শেষ বলে কিছু নেই
লেখক: শাম্ব চ্যাটার্জী
শিল্পী: ইন্টারনেট
অগাস্ট, ২০১৩
ক্যাম্পাসের পথ ধরে আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল কিম। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের কলেজ পার্ক ক্যাম্পাসটা বেশ বড়, প্রায় সাড়ে বারোশো একর জায়গা জুড়ে। সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাস, যার কেন্দ্রে রয়েছে ম্যাককেলিন মল। এমনকি নিজস্ব স্টেডিয়ামও রয়েছে। বিল্ডিংগুলো সব জর্জিয়ান স্থাপত্যের আদলে তৈরি। এখানেই পেইন্ট ব্রাঞ্চ ড্রাইভের ব্রেন্ডন আইরিবে সেন্টারে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র কিম। সাইবার সিকিউরিটি তার প্রধান বিষয়। আনমনেই হাঁটছিল সে। মাথার মধ্যে দ্রুত নানারকম চিন্তা পাক খাচ্ছিল। গত কয়েকমাস ধরে বয়ে চলা ঘটনাগুলো মেলানোর চেষ্টা চলছিল তার ভিতরে। কিছুতেই মন মানতে চাইছিল না, যে আজ তারই জন্য দেশবাসী এই ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছে। সেদিনটার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে কিমের। বড় আনন্দের দিন ছিল। কিম স্মৃতির হাত ধরে অতীতে ফিরে যায়।
রোজকার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কংক্রিটে বাঁধানো পথ ধরে ডিপার্টমেন্টের দিকে এগোচ্ছিল কিম। দূর থেকে দেখল গেটের সামকল্নেপ একটা হালকা ভিড় জমে উঠেছে। সাততলা আধুনিক স্থাপত্যঘেঁষা বিল্ডিংটা দূর থেকেই দেখা যায়। ও একটু অবাকই হল, কেননা এসময় সকলের ক্লাসে থাকার কথা। কিম নিজে বড় একটা লেকচার মিস করে না, কিন্তু সেদিন বিষয়টা ছিল অন্যরকম। ফাইনাল ইয়ারের প্রোজেক্ট সিলেকশনের রেজাল্ট ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। কিমের মাথায় সব ছাপিয়ে শুধু একটা কথাই ঘুরছিল। ডিপার্টমেন্ট টপার হিসাবে পছন্দের ল্যাব পাওয়া তার পাকা, কিন্তু এরপর…। এদেশে মাস্টার্স করবার খরচ অনেক। পড়াশোনার ইন্টার্নশিপের পাশাপাশি একটা কুরিয়ার সংস্থায় পার্টটাইম চাকরি সে জুটিয়েছে বটে, তবে তা যথেষ্ট নয়। স্কলারশিপের একটা ব্যবস্থা হলে সুরাহা হয়, তাহলে মেরিল্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি সেন্টারে মাস্টার্স পড়ার জন্য অন্তত তাকে আর ভাবতে হবে না। এখানকার সব ছাত্রই এই স্বপ্নটা দেখে। ক্যাম্পাসের কম্পিউটার আর ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দক্ষ মেধার ফলশ্রুতি এই সেন্টার। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিও একে মান্যতা দিয়েছে। আর তাই ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ভরসা আদায় করে নিয়েছে এই গবেষণা সংস্থা।
পিছন থেকে হঠাৎ ভেসে আসা পরিচিত আওয়াজে সংবিৎ ফেরে কিমের। অ্যান্ডি উইলিয়ামস। কিমের ক্লাসমেট। ঘুরে দাঁড়াতে অ্যান্ডি ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল।
-“খবরটা শুনেছিস?”
-“কোন খবর?”
-“এ তো দেখছি, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই…।”
-“মানে…!!!”
-“এই সেমিস্টারেও তুইই টপার। আর…।”
অ্যান্ডির প্রথম খবরটা কিমের কাছে নতুন নয়। কিন্তু আর কী খবর থাকতে পারে অ্যান্ডির কাছে? কিমের কৌতূহলের পারদ ক্রমশ চড়তে থাকে। অ্যান্ডির মিটিমিটি হাসি তাকে আরও অধৈর্য করে তোলে।
-“খামোখা কেন টেনশন বাড়াচ্ছিস! ঝেড়ে কাশলেই হয়।” বলে অ্যান্ডির দিকে তাকাল কিম।
-“আরে চটছিস কেন?” অ্যান্ডি বলে।
-“নাম করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘এথান ফাউন্ডেশন’ বেশ মোটা অঙ্কের স্কলারশিপ দিচ্ছে তোর নামে। মনে পড়ে, লাস্ট সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড নম্বর পাওয়ার জন্য ‘দ্য গেজেট’-এ তোর নামে বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল? সেখান থেকেই হয়তো খবর পেয়ে ওঁরা তোর খোঁজখবর করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাক তোর মাস্টার্স পড়ার খরচ নিয়ে আর তোকে ভাবতে হবে না।”
শেষের খবরটা শুনে কিম নিজের দুই কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না! এই সুযোগটা না পেলে তার স্বপ্নের ভরাডুবি ছিল আসন্ন। এই সংস্থা সম্পর্কে তার জ্ঞান সামান্যই। তবে টিভি-নিউজপেপারের দৌলতে যেটুকু জানে, ওই ফাউন্ডেশন নানা সৎ কাজে দান-খয়রাত করে থাকে। আবেগে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরল সে।
-“ওরে ছাড় ছাড়। ওদিকে সব ডিপার্টমেন্টের সামনে তোর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রফেসর সিম্পসন আজকের দিনটা সকলকে ছুটি দিয়েছেন সেলিব্রেট করার জন্য।” অ্যান্ডির কথায় হুঁশ ফিরল কিমের। দু’জনে ডিপার্টমেন্টের দিকে এগোল।
(২)
নভেম্বর, ২০১৮
রাত থাকতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। মাছ ধরার এই ট্রলারগুলো ছোটখাটো হলেও বেশ শক্তপোক্ত। নভেম্বরের এই সময়টা দিনেরবেলার তাপমাত্রা ৩০-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের আশপাশে থাকে। রাতে তাপমাত্রা নামলেও ততটা ঠান্ডা অনুভূত হয় না। তবে আজ হালকা ঝোড়ো হাওয়া রয়েছে। বাতাসের গতিতে বেশ বড় বড় ঢেউ উঠছিল। সমুদ্রের উপর আমাদের ট্রলারটা ওই সব ঢেউয়ের মাথা থেকে ক্রমাগত নীচে আছড়ে পড়ছিল। আমার সঙ্গী মৎস্যজীবীদের মুখে ভয়ের কোনও লেশ ছিল না। বরং আমার গন্তব্যের ব্যাপারে তাঁদের উৎকণ্ঠার মাত্রা ছিল বেশি। সংখ্যায় ওরা জনাসাতেক। অকুতোভয় বলা চলে। আর হবে নাই বা কেন, সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই তো ওদের কাছে নতুন কিছু নয়। নোনা জলের নেশা ওদের রক্তে, শিরায় শিরায় সেই নেশাই নিরন্তর বহমান। প্রথমটায় ওরা রাজি হয়নি। না, সমুদ্রে ভেসে পড়ার প্রস্তাবে নয়। ওরা রাজি হয়নি গন্তব্য ভূখণ্ডের কথা শুনে। জায়গাটা মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। শেষমেশ আমি ওদের বুঝিয়ে বলি ওদের অদ্দুর না গেলেও চলবে। মূল দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি পৌঁছে আমায় একটা ছোট্ট ডিঙির ব্যবস্থা করে দিলেই চলবে। আমি একলাই চলে যাব। এসব শোনার পরও ওরা ক্রমাগত মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাচ্ছিল। সব বুঝে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলাম। ট্র্যাভেলার্স পাউচ থেকে নোটের বান্ডিলটা বার করতেই দ্রুত ওদের চোখের ভাষার পরিবর্তন পড়ে ফেলেছিলাম আমি। আমার সঙ্গীবন্ধুদের কাছে ব্যাপারটা অজ্ঞাতই ছিল। ঘুণাক্ষরেও মুখ ফসকে তাদের সামনে কিছু বলিনি। বললে তারা আমাকে পরিবারের দোহাই দিয়ে যেতে দিত না। ঠিক হল সপ্তাহান্তে রওনা দেব আমরা।
বিধি ছিল বাম। সব কিছু ঠিকঠাক এগোলেও আবহাওয়া বাধ সাধল। তাছাড়া মেছুড়েদের কাছে খবর ছিল উপকূলরক্ষীদের বিশেষ টহলদারি চলবে ওইদিন। তাই ঠিক হল, দিনদুয়েক পর যাত্রা শুরু করা যাবেখন।
ঠিক দু’দিন পর এক নির্জন খাঁড়ি থেকে আমাদের ডিঙি সমুদ্রে পাড়ি জমাল। বুদ্ধিটা মেছুড়েদের। পরে বুঝেছিলাম সকলের চোখ এড়িয়ে অনতিদূরে সমুদ্রে অপেক্ষারত ট্রলারে পৌঁছনোর এটাই ছিল শ্রেষ্ঠ উপায়। আমার কাছে খবর ছিল চলতি বছরে সরকার অভীষ্ট গন্তব্যের উপর থেকে ‘রেস্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট’ তুলে নিয়েছে। তাই বিদেশি হলেও ধরা পড়ার ভয় আমি করিনি। কিন্তু মেছুড়েদের উপর উপকূল রক্ষীবাহিনী আর নৌসেনার নজরদারি চলতেই থাকে। তাই প্রতিটা পদক্ষেপ ওরা খুব সাবধানে নিচ্ছিল। আগেই বলেছি সেই রাতে আবহাওয়ার গতিক খুব সুবিধের ছিল না। ছোট্ট ডিঙি নৌকোটা ঢেউয়ের দাপটে খোলামকুচির মতো ভাসছিল। ডিঙির চালক নিপুণ হাতে দাঁড় বেয়ে ট্রলারের কাছে পৌঁছতে, অন্য মেছুড়ে খোলের ভিতরে গুটিয়ে রাখা কাছি ছুঁড়ে দিল উপরের দিকে। ট্রলারে দাঁড়ানো তার সঙ্গী অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সেটা লুফে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে বেঁধে দিতে ডিঙিখানা ধীরে ধীরে গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল। এরপর দড়ি ধরে একে একে ট্রলারে গিয়ে উঠলাম। রওনা হলাম মূল লক্ষ্যের দিকে।
পরদিন সকাল নাগাদ দূর থেকে প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা সবুজ দ্বীপের দর্শন পেলাম। পাশের সঙ্গী মেছুড়ে লোকটি ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে পৌঁছসংবাদ দিয়ে জানাল এর বেশি তাদের পক্ষে এগোনো অসম্ভব। ট্রলার থেকে সৈকতের দূরত্ব শ’চারেক মিটার হবে। আয়তনে প্রায় ষাট বর্গকিলোমিটারের অনেকটা চতুর্ভূজ আকারের দ্বীপটির বয়স প্রায় ষাট হাজার বছর। এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে থাবা বসাতে পারেনি। নিজের অজান্তেই ক্যামেরাটা জুম করে সেই নৈসর্গিক শোভার কৌমার্য উপভোগ করে চলেছিলাম। ফেনিল জলরাশির শব্দ ছাপিয়ে কানে বাজছিল শাটারের যান্ত্রিকতা। হঠাৎ চোখ আটকে গেল সৈকতের একধারে। অভীষ্টের খোঁজ পেল সন্ধানী মন। আঙুল তখনও ক্যামেরার বোতামে। যা দেখলাম, আশ্চর্য হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এও কি সম্ভব!
নাহ, আর দেরি করিনি। ভগবানের উপর ভরসা রেখে একাই ডিঙিনৌকোয় চেপে বসলাম আমি। যাওয়ার আগে ওদের আমার ক্যামেরাটা দিয়ে বলেছিলাম, আমার কিছু হলে যেন সেটা আমার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অদৃষ্টে যা আছে দেখা যাবে। ধীরে ধীরে দাঁড় বাইতে আরম্ভ করলাম। সমুদ্র শান্তই ছিল, কালরাতের অস্থিরতার লেশমাত্র সকালে ছিল না। তীরের যত কাছে এগোচ্ছিলাম, বুকের উত্তেজনা ততই যাচ্ছিল বেড়ে। সেটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় না আবিষ্কারের আনন্দে, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তীরে পৌঁছে ডিঙিটা দড়ির সাহায্যে খুঁটি পুতে আটকে আগে বুক ভরে বাতাস টেনে নিলাম। কে জানে পরে…। বুকপকেটে রাখা বাইবেলটা একবার হাত বুলিয়ে স্পর্শ করতে একটা অদ্ভুত সাহসে মন ভরে গেল। দৃপ্ত পায়ে সামনে পা বাড়ালাম। ঠিক তখনই বুকে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভুতি হল। কয়েক পা এগোনোর পর মুখ থুবড়ে পড়লাম। বাড়ির কথা বড্ড মনে পড়ছিল তখন।
(৩)
এপ্রিল, ২০১৫
সাধারণত বিমানযাত্রার সময় আমি খুব একটা ঘুমোই না। খুব দীর্ঘ যাত্রাসময় হলে আলাদা কথা। নাহলে পত্রপত্রিকার বা জার্নালের পাতা উল্টে সময়টা বেশ কেটে যায়। এবারে অবশ্য কাছাকাছিই যাচ্ছি। গন্তব্য কাঠমান্ডু। ইন্দিরা গান্ধি জাতীয় বিমানবন্দর থেকে ত্রিভুবন বিমানবন্দর ঘণ্টাদেড়েকের সফর। নেপালের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব বিভাগের আমন্ত্রণে যৌথ গবেষণার সূত্রে আমার এই আকাশযাত্রা। ওহ! কথায় কথায় পরিচয়টা বলা হয়নি। আমার নাম অমল ত্রিবেদী। রুরকি আইআইটি-তে ভূমিকম্প প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে পৃথিবীজুড়ে যে গবেষণা চলছে, আমি ও আমার গবেষণাদল সেই একই বিষয়ে আগ্রহী। গত দশ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছি আমরা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যেমন আগে থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনেকখানি ঠেকানো যায়, একইভাবে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও বিকল্প খোঁজার চেষ্টা চলছে নিয়ত। এব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ চার্পাক। উনিই প্রথম রেডন গ্যাসকে কাজে লাগিয়ে এক বিশেষ সংবেদনশীল যন্ত্র বানান। এই ধরনের পরীক্ষাই পূর্বাভাস পাওয়ার সবথেকে ভালো পদ্ধতি। রেডিয়াম থেকে উৎপন্ন এই গ্যাস পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই কমবেশি মাটির তলায় পাওয়া যায়। তেজস্ক্রিয়তার দরুন রেডন গ্যাস থেকে উৎপন্ন হয় আলফা কণা। খুব পাতলা একরকমের প্লাস্টিকের প্লেট আছে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যার নাম সলিড স্টেট নিউক্লিয়ার ট্র্যাক ডিটেক্টর। মাটির ৭০-৮০ সেন্টিমিটার নীচে রাখা ওই প্লেটে আলফা কণা ঢুকলে জটিল পারমানবিক প্রক্রিয়ায় যে ক্ষত বা গর্ত তৈরি হয় তা সহজেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ে। এইভাবে নিঃসৃত আলফা কণার সংখ্যায় যদি বড় কোনও তারতম্য ধরা পড়ে, তাহলে বলাই যায় মোটামুটি ৫০০ কিমি দূরত্বের মধ্যে সাত থেকে দশ দিনের মাথায় ভূমিকম্প হতে পারে। কেন এটা ঘটে, সেটা নিয়েই বিশ্বজুড়ে আমাদের গবেষণা। গোটা পৃথিবীতে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে তাই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ করে তথ্যসংগ্রহ আর বিশ্লেষণ করে নিরন্তর আমাদের প্রয়াস জারি। এই রে, পরিচয় দিতে গিয়ে বোধহয় ছোটখাটো একটা লেকচার দেওয়া হয়ে গেল। মাফ করবেন, পেশাগত বদভ্যাস আরকি! এবারের সফরে নেপালের গবেষক দলটার সঙ্গে ওদের পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বসব। সম্প্রতি মেলা কিছু কিছু তথ্য সত্যিই ভাববার মতো! কিছু ছোটখাটো কম্পন দেখা গেলেও সংবেদনশীল যন্ত্রে উল্লেখযোগ্য কোনও তারতম্য নজরে আসেনি! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাতে ধরা নেচার জিওসায়েন্সের পাতা ওলটাতে গিয়ে একটা প্রবন্ধে চোখ আটকে গেল। পড়তে পড়তে ডুবে গেলাম ওটার মধ্যে।
চটকা ভাঙল পাইলটের ঘোষণায়। ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করতে চলেছে আমাদের বিমান। পাশের উইন্ডো দিয়ে তাকাতে নজরে এল চারপাশের উচুঁ পাহাড়-পর্বতে ঘেরা উপত্যকার রমণীয় সৌন্দর্য। এখানে উড়োজাহাজ নামাতে যেমন সতর্ক থাকতে হয়, তেমনি ওঠানোর সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। আসলে বিমানবন্দরের নয় মাইল দূরে থাকা এক বিশাল পাহাড়ের জন্য রানওয়েতে কোনও উড়োজাহাজই সোজা নামতে পারে না। ওই পাহাড় পেরোনোর পরপরই দ্রুত বিমান অবতরণ করাতে হয়। তাছাড়া এখানে অটোমেটিক ল্যান্ডিং সিস্টেমও নেই। গতমাসেই টার্কিশ এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস এ৩৩০ ঘন কুয়াশার মধ্যে নামার সময় রানওয়ে থেকে সরে পিছলে ঘাসের উপর চলে যায়। বিমানের সামনের চাকা ভেঙে গিয়েছিল, আর তাই এই বিমানবন্দর সাময়িকভাবে আন্তর্জাতিক বিমানের জন্য বন্ধও করা হয়। এই মাসে উড়ান আবার স্বাভাবিক হয়েছে। পাইলটরা তাই অতিরিক্ত সতর্ক থাকেন। যাইহোক আমরা সফলভাবেই অবতরণ করলাম।
বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক টার্মিনালে সার্কভূক্ত দেশের জন্য আলাদা লাইনে দাঁড়ালাম। এই লাইনে কোনও ভিসা ফি লাগে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার পাসপোর্টে সিল লাগানোর পর লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরের প্রধান ফটকে চলে আসলাম। বাইরে বেরিয়ে প্রি-পেড ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে এগোলাম আমি। বহুবার যাতায়াত করায় জায়গাটা এখন আমার হাতের তালুর মতো চেনা। এখান থেকে শহরের কেন্দ্রস্থল ছয় কিলোমিটার দূরে। সময় লাগে প্রায় পঁচিশ মিনিট। তাড়াতাড়ি ফিরব বলে সঙ্গে এবারে বেশি লাগেজ আনিনি। কাউন্টারের ভদ্রলোক আমাকে দেখেই একগাল হেসে শুভেচ্ছা জানালেন। ঘনঘন আসার দৌলতে আমার মুখ তার চেনা। এঁদের আতিথেয়তা সত্যিই অতুলনীয়! আমাকে যেতে হবে কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কীর্তিপুর শহরে। ওখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস। ভাড়া মিটিয়ে চটপট ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম আমি। মাথার ভিতর তখনও ঘুরছিল পত্রিকায় পড়া প্রবন্ধটার কথা। তখনও অদূর ভবিষ্যতে ঘটতে চলা বিপর্যয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আভাস আমার ছিল না, থাকলে…
(৪)
এপ্রিল, ২০০৫
কন্ডোর এয়ারলাইন্সের ছোট বিমানটার চাকা ফেয়ারব্যাঙ্কস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করতে যাত্রীদের মধ্যে নামবার জন্য মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গ্রীষ্মের এই সময়টায় এরা ফ্রাঙ্কফুর্ট আর ফেয়ারব্যাঙ্কসের মধ্যে পর্যটকদের জন্য বিমানব্যবস্থা চালু রাখে। এই শহরটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম শহর। পঞ্চাশের দশকে এই বিমানবন্দর সিয়াটল আর পোর্টল্যান্ডের সঙ্গে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র ছিল। পরে ষাটের দশকে তা অ্যাঙ্করেজে স্থানান্তরিত হয়। বিমানবন্দরটি মূল শহরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫ কিমি দক্ষিণপশ্চিমে।
জেটব্রিজের সঙ্গে বিমানের সংযোগ হতে যাত্রীরা সব একে একে ছিমছাম স্থাপত্যের মেন টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। এদের মধ্যে এক মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোক দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিবাসন অফিসারের কাছে নিজের পাসপোর্ট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে, বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমান ক্যাবে নিজের ছোট্ট লাগেজসহ উঠে পড়লেন। ভদ্রলোককে নিয়ে গাড়ি উল্কাগতিতে শহরের দিকে রওনা দিল।
এই সময়টা ফেয়ারব্যাঙ্কসে মিডনাইট সান সিজন। এপ্রিলের মাঝ বরাবর থেকে অগাস্টের মাঝ বরাবর পর্যন্ত এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই সূর্যের আলোর রেশ থাকে। পর্যটকদের ভিড় তাই খারাপ নয়। শহরের অন্যতম সেরা হোটেল, হ্যাম্পটন ইন-এ ঠাঁই মেলা তাই বেশ কঠিন ব্যাপার। আগন্তুক ভদ্রলোকের ক্যাব সেখানে প্রবেশ করতে উনি নেমে সিধে হোটেলের লাউঞ্জে প্রবেশ করলেন। বোঝা গেল ক্যাবের ভাড়া আগেই মেটানো হয়েছে। উনি গিয়ে রিসেপশানে দাঁড়াতে কর্মরত লোকটি ওঁর হাতে একখানা বিলাসবহুল স্যুইটের স্মার্টকার্ড তুলে দিয়ে বলল, “আপনার রুম রেডি আর লাগেজ ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে।” মৃদু হেসে স্যুইটমুখো হলেন সেই আগন্তুক।
এদের স্টুডিও স্যুইট বেশ বড়সড়। ঘরে ঢুকেই ভদ্রলোক নিজের মুঠোফোনে একটা প্রাইভেট নাম্বার ডায়াল করতে ওপাশ থেকে ফ্যাশফ্যাশে গলায় আওয়াজ এল, “আশা করি আপনার প্লেনের সফর নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয়েছে। কাল সকাল সাতটা নাগাদ গাকোনা রওনা হবার জন্য আপনার ক্যাব রেডি থাকবে। ওখানে গাকোনা লজে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এসময়ে পর্যটকের ভিড় থাকার জন্য কেউ চট করে সন্দেহ করবে না। পৌঁছবার পর একটা ফোন কল পাবেন। সে আপনাকে বলবে, “অফসিজনে এলে ভাড়া কম লাগত।” উত্তরে বলবেন, “বন্ধুর বাড়িতে উঠলে ভাড়ার প্রয়োজন আছে কি?” এরপর সে আপনার সঙ্গে যে নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করতে বলবে, সেই সময়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেই আপনার কাজ হয়ে যাবে।” এরপর ফোনটা কেটে যেতে ভদ্রলোকের মুখে তৃপ্তির
ছাপ ফুটে উঠল। ধীর পায়ে ওয়াশবেসিনের পাশে রাখা কফিমেকারে ফিল্টার কফি বানাতে দিয়ে মৃদু শিস দিতে দিতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। শাওয়ারের তলায় দাঁড়াতে পথশ্রমের ক্লান্তি নিমেষে পালাল। স্নান সেরে পোশাক পাল্টানোর পর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভবিষ্যৎ রূপরেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। এই কাজটা সুষ্ঠুভাবে করতে পারলে দেশের প্রেসিডেন্ট খুশি তো হবেনই, উপরন্তু পুরস্কারও জোটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর নিজের অবশ্য পুরস্কারের মোহ খুব একটা নেই। তবে বিজ্ঞানের নতুন দিক উন্মোচনের অদম্য কৌতূহল তাঁর বরাবর। এবারের বিষয়টা নিয়ে বহুদিন গবেষণায় লেগে আছেন তিনি। কিন্তু কোথায় যেন একটা খামতি থেকে যাচ্ছে। সাফল্য ধরি ধরি করেও ধরা দিচ্ছে না। শেষমুহূর্তে ফাঁকি দিচ্ছে। হঠাৎই সুযোগটা এসে গেল। আমেরিকার টেক্সাস শহরে একটা কনফারেন্সে দেখা হল পুরনো বন্ধু সেওং জিন-এর সঙ্গে। তাঁরা দুজনেই আমেরিকার ক্যালটেক থেকে স্নাতক। গবেষণাও শেষ করেছেন একই জায়গায়। তারপর উনি দেশে ফিরে গেলেও সেওং আর ফেরেনি। নিজে দেশে ফিরে সরকারি গবেষণা সংস্থায় যোগদান করে। আজ সেখান থেকে ধাপে ধাপে পদোন্নতি হয়ে মুখ্য বিজ্ঞান উপদেষ্টার পদে আসীন। সেওং প্রথমে ক্যালটেকে থাকলেও মাঝের সময়টুকু তাঁদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না। সেদিন সেমিনারে দেখা হওয়ার পর দু’জনে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। কথায় কথায় জানতে পারলেন পরে সে ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কায় যোগ দেয়। আবেগের বশেই হোক বা পানীয়ের প্রভাবে সেওং-এর মুখ ফসকে তার কাজের কিছু আভাস পাওয়া গিয়েছিল। দু’জনের গবেষণার লক্ষ্য ছিল এক। এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, এব্যাপারে সেওং-এর কাজ প্রায় সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। বন্ধু হলেও সামান্য ঈর্ষা তাড়া করল ওঁকে। সেই সূত্রেই চর লাগালেন পরম বন্ধুর পিছনে। সরকারি সাহায্যে অঢেল পয়সা ব্যয় করলেন তথ্য জোগাড়ের ধান্দায়। ভস্মে ঘি ঢালা হল এক প্রকার! সেওং-এর অর্থলোভ কোনওকালেই ছিল না। সেটাই আবার প্রমাণিত হল।
এরকম এক মুহূর্তে হঠাৎ একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে ফোন এল ওঁর চেম্বারে! ওপ্রান্ত থেকে যে স্বর ভেসে এল তার সঙ্গে উনি সুপরিচিত। সেওং জিন স্বয়ং! বিমর্ষ গলায় সে যা বলল, তার সারমর্ম বেশ চমকপ্রদ! সেওং বলে, “নিজের আদর্শের সঙ্গে নিরন্তর এই লড়াই আর সহ্য হচ্ছে না বন্ধু। বিজ্ঞানের সাধনায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম মানুষের কাজে আসব বলে। অন্তত এতদিন সেই বিশ্বাসটাই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা আমার সেসব ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমার আলাস্কায় থাকার খবর তো তুমি জানো বন্ধু, যেটা জানো না সেটা হল আমার নিভৃত গবেষণার আসল বিষয়টা।” এরপর ছোট্ট বর্ণনায় নিজের কর্মকান্ডের বিস্তার তুলে ধরেছিল সে। সব শুনে ফোনের এপারে ওঁর শিরায় শিরায় রক্তস্রোতের প্রলয়নাচন শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেষে বলা সেওং-এর ছোট্ট তথ্যটা নাড়া দিয়েছিল সবথেকে বেশি। সাফল্য নাকি একেবারে দোরগোড়ায় উপস্থিত। আর সেটা হলে দুনিয়ায় আধিপত্য কায়েম করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার প্রয়োজন পড়বে না। সবশেষে সেওং-এর কথা থেকে তার ফোন করার আসল কারণ বোধগম্য হল। সেওং-এর বক্তব্য অনুযায়ী, সে এই আবিষ্কারের বিকেন্দ্রীকরণ চায়। তার মতে পৃথিবীতে দাদাগিরি ফলাবার এই জঘন্য ষড়যন্ত্র মানবতার পরিপন্থী। বিকেন্দ্রীকরণ হলে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধকে আটকানো যাবে। অবশ্য এই আবিষ্কার একা কারও হাতে থাকলে যুদ্ধ পর্যন্ত আদৌ কোনও কিছু গড়াত কিনা, সেব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল! কারণ সেটা এর মালিককে ভগবানের সমতুল করে ফেলত। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই সব ঘটত আর কী। যাই হোক, এরপর সেওং প্রযুক্তি পাচারের পুরো পরিকল্পনাটা খুলে বলে। আর ঠিক সেই কারণেই এই সফর।
পরদিন যথাসময়ে ক্যাবে গাকোনা অভিমুখে রওনা হলেন ভদ্রলোক। রিচার্ডসন হাইওয়ে ধরে গাকোনা যাওয়ার মজাই আলাদা। কম দূরত্ব বলে গাড়িতে বসে থাকার সময়টাও কম, আর এই রুটের যাত্রাপথের দৃশ্যাবলি দেখার মতো! ফেয়ারব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। অন্যদিকে আলাস্কা হাইওয়ে ধরে ডেল্টা থেকে টোক যাওয়ার পথ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব চিত্তাকর্ষক নয় এবং টোকে দেখার বা ঘোরার কিছুই নেই। টোক কাটঅফ ধরে টোক থেকে গাকোনা যাওয়ার পথে কিছু চমৎকার দৃশ্যাবলি রয়েছে, তবে রাস্তার অবস্থা খুব ভালো নয়। তাছাড়া টোক হয়ে গাকোনার যাওয়ার পথ প্রায় ১০০ মাইলের কাছাকাছি। ভদ্রলোকের ক্যাব অবশ্য দ্বিতীয় পথেই যাত্রা শুরু করল। কারণটা সহজেই অনুমেয়, লোকেদের চোখ এড়ানো। বিকেলের আগেই ভদ্রলোক গাকোনা লজে পৌঁছে গেলেন। পৌঁছে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নিলেন তিনি। পূর্বে উল্লেখিত ফোনকল আসার জন্য বেশি অপেক্ষা করতে হল না। ফোন বাজতে দ্রুত রিসিভার তুলে সৌজন্য বিনিময়ের শেষে সাংকেতিক শব্দের যথাযথ উত্তর দিতেই ওপাশ থেকে ওঁকে বলা হল বাইরের গাড়িতে মায়ারস লেক রোডহাউস মোটেলের রেস্তোরাঁতে চলে আসতে। সেখানে নির্দিষ্ট টেবিল বুক করা আছে।
রেস্তোরাঁটা বেশ ছিমছাম। পৌঁছে ভদ্রলোক নিজের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে বসলেন। উডেন ফিনিশের দেওয়াল ও ফ্লোরিং-এ আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। ছোট্ট কিন্তু লম্বাটে ঘরটার একপ্রান্তে হাই-চেয়ারে ঘেরা কাউন্টার, আর বাকি অংশটায় বসার টেবিল সাজানো। চারদিকের দেওয়ালে মাছ ধরার বিভিন্ন মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি। চেয়ারে বসে ভদ্রলোক কাউন্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ওঁর চোখ তখন ইতিমধ্যে কাউন্টারে টাঙানো খাদ্যতালিকায় নিবদ্ধ। উঁচু রাশভারী গলায় হাঁক দিয়ে একপ্লেট ম্যাকমায়ার অর্ডার করলেন তিনি। সসেজ, বেকন আর হ্যামে ভরপুর খাবারের নাম শুনেই বোঝা গেল খিদেটা বেশ জাঁকিয়ে পেয়েছে ওঁর। কিছু পরে খাবার পরিবেশিত হতেই হামলে পড়লেন ভদ্রলোক। খাওয়া শেষ হতে আইরিশ কফির স্বাদ নিতে নিতে ভদ্রলোক সাতপাঁচ ভাবতে লাগলেন। এই রেস্তোরাঁর অ্যান্টিক আর ট্যাক্সিডার্মির সংগ্রহের বেশ সুনাম রয়েছে। অপেক্ষার মাঝে চট করে সেখানা ঘুরে দেখতে পারতেন, অথচ ভদ্রলোকের সেব্যাপারে কোনও হেলদোল চোখে পড়ল না। বোঝা যায় ওঁর আগ্রহটুকু এখানে আসার প্রধান কারণেই সীমাবদ্ধ। এরমধ্যে সেখানে এক আগন্তুকের প্রবেশ ঘটল। লোকটি মাঝারি উচ্চতার, গায়ে ওভারকোট চাপান। ধীরে এগিয়ে এসে অপেক্ষমাণ ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে বসলেন। মৃদু আলাপচারিতার পর কোটের পকেট থেকে একটা সুদৃশ্য পারফিউমের কৌটো ভদ্রলোকের সামনে রাখল আগন্তুক। ভদ্রলোক তখন নিজের ল্যাপটপে কিছুক্ষণ খুটখাট বোতাম টেপাটেপির পর স্ক্রিনটা আগন্তুকের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হাসি খেলে গেল লোকটির মুখে। পাচারকারীর অ্যাকাউন্টে ততক্ষণে তার পারিশ্রমিক ট্রান্সফার হয়ে গেছে। পারফিউমটা ব্যাগে পুরে বিদায়সম্ভাষণ জানিয়ে গাকোনা লজে ফিরে এলেন ভদ্রলোক।
ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক সেই পারফিউমের ঢাকনা খুলে স্প্রেয়ারে চাপ দিতে খুট করে একটা শব্দ হয়ে সেটার তলার অংশটা থেকে একটা খোপ বেরিয়ে এলো। খোপের দিকে তাকিয়ে ওঁর মুখে হাসি খেলে গেল। সেওং-এর পাঠানো ওই ছোট্ট পেনড্রাইভেই রয়েছে সাফল্যের চাবিকাঠি।
পরদিন ভদ্রলোক গাকোনা থেকে ফেয়ারব্যাঙ্কস ফিরে এলেন। এরপর যথাসময়ে দেশে ফেরার বিমান ধরলেন তিনি। শুরু হল মারণ গবেষণার নতুন অধ্যায়।
(৫)
অগাস্ট, ২০১৫
মেরিল্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে জোরে পা চালাল কিম। মাস্টার্সের পড়াশোনা জোরকদমে চলছে তার। এখন অবশ্য ইন্টার্নশিপের সময়। ‘এথান ফাউন্ডেশন’-এর স্কলারশিপে সব ভালোই চলছিল, শুধু…। ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে যেদিন তার সঙ্গে দেখা করা হয় সেদিন কিমের মনটা ছিল খুশিতে ভরা। ওনাদের প্রতিনিধি হিসাবে তার কাছে এসেছিলেন মিঃ ইয়ুন মিন-জুন। প্রবাসী কোরিয়ান ভদ্রলোক প্রাথমিক কথাবার্তার পর কাজের কথায় আসেন। ওঁর কথানুযায়ী ‘এথান ফাউন্ডেশন’ দুনিয়া জুড়ে নানা জনহিতকারী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। আর এই সমস্ত প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা আসে ওনাদের বিভিন্ন রিয়েল-এস্টেট ইন্ডাস্ট্রি ও ব্যাঙ্কিং সংস্থার বাৎসরিক লাভের পয়সা থেকে। সম্প্রতি এই ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় একটা সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। বিশ্বজোড়া শাখা ছড়ানো ব্যবসায় ঋণখেলাপির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ব্যবসার মূলধনের জোগান যদি এইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে দেউলিয়া হতে আর দেরি নেই।
কিমের প্রথমে মাথায় ঢুকছিল না এসব কথা ওর কাছে তোলার মানে কী? তার মতো এক ইউনিভার্সিটি ছাত্র এসব জেনে করবেই বা কী! মিঃ ইয়ুন মিন-জুনের পরের কথাগুলোয় ব্যাপারটা তার কাছে কিছুটা স্পষ্ট হল। উনি বললেন যে ব্যাঙ্ক এই ঋণখেলাপি গ্রাহকদের চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে ওই পয়সা উদ্ধার করে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করে এদের জব্দ করা মুশকিল। তার আগেই বিদেশি পাসপোর্ট আর নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করে তারা অন্য দেশে পালিয়ে গিয়ে আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সংস্থার ম্যানেজমেন্ট বুদ্ধি একটা বার করেছে বটে। কোনওভাবে যদি এদের কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করে তথ্য জোগাড় করা যায়, তবে ভয় দেখিয়ে অর্থ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। বিট কয়েন ব্যবস্থার মাধ্যমে রাতারাতি পয়সা ট্রান্সফার হয়ে যাবে। ধরার কোনও রাস্তাই থাকবেনা। কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পুরো ব্যাপারটাই প্রশাসনের চোখে সম্পূর্ণ বেআইনি। তবে পুলিশ বা ইন্টারপোলকে জানিয়ে এর সুরাহা করা একপ্রকার অসম্ভব। এই কাজেই কিমের সাহায্য প্রয়োজন। হ্যাকিং-এ পারদর্শী কিম যদি কাজটা করতে পারে, তাহলে ফাউন্ডেশন তার ভবিষ্যতের উচ্চতর গবেষণার সমস্ত খরচের ভার নেবে। সব শুনে কিম কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাতে মুহূর্তের মধ্যে মিঃ জুন-এর মুখের হাবভাব গেল পুরো বদলে। ঠান্ডা গলায় চোয়াল শক্ত করে কেটে কেটে যা বললেন তার মানে একটাই দাঁড়ায়। কিম গররাজি হলে ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে তার স্কলারশিপ তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে নেওয়া হবে। সবাই ভাববে পারফরম্যান্স ভালো না হওয়ার জন্য সে বাদ পড়েছে। আর সেটা হলে শুধু তার মাস্টার্সের স্বপ্নই চুরমার হবে না, কেরিয়ারেও কালো দাগ পড়বে। পরিস্থিতির জটিলতায় কিম শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় কালান্তক খেলা।
(৬)
নভেম্বর, ২০১৮
এয়ার ইন্ডিয়া-র ফ্লাইট পোর্ট ব্লেয়ারে অবতরণের মুহূর্তে বিমানের জানালা থেকে নীচের নীল সমুদ্রে ঘেরা সবুজে ভরা জায়গাটার অপরূপ রূপরেখা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল প্রফেসরের চোখে। একমাত্র রানওয়ের কাছাকাছি আসতেই আশপাশের জনবসতির আভাস পাওয়া গেল। প্রফেসর ধীমান বাগচি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভারত সরকার এবারে ওঁর উপর এক গুরুদায়িত্ব সঁপেছেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক অনভিপ্রেত মৃত্যুকে নিয়ে এখন দেশসহ গোটা দুনিয়া তোলপাড়। এক আমেরিকান পর্যটক স্থানীয় নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে গিয়ে দ্বীপের অধিবাসীদের ছোঁড়া তিরে মারা গেছেন। ওঁর সঙ্গী মেছুড়েদের দল ধরা পড়ার পর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে ভদ্রলোক একাই ওখানে যাবেন বলে জেদ ধরেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার। ডিঙিনৌকো থেকে নেমে বালিয়াড়ি ধরে এগোনোর সময় ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা তিরে আহত হলে অধিবাসীরা এসে ওর দেহটাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে মৃতদেহটা সমুদ্রের দিকে মুখ করে বালিতে পুঁতে দেয় তারা। মেছুড়েরা ভদ্রলোককে বাঁচানোর তাগিদে দ্বীপের দিকে সামন্য এগোতেই ওরা অনর্গল তির ছুঁড়তে থাকে। সেই দেখে পিছু হটে আসে মেছুড়ের দল। হাজার চেষ্টা করেও সেই আমেরিকান পর্যটকের দেহ উদ্ধার করা যায়নি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন আর নৌসেনা তার দায়িত্ব নিয়েছে।
প্রফেসরের ডাক পড়েছে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। প্রফেসরের পরিচয় আপনারা সকলেই জানেন। উনি কলকাতার স্বনামধন্য ইনস্টিটিউট অফ ফরেনসিক সায়েন্সের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও ডিরেক্টর পদে আসীন। এর আগে বহু জটিল কেসের সমাধান করেছেন হেসেখেলে। এবারের ঘটনায় বড় অদ্ভুত কারণে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। মেছুড়েদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ওই পর্যটকের ক্যামেরা আর তাদের লক্ষ্য করে ছোঁড়া উদ্ধার হওয়া তির যত মাথাব্যথার কারণ। ফরেনসিক যাচাইয়ের পর পাওয়া তথ্য সত্যিই গভীর চিন্তার বিষয়। তিরের ডগায় পাওয়া গিয়েছে মারাত্মক বিষ রিসিনের উপস্থিতি। রিসিন মূলত ক্যাস্টর বীজ থেকে ক্যাস্টর অয়েল তৈরির সময় পাওয়া বর্জ্যাবশেষ থেকে তৈরি হয়। এই বিষ দেহে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে শরীরকোষকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরিতে বাধা দেয়। ফল মৃত্যু। আশ্চর্যের বিষয় হল সেন্টিনেলিরা আদিম জীবনযাত্রায় অভস্ত্য অনগ্রসর জাতি। তাদের তিরে রিসিনের মতো বিষের উপস্থিতির কোনও ব্যাখ্যা মেলা ভার হয়ে উঠেছে! গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মিলেছে আর এক ভয়ঙ্কর তথ্য। ওই পর্যটকের ক্যামেরায় তোলা ছবিতে ধরা পড়েছে আদিবাসীদের এক বিস্ময়কর ছবি! তাদের শরীর ঢাকা রয়েছে সূক্ষ্ম বর্মের মতো এক আচ্ছাদনে। সভ্যতার আলো যেখানে প্রবেশ করতে পারেনি, সেখানে এই ঘটনা বিশ্বাস করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু ছবিগুলো নগ্ন সত্যকে ঢাকা দিতে পারছে কই! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুরোধে প্রফেসর বাগচি তাই ঘটনার তদন্তে সাহায্যের সমস্ত দায়ভার নিয়েছেন। ওঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্কও রীতিমতো ধন্দে পড়েছে। প্রশাসন ও নৌসেনা তদন্তের স্বার্থে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার আর ড্রোন পাঠিয়েছিল। তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় ছুটে এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা বিষাক্ত তির। ছুটে আসা তিরে জখম সেনার রক্তেও মিলেছে রিসিনের উপস্থিতি। প্রাণভয়ে ভীত এক সেনা সরকারি নিয়ম ভুলে ওই সময় হেলিকপ্টার থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়লেও তা দ্বীপের অধিবাসীদের পরা সূক্ষ্ম বর্ম ভেদ করতে পারেনি! দ্বীপের অধিবাসীদের কোনওরকম অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুও সরকারের কাম্য ছিল না। আর তাই এরপর সেনাবাহিনী আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি, তবে রুটিন টহলদারি চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ছবিগুলো নিজের ল্যাপটপে বসে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে জুম করে দেখতে গিয়ে বিদ্যুৎচমকের মতো একটা তথ্য মাথাচাড়া দেয় প্রফেসরের মনে। দ্রুত নেট ঘাঁটতে শুরু করেছিলেন প্রফেসর। তাতেই বেরিয়ে এল সাম্প্রতিক এক চাঞ্চল্যকর তথ্য!
কিছুদিন আগে মিশিগান ভিত্তিক একটি জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা ফিউচুরা বায়োক্র্যাফট ল্যাবরেটরি আমেরিকান আর্মিকে স্পাইডার সিল্ক থেকে তৈরি কিছু পরীক্ষামূলক বুলেটপ্রুফ বর্ম সরবরাহ করেছে। এই বর্মগুলো ড্রাগন সিল্ক থেকে তৈরি। স্পাইডার সিল্ক এক শক্তিশালী প্রাকৃতিক তন্তু, কিন্তু বড় আকারে এর উৎপাদনে কিছু সমস্যা রয়েছে। মাকড়সারা অনেক সময় নিজেদেরই আক্রমণ করে সাবাড় করে দেয়, আর তাই মাকড়সা খামার বানিয়ে বড়মাত্রায় সিল্ক বানানোর ক্ষেত্রে এই পথ অবলম্বন করা সম্ভব হয় না। সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণার পর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে রেশমকীটে ওই জিন সন্নিবেশিত করে এক যৌগিক রেশম বানিয়ে ফেলেন। এই নতুন আবিষ্কারের প্রসার্য শক্তি ১.৭৯ গিগাপাস্কালের সমতুল, আর স্থিতিস্থাপকতা ৩৮ থেকে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। তাদের দাবি ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী এই আবিষ্কৃত বর্ম পড়ে রীতিমতো দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবে।
এই পর্যন্ত পড়ে প্রফেসর থমকালেন। তাঁর মাথার শিরাগুলো উত্তেজনায় রীতিমতো দপদপ করছিল। দুটো ঘটনা কী করে মেলাবেন কিছুতেই ওঁর বোধগম্য হচ্ছিল না। অথচ ইন্টারনেটে পাওয়া ছবিগুলোর সঙ্গে পর্যটকের ক্যামেরা আর সেনাবাহিনীর ড্রোনে ধরা পড়া ছবিগুলোয় বড় অদ্ভুত মিল! রানওয়েতে বিমানের চাকা স্পর্শ করতে শরীরে মৃদু ঝাঁকুনি অনুভব করলেন প্রফেসর বাগচি। তাঁর চিন্তাসূত্র কিছুক্ষণের জন্য ছিন্ন হল। বাইরে তাকাতে দেখলেন বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নীল-সাদায় মেশানো বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে। তাঁর দু’ঘণ্টার বিমানসফরের আপাতত এখানেই ইতি। জেটব্রিজ না থাকায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্য যাত্রীদের অনুসরণ করে সামনে অপেক্ষমাণ বাসে উঠে পড়লেন প্রফেসর। লাগেজ সংগ্রহের পর বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়ানো সরকারি গাড়িতে উঠে পড়লেন তিনি। রওনা হলেন সেনাবাহিনীর গেস্ট হাউসের দিকে।
(৭)
সেপ্টেম্বর, ২০১৮
উত্তর কোরিয়ার পূর্ব প্রান্তে সাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত কুমগানসান নামের অরণ্যময় পার্বত্য এলাকা। কুমগানসান দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত। মনোরম দৃশ্যের জন্য পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস। এখানে তাই টাকাপয়সার লেনদেন সব ডলারে মেটানো হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করলে অবিভক্ত কোরিয়া দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৫০ সাল নাগাদ এই দেশ সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শ অনুসরণ করে, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার মতাদর্শে চালিত হয়। মার্ক্সবাদ বা লেনিনবাদ নয়, বরং চুছে (Juche) বা “স্বনির্ভরতা” হল দেশটির বর্তমান সরকারি রাজনৈতিক দর্শন। আর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টিই হল দেশটির একমাত্র শাসক রাজনৈতিক দল। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর গুলিতে পার্ক ওয়াং-ইয়া নামে এক দক্ষিণ কোরীয় পর্যটকের মৃত্যু হলে দু’দেশের পর্যটন সম্পর্কের অবনতি হয় যা আজও বজায় রয়েছে।
পিয়ং ইয়াং মেট্রোর চোলিমা লাইনের কেসন স্টেশন থেকে এক ভদ্রলোক মেট্রোয় উঠে চারপাশে নজর বুলিয়ে কোণের ফাঁকা সিটে গিয়ে বসলেন। পিয়ং ইয়াং মেট্রো হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে গভীর পাতালরেল। প্রায় ১১০ মিটার, মানে ৩৬০ ফুটের কাছাকাছি। অফিস টাইমের ব্যস্তসময় হলেও কোলাহল খুব একটা নেই! বোঝা যায় কাজের সময়টুকু কাজ ছাড়া অন্য বিষয়ে মন দেওয়ার সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই এ শহরের অভিধানে অন্তত নেই। আগন্তুক ভদ্রলোকও এবিষয়ে ব্যতিক্রমী নন। মুখ দেখে সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল ওঁর মনের উত্তেজনার কথা। ঠিক সেই সময় ভদ্রলোক মনে মনে বলে উঠলেন, “যাক বাবা নিশ্চিন্দির ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট যে এত সহজে গবেষণার ভবিষ্যৎ অনুদান মঞ্জুর করে দেবেন… অবশ্য বিনিময়ে এযাবৎ আমার সাফল্যও নেহাত কম নয়। দুনিয়া দেখবে এই শর্মা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। শুধু…” শেষে আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি। আসলে থেকে থেকে একটা যন্ত্রণা ওঁকে কুরে কুরে খায়। অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর স্মৃতি, সহজে ভোলা খুব মুশকিল। সব থেকে কষ্টের নিজের সৃষ্টিকে হারানোর। এখন অবশ্য সেই ক্ষতে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়েছে। তাঁর তুলে দেওয়া নতুন আবিষ্কারে প্রেসিডেন্ট যারপরনাই খুশি। একটা আবিষ্কার আপাতত দুনিয়ার ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্টের অর্থের জোগান নিয়ে চিন্তা দূর করার দুর্দান্ত হাতিয়ার। বাকি দুটো তো লাজবাব। এর প্রথমটা সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য বর্মের চাহিদা পূরণ করা ছাড়াও আর একটা কাজে…। আর দ্বিতীয়টা সত্যিই চমকপ্রদ। আদতে অ্যারাকনোলজি নিয়ে গবেষণা করলেও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অন্য শাখাও তাঁকে সমানভাবে উৎসাহী করে এসেছে চিরকাল। সুইডেনের লিঙ্কোপিং ইউনিভার্সিটির এক গবেষণাদলের সঙ্গে এবিষয়ে কিছুদিন কাজও করেছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার আজ তাঁর হাতের মুঠোয়। ইতিমধ্যে তার ফলও ফলতে শুরু করেছে। শুধু দেশে নয় বিদেশেও। প্রেসিডেন্ট আজ তাই দুহাত উপুড় করে দিয়েছেন তাঁর গবেষণায়।
চটকা ভাঙল মেট্রোর ঘোষকের আওয়াজে। তাঁর গন্তব্য এসে গিয়েছে। ইয়ং ওয়ান স্টেশনে দরজা খুলতে ধীর পায়ে নেমে গেলেন তিনি। পেপার টিকেটখানা জমা করে বারমুখো হলেন ভদ্রলোক। অ্যালুমিনিয়ামের মুদ্রা টিকেট ধীরে ধীরে বন্ধ হলেও সব স্টেশনে এখনও স্বয়ংক্রিয় টিকেট স্ক্যানার মেশিন পুরোদমে চালু হয়নি। এখান থেকে পিয়ং ইয়াং সেন্ট্রাল রেলস্টেশন খুব কাছে। তাঁকে রাসন যেতে হবে। তারপর র্যাঞ্জিন স্টেশনে নেমে ক্রুজে করে কুমগানসান। সেখানে পাহাড়ে ঘেরা নিভৃত গবেষণাগার তাঁর অপেক্ষাতে।
(৮)
নভেম্বর, ২০১৮
গেস্ট হাউস থেকে নৌসেনার সদর দপ্তরের দিকে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিল সেনাবাহিনীর সাদা রঙের গাড়িটা। গাড়িতে বসা প্রফেসরের মাথায় তখন বিভিন্ন তথ্যসূত্রের ভিড়। এখানে আসার পর গত কয়েক দিনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে। সেগুলোর ব্যাখ্যাই খুঁজে চলেছেন উনি। হপ্তাখানেক আগে নৌসেনার টহলদারি দল রুটিন নজরদারির সময় দ্বীপের এক অধিবাসীকে উদ্ধার করেছে। প্রাথমিক অনুমানে সবাই ভেবেছিল লোকটা বোধহয় ডিঙি নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে সামুদ্রিক ঝোড়ো আবহাওয়ার শিকার হয়েছে। যদিও সেন্টিনেলিরা অল্প গভীর জলে মাছধরায় পটু, সাধারণত গভীর সমুদ্রের দিকে যায় না। জ্ঞান ফেরার পর সেই ভুল অচিরেই ভেঙে যায়। কথা বলার সুবিধার জন্য এক ওঙ্গে উপজাতির লোককেও সঙ্গে রাখা হয়েছিল। লোকটার চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে পরিচিত ভাষায় কথা বলতে পরিষ্কার ইংরেজিতে প্রশ্ন ভেসে এল, “হোয়্যার অ্যাম আই?” সেনার লোকেরা তখন হতভম্ব! কর্তব্যরত অফিসার এগিয়ে এসে জায়গার নাম বলতে লোকটা একেবারে মৌনতা অবলম্বন করল। শুধু থেকে থেকে একটা কথাই সে অস্ফুটে উচ্চারণ করে চলল, “আই হ্যাভ টু গো ব্যাক।” তাকে দিয়ে আর কোনও কথাই বলানো গেল না।
বেশ কিছুক্ষণের ব্যর্থ চেষ্টার পর অফিসাররা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লোকটাকে সেনা হাসপাতালে নিয়ে গেল। উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা। আসলে ২০১১ সালের সরকারি জনগণনা মতে এই অধিবাসীরা এমনিতেই সংখ্যালঘু, আর তাই লোকটার জীবন নিয়ে কোনওরকম ঝুঁকি ওঁরা নিতে চাননি। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি প্রফেসরের পরামর্শে লোকটার রক্তের নমুনা কলকাতায় ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে জমা করা হয়। এরই সঙ্গে উদ্ধারের সময় লোকটার শরীরে পাওয়া বর্মের মতো পোশাকটা খুলে কেন্দ্রীয় সেনা গবেষণাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সকালেই প্রফেসরের সমিধের সঙ্গে কথা হয়েছে। সমিধকে আপনারা সকলেই চেনেন। ইন্সটিটিউট অফ ফরেন্সিক সায়েন্সের ফরেনসিক এন্টোমোলজি বিভাগের প্রধান। রোঁয়া-র কেসটায় এই সমিধই জটিল জিন সংযোজনে তৈরি মাকড়সার রহস্য সমাধান করেছিল। সমিধের কাছ থেকে সেন্টিনেলি উপজাতির লোকটার রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে অবাক করা খবর পেলেন প্রফেসর! উপরি পাওনা হিসাবে সমিধ আরও যা বলল, সেটা ওঁকে চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট!
রক্ত নমুনার জেনেটিক বিশ্লেষণের পরে লোকটার ডিএনএ-তে কিছু নতুন জিনের খোঁজ মিলেছে যা আর যাই হোক মানুষের শরীরে পাওয়া অসম্ভব! অন্য প্রজাতির জিন মানচিত্র ঘেঁটে মিলেছে এক আশ্চর্য তথ্য! সারমেয় দেহে উপস্থিত কিছু জিনের সঙ্গে লোকটার শরীরে মেলা ওই জিনগুলোর অদ্ভুত মিল! এরপর চটজলদি জিনোম ডেটাবেসের তথ্যভাণ্ডার তোলপাড় করে সমিধ খুঁজে বার করে, সুইডেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল সারমেয় জিন নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ওই প্রাণীদের উন্নত সামাজিকতা বোধের জন্য দায়ী জিনগুলোকে খুঁজে বার করেছিলেন। কিন্তু সেই জিন কী করে মানুষের শরীরে আসবে! সেই মুহূর্তে একটা সম্ভাবনাই আলোড়িত হচ্ছিল সমিধের মনে। উদ্ধার হওয়া উপজাতির লোকটির জিন বিশ্লেষণে মেলা ওই জিনগুলোর উপস্থিতি শুধু একভাবেই হওয়া সম্ভব। সেটা হল জিন থেরাপির ব্যবহার। রেট্রো ভাইরাল জিন থেরাপি আজকাল ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও কাজে লাগে। এই ভাইরাল ভেক্টরের সাহায্যে মানবকোষের জিনোমে জিনগত স্থায়ী পরিবর্তন করা সম্ভব। প্রকৃতিগতভাবে এই পরিবর্তন কোনওমতেই হতে পারে না।
শুনে প্রফেসর ভুরু কুঁচকেছিলেন। মানুষের শরীরে এহেন ছুরিকাঁচি চালানো কোনও দেশেই আইনসিদ্ধ নয়। এতবড় কাণ্ডের মূল কাণ্ডারী তবে কে? কার পক্ষে সরকারের চোখ এড়িয়ে এই কারিকুরি করা সম্ভব? আর তার দরকারটাই বা কী?
এরপরই সমিধ তাঁকে আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে। সম্প্রতি দেশের সবথেকে বড় বিজনেস টাইকুন মিঃ পরেশ আম্বানি হঠাৎই রহস্যজনকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। সকালবেলা ভদ্রলোক গলফ খেলার শেষে নিজের ফার্মহাউসের লনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওঁর বেয়ারা সরবতের গ্লাস নিয়ে সেখানে পৌঁছে দেখে উনি আরামকেদারায় এলিয়ে পড়ে। প্রথমে সবাই মাইনর হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা বলে সন্দেহ করলেও ডাক্তারি রিপোর্টে অন্য কারণ মিলেছে। ওঁর রক্তে হালকা মাত্রায় আলফা-ল্যাট্রোটক্সিন পাওয়া গেছে। এই নিউরোটক্সিন বিষ নর্থ আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার কুখ্যাত ব্ল্যাক উইডো মাকড়সার দংশনে বেরোয়। ভারতে এই প্রজাতির দেখা মেলে না। তাহলে…
প্রতক্ষ্যদর্শী বেয়ারা পরে পুলিশের কাছে জানায়, এক মুহূর্ত দেরি না করে মিঃ আম্বানিকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে অ্যাম্বুল্যান্সে ওঁর শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আর সঙ্গে ছিল মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা, প্রলাপ বকা আর মারাত্মক খিঁচুনি। বিষের মাত্রা কম থাকায় উনি কোনওক্রমে রক্ষা পান। পরে তদন্তকারী ফরেনসিক দলের সঙ্গে সমিধও সেখানে যায়। প্রথমটায় কিছু নজরে না এলেও হাতের ছাপ আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় সূত্র সংগ্রহ করে বেরোবার মুখে হঠাৎ তার নজরে পড়ে একটা বিশেষ জিনিসে। মিঃ আম্বানির বসবার চেয়ারের ঠিক পাশের বাহারি গাছে ঝুলতে থাকা একটা মাকড়সার জালে। সেটা বেশ অন্যরকম। সেটার উপরে যেন বেশ সুন্দর ইংরাজি ‘Y’ অক্ষরের আদলে অলংকরণ করা। নিজের সামান্য বিদ্যায় সে এটুকু বুঝতে পেরেছিল, এই জাল সিগনেচার স্পাইডার নামে এক বিশেষ প্রজাতির মাকড়সার কীর্তি। গোটা বিশ্ব জুড়েই এরা ছড়িয়ে আছে। খটকা লেগেছিল অন্যখানে। এই প্রজাতির মাকড়সারা তাদের তৈরি জালে সবসময় ইংরাজির ‘X’ অক্ষরের অলংকরণ করে থাকে। তারপর জালের ঠিক মাঝখানে ওই অক্ষরের সঙ্গে পা মিলিয়ে শিকারের জন্য ওত পেতে বসে থাকে। নতুন আদলের কোনও ব্যাখ্যা তার মাথায় এল না।
এরপরে সে বাড়ি ফিরে ক্যামেরায় তোলা অকুস্থলের ফটোগুলো ফের খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে। বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা আশঙ্কার কথা তখনই তার মাথায় খেলে যায়! নিজের স্বাভাবিক কৌতূহলে সে ওই মাকড়সাটাকে সংগ্রহ করে এনেছিল। দ্রুত কাচের জারে রাখা প্রাণীটাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেয় ফরেনসিক এন্টোমোলজি ল্যাবের দিকে। সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে ওটার ডিএনএ থেকে পাওয়া তথ্য আর বিষের রাসায়নিক ধর্ম বিচার করে সমিধ নিশ্চিত হয় মিঃ আম্বানির বিষক্রিয়া কোনও আততায়ীর কর্ম নয়। পরিশেষে সে তার সন্দেহের কথা প্রফেসরকে খুলে বলে। সব শুনে প্রফেসরের মুখে ভাবনার বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সমিধের ফোনটা পাওয়ার পর প্রফেসর দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। প্রথমেই তিনি নৌসেনার পরিচিত অফিসারকে ফোন করে সেন্টিনেলি লোকটার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর সংগ্রহ করলেন। এরপর লোকটার শরীরে পাওয়া বর্মের মতো পোশাকটার বিশ্লেষণ করে কী তথ্য বের হল জানতে চান। উত্তরে অফিসার যা জানায়, সেটা তাঁর অনুমানের সঙ্গে সরাসরি মিলে যায়। বিমানে এখানে আসবার সময় নেট ঘেঁটে আর বিভিন্ন গবেষণাপত্র হাতড়ে যা আন্দাজ করেছিলেন সেটাই সঠিক। সমিধের ধারণাও তাঁর নির্ভুল বলে মনে হয়। চট করে অফিসারকে বলে তিনি সেনাপ্রধানের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে কথা বলার অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে নেন। সেই কারণেই এই মুহূর্তে তাঁর গাড়ি নৌসেনার সদর দফতরের দিকে ছুটে চলেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করতে হবে, নইলে…
(৯)
অক্টোবর, ২০১৮
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা শহরের সুকর্ণ-হাত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সুন্দরভাবে সাজানো এই বিমানবন্দরের স্থপতি পল অ্যান্ড্রু প্যারি বিমানবন্দরটিও তৈরি করেছেন। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম ও ব্যস্ততম বিমানবন্দর। ভোরের ফ্লাইট হলেও বিমানবন্দরের ওয়েটিং টার্মিনালে লোকের কমতি নেই। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে কিছু সরকারি আধিকারিকও রয়েছেন। অর্থমন্ত্রকের জরুরি মিটিংয়ে যোগদান করতে তাঁরা পাঙকাল পিনাঙে যাচ্ছেন। মিঃ সুদার্ত সমাদিকর্তাও ওঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। উনি বর্তমানে প্রাইমেট নিয়ে গবেষণায় রত। সরকারের তরফ থেকে ওঁকে উবুদ বাঁদর অভয়ারণ্যের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে।
বালির পাদং তেগাল গ্রাম জুড়ে এই বিস্তৃত বনাঞ্চল। গ্রামবাসীদের অধ্যাত্মবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার সাথে সাথে উবুদ বনাঞ্চল তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও নিরন্তর যুগিয়ে চলেছে। পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু উবুদ। ১৮৬ প্রজাতির গাছ এই ১২.৫ হেক্টরের বনভূমিকে শুধু সবুজময় করে তোলেনি, আশ্রয় দিয়েছে প্রায় ৭০০ বাঁদরসহ অন্যান্য প্রজাতিকে। পর্যটকদের ঘোরার জন্য শাটল বাসও চালু থাকে দিনভর।
মিঃ সমাদিকর্তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কোনও ব্যাপারে বিশেষ উদ্বিগ্ন তিনি। অস্ফুটে কিছু বলে চলেছেন ভদ্রলোক। একটু খেয়াল করতে বোঝা গেল ওঁর বলা কথাগুলো, “আমাদের বুঝতে হবে গবেষণার নামে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করলে আখেরে সেটা আমাদের জন্য বুমেরাং হবে। উবুদ আমাদের ঐতিহ্য। এ তো জঘন্য ষড়যন্ত্র। অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হতে গিয়ে সরকার বিবর্তন নিয়ে জুয়াখেলা খেলতে চাইছে। এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আজ মিটিংয়ে এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। সরকারকে শিগগিরি এই কর্মকাণ্ড বন্ধের উপায় বার করতে হবে, নাহলে…”
উবুদের বাঁদরকুলের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দায়ভার মিঃ সমাদিকর্তাই সামলান। এব্যাপারে গ্রামবাসীরা ওঁকে সবরকম সাহায্য করে থাকে। ওরাই প্রথম খবরটা দিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে বাঁদরগুলোর আচরণে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। এতো শান্ত চুপচাপ আর আজ্ঞাবদ্ধ স্বভাব সত্যিই ওদের ধর্মবিরুদ্ধ! এমনিতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে ওদের সদ্ভাব ভালই। খাবারের জন্য দুষ্টুমিও মাঝেসাঝে করত। কিন্তু বছরদুয়েক হল সেটাও বন্ধ। উল্টে দলবেঁধে সব চুপচাপ বসে থাকে। ডেকে খাবার দিলে তবেই খায়। যেন বাধ্য শিশুর মতো অভিভাবকের নির্দেশের অপেক্ষা করছে। গ্রামবাসীদের বক্তব্য শোনার পর মিঃ সমাদিকর্তা কিছু বাঁদরের রক্ত নমুনা সংগ্রহ করে জাকার্তায় ওঁর সরকারি গবেষণাগারে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। ডিএনএ নমুনা থেকে পাওয়া তথ্য জিনোম ডেটাবেসে মেলাতেই বেরিয়ে আসে আসল কারণ। ওদের দেহে মেলে সারমেয়কুলের উন্নত সামাজিকতা বোধের জন্য দায়ী জিনগুলো! হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন তিনি। আর কয়েকবার একই পরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হন, আগের পাওয়া তথ্য এক্কেবারে নির্ভুল। কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁর মনে পড়ে সরকারের তরফ থেকে বছর তিনেক আগে এক বিদেশি এনজিও সংস্থা উবুদ বনাঞ্চলের বাঁদরকুলকে নিয়ে পরীক্ষামূলক ডকুমেন্টারি বানাতে সেখানে যায়। স্বাস্থ্যপরীক্ষার কারণ দর্শিয়ে কিছু বাঁদরকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাদের যথাস্থানে উবুদে পুনর্বাসিত করা হয়। সরকারি দফতরের নির্দেশ বলে মিঃ সমাদিকর্তাও বিশেষ মাথা ঘামাননি। পরেও তারা বেশ কয়েকবার একই কাজে এসেছিল। নিজের বিশ্লেষণ আর এই ঘটনাগুলো মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে ওঁর বিশেষ কষ্ট হয়নি।
অস্থিরভাবে পায়চারি করার মাঝে চেক-ইন সংক্রান্ত ঘোষণা হল লায়ন এয়ারের পাঙকাল পিনাঙগামী বিমানের যাত্রীদের উদ্দেশে। হ্যান্ড লাগেজ তুলে নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হলেন মিঃ সমাদিকর্তা। ঠিক সকাল ৬.২০ মিনিটে বিমান রওনা হল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। যাত্রাপথ ঘণ্টাখানেকের।
মিনিট দশেকের মধ্যেই এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল লায়ন এয়ারের বিমানটির। নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে আকাশে কিছুক্ষণ নড়াচড়ার পর হঠাৎই কোনও রকম শব্দ ছাড়া দ্রুত নীচে নামতে শুরু করে সেটি! কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই ভেসে এল বিস্ফোরণের আওয়াজ! দূর থেকে শুধু দেখা গেল জলের ভিতর থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসা কালো ধোঁয়া! মুহূর্তের মধ্যে ১৮৯ যাত্রীর জাভা সমুদ্রে সলিলসমাধি হল। এদের মধ্যে মিঃ সমাদিকর্তাও একজন। তল্লাশিতে বিমানের ব্ল্যাক বক্স মিললেও, মিলল না শুধু সরকারি আধিকারিকদের একজনেরও দেহাবশেষ!
(১০)
নভেম্বর, ২০১৮
আন্দামান নৌসেনার সদর দফতর। লোকচক্ষুর আড়ালে চলছে এক অভূতপূর্ব জিজ্ঞাসাবাদ। একটা ছোট্ট শব্দরোধী ঘরে সরকারের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার আর নৌসেনা প্রধানের সামনে বসে রয়েছে উদ্ধার হওয়া সেন্টিনেলি উপজাতির লোকটি। প্রফেসর বাগচিও উপস্থিত। পিনপতন নিস্তব্ধতা চারিদিকে। সরকারের বিশেষ অনুমতিক্রমে উদ্ধার হওয়া লোকটার নার্কো টেস্ট চলছে। উপজাতি আইন বা সরকারি নিয়মের বিরুদ্ধে হলেও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে। লোকটার শরীরে শিরায় শিরায় এখন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ঢোকান বার্বিচুরেটের প্রভাব। এতক্ষণে সেটা তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের দখল নিতে শুরু করেছে। নিউরোট্রান্সমিটার আর তার বশে নেই। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হতেই বেরোতে শুরু করল একের পর এক হাড় হিম করা তথ্য!
১৯৯৩ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর আর্থিক সহায়তায় আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিরক্ষা উন্নয়ন গবেষণা কর্মসূচি সংস্থা এক বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে আয়নমণ্ডলের সৌরবিদ্যুতের উপর প্রভাব তৈরি করা। স্নায়ুযুদ্ধের শুরু থেকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র আলাদাভাবে এই বিষয় নিয়ে কাজ চালাচ্ছিল। তবে রাশিয়া পরে এব্যাপারে নিজেদের চরম গোপনীয়তায় ঢেকে ফেলে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র খোলাখুলি কাজ চালাতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রক মুখ ফস্কে উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পাঠিয়ে আবহাওয়া পরিবর্তন, ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটানোর কথা উল্লেখ করে ইকো টেরোরিজমের বিপদ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিলেও, রাশিয়া বরাবর চুপচাপই ছিল। ওই শেষ, তারপরে দুই দেশই আর ব্যাপারটাকে লোকসমক্ষে আসতে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার গাকোনার টোক হাইওয়ে সংশ্লিষ্ট ৪০ একর আয়তনের বিশাল এলাকায় ১৮০টি অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্টেনার সমাহারে চলছিল হার্প প্রযুক্তির এই কর্মযজ্ঞ। যার পেটেন্ট রয়েছে পদার্থবিদ বানার্ড ইস্টল্যান্ডের নামে।
সার্বীয় বংশোদ্ভূত মহান বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার মাথায় সবার প্রথম হার্পসদৃশ অস্ত্রের ধারণা আসে। ১৯৪৩ সালে ওঁর রহস্যজনক মৃত্যুর পর মার্কিন সরকার তাঁর সমস্ত গবেষণা সংক্রান্ত কাগজ সরিয়ে ফেলে। গবেষণা এগোনোর নাম করে সেগুলো জনসমক্ষের আড়ালে নিয়ে যাওয়াই ছিল সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। টেসলা হার্প নিয়ে তাঁর আমৃত্যু গবেষণায় একে লেজার গানের সমতুল প্রাণঘাতী বলে উল্লেখ করেছিলেন।
সোজা কথায় বলতে গেলে টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এর ফলে মূলত ভূমিকম্প ঘটে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র হার্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেকটনিক ওয়েপনের মতো মারাত্মক মারণাস্ত্র তৈরি করে ফেলে। ওই মারণাস্ত্র দিয়ে টেরেস্টেরিয়াল স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভূমি থেকে আয়োনোস্ফিয়ারের ১০০-৩৫০ কিমি এর মধ্যে তরঙ্গ পাঠানো হয়। সেই তরঙ্গ উত্তপ্ত হয়ে আয়োনোস্ফিয়ারের ইলেকট্রন এর মধ্যে পরিবর্তন সৃষ্টি করে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে। আয়নোস্ফেয়ারের এফ ওয়ান স্তর সেই তরঙ্গকে ভূমিতে পাঠায়। ভূমিতে স্থাপিত হার্প এন্টেনা সেই তরঙ্গ গ্রহণ করে অন্য একটি স্যাটেলাইটে পাঠায়। প্রয়োজনের সময় সেই স্যাটেলাইটটি মারণাস্ত্রের কাজ করে।
প্রফেসর নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, “অধ্যাপক ত্রিবেদী তাহলে ঠিক আশঙ্কাই করেছিলেন। সেদিন নেপালের ওই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের পর ফোনে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বন্ধুবর তো আমায় বলেছিলেন তাঁদের সংবেদনশীল যন্ত্রে রেডন গ্যাসের কোনও আগাম আভাস মেলেনি! ঘটনার পরে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফেলো বেঞ্জামিন ফালফোর্ড তাঁর ব্লগে সকলকে সতর্ক করলেও বাকিরা সেটা উপেক্ষাই করেছিল। আমি নিজেও তো…”
লোকটা বলে চলে, “পরপর ঘটে যাওয়া কতগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পেছনে এই হার্প প্রযুক্তির হাত রয়েছে বলে বিশ্বজুড়ে আওয়াজ উঠতে থাকে। ১৯৯৮ সালে আফগানিস্তানে সংঘটিত ভূমিকম্পে রাশিয়ার হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। রাশিয়ার এই অগ্রগতিতে যুক্তরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসেছিল। তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছিল নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর জন্য। ঠিক সেই সময় ২০০৫ সাল নাগাদ আলাস্কার গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকল্পের নথি গোপনে পাচার হয়ে যায়। পাচারে জড়িত ছিলেন সংস্থার নাম করা বিজ্ঞানী প্রফেসর সেওং জিন। পরে তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
সামান্য থেমে লোকটা আবার বলতে শুরু করে, “এই ঘটনার পিছনে উত্তর কোরিয়ার খ্যাতনামা পদার্থবিদ মিঃ উন হা-জং-এর হাত ছিল। তবে এতে আসল ইন্ধন ছিল চিনের। ইউরেশিয়ায় রাশিয়ার দাদাগিরি আর যুক্তরাষ্ট্রের একনায়কতন্ত্রের স্বপ্ন তাঁরা মেনে নিতে পারেনি। আর তাই দক্ষিণ কোরিয়া যখন আমেরিকার দিকে ঝুঁকল, তখন চিন উত্তর কোরিয়াকে হাত করতে শুরু করে। মিঃ হা-জং-এর হাত ধরে ধীরে ধীরে উত্তর কোরিয়া ওই একই হার্প প্রযুক্তি গবেষণায় এগিয়ে যেতে থাকে। অর্থ নিয়ে সমস্যা মাথা চাড়া দেয়নি, কেননা চিন এ ব্যাপারে বেশ দরাজ ছিল। নিজের দেশে এই প্রযুক্তির প্রমাণ তারা রাখতে চায়নি। দুনিয়ার চোখকে ধোঁকা দেওয়াই ছিল আসল কারণ। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা উত্তর কোরিয়ার পক্ষে চিনের প্রভুত্বের আগল ভেঙে বেরোনো ছিল একপ্রকার অসম্ভব। সমস্যা শুরু হয় অন্যখানে। উত্তর কোরিয়ার মধ্যেও আস্তে আস্তে ক্ষমতার প্রতি মোহ মাথা চাড়া দিতে শুরু করল। সেই লক্ষ্যে তাঁরা চিনের দেওয়া অর্থের বেশ বড় অংশ হার্প প্রযুক্তি ছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্রের ভাঁড়ার বাড়ানোয় ঢালে। এই কাজে বাড়তি অর্থের যোগান দেওয়ার পরিকল্পনাটা ছিল বড় অদ্ভুত।”
সেন্টিনেলি লোকটার কথার মাঝে প্রফেসর বাগচি অস্ফুটে বলে ওঠেন, “এখানেই শুরু হল ওদের দুনিয়া জুড়ে মুক্তিপণ আদায়ের খেলা।” বাকীরা একযোগে প্রফেসরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। প্রফেসর বলে চললেন, “ভণ্ড এনজিও সংস্থার আড়ালে এরা গোটা বিশ্বে জাল পাতল। কাজে লাগাল কিছু দক্ষ হ্যাকারকে। যাদের কাজ ছিল বড় বড় বিজনেস টাইকুনদের কম্পিউটার হ্যাক করে গোপন তথ্য হাতিয়ে তাদের তথ্য ফাঁসের হুমকি দেওয়া। কথায় কাজ না হলে প্রথমেই তাদের সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিত এরা, যেটা সারানো প্রায় দুঃসাধ্য। এতেও কাজ না হলে, লোক ভাড়া করে জিন প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি বিষাক্ত মাকড়সার শিকার বানানো। পুরো মেরে ফেলত না এরা। স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হেনে মৃদু পক্ষাঘাতের শিকার বানাত। এরপর ভয়ে টাকা পাঠাত শিল্পপতিরা। পুরোটাই হত ডার্ক ওয়েবে বিট কয়েনের মাধ্যমে।” সমিধের পাওয়া তথ্য ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সাহায্যে সরকারকে জানিয়েছিলেন প্রফেসর। এরপরে ওঁরা ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে তদন্ত চালাতেই ধরা পড়ে এথান ফাউন্ডেশনের আসল কারিকুরি। গরিব মেধাবী ছাত্রদের স্কলারশিপের টোপ দেখিয়ে বিশ্বজোড়া হ্যাকিং-এর জাল পেতেছিল মূর্তিমান শয়তানগুলো। দাবার বোড়েদের ধরতে জাল পাতে ইন্টারপোল। মিঃ পরেশ আম্বানিকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কথোপকথন চলার সময় দ্রুত বদলাতে থাকা সার্ভার ট্র্যাক করে ইন্টারপোল নিযুক্ত সাইবার বিশেষজ্ঞরা ধরে ফেললেন কিমের মতো ঘুঁটিদের। কিন্তু আসল মাথা তো বসে অন্যখানে।
ওষুধের প্রভাবে ঘোরে থাকা সেন্টিনেলি লোকটা অদ্ভুতভাবে হেসে উঠে বলে, “ইউ কান্ট ক্যাচ দেম সিমপ্লি।” প্রফেসরের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। প্রশ্নোত্তর পর্ব আবার শুরু হয়। “নেপাল আর সাম্প্রতিককালের ঘটা ভূমিকম্পগুলো এদেরই কীর্তি তাই তো?” প্রফেসর প্রশ্ন করলেন।
এলিয়ে থাকা মাথাটা সোজা করে লোকটা বলে চলে, “সে আর বলতে…, উত্তর কোরিয়ার আড়ালে চিন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল হার্প গবেষণায় তাদের সমান্তরাল উত্থানের কথা। যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো শুধু কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করার লক্ষ্যে অবিচল ছিল। ওদের মাথায় আসেনি প্রযুক্তির এই হাত বদলের রহস্য। গত জুন মাসে সেন্তোসা আইল্যান্ডের কাপেল্লা হোটেলে দুই দেশের প্রেসিডেন্টের যে শান্তি-বৈঠক হয়, সেখানেও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়েই শুধু কথা হয়। উত্তর কোরিয়া নিরস্ত্রীকরণে সায় দিলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যুদ্ধজয়ের হাসি হেসেছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল ওঁদের সব থেকে বড় মূর্খামি। দেশে ফিরে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কথামতো নিউক্লিয়ার শাটডাউন ঘোষণা করলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। অর্থনৈতিক কোনও বিপত্তিই সেক্ষেত্রে আর বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শুধু চলতে থাকে হার্প কর্মযজ্ঞ। পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে যা আরও কৌশলী।”
“তোমাদের এই আজব পরিবর্তনের রহস্যটা তাহলে কী? আর এর সঙ্গে তার যোগাযোগটাই বা কী?” ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার অধৈর্য স্বরে প্রশ্ন করলেন।
মৃদু হেসে লোকটা বলল, “আমেরিকা তাদের আলাস্কার গোটা কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখেছে বলে দুনিয়ার চোখে ধোঁকার ঠুলি পরিয়ে রেখেছে। গুগল আর্থ ঘেঁটে দেখবেন আলাস্কার গাকোনার ওই অঞ্চলটার কোনও তথ্যই কেউ পাবে না। পুরো ব্ল্যাক আউট যাকে বলে। তলায় তলায় ওদের মারণ গবেষণা জারি। চিনের বুদ্ধিতে উত্তর কোরিয়া তাই এই উপমহাদেশে এমন এক নিশ্চিন্ত জায়গার খোঁজ করছিল, যেখানে মানুষের হাত পড়েনি। আমাদের দ্বীপটা এভাবেই ওদের নজরে আসে। ওরা বেশ ভালোভাবেই জানত, ভারত সরকারের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় আমাদের কেউ ঘাঁটায় না। দ্বীপটা বাইরের জগতের আওতার বাইরে। ২০০৪ সালে বিধ্বংসী সুনামির পর সরকারের বেশ কিছুদিন লেগে যায় সেই ধাক্কা সামলাতে। ওরা আমাদের নজরে রেখেছিল। এই ফাঁকে আমাদের জনা কয়েক লোককে মাছ ধরার সময় উঠিয়ে নিয়ে যায়। আধুনিক অস্ত্রসহ ছদ্মবেশে মাছধরার ট্রলারে এসেছিল ওরা। এরপরেই…” সামান্য থেমে আবার বলতে শুরু করল সে, “কয়েক মাস বাদে আবার তাদের ফিরিয়ে দিয়ে যায় দ্বীপে। আশ্চর্যের ঘটনা হল, ফিরে আসা লোকগুলো ছিল সম্পূর্ণ আলাদা! আমাদের তুলনায় অনেক সভ্য, ভদ্র! ওরা ফিরে এসে ধীরে ধীরে আমাদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। সভ্যতার পাঠ শেখায় আমাদের। নিজেদের ভাষার সঙ্গে আধুনিক ভাষাও আয়ত্ত করলাম আমরা। ধাপে ধাপে আধুনিকতায় প্রবেশ করলাম। সুরক্ষার জন্য ওরা আমাদের বর্মের ব্যবস্থা করল। ওটা ছিল প্রফেসর ইয়াং-এর তুখোড় আবিষ্কার! কিন্তু কঠিন নির্দেশ ছিল চট করে সেটা যেন বহির্বিশ্বের নজরে না আসে।”
লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে উত্তেজিত প্রফেসর বাগচি বলে ওঠেন, “প্রফেসর ইয়াং মানে… ভদ্রলোকের পুরো নাম কি ঝাং ইয়ং? সে বেঁচে আছে?” হেসে মাথা হেলায় লোকটা। সমিধের দেওয়া তথ্যগুলো ভেসে ওঠে প্রফেসরের মনে। জৈব প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি মাকড়সা আর সেন্টিনেলিদের দুর্ভেদ্য বর্ম তাহলে ওই পাগলা বৈজ্ঞানিকের মাথার ফসল। জিন থেরাপি দিয়ে লোকগুলোকে সভ্যও বানিয়েছে সে! হে ভগবান! আর দুনিয়া ভেবেছিল বাইয়ুন লেক সংলগ্ন অঞ্চলের সেই আকস্মিক ভূকম্পে লোকটা পৃথিবী থেকেই বিদায় নিয়েছে।
সেন্টিনেলি লোকটা আবার বলতে শুরু করল, “আসলে ওরা চাইছিল দ্বীপটা হার্প প্রযুক্তির দ্বিতীয় ঘাঁটি বানাতে। বাধ সাধল সেদিনের ঘটনাটা। ওই আমেরিকান পর্যটক যে গোঁয়ার্তুমি দেখিয়ে সটান ডিঙি ভাসিয়ে দ্বীপে হাজির হবে সেটা আমরা কল্পনাতেও আনিনি। বাধ্য হয়ে ভয় দেখাতে তির ছুঁড়তে হয়েছিল আমাদের। বোকাটার ক্যামেরায় যে আমাদের ছবি উঠেছে সেটা শক্তিশালী বাইনোকুলারে আমাদের লোকেরা আঁচ পেয়েছিল। ভয় দেখাতে পর্যটকের দেহটা তাই আমরা সমুদ্রের দিকে মুখ করে সৈকতের বালিতে পুঁতে রেখেছিলাম। বিষাক্ত তিরও ছোঁড়া হয়, কিন্তু মেছুড়েদের ট্রলারটা দ্রুত আমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। ওদের ঘটনাটা জানাতে নির্দেশ আসে সাবধানে থাকতে। এরমধ্যে আপনারা আমাকে উদ্ধার করলেন।”
প্রফেসর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, “সবই বুঝলাম, কিন্তু মিঃ ইয়াং এতবড় জিন থেরাপি মানুষের উপর প্রয়োগ করার আগে তাঁর পদ্ধতির যথার্থতা যাচাই করলেন কীভাবে? মানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালালেন কাদের উপর?”
নড়েচড়ে বসে লোকটা। ঘোরের মধ্যেই বলে ওঠে, “এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারণা করা বড় সহজ কাজ নয় তামাম দুনিয়ার পক্ষে। তাছাড়া পয়সা ফেললে সব হয়। সেটার অভাব যে ওদের নেই, তা আশা করি আপনারা এতক্ষণে আন্দাজ করতে পেরেছেন। বালির পাদং তেগাল গ্রামের নাম শুনেছেন। সেখানে উবুদ বনাঞ্চল এক শ্রেণির বাঁদরদের স্বর্গরাজ্য। সরকারকে টাকা খাইয়ে ওদের গিনিপিগ বানানোর কাজটা খুব সহজেই হয়ে যায়। অবলা প্রাণীদের অভিযোগ শুনছেই বা কে? যারা পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের সরিয়ে ফেলা হয়।”
প্রফেসরের মনে পড়ে গেল গত মাসে জাকার্তার বিমান দুর্ঘটনার কথা। সেই দুর্ঘটনায় তো সরকারের বেশ কয়েকজন আধিকারিকও মারা গিয়েছিলেন। তাদের দেহ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। তবে কী…। সব শুনে দুয়ে দুয়ে চার করে ফেললেন প্রফেসর বাগচি। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার আর নৌসেনার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শুরু করে দিলেন তিনি। প্রয়োজন পড়লে ইন্দোনেশিয়া সরকারের উপর কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়ে উবুদের বাঁদরগুলোর জিন বিশ্লেষণ মানচিত্রের তথ্যসহ ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চলার সময় পুরো ঘটনার সাক্ষী হিসাবে তাদের পাওয়া যায়। হাতে সময় খুব কম।
(১১)
ডিসেম্বর, ২০১৮
বালির পাদং তেগাল গ্রাম। পবিত্র বাঁদর অভয়ারণ্য সবে ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে। এই সময়টায় আবহাওয়া বর্ষামুখর। কাল রাত্রে বেশ ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের পুরা দালিম আগুং পাদং তেগাল বা মৃত্যুর মহান মন্দির চুপচাপ দাঁড়িয়ে। এখানে স্থানীয়রা শিবের রূপে হায়াং বিধির পুজো করে। মন্দির জুড়ে ভ্যাম্পায়ার শিশুযুগলের মূর্তিসহ আরও দর্শনীয় স্থাপত্যের ছড়াছড়ি। পাদং তেগাল গ্রামে এই মন্দির আর পবিত্র অভয়ারণ্য নিয়ে অধ্যাত্মবোধের সার্থক উন্মেষ ঘটেছে। হঠাৎ চারপাশের পরিবেশটা গেল বদলে। আপাতশান্ত অভয়ারণ্যের বাসিন্দারা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। আর ঠিক সেইসময় তীব্র কম্পনে থর থর করে কেঁপে উঠল চারপাশ। মুহূর্তের মধ্যে সুন্দর সাজানো জায়গাটা এলোমেলো হয়ে ধ্বংসস্তূপের আকার নিল। বালির সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ধেয়ে এল সুনামির করাল থাবার গ্রাস। কম্পন-সুনামির জোড়া তাণ্ডবে সৈকত আর অভয়ারণ্যে মানুষ আর বন্যপ্রাণীরা ঢলে পড়ল অকালসমাধির দিকে।
নাগুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবস্থা আরও শোচনীয়। দূর থেকে নজরে আসা এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারে তখনও কর্তব্যরত অফিসার শেষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। শেষ বিমান উড়ে যেতেই নিজেকে বাঁচাতে ভবনের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে লাফ দিলেন ভদ্রলোক। শেষরক্ষা তবুও হল না। নিথর দেহটা পড়ে রইল মাটিতে। প্রফেসর ঝাং ইয়ং-এর সাফল্যের নিদর্শন হিসাবে বাঁদর প্রজাতির কোনও প্রতিনিধিকেই আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলনা। এক্ষেত্রেও রেডন গ্যাস সংবেদনশীল যন্ত্রে কিছু ধরা পড়ল না!
নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ডের দখল নিল ভারতীয় নৌসেনা। আর্মি আর এয়ার ফোর্স এব্যাপারে পূর্ণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অধিবাসীদের সভ্য বানিয়ে দ্বীপের অরণ্যসংকুল অঞ্চলে বেশ গুছিয়ে বসেছিল উত্তর কোরিয়া আর তাদের বন্ধুরাষ্ট্র চিন। হার্প প্রযুক্তির দ্বিতীয় গবেষণাগারের কাজ চলছিল জোরকদমে। এছাড়া চলছিল অন্যান্য গবেষণামূলক উন্নয়নের কাজ। সরকার থেকে গবেষণাগারের দখল নেওয়া হল। ঠিক হল, কেন্দ্রীয় সাহায্যে দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রকে অক্ষুণ্ণ রেখে আন্দামানের মূল দ্বীপের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হবে জায়গাটাকে।
আন্তর্জাতিক আদালত বিশেষ সদস্য দল পাঠিয়েও প্রফেসর ইয়ং-এর কুমগানসানের গবেষণাগারের কোনও হদিশ পেল না! একইভাবে খোঁজ পাওয়া গেল না উত্তর কোরিয়ার হার্প কর্মযজ্ঞের!
(১২)
জুলাই, ২০১৯
প্রবল বর্ষণের ফলে মুম্বাই ও উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছরে এমন বিপজ্জনক বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি দেশ। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে খরার পরিস্থিতি। সামরিক হেলিকপ্টার, দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর রবারের ডিঙি ও উদ্ধারকারী দল সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। বিজ্ঞানীরা দায়ী করেছেন পরিবেশ দূষণের মারাত্মক প্রভাবকে। কিন্তু…
ভোররাতে কেঁপে উঠল পুরুলিয়া। একই সঙ্গে সামান্য আগে-পরে কেঁপে উঠল বাঁকুড়া, অসম, জম্মু-কাশ্মীর ও অরুণাচলপ্রদেশ। আশ্চর্যজনকভাবে সব ক্ষেত্রেই যেখানে ভূমিকম্প হয়েছে, ভূত্বক থেকে ১০ কিলোমিটার নীচে রয়েছে তার এপিসেন্টারগুলো। এক্ষেত্রেও রেডন গ্যাস সংবেদনশীল যন্ত্রের আগাম আভাস কিছুই ছিল না! তাহলে কি…?
আইসোলা দেলে ফেমাইন। সিসিলির এক ব্যক্তিগত মালিকানাধীন দ্বীপ। প্রকৃতির কোলে এক ছিমছাম, নিস্তব্ধ আর সবুজে মোড়া জায়গা। সতেরো শতকের এক পাথুরে মিনার ছাড়া সভ্যতার আর কিছু তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এক সময়ে এটি মূল ভূখণ্ডের অংশ থাকলেও পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আগে স্নরকেলিং আর স্কুবা ডাইভিং-এর জন্য লোকে ভিড় জমাত এখানে। দ্বীপ লাগোয়া জলে প্রচণ্ড স্রোতের কারণে সেই ভিড় এখন অনেকটাই কম। পাগল ছাড়া কেউ আর আজকাল ওমুখো হয় না। দ্বীপের মালিক কাউন্টেস কয়েক বছর হল সেটিকে বেচে দিয়েছেন এক অজ্ঞাতপরিচয় প্রকৃতিপ্রেমিকের কাছে। মালিকানা পাওয়ার পরেই নীরবে জোরদার কর্মকাণ্ড চলছে সেখানে। শুধু…
(সব চরিত্র ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
Tags: ইন্টারনেট, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, শাম্ব চ্যাটার্জী
দুর্দান্ত! এককথায় অতি উন্নতমানের একটি কল্পগল্প। টুকরো টুকরো ঘটনা হিসাবে এগিয়েছে। শেষে এসে সব আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে; দারুন! দারুন!
হার্প প্রযুক্তি, হ্যাকিং, জেনেটিক্স, এসপিউনাজ সব মিলিয়ে স্বার্থক সায়েন্স ফিকশন। লেখককে অনেক ধন্যবাদ এমন দারুন একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্যে।
লেখকের তরফ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাই।
বেশ জমজমাট লেখা । সাইফুলের কথার সূত্র ধরেই বলছি শুধু যে আপনি প্রযুক্তি গুলি রেখেছেন তা ই নয় । বিট কয়েনের কালোবাজারি , ছাত্রদের খানিকটা বুঝিয়ে আবার ব্ল্যাক মেল করে কাজ আদায় করা ইত্যাদি দিক গুলি ও ভাল লেগেছে । আশাকরি আরো লিখবেন ।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান মতামতে ঋদ্ধ হলাম। সবসময় ভাল থাকবেন।