সায়েন্স ফিকশন – সির্দ্ধাথ ঘোষের কলমে
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: সুদীপ দেব
প্রথম পর্ব
একটি পরিভাষার জন্ম
বিশ্বের প্রথম নিছক সায়েন্স ফিকশন বিষয়ক পত্রিকাটি আমেরিকার পত্রিকা বিপণিতে আত্মপ্রকাশ করে ১৯২৬-এর ৫ এপ্রিল। যদিও ‘সায়েন্স ফিকশন’ পরিভাষাটি তখনো তৈরী হয় নি। ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’ নামে এই পত্রিকার সম্পাদক হিউগো গার্নসব্যাক-এর কলমেই তিন বছর পরে পরিভাষাটির জন্ম। ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’–এর প্রবর্তন সূত্রেই প্রকাশনার একটি শাখা ও সাহিত্যের একটি ‘ঘরানা’ রূপে সায়েন্স ফিকশন স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে।
১৮৮৪-তে লুক্সেমবার্গে জন্ম গার্নসব্যাকের। কিন্তু ১৯০৪-এর পর থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। প্রযুক্তিবিদ্ এই মানুষটি নতুন ধরনের এক ব্যাটারি উদ্ভাবনের কৃতিত্ব অর্জন করার পর বিশ্বের প্রথম রেডিও ম্যাগাজিন ‘মর্ডান ইলেকট্রিক্স’ প্রকাশ করেন ১৯০৮-এ এবং রেডিও সম্প্রচার বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ ‘দা ওয়ারলেস টেলিফোন’ (১৯১০) রচনা করেন। পারিবারিক ব্যবহারের উপযোগী প্রথম ‘রেডিও সেট’ও ডিজাইন করেছিলেন তিনি। ১৯১১-য় ‘মডার্ন ইলেকট্রিক্স’-এর পাতা ভরানোর জন্য তিনি প্রথম সায়েন্স ফিকশন চর্চায় উৎসাহী হন। ‘র্যালফ 124C 41+’ নামে একটি উপন্যাস বারোটি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল।
সাহিত্যের সাথে কণামাত্র সম্পর্ক-রহিত এই উপন্যাসে গতিসঞ্চারের জন্য প্রযুক্তি-বিষয়ক পূর্বাভাসের বন্যা বইয়েছিলেন লেখক – আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, প্ল্যাস্টিক দ্রব্য, টেপ রেকর্ডার, টেলিভিশন, মাইক্রোফিল্ম, নিদ্রারতকে প্রশিক্ষণের যন্ত্র ইত্যাদি। এক মঙ্গলবাসী কর্তৃক নায়িকাকে অপহরণের পর মহাকাশে এক ভয়ানক যুদ্ধকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল উপন্যাসের প্লট। গার্নসব্যাকের এই রচনাই জানিয়ে দিচ্ছে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা কী জাতীয় সৃষ্টিকে অনুমোদিত ও উৎসাহীত করেছিল। পরবর্তী কালে এই জাতীয় রচনাকে ‘সোপ অপেরা’-র আদর্শ জুটি হিসাবে ‘স্পেস অপেরা’ আখ্যা দিয়েছিলেন উইলসন টাকার নামে এক সমালোচক।
‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’-এর পরে গার্নসব্যাক একের পর এক ‘সায়েন্স ওয়ান্ডার স্টোরিজ’, ‘এয়ার ওয়ান্ডার স্টোরিজ’, ‘সায়েন্স ওয়ান্ডার কোয়ার্টারলি’ ইত্যাদি সম্পাদনা করেন। ১৯৫২-য় তাঁর শেষ প্রয়াস ‘সায়েন্স ফিকশন প্লাস’ পত্রিকা। কিন্তু ততদিনে সায়েন্স ফিকশনের কাছে পাঠকের চাহিদা গার্নসব্যাকের প্রযুক্তি বিষয়ক অতি-আশাবাদী পূর্বাভাসের গন্ডি অতিক্রম করেছে, ‘গার্নসব্যাকের ডিলিউশন’ নামে পরিহাসের বিষয় হয়েছে। সাত সংখ্যার পর পত্রিকাটি উঠে যায়।
গার্নসব্যাকের সময় থেকে সায়েন্স ফিকশন একটি মূলত মার্কিনী উপ-সংস্কৃতি রূপে পত্রিকা-কেন্দ্রিক শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এবং গার্নসব্যাকের পদাংক অনুসরণ করেই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরিজ’ – যার সম্পাদক জন ডব্লিউ ক্যাম্পবেল জুনিয়র অভিহিত হতেন ‘দা গুরু অফ ইন্জিনিয়ারিং মাইন্ড’ হিসাবে। সম্পাদক হিসাবে তিনি কিছু তরুণ লেখককে অবশ্য সুযোগ দিয়েছিলেন যাঁরা পরবর্তীকালে ‘সায়েন্স ফিকশন’ লিখে নাম করেছেন। যেমন, আইজ্যাক অ্যাসিমভ, থিওডোর স্টার্জন প্রমুখ। তিনের দশকের এই গার্নসব্যাক ও ক্যাম্পবেল পর্বটিকে ‘এস.এফ.’ ভক্তকুল তাঁদের ‘গোল্ডেন এজ’ বলে থাকেন।
গার্নসব্যাক ও ক্যাম্পবেলের হাতে পরিভাষাটির জন্ম ও প্রাথমিক প্রচারলাভ সত্ত্বেও, ধর্মীয় উপগোষ্ঠীভুক্ত উৎকট এক জাতীয় ভক্তকুল সৃষ্টি হলেও, এই ধারা পরিণতিতে ‘কমিক স্ট্রিপ’-এর বেনোজলে ভেসে গেছে। সায়েন্স ফিকশন শব্দদ্বয় উচ্চারিত হওয়া মাত্র দীর্ঘকাল আমরা তটস্থ হয়ে উঠেছি এই ভেবে যে এইবার উদগত চক্ষু অপার্থিব দানব অথবা সুপারম্যানের লড়াই দেখতে হবে। সায়েন্স ফিকশনকে আমরা ‘বাক রজার্স’ বা ‘ব্যাটম্যান’ জাতীয় গাঁজাখুরি কল্পনা বলে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি। এর পিছনেও গার্নসব্যাক তথা ‘গোল্ডেন এজ’-এরই সর্বাধিক অবদান।
১৯২৮-এ প্রথম এস.এফ. কমিক স্ট্রিপ ‘বাক রজার্স’ প্রকাশিত হয়, তারপরে ১৯৩৮-এ আবির্ভাব ‘সুপারম্যান’-এর। এই জাতীয় এস.এফ. চিত্রকাহিনী সমেত ‘ডোনাল্ড ডাক’, ‘দা লোন রেঞ্জার’, কি ‘বাবর’ ইত্যাদি স্ট্রিপের মধ্যেও ইয়াংকি সংস্কৃতির প্রচ্ছন্ন প্রলোভন ও বিশ্বকে মার্কিনী ছাঁচে রূপান্তরিত করার বিষয়টি বহু সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আলেন্দে-র আমলে চিলির গবেষক ও অধ্যাপক এবং বর্তমানে নির্বাসিত অ্যারিয়েল ডর্ফম্যান। তাঁর রচিত দু’টি গ্রন্থ ‘দা এম্পায়ার্স ওল্ড ক্লোদস’ এবং ‘হাউ টু রিড ডোনাল্ড ডাক্’ (সতেরোটি ভাষায় অনূদিত) নিরীহদর্শন কমিক স্ট্রিপের রাজনৈতিক ও সামাজিক নিহিতার্থ নিয়ে অত্যন্ত মননশীল আলোচনা।
এই জাতীয় এস.এফ. রচনায় আসলে চটুল মার্কিনী ছাঁচের ‘ওয়েস্টার্ন কাহিনী’কেই (‘রেড’ ইন্ডিয়ানদের ধ্বংস করার কাহিনীকেই) ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক প্রগতির মুখোশ এঁটে পরিবেশন করা হয়। ঘোড়ার জায়গায় দেখা দেয় স্পেসশিপ আর তীর -ধনুকের বদলে তুলে নেওয়া হয় ‘লেসার গান্’। ফলে সামরিকবাদ, জাতিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং আতংক ও সংঘর্ষ ইত্যাদি তথাকথিত ‘পপুলার কালচার’-এর যাবতীয় ক্ষত এস.এফ.-এর দৌলতে পৃথিবীর দেশ কাল ছাড়িয়ে গ্রহান্তরের অতীত ও ভবিষ্যৎকেও অমানবিক রক্তপাতে সিঞ্চিত করেছে।
বিজ্ঞানের প্রশ্রয়ে ‘সুপারম্যান’ বা অতিমানবের কাহিনী সম্বন্ধে সায়েন্স ফিকশন রচয়িত্রী উরসুলা কে. লেগুঁই লিখেছেন৭ :
সুপারম্যান একটি ‘সাব্-মিথ’। তার পিতা নীৎসে এবং মাতা কমিক-পুস্তক। সুপারম্যান প্রতিটি দশ বছরের বালক বালিকা এবং আরো লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে বেঁচে আছে এবং আছে বহাল তবিয়তে। সায়েন্স ফিকশনের অন্যান্য সাব্-মিথ হল অভিনব সব অস্ত্র সংবলিত প্রাক্তন ‘তরোয়াল ও ইন্দ্রজাল’ জগতের যত শ্বেত-কেশী নায়ক, উন্মাদ অথবা ঈশ্বর রূপে নিজেকে কল্পনাকারী কম্পিউটার, বিকৃত মস্তিষ্ক বিজ্ঞানী, সহৃদয় স্বৈরাচারী, অপরাধীর সন্ধান লাভে সফল গোয়েন্দা, সেই সব পুঁজিপতি যারা গ্যালাক্সি কেনা-বেচা করে, মহাশূন্য-যানের দুঃসাহসী ক্যাপ্টেন বা সৈন্য, দুষ্কৃতকারী এলিয়েন, সুমতি সম্পন্ন এলিয়েন এবং প্রতিটি উদ্ভিন্ন যৌবনা মস্তিষ্কহীন তরুণী যাদের দানবের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের সান্ত্বনা প্রদান ক’রে উপদেশ দেওয়া হয়েছে বা অধুনা যারা উপরোক্ত নায়কদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে।
সায়েন্স ফিকশন নয়, শুধু এই নামের পরিভাষাটি প্রনয়নের জন্য গার্নসব্যাকের যেটুকু কৃতিত্ব। অবশ্য একথা স্বীকার করতে হবে, স্বয়ং গার্নসব্যাক ও তাঁর অনুগামীরা শেলি, ভার্ন ও ওয়েল্স প্রমুখের সাহিত্যকর্ম নিয়মিত পুনমুর্দ্রন করেছেন এবং ‘এস.এফ.’ তক্মা জুড়ে তাঁদের নিজেদের পূর্বসূরি বলে দাবি করেছেন। কাজেই শুধু সমসাময়িক রচনা নয়, ‘সায়েন্স ফিকশন’ পরিভাষাটি তার জন্ম-পূর্বের সাহিত্যকর্মকেও ঘরানা ভুক্ত ক’রে নিয়েছিল।
পরিভাষাটির জন্মদান ও তাকে জনপ্রিয় ক’রে তোলা এবং তিনের দশক ‘গোল্ডেন এজ’ নামে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও গার্নসব্যাক-রা মার্কিনী পাঠশালা খোলার বহু পূর্বে এবং পাঠশালা বন্ধ হওয়ার পরে পঞ্চাশের দশক থেকে রচিত সায়েন্স ফিকশনই প্রণিধানযোগ্য। সায়েন্স ফিকশনের তাৎপর্য, সার্থকতা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনায় গার্নসব্যাকদের কোনো ঠাঁই নেই।
কয়েকটি অসম্পূর্ণ সংজ্ঞা
ব্যক্তিগত সাহিত্যিকের কীর্তি নয়, সামগ্রিকভাবে ‘সায়েন্স ফিকশন’-কে নিয়ে সাহিত্য সমালোচকরা প্রথম বিশ্লেষণ শুরু করেন এই শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে। একটি ‘ঘরানা’ হিসাবে বুদ্ধিজীবীদের এই প্রথম স্বীকৃতি সত্ত্বেও ‘ঘরানা’-টির সংজ্ঞা নিরূপণে কিন্তু আজও কোনো ঐকমত্যে উপনীত হওয়া যায় নি। এমন কথাও আলোচিত হয়েছে যে সায়েন্স ফিকশনের যত লেখক তত তার সংজ্ঞা এবং কোনো বিশেষ বন্ধনীর মধ্যে ‘ঘরানা’-কে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও এখানে বিশিষ্ট লেখক ও সমালোচকের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা পেশ করা হচ্ছে, কারণ এই সংজ্ঞা-ভেদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সংজ্ঞা-নিরূপণের অসুবিধা এবং সার্থক সায়েন্স ফিকশনের ব্যাপ্তিরও পরিচয়।
ক. সায়েন্স ফিকশন কাহিনীতে কল্পনা ক’রে নেওয়া হয় একটি প্রকৌশলকে, বা একটি প্রকৌশলের প্রভাবকে, বা প্রাকৃতিক পারম্পর্যের একটি বিশৃঙ্খলাকে, যার অভিজ্ঞতা মানুষ এই রচনাটির পূর্বে লাভ করে নি। (- এডমান্ড ক্রিস্পিন, বেস্ট এস এফ স্টোরিজ, ১৯৫৫)।
খ. সায়েন্স ফিকশন সেই শ্রেনীর আখ্যান যেখানে এমন একটি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয় যার উদ্ভব আমাদের পরিচিত জগতে সম্ভব নয়, কিন্তু প্রকল্পটির উৎস মানবিকই হোক বা অপার্থিব, সেটি গড়ে ওঠে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের কোনো উদ্ভাবনকে বা ছদ্ম-প্রকৌশলকে ভিত্তি করে। (- কিংস্লি অ্যামিস, নিউ ম্যাপ্স অফ হেল্, ১৯৬০)।
গ. এস.এফ. কাহিনী গড়ে ওঠে মানুষকে ঘিরে, যা একটি মানবিক সমস্যা এবং একটি মানবিক সমাধান সম্পন্ন, কিন্তু বৈজ্ঞানিক মর্মবস্তু ভিন্ন এই কাহিনী কখনোই রচিত হতে পারত না। (- থিওডোর স্টার্জন, দ্র. জেমস ব্লিশ প্রণীত ‘দা ইসু অ্যাট হ্যাণ্ড’, ১৯৬৪)।
ঘ. সায়েন্স ফিকশন ফ্যান্টাসিরই একটি স্বতন্ত্র ধারা যেখানে পাঠকের পক্ষে ‘অবিশ্বাসকে ইচ্ছাকৃতভাবে সংহত রাখার’ প্রক্রিয়াটি অনেক সহজবোধ্য। কারণ, ভৌত বিজ্ঞান, স্থান, কাল, সমাজ-বিজ্ঞান এবং দর্শনকে ঘিরে তার কাল্পনিক পূর্বাভাসগুলি লালিত হয় এক বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার আবহাওয়ায়। (- স্যাম মস্কোউইৎজ, সিকার্স অফ টুমরো, ১৯৬৬)।
প্রাত্যহিক জীবনে যা সম্ভব তার সীমানায় আবদ্ধ থাকতে মানুষ নারাজ। মানুষের আকাঙ্ক্ষা – বিচিত্র অদ্ভুত অজানা ও অশ্রুতের অভিজ্ঞতা লাভের আকাঙ্ক্ষা (শুধু কল্পনায় হলেও)। খোলা মন নিয়ে একেবারে অপ্রত্যাশিতকে গ্রহণ করা বা প্রত্যাশিত পরিচিতকেই, অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিতে সমীক্ষা করা, তাকে আশ্চর্য অভিনব কিছুতে পরিনত করা এস.এফ.-এর একচেটিয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। পুরাণ, রূপকথা ও রোমাঞ্চ কাহিনীতেও এই সব উপাদানের প্রাচুর্য। বিজ্ঞানের কোনো প্রশ্রয় ছাড়াই মানুষের কল্পনা কতটা প্রসারিত হতে পারে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় ধর্মীয় বহু উপাখ্যান, পুরাণ ও কিংবদন্তি থেকে। স্থলচারী মানুষের শুধু একটি আকাঙ্ক্ষার কথাও যদি বিবেচনা করা হয় – গগন বিহারের স্বপ্ন – তা হলেই বক্তব্য স্পষ্ট হবে।
আকাশ ছাড়িয়ে মহাশূন্যে হানা দেওয়ার, চান্দ্র অভিযানের বাসনা পূর্ণ হয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত লুসিয়েন-এর Menippus উপন্যাসে। জ্যোতির্বিদ কেপ্লার রচিত Somnium-এর ও ফ্রান্সিস গডউইনের একটি উপন্যাসেরও উপজীব্য মহাকাশে পাড়ি। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্যারিস-বাসী Cyrano de Bergerac (Rostand-এর কমেডির চরিত্র হিসাবেই এখন অধিক পরিচিত) তাঁর পূর্বসুরিদের চন্দ্রাভিযানের যাবতীয় কল্পনাকে প্যারডি ক’রে দু’টি ভিন্ন মেজাজের উপন্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জুল্ ভার্নকেই কেন আমরা মহাকাশযাত্রা বিষয়ক প্রথম এস.এফ. রচনাকারের আসনটি দিই?
কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট ‘গোলেম্’ ইত্যাদি কাল্পনিক দানবের অস্তিত্ব সত্ত্বেও মেরি শেলীর ফ্র্যাংকেনস্টাইনের দানব, কারেল চাপেকের রোবোট বা ওয়েল্সের ডক্টর মোরো-র গবেষণাজাতদেরই শুধু সায়েন্স ফিকশনের তক্মা লাগাবার পিছনে কি বিচারধারা অনুসৃত হয়?
ইউটোপিয়া বা ডিস্টোপিয়া – স্বপ্নরাষ্ট্র বা ভগ্নস্বপ্নের রাষ্ট্র বিষয়ক সাহিত্যের সঙ্গে সায়েন্স ফিকশনের সম্পর্কই বা কি? ডার্কো সুভিন নামক এক সমালোচক বলেছেনঃ ‘অ্যাডভেঞ্চার, রোমান্স, জনপ্রিয়তা বা অভিনবত্ব, সব কিছু সত্ত্বেও এস.এফ. শুধু ইউটোপিয়া এবং অ্যান্টি-ইউটোপিয়ার দুই দিগন্তের মধ্যেই লেখা সম্ভব।’ কিন্তু কোন সূত্রে এডওয়ার্ড বেলামি-র ‘লুকিং ব্যাকওয়ার্ড’ (১৮৮৮), উইলিয়াম মরিসের ‘নিউজ ফ্রম নো হোয়ার’ (১৮৯০), জ্যাক লন্ডনের ‘আয়রন হিল্’, কি অল্ডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্লড’ ইতাদিকে এস.এফ. বলে অভিহিত করতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত, কিন্তু ওয়েল্সের ‘টাইম মেশিন’, কি জামিয়াতিনের ‘উই’ এর ক্ষেত্রে তা নয়!
এই পরিচ্ছেদের শুরুতে উদ্ধৃত সংজ্ঞাগুলির সাহায্যে এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। এমনকি সব বাদ দিলেও, বিশুদ্ধ ‘ফ্যান্টাসি’ ও সায়েন্স ফিকশনের মধ্যেও ভেদরেখা নির্ণয়ে অসমর্থ এই অসম্পূর্ন সংজ্ঞাগুলি।
কিন্তু বিভিন্ন সংজ্ঞার ও এই পরিভাষার জন্মের ইতিহাস ছাড়িয়ে আমরা যদি পিছিয়ে যাই ১৮১৮-য়, মেরি শেলির কালে এবং তারপরে জুল ভার্ন ও এইচ. জি. ওয়েল্সের রচনার বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের চেষ্টা করি – কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের হদিশ পাওয়া সম্ভব।
মেরি শেলি, জুল্ ভার্ন ও এইচ. জি. ওয়েল্স
প্রথম সায়েন্স ফিকশন আখ্যা দিয়ে সাহিত্য সমালোচকরা যদি দ্বিধাগ্রস্ত হনও, কবি-পত্নী মেরি উলস্টোনক্র্যাফ্ট গডউইন শেলি-র (১৭৯৭-১৮৫১) সুপরিচিত ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ যে সায়েন্স ফিকশনের যাবতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সংবলিত তাতে কোনো দ্বিমত নেই। এই উপন্যাসটির উল্লেখ মাত্র মানুষের হাতে-গড়া দানবের কীর্তিকলাপের কথাই যদি শুধু আমরা স্মরণ করি তা হলে এই দানবের সঙ্গীলাভের জন্য আর্তনাদ বা তার সৃষ্টিকর্তার পত্নীকে বিয়ের রাত্রে হত্যা ইত্যাদি উপন্যাসটিকে গথিত ফিকশনের অতিরিক্ত কোনো মর্যাদা দিতে অক্ষম। বস্তুতপক্ষে, উপন্যাসটির নাম যে ফ্র্যাংকেনস্টাইন নয় – ফ্র্যাংকেনস্টাইন, অর্ দা মডার্ন প্রমিথিউস, সেটাও বিশেষভাবে খেয়ালে রাখা দরকার।
আমেরিকা ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক বিপ্লবের অল্পদিন বাদে জন্ম মেরি শেলির। নেপোলিয়নের যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতিও মিলোয় নি উপন্যাসটি প্রণয়নের কালে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতেও চলেছে তখন পালাবদলের তুমুল কান্ড। শিল্প-বিপ্লবের এক চূড়ান্ত পর্বে কারখানার অঙ্গন ছেড়ে জল ও স্থল বিজয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাষ্পীয় শক্তি ঔপনিবেশিকদের হাতে আরো কিছু তুরুপের তাস তুলে দিতে চলেছে। অন্য দিকে বার্জেলিয়াস ও লামার্ক বায়োকেমিস্ট্রি ও বিবর্তনবাদ নিয়ে অভিনব গবেষণায় সিদ্ধি লাভ করছেন। বিশুদ্ধ জ্ঞানের অন্বেষণ যে-বিজ্ঞানকে একদিন রাজশক্তি ও ধর্মের প্রতিপক্ষ করেছিল, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা দূরে থাক তখন তা রাজনৈতিক ক্ষমতার সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করতে শুরু করেছে। ইতিহাসের তৎকালীন পটভূমিতে বিজ্ঞানের সামগ্রিক ভূমিকার চেয়েও অবশ্য বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত মূল্যবোধের শংকটই উদ্বুদ্ধ করেছিল মেরি শেলি-কে। প্রকৃতির উপর মানুষের কর্তৃত্ব জারির শুভ-অশুভ বিবেচনা-নির্ভর সীমা নির্ধারণের বিষয়টিও লেখিকার বিবেচনাধীন ছিল। এবং এই বিবেচনা ব্যতীত আজ অবধি সায়েন্স ফিকশনের অস্তিত্ব অর্থবহ, সার্থক হয়ে উঠতে পারে না।
বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞানের সাধনা এবং মানব প্রজাতির উন্নতি সাধনের জন্য গবেষণা সূত্রে ভিক্টর ফ্র্যাংকেনস্টাইন সৃষ্টি করেছিল একটি দানব। কুৎসিত-দর্শন সত্যি, কিন্তু সত্যি কী দানব? ‘সভ্যতার’ সংস্পর্শে না আসায় অকলুষিত একটি সরল বন্য প্রাণী। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও মানবিকতার পরিচয়ই তো বহন করছে তার এই উক্তিঃ ‘আমি আমেরিকান ভূখণ্ড আবিষ্কারের কথা শুনেছি এবং তার আদিম বাসিন্দাদের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা ক’রে কেঁদেছি…’
ভিক্টরের এই সৃষ্টি সায়েন্স ফিকশনের অসংখ্য এলিয়েনদের প্রথম পুরুষ যাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মানুষ আক্রমণ করেছে, কারণ সে ভিন্ন, অন্যরকম। উপনিবেশের আদিবাসীদের সভ্যতাকে তুচ্ছ জ্ঞানে ধ্বংস করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তো রয়েইছে দানবের উক্তিতেই। দানবের কাহিনী বিবৃত করতে গিয়ে মেরি শেলি প্রকৃতপক্ষে সমাজের পরিত্যক্তদের মানবিক আবেগকে বিশ্লেষণ করেছেন। আর আধুনিক প্রমিথিউস ভিক্টর মূলত একটি ‘ফাউস্ত’ চরিত্র। জ্ঞান অন্বেষণের হিতাহিতের দ্বৈরথে পীড়িত। বিজ্ঞান-চর্চার ভালো-মন্দ নয়, এই চর্চা যে নৈতিক উভয়সংকট সৃষ্টি করে, তারই প্রবক্তা ভিক্টর।
উপন্যাসটি প্রকাশের কালে ‘সায়েন্টিফিক রোমান্স’ এই গোত্রভুক্ত করার বা ‘গথিক’ ধারার সঙ্গে তার আত্মীয়তা স্থাপনের চেষ্টা সত্ত্বেও রচয়িতা তাঁর সৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে গ্রন্থটির ভূমিকা (যদিও অনেকের অনুমান পত্নীর হয়ে ভূমিকাটি লিখেছিলেন কবি শেলি) :
আমি অতিপ্রাকৃত আতংকের এক মালা বুনেছি বলে মনে করি না। … ঘটনাটি থেকে সঞ্জাত পরিস্থিতির অভিনবত্বই প্রণোদিত করেছিল [রচনাটিকে] এবং পার্থিব জগতের তথ্য হিসাবে যতই অসম্ভব হোক, কল্পনাকে তা এমন একটি দৃষ্টিকোণ অর্পণ করে যার ফলে মানবিক আবেগকে যেভাবে চিত্রণ করা যায়, বাস্তবগ্রাহ্য ঘটনার আটপৌরে সম্পর্ক থেকে ততখানি সামগ্রিক ও কর্তৃত্বব্যঞ্জকভাবে তা প্রসূত হয় না।
১৮১৮-তে ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ প্রকাশের পর সেই বছরেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ওয়াল্টার স্কট ‘ব্ল্যাকউড্স এডিনবরা ম্যাগাজিনে’র মার্চ সংখ্যায় গ্রন্থটি সমালোচনা করেন। লক্ষণীয়, স্কটও সায়েন্স ফিকশনের স্বাতন্ত্র্য ও সম্ভাবনা স্পষ্ট অনুধাবন করেছিলেন৭ :
[এই গ্রন্থে] কল্পনার উদ্দাম সব বেনিয়মের মধ্যেও সম্ভাব্যতাকে কিন্তু মোটেই দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে রাখা হয় নি, বরং লেখিকা তাঁর আখ্যানের ভিত্তিরূপে যে অ-সাধারন স্বীকার্য (postulates)-গুলি মেনে নিতে বলেন তাও আমরা অনুমোদন করি শুধু এই শর্তে যে অতঃপর তিনি তার ফলাফল নির্ভুল যুক্তি-নির্ভর পথেই নির্ধারিত করবেন।
‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ শুধু সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ নয়, উপরোক্ত ভূমিকা ও সমালোচনার সুবাদে তা ‘সায়েন্স ফিকশন’ নামটি জন্মের পূর্বেই তার দু’টি সম্ভাব্য সংজ্ঞাও দিয়ে গেছে আমাদের।
সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানহীন ভিক্টরের নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অহেতুক আস্থার পার্সোনিফেকেশন্ হিসাবে, ভিক্টরের দ্বৈত সত্তারূপেও তার তৈরি দানবটিকে ব্যাখ্যা করা যায় নিশ্চয়। কিন্তু শুধু এই দ্বৈতসত্তারূপে দানবটির অস্তিত্ব উপন্যাসটিকে সায়েন্স ফিকশনের স্বাতন্ত্র্য দিতে পারে না। নিজের ক্ষমতার বাইরে হস্তক্ষেপের অশুভ কারণে জন্ম যে মেফিস্টোফিলিসের সে-ও ফাউস্টেরই দ্বৈত সত্তা। দ্বৈত সত্তা দানবই হোক কি অশরীরী, তাকে একই ব্যক্তিত্বের দু’টি বিরোধী সত্তা রূপে কল্পনা করা যায়। তারই অন্যতম সেরা সাহিত্যিক উদাহরণ রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’। সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ডক্টর হাইড নিজের তৈরি একটি ওষুধ খেয়ে নিজেকে পরিণত করেছিলেন দানবে। ভিক্টোরিয়ান যুগের ভণ্ডামি ও বিভাজিত ব্যাক্তিত্বকে উদ্ঘাটন করার জন্য স্টিভেনসনের এই রূপক। উপন্যাসের মূল সমস্যা অবশ্য বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীর সামাজিক ভূমিকা ঘিরে গড়ে ওঠে নি।
সায়েন্স ফিকশনের ইতিহাসে মেরি শেলির পরবর্তী অধ্যায়ের দুই জ্যোতিষ্ক জুল ভার্ন ( ১৮২৮-১৯০৫ ) এবং এইচ. জি. ওয়েল্স ( ১৮৬৬-১৯৪৬ )। সায়েন্স ফিকশনের দুই পূর্বপুরুষ রূপে এক নিশ্বাসে নাম দু’টি উচ্চারণ করতেই অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু কি সাহিত্যিক প্রকরণের বিচারে, কি ইতিহাসে বিজ্ঞানের ভূমিকার ব্যাখ্যায় দু’জনের মেজাজে, ভঙ্গি ও উদ্দিষ্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূলত তাঁদের হাতে গঠিত সায়েন্স ফিকশনের দুই শিবিরের অস্তিত্ব আজও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নি। বিশেষ ক’রে বাংলায় সায়েন্স ফিকশন-চর্চাকে তা কিভাবে প্রভাবিত করেছে সে-প্রসঙ্গে আমরা পরেও আবার ফিরে যাব।
ভার্ন ও ওয়েল্সের বহুপঠিত উপন্যাসের আখ্যান বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। এখানে আমরা তাঁদের ভিন্নতার কয়েকটি সূত্র সন্ধানের চেষ্টা করব।
বাণিজ্যিক উৎসাহে ভৌগোলিক অভিযান যখন পৃথিবীতে আর কোনো অজ্ঞাত জগতের সন্ধান লাভের রোমাঞ্চকর বাসনাকে প্রায় নির্বাসিত করেছে, জুল ভার্ন হাজির হলেন তাঁর কাল্পনিক দুনিয়া নিয়ে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অজানা নতুন রাজ্যে পদার্পণের সুযোগ দিল – জলে স্থলে অন্তরীক্ষে, এমনকি মহাকাশে অ্যাডভেঞ্চারের প্রতিশ্রুতি। মহাকাশ যাত্রাকে খুঁটিনাটি বর্ণনার গুণে একটি বিজ্ঞান-সমর্থিত ঘটনার ইলিউশন হিসেবে সৃষ্টি করলেন ভার্ন ১৮৬৫-তে তাঁর ‘ফ্রম দা আর্থ টু দা মুন’ উপন্যাসে। ভার্ন তাঁর উপন্যাসরাজির নাম দিয়েছিলেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজেস’।
কিশোর থেকে বৃদ্ধ শতাধিক বছর ধরে আজ অবধি ভার্নের অ্যাডভেঞ্চারে নিজেরা অংশগ্রহণ ক’রে আসছে। বর্ষীয়ান তলস্তয়কেও শিহরিত করেছিলেন ভার্ন। খেলার ছলে ভার্নের উপন্যাসের জন্য বহু ইলাসট্রেশন করেছেন তিনি। ঠাকুরদা কুলদারঞ্জন রায়ের অনূদিত ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ পড়ে দশ বছরের কিশোর সত্যজিৎ রায়ও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ভার্নের গল্পের প্রাণ-মাতানো নিখুঁত বর্ণনার অঢেল প্রাচুর্য আজো তাঁকে বিস্মিত করে।
শ্রীমতী কার্ল-মার্কসের নিকট বন্ধু, প্যারি কমিউনে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবী ও বিজ্ঞানী Gustave Flourens-এর আদলে ভার্ন সৃষ্টি করেছিলেন ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ্স আন্ডার দা সি’-র রহস্যময় নায়ক ক্যাপ্টেন নেমো-কে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের এবং ভারতের সিপাহি অভ্যুথানের প্রতিও ভার্নের সশ্রদ্ধ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচনায়। কিন্তু ‘বিজ্ঞান’কে তিনি বিশুদ্ধভাবে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিরপেক্ষ হাতিয়ার রূপে কল্পনা করেছিলেন। তাঁর রোমান্টিক কল্পনায় সাম্য ও স্বাধীনতা অর্জনের বাসনা পূর্ণ করেছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ।
ভার্ন তাঁর ‘ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ’ সমূহে বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বস্ততা সম্বন্ধেও সচেতন ও গর্বিত ছিলেন। সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তত্ত্বকে নিকট ভবিষৎতের চেয়ে দূরে প্রক্ষেপ করেন নি সতর্ক ভার্ন। অদ্ভুত নিয়ে তাঁর কারবারে অসম্ভবকে পরিহার করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টার কসুর ছিল না। আর তাই ওয়েল্সের রচিত গ্রহান্তরে ভ্রমণের কাহিনী পড়ে তিনি বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন: ‘আমি [যেখানে] পদার্থবিদ্যাকে কাজে লাগাই, উনি বিশেষ এক ধাতুতে তৈরি উড়োজাহাজে ক’রে হাজির হন মঙ্গলগ্রহে। দেখান তো সেই ধাতুটি আমাকে!’
কিন্তু পরিহাস এখানেই যে এই পিউরিটান মনোভাব সত্ত্বেও ওয়েল্সের ঐ অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি ধাতুর মতো ভার্নের বারুদ-ঠাসা মহাকাশে ক্ষেপণের কামানটিকেও বিজ্ঞান সমান অসম্ভব বলে সহাস্যে খারিজ করেছে। ওয়েল্সের কল্পনার অদৃশ্য মানুষের অবশ্যম্ভাবী দৃষ্টিহীনতা ইত্যাদি স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক বিচ্যুতি লক্ষ করা যায় ঠিকই, কিন্তু শুধু সেই সুবাদে এস.এফ. রাজ্যে উচ্চতর সম্মানের আসনটি ভার্ন অধিকার করতে পারবেন না। সার্থক পূর্বাভাসই যদি খাঁটি এস.এফ.–এর লক্ষণ হয়, তবে ভার্নের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যভেদের গুটিকতক সাফল্য বাদে অধিকাংশই আজ প্রলাপ!
ভার্নের পূর্ববর্তী শেলি এবং পরবর্তী ওয়েল্সের রচনায় প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল ইতিহাসে বিজ্ঞানের ভূমিকাকে ঘিরে তাঁদের সপ্রশ্ন অনুসন্ধান থেকে। বৈজ্ঞানিক প্রগতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যজাত শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব ও নীতিবোধ রহিত বিজ্ঞানের সঙ্গে সামাজিক-জীব বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব যে-সাহিত্যিকে প্রণোদিত করে বা এই সচেতনতা সঞ্চারিত করাই যার অভীষ্ট-বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার জন্য সমকালীন বিজ্ঞানের শুধু অনুমোদিত ক্ষেত্রের সীমা তাকে আবদ্ধ করতে পারবে না-এ শুধু প্রত্যাশিতই নয়, এই জাতীয় সৃষ্টির জৈবিক নিয়মেরই অধীন।
বিপরীতে ইতিহাসে বিজ্ঞানের সদর্থক ভূমিকা সম্বন্ধে আশাবাদী ভার্নের রচনায় প্রকৌশলের রোমান্টিক রূপটি আজ শুধু যন্ত্রবিপ্লবের যুগের এক আত্ম-তুষ্ট ইঞ্জিনিয়ারের খর্বদৃষ্টির পরিচায়ক। উপরন্তু বিজ্ঞানের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রতিটি কল্পনাকে বিশ্বাসযোগ্য ক’রে তোলার জন্য উপন্যাসের দেহের অধিকাংশ জুড়ে ভার্নের ‘ন্যাচারালিস্টিক’ বিবরণ যখনই অসম্ভব বা অবাস্তব প্রমাণিত হয়েছে, সম্পর্কিত সৃষ্টিটি তার একমাত্র অবলম্বন বা গর্বটিকেও খুইয়েছে। আজ ফিকশন হিসাবে যত না তার চেয়ে অভিধান কাহিনী রূপেই গুটিকতক ভার্নের উপন্যাসের সমাদর এবং কিশোরোপযোগী এস.এফ.–এর মডেল জ্ঞানেই কিছু লেখক তাঁকে অনুসরণ করেন।
বিপরীতে ওয়েল্সের মহাকাশ-যান, টাইম মেশিন ইত্যাদি তার আবির্ভাব কালেও যা ছিল আজও ততটাই অবাস্তব। বিভিন্ন ‘গ্যাজেট’কে যন্ত্রসম্ভব বা প্রকল্পকে বিজ্ঞান-সমর্থিত ক’রে তোলার জন্য কারিগরি খুঁটিনাটির অশেষ জটিলতার মধ্যে যান নি ওয়েল্স, কারণ সেটা তাঁর উদ্দিষ্টই নয়।
ওয়েল্সের টাইম মেশিনের সঙ্গে সত্যিই সত্যজিৎ রায়ের গল্প ‘টেরোড্যাক্টিলের ডিম’-এর পরিহাসমূলক উক্তির বিশেষ অমিল নেই, ‘সেই যে একটা সাইকেলের মতো জিনিস চেপে হ্যান্ডেল টানলেই অতীত যুগে, আর আরেকটা টানলেই ভবিষ্যতে চলে যায়।’ কিন্তু ‘অবিশ্বাসকে স্বেচ্ছায় সংহত করার’ সাহিত্যিক পদ্ধতি এই যন্ত্রযোগেই আমাদের পৌঁছে দিতে পারে ভিন্ন দুনিয়ায়। ভিত্তিতে একটি অনুমান – হাইপথেসিস থাকলেও এই ভিন্ন দুনিয়ায় কিন্তু অন্বেষণ চালায় যুক্তিগ্রাহী বাস্তবতা। টাইম মেশিন বা সমগোত্রীয় অসম্ভব যন্ত্র বা কৌশল, বিবিধ কাল্পনিক ও ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ইত্যাদির প্রাথমিক অঙ্গনটি এস.এফ.–রচয়িতাদের (এবং পাঠকেরও কাছে) সাহিত্য-প্রকরণ স্বীকৃত এক ধরনের জাম্পিং-বোর্ড মাত্র। গল্পের রাজ্যে (সত্যান্বেষণের ক্ষেত্রে) পৌঁছে দিয়েই এই সিঁড়িটির কাজ ফুরোয়। জগৎ ও জীবনকে পর্যালোচনার অভিনব একটি মাত্রা যোজনা করেই যা নিজেকে সরিয়ে নেয়।
ফ্যান্টাসির সঙ্গে সায়েন্স ফিকশনের স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নটিও এই সূত্রেই উথাপিত হতে পারে। বিশুদ্ধ ফ্যান্টাসি একটি মাত্র মূল কল্পনাকে ঘিরে দানা বাঁধে না। অসম্ভব কল্পনা থেকে অসম্ভবতর কল্পনা পল্লবিত হতে থাকে সেখানে। বিপরীতে, এস.এফ.–এর মূল প্রকল্পটি যতই অবিশ্বাস্য হোক, বিজ্ঞানের ইতিহাস তাকে এক ধরনের দার্শনিক বিশ্বাসযোগ্যতা দেয় (সার্থকতার সেটাও একটি বিচার নিশ্চয়)। স্থলবন্দী প্রস্তরযুগের মানুষের কাছে জলচর, নভোচর যন্ত্র যতটা দুরূহ কল্পনা, আমাদের কাছে সময়চর যন্ত্র (বিজ্ঞানসিদ্ধ না হোক তবু) ততটা বোধ হয় না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ধারা যে-হারে পুষ্টি লাভ ক’রে চলেছে, বিস্ময়কর চিন্তা বা কল্পনাকে তার চেয়ে দ্রুত হারে পরিচালিত করতে না পারলে তাই নিকট আত্মীয় ফ্যান্টাসির আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে এস.এফ. স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। মানুষ ও পশুর কথোপকথনে কোনো বাধা নেই রূপকথায়। এবার স্যামুয়েল আর. ডিলানি-র উপন্যাস ‘ব্যাবেল-১৭’-য় কি ঘটছে দেখা যাক। গ্রহান্তরের আগন্তুক সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষীর সঙ্গে সেখানে ভাব বিনিময় হচ্ছে কম্পিউটারের মধ্যস্থতায়, কিন্তু সেটি সম্ভব হয়েছে ‘লিঙ্গুইস্টিক’ ও ‘সেমিওটিক্স’ বিদ্যার উপর আধুনিক দখলদারির সুবাদেই। আরো খেয়াল করা দরকার, ভাষা ও ভাববিনিময়ের সমস্যাকেন্দ্রিক এই উপন্যাসে বিষয়টি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অন্যান্য এস.এফ. রচনায় যেখানে তা নয়, এলিয়নদের সঙ্গে কথা চালানোরও দরকার হয় না, টেলিপ্যাথিই সুযোগ ক’রে দেয়।
ভার্নের এস.এফ. বিজ্ঞানের ক্ষমতায় ও মহাবিশ্বের বৈচিত্র্যে মুগ্ধ, আশ্চর্যের সেখানে আশ্চর্য হিসাবেই সমাদর, কিন্তু ওয়েল্সের এবং তাঁর পরবর্তী রচয়িতাদের হাতে পরিশীলিত এস.এফ. সুনির্দিষ্ট দ্বিধা, বিজ্ঞানের রীতি-পদ্ধতির ভিত্তি নিয়ে, সমাজ ও জীবনের উপরে প্রযুক্তির প্রতিঘাত নিয়ে চিন্তা ও মননের অবকাশ দেয়।
ওয়েল্সের গড়া টাইম মেশিন, ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যুদ্ধ (প্রত্যক্ষ ও বায়োলজিকাল), অদৃশ্য মানুষ ইত্যাদি কালক্রমে এস.এফ.-এর বাঁধাধরা বহু ব্যবহৃত উপকরণে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যোগ্য হাতে ‘ক্লিশে’-তে পরিণত টাইম মেশিন যে আজো তার উপযোগিতা হারায় নি, তার নিদর্শন এক দিকে সায়েন্স ফিকশনের বৈশিষ্ট্য নির্দেশিত করে আর অন্য দিকে সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যেই সন্ধান নিতে নির্দেশ দেয় তার সার্থকতার।
কারেল চাপেক
ওয়েল্সের পরে ও দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তী পর্বের অন্তর্ভুক্ত এস.এফ.-এর তথাকথিত ‘গোল্ডেন এজ’ ও মার্কিনিয়ানার প্রসঙ্গ ইতিপুর্বেই আলোচিত। ডেভিড লিন্ডসের ‘এ ভয়েজ টু আর্কটুরাস’ (১৯২০) এবং ওলাফ স্টেপ্লডনের ‘স্টার মেকার’ (১৯৩৭) ইত্যাদি অত্যন্ত গম্ভীর মেজাজের ও তাৎপর্যময় সায়েন্স ফিকশন রচনা হয়েছে এই পর্বে। কিন্তু বর্তমানে বিশেষ ক’রে আমাদের দেশে দুর্লভ এই সব গ্রন্থ এবং যে-কোনো দুর্লভ গ্রন্থের আলোচনার পূর্ব শর্ত রুপে কাহিনীর সারসংক্ষেপ ও কাঠামো পেশ করার পরিসর এই প্রবন্ধে নেই।
এই পর্বের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তাই কারেল চাপেককেই শুধু উপস্থিত করা হচ্ছে। তবে তার আগে আর একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। ১৮৮৮-তে এডোয়ার্ড বেলামি-র ‘লুকিং ব্যাকওয়ার্ড ২০০০-১৮৮৭’ নামে উপন্যাসে ইঊটোপিয়ার বৈজ্ঞানিক প্রগতিতে আস্থা রেখেই রচিত হয়েছিল ভবিষ্যতের আদর্শ সমাজতান্ত্রিক সমাজ। ১৯০৭ এ জ্যাক লন্ডনের ‘আয়রন হিল’ প্রোলিতেরিয়ান বিপ্লবের সন্মুখীন এক ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদী আমেরিকাকে উপস্থিত করেছিল। কিন্তু ১৯১৮-র রুশ বিপ্লবের পর কমিউনিজমের বিরোধিতা থেকে জন্ম নিল ভিন্ন জাতের ডিস্টোপিয়া। কমিউনিস্ট দুনিয়ায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের স্থান নেই এই প্রোপাগান্ডার সমর্থনে রচিত হল প্রযুক্তির অপব্যবহারের কালো ছবি জামিয়াতিনের ‘উই’ (১৯২০) গ্রন্থে। সায়েন্স ফিকশনের কিছু বৈশিষ্ট্য সংবলিত হলেও বর্তমান প্রবন্ধে এই জাতীয় প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক চরিত্রের ইঊটোপিয়া-কে আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।
১৯২২-এর ৯ই অক্টোবর কারেল চাপেকের নাটক R.U.R. নিউ ইয়র্কে প্রথম মঞ্চস্থ হওয়ার পর ‘নিউ ইয়র্ক আমেরিকান’ লিখেছিল ‘বার্নার্ড শ’ সম্ভবত R.U.R. লেখেন নি, কিন্তু সম্ভবত লিখবেন। শ’-এর লেখা R.U.R.-এর একটি পাঠ্যান্তর আমরা পাব এবং তখন কাল রাতে যাকে অত্যন্ত উপভোগ্য ও উদ্দীপ্ত কল্পনার ফ্যান্টাসি হিসেবে গ্রহন করেছি তা পরিণত হবে একটি নিরস তিক্ত সমালোচনায়। কারণ R.U.R. শেভিয়ান হলেও মনোরঞ্জক।’১০ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক চেকোস্লোভাকিয়ার কারেল চাপেক-এর (১৮৯০-১৯৩৮) পূর্বোক্ত R.U.R. নাটকটি আসলে Rossums Universal Robots-এর আদ্যাক্ষর সংগ্রহ। মূল নাটকটি পড়ার সৌভাগ্য না হোক, ‘রোবট’ শব্দটির সৃষ্টীকর্তা হিসেবে চাপেকের নাম সুবিদিত। সায়েন্স ফিকশনের দুনিয়ায় রোবট আজ অবধি বিভিন্ন চরিত্রে অবতীর্ণ একটি অত্যন্ত উপযোগী ও সফল অভিনেতা। বর্তমানে যান্ত্রিক চেহারাবিশিষ্ট কৃত্রিম জীবকে সাধারনত ‘রোবট’ আখ্যা দেওয়া হয়, আর মানুষের দেহধারীকে ‘হিউম্যানয়েড’। কিন্তু মূলে সেই চাপেকের ‘রোবট’। শুধু তাই নয়, আধুনিক আখ্যা অনুসারে চাপেকের রোবটকে ‘হিউম্যানয়েড’-ই বলা উচিত। কারন দেখতে তারা মানুষের মতোই ছিল।
অজস্র অবিকল উৎপাদনের (ইন্টারচেঞ্জেবল মাস্ প্রোডাকশন) যুগে পণ্যনির্মাতারা রাসায়নিক পদ্ধতিতে কৃত্রিম মানুষ উৎপাদন শুরু করে R.U.R-এ। গৃহভৃত্যের কাজ করার উপযোগী ও খুব শস্তা দামের এই রোবটদের কিছুকাল পরেই অপব্যবহার করা হয় – নিযুক্ত করা হয় সৈন্যরূপে। প্রথমে বাধ্য ক্রীতদাস ছিল তারা, কিন্তু একজন রাসায়নিক উৎপাদনের একটি ফর্মুলা পরিবর্তন করার পর তাদের মনে সঞ্চারিত হয় আবেগ ও স্বাধীনতা অর্জনের বাসনা। রোবটদের মুক্তি আন্দোলনের পরিনতি ঘটে এক বিদ্রোহে, যার ফলে মানবজাতি সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে অযৌন রোবটদের মধ্যে একটি আদম ও একটি ইভের আবির্ভাব নির্দেশ করে যে এই প্রজাতি অবলুপ্ত হবে না।
R.U.R ব্যাতীত আরো একটি এস.এফ. নাটক ‘দা ইন্সেক্ট প্লে’ (১৯২১) ও তিনটি গুরুত্বপূর্ন উপন্যাস ‘দা অ্যাবসোলিউট অ্যাট লার্জ’ (১৯২২) ‘কারাক্রিট’ (১৯২৪) এবং ‘ওয়ার উইথ দা নিউট্স’ (১৯৩৬) রচনা করেছিলেন চাপেক। তাঁর সেরা কীর্তি অবশ্য শেষোক্ত উপন্যাসটি। একাধারে হাস্যমধুর ও আশংকার শিহরনময় এই রাজনৈতিক ব্যঙ্গদীপ্ত উপন্যাস সায়েন্স ফিকশনের স্বাধিকারের ক্ষেত্র ও তার সিদ্ধির একটি বিশিষ্ট উদাহরণ।
তিনটি খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থটি। প্রথম খণ্ডে মুক্তো-সন্ধানী এক জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রাচ্যের একটি দ্বীপের সামুদ্রিক সরোবরে নিউট্ নামক জলচরদের একটি প্রজাতির সন্ধান পায়। আকারে তারা মানুষদের চেয়ে কিঞ্চিৎ ছোট। জলে বাস করলেও মাঝে মাঝে তারা কিছুক্ষণের জন্য ডাঙায় বাস করতে পারে। ক্যাপ্টেনের ধারনা হয় এদের মানুষের মত কথা বলতে ও যন্ত্রাংশ বা হাতিয়ার ব্যবহার করতে শেখানো সম্ভব। ক্যাপ্টেন চেক ব্যবসায়ী-সম্রাট বণ্ডিকে উৎসাহিত করে নিউট্দের উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য। যাতে প্রথমে মুক্তা-সংগ্রহ ও পরে অন্য কাজেও ব্যবহার করা যায় তাদের। হাঙরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্রলাভ মাত্র নিউট্রা অত্যন্ত দ্রুতহারে বংশবৃদ্ধি শুরু করে ও দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে ছড়িয়ে পড়ে তারা। মানুষ ব্যাপারিরা তখন তাদের শিকার, গ্রেপ্তার ও কেনাবেচা আরম্ভ করে। নিউট্রা মানুষের অফুরন্ত এক ক্রীতদাস-শ্রমশক্তির ভান্ডারে পরিণত হয়।
গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে নিউট্দের বিশ্বজোড়া শোষণ বঞ্চনার কাহিনী। পৃথিবীর যাবতীয় সমুদ্র ও নদীতটে তাদের আমদানি করা হয়, ব্যবহার করা হয় সম্ভাব্য সকল উদ্দেশ্যে। চিড়িয়াখানায় ভরা হয়, ব্যবচ্ছেদ-সমেত বৈজ্ঞানিক গবেষণার বস্তুতে পরিণত করা হয় এবং শেষে মানবতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর খপ্পরেও পড়ে। তারা নিউট্দের বস্ত্র ভূষিত করে, তাদের নাগরিক অধিকার প্রদান করে এবং বিভিন্ন ধর্মে দীক্ষা দেয়। এই খণ্ডের অন্তিম পর্বে দেখা যায় নিউট্রা বৈজ্ঞানিক সমাবেশে গবেষণাপত্র পাঠ করছে এবং নিজ নিজ ধর্মে মানুষকে ধর্মান্তরিত করছে। বিশ্বের উন্নত যাবতীয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তখন তাদের ওপর নির্ভরশীল এবং নিউট্রাও বিস্ফোরক ও অন্যান্য অস্ত্র-সমেত প্রভূত পরিমানে শক্তি সঞ্চয় করেছে।
তৃতীয় খণ্ডে নিউটরা যুদ্ধ জারি করে মানুষদের বিরুদ্ধে। তাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত অঞ্চলের সম্প্রসারনের দাবিতে। প্রজননের জন্য তাদের তটভূমি প্রয়োজন এবং সেই অনুসারে পৃথিবীর কন্টিনেন্টাল ভূভাগকে তারা নতুনভাবে সজ্জিত করার পরিকল্পনা গ্রহন করে, যাতে তটভূমির পরিমাণ সবচেয়ে বৃদ্ধি পায়। বোঝা যায় আমাদের পরিচিত বহু দেশের অস্তিস্ব নির্মূল হয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে। নিউট্দের প্রতিহত করার কি কোনো উপায় নেই? উপন্যাসের এই অংশে, শেষ অধ্যায়ে লেখকের ‘অন্তর-কন্ঠ’ ধ্বনিত হয়। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে উদ্ধৃতি মারফত রিপোর্ট-ধর্মী একটি আখ্যান রচিত হয়েছিল। লেখক এইসব নথির সংকলকের অতিরিক্ত কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেন নি। ‘অন্তর-কন্ঠ’-র সঙ্গে লেখকের আলোচনাসূত্রে বেরিয়ে আসে আশাপ্রদ(?) উপলব্ধি : নিউট্রা মানুষের কাছ থেকে এত শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে লোভ আর উচ্চাশার তাড়নার পরিনতিতে তারাও নিজেদের মধ্যে আত্মক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর
মেরি শেলীর কালে বিজ্ঞানের অনৈতিক প্রয়োগের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তলব পড়ত বিজ্ঞানীদের। অসামাজিক অমানবিক উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ রোধ করবার জন্য তাই খুনে বৈজ্ঞানিকের বিকল্পরূপে উপস্থাপিত আদর্শবাদী বৈজ্ঞানিকের প্রতিষেধকও ছিল একটা। কিন্তু কালক্রমে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গবেষণাগারের প্রাচীরটিও সুদৃঢ় ও দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে লাগল। বিজ্ঞানের ভাষা ক্রমেই সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্যতর প্রাচীন চীনা ব্যাকরণে পরিণত হতে লাগল। অন্যদিকে বিজ্ঞান থেকে জন্ম নিল এক মহাবিজ্ঞান। মহাবিজ্ঞানের রাজ্যে ব্যাক্তিগত প্রতিভার স্ফুরণের পক্ষেও তখন অপরিহার্য হয়ে উঠল প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা। গ্যালিলিও-কোপার্নিকাসের যুগে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মধ্য দিয়ে যে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম তার সঙ্গে ক্ষীন সম্পর্ক মহাবিজ্ঞানের। বার্নাল, হ্যালডেন, পিয়ের-জোলিও কুরি, পাউলিং প্রমুখের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হবে যে বর্তমান যুগে নিজস্ব কক্ষে বসে কম্পিউটার বা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তোয়াক্কা না করে কোনো নিউটনের আর স্বাধীনভাবে যুগান্তকারী আবিষ্কারের সুযোগ নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির মুহুর্তে বিশেষ করে মহাবিজ্ঞানের উপরোক্ত স্বরূপ আর হৃদয়াঙ্গম না করার কোনো উপায় রইল না। হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে কবরস্থ হল বিজ্ঞানের যাবতিয় অবশিষ্ট ‘মিথ্’। এবং জড়কে শক্তিতে পরিণত করার অনিয়ন্ত্রিত সাফল্যের সেই অসভ্য আলোকে নিজের শক্তিমত্তা নতুন করে উপলব্ধি করল সায়েন্স ফিকশন। সহজবোধ্য ভাষায় সায়েন্স ফিকশন ফলাফল ও পরিণতির বিচারে সাধারন মানুষকেও দুর্জ্ঞেয় বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ সমালোচনার অধিকার প্রদান করল। একই সঙ্গে সায়েন্স ফিকশন শুধু সাহিত্যাভিলাষী বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদ্দের একচেটিয়া চারণক্ষেত্র রইল না।
ঘরানা রূপে সায়েন্স ফিকশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালেই সিরিয়াস সাহিত্যের মর্যাদা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, ইতিপূর্বে শেলি, ওয়েল্স বা চাপেক্ প্রমুখ সাহিত্যের মূলধারার মধ্যেই যে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, যার গায়ে গার্নসব্যাক ও তার অনুগামীরা প্রথম ‘এস.এফ.’ তকমা লাগিয়েছিল, সেই রচনাগুলি নতুনভাবে তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে উঠল পারমাণবিক যুগে। এস.এফ.-এর ঐতিহ্য সন্ধানের ক্ষেত্রে এই পারমানবিক যুগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। রোমাঞ্চকর গথিক নভেলের কুলে জন্মেও ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ বিজ্ঞান-চর্চার নৈতিকতার প্রতি সপ্রশ্ন দৃষ্টিবলে স্বতন্ত্র হতে পেরেছিল। আর উত্তর-পারমানবিক যুগে তেজস্ক্রিয়তার বলি-স্বরূপ (মিউটেশন-ঘটিত) যে অসহায় করুন সব দানবের জন্ম বা ক্লোনিঙের আশ্রয়ে কনসেনন্ট্রেশন ক্যাম্পের ঘাতক প্রাক্তন এস. এস. বাহিনী প্রধানের কোষ বীজ জাত অসংখ্য অবিকল নৃশংস নাজিদের বাহিনী- আধুনিক সায়েন্স ফিকশনের এই সব চরিত্রদের পূর্বপুরুষরূপে ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবকে নতুনভাবে চিনলাম আমরা। চাপেকের ‘রোবট’ বা ‘নিউট্’ বিদ্রোহ বা ওয়েল্সের ‘টাইম মেশিন’ নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে অর্থবহ হয়ে উঠল এবং উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ন হতে শুরু করল তারা। সায়েন্স ফিকশনে একই ‘থিম্’ অথবা ‘ফর্ম’ বারংবার ব্যাবহারেও জীর্ণ না হয়ে বাস্তবতার স্বরূপ উপলব্ধিতে সাহায্য করে – এই বৈশিষ্ট ধরা পড়ল উত্তর-পারমাণবিক যুগেই।
পারমাণবিক আতঙ্কের জনক বিজ্ঞান তার হৃতসন্মান কিছুটা উদ্ধার করল মহাকাশে পদার্পণ ক’রে। ১৯৫৭-এ ছোট্ট স্পুটনিকের ব্লিপ ব্লিপ ধ্বনি, চার বছর পরে গ্যাগারিনের চোখ দিয়ে মহাকাশে ভাসমান নীল পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করা, আর ১৯৬৯-এ চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রঙের পদক্ষেপ- এইসব কীর্তির পরে মহাকাশ বিজয়ের স্বপ্ন হিরোশিমার স্মৃতিকে নির্বাসিত করবে ভাবা গিয়েছিল। মনে হয়ছিল, মহাকাশেযুগের ‘মিথ্’ বিজ্ঞান নামক দেবতার পবিত্র মন্দির গড়ে তুলবে। সায়েন্স ফিকশনের কল্পিত আতংককে যেমন ম্লান ক’রে দিয়েছিল হিরোশিমার বাস্তব, তেমনই সায়েন্স ফিকশনের স্বপ্নের চেয়েও মোহময় হয়ে উঠবে মহাকাশ অভিযান – এই আশা সম্পূর্ন চূর্ণ হয়ে গেল ১৯৮৬-তে চ্যালেঞ্জার বিস্ফোরণের সঙ্গে। ওয়াষিংটন থেকে সাংবাদিক ওয়ারেন উন্না চ্যালেঞ্জার ধ্বংসের প্রসঙ্গে লিখলেন : ‘a terrifying SF scenario which, alas, was the real thing.’১৩
টি.ভি. স্ক্রিনের সন্মুখে উপবিষ্ট আমেরিকার চোখের সামনে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার যাত্রা শুরুর পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। চ্যালেঞ্জারের সাত যাত্রীর মধ্যে ছিলেন প্রথম অসামরিক মহাকাশযাত্রী ইতিহাসের শিক্ষিকা ক্রিস্টা ম্যাক্অলিফ। নিউ হ্যাম্পশায়ারে তাঁর নিজস্ব স্কুলের যাবতীয় ছাত্রছাত্রী সহ আমেরিকা ও কানাডার পঁচিশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী লাইভ শো দেখছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই টি.ভি. যোগে ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করার কথা তাদের।
নিঃসন্দেহে দুর্ঘটনা, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বলে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। কোনো আদর্শবাদী বৈজ্ঞানিক অভিযানে পাড়ি দেয় নি চ্যালেঞ্জার। জন্মসূত্রেই সামরিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সৃষ্ট এই স্পেসশিপ শক্তির স্থূল আস্ফালনের আর পাবলিসিটির স্বার্থে অকারণ নরমেধ ঘটাল। বস্তুতপক্ষে এই দুর্ঘটনার বহু পূর্বেই মহাকাশ অভিযান তাঁর প্রতিশ্রুত মূল লক্ষ্য, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান থেকে বিচ্যূত হয়েছে। বিশ্ব সৃষ্টি ও প্রাণের রহস্যভেদের পথ ত্যাগ ক’রে তা একদিকে সামরিক শক্তিমত্তার সূচক হয়ে উঠেছে; আর অন্য দিকে কৃত্রিম স্যাটেলাইটের ব্যবসায় (টি.ভি. অনুষ্ঠান প্রচার ইত্যাদির দৌলতে) ‘নিকট মহাকাশ’ নামে এক খনি থেকে রত্ন-সঞ্চয়ে আত্মহারা।
চ্যালেঞ্জারের ঘটনা অবশ্য বিবেকবান এস.এফ.-রচয়িতাদের নতুন কোনো অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মহাশক্তিদের ঠাণ্ডা লড়াই, টেকনোলজির প্রশ্রয়ে একদিকে তৃতীয় বিশ্বে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী অভিযান ও অন্য দিকে ‘উন্নত’ রাষ্ট্রের বৈভব-মুগ্ধ সামাজিক জীবন – এই সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল লেখকের পক্ষে মহাকাশ-বিজয়ের ক্ষণিক রূপকথায় বিভ্রান্ত হওয়া দুষ্কর। সিরিয়াস সায়েন্স ফিকশন লেখকের পক্ষে বোধহয় দুঃসাধ্যই।
রূপকথা, নীতিকথা, মহাকাব্য, ব্যঙ্গ, কৌতুক, সমালোচনা, আতংক-সঞ্চার, বিশ্লেষণ – নানা পথে বিচিত্র মতে, বিভিন্ন ফর্ম, থিম্ ও সাহিত্যিক প্রকরণের আশ্রয়ে সায়েন্স ফিকশন নামক সাহিত্যের গবেষণাগারে বিভিন্ন কল্পিত পরিস্থিতিতে মানুষ আর মানবিকতাকে বারবার যাচাই করা হয়েছে। স্বল্প পরিসরে এখানে প্রথমে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় রচিত এস.এফ.-এর বৈচিত্র্যের দিকেই শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
‘সায়েন্স ফিকশনের নব্বই শতাংশই জঞ্জাল।’ বলেছিলেন এক সমালোচক। কথাটা সাধারণভাবে ‘সাহিত্যে’র ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তবে সায়েন্স ফিকশনের দশ শতাংশের মধ্যেও প্রবল জনপ্রিয় বহু লেখক রয়েছেন যাঁরা প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে জঙ্গি ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ প্রচার করেন। যেমন রবার্ট এ. হাইনলাইন। যাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘সোসাল ডারউইনিস্ট’ হিসেবে। এই জাতীয় রচনাকারও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়।
ফ্রাংকেনস্টাইনের রচয়িতা মেরি শেলির খুব স্বল্প পরিচিত আরেকটি উপন্যাস ‘দা লাস্ট ম্যান’ (১৮২৬)। ‘প্লেগ’-এর দুরন্ত প্রকোপে মানব সভ্যতা সম্পূর্ণ মুছে যাওয়ার এই কাহিনী সমসাময়িক সমালোচকদের কাছে অসুস্থ চিন্তার ও দূষিত রুচির পরিচায়ক মনে হয়েছিল। পরবর্তীকালে জ্যাক লন্ডনের ‘দা স্কার্লেট প্লেগ’ (১৯১৫), ওয়েল্সের ‘ইন দা ডেজ অফ দা কমেট’ (১৯০৬), ম্যাথু ফিলিপ্স শিল-এর ‘দা পার্পল্ ক্লাউড’ (১৯০১) ইত্যাদি উপন্যাসে বারবার বিভিন্ন প্রলয়ে মানবজাতির বিলুপ্তিকে ঘিরে কল্প-কাহিনী গড়ে উঠেছে। কিন্তু ১৯৪৫-এর ৮ অগাস্ট-এর পরে এই প্রলয়ের সাহিত্য, পৃথিবীর শেষ মানবের কাহিনী যেমন নতুন তাৎপর্য পেল তেমনই জন ক্রিস্টোফার-এর ‘দা ডেথ অফ গ্রাস’ (১৯৫৬) বা জন ওয়াইন্ডহ্যামের ‘দা ডে অফ দা ট্রিফিড্স’ (১৯৫১)-এর প্রলয়ের কারণ যাই ঘোষিত হোক তার মর্ম অনুধাবনে কোনোই বাধা ছিল না। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে পারমাণবিক আতংক-প্রসূত সৃষ্টি, যেমন নেভিল শ্যুট-এর ‘অন্ দা বিচ্’ (১৯৫৭) ইত্যাদি সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের চেয়ে চলচ্চিত্রকেই তার প্রধান বাহন হিসেবে লাভ করেছে।
পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরবর্তী দুনিয়ায় সায়েন্স ফিকশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিল। এস.এফ.-এর নিহিত সম্ভবনা প্রকট হল মানুষের বাক্তিগত জগতে, তার মনোজগতে অবগাহনের সুবাদে। ব্যক্তিমানসের উপর দ্রুত, অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল এই জগতের প্রতিক্রিয়ার খতিয়ান নেওয়ার কাজে সায়েন্স ফিকশনের কিছু নিজস্ব পদ্ধতির উপযোগিতা সম্বন্ধে দ্বিমত রইল না। শুধু ভিন্ন স্থান ও কালের দৃষ্টিকোণে হাই-টেক্ দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শীতল প্রস্তুতির বিকল্প অতিরঞ্জিত চিত্র নয়। শুধু ‘মেসেজ’ হিসেবে নয়, এই আতংকিত যুগের ‘প্রোডাক্ট’ রূপেও এস.এফ. পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাশূন্যের ঘত গহনে পাড়ি দিতে লাগল, ততই চেনা পৃথিবীকে আর পরিচিত বাক্তি মানসকে বারংবার পরখ আর আবিষ্কার করতে লাগল নতুন দৃষ্টিতে। অপার্থিব বুদ্ধিমানদের সঙ্গে স্বদেশের বা নেই-দেশের সাক্ষাৎকারের পর তাদের সম্বন্ধে সংগৃহীত অভিনব তথ্যের চেয়ে সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থিবদের মনঃসমীক্ষণ।
ফ্রেডারিক পোল এবং সি. এম. কর্মব্লুথ রচিত ‘দা স্পেশ মার্চেন্ট’ (১৯৫৩) উপন্যাস আধুনিক মূল্যবোধ নিয়ে উদ্দাম কৌতুক আর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ। বিজ্ঞাপন এই কল্পিত জগতের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। প্রচার-মাধ্যম নিজেদের পণ্যের বিক্রি বাড়াতে যেখানে নির্দয়ভাবে গণ-মগজ ধোলাইয়ের সব রকম কৌশল প্রয়োগ করে অভ্যাস-সৃষ্টির জন্য। হালকা চালে লেখা এই সামাজিক সমালোচনামূলক গ্রন্থটির যেমন দংশন তেমনই আবেদন।
ওয়াল্টার মিলার-এর সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের ‘এ ক্যান্টিক্ল ফর লাইবোউইৎজ্’ (১৯৫৯)-এর কাহিনী শুরু হচ্ছে একটি পারমাণবিক ধ্বংসকাণ্ডের পরে এবং কয়েক শতাব্দী ধরে মূল্যবোধ–রহিত বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ হয়েছে সেখানে।
ছয়ের দশকের যাঁরা সায়েন্স ফিকশন রচয়িতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁদের মধ্যে আমেরিকার ফিলিপ কে. ডিক্ ও উরসুলা কে. লেগুই (LeGuin) এবং ইংলন্ডের জন বানার ও ডি. জি. কম্পটন উল্লেখযোগ্য। ডিক্ সম্বন্ধে ১৯৬৯-এ টাইম্স লিটেরারি সাপ্লিমেন্ট লিখেছিল৫:
Of all SF writers prolific Mr. Dick has proved to take all the somewhat shopsolied props- spaceship, mutants, robots, nuclear bonms, drugs, plane, colonization – and create something of a poetic significance for them.
আসলে ডিক্ প্রচলিত এস.এফ.-এর কথনশৈলীর ও সামাজিক মুল্য নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন তাঁর এস.এফ. –রচনায়। এস.এফ.–এর গৎ ব্যবহার করেই এস.এফ.–কে সমালোচনা।
ডিকের উপন্যাস ‘দা ম্যান ইন দা হাই ক্যাসেল’–এর চরিত্ররা এক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাস্ত। বিজয়ী জার্মান ও জাপানীরা বিভক্ত আমেরিকাকে শাসন করছে। এই সাহিত্য-জগৎ অবশ্য ঠিক আমাদের ‘বাস্তব’–এর মত নয়। একই সঙ্গে একাধিক সময়স্রোত ও বাস্তবতা নিয়ে এই জটিল ও মননশীল উপন্যাসের আখ্যান বর্ণনা ক’রে তার স্বাদ সঞ্চারিত করা সম্ভব নয়। তবে ডিকের কল্পনা থেকে জারিত চরিত্র ও পরিস্থিতি উপন্যাসটির সজীবতার অন্যতম কারণ। জাপানীরা যেখানে কোল্ট রিভলভার, মিকি মাউস ঘড়ি ইত্যাদি মার্কিন অ্যান্টিক সংগ্রহ করে, আমেরিকানরা জাপানিদের সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারিক আচার-অনুষ্ঠান আয়ত্ত করতে ব্যস্ত, আর জার্মানরা তখনো হিটলারের আদর্শ অনুসরণ করছে, কিন্তু জাপানিরা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিপক্ষ।
ডিক্-এর আরেকটি উপন্যাস ‘ইউবিক’ (Ubik)–এ মর্গে সুরক্ষিত কয়েকটি জীবম্মৃত মানুষের মন উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। ‘এলিয়েনেশন’, ‘এক্সিসটেন্শিয়ালিজম’ ইত্যাদি প্রসঙ্গ ডিকের রচনায় স্বাভাবিকভাবেই উত্থাপিত হয়। সম্ভবত ডিক্ তাঁর সেরা স্বীকৃতি পেয়েছেন পোলিশ সাহিত্যিক স্তানিসোয়াভ লেম্-এর কাছ থেকে। ‘সায়েন্স ফিক্শন স্টাডিজ’ পত্রে (মার্চ, ১৯৭৫) ‘এ ভিসনারি অ্যামং-শার্লাটন্’ শীর্ষকে লেম্ -এর রচনাটি প্রকাশিত হয়৫ :
Dick Subjects ordinary people to tests under terrible pressure and in his fantastic experiment. Only the psychology of characters remain non-fantastic; He sacrifices order and convention for the sake of vision leading to the same difficulty about genre replacement that we meet within the writings of Kafka.
ইংল্যান্ডের জন ব্রানার দু’টি উপন্যাসের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। ‘স্ট্যান্ড অন জানজিবার’ (১৯৬৮) ও ‘দা শিপ লুক্ আপ’ (১৯৭২)। ‘জানা’ বলতে এখন আমরা যা বুঝি তা তো আসলে টুকরো টুকরো ভাবে সংগ্রহ করা হয় স্কুলের শিক্ষা, সংবাদপত্র, রেডিও ও টি. ভি.–র খবর বা প্রচার ইত্যাদি থেকেই। এর থেকেই একটা ছাঁচ গড়ে ওঠে আমাদের মনে যার থেকে বিংশ শতাব্দীর বিভ্রান্তিকর পরিবর্তনশীল পরিবেশে মানুষ তার অবস্থান নির্দিষ্ট করে। ঠিক এই টেক্নিকেই রচনা করেছেন ব্রানার তাঁর উপন্যাস। ব্রানারের দ্বিতীয় উপন্যাসটিতে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সদ্য পরিবেশ দূষণের প্রাথমিক কুফল লাভ করতে শুরু করেছে। শনাক্ত করতে অসুবিধা হয় এমন কোনো দূর ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন নয়। বিক্ষিপ্তভাবে স্থানবিশেষে যা ইতিপূর্বেই ঘটে গেছে বা এখন ঘটছে তাকেই সামান্য প্রসারিত করে লেখক সাবধান করতে চেয়েছেন।
ব্রানারেরই প্রায় সমসাময়িক আরেক ব্রিটিশ লেখক ডি. জি. কম্পটন–এর তিনটি উপন্যাস, ‘ফেয়ারওয়েল আর্থস্ ব্লিস্’ (১৯৬৬), ‘সিন্থাজয়’ (১৯৬৮) এবং বিশেষ ক’রে ‘দা আন্স্লিপিং আই’ (১৯৭৪) চূড়ান্ত সামাজিক ও মানসিক চাপের মধ্যে মানস-জীবনকে অধ্যয়ন করেছে বিরল দক্ষতায়। শেষোক্ত উপন্যাস এমন একটি সমাজের কাহিনী যেখানে নাগরিকরা সবাই সুখী, প্রত্যেকের জীবন পুরোপুরি সুরক্ষিত। তবু ব্যাক্তিজীবনে উত্তেজনার প্রয়োজন থেকেই যায় এবং টি. ভি. সেখানে সেই প্রয়োজন মেটায়। এক মহিলা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর কাহিনী শুরু হয়। তারপরেই একজন সাংবাদিকের চোখে একটি অস্ত্রোপ্রচার করা হয় যাতে দর্শন সূত্রে তার যাবতীয় অনুভব সরাসরি প্রেরণ করা যায় টি. ভি .স্টুডিও-য়। এই সাংবাদিকের অসুস্থ মহিলাটিকে অনুসরণ, তাঁর বিশ্বাস অর্জন এবং এই মহিলার ব্যক্তিগত জীবনকে পর্যবেক্ষণ–এ সবই সম্প্রচারিত হয়। উত্তেজনার খোরাক যোগাতে মানুষের নিতান্ত ব্যাক্তিগত যন্ত্রণার মধ্যেও গোপনে অভিসার চলে।
১৯৬৪-তে মাইকেল মুবকক্ ইংল্যান্ডের ‘নিউ ওয়ার্লডস’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহন করার পর সায়েন্স ফিকশনের রাজ্যে একটি নতুন আন্দোলন জন্ম নেয়। মূলত সাহিত্য সচেতনতার আন্দোলন। এই আন্দোলনের আদি প্রবক্তা জে. জি. ব্যালার্ড। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন (লেখকদের), এস.এফ. ভবিষ্যতের সূত্র ধরে ঠিকই, কিন্তু চিন্তা তার বর্তমানকে নিয়েই। প্রচলিত সাহিত্যকে (মেইন স্ট্রিম-কে) তিনি আখ্যা দিলেন ‘রেট্রোস্পেকটিভ ফিকশন’, আর এস.এফ.-কে বিশিষ্ট করলেন ‘প্রস্পেক্টিভ’ হিসেবে। ফলে শুধু নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, অধীত বিষয়ের অভিনবত্বও নয়, এস.এফ.–এর আখ্যানরচনা শৈলীরও স্বতন্ত্র একটি দাবীর কথা উঠল। ব্যালার্ড মনে করেন গদ্য সাহিত্যে সুরিয়ালিজ্মের সেরা বাহন এস.এফ.। ঘন প্রতীকী দুনিয়া, বহু কাল-স্রোত, বিকল্প বিশ্ব, মরুভূমি, সমুদ্র আর স্ফটিকের প্রতিমা, মনোবিশ্লেষণ ও ভাষার প্রতি আকর্ষণ চিহ্নিত করে ‘নিউ ওয়েভ’-এর লেখকদের। আরো একটি বৈশিষ্ট্য আছে ‘নিউ ওয়েভ’-পন্থীদের। তাঁরা কোকিলের পন্থায় অন্যের বাসায় সাহিত্য প্রসব করার পরীক্ষা চালিয়েছেন। জেমস্ জয়েস বা রোব্ গ্রিয়ে প্রমুখের বিশিষ্ট স্টাইল অনুসরণই নয়, খোদ এস.এফ.–সাহিত্যের প্যারডি রচনাতেও সিদ্ধিহস্ত তাঁরা। এই ‘মেটা–এস.এফ.’-এর দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।
মার্কিন লেখক নর্মান স্পিনার্ড ‘দা আয়রন ড্রিম’ (১৯৭২) নামক উপন্যাসের মধ্যে আরেকটি উপন্যাস পেশ করেন। দ্বিতীয় উপন্যাসটি হল জনৈক অ্যাডলফ হিটলার রচিত ও ১৯৫২-য় ‘হিউগো’ পুরস্কার (এস এফ সাহিত্য পুরস্কারের মধ্যে ‘হিউগো’ অন্যতম। এ ছাড়া আছে ‘নেবুলা অ্যাওয়ার্ড’।) প্রাপ্ত ‘দা লর্ড অফ্ দা স্বস্তিকা’। এই লেখক-রূপী হিটলারের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তার রচনার পর একটি পরিশিষ্ট সংবলিত স্পিনার্ডের এই উপন্যাসে আমরা দেখি ইতিহাসের সামান্য একটু বিচ্যুতির ফলে এস.এফ. লেখক হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই প্রবাসী হয়েছে আমেরিকায়, যদিও তার রচিত উপন্যাসের নায়ককে নাজি হিসেবে চিনতে অসুবিধা হয় না। এই নাজি-নায়ক পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর তেজস্ক্রিয়তার যত বলি, পঙ্গু বিকৃতদের নিয়ে গড়ে তলে ‘বিশুদ্ধ’ নাগরিকদের এক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। স্পিনার্ড এই উপন্যাসে চটুল জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশনের ফ্যাসিস্ট ও মিলিটারি প্রবণতাকে অনুকরণ সূত্রেই তীব্র আক্রমণ চালিয়েছেন।
ফিলিপ জোসে ফার্মার প্রধানত এস.এফ.-এ যৌনতার প্রসঙ্গ অবতারণার কারণেই একটি বিতর্কিত নাম। এ-কথা অনাস্বীকার্য যে ‘সায়েন্স ফিকশনে কি পর্নোগ্রাফি লেখা সম্ভব?’ – ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করার জন্যই সচেতনভাবে ফার্মার এই স্বল্প-ব্যবহৃত রাস্তায় পরিক্রমাকে অভিনবত্ব ও জনপ্রিয়তা উভয়ই অর্জনের পক্ষে সেরা বিবেচনা করেছিলেন। (তাঁর ‘ফ্রেশ’ (১৯৬০) উপন্যাসের সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদে উল্লিখিত হয়েছিলঃ ‘New Earth – where lust is religion, and love is a violent public spectacle! A startling experience in science fiction!’)। কিন্তু তাঁর এস.এফ. রচনা বিতর্কিত হয়েও যৌন–উত্তেজক রূপে সাফল্য অর্জন করে নি। ফার্মার-এর ‘লর্ড টাইগার’ (Lord Tyger) এর সার্থকতা ঐ গতে-বাঁধা এস.এফ.–এর প্যারডি রচনারই সূত্রে। ১৯৭০-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসে এডগার রাইস বারোস্-এর এক গোঁড়া ভক্ত বাস্তবে টারজানের গল্পটিকে নকল করতে চেয়েছিল। প্রথম পরীক্ষায় ইংল্যান্ডের এক লর্ডের পুত্রকে অপহরণ করে বাঁদরের হাতে সমর্পণ করা হয়। সে কিন্তু কোনো ভাষাই শিখতে পারে না শেষ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পরীক্ষায় আরেক লর্ড-পুত্রকে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। কপট বাঁদর রূপে সার্কাসের বামনরা প্রতিপালিত করে তাকে। এই দ্বিতীয় টারজান কি ভাবে সারা জঙ্গলের যৌন-যন্ত্রণা হয়ে উঠল তারই এক প্রমত্ত কাহিনী এই উপন্যাস।
‘নিউ ওয়েভ’ মুভমেন্টের পাশাপাশি ‘ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট’–এর র্যাডিকাল সমাজ-সচেতন অংশ সায়েন্স ফিকশন-কে তাঁদের অন্যতম বাহন সাব্যস্ত করেছেন। ইংল্যান্ডের উইমেন্স প্রেস থেকে একটি সায়েন্স ফিকশন সিরিজে বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বহুদুর আর ভবিষ্যৎ থেকে এখন ও এখানের এই সব রচনায় নারীজীবনের নানা সমস্যা ও সম্ভবনা আলোচিত – আক্রান্ত নারীসমাজ ক্ষমতাসীন মহিলা, একক মহিলা বা যূথবদ্ধ মহিলা। ‘ফেমিনিস্ট’ লেখিকাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতি জোয়ানা রাস্ (জন্ম ১৯৩৭)। ‘দা ফিমেল ম্যান’ উপন্যাস বা ‘এক্সট্রা (অর্ডনারি) পিপ্ল’ গল্পগ্রন্থ বিষয়ের গুরুত্ব ছাড়াও সমৃদ্ধ ভাষা ও বলিষ্ঠ গদ্যের গুনেও বিশিষ্ট। ১৯৮৪-তে প্রকাশিত ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা সুজেট হ্যাডেন এল্গিন-এর ‘নেটিভ টাঙ্’ (Native Tongue) একটি অভিনব কীর্তি। ভবিষ্যতের এই পৃথিবীতে পুরুষরা সর্বশক্তিমান, নারী আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং ভিন্গ্রহের সভ্যতার সঙ্গে তখন সংযোগ সাধিত হয়েছে। নক্ষত্রলোকে উপনিবেশ বিস্তারের এই যুগে ভাষাতত্ত্ববিদ্রা এলিয়েনদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর দায়িত্ব লাভ করার সূত্রে অর্জন করেছে প্রভূত ক্ষমতা। বংশ পরম্পরায় প্রভুত্ব চালিয়ে যাচ্ছে তারা। লেখিকা এই উপন্যাসে এমন একটি সমাজ তৈরি করেছেন যেখানে আন্তঃনাক্ষত্রিক বাণিজ্য ভাষা-শিক্ষাকে একটি মূল্যবান পণ্যে পরিণত করেছে। এরই বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র একটি নারী গোষ্ঠি লাডেন্ নামে নিজেদের মধ্যে একটি গুপ্ত ভাষা বিকশিত ক’রে সংগঠিত করছে প্রতিরোধ। ভাষা-অস্ত্রকে তারাও ব্যবহার করতে পারে মুক্তি অর্জনের স্বার্থে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সায়েন্স ফিকশনের বিচিত্র সম্ভারের মধ্যে খুবই বিবর্ণ আইজ্যাক অ্যাসিমভ ও আর্থার সি ক্লার্ক-এর সৃজনধর্মী রচনা। কিন্তু প্রচার-মাধ্যম ও পণ্য-বিক্রেতা সমাজের মধ্যে কোনো গূঢ় সাধারণ স্বার্থরক্ষার সুবাদেই নিশ্চয় এই দুই লেখকের রচনা ছাড়া বিদেশী সায়েন্স ফিকশন বর্তমানে কলকাতায় অন্তত রীতিমতো দুষ্প্রাপ্য। সাধারণভাবে এই দুই লেখকের সাহিত্যকর্মে সমকালীন বিশ্বের কোনো সমস্যার আঁচ পড়ে নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর অন্ধ আস্থা বজায় রাখার জন্য তাঁরা ইতিহাসের শিক্ষাকে উপেক্ষা ক’রে রোমান্সের জাল বুনেছেন। বিজ্ঞান ও মিস্টিসিজম জড়িয়ে এক ধরনের ছদ্ম-দার্শনিকতারও ভাণ আছে ক্লার্কের রচনায়। অন্য দিকে আসিমভ গার্নসব্যাক-মার্কা স্পেস অ্যাডভেঞ্চার রচনা করেছেন। রোবট-কাহিনী রচনায় অ্যাসিমভের সাফল্য আসলে এক ধরনের ধাঁধা জাতীয় খেলা নির্মাণের কুশলতা-নির্ভর। প্রত্যেক রোবটের অবশ্য পালনীয় তিনটি নিয়ম লিপিবদ্ধ করেন তিনি। তারপর তারই ফাঁক-ফোকর দিয়ে কত রকম পরিস্থিতি ও সমস্যা সৃষ্টি ও সমাধান করা যায় তার পরীক্ষা চালানো হয় গল্পে। গল্পের কাঠামো নির্দিষ্ট ক’রে দিয়ে তারপর রচনা দাঁড় করানোয় সিদ্ধহস্ত অ্যাসিমভ অনেক বেশি সফল গোয়েন্দা কাহিনীকার হিসাবে। অবশ্য দুই লেখকেরই জনপ্রিয়তার স্বতন্ত্র কিছু কারণ আছে। দু’জনেই ‘পপুলার সায়েন্স’ রচনায় কৃতী।
রে ব্র্যাডবেরি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালের লেখকদের মধ্যে সায়েন্স ফিকশন এলাকার বাইরে সর্বাধিক পরিচিত ও সম্মানিত এস.এফ.-রচয়িতা রে ব্র্যাডবেরি। আমেরিকায় ইলিনয়েসের Waukegan–এ তাঁর জন্ম ১৯২০-র ২২ অগাস্ট। ‘বিশ্বের সেরা’ নামধারী ‘ভৌতিক’, ‘রোমাঞ্চ’, ‘রহস্য’, ‘ফ্যাণ্টাসি’ ও ‘সায়েন্স ফিকশন’ গল্পের যে-কোনো সুপ্রচলিত সংকলনেই ব্র্যাডবেরি অন্তর্ভূক্ত। শুধু তাই নয়, সেরা আমেরিকান গল্পের বহু সংকলেনও ব্র্যাডবেরি উপস্থিত। ‘ও হেনরি মেমোরিয়ল’ পুরস্কারও পেয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়ার এক সমালোচক লিখেছেন যে ইংরেজি ভাষায় অধুনিক এস.এফ.-রচয়িতাদের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যাডবেরি। ‘ব্র্যাডবেরি মার্কিন মুলুকের বিবেক।’
গথিক আতংক কাহিনীই লিখুন, অথবা সায়েন্স ফিকশনই লিখুন, লেখকের নিজস্ব ছোঁয়া ও মেজাজের দীপ্তি তাকে ব্র্যাডবেরির নিজস্ব চরিত্রের ছাপে চিহ্নিত ক’রে রাখে। শুধু তাই নয়, ব্র্যাডবেরির উপন্যাস বা গল্পের মধ্যে ‘রোমাঞ্চ’, ’অপ্রাকৃত’, ও ‘সায়েন্স ফিকশন’ এমনই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে যে সমালোচকরা তাকে কোন নামে ডাকবেন, কোন সংজ্ঞার ভিত্তিতে কি আখ্যা দেবেন নির্ধারণ করতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন।
‘An extreme elegiac sentiment and gentle fantasy, touched with the eerie and uncanny. It is a special preserve, very much his own…’ ব্র্যাডবেরি সম্পর্কে দুই সাহিত্য সমালোচকদের মন্তব্য৮। ব্র্যাডবেরির দুনিয়া রুক্ষতা, আতংক, অতিপ্রাকৃত ও রোমাঞ্চকর ঘটনার উপর পরিব্যপ্ত ভাষা ও স্টাইলের প্রসাদে বোনা কাব্যময় কুয়াশা। পরিবেশিত ঘটনা বা চিন্তার সঙ্গে পরিবেশন ভঙ্গির এই দ্বান্দ্বিকতা তাঁর রচনাকে আন্দোলিত করে আশা আর হতাশার মধ্যে।
বিজ্ঞানের ভাষা আন্তর্জাতিক হতে পারে, কিন্তু সাহিত্যের সাধারণ চরিত্র অনুসারে সায়েন্স ফিকশনেরও জন্ম ও পুষ্টি নিজের দেশের জল মাটি আর হাওয়াতেই। ইয়াংকি সভ্যতার নয়, আমেরিকাবাসীর দেশ যে আমেরিকা, তার এবং বিশেষ ক’রে নিজের প্রাদেশিক জন্মভূমিরই স্বাদ আর গন্ধে ভরা ব্র্যাডবেরি।
১৯৫০-এ প্রকাশিত হয় ব্র্যাডবেরির উপন্যাস ‘দা মার্শিয়ান ক্রনিক্লস’। ‘টুমরো’ পত্রিকার সমালোচনায় ক্রিস্টোফার ইশারউড আত্মহারা প্রশংসা করেন, ‘the sheer lift and power of a truly original imagination’-এর। ব্র্যাডবেরিকে ‘আবিষ্কার’ করার জন্য গর্বিত বোধ করেন তিনি। ইশারউডের এই সমালোচনা সূত্রেই ব্র্যাডবেরি প্রথম জাতীয় স্বীকৃতি অর্জন করেন।৫চারের দশকে লেখা কিছু ছোট গল্পের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন ক’রে রচিত এই উপন্যাসটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘দা সিল্ভার লোকাস্টস’ (১৯৫০) নামে।
মঙ্গলগ্রহে মানুষদের হানা দেওয়ার এই উপাখ্যান শুরু হচ্ছে ১৯৯৯-এর অগাস্ট মাসে একটি গ্রীষ্মের রাতে। অদ্ভুত সব চিন্তা অকস্মাৎ উদিত হল মঙ্গলবাসীদের মধ্যে। সম্পূর্ণ পরদেশী এক ভাষায় – ইংরেজিতে – মঙ্গলবাসী এক মহিলা নিজের অজান্তে হঠাৎ আবৃত্তি করলেন : ‘She walks in beauty, like the night / of cloudless climes and starry skies…’ সারা গ্রহ জুড়েই সে রাতে শিশু, মহিলা ও পুরুষরা এইরকম অপরিচিত ভাষায় কবিতা, ছড়া বা সংলাপ ইত্যাদি উচ্চারণ ক’রে স্ব্য়ং নিজেরা স্তম্ভিত হচ্ছিল। একটা অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে তারই অবশ্যম্ভাবী ইংগিত, কারণ এই গ্রহের বাসিন্দারা টেলিপ্যাথি শক্তিধর। মানুষ সশরীরে আবির্ভূত হওয়ার আগেই তাদের চিন্তাজগৎ মঙ্গলবাসীদের মনে হানা দিয়েছে।
এই উপন্যাসে প্রযুক্তিগতভাবে মঙ্গল কতখানি অগ্রসর সেটা খুব স্পষ্ট নয়। কিছুটা প্রাচীন গ্রীকদের মতো মার্বেল অ্যাম্ফিথিয়েটারে তারা কনসার্টের আসর বসায়, তাদের সন্তানরা খেলা করে মশাল-প্রজ্জ্বলিত পথে পথে, আবার খাল দিয়ে ‘ব্রোঞ্জের ফুলের মতো পেলব’ নৌকায় চলাচল আর রুপালি নীরব লাভা-র বুদবুদ-ওঠা টেবিলে রান্নার কাজ সারার উল্লেখও রয়েছে। কিন্তু মনে হয় মঙ্গলবাসীরা সচেতনভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে সমাজে কলকব্জাকে একটি বিনীত ভূমিকা অর্পণ করেছে। যন্ত্রপাতির সমাদর সেখানে শিল্প-মাধ্যম হিসাবে, খেলনা হিসাবে, গ্রামীণ জীবনধারার অনুগ্র সমর্থন হিসাবে। গল্পে দেখা না দিলেও, পৃথিবী থেকে মঙ্গলের পথে ধাবমান রকেট-যানের অস্তিত্বই এমন এক প্রযুক্তিকে নির্দিষ্ট করে যা মঙ্গলবাসীদের জীবনধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান ও তাকে ধ্বংস করার শক্তি ধরে।
একক যাত্রীবাহী রকেটে একে একে মানুষ এসে নামে মঙ্গলে। বিভিন্ন মঙ্গলবাসীর সঙ্গে মানুষের এই একাধিক প্রথম সংযোগের বিবিধ ফলাফল থেকে আমরা জানতে পারি মঙ্গলের সভ্যতার ও ব্যক্তি হিসাবে মঙ্গলবাসীদের বৈচিত্রের কথা। ভুবন-বিদারী গর্জনে একটি অবতরণের পর এক ঈর্ষ্যাকাতর মঙ্গলবাসী সঙ্গে সঙ্গে তার চালককে হত্যা করে, কারণ সে ভয় পেয়েছিল তার স্ত্রী এই পৃথিবীবাসীর প্রেমে পড়তে পারে। পরবর্তী পর্বে অভিযাত্রীদের একটি পুরো দল যে–জায়গায় নামে, দেখে মনে হয় বুঝি ছোট্ট কোনো আমেরিকান নগরীরই উপকণ্ঠ। অভিযাত্রীদের স্বাগত জানায় তাদেরই পিতা, মাতা, আত্মীয় আর বন্ধুরা। যাদের মধ্যে অনেকেই মৃত বলে জানা ছিল এতদিন। টেলিপ্যাথি ক্ষমতাবলে অভিযাত্রীদের মন পড়ে নিয়ে মঙ্গলবাসীরাই পুনঃসৃজন করেছিল এই শহর আর তার বাসিন্দাদের। অভিযাত্রীরা দল ভেঙে যে-যার নিজের পুরনো গৃহের আকর্ষণে বিভিন্ন পথ ধরে এবং সবাই নিহত হয়।
কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ ও মঙ্গলবাসী পরস্পর নিধনে সম্মুখীন হয় না। প্রথম বিফলতার পর মানুষ যখন দলবদ্ধভাবে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে হাজির হল, তত দিনে অধিকাংশ মঙ্গলবাসী উজাড় হয়ে গেছে মহামারিতে। পৃথিবী থেকে সংক্রামিত রোগের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিষেধক ছিল না। গুটিকতক ভাগ্যবান মঙ্গলবাসী শহর ত্যাগ ক’রে আশ্রয় নেয় পর্বতদেশে। মঙ্গলের আগ্রাসন এবার পুরোদমে শুরু হয়। রকেট বোঝাই ক’রে কাঠকুটো ও নির্মাণ সামগ্রী আসে। শহর তৈরি হয়, রাস্তা গড়া হয়, পোঁতা হয় পৃথিবী থেকে আনা গাছ-গাছালি।
উপত্যকা পাহাড় আর খালবিলের নামকরণ করা হয় রকেট-পাইলট ও অভিযাত্রীদের নাম ধরে, পৃথিবীর চেনা জায়গার নামে। হানাদাররা উপনিবেশকে তাদের ফেলে-আসা বাসস্থানের চেহারা দিতে সর্বদাই উৎসুক। ‘দা অফ সিজ্ন’ নামে অধ্যায়ে রাস্তার ধারে স্যাম পার্কহিল একটি ‘হট্ ডগ’ স্ট্যাণ্ড খোলে। নিও লাইট থেকে আলো, জিউক বক্স থেকে সংগীত বর্ষিত হয়। এই রাস্তা অবিলম্বে সরগরম হয়ে উঠবে বলে তার ধারণা। কিন্তু মঙ্গলে পুরোপুরি গুছিয়ে বসার আগেই খবর এল পৃথিবীতে পারমাণবিক মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মানুষই মঙ্গল ছেড়ে পাড়ি দিল পৃথিবীতে। মঙ্গলের পরিত্যক্ত প্রায় ভৌতিক শহরে কিছু পড়ে-থাকা মানুষের পরিণতির কাহিনী শুনিয়ে শেষ গল্প, ‘দা মিলিয়ন ইয়ার পিকনিক্’- ব্র্যাডবেরি পৃথিবী থেকে শেষ দু’টি রকেটের যাত্রীদের নিয়ে এলেন আবার মঙ্গলে। ছুটি কাটাবার নামে টিমোথি, মাইকেল আর রবার্টকে নিয়ে তার পিতা মাতা মঙ্গলে এসে মাছ ধরতে বেরোলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিতা তাদের বাহক রকেটিকে ধ্বংস করে প্রত্যাবর্তনের পথটি রুদ্ধ ক’রে দিলেন। পারমাণবিক যুদ্ধে বিধ্বস্ত পৃথিবী থেকে আবার যদি হানাদার আসে, তাহলে রকেটটিই তাদের উপস্থিতির জানান দেবে। পুত্রদের মঙ্গলবাসী দেখার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পিতা তাদের নিয়ে আসেন একটি খালের ধারে। জলে পরিবারের সব সদস্যদের প্রতিফলন দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবাসীদের এবার দেখলে তো?’
বিষাদময় ও কাব্যিক, শান্ত ও গভীরভাবে মানবিক, ছেলেবেলার খেলনার মতো অকিঞ্চিৎকর অথচ তাৎপর্যময় খুঁটিনাটির কবিতায় ভরা ব্র্যাডবেরির এই জগৎ, যেখানে মানুষকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞান তার আত্মহারা দৌড়ে বিরাট এক ব্যবধান তৈরি করেছে। ব্র্যাডবেরির আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক ক্রুফো চলচ্চিত্রায়িত করেন। (চিত্রনাট্য রচনা করেন ব্র্যাডবেরি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ব্র্যাডবেরি ‘মবি ডিক’, ‘দা ড্রিমার্স’ ও ‘দা রক ক্রায়েড আউট’ ইত্যাদি চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন)। ফারেনহাইট ৪৫১ সেই তাপমাত্রা যাতে কাগজে আগুন ধরে। ভবিষ্যতের এক প্রযুক্তি-উন্নত সমাজের কাহিনী, যেখানে বই-পড়া নিষিদ্ধ। টি.ভি.-কেন্দ্রিক অডোভিশুয়াল দুনিয়ায় অপসংস্কৃতি রোধ করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়মিত গ্রন্থ-দহনের অভিযান চালায়। এই নৈরাশ্যময় পরিস্থিতির সমান্তরালে পরিবেশিত হয় এক অদ্ভুত প্রতিরোধ। স্বেচ্ছা নির্বাসিত কিছু মানুষ গোপনে এক স্থানে মিলিত হয়। তারা প্রত্যেকে এক একটি গ্রন্থ নির্বাচন ক’রে তার আদ্যোপান্ত মুখস্ত করতে শুরু করে। বইয়ের পাতা পড়তে থাকে আর মনের পাতা ভরে ওঠে উত্তরপুরুষদের জন্য ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি।
ব্র্যাডবেরির রচনায় প্লট অপেক্ষা ভাষা, আবহ ও মেজাজ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তাঁর ছোটগল্পের আলোচনা করার সময়ে কাহিনীর সার-সংক্ষেপ পেশ করাটা বাঞ্ছনীয় নয়। এখানে শুধু বিভিন্ন গল্পে এস.এফ.-এরই বহু ব্যবহৃত নানা উপকরণ ও প্রকরণ, যেমন পৃথিবীর শেষ মানুষ, মনস্টার, মহাকাশে পাড়ি, টাইম মেশিন, কি অদৃশ্য মানুষ ইত্যাদিকে তিনি কত অসাধারণ দক্ষতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূমিকা অর্পণ করেছেন – তারই কিছু উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে।
‘দা পেডেস্ট্রিয়ান’ গল্পে একটি ছোট্ট শহরে টি.ভি. স্ক্রিনের সামনে বিহ্বল পতঙ্গের মতো সকলে যখন গৃহবন্দী, একটি মানুষ শুধু পথে পথে পায়ে হেঁটে বেড়ায়। রাত্রি আর সমুদ্রের ঘ্রাণ নেয়। পায়ে হেঁটে বেড়াতে সে ভালোবাসে। পুলিশ ফৌজের দূর-নিয়ন্ত্রিত চালক-বিহীন একটি গাড়ি (পুলিশের একমাত্র গাড়ি) মাতালের মতো টহল দিতে দিতে আকস্মিকভাবে পথচারীকে আবিষ্কার করে। এবং দীর্ঘ জেরার পর তাকে গ্রেপ্তার করে। কারণ ‘বেড়াতে ভালো লাগে’ এই দুর্বোধ্য কৈফিয়তের কোনো মীমাংসা করতে পারে না যন্ত্র-মগজ। প্রতিবন্ধী-সুলভ আচরণ সংক্রান্ত গবেষণায় ‘সাইকিয়াট্রিক সেণ্টার’-এ পথচারীকে প্রেরণ করার কথা জানিয়ে গল্পটি শেষ হয়।
‘দা ফগ হর্ন’ গল্পে নিঃসঙ্গ প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী লাইটহাউসের বিপদ সংকেত শুনে হারানো সঙ্গীর আহ্বান বলে ভুল করে।
‘এ সাউণ্ড অফ থাণ্ডার’-এ TIME SAFARI INC. নামে সংস্থায় টাইম মেশিনে চড়ার টিকিট কিনে এক জন অতীতে পাড়ি দেয়। অসতর্ক যাত্রীর পদপিষ্ট হয়ে কয়েক কোটি বছর পূর্বে মারা যায় একটি প্রজাপতি। বর্তমানে প্রত্যাবর্তনের পর যাত্রীর চোখে পড়ে সাইন বোর্ডে কালান্তরে পাড়ি দেওয়ার এই সংস্থাটির নামের বানানে কিছু গরমিল : TYME SAFARI INC.। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে সে পাড়ি দেওয়ার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনের যে-ফল বেরিয়েছিল তাও পা্লটে গেছে। নির্বাচিত হয়েছেন স্বৈরাচারী এক ভিন্ন শাসক। সুদূর অতীতে সামান্য একটি প্রজাপতির নিধনের ফলে পুরো ইকোলজিকাল সিস্টেম এতটাই বিপর্যস্ত।
‘দা ইনভিজিব্ল বয়’ গল্পের নিঃসঙ্গ ডাইনি মানুষকে অদৃশ্য ক’রে দেওয়ার মন্ত্র জানে বলে ভাণ করে। উদ্দেশ্য, এই লোভ দেখিয়ে একটি বালককে তার কাছে আটকে রাখা। ডাইনির মুখ থেকেই ছেলেটি শুনতে পায় কিভাবে তার হাত-পা থেকে সমস্ত শরীর আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সে বিশ্বাস করে। তারপর ডাইনি আবার মন্ত্র পড়ে তাকে দৃশ্য করে দেয়। ছেলেটি ছুটে পালায়। তারপর নিঃসঙ্গ ডাইনি একা খাওয়ার টেবিলে বসে সত্যিকারের অদৃশ্য এক বালকের সঙ্গে গল্প জোড়ে।
শুক্র, মঙ্গল ও শনিগ্রহে তখন নিয়মিত যাত্রীবাহী রকেট সার্ভিস শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ‘দা রকেট’ গল্পের নায়ক ফিওরেল্লো বোদোনি সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়েও সপরিবারে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করতে পারে নি। মহাকাশ ভ্রমণের একটি টিকিট সে কাটতে পারে, কিন্তু কে যাবে? লটারি করা হয়, কিন্তু ভাগ্যবান্ অন্যদের বঞ্চিত করতে চায় না। একে একে পরিবারের সবাই অস্বীকার করে একা সুযোগ নিতে। বোদোনি তারপরে এক দিন দু’হাজার ডলার দিয়ে কিনে আনে বাতিল রকেটের এক খোল। স্বয়ং মহাকাশযানের চালকের দায়িত্ব নিয়ে উঠে বসে সেই রকেটে। তারপর বাড়ির উঠানের সেই লঞ্চিং নিশ্চল মহাকাশযানে ক’রে সপরিবারে যাত্রা করে তারা। রোমাঞ্চকর মঙ্গল পরিক্রমা সেরে নিরাপদে অবতরণও করে সেই স্থানে, সেখান থেকে রকেট নড়ে নি এক বিন্দু।
‘দা স্মাইল’ গল্পে আবার আমাদেরই চেনা পৃথিবীর এক বিদ্ধস্ত রূপ। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনকে ধ্বংস করার সুযোগ পেলে তখন অনুষ্টিত হয় জাতীয় উৎসব। এমনই এক উৎসবে মোনালিসার ছবি ছিন্ন করা হল তুমুল উদ্দীপনায়। উৎসবের পর বাড়ি ফিরে এসেছে টম, রাত্রে তার গায়ে যখন চাঁদের এক ফালি আলো, শ্বাস বন্ধ ক’রে সন্তর্পণে মুঠো খুলল। সারা বিশ্ব তখন ঘুমাচ্ছে, জেগে আছে শুধু ছেঁড়া ক্যানভাসের দোমড়ানো ফালিতে এক টি হাসি। টম চোখ বোজার পরে অন্ধকারেও জেগে থাকে সেই হাসি। পৃথিবী জুড়িয়ে আসে, শীতল আকাশ বেয়ে চাঁদ উঠল, আবার নেমেও এলো – প্রভাত সমাগত – হাসিটি তবু অমলিন, উষ্ণ আর শান্ত।
এই নমুনাস্বরূপ গল্পগুলি ব্র্যাডবেরির যে গল্প সংকলনগুলি থেকে আহৃত – ‘দা ইলাস্ট্রেড়েড ম্যান’ (১৯৫২), ‘দা গোল্ডেন অ্যাপেল্স অফ দা সান্’ (১৯৫৩), ‘দা ডে ইট রেইন্ড্ ফর এভার’ (১৯৫৯), বা ‘দা মেশিনারিজ অফ জয়’ (১৯৬৬) – সাহিত্যরসিক মানুষ প্রত্যেকে উপভোগ করবেন।
সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও স্ত্রুর্গাৎস্কি ভ্রাতৃদ্বয়
ব্র্যাডবেরির সূত্র ধরেই সোভিয়েত রাশিয়ায় সায়েন্স ফিকশন-চর্চার প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্র্যাডবেরি সম্বন্ধে রুশ সমালোচকের মন্তব্য। রাশিয়ায় সমাদর রুশ এস.এফ.-এর বৈশিষ্ট্যেরও ইংগিত বহন করে।
ইংলণ্ড ও আমেরিকার তুলনায় সোভিয়েত রাশিয়ায় অনেক বেশি সমাদর সায়েন্স ফিকশনের। এবং তা শুধু মনোরঞ্জক হালকা সাহিত্য হিসাবেই নয়। বর্তমানে প্রতি বছর প্রকাশিত এস.এফ. গ্রন্থের শিরোনামের সংখ্যা বা শিরোনাম পিছু মুদ্রিত গ্রন্থসংখ্যার বিচারেও রাশিয়া পশ্চিমী যে-কোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।
মহাকাশ দখলের মার্কিন-সোভিয়েত প্রতিযোগিতা পরিভাষার মধ্যেও প্রতিফলিত। মহাকাশচারী মার্কিন মুল্লুকে ‘অ্যাস্ট্রোনট’ আর রাশিয়ায় ‘কস্মোনট’। দুই বৃহৎ শক্তির এই সংঘাতের একটি পক্ষ হিসাবে সোভিয়েত সায়েন্স ফিকশনের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা আমাদের অভিপ্রেত নয়, কারণ এই জাতীয় মার্কিন রচনাকেও বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।
রুশ সায়েন্স ফিকশনের সেই চারিত্রিক লক্ষণই আমাদের আকর্ষণ করে যা গড়ে উঠেছে তাদের জাতীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য অনুসারে। এক ঐতিহাসিক ঘটনা ১৯১৮-য় পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। আর সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের স্পর্শেই সজীব সোভিয়েত এস.এফ.।
ভোগ্যপণ্য বিক্রেতাদের কোলাহলমুখর ইঁদুর-দৌড়ে উন্মত্ত বিভ্রান্ত ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায় অবাধ বাণিজ্যের সুবিধাভোগী সমাজে সিরিয়াস এস.এফ.-এর মূল সুরে দার্শনিক আশংকা আর বিষন্নতা। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের তাল কেটে যাওয়ার যন্ত্রণা। অপ্রতিহত বর্তমানকে ভবিষ্যতের পর্দায় প্রক্ষেপ ক’রে আতংকচিত্র দর্শন।
বিপরীতে, সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় বিজ্ঞানকে রাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বীকৃত আদর্শ থেকে জন্ম নিতে পেরেছে কিছু আলোকিত ভবিষ্যৎ – স্বপ্ন-দুনিয়া। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনায় সোভিয়েত সায়েন্স ফিকশনের মুখ্য প্রতিপক্ষ স্বয়ং প্রকৃতি। একথাও মনে করার কারণ নেই যে আশাবাদী এই জাতীয় রচনা সর্বদাই সমতল, নিরুত্তাপ, একমাত্রিক। প্রকৃতিকে বিজয়ের পথে সেখানে সম্মুখীন হতে হয় পরিবেশদূষণ ও ইকোলজিকাল সিস্টেমের সমস্যার, অনগ্রসর ‘এলিয়েন’ সভ্যতায় হস্তক্ষেপের নৈতিক অধিকার (উদ্দেশ্য মহৎ হলেও) ইত্যাদি জটিলতার।
মহাকাশে স্পুৎনিকের ব্লিপ ব্লিপ ধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ১৯৫৭-য় আধুনিক সোভিয়েত এস.এফ.-এর ভিত্তি স্বরূপ আইভান ইয়েফ্রেমভের ‘অ্যান্দ্রোমিদা নেবুলা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। ২৮০ আলোকবর্ষ দূরে ৩০০০ সালের এক আদর্শবাদী শ্রেণীহীন কমিউনিস্ট সমাজের ইউটোপিয়া। অদূর ভবিষ্যতে এস.এফ.-এর ধারা কোন্ সার্থকতার পথ নেবে অনুধাবন ক‘রে ইয়েফ্রেমভ লিখেছিলেন : ‘এস.এফ.-এর উদ্দেশ্যকে শুধু বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় ক’রে তোলার মধ্যে অবনমিত করা যায় না। মানুষের জীবন ও মনোজগতের উওপর বিজ্ঞানের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিঘাত – এই নিয়েই এস.এফ.-এর আদৎ কারবার।‘২
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশ্রয়ে কল্পিত বিচিত্র দুনিয়ায় মানুষের প্রতিক্রিয়া কি হবে – যুক্তি-নির্ভর মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা, মানবিক সম্পর্কের নতুন নকশা, নৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি, ভবিষ্যৎ ইতিহাসের বিভিন্ন প্রকল্প, অনুসন্ধানের কার্য-কারণ তাড়িত যান্ত্রিকতা বর্জন ক’রে শিল্পের নিজস্ব যুক্তিধারার আশ্রয় এবং সবার উপরে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির তথা সমাজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দানের সুবাদে সোভিয়েত এস.এফ. বহু স্তরের আবেদনে সমৃদ্ধ।
সোভিয়েত এস.এফ.-এর স্বাতন্ত্র্য-উজ্জ্বল, প্রতিনিধিত্ব করার মতো একটি কাহিনী লিওনিদ পানাসেংকোর ‘দা ডায়ালগ’। ১৬০০ খ্রীস্টাব্দ। ভিন্ন এক গ্যালাক্সির উন্নততর এক সভ্যতার একজন অপার্থিব যাত্রী মহাকাশযানে ক’রে টহলে বেরিয়ে পৃথিবীর কাছে পৌঁছেছে। সেদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি। ধর্মান্ধরা একটি মানুষকে টেনে নিয়ে চলেছে ভেনিসের Campo de Fiori চত্বরে। জ্বলন্ত দগ্ধ ক’রে হত্যা করা হবে নোলা-র বাসিন্দা এই বিধর্মীকে। মানুষটির নাম জিওর্দানো ব্রুনো। সত্যান্বেষী মহাজ্ঞানী এই মানুষটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষণশীলতা, ভণ্ডামী ও সাধারণভাবে অনগ্রসর সমাজের হাত থেকে রক্ষা ও উদ্ধার করা। নৈতিক দায়িত্ব মনে করে ভীন্গ্রহী আগন্তুক। অশরীরী এই এলিয়েনের আগমন শুধু ব্রুনোই উপলব্ধি করেন। কিন্তু ভীন্গ্রহীকে হস্তক্ষেপ না করতে অনুরোধ করেন ব্রুনো, আগন্তুক এ কাজ কোরো না তুমি। তা হলে এটা হবে আরেকটা অলৌকিক ঘটনা, পুরোহিতদের আরেকটা বিজয়। তারা সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করবে শয়তান রক্ষা করেছে আমায়। … এমনিতেই বহু অলৌকিক কাণ্ড বাধিয়ে রেখেছে ধর্মীয় মন্দির। আমি আমার নিজের পথ ধরেই এগিয়েছি এবং এইটাই তার যুক্তিপূর্ণ প্রান্ত। আমি জানতাম যে জীবন্ত দগ্ধ হওয়া এড়াতে পারবো না। … তা হোক। অলৌকিক কাণ্ড নয়, ওদের প্রয়োজন একটি বলি …।’ ইতিহাসের দাবী ব্রুনোকে শহীদ হয়েই নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে।
এস.এফ. তার অলৌকিক সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের মধ্যস্থতায় এইভাবেই গড়ে তোলে বাস্তবের অলৌকিকের বিরুদ্ধে সচেতনতা। অনুন্নত সমাজের বা রাষ্ট্রের উপর হস্তক্ষেপ না-করা – নন-ইন্টারভেন্শন-গল্পের এই থিম্টিও লক্ষণীয়। এই থিম্ প্ররোচিত করেছে সোভিয়েত এস.এফ.-লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্কাদি ও ৰোৱিস্ স্ত্রুর্গাৎস্কি ভ্রাতৃদ্বয়কে।
এই লেখক-জুটির মধ্যে আর্কাদি (জন্ম ১৯২৫) জাপানি ভাষা ও সাহিত্যবিদ্, আর ৰোৱিস্ (জন্ম ১৯৩৩) মেকানিক্স ও গণিতবিদ্যার স্নাতক। ১৯৫৭ থেকে তাঁরা সায়েন্স ফিকশন রচনা শুরু করেন। তাঁদের প্রথম দিকের উপন্যাস ও গল্প, ‘দা ল্যান্ড অফ দা পার্পল ক্লাউড’, ‘রিটার্ন নুন : টোয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরি’ ইত্যাদি মহাকাশ-অভিযাত্রী একটি দলের নিত্য-নতুন অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দুঃসাহসিক সব মহাকাশযাত্রীদের কাহিনী এক দিক থেকে খুবই গতানুগতিক, কিন্তু এই অভিযান কাহিনীর মধ্যেও নৈতিক ও দার্শনিক কিছু স্পর্শ আছে যা লেখকদ্বয়ের ভবিষ্যৎ সাহিত্যকর্মে পূর্ণমাত্রায় অভিব্যক্ত হয়েছে।
‘দা প্রিডেটরি থিংস অফ দা এজ’ (‘দা ফাইনাল সার্কল অফ প্যারাডাইস’ নামে ইংরাজিতে অনূদিত) প্রকাশিত হয় ১৯৬৫-তে। স্পেস পাইলট জিলিন-কে ইউনাইটেড নেশন্স-এর সিকিউরিটি কাউন্সিল তাদের এজেন্ট হিসাবে মধ্য ইউরোপের একটি কাল্পনিক রাজ্যে প্রেরণ করে। সময় : বিংশ শতাব্দীর অন্ত ভাগ। জিলিনের কাজ অতীতের যত বিষাক্ত জিনিসের মোকাৰিলা – রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী, ফ্যাসিস্ট আর গ্যাংস্টারদের দমন। কৃতকার্য জিলিন-কে তারপরে পাঠানো হয় ‘মূর্খদের দেশে’। সেখানে বৈষয়িক উন্নতি একটি উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে, কিন্তু দেশের মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা প্রায় লুপ্ত। যেন এক দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপে তারা চিন্তা করতে একেবারাই নারাজ। এই দেশ থেকে ভীতপ্রদ রিপোর্ট আসতে শুরু করে ‘স্নেগ’ নামক এক নতুন মাদক দ্রব্য সম্বন্ধে। ‘স্নেগ’ সেখানেই প্রথম তৈরি হয়েছিল আর তারপর থেকেই কেনাবেচা চলছে চোরাবাজারে। এই মাদকদ্রবোর প্রভাবে মানুষ পরিণত হয় গবেষণাগারের ইঁদুরে। সুইচ টিপে যে-ইঁদুর তার মস্তিষ্কের ‘সুখ’-এর কেন্দ্রকে এক নাগাড়ে উত্তেজিত ক’রে চলে। জিলিনের পূর্ববর্তী অনুসন্ধানকারীরা নিজেরাই আসক্ত হয়ে পড়েছিল এই মাদকদ্রব্যে।
স্ত্রুর্গাৎস্কিদের ‘দা রোড সাইড পিক্নিক’ (১৯৭২) অবলম্বনে বিখ্যাত চলচিত্রকার তার্কোভস্কি তুলেছিলেন ‘দা স্টকার’। উপন্যাসের কাহিনীটি ই. টি. (এক্সস্ট্রা টেরেস্ট্রিয়াল) সংক্রান্ত হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের। কে কেন এবং কখন পৃথিবীতে এসেছিক গ্রহান্তর থেকে তা জানা যায় না। শুধু দেখা যায় তারা ফেলে রেখে গেছে একটি রহস্যময় ‘অঞ্চল’। ভিন্ন এক সভ্যতার বহু দুর্জ্ঞেয় নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। যার অর্থ বা লিপিভেদ করার যাবতীয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর মানুষের নৈতিকতাকে ভিত্তি ক‘রে লেখকদ্বয় অপার্থিবদের সঙ্গে এই সংস্পর্শের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন এবং এই ‘অঞ্চলে’ পা দিয়েই চোরাচালানকারী জীবন যুদ্ধে পর্যুদস্ত রোডেরিক, যে তার পথের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে, জীবনে প্রথম চিন্তা করার অবসর পায় সারা জীবন ধরে কী খুঁজছে সে, জীবনের কাছ থেকে কি তার প্রত্যাশা!
‘হার্ড টু বি এ গড’ (১৯৬৪), দা ইনহিবিটেড আইল্যান্ড’ (১৯৭০) ও ‘এ বিট্ল ইন দা অ্যান্টহিল’ (১৯৮০) – এই তিনটি উপন্যাসে স্ত্রুর্গাৎস্কিরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নন-ইন্টারভেন্শনের বিষয়টিকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন বিবেকবান্ মানুষের প্রশ্ন, সমস্যা, মানসিক যন্ত্রণা। কোনো সরল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পথ নেই ভবিষ্যতের এই জটিল কাহিনীগুলিতে। আন্তনকে একটি গ্রহে পর্যবেক্ষক হিসাবে পাঠানো হয়। শুধু চেয়ে দেখা, নথিবদ্ধ আর বিশ্লেষণ করাই তার কাজ। কিন্তু মধ্যযুগীয় অন্ধকারে আচ্ছন্ন সেই গ্রহে যখন ফ্যাসিবাদের আরো নৃশংস এক রূপ দানা বেধে ওঠে, কোনো বিবেকবান মানুষ কি শুধু পর্যবেক্ষক হিসাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে? কিন্তু ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে হস্তক্ষেপ সমর্থনযোগ্য হলেও মানৰ সমাজের পক্ষে নিজেদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে অন্য গ্রহে রোপণ করার কি কোনো অধিকার আছে? প্রথম উপন্যাসের এই প্রশ্ন পরবর্তী দু’টি উপন্যাসে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে (পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর এক দুনিয়ায় এবং পৃথিবীতে গ্রহান্তরের এক অশুভশক্তি সম্পন্ন আগন্তুককে ঘিরে) আরো বিশদে আলোচিত। বিনা কারণে এক রুশ সমালোচক স্ত্রুর্গাৎস্কি-বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধের নামকরণ করেন নি ‘A Test For Humanity’।৩
স্তানিসোয়াভ লেম
অস্ট্রিয়ান সমালোচক রোটেন্স্টাইনার ‘দা সায়েন্স ফিকশন বুক’ গ্রন্থে ‘সেরা সমকালীন সায়েন্স ফিকশন লেখক’ শিরোনামে একটি অধ্যায়ে স্তানিসোয়াভ লেম-এর কৃতিত্ব বর্ণনা করেছেন।১০জেরাল্ড জোনাস নামক এক সমালোচক বলেছেন লেম-ই একমাত্র সায়েন্স ফিকশন লেখক জিনি নোবেল পুরস্কার অর্জনে সমর্থ।১২
১৯২১-এর ১২ সেপ্টেম্বর পোলান্ডের লুভ (Lvov) শহরে স্তানিসোয়াভ লেম-এর জন্ম। পিতা-মাতা দু’জনেই ছিলেন চিকিৎসক। লেম-ও ডাক্তারি ছাত্র হিসাবে পাঠগ্রহণ শুরু করেছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডের সমস্ত শিক্ষায়তন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৪১-এ পাঠক্রমে ছেদ পড়ে। যুদ্ধ বিরতির পূর্বাবধি তিনি একটি জার্মান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে মোটরগাড়ি মেরামতির ও ঝালাই শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। একটি সাক্ষাৎকারের সময় তিনি রসিকতা ক’রে বলেছিলেন, যে মিস্ত্রি হিসাবে এতই অপটু তিনি যে একটি অন্তর্ঘাতমূলক কাজের জন্য প্রায় ফাঁসতে বসেছিলেন একবার। যুদ্ধের পর পিতা-মাতার সঙ্গে ক্র্যাকাও চলে আসেন ও ১৯৪৮-চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ শেষ করেন। কিন্তু ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন নি, কারণ সে সময়ে ডাক্তারি ডিপ্লোমাধারীদের বাধ্যতামূলকভাবে আজীবনের কড়ারে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হচ্ছিল।
লেম এক অর্থে একটি আধুনিক রেনেশাঁস ব্যক্তিত্ব। ‘মাথেমেটিকাল লিঙ্গুইস্টিক্স্’, স্ট্রাকচারাল লিটারেচার’ থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞানের পদ্ধতি (methodology) এবং সাইবারনেটিক্স বিদ্যায় (দিদ্ধান্ত গ্রহণের বুদ্ধিসম্পন্ন যন্ত্র নির্মাণ বিদ্যায়) তাঁর অবাধ অধিকার। এই বহুগামী অনুসন্ধিৎসু মনের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল তাঁর সাহিত্যকর্মও। সাহিত্যের বিবিধ শাখায় তিনি চালিয়েছেন পরীক্ষা – কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, গোয়েন্দা কাহিনী, ফ্যান্টাসি, বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ, সাহিত্য সমালোচনা, সাইবার-নেটিক তত্ত্ব, অপ্রকাশিত গ্রন্থের সমালোচনা, দার্শনিক প্রবন্ধ ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, তাঁর বহু একক সাহিত্যকর্মও বহুস্তর বিশিষ্ট, যার মধ্যে জড়িয়ে আছে পূর্বোক্ত বিবিধ ফর্ম বা ফর্মের উপাদান।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈষয়িক সাফল্য স্বীকার করেও তিনি জ্ঞান ও সত্যের অন্বেষণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কৃতকার্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান । অত্যন্ত নিকট ও পরিচিত জগতেরও ক্ষুদ্র একটি চৌহদ্দির বাইরে বিজ্ঞান আমাদের বিমূর্ত উপলব্ধির আকাঙ্ক্ষাকে কতদূর চরিতার্থ করতে সক্ষম – এই বিষয়টি তাঁকে বার বার প্ররোচিত করেছে। থিম, ফর্ম, প্লট, কি স্টাইল – গোয়েন্দা কাহিনীর ঘরানা, কি সায়েন্স ফিকশন – সবই তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের কাজে নিযুক্ত।
চমক ও তিক্ততা, ভীতি ও আস্থা , ব্যঙ্গ আর কৌতুকে বোনা তাঁর জগৎ। গ্রন্থভেদে তাঁর বিষয় ও স্টাইলও এত ভিন্ন যে বিশেষ কোনো রচনাকে প্রতিনিধিমূলক বিবেচনা করা এবং সেই সূত্রে লেম-এর স্বকীয়তার আভাস দেওয়া দুঃসাধ্য। তাঁর সাহিত্যকৃতির বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জন্য কখনো তাঁর সঙ্গে পাউন্ড বা ইলিয়টের তুলনা করা হয়েছে, কখনো একটি গল্পে খুঁজে পাওয়া গেছে কাফ্কাকে, ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস্’ উপন্যাসের বিবরনধর্মিতাকে ‘মবি ডিক’ জাতীয় সাফল্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে, আবার দর্শনতত্ত্বকে সাহিত্যের ছটায় উদ্ভাসিত করার জন্য টমাস মান্কে স্মরন করা হয়েছে। (‘… who brings a marvelous flair to philosophical novel and who renders ideas provocatively in literary guise. In this respect his work is reminiscent of Thomas Mann’s – learned and interesting, although not startling।’)১৩
রোটেন্স্টাইনায়েরের পূর্বোক্ত রচনায় উদ্ধৃত হয়েছে অজ্ঞাতনামা এক ব্রিটিশ সমালোচকের উক্তি: ‘ “সোলারিস” যেন ফ্রয়েড ও এইচ. জি. ওয়েল্স জুটির উদ্দীপ্ত যৌথকর্ম।’
‘সোলারিস’ উপন্যাসটি ( বা তাঁর অন্য কোনো গ্রন্থকেই স্বতন্ত্রভাবে ) লেম-এর সেরা কীর্তি বলা বাতুলতা! তবে স্বীকার করতেই হয় এটি তাঁর সর্বাধিক পাঠিত ও আলোচিত গ্রন্থ এবং এই উপন্যাসের সুবাদেই তাঁর নাম ইংলন্ড ও আমেরিকায় রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান ও ইস্টার্ন ব্লকে লেম-এর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কান্ ও কারলোভি ভ্যারিতে উচ্চ-প্রশংশিত আন্দ্রেই তার্কোভ্স্কি-র ‘সোলারিস’ নামে রুশ চলচ্চিত্রের কাহিনীকার হিসাবেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ১৯৭০-এ প্রথম ‘সোলারিস’-এর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যদিও পোলিশ ভাষায় সেটি ১৯৬১-তে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সোলারিস-এর ফরাসি অনুবাদ থেকে পুনরনূদিত ইংরেজি সংস্করনটি।
ইয়োরোপ ও আমেরিকায় এস.এফ. বিষয়ক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও শিক্ষণের সহায়ক-গ্রন্থ হিসাবে রচিত প্যাট্রিক প্যারিন্ডার-এর ‘সায়েন্স ফিকশন : ইটস ক্রিটিসিজ্ম অ্যান্ড টিচিং’।৭ প্যারিন্ডার একটি ঘরানা (genre) রূপে সায়েন্স ফিকশনের স্বরূপ উদঘাটনের জন্য চারটি অক্ষে বিভক্ত করেছেন তাঁর আলোচনা – উপকথা (ফেব্ল), এপিক, রোমান্স এবং প্যারডি। তিনি মনে করেন সায়েন্স ফিকশনের কোনো গ্রন্থকে তখনই ‘ক্ল্যাসিক’ আখ্যা দেওয়া যায়, যখন তার মধ্যে এই চারটি অক্ষের সার্থক সংশ্লেষ ঘটে। (‘The intensive reading of such a work will, in effect, be a rehearsal of all that the genre is and might be.’)। এবং ‘সোলারিস’ তাঁর বিবেচনায় এই চারটি অক্ষ ঘিরেই সৃজনশীল মৌলিকতায় উজ্জ্বল।
‘সোলারিস’ একটি গ্রহের নাম। দু’টি সূর্য বিশিষ্ট এই গ্রহকে আচ্ছাদিত ক’রে আছে এক মহাসমুদ্র। এক ধরনের ঘন আঠাল তরল বা জেলি জাতীয় পদার্থে যা পূর্ণ। অবিরাম স্পন্দ্যমান এই সমুদ্র বিচিত্র সব আকৃতি গ্রহণ ক’রে চলেছে প্রতি মুহূর্তে, যার কখনো পুনরাবৃত্তি ঘটে না। বংশ পরম্পরায় বিজ্ঞানীর দল এই সমুদ্রকে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন ক’রে চলেছেন। তাঁদের মতে এই সমুদ্রও এক অবিচ্ছিন্ন মহা-প্রাণ ( bio-mass)। মহাজ্ঞানী এক সমুদ্র। বিজ্ঞানীরা এই জীবন্ত সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মানবিক আকাঙ্ক্ষায় পীড়িত। ‘সোলারিস’-কে নিয়ে গবেষণা ‘সোলারিস্টিক’ বিদ্যার জন্ম দিয়েছে, কিন্ত আজো কোন সংযোগ স্থাপিত হয় নি। ইতিমধ্যে কিছু বিজ্ঞানী ও অভিযাত্রী এমন পরিস্থিতির মধ্যে উধাও হয়ে গেছে যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। এই অবস্থায় উপন্যাসের নায়ক কেল্ভিন এসে পৌঁছয় সোলারিস-এর আকাশে ভাসমান স্পেস- স্টেশনে, গবেষণা কেন্দ্রে। এই গবেষণা কেন্দ্রে কেল্ভিনের কয়েকমাসের অভিজ্ঞতার বিবরণ ‘সোলারিস’-এর আখ্যানভাগ। মনস্তত্ত্ববিদ কেল্ভিন গবেষণা কেন্দ্রে পৌঁছাবার কিছু পূর্বে তার এক বিজ্ঞানী সহকর্মী গিবারিয়ান সেখানে আত্মহত্যা করেছে। কেলভিন দেখল তার সহকর্মী পদার্থবিদ্ সার্টোরিয়াস ও সইবারনেটিক-বিশারদ স্নো, দুজনেই মানসিক রোগাক্রান্ত। কাল্পনিক দৃশ্যকে তারা চাক্ষুষ করেছে। স্পেস-স্টেশনের এই তোলপাড় অবস্থার জন্য দায়ী ‘আগন্তুক’রা। মানুষ মহাসমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে না পারুক, মহাসমুদ্র মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসেই সম্ভবত সৃষ্টি করেছে এই ‘আগন্তুক’দের। তাঁদের প্রেরণ করেছে স্টেশনে। এই ‘আগন্তুক’রা মানুষের দেহধারী। এবং স্টেশনের বাসিন্দাদের স্মৃতি ও গোপন আকাঙ্ক্ষাকে ব্রেন-স্ক্যানিং মারফত মহাজ্ঞানী সমুদ্র এমন ‘আগন্তুক’দেরই সংশ্লেষণ করেছে যারা স্টেশনের বাসিন্দাদেরই সুপরিচিত বা নিকটজন। আগন্তুকরা মুহূর্তের জন্য তাদের পার্থিব আত্মীয়ের সঙ্গ ত্যাগ করতে নারাজ। জোর ক’রে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলে তারা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তারা এমন উপাদানে গঠিত যে আঘাত ও ক্ষত আপনা থেকে নিরাময় হয়। এমনকি কাউকে রকেটে চড়িয়ে মহাশূন্যে নিক্ষেপ ক’রে দিলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবিকল এক বিকল্প তার স্থান পূরণ করে। স্বাভাবিক মানুষের মতই বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন তারা এবং নিজেদের অপার্থিব অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রথমিকভাবেই অসচেতন।
এখানে ‘আগন্তুক’দের আমরা সুপ্ত ব্যাক্তিগত যৌনবাসনার বা শৈশবের আকাঙ্ক্ষার শরীরী প্রতিমূর্তি হিসাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। যার সঙ্গে হয়ত অপরাধবোধও জড়িত। এক নিগ্রো মহিলা-রূপী আগন্তুক তাই গিবারিয়ানকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে, এক বামন বসবাস করে সার্টোরিয়াসের সঙ্গে। কেল্ভিনের সমস্যা আরো দ্বিধাপীড়িত। তার ‘আগন্তুক’-রেয়া ( মূল পোলিশে ‘হরে’ ) নামে একটি মেয়ের প্রতিমূর্তি যার সঙ্গে কেল্ভিন সত্যিই এককালে মর্মন্তুদ প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আগন্তুক ‘রেয়া’র সঙ্গে কোন সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব এটা কেল্ভিন ‘বিজ্ঞান’-এর ব্যাখ্যা অনুসারে উপলব্ধি করেও তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে নি। (এখানে উল্লেখযোগ্য, আগন্তুকদের রক্ত পরীক্ষা করেও কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় নি তাঁদের পার্থিব আদত মডেলের সঙ্গে)। স্নো এবং সারটোরিয়াস ‘আগন্তুক’দের দেহের ‘নিউট্রিনো কাঠামো’-কে বিপর্যস্ত করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করার পর রেয়া আত্মহত্যা করে। কেল্ভিন-রেয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। কিন্তু পার্থিব রেয়াও আত্মহত্যা করেছিল একদিন। কাজেই আগন্তুক রেয়া-কে আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছে দুই বৈজ্ঞানিক, কিন্তু সেটা কি তাদেরই স্বাধীন চিন্তাজাত? যাই হোক্ রেয়া-র প্রস্থান (বাস্তবের রেয়া-র মতোই) কেল্ভিনকে সোলারিস রহস্যে অবগাহনে আরোই উৎসাহিত করে। এবং তার এই উৎসাহ প্রধানত আবেগজাত।
কেল্ভিন তার পূর্বসূরি বিজ্ঞানীদের আহৃত তথ্য ও তত্ত্ব ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে শুরু করে। জানা যায় ‘সোলারিস্টিক’ বিদ্যার চর্চা আটাত্তর বছরে মূল সমস্যার কাছে এতটুকু অগ্রসর হতে পারে নি। কেন পারে নি তা শুধু ‘সোলারিস’ উপন্যাস নয়, লেম-এর সৃজনশীল রচনার এক বড়ো অংশ জুড়ে আছে সেই ‘এপিস্টোমোলজি’ সংক্রান্ত দার্শনিক ভাবনা। ‘এপিস্টোমোলজি’ শব্দটিকে পরিহার করে লেম স্বয়ং এক সাক্ষাৎকারে বুঝিয়ে বলেছিলেন ‘[এই নাটকের] ফোকাল্ পয়েন্ট হল জ্ঞান আহরণের জন্য মানুষের অক্ষম যন্ত্রপাতির ট্রাজেডি।’ (‘… whose focal point is the tragedy of man’s imperfect machinery for gaining knowledge.’)।১৩
কেলভিনের মতে পূর্ব-নির্ধারিত ছকের সঙ্গে খাপ খায় না এমন সব তথ্যকে বর্জন করতে বলে যে- বিজ্ঞান তা আসলে জ্ঞান অর্জনের বা উপলব্ধির সহায়ক নয়।
অন্যদিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত, অজ্ঞাত ও বিচিত্রের সম্মুখীন মানুষ যখন জ্ঞান আহরণের উপকরণযোগে তার মর্মভেদ করতে পারে না – তখন কি ঘটে – বা বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর তার প্রতিক্রিয়া কি – এই অনুসন্ধানও ‘সোলারিস’ তথা লেম-এর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের এক বিশেষ স্থান জুড়ে আছে। এবং এই সূত্রেই ‘মেটাফিজিক্স’-এর অতিরিক্ত তাঁর সামাজিক উদ্বেগ এবং মানবিকতারও প্রকাশ। ‘সোলারিস’-এর তিন বিজ্ঞানীর কথা ধরা যাক।
সার্টোরিয়াস বিজ্ঞানীকূলের সেই গোষ্ঠীর প্রতিনিধি যিনি ‘ফলপ্রসূ’ কাজ করেন। তাঁর মতে ‘সোলারিস’ স্পেস- স্টেশনের একটাই তাৎপর্য – মহাজাগতিক সম্প্রসারণ এবং ব্যক্তিস্বার্থহীন আত্ম-ত্যাগের যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি তারই প্রতীক এটি। পৃথিবীর মানুষের বৈষয়িক প্রয়োজন উপেক্ষা ক’রে বিমূর্ত জ্ঞান অন্বেষণের কর্মকাণ্ডে বিপুল সম্পদ বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাঁর ‘নৈতিক’ দায়িত্বই সার্টোরিয়াসকে আর কিছু না হোক ‘আগন্তুক’দের নিহত করার যন্ত্র নির্মাণে উৎসাহিত করে, ইউনাইটেড নেশন্স-এর চিঠি লঙ্ঘন করেও সোলারিসের সমুদ্রকে তিনি এক্স-রে দিয়ে আঘাত করেন এবং ‘অস্ত্রবিদ বিজ্ঞানী’র মত কিছু ‘ফল’ অবশ্যই পান। বিজ্ঞানী স্নো উদারপন্থী হয়েও কিন্তু শেষ অবধি এক অসহায় হতশাবাদী। সহকর্মীদের কর্মধারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেন না, শুধু ইংগিত দেন যে মহাকাশ অভিযানের এই উন্মত্ততা আসলে মানুষের বাস্তব সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে যাওয়ারই নামান্তর। অন্যদের ধ্বংসাত্মক সমালোচনা কিন্তু তাঁর নিজস্ব মননশীলতার ও নৈতিকতার পরাজয়কে গোপন করতে পারে না। এই দু’জনের বিপরীতে কেল্ভিন এক রোমান্টিক আদর্শবাদী, কল্পনাপ্রবণ – নতুন অভিজ্ঞতাকে খোলামনে গ্রহণ করতে সক্ষম। তার দৃঢ় বিশ্বাস সোলারিস-এর রহস্যের সম্মুখীন হওয়া তার পক্ষে এক ব্যাক্তিগত অন্বেষণ। অন্য দুই সহকর্মীর সঙ্গে কেল্ভিনের স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম কারণ নিশ্চয় রেয়া-র প্রতি তার অন্ধ ভালবাসা। অচরিতার্থ হলেও এই প্রেমের মূল্য তার জীবনে যতখানি দুর্জ্ঞেয়, রহস্যভেদে অসমর্থ হলেও তার ‘সোলারিস’ ত্যাগ না করার বাসনার গুরুত্বও ততটা। কিংবা উপন্যাসের শেষাংশে দেখি জ্ঞানী সমুদ্র খেলাচ্ছলে হলেও কেল্ভিনকে স্পর্শ করছে, মনে হয় হয়ত সে জানতে পারবে। কিন্তু কেল্ভিনের সেই জানা হবে তার নিতান্ত ব্যাক্তিগত উপলব্ধি। মানুষ হিসাবে সেই জানাকে সে সঞ্চারিত করতে পারবে কিনা – ‘সোলারিস’-এর মহাপ্রাণের মধ্যে তার মানবসত্তার বিলুপ্তি ঘটিয়েই একমাত্র এই জানা সম্ভব কিনা – এই সব প্রশ্ন নিরুত্তর থেকে যায়।
বাঙালি পাঠকদের পক্ষে সুখবর লেম-এর দুটি গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। ‘পৃথিবী কি ক’রে বাঁচল’ এবং ‘মুখোশ ও মৃগয়া’। আনুবাদ সহজসাধ্য নয়, বলাই বাহুল্য। প্রথম গ্রন্থটি রোবটদের জন্য লেখা রূপকথার সংকলন। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে ট্রুর্ল ও ক্লাপাউৎসিউশ নামে বিজ্ঞানী ও যন্ত্রবিদ দুই বন্ধুর প্রাণ মাতানো কীর্তিকাহিনী ও দুরন্ত অ্যাডভেঞ্চার। এরা দু’জন যারা রোবট বানাতে সিদ্ধহস্ত, তারা নিজেরাও রোবট। পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলে তাদের অদ্ভুত সব যন্ত্রও নির্মাণের। আর সেই সুবাদেই ঘটে যায় নানা কেলেংকারি, সৃষ্টি হয় উদ্ভট সব সমস্যা। একটি উদাহরণ : একবার তারা বানিয়ে ফেলল এমন যন্ত্র, যা ‘ন’ দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্বব্রম্ভাণ্ডের এমন সব জিনিসই বানাতে পারে। কার্যকালে দেখা গেল তার অর্থ তারা সবকিছুই বানাতে পারে এমনকি ‘নাস্তি’ও (অনস্তিত্ব)। আবার রোবটদের ভিন্ন এক জগতে প্রযুক্তির প্রবল আস্ফালন সত্ত্বেও, অ্যাটম বোমাও যখন হার মেনেছে এক আপদকে বিদায় করতে, মহাবিজ্ঞানী মুস্কিল আসান করলেন সব যন্ত্রের সেটা যন্ত্র ‘আমলা যন্ত্র’ বা ‘আপিস যন্ত্র’ তৈরি ক’রে যার বিশাল ‘আ’-কে কেউ ঘায়েল করতে পারে নি। ‘মুখোশ ও মৃগয়া’-ও রোবটদের দুটি কাহিনী। তবে এখানে কৌতুক আর রঙ্গব্যাঙ্গ নয়। ‘মৃগয়া’-য় নভোযাত্রী পিরস্ক বেরোয় এক বিপজ্জনক অভিযানে এক বেপথু রোবটকে গ্রেপ্তার করতে। আর ‘মুখোশ’-এ দেখি রোবট খুঁজে বেড়াচ্ছে তার স্রষ্টা মানুষকে। মানুষেরই আত্মানুসন্ধানের দু’টি কাহিনী – কল্পিত অবস্থানের মেরু বিপর্যয় ঘটিয়ে রচিত।
‘সোলারিস, দা ইনভিসিবল, মেমোয়ার্স ফাউণ্ড ইন এ বাথ্ টাব, সাই-বিরিয়াদ, ফিউচারোলজিকাল কংগ্রেস, স্টার ডায়েরিজ, মরটাল এনজিন্স, চেন অফ চান্স, পারফেক্ট ভ্যাকুয়াম, টেলস অফ পিক্স দা পাইলট ইত্যাদি লেম-এর ষোলটি গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে ইংরাজিতে।
ইংলন্ড ও আমেরিকায় প্রভূত স্বীকৃতি পেয়েছেন লেম। ১৯৭৬-এ নিউইয়র্ক টাইম্স বুক রিভিউ ও ১৯৭৮-এ নিউ ইয়র্কার-এর প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছেন তিনি। এর গুরুত্ব বোঝা যায় যখন দেখি আমেরিকায় মাত্র জনা-দশেক বিদেশী লেখক এই সম্মান উপভোগ করেন – গ্রাস্, ব্যোল্, বর্হেস, ফুয়েস্তেস ও ক্যালভিনো প্রমুখ। কিন্তু তার মধ্যে লেম ভিন্ন দ্বিতীয় সায়েন্স ফিকশন লেখক নেই।
লেম-এর উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতা এস.এফ.-এর প্রচলিত ধারা ত্যাগ ক’রে অর্জন করেছে নতুন শক্তি। মানুষের গড়া (অতিবিজ্ঞানের) দানবকে বীভৎসরূপে উপস্থাপিত করেও তার ধ্বংসলীলার বর্ণনা দিয়ে সমাজের স্বার্থরক্ষার মহান কর্তব্য পালন করার চেষ্টা নেই তাঁর। বরং যন্ত্রমানুষকে জ্ঞান ও চেতনা প্রদান ক’রে তাদের দৃষ্টিতে প্রতিবিম্বিত করেছেন আবিষ্কারক মানুষের স্বরূপ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাধনাকে একাধারে সমর্থিত ও তার সাধকদের সমালোচিত করার এই দৃষ্টিকোণ শুধু সাহিত্যিকের প্রকৌশল নয়, দার্শনিক অবলম্বন।
সহায়ক গ্রন্থ ও উল্লেখপঞ্জি
১. John Baxter, Science Fiction in Cinema, 1970.
২. Evgeni Brandis, ‘The Horizons of Science Fiction’, Soviet Literature, January, 1983
৩. Vladimir Gaskov, ‘A Test of Humanity’, Soviet Literature, January, 1983
৪. Harry A. Katz, et al, Introductory Psychology Through Science Fiction, 2nd ed., 1977.
৫. P. S. Krishnamoorthy, A Scholar’s Guide to Modern American Science Fiction, 1983
৬. V. S. Muraviov, ‘Invitation to the Strange Land’ (in Russian), Science Fiction : English & American Science Fiction, Moscow, 1979.
৭. Patrick Parrinder, Science Fiction : Its Criticism & Teaching, 1980
৮. Rabkin E. S. & Scholes R., SF : History, Science, Vision, 1977
৯. Satyajit Ray, ‘Ordeals of the Alien’ I & II, The Statesman, Oct 4 & 5, 1980
১০. Franz Rottensteiner, The Science Fiction Book, 1975
১১. Marie Seton, Satyajit Ray, 1972 (Vikas).
১২. Philip Strick, Science Fiction Movies, 1976
১৩. Richard E, Ziegfeld, Stanislaw Lem, 1985
কঃসঃ – এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশ পায় এক্ষণ বার্ষিক সংখ্যা ১৩৯৫-তে। সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি কল্পবিশ্বের দুটি সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশ করা হবে।পুনঃপ্রকাশের সময় বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এই সংখ্যায় থাকছে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লেখা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা। পরের সংখ্যায় থাকবে এই প্রবন্ধের বাকি অংশটি যেখানে আছে মূলত বাংলা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা। লেখকের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি এবং রচনাসমূহের তালিকা প্রকাশ পেয়েছিল কল্পবিশ্বের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায়। উৎসাহী পাঠক সেটি পড়তে পারেন নিচের লিঙ্ক এ ক্লিক করেই।
স্বর্ণযুগের সিদ্ধার্থ
৩১শে অক্টোবর ২০০২ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। আমরা তাঁর মেয়ে বা অন্য কোন নিকট আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাই তাদের অনুমতি ব্যাতিরেখেই প্রবন্ধটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হল।
Tags: প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রবন্ধ, বিশেষ আকর্ষণ, সায়েন্স ফিকশন - সির্দ্ধাথ ঘোষের কলমে, সিদ্ধার্থ ঘোষ, সুদীপ দেব