সরীসৃপ
লেখক: কৌস্তভ গাঙ্গুলী
শিল্পী: বিনয় পাল
টিকি হয়তো আর বেঁচে নেই৷ কাল রাতে বাবা ঘরে স্প্রে করেছিল, সকালে যখন মা আমায় খাটে বসিয়ে চেঞ্জ করাচ্ছে, তখনই দেখতে পাই, আরশোলা ক‘টা মরে আর টুকি, তাসি, আপু — এরা সবাই মাটিতে চিৎ হয়ে আছে … পেটের কাছটা নীলচে ক্যামন ….. হঠাৎ চোখে পড়ে, টিকি আলমারির তলা থেকে বেরিয়ে আসে, গুড়গুড় করে দৌড় দিয়ে খাটের তলায় ঢোকার সময়ই, আয়া মাসী, ঝাড়ুর বাড়ি বসিয়ে দেয় ওর ওপর৷ আমি শিউরে উঠি, কিন্তু বারণ করতে পারি না, গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে অস্ফুট আওয়াজ ….. চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে আমার…. টিকি তুইও চলে গেলি! টুকি, তাসিদের গায়ে লাল পিঁপড়ে জড়ো হয়েছে এতক্ষণে, কিন্তু টিকিটাকে তো দেখতে পাচ্ছি না! টিকিদের সব বন্ধুদের আমার চেনা, সবার নাম তো আমিই রেখেছি৷ ঝাঁটার আঘাতে এলিয়ে পড়েছিল টিকি, তারপর মাসী ফিনাইল, বালতি আনতে বেরোল, মা আমায় স্যুপ খাওয়াচ্ছিল সেই মুহুর্তে৷ টিকির বন্ধুরাও পড়ে আছে এখনো ঘরে পেট উল্টে ….. কিন্তু টিকি কই! ঘর তো এখনো ঝাঁট হয়নি, তাহলে, তাহলে ও কি তবে এখনো বেঁচে! সুযোগ বুঝে পালিয়েছে…. আমাকে চমকে দিয়ে টিকির আওয়াজ ভেসে এল টিক্টিক্টিক্টিক্টিক্…….. সত্য সত্য সত্য৷
সব দেখতে পাই, ব্রেন সবার মতন কাজও করে, তিন বছর আগে দার্জিলিং এ ঘুরতে গিয়ে ম্যালে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাই, শিরদাঁড়ায় সাংঘাতিক চোট লাগে, কোমা গ্রাস করে আমায়৷ শরীরের স্পর্শানুভূতি চলে গেছিল…. এরপর দীপ্তেশও আমার সঙ্গ ছাড়ে৷ দীর্ঘ সাত বছরের ভালোবাসার প্রতিদান ছিল এটাই৷ নামজাদা ফিজিওথেরাপিষ্টের টানা চিকিৎসায় এখন অবশ্য শারীরিক অনুভূতিগুলো অনেকটাই ফিরে এসেছে কিন্তু নড়াচড়া করতে পারি না, গলার আওয়াজও বেরোয় না আর… চেষ্টা করি…. অর্থ পূর্ণ কথাগুলো ঘড়ঘড়িয়ে ওঠে৷ মনের মধ্যেই জমে থাকে সব বলতে না পারা কথা৷
টিকির সাথে আমার প্রথম আলাপ দু‘মাস আগে, ঘরের সিলিং এ পোকার পিছু করতে গিয়ে আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে, মাসী হুঁশ হুঁশ করতেই, কিলবিলিয়ে দৌড়ে দেওয়াল বেয়ে ঘুলঘুলিতে ঢুকে পড়ে টিকি৷ মা‘র কথামতো মাসী যখন আমায় চেঞ্জ করাচ্ছিল, টিকি ঘুলঘুলি থেকে মুন্ডুটা বার করে ক্যামন ভাবে ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়েছিল আমার দিকে৷ আমার আপাদমস্তক নগ্ন দেহর দিকে৷ আমার কিছুই মনে হয়নি তখন৷ মানুষ তো নয়, সরীসৃপ! তারপর থেকে যখনই আমায় পোষাক ছাড়ানো হত, অথবা স্নান, তখনই দেখতাম একটা টিকটিকি ঘরের দেওয়ালে গেঁথে রয়েছে৷
একদিন গভীর রাতে নাকের ডগায় কি একটা ছোঁয়া পেলাম, ঘরের হাল্কা আলোতে চোখ মেলতেই দেখি নাকের ওপর টিকি! গলা দিয়ে ভয়ার্ত আওয়াজ উঠে আসার আগেই — টিক্ টক্ টিক্ট, টিক্টি টক্, টক্, টক্, টিক্ টিক্৷ তখনও ওর সাথে আমার পরিচয় হয়নি, জানতামও না ও এতো অনুভূতিপ্রবণ, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মনে হল সেইসময় আমায় ও কিছু ইঙ্গিত করছে, আওয়াজ করলাম না আর৷ ম্যাক্সির মধ্যে দিয়ে গলে গেল ভেতরে, টের পাচ্ছিলাম কিছুটা, ব্যাটা এমন এমন জায়গা ছানবিন করছে দীপ্তেশ আমার বর হলে ততটা সাহস পেত৷ পরে আমায় টিকি বলেছিল সেদিন সারারাত ও আমার শরীরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেরিয়েছে নির্দ্বিধায়৷ ধীরে ধীরে আমার সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে যায় টিকি৷ কথা বলতে পারতাম না বলে হয়তো অনুভব শক্তি বেড়ে গেছিল, টিকির আওয়াজ শুনে ও কি বোঝাতে চায় ধরতে পারতাম৷ আর ও; আমার মনের কথা বুঝতো আমার চোখের দিকে নিজের মণিকাটা দৃষ্টি রেখে৷ প্রত্যেক রাতেই টিকি আমার শরীরের লজ্জার জায়গাগুলো থেকে উষ্ণতা গ্রহণ করে নিতো চরম আহ্লাদে৷ মাঝে মাঝে আমি শিউড়ে উঠতাম ওর ক্ষিপ্র চলাচলে। কোনো এক ভোরে টিকি জানিয়েছিল, আমায় ও ভালোবাসে৷ থতমত খেয়ে গেছিলাম পুরো৷ কোনো প্রত্যুত্তর দিইনি, চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম খালি৷ শরীরের মধ্যে বমি পাক খাচ্ছিল৷ পরে টিকি ক্ষমা চেয়েছিল আমার কাছে… লজ্জিত হয়ে পড়েছিল খুব৷ দু‘ তিন দিন আসেনি, শেষে একদিন ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি দিলে, আমার চোখ যে আদিম চাহিদার কথা ওকে জানিয়েছিল, তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল পাঁচ মিনিট ধরে টানা টিকটিক অট্টহাস্যে৷ আয়া মাসী হাই তুলতে যাচ্ছিল সেইসময় পাশে বসে আমার, বুকে দম আটকে গেছিল আওয়াজে৷
আমার শরীরের চাহিদা কখনোই টিকি মেটাতে পারবেনা৷ কিন্তু ওর সাহচর্যে, বন্ধুত্বে আমার সময়টা কেটে যায়৷ শারীরিক দিক থেকেও এখন আমি অনেকটা সুস্থ৷ চিকিৎসা কাজ দিয়েছে, আগের থেকে শরীরে সাড় অনুভব করছি অনেক বেশী৷ ডাক্তাররা বাবা মাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, আমার জন্য তাদের অফুরান সময় ব্যয় করার জন্য, কারণ পাশে দাঁড়িয়ে স্নেহ ভালোবাসা দেওয়া এই কঠিন সময়ে খুব দরকার৷ কিছুটা অবাক হয়েছিল আমার মা৷ বাবা তো আমার অফিসে বেরোয় ভোরে, আর এতটাই ক্লান্ত হয়ে ফেরে যে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ আর মা নিজে একগাদা টিউশন পড়ায়, সময় তো খুব একটা দিতে পারে না তারা৷ তবে আমি সুস্হ হচ্ছি এটাই তাদের বড় পাওয়া৷ রাত্রে টিকির স্পর্শ সুখ আরো বেশী অনুভব হচ্ছে, আথালি পাথালি সুখ দিচ্ছে টিকি আজকাল আমায় ওর দৌড় ঝাঁপে, আমি জানি টিকির ভালোবাসাই আমাকে সুস্হ করে তুলছে৷
গতকাল সকালে আমি চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম, টিকিও আমার কপালে বসেছিল চুপ করে, একটু রাগারাগি হয়েছিল৷ এখন দুজনেই চুপচাপ, নৈঃশব্দ৷ “ম্যাগোওওওওওওওও” মাসীর চিৎকার, টিকি এক দৌড়ে ঘুলঘুলিতে৷ মা ছুটে এল, মাসীর মাকে দেওয়া বয়ান অনুযায়ী আমি ঘুমাচ্ছিলাম আর একটা গোদা টিকটিকি আমার কপালে বেয়ে বেয়ে উঠছিল৷ আমি তো থ‘। টিকি তো বসে ছিল ঠায় কপালে চুপটি করে! তারপর বাবার ইনসেক্ট কিলিং স্প্রে৷ আর আজ সকালে এতগুলো অপাংক্তেয়র মৃত্যু৷
আমি এখন চুপটি করে শুয়ে৷ বিদ্যুত চমকাচ্ছে বাইরে ঘন ঘন, ঝোড়ো হাওয়া, স্নাত হচ্ছে রাত৷ টিকি এসেছে, আজ যেন উথলে উঠেছে সরীসৃপের কামবোধ… উজাড় করে দিয়েছে ও নিজেকে৷ আজ বাতাসও যেন যাবতীয় শৈত্য মেখে সরীসৃপ হয়ে উঠেছে, রাত্রি আজকে পতঙ্গভুক, গিলতে চলেছে কালো মেঘের মতন হাঁ নিয়ে আকাশের আগলানো ছোটো ছোটো তারাগুলোকে৷ টিকির দৌরাত্ম্যে আমার রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেছে আজ অনেকটাই৷ আজ আমি প্রবল অর্গাজমের স্বাদ পেলাম টিকির থেকে৷ বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে টিকি উঠে এল চোখের সামনে… গা গুলিয়ে উঠল আমার, মাথার একটা পাশ থেৎলে গেছে ওর, ডান চোখটার জায়গায় বেরিয়ে এসেছে মাথার ঘিলু৷ টিকি ডেকে উঠল, টক্ টক্ টক্ টক্ট টক্ট টিক্ট টিক টিক টিক্ট টিক টিক টক টিক্ট৷ টিকি আর বেশীক্ষণ বাঁচবে না ওর মাথা থেৎলেছে, একটা পা কেটে ঝুলছে, পেটের নাড়িভুঁড়ি ও বেরিয়ে এসেছে, এখন ও আমায় ওর সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়৷ আমি ঘেন্না পেয়েছিলাম এই ভেবে যে এই ক্ষতবিক্ষত গলা পচা নিয়ে আজকেও আমার শরীর দখল করল…৷ কিন্তু এখন আমি ভয়ার্ত অবস্থায় ওর দিকে চেয়ে৷ কি বলছে ও এসব! টিকি ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে, ট্যাঁক ট্যাঁক ট্যাঁক ট্যাঁক টোঁক টোঁক টোঁক টোঁক৷ বীভৎস হাসি, বাতাস গুমোট হয়ে ওঠে চারপাশের…
আমি গোঙাচ্ছি আর কেঁপে চলেছি, গ্যাঁজলা উঠছে মুখে৷ টিকি ওর শরীরটা নিয়ে আমার নাকের ফুটো দিয়ে এতক্ষণে অনেকটা ঢুকে গেছে…
Tags: কৌস্তভ গাঙ্গুলী, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, ফ্যান্টাসি গল্প, বিনয় পাল, সরীসৃপ, হরর
Adbhut, bhoyonkor, apnar kolponashokti r sotyi prosongsha kora uchit
odbhut,odbhut..
prosenjit