সায়েন্স ফিকশন এবং অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির
লেখক: অর্চন চক্রবর্তী
শিল্পী: সন্তু বাগ
আজ সায়েন্স ফিকশন লেখকদের মধ্যে এইচ জি ওয়েলস এবং জুল ভার্নের নাম দুগ্ধপোষ্য শিশুরাও জানে। কিন্তু আজ থেকে সত্তর-বাহাত্তর বছর আগে পরিস্থিতি মোটেও এমনটা ছিল না। হাতে গোনা কয়েকজন উৎসাহী পাঠক ছাড়া বাঙালি পাঠক সমাজে সায়েন্স ফিকশন এর কদর ছিল না বললেই হয়।
সেই সময় ‘অভ্যদয় প্রকাশ মন্দির’ এর কর্ণধার শ্রী অমিয় কুমার চক্রবর্তী সায়েন্স ফিকশনকে বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করেন। কাজটা সহজ ছিল না, ঝুঁকিও ছিল প্রচুর। তখন অভ্যুদয় টলোমলো পায়ে সবে চলতে শুরু করেছে। সরকারি চাকরির মোহ এবং নিরাপত্তাকে ছিন্ন করে সাহিত্য, বিশেষ করে শিশু ও কিশোর সাহিত্য সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। লেক রোডের পৈতৃক বাসভবনের একটা ছোট ঘরে অভ্যুদয়ের তখন অফিস এবং দোকান। পরে অবশ্য কলেজ স্ট্রিটে অভ্যুদয় স্থানান্তরিত হয়। এই পরিস্থিতিতে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে বাংলা বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া দুঃসাহসের কাজ। কিন্তু পাঠকের দরবারে ভালো বই প্রকাশনার জন্যে উনি দুঃসাহসী হয়েছিলেন।
এইচ জি ওয়েলসের ‘আইল্যান্ড অব ডক্টর মোরো’ বইটা নিজেই অনুবাদ করে নিজের প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশ করলেন। সাহিত্যবোধ তাঁর ছিলই, তা ছাড়া এর আগে কয়েকটি বই অনুবাদ করে উনি হাত পাকিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে বইটার অনুবাদ হয়েছিল যথেষ্ট উঁচুমানের। কিন্তু শুধু ছাপালেই তো হবে না, প্রচারের দিকটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নামী পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতো সামর্থ্য তখন তাঁর ছিল না। এই জন্য ব্যবসার কাজকর্ম সামলে এবং ছুটির দিনে তিনি প্রচারের জন্য বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন স্কুলে স্কুলে লাইব্রেরিগুলোতে এবং বইয়ের দোকানে দোকানে। নিজ মুখে বইয়ের গুণাগুণ বোঝাতেন। এ ভাবেই তিনি প্রচার শুরু করলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে এ ভাবেই প্রচার করে গেছেন। একে একে এইচ জি ওয়েলসের ‘দি টাইম মেশিন’ এবং ‘ফার্স্ট মেন ইন দি মুন’ বই দুটো অনূদিত হয়ে প্রকাশ পেল। আস্তে আস্তে বইগুলো পাঠক সমাজে সমাদর পেতে লাগল। হৈ হৈ করে না হলেও বিক্রি বাটা ছিল মোটামুটি সন্তোষজনক।
এরপর উৎসাহিত হয়ে তিনি ‘এইচ জি ওয়েলসের গল্প’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বহুমানযোগ্য লেখক ও সম্পাদক শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। এইচ জি ওয়েলসের দশটা কালজয়ী গল্প দিয়ে এই বইটাকে সাজানো হয়েছে।
গল্পগুলো হল
(১) দৃষ্টিহীনের দেশ (The Country of The Blind)
(২) সুন্দর পোষাক (The Beautiful Suit)
(৩) নতুন তারা (The Star)
(৪) পাইক্র্যাফটের গোপন রহস্য (The Truth About Pyecraft)
(৫) অপহৃত বীজানু (The Stolen Bacillus)
(৬) নতুন গতিশক্তি (The New Accelerator)
(৭) অলৌকিক (The Man Who Could Work Miracles)
(৮) ম্যাজিকের দোকান (The Magic Shop)
(৯) প্রাচীরের দরজা (The Door In The Wall)
(১০)পরলোকগত মিঃ এভ্সহ্যামের কাহিনি (The Story of Late Mr. Elvesham)
প্রতিটা গল্পেরই অনুবাদ হয়েছিল খাসা।
এরপর প্রকাশক মনস্থ করলেন সায়েন্স ফিকশনের জনক জুল ভার্নের কিছু বই অনুবাদ করে প্রকাশ করবেন। একজন ভালো অনুবাদকের খোঁজে ছিলেন, যিনি গল্পের মূল ভাব এবং মেজাজকে অক্ষুন্ন রেখে সাবলীল অনুবাদ করতে পারবেন। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন শ্রী মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে। মানবেন্দ্রবাবুর বয়স তখন বেশ কম। সতেরো-আঠেরোর বেশি নয়। তা হলেও প্রকাশক তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা আঁচ করে অনুবাদের দায়িত্ব দিলেন। একে একে মানবেন্দ্রবাবুর অনুবাদে ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দি আর্থ’, ‘ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন’, ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’, ‘পারচেজ অব দ্য নর্থ পোল’, ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’, ‘রাশিয়ার রাজদূত মাইকেল স্ট্রগফ’, ‘আ্যড্রিফট ইন দ্য প্যাসিফিক’ বইগুলো প্রকাশিত হল। মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে অনুবাদক নিয়োগ করে প্রকাশক যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ পরবর্তীকালে উনি যশস্বী অনুবাদক হয়েছেন। এ ছাড়াও ‘টোয়েন্টি থাওজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ বইটা অনুবাদ করলেন শ্রী শৈবাল চক্রবর্তী এবং ‘ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস’ অনুবাদ করলেন অমিয় কুমার চক্রবর্তী। প্রতিটা বই-ই অসাধারণ অনুবাদ হয়েছিল। মাঝখানে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘বিজ্ঞাননির্ভর গল্প’, ‘ময়দানবের দ্বীপ’ এবং হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘অসম্ভবের দেশে’ এই বইগুলো ও প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে পনেরোটা সায়েন্স ফিকশন আধারিত বই বেরয় অভ্যুদয় থেকে ওই সময়ে এবং ওই সব ক-টা বই-ই একসঙ্গে পাওয়া যেত। গুণমানে উজ্জ্বল একসঙ্গে এতগুলো বই পাঠকের দরবারে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিল। নড়েচড়ে বসলেন পাঠক। তাঁরা জানলেন, সায়েন্স ফিকশন বিশ্বসাহিত্যের একটা বলিষ্ঠ বহমান ধারা। ঘরে ঘরে এবং লাইব্রেরিগুলোতে বইগুলো পাকা আসন করে নিল। প্রকাশকের এতদিনের উদ্যম, চেষ্টা এবং পরিশ্রম সার্থক হল। সেই সময়ের নিরিখে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির এক প্রয়োজনীয় এবং উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিল, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
Tags: অর্চন চক্রবর্তী, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রবন্ধ, সন্তু বাগ
Can we get list of Science Fiction books and year of published by Abhyudoy Mandir? But again a wonderful effort to publish this article.
ইন্টারনেট আরকাইভে পাবেন।
অ্যাকসেলারেটর-এর বাংলা পরিভাষা ত্বরক হবার কথা ছিল। যা-হোক, এগুলো কি সানুমতি অনুবাদ ছিল?