সিঁড়ি
লেখক: রাজকুমার রায়চৌধুরী
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
হরিহর হাজরা সদ্য সরকারী চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন। বছর তিন আগে স্ত্রী গত হয়েছেন। নিঃসন্তান হরিহর বাবুর কোন নিকট আত্মীয়স্বজন নেই। অল্পবয়সে বাবা মা মারা যাওয়ার পর দাদুর কাছে মানুষ হয়েছেন। দাদুও বহুদিন হল গত হয়েছেন। দূর সম্পর্কের এক ভাইপো আছে। আসামে থাকে, মাঝে মাঝে খোঁজ নেয়। তাই হরিহর বাবুর ঝাড়া হাত পা। বই পড়া ও নাটক দেখার অভ্যেস আছে তাই সময় কেটে যায়। দক্ষিণ কোলকাতার এক শহরতলিতে একটি চার তলা বাড়ির তিন তলার একটি ফ্লাটে হরিহর বাবু থাকেন। ৪০ টা সিঁড়ি ভাঙ্গলেই একতলায় পৌছনো যায়। সাধারণত বাড়ির সিঁড়ির ধাপ কেউ গুনে সেই সংখ্যা কেউই মনে রাখে না। তবে হরিপদবাবুর এই সিঁড়ির সংখ্যা মনে রাখার পেছনে একটা কারণ আছে। হরিপদবাবুর বাড়ির সামনে যে বিদ্যুৎ বিভাগের ট্রান্সফরমারটা রয়েছে সেটা বেশ পুরোনো আর ওঁর বাড়ির রাস্তার শেষ প্রান্তে রয়েছে কিছু বেআইনি লোহার কারখানা। সেই কারখানাগুলোর বেআইনী হুকিং এর ফলে প্রত্যেক দু-তিন মাসে একবার করে ট্রান্সফরমারের ফিউস উড়ে যায়। এরকম একাধিকবার হয়েছে যে সন্ধ্যেবেলায় ফিউস উড়ে গিয়ে সারা পাড়া ও বাড়ি অন্ধকার আর হরিহরবাবু বাড়ির বাইরে। সঙ্গে টর্চ জাতিয় কিছু নিয়ে বেরোন নি। এদিকে গত কয়েক বছর ধরে হরিহর বাবুকে সামান্য রাতকানা রোগে ধরেছে। ফলে বাড়ি ফিরে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে ওঁকে যথেষ্ট নাকাল হতে হয়েছে। তাই একদিন দিনের বেলা বুদ্ধি করে সিঁড়ি গুলো গুনে রেখেছেন। ফলে এখন আকস্মিক অন্ধকারেও সিঁড়ি গুনে হাতড়ে হাতড়ে নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যাওয়াটা ওঁর দিব্বি রপ্ত হয়ে গেছে।
২
জুলাই মাসের এক শনিবার। খুব জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আর একবার বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে হরিহর বাবু ওষুধ কেনার জন্য ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে নীচে নামতে শুরু করলেন। কিন্তু বাঁধা হিসেবের চল্লিশটা সিঁড়ি ভেঙ্গেও একতলা আসার কোন লক্ষণ দেখতে পেলেন না। গুনতে ভুল করেছেন ভেবে আরো খানিকটা নামলেন সিঁড়ি ভেঙ্গে। কিন্তু তাও বাড়ির নিচতলায় পৌঁছে উঠতে পারলেন না। হরিহর বাবু খুব অবাক হলেন। কিন্তু তিনি হালছাড়ার পাত্র নন। যৌবনে হিমালয়ে ট্রেকিং করেছেন। সুতরাং সিঁড়ি ভাঙ্গা থামালেন না। কিন্তু তিন ঘন্টা সিঁড়ি ভেঙ্গেও একতলায় পৌঁছলেন না। যখন খুবই ক্লান্ত বোধ করছিলেন তখনই দেখলেন সামনে একটি ফ্ল্যাটের খোলা দরজা। ফ্ল্যাটটি যেন তাঁকে আহ্বান করছে। ফ্ল্যাটে ঢুকে তিনি কোন লোকজন দেখতে পেলেন না। তবে ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলে প্রচুর উপাদেয় খাদ্যবস্তু সাজানো। হরিহর বাবুর বিলক্ষণ খিদে পেয়েছিল। তাই ওখানে কিছু খেয়ে ও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার নীচে হাঁটা শুরু করলেন। আরো তিন ঘন্টা পর আবার একটি খোলা ফ্ল্যাট ও আবার সেই একই ব্যাপার৷ ভালো ভালো খাবার টেবিলের উপর রাখা। তবে এবার এক প্রস্থ নতুন পোষাকও টেবিলের উপর রাখা। অথচ হরিহর বাবুর পোষাক কিন্তু এখনো ধোপদুরস্ত। দেখে মনে হবে সদ্য পাট ভেঙ্গে পড়েছেন। হয়ত একঘেঁয়েমি কাটাবার জন্য নতুন পোষাক রাখা আছে। হরিহরবাবু নতুন পোষাক পরে দেখলেন দারুণ ফিট করেছে। আবার হরিহর বাবু সিঁড়ি ভাঙ্গা শুরু করলেন।
৩
হরিহরবাবু প্রথম থেকেই হিসেব রাখছিলেন কত গুলো সিঁড়ি ভাঙ্গছেন। এ পর্যন্ত ৭ লক্ষ হয়েছে। বিশ্রামের সময়, রাত্রে ঘুমানো ইত্যাদি ধরলে প্রায় ৯/১০ মাস কেটে যাওয়ার কেটে যাওয়ার কথা। যে কটা ঘরে বিশ্রাম নিয়েছেন সবেতেই একটা ডিজিটাল ঘড়ি ছিল যাতে তারিখ ও সাল লেখা ছিল। অথচ প্রথম ও শেষ ঘরের ঘড়ি অনুযায়ী মোটে দেড় মিনিট কেটেছে যা তাঁর ফ্ল্যাট থেকে রাস্তায় পৌঁছতে লাগে। তাও তিনি ইদানিং আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙ্গেন বলে। সিঁড়ি ভাঙ্গার অবসরে একটা ঘরে বসে এসব ভাবছিলেন। আগের সব ঘরের মত এঘরে ঘড়ি ও একটা ভালো আয়না রয়েছে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলেন। বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। জামা কাপড়ও একই রকম রয়েছে, মনে হয় সদ্য ঘর থেকে বেরিয়েছেন। যদিও হরিহর বিজ্ঞানের ছাত্র নন, কিন্তু বিজ্ঞানের বই, সায়েন্স ফিকশন নিয়মিত পড়েন। হঠাৎ তার মনে হল উনি একটা time warp এ পড়ে গেছেন যেখানে সময় একটি বৃত্তেই আবদ্ধ থাকে। তাই যদি হয় তাহলে এই time warp নিশ্চয় আছে বেশ দীর্ঘ সময় জুড়ে। রিলেটিভিটির তত্ত্ব অনুযায়ী এত দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে হবার কথা নয়। এর জন্য যে পরিমাণ এনার্জি দরকার তা দুটি ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে ভেসে আসা গ্র্যাভিটি ওয়েভ মেপেছেন। অনুমান করা হচ্ছে দুটি ব্ল্যাক হোলের সংর্ঘষে এর উৎপত্তি। কিন্তু এত দূর থেকে আসা অত্যন্ত ক্ষীণ এই ওয়েভ মাপতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। হরিহর বাবু ভাবলেন Everett এর বহু বিশ্বথিয়োরী হয়ত সত্য। কোয়ান্টাম তত্ব অনুযায়ী যে কোন বস্তু এখন হয়ত কোন স্থানে আছে, কিন্তু ভবিষ্যতে কোথায় থাকবে তা স্থির করে বলা যায় না। তবে যদি দেখবার চেষ্টা করি সেটি এই মুহূর্তে কোথায় আছে তাহলে অন্য কোন স্থানে সেটির থাকার সম্ভাবনা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। Everett সাহেব কিন্ত মনে করতেন প্রত্যেক সম্ভাবনাই এক একটা সমান্তরাল বিশ্বে ঘটে। অর্থাৎ হরিহর বাবু একটা বিশ্বে হয়ত সিঁড়ি ভাঙ্গছেন, অন্য একটা বিশ্বে হয়ত উনি কাশ্মীরে আছেন। আর একটা বিশ্বে হয়ত উনি জীবিত নেই। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোন উপায় বার করতে পারেন নি যাতে এক বিশ্ব থেকে আর বিশ্বে যাওয়া যায়। হরিহর বাবু মনস্থির করে ফেললেন যে এই রহস্যের শেষ জেনে ছাড়বেন। এই উদ্দেশ্যে শেষ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েই হরিহর সিঁড়ি ধরে নিচে রওনা দিলেন। কিন্তু কয়েক ধাপ নেমেই হঠাৎ একটা সিঁড়ি ফসকে আছাড় খেয়ে সিঁড়িতে গড়াতে শুরু করলেন। গড়াতে গড়াতে একটা ধাপে ওঁর মাথা ঠুকে গেল আর হরিহর জ্ঞান হারালেন।
৪
মাসের শেষ শনিবার কেবল অপারেটরের লোক গোবিন্দ মাসের টাকাটা নিতে আসে। প্রথমে সে হরিহর বাবুর কাছে টাকা নেয় তারপর দোতলা সর্বশেষে একতলা এই নিয়ম। আজ বৃষ্টি পড়ছিল বলে গোবিন্দ একটু দেরীতেই এসেছে। তিনতলায় উঠতে গিয়েই সে দেখল হরিহর বাবু উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। সিঁড়ির শেষ ভাগে মাথাটা রাখা৷ মাথার একপাশে চাপ চাপ রক্ত। এই দৃশ্য দেখে গোবিন্দ আঁতকে উঠল। সে ভাবল হরিহর বাবু মারা গেছেন। যদিও তার একটু আফসোস হচ্ছিল যে এ মাসের টাকাটা আর পাবে না। তবে গোবিন্দ লোকটা ভালো। গোবিন্দ আর দেরী না করে একতলায় ময়ুখ মল্লিকের ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল টিপল।
দরজা খুলে ওকে দেখে ময়ুখ বাবু বললেন, “দাঁড়াও তোমার টাকাটা আনি।”
“টাকা পরে দেবেন স্যার, একবার তেতলায় চলুন।”
গোবিন্দর কথা শুনে ময়ুখ বাবু অবাক হন। “কেন কি হয়েছে?”
“হরিহর বাবু বোধহয় মারা গেছেন স্যার!”
“কি বলছ তুমি! আজকে সকালেই কথা হল; আমার থেকে ইংরেজি কাগজটা নিয়ে গেলেন। বিজ্ঞানের একটা নতুন আবিষ্কারের উপর একটা লেখা আজ বেরিয়েছে; সেটা পড়বেন বলে। এর মধ্যে কি হল?”
কথা বলতে বলতেই দুজনে তিনতলায় পৌঁছলেন। ময়ুখ বাবুর সাথে হরিহর বাবুর খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও আলাপ ছিল। দুজনেই ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালবাসেন। এই নিয়ে ওঁনাদের মধ্যে আলোচনাও হত।
হরিহর বাবুকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ময়ুখ বাবুর মনে হল হয়ত গোবিন্দ ঠিক বলেছে, হরিহরবাবু হয়ত মারাই গেছেন। তবে কাছে গিয়ে দেখলেন এখনো নিঃশ্বাস পড়ছে! তাড়াতাড়ি হসপিটালে পাঠালে হয়ত বেঁচেও যেতে পারেন।
ময়ুখ বাবুর মোবাইলে দুটি অ্যাম্বুলেন্স সংস্থার ফোন নম্বর ছিল। প্রথমটি না পাওয়া গেলেও দ্বিতীয়টি পেতে কোন অসুবিধে হল না। কাছেই ওদের অফিস৷ দশ মিনিটের মাথায় অ্যাম্বুলেন্স এসে গেলো। ময়ুখ বাবু গোবিন্দকে জোর করেই ওনার সঙ্গী করলেন হাসপাতালে যাবার জন্য। বাইপাসের একটি হাসপাতালে হরিহর বাবুকে ভর্তি করা হল। এই হাসপাতালে ময়ুখবাবুর এক ভাগ্নে কাজ করে। নিউরোলজির ডাক্তার। নাম কনক কর্মকার।
৫
তিন দিন বাদে ময়ুখ বাবু হরিহর বাবুর সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে গেলেন। দুজন ডাক্তার ওনাকে দেখছেন।
অরিন্দম অধিকারী, নিউরোলজিস্ট আর মিলন মাইক্যাপ, হার্ট স্পেশালিস্ট। ডাঃ অধিকারী কনকের সিনিয়র।
আজকেই ICU থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে হরিহর বাবুকে শিফট করা হয়েছে। তবে বেশী কথা বলা বারণ। ময়ুখ বাবুকে দেখে হরিহরবাবু চিনতে পারলেন।
ময়ুখবাবু হরিহর বাবুকে বললেন, “সিঁড়িতে পড়ে গেলেন কি করে?”
“কিছুই মনে নেই।”
এরপর হরিহর বাবু যা বললেন তা শুনে ময়ুখ বাবু বেশ অবাক হয়ে গেলেন। হরিহর বাবু বললেন যে বাড়িতে গিয়ে উনি ময়ুখ বাবুর কিরীটির গল্পের বইটা ফেরৎ দেবেন। ময়ুখ বাবুর অবাক হওয়ার কারণ এই বইটা আট মাস আগে হরিহর বাবু পড়তে নিয়ে ছিলেন এবং ফেরতও দিয়েছেন। ময়ুখ বাবুর ভাগ্নে ওনার সঙ্গেই ছিলো। কনক বলল যে হরিহর বাবু বিপদ থেকে মুক্ত, তবে স্মৃতিশক্তি ফিরতে সময় লাগবে। কিন্তু কিছু দিনের স্মৃতি হয়ত কোন দিনই আর ফিরবে ন। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পরেই উনি প্রলাপের মত বার বার বলছিলেন
“বাবা কত সিঁড়ি কোন দিনই কি শেষ হবে না!”
তারপর আর কিছুই বলতে পারছেন না।
“মামা তুমি কি এই সিঁড়ির ব্যাপারে কিছু জানো?”
ময়ুখবাবু এই কথা শুনে হঠাত কিরকম হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ কনকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। শেষে বলে উঠলেন,
“না তা জানিনা তবে মনে হয় গত আট মাসের স্মৃতি উনি অদূর ভবিষ্যতেও ফেরত পাবেন না।”
“তুমি কি করে জানলে? স্যারও এরকম আন্দাজ করছেন।”
“কনক বল তো আট মাসে কতগুলো সিঁড়ি ভাঙ্গা যায়?”
ময়ুখ বাবুর প্রশ্ন শুনে কনক অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। কনকের এই হতবাক অবস্থা দেখে ময়ুখ বাবু বললেন,
“ভেবে দেখিস।” বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি ডেকে সটান বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
ওর নিজের সিঁড়ি ভাঙার অঙ্কটাও যে মেলানো বাকি আছে, সেটা এতদিন ওর মনেই পড়েনি!
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, রাজকুমার রায়চৌধুরী, সিঁড়ি, সুপ্রিয় দাস
Sniri bhanga onko – chomotkar