সরণি সরেনি কেন?
লেখক: এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: ইন্টারনেট
সে দিন যেটা স্বপ্ন বলে ভেবেছিলাম, আসলে সেটা সত্যি সত্যিই ঘটেছিল। রাস্তা কখনও চলতে পারে ভ্রমেও ভাবিনি, সেই দেখলাম, হুবহু অজগর সাপের চলা। কড়ি বরগায় ঠোকাঠুকি করতে করতে সঙ্গে চলেছে লাইন বেঁধে বাড়িঘর। কখন আমার ঘুম ভেঙেছে ওরা বুঝতে পারেনি, খেয়াল হওয়া মাত্র যে যেখানে ছিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল। তাই হ্যারিসন রোডের বাড়িগুলো একটু হেলানো আছে লক্ষ করবেন। সবগুলো সোজা হবার সময় পায়নি, হঠাৎ দেখলে মনে হবে অবিকল স্টার্ট নেবার আগে গোঁত্তা মারার ভঙ্গী, যেন আবার সুবিধে পেলেই দৌড় দেবে। আগেই বলেছি এসব স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেবার নয়। অসম্ভব কল্পনাও নয়। সত্যের চেয়েও সত্য। সত্যের চেয়েও সত্য কি? তা হল চতুর্মাত্রিক কাল। শুনতে আজগুবি, কিন্তু প্রণিধান করার যোগ্য।
* * *
‘বাড়ি, বাড়ি জিনিসটা আসলে কি?’ জিজ্ঞেস করছিল যাদবপুর থেকে সদ্য পাস করা আর্কিটেক্ট প্রিয়তোষ তার বাল্যবন্ধু অসীমকে। অসীমের স্ত্রী অর্চনার সম্প্রতি বাড়ি করার খেয়াল চেপেছে। কথা হচ্ছিল সেই প্রসঙ্গে।
‘বাড়ির সংজ্ঞা কী?’ আবার প্রশ্ন করলে সে।
‘একটা মাথা গোঁজবার আস্তানা। তা ছাড়া আর কি।’ বাড়িঘর, জমিজমার ব্যাপারে অসীমের অসীম বৈরাগ্য।
‘তোর মুণ্ডু! তোর সঙ্গে দেখছি অন্য আকাটগুলোর বিশেষ তফাত নেই।’
‘আমার সংজ্ঞাটাই একমাত্র সংজ্ঞা নাও হতে পারে।’
‘একমাত্র! বিন্দুমাত্রও নয়। মাথা গোঁজবার আস্তানাই যদি দরকার তা হলে আদিম মানুষের গুহা কি দোষ করল? গুহা নয়। আধুনিকভাবে যতই সাজাও না কেন। বাড়ি কোনওমতেই গুহা নয়। আসলে বাড়ি একটা জীবন্ত বস্তু—যে থাকবে, তার সঙ্গে বাড়বে, কমবে, তার ভাবের অভিব্যক্তির সঙ্গে বদলাবে—তবে না বাড়ি। না হলে কি চারদিকে চারটে দেওয়াল আর মাথার ওপর ছাদ—এ তো একটা কবরখানা। কিছু মনে করিস না—তোদের ওই তাজমহল, আজকালকার বাড়ি দেখলেই আমার তাজমহলের কথা মনে পড়ে যায়।’
‘তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। তুই যা হয় বললেই হল?’
‘আহা, হোক না অন্য সবাই আশ্চর্য। আমি শুধু আশ্চর্য হই এখনও তাজমহলের যুগের চেয়ে মানুষের বেশিদূর উন্নতি হয়নি এই দেখে। সেই কুড়ি হাজার শ্রমিক আঠারো বছর পরিশ্রম করিয়া—রেখে দে, রেখে দে। আমাদের পূর্বপুরুষরা বাড়ি বানাবার যে সব নিয়ম বেঁধে গেছেন আমরা তার বাইরে একচুল যাবার সাহস রাখি না—এটা কেমন কথা। তাঁদের মতবাদ বহুকাল পুরানো হয়ে বস্তাপচা হয়ে গেছে। ও-সব এখন ফেলে দিলেই হয়। যে কোনও গর্দভের পক্ষে সামান্য জ্যামিতি জানা থাকলেই একটা সাধারণ চিরাচরিত বাড়ির নকশা বানানো সম্ভব। কিন্তু বাড়ি তা হবে কেন?’
উত্তেজনায় টেবিলে এক ঘুষি মারে প্রিয়তোষ। চায়ের কাপ থেকে একটু চা চলকে উঠে প্লেটে পড়ে যায়। টেবিলের পালিশ নষ্ট হয়নি—আড়চোখে দেখে নিয়ে আশ্বস্ত হয় অসীম। অর্চনা দেখে ফেললে আর রক্ষে ছিল না।
‘বাড়ি কি হবে তা হলে?’ জিজ্ঞেস করে সে নিরীহভাবে।
‘তুই তো সায়েন্স পড়েছিস। স্টিরিয়ো কেমিস্ট্রির কি মারাত্মক সব প্রয়োগ হতে পারে ভেবেছিস কখনও?—তা ছাড়া মডুলার সিস্টেমই বা কি দোষ করল। স্থাপত্যবিদ্যায় সব রকম রদবদলের জন্যে স্কোপ আছে, বুঝলি—যাকে বলে অ্যাকশনাল স্ট্রাকচার। আসল কথাটা হল ইউক্লিডের জ্যামিতি ছেড়ে আমরা যখন অনেক দূর এগিয়ে গেছি তখন বাড়ির ডিজাইন করার বেলায় বেচারা ইউক্লিডকে নিয়ে টানাটানি করা কেন?’
‘তা হলে কাকে নিয়ে করবে? আইনস্টাইন?’
‘আলবত। আইনস্টাইন—চতুর্মাত্রিক কাল। আরে দাঁড়া দাঁড়া, কি বললি তুই! চতুর্মাত্রিক কাল। না জেনে এটা একটা মোক্ষম কথা বলে ফেলেছিস রে। চতুর্মাত্রিক বাড়ি। দারুণ!’
প্রিয়তোষ অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করে কথাটা উচ্চারণ করে।
‘চতুর্মাত্রিক বাড়ি।—কি কথাই বলেছিস। আমি একেবারে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি—কি একখানা বাড়ি, কত দিকে উন্মুক্ত তার সম্ভাবনা—’
‘তুই কি সাত সকালেই গাঁজায় দম দিয়ে এসেছিস নাকি?’
‘গাঁজা ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। পাড়ায় বদনাম হয়ে যাচ্ছিল। তুই আমার কথা মন দিয়ে শোন। অর্চনা বাড়ি বাড়ি করে তোর কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে না?’
‘করলে আর কি করা যাবে। আজকালকার দিনে সৎপথে থেকে আমার মতো লোকের পক্ষে—’
‘আরে যায়, যায়, খুব করা যায়। চতুর্মাত্রিক হলেই যায়। একখানা ঘরের ভিতের ওপর দেখবি আটখানা ঘরওয়ালা বাড়ি তৈরি হয়ে যাবে। অসীম, এই তোর সুযোগ। এক ঢিলে দুই পাখি মারবি।’
‘কোন দুই পাখি?’
‘এক নম্বর পাখি অর্চনা। অর্চনার ঘ্যানঘ্যান বন্ধ করার জন্যে তুই ওকে একটা বাড়ি করে দিচ্ছিস। আর দু-নম্বর হলাম আমি। তুই তোর এত দিনের বন্ধুকে একটা সুযোগ দিচ্ছিস—একটা বিরাট বৈপ্লবিক আইডিয়াকে হাতে-কলমে ইটে-কংক্রিটে তৈরি করে দেখাবার। তুই দিয়েই দেখ আমায়।’
‘ব্যাপারটা আমাকে আর একটু বুঝিয়ে বল। বাড়ি করা কি অমনি মুখের কথা। যতই বাল্যবন্ধু হোস, টাকাটা তো আমাকে বার করতে হচ্ছে।’
‘আরে সেই কথাই তো বলছি। তোর মাথায় যদি কিছু ঢোকে। তোর মাল কত কম লাগছে, খরচ পড়ছে একটা আস্ত বাড়ির আট ভাগের এক ভাগ। দাঁড়া, দেশলাইটা দে। তোর বাড়িতে কোথাও প্লাস্টিসিন পাওয়া যাবে?’
‘থাকতে পারে। কী হবে প্লাস্টিসিন দিয়ে?’
‘দেখাব তোকে আমার চতুর্মাত্রিক বাড়ি কেমন হবে। নিয়ে আয় আগে।’
অনেক খোঁজাখুঁজির পর টুনটুনির খেলার বাক্স থেকে এক দলা প্লাস্টিসিন পাওয়া গেল। তিন-চার রকম রং একসঙ্গে লাড্ডু পাকানো।
‘দে, দে, এতেই হবে।’ উৎসাহের চোটে এবার চায়ের কাপটাই উলটে ফেলল প্রিয়তোষ।
‘কি হল, কোথায় চললি আবার। ওইটুকু চায়ের জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, আমি খবরের কাগজ দিয়ে সোক করিয়ে দিলাম। নে, চলে আয়।’
ছোট ছোট প্লাস্টিসিনের দল নিয়ে মটরশুঁটির দানার মতো গুলি পাকালো প্রিয়তোষ। চারটি গুলির মধ্যে চারটে দেশলাই কাঠি গুঁজে সেগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ল।
‘কী হল এটা?’
‘ওটা তো একটা বর্গক্ষেত্র মনে হচ্ছে।’
‘বাঃ। ইশকুলে কিছু শিখেছিলি দেখছি। এইবার আরও চারটে কাঠি।। এবার হল একটা কিউব, যাকে বাংলায় বলে, কী বলে বাংলায়? ঘনক?’
‘হবে হয়তো। অতদূর পড়িনি।’
‘খুব পড়েছিস। ভুলে মেরে দিয়েছিস এখন। কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর যা পড়েছিলি সেগুলোর মধ্যে বেশিটা ভুলে যাবার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই হল সত্যিকারের শিক্ষা। তোর শিক্ষাদীক্ষা সম্বন্ধে বরাবরই আমার—যাই হোক। রেখে দে। আর গুলি পাকাতে হবে না। বাকিটা আমি বলছি।’
‘বেশ বলে যা।’ আত্মসমর্পণ করে অসীম।
‘এইবার প্রথম কিউবটির একটি কোণ সাবধানে খুলে সেখানে জুড়ে দে একটি দ্বিতীয় কিউব। আরও আটটা দেশলাই কাঠি নে। প্রথম কিউবের তলার সঙ্গে জুড়ে দে দ্বিতীয় কিউবের তলা একটু তেরছাভাবে এবং প্রথম কিউবের মাথার সঙ্গে দ্বিতীয় কিউবের মাথা—ওই একই ভাবে।’
‘তাতে কী দাঁড়াচ্ছে শেষ অবধি?’
‘এইভাবে আটটি কিউব দিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি চতুর্মাত্রিক বাড়ি। কেবল এই চতুর্থ মাত্রাটা কাল নয় আর একরকম দেশ।’
‘আমি তো দুটোর বেশি কিউব দেখতে পাচ্ছি না। আরও ছ-টা কোথায়?’
‘একটু কল্পনার প্রয়োগ কর বন্ধু। তিন নম্বর কিউব হল প্রথম কিউব ও দ্বিতীয় কিউবের মাথা দিয়ে—’
‘তোমার মাথা। ওগুলো তো কিউব হবে না, বেঁকে যাবে। সামন্তরিক হয়ে যাবে।’
‘সে তো তোমার দৃষ্টিভঙ্গীতে। পার্স্পেকটিভের উপর। কাগজে যখন একটা কিউব আঁকো তখন তার পাশের বর্গগুলো সামন্তরিকের মতো দেখায় না? এ-ও তো তাই। তুমি ত্রিমাত্রিক দৃষ্টি দিয়ে একটা চতুর্থমাত্রিক বস্তু দেখছো। তুমি যাই দেখো না কেন, ওগুলো আসলে কিউব।’
‘বুঝলাম না।’
‘তুই একটা রাম গবেট। শোন। মিষ্টির দোকানে কিরকম একটা ফ্ল্যাট কার্ডবোর্ড দিয়ে বাক্স বানায় দেখেছিস? বাক্সটা একটা কিউব, ত্রিমাত্রিক, কিন্তু তাকে খুলে ফেলে আবার ফ্ল্যাট করে দিলে তার শুধু দৈর্ঘ আর প্রস্থ রইল, তখন সেটা হয়ে গেল দ্বিমাত্রিক।’
‘এই পর্যন্ত সহজেই বোঝা গেল।’
‘বাকিটাও বুঝবি। এখন তোর সুবিধের জন্যে চতুর্মাত্রিক বাড়িটাকে আমি ত্রিমাত্রিকে এনে ফেলেছি।’
প্রিয়তোষ আরও কতকগুলো গুলি নিয়ে খুব চটপট একটা জিনিস তৈরি করলে, পরপর চারটি দেশলাই কাঠির কিউব, একটির মাথায় একটি, এইভাবে চারতলা।
‘এই হল চারটি কিউব। এবার দুতলার চারটি সাইডের সঙ্গে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে যুক্ত হল আরও চারটি কিউব। এই হল আমার বাড়ির ত্রিমাত্রিক চেহারা। কিছু বুঝলে যাদু? প্রত্যেকটি ঘর খোলা। আলো আর বাতাস। কলকাতার মধ্যে এমন একখানা বাড়ি, ভাবতে পারিস?’
অসীম অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবে। তারপর বলে, ‘গোল্লায় যাক তোর চতুর্মাত্রিক বাড়ি। কিন্তু এই রকম প্ল্যানে একখানা ত্রিমাত্রিক বাড়ি বানাতে পারলে মন্দ হত না। একটা ঘরের ফাউন্ডেশন, চোদ্দো বাই চোদ্দো। প্রিয়তোষ, এরকম অদ্ভুত প্ল্যানে বাড়ি বোধহয় বানানো সম্ভব নয়।’
‘কে বলেছে সম্ভব নয়। আমার অভিধানে অসম্ভব বলে কোন কথা নেই।’
‘কিন্তু এমন প্ল্যান স্যাংশন হবে না—’
‘আলবত হবে। প্ল্যান কি করে স্যাংশন হয় তা আমার ঢের ঢের জানা আছে। তুই আমার ওপর বিশ্বাস করে ছেড়ে দে। আমি তোকে একখানা এমন বাড়ি বানিয়ে দেব।’
‘ঠিক ভরসা হচ্ছে না, শেষে কি সেই ইঞ্জিনিয়ারের মতো হবে নাকি? যে নিজের ডিজাইন করা বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করে সবাইকে দোতলায় নিয়ে যেতে গিয়ে দেখে, ওই যাঃ, সিঁড়িটাই তো করা হয়নি। ভুল হয়ে গেছে।’
‘কার সঙ্গে কার তুলনা করছিস। যত সব টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ব্যাপার। আমি হলাম ভবিষ্যতের অগ্রদূত। তোরা অনেক ভাগ্য করেছিস যে, ভবিষ্যতের প্রথম বাড়ির প্রথম বাসিন্দা হতে যাচ্ছিস। বিখ্যাত হয়ে যাবি রে। আর তোদের বাড়ির সামনের রাস্তাও হবে বিখ্যাত। প্রিয়তোষ সরণি—আমি এখনি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি।’
‘বয়ে গেছে। ধারে কাছে কি হোমরাচোমরা লোকের অভাব যে তোর নামে রাস্তা হবে? তা ছাড়া অর্চনা রাজি হবে না।’
‘আরে রাখ। বৌয়ের ভয়ে ল্যাজ গুটিয়ে বসে থাকবি আবার এদিকে হবেন ভবিষ্যতের অগ্রদূত। শখ কত!’
* * *
‘কোনদিকে যাচ্ছি আমরা?’ আঁচল সামলাতে সামলাতে জিজ্ঞেস করে অর্চনা। ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে এসেছে বটে কিন্তু যা চোরের উপদ্রব। বিকেলে ঝি আসার আগে ফিরতে হবে। চারটের আগে না এলে শোভার মা দুধ নিয়ে ফিরে যাবে। প্রিয়তোষবাবু খামখেয়ালী লোক, সময় নেই, অসময় নেই, হয়তো বলেই বসবেন—চলুন যাই কাশ্মীর।
‘আমরা যাচ্ছি বেশিদূর নয়। এই কাছেই। খালটা পেরোলে রেল লাইন—’
‘প্রিয়তোষবাবু কি করছেন। একটু সাবধানে চালান। ট্রেন তো ফস্কে যাচ্ছে না। ওই ঠেলাওয়ালাটা গিয়েছিল আর কি।’
‘তার ওপারে হল লেক গার্ডনস। লেক হইয়াছে গার্ডন যাহার তারেই কয় লেক গার্ডনস। বহুব্রীহি। ভুল হলে শুধরে দেবেন।’
‘কিন্তু ওখানে আর বাড়ির জায়গা কই রে?’ অসীম ভুল করে বলে ফেলে।
‘বাড়ি? কোন বাড়ি? কি বলছ তোমরা।’ অর্চনার গলায় সন্দেহ। তাকে বাদ দিয়ে বাড়ি-টাড়ি কেনার মতো গুরুতর ব্যাপার অসীম একাই করে ফেলবে এও কি সম্ভব। ওই প্রিয়তোষবাবুটি বড় লোক সুবিধের নয়।
‘মানে আপনার স্বামী আপনাকে একটা বাড়ি উপহার দিয়ে চমকে দিতে চাইছেন। আপনার জন্মদিন উপলক্ষে।’ জন্মদিন, অর্চনার ভুরু কুঞ্চিত হয়। যা ভেবেছে তাই। নিশ্চয় বিক্রির ব্যাপারে প্রিয়তোষবাবুর কিছু বখরা আছে। গাড়ির পিছনে বসে বড় অসুবিধে বোধ করতে লাগল সে, কাউকেই কটমট করে তাকিয়ে ভস্ম করা যাবে না, বড় জোর ঘাড়ের কাছটা একটু গরম হবে।
কথাটা ঘোরাবার জন্য প্রিয়তোষ সচেষ্ট হয়। আর কিছু ভেবে না পেয়ে হঠাৎ বলে বসে, ‘তোমাদের কাল রাত দুটো, না দুটো নয়, ঠিক দুটো বেজে পাঁচ মিনিটে ঘুম ভাঙেনি আশা করি?’
অৰ্চনা এরকম ভাঁড়ামির উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করে না। থমথমে মুখে বাইরে তাকিয়ে দেখে একটা মন্দির জাতীয় কিছুর সামনে অন্তত পক্ষে তিনশো লোকের ভিড়, প্রত্যেকের হাতে ঘটি, মুখে নির্বিকার ভাব। ভদ্রমহিলারা অনেকে দামী টাঙ্গাইল পরে কাঠফাটা রোদে বেশ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, কেউ ছাতা অবধি খোলেননি। কি অদ্ভুত ব্যাপার। অর্চনা কিছুক্ষণের জন্য সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ততক্ষণ অসীম কথা বলছিল।
‘না, রাত দুটোর সময় ঘুম ভাঙেনি। ওরকম বিদঘুটে সময়ে ঘুম ভাঙতে যাবেই বা কেন?’
‘না, এমনিতে ভাঙ্গার কথা নয়। তবে ভূমিকম্প হলে আলাদা কথা।’
‘অ্যাঁ ভূমিকম্প’—অর্চনা চমকে উঠে, একটু আগেকার বিরাগ ভুলে প্রিয়তোষের সঙ্গে কথা বলে ফেলে।
‘কাল রাত্রে একটু ভূমিকম্প হয়েছিল। খুব সামান্য। একটু ঝাঁকানি। আমার ঘুম এমনিতেই পাতলা, তাই জেগে গিয়েছিলাম।’
‘শুনলে তুমি?’ আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে অর্চনা। ‘ভূমিকম্প।’ সে অসীমকে ধরে একটা ঝাঁকুনী দেবার চেষ্টা করে। ওই জন্যেই বলেছিলাম পার্ক সার্কাসে বাড়ি ভাড়া নিও না।’
‘ভূমিকম্প কি খালি পার্ক সার্কাসেই হয়েছে না কি?’
‘ওই তো প্রিয়তোষবাবু বলছেন। উনিও তো দিলখুশা স্ট্রিটে—’
‘আসলে তেমন কিছু হয়নি। মানে সেরকম যদি চৌত্রিশ সালের মতো কাণ্ড হত তাহলে কি আর আপনাদের ঘুম ভাঙত না।’ প্রিয়তোষ যতই গন্তব্যস্থলের নিকটবর্তী হয় ততই আত্মবিশ্বাসে তার গলার আওয়াজ আরও দরাজ, মেজাজ আরও দিলদরিয়া হতে থাকে। ‘তা ছাড়া বুঝলেন, অর্চনা দেবী’ সে ঘাড় ঘুরিয়ে এক নিমেষের জন্য অর্চনার সযত্নরচিত খোঁপাটির দিকে প্রশংস দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ফলে অর্চনার রাগ ও ভয় তিরোহিত হয়। সুযোগ বুঝে প্রিয়তোষ ভক্তকে অভয়দান করার ভঙ্গীতে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে, ‘এই যে আপনার নতুন বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি, এ হল একেবারে ভূমিকম্প প্রুফ। বাইরে যতই ঝড় জল হোক, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ব্ল্যাক আউট, বন্যা, কিংবা পঙ্গপাল, আপনার বাড়ির গায়ে কিন্তু আঁচড়টি লাগবে না। আপনার চতুর্মাত্রিক বাড়ি একেবারে নট নড়নচড়ন, নট কিচ্ছু।’
অবিশ্বাসীর চোখে একবার কেবল তার দিকে তাকিয়ে অর্চনা বলে, ‘হুঁ।’
রেল লাইন পার হবার জন্যে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হয়। ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে একটি মালগাড়ি, তারপরে ঝাঁকা মাথায় এক বুড়ি, গুটি দশেক রিক্সা, জনাষাটেক পদাতিক, তারপর বিভিন্ন প্রকারের চাকাওয়ালা যান সব পার হয়ে বাস-ডিপোর কাছাকাছি পৌঁছে তারা বাঁদিকে মোড় নেয়। সারি সারি বাড়ি, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে, সবই নতুন সবই সোজা। এরপর একটু ডানদিক-বাঁদিক করে হঠাৎ তারা এক মেঠো পথে উপস্থিত হয়—তার দুপাশে ফাঁকা মাঠ, কিছুটা জলা, তার মধ্যে গা ডুবিয়ে বসে আছে একপাল মোষ, দু-চারটে গোরু চরছে এদিক-ওদিক, এরই মধ্যে ছড়ানো ছিটোনো বাড়ি উঠছে, কোনটার সবে ভিত খোঁড়া, কোনটার একতলা উঠেছে, কোনটা প্রায় শেষ। তার মধ্যে অত্যন্ত বেমানান ভাবে অতিশয় বিচিত্র চেহারার একটি ঘর বেশ উঁচু ফাউণ্ডেশনের উপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
ঘ্যাঁচ করে গাড়িতে ব্রেক কষে ফেলল প্রিয়তোষ, দরজা খুলেই সে এক লাফে বেরিয়ে আসে তারপরেই ‘এ কি হল, এ কি হল’ বলতে বলতে তীব্রবেগে দৌড় লাগায় ঘরটির দিকে। পিছু পিছু ছোটে অসীম আর অর্চনা, কিছু না বুঝেই। হাঁফাতে হাঁফাতে যখন ওরা ধরে ফেলে প্রিয়তোষকে তখন তার লম্বা জুলফি বেয়ে ঘাম ঝরছে, চুল ঝুলে পড়েছে চোখের ওপর। ঘাড়ের উপর লতিয়ে পড়া বাবরি মুঠো করে ধরে সে হুংকার দেয়—‘চুরি, চুরি। সব চুরি হয়ে গেছে।’ হতভম্ভের মত আওড়ায় অসীম—‘তুই যে বলেছিলি আটটা ঘর, আমি তো শুধু একটাই দেখতে পাচ্ছি।’ ‘ছিল, ছিল,’ রুদ্ধশ্বাসে বলে প্রিয়তোষ, ‘চুরি হয়ে গেছে। এই তো কাল বিকেলেও ছিল।’
‘কাল বিকেলেও ছিল?’ বোকার মত প্রতিধ্বনি করে অসীম।
‘আরে আমি কাল নিজে এসে দেখে গেলাম, মালীকে বলে গেলাম লনে জল ছিটিয়ে রাখতে—’
এদিকে ওদিকে পর্যবেক্ষণ করে অসীম। ‘যদি কাল রাত্রেই ঘরগুলো চুরি হয়ে থাকে তবে তো ইঁটপাটকেল দু-চারটে পড়ে থাকা উচিত। লন তো দেখছি পরিষ্কার।’
অর্চনা এতক্ষণ একা দাঁড়িয়ে বিরক্ত হচ্ছিল। ‘তোমরা কি আমাকে এইখানে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাও নাকি? ভেতরে একটু ঢুকলে হয় না? তবে হ্যাঁ, আমি আপনাকে এইটুকু বলে রাখতে চাই প্রিয়তোষবাবু যা নমুনা দেখছি তাতে আপনার বাড়ির অবশিষ্ট অংশটুকু যে আমার খুব পছন্দ হবে তেমন কিন্তু মনে হচ্ছে না।’
ভেতরে অপছন্দ হবার মতো তেমন কিছু ছিল না, কারণ নীচের তলার ঘরটি ঠিক থাকার জন্য নয়। সেটি গ্যারাজ এবং এয়ারকণ্ডিশনিং প্লান্ট ইত্যাদি রাখার জন্য। যদিও চতুর্মাত্রিকের প্রধান সুবিধে হল আলো-বাতাস, প্রিয়তোষ পুরো বাড়িটি এয়ারকণ্ডিশন করতে ছাড়েনি। আজকালকার সর্বাধুনিক মত অনুসারে বাইরের রোদ্দুর এবং ঘরের ভেতরের কম আলো এই কম বেশিটা চোখের পক্ষে ক্ষতিকর, সুতরাং বাড়ির সব ঘরে প্রত্যেকটি কোণে কন্দরে আলোর হবে সমান তেজ। জানলা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছে রোদে জ্বলা আকাশ, সূর্যের হাজার হাজার লাক্স আর পরমুহূর্তেই ঘরের মধ্যে চোখ ফেরালে তিনশো, এটা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়। সুতরাং সর্বত্র সমান আলো, সর্বত্র সমান তাপ—এর জন্য চাই কৃত্রিম উপায়।
‘এবারে তাহলে একটু ছাদে গিয়ে দেখা যাক বাকি বাড়িটা কোথায় গেল’—অসীম বলে। ‘কিন্তু সিঁড়িটা কোথায় রে? সেটাও চুরি হয়ে গেল নাকি?’
‘না, তা হবে না।’ এই বলে পা দিয়ে একটি বোতাম টেপে প্রিয়তোষ সঙ্গে সঙ্গে ছাদের একটা প্যানেল সরে গিয়ে সেখান থেকে নিঃশব্দে যে ধাপগুলি নেমে আসে তার আংশিক তুলনা বাংলা সিনেমার বড়লোকদের বাড়ির সিঁড়ি। স্বচ্ছ প্লাষ্টিকের ধাপ, রূপোলী অ্যালুমিনিয়মের রেলিং—কিছুক্ষণের জন্য কারো মুখে বাক্য সরে না।
‘এটা তো মন্দ বানাসনি।’ অসীম অবশেষে বলে। ‘তবে এই সিঁড়ি দিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না এই যা দুঃখ।’ ‘সিঁড়ি দিয়ে কোথাও যাওয়া না গেলে সে সিঁড়ি বানানোর মানেটা কি?’ নির্দয়ভাবে জিজ্ঞেস করে অর্চনা। আসলে চতুর্মাত্রিক বাড়ি সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না, কোনও ধারণাই নেই—আর কি করেই বা থাকবে। কারণ এই রকম বাড়ি পৃথিবীতে সেই তো প্রথম।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ওরা আশা করেছিল ছাদে এসে পৌঁছবে কিন্তু তার বদলে এসে উঠল দোতলার পাঁচটি ঘরের মাঝখানের ঘরটিতে, গোড়ার প্ল্যানে যেমন ছিল।
প্রিয়তোষের মুখে কথাটি নেই, অসীমের অবস্থাও তথৈবচ। কেবল অর্চনা কিছু না বুঝেসুঝে এদিক-ওদিক তাকিয়ে যা ইচ্ছে তাই মন্তব্য করতে লাগল।
মাঝের ঘরটি বসার ঘর। অর্চনার দেখা কোন বসার ঘরের সঙ্গে কোনখানে তার মিল নেই। বেশ মোটা হাতলওয়ালা সোফা বা পা ডোবানো কার্পেট—এর কোনোটাই সেখানে দেখতে পেল না সে, তার বদলে অদ্ভুত চেহারার কিছু বসার জিনিস, তাকে চেয়ার না মোড়া না কি আখ্যা দেওয়া যায় ভেবেই পেল না সে। আলোটা মন্দ না, কোথাও কোনো বালব দেখা যাচ্ছে না, সুইচবোর্ড বলেও কোন বস্তু নেই, কিছু ছবি আছে দেওয়ালে, তা থাক, ছবি নিয়ে অর্চনা বড় একটা মাথা ঘামায় না। তার পক্ষে সবচেয়ে দরকারী ঘর যেটা—রান্নাঘর, সেদিকে দৃষ্টি গেল। বিলিতি ম্যাগাজিন থেকে যেন তুলে আনা হয়েছে। আপাদমস্তক গোলাপী, ফ্রিজ যে আবার গোলাপী হতে পারে তাও তো সে জানতো না। দেওয়াল আলমারীগুলো গোলাপী রং করে বেশ খুলেছে। তবে বড় ছোট বাপু, ওর মধ্যে আমার চালের ড্রাম ধরবে কি করে। তা ছাড়া অত উঁচুতে। আর গ্যাস ফুরোলে করছি কি? ও, পাশেই একটা দেওয়ালে ঝোলানো গোলাপী টেলিফোনও রয়েছে দেখছি।
‘বাইরে থেকে দেখে কিছুতেই বোঝবার জো নেই যে দোতলায় এতটা জায়গা। কিন্তু খাবার ঘরের ওই গোল টেবিলটি কার পছন্দে কেনা হয়েছে শুনি? প্রিয়তোষবাবুর নিশ্চয়ই।’
অর্চনার ভুরু কোঁচকানো মাঠেই মারা গেল, অসীম ও প্রিয়তোষ তখনো স্তম্ভিত হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে।
‘প্রিয়তোষ?’
‘দাঁড়া দেখি।’ প্রিয়তোষ কপালের ঘাম মুছে পা দিয়ে একটা বোতাম টেপে। ঠিক আগের সিঁড়িটির মত ছাদ থেকে আর একটি স্বর্গের সিঁড়ি ভেসে আসে। ওরা তিনজন নিঃশব্দে ওপরে ওঠে। শোবার ঘর। চারটি জানলাতেই ভারী পর্দা টানা। ঘরে ঠিক দোতলার মতোই স্নিগ্ধ আলো। অসীম একটু দম নেয়। ‘এর ওপরের তলায় তুই প্ল্যান করেছিলি আমার পড়ার ঘর—তাই না? তাহলে সবচেয়ে ওপরের তলায় উঠলে হয়তো আমরা ব্যাপারটার কিছু হদিশ পেতে পারি।’
আর এক প্রস্থ সিঁড়ি ওঠা। এবার ওরা ছাদে পৌঁছবে ভেবেছিল, কিন্তু তার বদলে দেখল তিনজনেই দাঁড়িয়ে আছে একতলার গ্যারাজে।
অর্চনা চিৎকার করার আগেই অসীম শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে।
‘আর নয়, পালাও, পালাও। এ-সব ভূতুড়ে কাণ্ড।’ দুজনেই খোলা দরজা দিয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে যায়। প্রিয়তোষ নিজের চিন্তায় মগ্ন। ওদের লক্ষই করেনি। হঠাৎ ওপরতলা থেকে ভাঙা গলায় হৈ-চৈ শুনে তিন লাফে সিঁড়ি টপকে উপস্থিত হয় বসার ঘরে। মাঝের ঘরে অসীম দাঁড়িয়ে, অৰ্চনা অজ্ঞান। প্রিয়তোষ দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে এক বোতল ঠান্ডা জল এনে তার মাথায় ঢেলে দেয়।
‘উঃ—আঃ—’ উঠে বসে অর্চনা। ‘আপনি আমার পনেরো টাকার খোঁপা নষ্ট করে দিলেন। এই খোঁপাটা অন্তত সাতদিন রাখতাম আমি। তা ছাড়া আমার সেরামিকের কানের ফুল—দেখুন গলে কি অবস্থা হয়েছে।’
প্রিয়তোষ তার কথায় কর্ণপাতও করে না। আবার রান্নাঘরে যায়। তার সামনে গেলাসে করে একটা হলদে মতো জিনিস ধরে বলে, ‘নিন এটা খেয়ে নিন।’
‘উঃ, কি গন্ধ। প্রিয়তোষবাবু আপনি কি আমাকে মদ খাওয়াবার চেষ্টা করছেন? ওগো শুনছো—’
‘আচ্ছা, ব্যাপারটা কি বলতো অসীম?’ জিজ্ঞেস করে প্রিয়তোষ। ‘আমার তো মনে হল তোরা চলে গেছিস।’
‘তাই তো গেলাম। বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখি এখানে।’
‘হুঁ। ভাবালে দেখছি।’
‘তখনি বলেছিলাম ওই সব চতুর্থ মাত্রা-টাত্রা নিয়ে ছেলেখেলা করতে যেও না। এখন সামলাও ঠ্যালা।’
‘কি হয়েছে তুই বুঝতে পারছিস?’
‘আজ্ঞে না। বুঝে দরকার নেই। তোমার চতুর্থ মাত্রা তোমারই থাক।’
অর্চনা এইবার কান খাড়া করে। ‘কি বলছো তোমরা? চতুর্থ মাত্রা, চতুর্থ মাত্ৰা?’
‘ও-সব তুমি বুঝবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো একটু।’
‘খুব বুঝবো। ইন্টারমিডিয়েটে আমার অঙ্ক ছিল। সলিড্ জিওমেট্রি আমার ভালোভাবেই জানা। মিস মিত্র কত দুঃখ করলেন আমার যখন বিয়ে হয়ে গেল। বলুন তো প্রিয়তোষবাবু ব্যাপারটা কি?’
‘ব্যাপারটা কিছুই নয়, খুব সামান্য। আমি আপনাদের জন্যে একটা চতুর্মাত্রিক বাড়ি বানিয়েছিলাম। সবাই তো ত্রিমাত্রিক বানায়, মানে দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা—বোঝেন তো ব্যাপারটা?’
‘নিশ্চয়।’
‘কিন্তু তাতে জায়গা বেশি লাগে, খরচও বেশি—’
এই কথাটা অর্চনার মনে ধরে। সে উৎফুল্ল হয়ে বলে—‘সে তো বেশ ভালো কথা। কিন্তু তারপর কি হল?’
‘তারপর আর কি? কাল রাত্রের ভূমিকম্পে মাত্রাগুলো ওলোট-পালোট হয়ে ঘরগুলো সব ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে গিয়েছিল, তাই আমরা নীচ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।’
‘কি বাড়িই বানালে।’ বিদ্রূপ করে অসীম। ‘ভূমিকম্প প্রুফ! না কাঁচকলা।’
‘কিন্তু দেখ, বাড়ির একটা জিনিস এদিক থেকে ওদিক হয়নি। কাল বিকেলে আমি ব্র্যাণ্ডির বোতল যেখানে রেখে গিয়েছিলাম, ঠিক সেখানেই আছে, ওল্টায়নি পর্যন্ত। চতুর্থ মাত্রায় যখন কোনও আবর্তন হয় তখন সেটা ত্রিমাত্রিক কোনও বস্তুকে স্পর্শই করতে পারে না।’
‘যাক গে—সে-সব বুঝে আমার কাজ নেই। আপাতত তুমি আমাদের এই বাড়ি থেকে বেরোবার একটা রাস্তা বাতলে দাও।’
‘হ্যাঁ, তাতো বটেই, তাতো বটেই। এই যে—’ প্রিয়তোষ হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় নীচে, তারপর বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পর মুহূর্তেই দোতলার ঘরে অসীম ও অর্চনার মুখোমুখি।
‘হুঁ।’ মাথা চুলকোয় সে। ‘একটু গোলমাল হয়ে আছে মনে হচ্ছে। আসলে বুঝলি এটা হচ্ছে একটা অঙ্কের প্রবলেম।’ পরক্ষণেই অর্চনার হিংস্র দৃষ্টি দেখে সে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, জানলা দিয়ে বেরোন যায় কিনা দেখি।’ পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায় সে। মুখ গম্ভীর আকার ধারণ করে।
‘কি হল, কি দেখছিস ওখানে?’ অসীম জিজ্ঞেস করে।
‘জানলাটার পরে কিছু থাকার কথা ছিল না, কিন্তু এখন দেখছি এখানে খাবার ঘরটা এসে গেছে।’
‘তোর বাড়ি আর তোর কথা শুনছে না।’ এত দুঃখেও অসীমের হাসি পায়।
‘আমার বাড়ি, আমার বাড়ি করছিস কেন। এটা তোমার বাড়ি, তোরা থাকবি বলে আমি এত কষ্ট করে তৈরি করলাম।’
অর্চনা ততক্ষণে খোঁপাটি আলাদা চেয়ারে রেখে বাকি চুলগুলো নেড়েচেড়ে শুকোচ্ছিল। এই কথার পর সে থমথমে গলায় বলে, ‘প্রিয়তোষবাবু, এই কাণ্ডের পর যদি আপনি কিংবা আপনার বন্ধু আশা করেন যে, আমি এই বাড়িতে থাকতে আসব, তাহলে খুব ভুল করছেন। বরং আমি টুনটুনির হাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে খাব, তাও ভালো তবু এই—’ সে চোখে আঁচল চাপা দেয়।
প্রিয়তোষ বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা দাঁড়ান, দাঁড়ান, জানলাটা দিয়ে—’ শার্সির দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে সে পা দিয়ে একটা বোতাম টেপে, পরক্ষণে সে অসীম ও অর্চনার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রিয়তোষ অবশ্য নিজেকে ঠিকই দেখতে পায় বাগানে হুমড়ি খাওয়া অবস্থায়। মাথার পিছন দিকটা ঢিবি হয়ে ফুলে উঠেছে—দু-চারটে গোলাপের কাঁটাও ফুটে গেছে পায়।
‘ছাদ থেকে পড়ে গেলাম মনে হচ্ছে।’ এই বলে আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে এক দৌড়ে একতলার ঘরে এসে ঢোকে। ‘অসীম, অর্চনা বাইরে আসার রাস্তা পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি।’ উল্লাসে চেঁচাতে থাকে সে।
‘কোথায়, কোথায়?’ সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে নেমে আসে ওরা দু-জন।
‘দোতলার পশ্চিম দিকের জানলা দিয়ে পিছন ফিরে লাফ মারুন, তাহলেই হবে।’
অর্চনা রাগে গজগজ করতে থাকে। ‘কি ছিরির বাড়িই না বানিয়েছেন, মরে যাই। যতবার বাইরে যেতে হবে, ততবার দোতলার জানলা দিয়ে পিছন ফিরে লাফ। তারপর হাড়গোড়গুলো ভাঙুক। আহ্লাদ আর কি।’
‘কিছু দরকার নেই অর্চনা। চল আমরা স্বাভাবিকভাবেই বেরোই, যেমন করে মানুষ বাড়ি দিয়ে ঢোকে, বেরোয়। খুব শিক্ষা হল যা হোক।’
ওরা দুজনেই রেগেমেগে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় এবং পরক্ষণেই উপস্থিত হয় দোতলার ঘরে।
‘ওভাবে হবে না, আগেই বলেছিলাম।’ শুকনো হাসি হাসে প্রিয়তোষ। হঠাৎ সে সচকিত হয়, মন দিয়ে কি যেন শোনবার চেষ্টা করে—
‘কার গলা শুনছি? মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ ঢুকেছে। নিশ্চয় সেই চোর ব্যাটা। চল তো ধরা যাক শয়তানকে। বাড়িকে বাড়ি লোপাট করে দিল হতভাগা, আমার সাত মাসের হাড়ভাঙা খাটুনি।’ প্রিয়তোষ রান্নাঘরের দিকে চলে যায়, প্রত্যেকটি ঘরে একবার করে উঁকি দেয়। কই কোথাও তো কেউ নেই। গেল কোথায় লোকটা? অথচ আমি স্পষ্ট আওয়াজ শুনলাম। পালিয়েছে তাহলে।’
‘কিন্তু কোন দিক দিয়ে? আমরাও তো তাই খুঁজছি।’
দক্ষিণ দিকের জানলাটা দেখা হয়নি। পর্দা তুলতেই দেখা গেল লোকটাকে। চারটে ঘর পেরিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে, দেখতে কিন্তু অনেকটা প্রিয়তোষের মতো। ‘তোমরা একটু এখানে আসবে?’ কাঁপা কাঁপা গলায় ডাক দেয় প্রিয়তোষ।
অসীম ও অর্চনা যখন তার পাশে এসে দাঁড়াল, তখন দেখা গেল, চারটি ঘর পার হয়ে তিনটি পিছন ফেরা মূর্তি—দুটি পুরুষ ও একটি নারী।
* * *
আরও এক বোতল ঠান্ডা জল খালি করার পর অর্চনার জ্ঞান ফিরল।
‘দেখ প্রিয়তোষ, আমি তোকে দোষ দিচ্ছি না। ছেলেবেলা থেকে তোর এই বাহাদুরী করার অভ্যাস দেখে আসছি, কখনও কিছু বলিনি। ইচ্ছে করে তুই যে আমাদের এরকম ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করিসনি, তাও আমি জানি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবে আমরা এখানে কতকাল আটকে থাকব—না খেয়ে না দেয়ে কতদিন বাঁচে লোকে?’
‘রান্নাঘরে অবশ্য খাবার-দাবার যা আছে, তাতে কিছুদিন চলতে পারে—’
‘বোকার মতো কথা বলিস না। তুই নিজেও বুঝতে পারছিস, যতই চেষ্টা করি, আমরা এই মারাত্মক বাড়ি থেকে বেরোতে পারব না। ওই জানলাটা দিয়েও না। তুই নিজেই আর একবার চেষ্টা করেছিস। ইচ্ছে হলে আরও একবার চেষ্টা করে দেখতে পারিস।’
বেপরোয়াভাবে তাই করে প্রিয়তোষ। উঠে গিয়ে জানলার কাচটা তোলে, তিনজনেই সেখানে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে নীচের দিকে তাকায়। তাকিয়ে যা দেখে, তাতে তারা তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যাহোক একটা কিছু ধরে ফেলার চেষ্টা করে, কারণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তারা বুঝতে পারে, সমস্ত বাড়িটা উল্টে গেছে এবং শুধু তাই নয়, জানলা দিয়ে যা দেখা গেল, তার সঙ্গে তাদের পরিচিত শহরের কোনও মিল নেই। সমুদ্রতট, তীরে গোল হয়ে আসা রাস্তা, ক্রমে উঁচুতে উঠেছে। রাস্তার ধারে আলোর মালা দেখাচ্ছে নেকলেসের মতো।
প্রিয়তোষ চতুর্থ মাত্রার কারবার করেছে, কাজেই তার কৌতুহলও বেশি। হামাগুড়ি দিয়ে কোনওমতে এসে সে আবার জানলায় উঁকি মারে। একটু পরেই সে বুঝতে পারে। ‘আরে এটা তো মেরিন ড্রাইভ দেখছি। আরব সাগরের জল। বম্বে।’
‘কোথায় ছিলাম লেক গার্ডনসে—প্রিয়তোষ সরণি আর কোথায় মেরিন ড্রাইভ।’
প্রিয়তোষ আবার ধরে ধরে যায় অন্য জানলাগুলোর দিকে। বিচিত্র দৃশ্য। এ যে দেখা যায় বিবেকানন্দ শিলা, তিন সমুদ্রের ঢেউ তোলপাড় করছে—কিন্তু উল্টো হয়ে আছে সবটাই। তৃতীয় জানলায় দেখা গেল এই বাড়িরই নীচের তলা আর চতুর্থ জানলা দিয়ে মহাশূন্যের নিকষ কালো অন্ধকার।
হঠাৎ বাড়িটা একটু দুলে ওঠে। ‘মনে হচ্ছে ভূমিকম্প,’ প্রিয়তোষ বলে, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। একবার ভূমিকম্প হলে দু-চারটে ঝাঁকুনি হবেই।’ কিন্তু ততক্ষণে যাদের লক্ষ্য করে বলা, তারা বিদ্যুৎগতিতে উঠে হাতের কাছে যে জানলা পেয়েছে তার কাচ তুলে মেরেছে লাফ, অগত্যা প্রিয়তোষকেও ওদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হল।
* * *
লনে বসে নিজেদের হাত পা পর্যবেক্ষণ করতে করতে এ ওর দিকে তাকায় ওরা।
‘ওই যাঃ,’ বলে অর্চনা। ‘খোঁপাটা বাড়িতে ফেলে এলাম।’
‘প্রিয়তোষ, তোর বাড়ি?’ অসীম ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে বলে।
‘হুঁ। ভিতটা যথেষ্ট শক্ত হয়নি মনে হচ্ছে। চতুর্থ মাত্রার ধাক্কা সইতে পারল না। পরের বার—’
‘এরপরেও আবার?’
‘ইনসিওর করা ছিল ভাগ্যে। তা ছাড়া অনেক জিনিস শিখলাম সেটাই লাভ।’
‘প্রিয়তোষ সরণি হবার আর কোনও চান্সই রইল না তাহলে। ভবিষ্যতের অগ্রদূত প্রিয়তোষ। বাড়ি নেই, সরণিও হাওয়া।’
‘কে বলে সরণি হাওয়া। ওই তো মোষ চরছে, ব্যাং ডাকছে। সরণি নিজের জায়গাতেই আছে। আরও কি হবে ভবিষ্যতে সেই আশায় সরণি সরেনি।’
সম্পাদক: গল্পটি লেখকের ‘মানুষ যেদিন হাসবে না’ বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পটি রবার্ট এ. হাইনলাইন এর ‘অ্যান্ড হি বিল্ড এ ক্রুকেড হাউস’ অবলম্বনে লিখিত। গল্পটি টাইপ করে সাহায্য করেছেন নির্জন সেন।
Tags: অনুবাদ গল্প, এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, রবার্ট এ. হাইনলাইন