চাই, যাতে আমি ভরসা পাই যে সে একশো শতাংশ ঠিকঠাক আছে। তুমি জানো? ব্যস, নিজের মনের শান্তির জন্য।’
‘ওহ্ সোনা’, সে বলল। ‘আমি জানতামই না তোমার ওপর দিয়ে এতসব যাচ্ছে।’ সু সশব্দে চুমু খায়। ‘তুমি যদি এমনটা ভাব, তাহলে অবশ্যই আমি তোমায় সাপোর্ট করি।’
ডক্টর কোয়ালস্কি ওর হাইটেক 4-D স্ক্যানার চালানোর সময় স্বাভাবিকভাবেই খোশমেজাজে ছিলেন। কিন্তু চশমা পরে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ওর মুখ থমথমে হয়ে পড়ল। ‘মাই গড,’ তিনি মৃদু বিড়বিড় করেন। ‘হায় ভগবান।’
‘কী হল?’ সু ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে।
ডঃ কোয়লস্কি রিভলভিং চেয়ারখানা ঘুরিয়ে হাসেন। ‘আয়্যাম সরি’ তিনি বললেন। ‘শিশুটির স্বাস্থ্যের দিকে সব ঠিক রয়েছে! তবে ব্যাপারখানা হল যে ভ্রূণটি লিখছে। সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে দেওয়ার মতো বিষয় নিয়ে।’ তিনি অবাক হয়ে মাথা নাড়লেন।’ আমি ভুলেই গেছিলাম ঘরে অন্য লোকজনও রয়েছে! তোমরা কথা বলার আগে অবধি আমি এর মধ্যে ডুবে গেছিলাম।’
সু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে বেনের হাত চেপে ধরার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বেনের আঙুলগুলি ছিল অসাড়। সে লাফিয়ে উঠে তাড়াতাড়ি স্ক্যানারের দিকে এগিয়ে গেল। ‘বাচ্চাটা কীভাবে ওই টাইপরাইটারটি পেল?’ বেন অবাক হয়ে বলে ওঠে।
ডাঃ কোওলস্কির জোরাল দাবি, ‘পঁচিশতম সপ্তাহে এটা স্বাভাবিক’।
বেন খেয়াল করল যে ভ্রূণটি ভীষণরকম সুন্দর একখানা ভিন্টেজ আন্ডারউড টাইপরাইটার ব্যবহার করছে। এ ছোকরা অবশ্যই ঔপন্যাসিক এবং সম্ভবত কথাসাহিত্যিক।
নিজেকে স্বাভাবিক শোনানোর চেষ্টায় বেন জিজ্ঞাসা করে, ‘সে কী লিখছে?’
‘ঐতিহাসিক উপন্যাস,’ ডাঃ কোওলস্কি জানালেন। ‘আমেরিকান সিভিল ওয়ার এবং জেনারেল কাস্টার সম্পর্কে।’
বেনের হৃৎকম্প বেড়ে গেল, ‘সে জেনারেল কাস্টার সম্পর্কে লিখছে?’
‘হ্যাঁ,’ ডাক্তার বললেন। ‘তবে এটি তার চেয়ে অনেক বেশি। এটি সাসপেন্সফুল, লিরিক্যাল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এটি আমেরিকারই একদম নিজস্ব গল্প।
‘বাহ!’ সু বলল। ‘এটা চমৎকার ব্যাপার। তাই নয় কী, সোনা?’
‘সে আমার আইডিয়া চুরি করেছে,’ বেন তাদের পাঁচতলা ব্রুকলিন ওয়াক-আপ অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে বিড়বিড় করে।
‘এটি কীভাবে সম্ভব?’ সু জিজ্ঞেস করল। সে বেশ ক্লান্ত হয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
‘তারা গর্ভ থেকেই অনেক জিনিস শুনতে পারে,’ বেন বলল। ‘সে নিশ্চয়ই আমাকে প্লট নিয়ে বা এই সম্পর্কে কথা বলতে শুনেছে।’
‘কিন্তু তুমি তো কখনই নিজের কাজের বিষয়ে কথা বল না,’ সু যুক্তি দেখায়। ‘আমি বলতে চাইছি, আজ অবধি আমারই তো কোনও ধারণা ছিল না যে তুমি জেনারেল কাস্টার সম্পর্কে কোনও বই শুরু করেছ।’
‘না, না, আমি শুরু করছি না; আমি প্রায় শেষ করে এনেছি! দুচ্ছাই। আমি শেষ অধ্যায়ে!’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে,’ সু শান্তভাবে বলল। ‘একই জিনিস সম্পর্কে দুটি বই থাকতেই পারে, তাই না?’
কিন্তু বেন ছেলেমানুষের মতো সিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সু-কে তাই একা একাই দরজা অবধি যেতে হয়।
বেন তার অফিসে ফিরে এসে কিছুটা মানসিক হিসেবনিকেশ করতে থাকে। ভ্রূণটি তার উপন্যাসের শেষের দিকে এগিয়ে গেলেও সে আটকে রয়েছে সু-র গর্ভের ভেতরে। ভূমিষ্ঠ হওয়া অবধি লেখাটা শারিরীকরূপে পান্ডুলিপিতে পরিণত হতে পারবে না। নির্ধারিত তারিখটি ধরে, বেনের খসড়া শেষ করতে এবং প্রকাশকদের কাছে এটি জমা দেওয়ার জন্য হাতে পনেরো সপ্তাহ রয়েছে। সে দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপটি চালায়। তখনই তার ফোনটি বেজে উঠল—ম্যানহাটনের এক অজানা নম্বর।
‘ডাঃ. কোয়ালস্কি? ‘সে ক্লান্তিতে জবাব দেয়।
‘দুঃখিত, আমি কোয়ালস্কি নই!’ নম্র কণ্ঠের এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন। ‘আমি ওয়াইলি এজেন্সির পক্ষ থেকে বলছি। আপনি কি বেন হারস্টেইন? ‘বেন উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। সে সাহিত্য প্রকাশনাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিল এবং এই কদিনের মধ্যে তার এমন একটি ফোন কল আসা প্রত্যাশিত। ‘হ্যাঁ, আমি বেন বলছি!’ ‘বলুন কী ব্যাপার?’
‘আমি আপনার ছেলের কথা বলছি,’ ভদ্রমহিলা জানান। ‘আমি সরাসরি তার কাছেই পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, তবে বুঝতে পারলাম যে তিনি এখনও জন্মগ্রহণই করেননি। যাইহোক, আমি ভাবছিলাম তিনি আমাদের প্রকাশনা সংস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রহী কিনা।’ এজেন্টের মুখে ভ্রূণের কাজের অগ্রগতিতে প্রশংসা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বেনের মেরুদণ্ডের কেন্দ্রস্থলে এক তীব্র ব্যথা কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে। যদ্দূর জানা যায়, জনৈক অত্যুৎসাহী নার্স reddit.com – এ ভ্রুণের 4-ডি স্ক্যানখানা পোস্ট করেছিল এবং লিঙ্কটি ভাইরাল হয়ে যায়।
‘সে আগ্রহী নয়,’ বেন বলল।
‘আপনি কি নিশ্চিত?’ ‘হ্যাঁ!’ দরজায় হালকা নক শোনা যায়।
‘সোনা?’ ‘তুমি ঠিক আছ?’ সু জিজ্ঞেস করে।
‘আমায় একা থাকতে দাও!’ বেন বলল। ‘আমি কাজ করার চেষ্টা করছি!’
‘মা কাজের লোকদের নিয়ে এসেছে,’ সু বলল। ‘মনে নেই বুঝি? বাচ্চার দোলনা-বিছানা সেটআপ করতে হবে?’
বেন এক ঝটকায় দরজা খোলে, ‘আমি ঠিক করেছি,’ সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে। ‘আমার অফিস আমি কাউকেই দিচ্ছি না।’
সুসান মাথা নিচু করে, সে সত্যিই বিভ্রান্ত। ‘আমি বুঝতে পারছি না,’ সে বলে। ‘আমরা তো ইতিমধ্যেই এ নিয়ে কথা বলেছি।’
সে বেনের হাত ধরতে চায়, কিন্তু বেন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়।
‘তোমরা সবাই আমায় একলা ছেড়ে চলে দাও!’ বেনের গলা ছিঁচকাঁদুনের মতো শোনায়।
‘আরে সোনা, এদিকে এসো, ‘সু মাতৃসুলভ আদরে ডাকলেও একঝটকায় দরজা বন্ধ করে বেন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘না, না, না, না!’
বেন গত তিনমাস অবিচ্ছিন্নভাবে লেখালেখিতে কাটিয়েছে, আহার-নিদ্রা সব শিকেয় তুলে। তবে সে যতই উন্মত্তের মত কাজ করুক না কেন, ভ্রূণটি তার ঘাড়ে শ্বাস ফেলতে থাকে।
সু-র গর্ভাবস্থার ছত্রিশতম সপ্তাহে, দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিন ভ্রূণের অসম্পূর্ণ বইটি থেকে একটি অংশ প্রকাশ করে। বেন নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পুরোটা পড়তে না পারলেও প্রথম তিন কলাম চটজলদি পড়ে ফেলা থেকে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। এটা অবিশ্বাস্যভাবে ভয় দেখানো কাজ। ভ্রূণ সাহস করে জেনারেল কাস্টারকে সমকামী হিসাবে চিত্রিত করার জন্য বেছে নিয়েছিল। যেমন তেমন সমকামী নয়— পুরোদস্তুর সমকামী।
সে একটি কালো চামড়ার আফ্রো-আমেরিকান চরিত্রও অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং তার কথোপকথনগুলোও আফ্রো-আমেরিকান উপভাষায় লিখেছে, এবং বিষয়টিকে বেশ রুচিসম্মতভাবে পেশ করেছে। বেন লেখকসসূচির নোটগুলিতে ‘নামহীন ভ্রূণ’ হিসেবে ভ্রুণটিকে একজন ‘স্টাফ রাইটার’ হিসাবে তালিকাভুক্ত হতে দেখে বেজায় ভয় পেয়ে গেল।
পরের সপ্তাহগুলোতে বেন নিজের অফিসে আরও বেশি সময় এবং সুসানের সঙ্গে কম সময় কাটাতে থাকে। সে এখনও প্রতি সন্ধ্যায় সু-র পেট ম্যাসেজ করে, কিন্তু সেটাও তার কাছে অনুভূতিশূন্য একখানা কাজ যেন। পেট্রোলপাম্পের কম্পলিমেন্টরি গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাস মোছার মতো—ছুটে গিয়ে কয়েকবার যেমন তেমন করে মুছে দেওয়া।
রাতে সু বালিশ জড়িয়ে নাক ডাকালেও বেন পাতার পর পাতা লিখে যায়, পাল্টায়, ফের লেখে এবং তার উপন্যাসের চূড়ান্ত সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
‘মিষ্টিসোনা?’ সু বলল। ‘তুমি কি একবার আসতে পারবে?’
‘আমি একটু ব্যস্ত,’ সে কঠোরভাবে বলল। ‘একটু অপেক্ষা করতে পারো না?’
সে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘না’।
‘দ্যাখো, কে মুখ দেখানোর সাহস করেছে’, নির্বিচারে বেনের দিকে অবজ্ঞা ছুঁড়ে জোন বলে ওঠেন।
বেন চোখের যোগাযোগ এড়ায় এবং তার স্ত্রীকে ডেলিভারি রুমে অনুসরণ করে। সু একটি চাকা লাগানো স্ট্রেচার বিছানায় শুয়ে রয়েছে। তার চারপাশে কয়েকজন নার্স, জনৈক অ্যানাস্থেসিস্ট এবং বিখ্যাত পরিচালক স্কট রুডিন দাঁড়িয়ে, তিনি ভ্রুণের বইটি নিয়ে তার পরবর্তী সিনেমা বানানোর চেষ্টায় আছেন।
বেন স্ত্রীর কাঁধ স্পর্শ করে বলে, ‘তুমি একদম ঠিক আছ, কোনও চিন্তা করো না।’
‘কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষণ?,’ সু জিজ্ঞেস করে।
বেন জোর করে হাসে, ‘কি? কি বলতে চাও তুমি?’। সে সু-র মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। সু জোরে তার হাত চেপে ধরে। সু-র চোখগুলো সাদা আর গ্লসি হয়ে রয়েছে ওষুধের প্রভাবে, কপালে ঘামের পরত।
‘কোথায় ছিলে তুমি? খুব মিস করেছি তোমায়।’
বেনের গলা শুকিয়ে আসে, তার অপরাধবোধ হয়। সে ক্ষমা চাইতেই যাবে এমন সময় সু-র শরীর অতর্কিতে এক মোচড় দিয়ে ওঠে। বেন ভয় পেয়ে যায়, সু এক উষ্ণ-শুভ্র বেদনায় ককিয়ে ওঠে।
‘এই তো চলে আসছে! ইটস অ্যা বিগ ওয়ান!’, ডঃ কোয়ালস্কি বলে ওঠেন। নার্সরা খুব যত্নে সু-র যোনি থেকে পান্ডুলিপিটি বের করতে শুরু করেন, যাতে টাইটেল পেজ সামনের দিকে থাকে। বইটির নাম দ্য লাস্ট স্ট্যান্ড এবং কোনওভাবে পান্ডুলিপিটিতে জর্জ সন্ডার্সের লেখা প্রকাশকের মুখবন্ধও স্থান পেয়েছে।
কিছুক্ষণ পর শিশুটিও বেরিয়ে আসে। রেইমন্ডের ফ্যাশনদুরুস্ত টুইড ব্লেজার আর চোখে ওয়ার্বি পার্কারের ফ্যাশানদুরস্ত চশমায় তাকে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছিল। ডাক্তার তাকে তার মায়ের কোলে তুলে দেন। প্রথমদিকে তাকে শান্ত মনে হলেও একটু পরেই সে তারস্বরে কাঁদতে থাকে। সু তাকে চুমুতে-আদরে শান্ত করার চেষ্টা করলেও যত সময় যাচ্ছে তার কান্না বেড়েই যাচ্ছে— ঠিক যেন কারখানার সাইরেন।
‘এটা কি স্বাভাবিক?, বেন জিজ্ঞেস করে, ‘এ সব কী হচ্ছে?’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,’ ডঃ কোয়ালস্কি ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চোখে জবাব দেন, ‘এটা স্বাভাবিক কান্নার চেয়ে আরও বেশি কিছু, আমি বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’
শিশুটি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। বারবার আকাশে হাত ছুঁড়ছে। যতবার শিশুর সঙ্গে তার চোখাচোখি হয় ততবারই শিশুটির চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। বেন জীবনে এত অসহায় কাউকে দেখেনি। হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো তার মাথায় এক আইডিয়া খেলে— সে জানে তাকে কী করতে হবে।
বেন তার সন্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘরটির দিকে তাকায়, শিশুটির কান্না যেদিকটায় তাকিয়ে, সেখানে নার্সরা যত্ন করে পান্ডুলিপিটি রেখেছে।
‘কারুর কাছে কি একটা কলম হবে?’, সে জিজ্ঞেস করে।
জোন তাকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলে ওঠেন, ‘কলম দিয়ে আবার কি করবে তুমি!’
‘আরে বাবা, একটা কলম দাও তো দেখি!,’ বেন জবাব দেয়।
জোন ভ্রু কুঁচকে বেনের দৃঢ় প্রত্যয় দেখে সরে আসেন। পার্স হাতড়ে একখানা ক্লাসমেইট অক্টেইন বল পেন পেয়ে সেটা তুলে দেন বেনের হাতে।
‘সে পান্ডুলিপিটায় একদফা কারেকশান করতে চায়,’ বেন হাসপাতাল কর্মীদের বোঝায়। ‘এ কারণেই সে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ভুল-ত্রুটিগুলো এডিট করার আগেই বইখানা সমালোচকদের হাতে চলে যাবে এই ভেবে সে উদ্বিগ্ন।’
বেন সযত্নে তার ছেলের হাতে কলম ধরিয়ে দেয়। শিশুটি ভয় আর উদ্বেগ মেশানো সজল চোখে পান্ডুলিপির দিকে তাকায়। বেন শান্ত গলায় বলে, ‘আমি জানি এটা খুব কঠিন।’ সে ধীরে ধীরে পাতা উলটাতে থাকে, যাতে শিশুটি সবখানা পৃষ্ঠায় দৃষ্টি বোলানোর সুযোগ পায়। ছ’নম্বর অধ্যায় এলে শিশুটি হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে। বেন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কি এই পাতায়? এই পাতায় কি কিছু সমস্যা রয়েছে?’ শিশুটি এইবার ফোঁপাতে থাকে।
‘ঠিক আছে। শশশশশ সব ঠিক আছে,’ সে পান্ডুলিপিটি শিশুর একদম নাগালের কাছে নিয়ে এলে দুগ্ধপোষ্যটি কলম হাতে ক্ষিপ্রগতিতে একখানা গভীর বর্ণনামূলক প্যারাগ্রাফের অন্তিম লাইনে কাটছাঁট শুরু করে।
‘গুড কাট’, বেন বলে ওঠে।
শিশুটি একখানা লম্বা প্রশান্তির নিঃশ্বাস টেনে তার বাবার হাতে ঘুমিয়ে পড়ে। শিশুটির স্ফিত গাল, নরম তুলতুলে ওঠানাম করা বুক— বিশ্বাসই হয় না বেনের যে এমন একখানা সৃষ্টিতে সেও অংশগ্রহণ করেছে। সে স্ত্রীর দিকে তাকালে দেখতে পায় ওর চোখ ছলছল করছে।
‘আই লাভ ইউ সোনা,’ সু বলে ওঠে।
‘আই লাভ ইউ টু। চলো এইবার এই ছোট্ট মানুষটিকে নার্সারিতে নিয়ে যাওয়া যাক’, বেন জবাব দেয়।
মূল রচনা: সাইমন রিচ
Tags: অনুবাদ গল্প, গল্প, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, শামীম আহমেদ, সাইমন রিচ, সুমন দাস
ওয়াও! দুর্দান্ত আইডিয়া। লেখক বাবা ঠিকই কান্নার আসল কারণটা ধরতে পেরেছে। অনুবাদ খুবই সাবলীল ছিলো। শুভকামন রইল।
গল্পখানা খাসা, আর অনুবাদও সুন্দর।
অনুবাদ খুবই বিশ্বস্ত। তার ফলে প্রথমদিকে বাক্যগুলো অত্যধিক লম্বা আর প্যাঁচালো লাগছিল। কিন্তু গল্পটা গতি ফিরে পাওয়ার পর আর কোনোদিকে তাকানো গেল না।
কল্পবিজ্ঞানের আদলে একটি অতি চমৎকার রূপক কাহিনি পড়ার সুযোগ পেলাম এখানে। ধন্যবাদ জানাই।
দারুণ লাগল ।