সাক্ষাতে সত্যজিৎ (পাঁচ দশকের পুরোনো সাক্ষাৎকার)
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: অন্তর্জাল
সত্যজিৎ রায়ের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার সম্পাদক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃত অদ্রীশ বর্ধন, আজ থেকে অনেক অনেকদিন আগে। অতীতের পাতা থেকে সেই দুর্লভ সাক্ষাৎকার আরও একবার ফিরে এল ‘কল্পবিশ্ব’-র পাঠকদের সামনে।
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধনের নেওয়া সত্যজিৎ রায়ের এই সাক্ষাৎকার দুটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার পাতায়। সেই সময় সত্যজিৎ রায় ‘অবতার’ নামে একটি সায়েন্স ফিকশন ছবি তৈরির কথা ভেবেছিলেন। চিত্রনাট্য তৈরি থেকে কাস্টিং ইত্যাদি বহু বিষয় নিয়েই তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেকটাই। যে সময়ে হলিউডের তৈরি সায়েন্স ফিকশন ছবিগুলিতে ভিনগ্রহের প্রাণীদের কেবল পৃথিবীর ওপরে আক্রমণকারী হিসেবেই দেখা হত, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ কল্পনা করেছিলেন এমন এলিয়েনের, যে কোনও সাম্রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছে নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি। এ প্রসঙ্গে সত্যজিতের ছোটগল্প ‘বন্ধুবাবুর বন্ধু’-র সেই ‘অ্যাং’ নামের ইটির কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে সকলের। কোনও সন্দেহ নেই, স্পিলবার্গের ‘ইটি’ ছবির অনেক আগেই এক মানববন্ধু এলিয়েনের কল্পনা করেছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু বিশ্বের সমস্ত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দুর্ভাগ্য শেষ পর্যন্ত ছবিটি হয়নি। সত্যজিৎ তাঁর সেই স্বপ্নের কথা আড্ডার মেজাজে জানিয়েছিলেন একান্ত স্নেহধন্য অদ্রীশ বর্ধনকে।
প্রথম সাক্ষাৎকার
লন্ডনে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর সায়েন্স ফিকশন ছবির এক বিশেষ ভূমিকায় প্রখ্যাত অভিনেতা পিটার সেলার্সকে চুক্তিবদ্ধ করিয়ে ফিরে এলেন। এসএফ সিনে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তিনি। তাঁর প্রথম সায়েন্স ফিকশন ছবি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য ‘আশ্চর্য!’-তে পরিবেশন করা উপলক্ষে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের আয়োজন হল অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে।
প্রশ্নোত্তর দেওয়া হল নীচে—
পিটার সেলার্সকে চুক্তিবদ্ধ করালেন কোন ভূমিকার জন্যে?
মাড়োয়ারি ভূমিকার জন্য।
পিটার সেলার্স কোন দেশবাসী?
ইংলিশ। যুদ্ধের সময়ে পুরো একবছর তিনি কলকাতায় ছিলেন।
কিন্তু তিনি বাংলা বলবেন তো?
আমার কাহিনিতে তাঁর বাংলা বলার দরকার নেই। আগাগোড়াই তিনি কথা বলবেন এক আমেরিকানের সঙ্গে ইংরেজিতে। কিন্তু তাঁর বাংলা বলার খুব ইচ্ছে। আমাকে খুব ধরেছিলেন। আমি কথা দিয়েছি, ছবিতে বাংলা বলার সুযোগ করে দেব!
পিটার সেলার্স তো ‘ডক্টর স্টেঞ্জ লাভ’–এ ছিলেন?
হ্যাঁ।
আমেরিকান চরিত্রে তাহলে মার্লোন ব্রান্ডো থাকছেন?
ব্রান্ডোর থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কেননা, প্রথমত আমার কাহিনির চরিত্রের সঙ্গে ব্রান্ডো তেমন খাপ খায় না। দ্বিতীয়ত, বিলেতে গিয়ে শুনে এলাম ব্রান্ডো একটু টেম্পারামেন্টের মানুষ। সোজা কথায় মেজাজি। ওঁর সঙ্গে কাজ করা মুশকিলের ব্যাপার।
কিন্তু ব্রান্ডো তো ইচ্ছুক? তা ঠিক। হঠাৎ কলকাতায় উনি এলেন, যোগাযোগটাও হয়ে গেল। তা ছাড়া আমার ছবি দেখতে উনি খুবই ভালোবাসতেন এবং প্রতিটি ছবি খুঁজে খুঁজে দেখেন। কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে সাধারণ দর্শকের কাছে ব্রান্ডোর আবেদন বেশি নয় কি? বেশি তো বটেই। ব্রান্ডোর নাম তো আছে। কিন্তু আমি ভাবছি স্টিভ ম্যাকুইনের কথা। স্টিভ এক কথায় অসাধারণ অভিনেতা। বছর চার-পাঁচ হল, তিনি খুব নাম করেছেন। আমার কাহিনির চরিত্রে তিনি খাপ খেয়ে যাবেন। তা অবশ্য সত্যি। ‘গ্রেট এসকেপ’ যারা দেখেছেন, তারা স্টিভ ম্যাকুইনকে ভুলতে পারেন না। তাঁর ব্যাক্তিত্ব ‘ক্যাসাব্ল্যাঙ্কা’–র হামফ্রি বোগার্টের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক কথা। কিন্তু ম্যাকুইন তো ব্যস্ত মানুষ। যদি পাওয়া না যায়? সেক্ষেত্রে পল নিউম্যানকে নেব। (পল নিউম্যানের সাম্প্রতিক ছবি ‘দ্য মুভিং টাগেট’। এই ছবিতে তাঁকে বেসরকারি গোয়েন্দা হিসেবে দেখা যাবে।)
|
কাহিনির নামকরণ হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। ইংরেজিতে ‘দ্য এলিয়েন’। বাংলায় সম্ভবত ‘অবতার’। তবে ওদেশে ও নাম কীরকম নেবে, তার ওপর নাম পালটানো নির্ভর করছে।
কাহিনিটা কী?
(সত্যজিৎবাবু তখন পুরো কাহিনিটা শোনালেন। শূন্যে আঙুল দিয়ে একে একে বর্ণনা দিতে লাগলেন। নিমীলিত চোখে গল্প বলতে লাগলেন। মনে হল যেন সমস্ত দৃশ্যটা তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। খুঁটিনাটি সহ সেই বর্ণনা শুনতে শুনতে অদ্রীশ বর্ধনও যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁয়ে এসে নেমেছে এক বিচিত্র গ্রহযান। তাদের অ্যাডভেঞ্চার, পৃথিবীর ছোট ছোট প্রাণী দেখে তাদের বিস্ময়, মানুষের ওপর তাদের সহানুভূতি, আমেরিকানের আবির্ভাব ইত্যাদি গভীর দাগ কেটে গেল তাঁর মনে।)
গল্প শেষ হলে অদ্রীশবাবু প্রশ্ন করলেন– ছবিতে গ্রহান্তরের আগস্তুকদের দেখাবেন?
নিশ্চয়। বলে, সত্যজিৎবাবু ভিন গ্রহের সেই অতি উন্নত বাসিন্দাদের যে বর্ণনা দিলেন তা যেমনই বিস্ময়কর, তেমনই অভিনব। ফ্যানট্যাসটিক মনে হলেও তা পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত। সত্যজিৎবাবুর ইচ্ছায় এই বর্ণনা এখন গোপন থাকবে—জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করা চলবে না। গল্পের ক্ষেত্রেও তিনি গোপনীয়তা অবলম্বন করতে চেয়েছেন, তাই লেখা হল না।
অদ্রীশবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন– এসব তথ্য এখন প্রকাশ করা যাবে কি?
না। মাইক উইলসন খুবই হুঁশিয়ার মানুষ। যখন সময় হবে, তখন তিনি পাবলিসিটি শুরু করবেন। (এই প্রসঙ্গে ‘২০০১-এ স্পেস ওডিসি’ সম্বন্ধেও আলোচনা হল। এই ছবিটি সম্বন্ধেও দারুণ গোপনীয়তা অবলম্বন করেছেন প্রযোজক। একটি স্থির চিত্রও বাইরে প্রকাশ পায়নি—সেট-এর মধ্যে অনুমতি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কাহিনিও কোথাও প্রকাশ পায়নি। গল্পটা অবশ্য লন্ডনে গিয়ে কাহিনিকার আর্থার সি ক্লার্কের মুখে সত্যজিৎবাবু শুনে এসেছেন, ছবি এবং সেটও দেখেছেন। প্রসঙ্গত, আর্থার সি ক্লার্ক এসএফ সিনে ক্লাবের অন্যতম শুভানুধ্যায়ী।)
মি. ক্লার্ক তাহলে আপনার সঙ্গে কীভাবে আছেন?
খুব সম্ভব তিনি আমার সঙ্গে থাকছেন না। কেননা, গল্পটা তাঁর সাহায্য ছাড়াই আমার লেখা হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমার লিবার্টি আছে, তবে উপন্যাস আকারে প্রকাশের সময় ক্লার্ক থাকবেন।
গ্রহযানের খুঁটিনাটি দেখাবেন?
নিশ্চয়।
(সত্যজিৎবাবু অতি উন্নত এক গ্রহের মহাকাশযানের যে বর্ণনা শোনালেন, তা শুনলে কল্পনাকেও থমকে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রও স্বীকার করেছেন, এ রকম মহাকাশযান সম্ভব। বিজ্ঞান প্রগতির মূল লক্ষ্যই হল তাই। আমরা এখনও যা কল্পনাতেও আনতে পারিনি, অতিদূর গ্রহের বাসিন্দারা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। সত্যজিৎবাবুর ইচ্ছায়, গ্রহযানের ভেতরের এবং বাইরের বর্ণনা আপাতত প্রকাশ করা হবে না।)
অদ্রীশবাবু আবার প্রশ্ন করেছেন—
‘অবতার’ তো বাংলায় লেখা হচ্ছে?
হ্যাঁ। কিন্তু এই কাহিনিকে অবলম্বন করে আর্থার সি ক্লার্ক উপন্যাস লিখবেন এবং সে উপন্যাস বিলেত থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কাহিনিকার হিসেবে আমাদের দুজনের নাম থাকবে।
ভারতের সর্বপ্রথম ৭০ এম এম এর ছবি তাহলে আপনিই তুলছেন এবং সে ছবিও ভারতের সর্বপ্রথম সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম?
হ্যাঁ। এ জন্যে ক্যামেরা আনা হবে বাইরে থেকে। মেকআপ ম্যানও আসবে বাইরে থেকে। স্পেসশিপ এক্সপার্টও বাইরে থেকে আসবেন।
সে তো অনেক খরচের ব্যপার?
মাইক উইলসন তা দিতে রাজি। তিনি সিলোন থেকে ৪/৫টি ছবি তুলেছেন। প্রতিটি ছবিতে শতকরা পাঁচশো ভাগ লাভ করেছেন। তিনি বলছেন, টাকার জন্যে ভাববেন না। টাকা আমেরিকা থেকে আসবে। মনে হচ্ছে এদের সঙ্গে কাজ করে আমি আনন্দ পাব। এত ভালো সেটআপ এর আগে আমি কখনও পাইনি। টাকাকড়ির কথা তো ছেড়েই দিলাম, এফিসিয়েন্সিও প্রচুর।
ছবি কৰে শুরু হবে?
মাইক উইলসনের ইচ্ছে এবছর সেপ্টেম্বর মাসে। এতগুলো যোগাযোগ যখন হয়ে গেল, ব্রান্ডোর সঙ্গে কথাবর্তা হয়ে গেল— তখন শুভস্য শীঘ্রম। কিন্তু বলেছিলাম, ‘অশনি সংকেত’ আর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ না তুলে সায়েন্স ফিকশনে হাত দেব না। কারণ, এ ছবি তোলার পর আমার ছবি তোলার ধারাটাই পালটে যাবে। মাইক উইলসনেরও তাই মত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থির হয়েছে, সামনের বছরের (১৯৬৮) জানুয়ারিতে কাজ শুরু হবে। তা না হলে কতকগুলো অসুবিধের সম্মুখীন হতে হবে।
অশনি সংকেত?
তার আগেই তোলা হয়ে যাবে।
গুপী গাইন?
সামনের বছরের অক্টোবরে তুলব।
আচ্ছা, মাইক উইলসন কি আমেরিকান?
তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডে। মার্চেন্ট নেভিতে যোগদান করে অনেক দেশ তিনি ঘোরেন। কানাডাতেও অনেককাল ছিলেন।
‘অবতার’–কে কি তাহলে আমেরিকান প্রোডাকশন বলা যাবে?
সেটা এখন ঠিক বলা যাবে না। (সাক্ষাৎকার সেদিনের মতো স্থগিত রইল। জানা গেল, সত্যজিৎবাবু ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির শুটিং নিয়ে ৫ মে পর্যন্ত ব্যস্ত থাকবেন।)
দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার
‘দ্য এলিয়েন’ সম্পর্কে কথাবার্তা পাকা করার জন্যে সত্যজিৎ রায় গিয়েছিলেন হলিউডে। ছিলেন বহুদিন। সম্প্রতি তিনি কলকাতায় ফিরেছেন। ফিরেই ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার জন্যে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অদ্রীশ বর্ধনকে তিনি বহু তথ্য জানান। প্রশ্নোত্তর আকারে সেই খবরগুলিই নীচে প্রকাশিত হল-
অবতার সম্বন্ধে সব ব্যবস্থাই কি সম্পূর্ণ করে এলেন?
মোটামুটি। তবে ছবি তোলার আগে আরেকবার হলিউডে যেতে হবে টেকনিশিয়ানদের নিয়ে।
ছবি কবে উঠছে?
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে শুরু হবে। তার আগে মাস তিন-চারের প্রস্তুতির প্রয়োজন।
মাঝে কি ছবি তুলবেন?
২১ জুলাই থেকে উত্তমের বাকি শুটিংগুলো শেষ হলেই ‘চিড়িয়াখানা’ শেষ হবে। অক্টোবরে হাত দেব ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে। রঙিন ফিল্ম। ফ্যানট্যাসি। ‘অশনি সংকেত’ বোধহয় পিছিয়ে গেল।
ইংরেজ অভিনেতাদের মধ্যে পিটার সেলার্স তো চুক্তিপত্র সই করেছেন। আমেরিকান অভিনেতাদের মধ্যে মার্লোন ব্রান্ডোকে নিচ্ছেন না?
না। কারণটা আগেই বলেছি। প্রথমত, এ চরিত্রে তিনি খাপ খান না। দ্বিতীয়ত, ব্রান্ডোর টেম্পারামেন্ট আলাদা। ডিরেক্টরদের সঙ্গে হামেশাই গোলমাল হয়। আমাকে অবশ্য কলকাতায় উনি বলেছেন, বাজে ডিরেক্টরদের সঙ্গে ওরকম আমি করেই থাকি। তাহলেও তাঁকে নিচ্ছি না আরও একটা কারণে। একটা ছবিতে দু’জন টপ স্টার থাকলে অনেক অসুবিধা হয়।
তাহলে কি স্টিভ ম্যাকুইন আসছেন?
না। দু’বছরের মধ্যে তাঁকে ধরা যাবে না। তাই একজন উদীয়মান অভিনেতাকে নেব। হলিউডে তিনি নাম করতে শুরু করেছেন। খবরটা পাব সাতদিনের মধ্যেই। এতে তাঁর পক্ষে একটা ভালো ‘ব্রেক হবে। আমাদেরও সুবিধে হবে।
পিটার সেলার্স নিঃসন্দেহে শক্তিমান ও খ্যাতিমান অভিনেতা। বিদেশি বাজারে এবং যারা ইংরেজি ছবি দেখেন, তাদের কাছে ‘অবতার’ বা ‘এলিয়েনে’র আকর্ষণ এজন্য নিশ্চয় বৃদ্ধি পাৰে। কিন্তু যারা বাংলা ছবি দেখেন, তারা পিটার্স সেলার্সের নাম শোনেননি বললেই চলে।
তারা তো সত্যজিৎ রায়ের নাম শুনেছেন।
টেকনিশিয়ানদের মধ্যে কাদের আপনি নিচ্ছেন?
ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র, আর্ট ডিরেক্টর বংশী চন্দ্রগুপ্ত। এদেরকে নিয়ে হলিউড যেতে হবে ছবি তোলার আগেই।
ছবি কি ৭০ মিলিমিটারের বড় ক্যামেরায় উঠবে?
না। উঠবে ৩৫ মিলিমিটারের ছোট ক্যামেরায়। তাতে সুবিধে দুটো। প্রথমত, বড় ক্যামেরা নাড়াচাড়া করার হাঙ্গামা থাকছে না। দ্বিতীয়ত, ৭০ মিলিমিটারের ছবি দেখানোর সিনেমা হল পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। তাই ছবি ৩৫ মিলিমিটারে উঠবে, তা থেকে খুব সহজেই প্রয়োজনমতো ৭০ মিলিমিটারের প্রিন্ট তৈরি করে নেওয়া যাবে। সবাই তাই করে।
অনেকেই আশা করছিল, আপনি বিদেশি ক্যামেরাম্যান নেবেন।
সে অফার অবশ্য আমি পেয়েছি। এই তো সেই চিঠি। টাইপ করা নয়, নিজের হাতে চিঠি লিখেছেন হলিউডের টপ ক্যামেরাম্যান হ্যাসকেল ওয়েসলার। আমার যে কোনও ছবিতে তিনি কাজ করতে প্রস্তুত। এজন্যে কানাকড়িও গ্রহণ করবেন না।
এ তো মস্ত খবর। আমাদের গর্বের বিষয়। আমার মনে হয় চিঠিখানা ফটোস্ট্যাট কপি করে ‘আশ্চর্য!’-তে ছেপে দেওয়া দরকার।
সেটা নিজের বড় পাবলিসিটি হয়ে যায়।
তাহলে, মাইক উইলসন আপনাকে সর্বপ্রথম যে প্রস্তাব জানিয়েছিলেন সেটি প্রকাশ করার অনুমতি দিন।
কোথায় আছে সে চিঠি খুঁজে দেখতে হবে। তুমি পরে এসে নিয়ে যেও।
‘অবতার’ ছবিতে টাকা ঢালছে কে?
কলম্বিয়া পিকচার্স। সারা পৃথিবীতে পরিবেশনার ভারও ওদের। আমি আর মাইক উইলসন একটা কোম্পানি করেছি ‘অবতার’ তোলার জন্যে। এ ব্যবস্থা এশিয়ায় এই প্রথম।
বাঙালি দর্শকদের জন্য আপনি তাহলে নামী অভিনেতা নিচ্ছেন না?
আমার সে রকম কোনও ডগমা নেই। যে চরিত্রে যাকে মানাবে, আমি তাকেই নেব। সে নতুনই হোক কি পুরোনো হোক। আমার প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’-তে আমি মনে করেছিলাম নতুন মুখের দরকার। তাই করেছি। সেই কারণে পুরো সিরিজটাতেই ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে। দ্বিতীয় ছবি ‘জলসাঘর’-এই তো ছবি বিশ্বাসকে নিয়েছি। ওই চরিত্রে তিনিই ছিলেন উপযুক্ত অভিনেতা। আবার ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমের দরকার হয়েছিল।
আবার কিছু ব্যক্তি প্রায়ই বলেন, শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎবাবুকে উত্তমকুমারকেও নিতে হল?
এখন আর তারা তা নিশ্চয় বলবেন না। তাছাড়া পাত্রপাত্রী নির্বাচন সম্পর্কে আমার পদ্ধতি আমি আগেও জানিয়েছি। বাংলাদেশের দু’একটি পত্রিকা ছাড়া সব কাগজেই তা বেরিয়েছিল।
বিলেত টেলিভিশনে সায়েন্স ফিকশন এসেছে?
এসেছে। গোটা দু-তিন রঙিন সিরিজ নিয়মিত চলছে।
সায়েন্স–ফিকশন বই?
একটা দোকান দেখলাম শুধু সায়েন্স-ফিকশন বই আর ম্যাগাজিনের জন্যে।
কিছু নিয়ে এলেন?
ওজন বেড়ে যাবার ভয়ে আনতে পারিনি। হালকা বলে কয়েকটা পেপারব্যাক কিনেছি। তার মধ্যে আছে ‘অ্যালফাভিল’ ছবির চিত্রনাট্য। অনেকগুলো ফুলপেজ ফটোগ্রাফও আছে। পরে তুমি এর অনুবাদ ‘আশ্চর্য!’-তে বার করতে পার। যদিও বিষয়টি খুবই কঠিন তাহলেও কিছু পাঠকের ভালো লাগবে।
প্রথম সাক্ষাৎকারটি ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার মে, ১৯৬৭ সংখ্যায় এবং দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ওই পত্রিকার সৌজন্যে অদ্রীশ বর্ধনের অনুমতি নিয়ে সাক্ষাৎকারদুটি এখানে প্রকাশ করা হল।
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, অন্তর্জাল, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বিশেষ আকর্ষণ, সাক্ষাতে সত্যজিৎ