স্মৃতিপথের নির্মাল্য
লেখক: কল্পবিশ্ব
শিল্পী:
বইপোকা ও সাহিত্য সরণি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়ের অকাল প্রয়াণে আমরা শোকস্তব্ধ। আদ্যন্ত বইপাগল এক তরতাজা প্রাণ এভাবে সকলকে ছেড়ে চলে যেতে পারে এ সত্যিই অকল্পনীয়। আমরা কল্পবিশ্বের তৃতীয় সংখ্যা নির্মাল্যর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করছি।
কিছু স্মৃতিচারণা, কিছু অনুভুতি
১) যে সময়ে বাংলা বই ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র বইকে ভালোবেসে ভার্চুয়াল মাধ্যমে পাঠকদের একত্রিত করার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছিল নির্মাল্য। একটা সুন্দর, মনোজ্ঞ সাহিত্যমহল উপহার দিয়ে একেবারেই অকস্মাৎ সে চলে গেল, কিন্তু রেখে গেল পাঠ ক-লেখক সমাগমের পথ। বোধহয়ওর জানা ছিল সময় খুবই কম ওর জন্য তাই পড়ে ফেলতে চেয়েছিল সাহিত্যের সব মণিমুক্ত। নিমুর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য জগৎ হারাল তার এক মনোযোগী পাঠককে, যা অপূরনীয় ক্ষতি। কিন্তু নির্মাল্যরা চলে যায় না, তারা থেকে যায় পাঠক হৃদয়ে।
যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস নিমু…
~ অরিন্দম ব্যানার্জী (কসবা)
২) “তুমি চলে গেছ দূরে
শুধু পরিচয়টুকু রাখি”::::
আজ লিখতে বসে হেমন্তবাবুর এই গানটাই মনে পড়ল। নির্মাল্য আমার বন্ধু-ভাই অত্যন্ত কাছের। কিন্তু মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ ওকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল চিরদিনের জন্য। এখন শুধু পরিচয়টুকুই রইল। নির্মাল্য বা আমার আদরের নিমু একটি সাধারণ নির্বিরোধী ছেলে। কিন্তু ও একটা আলোড়নের নাম। এত অল্প বয়সেই সে ‘বইপোকা’র মতো একটি গ্রুপ স্থাপন করেছিল যা আজ বাংলা সাহিত্যাকাশে আলোড়ন তুলে চলেছে নিয়ত। আমরাও সেই নিয়ত তরঙ্গের সাক্ষী।
আমাদের কাছের নিমু নেই। ওর স্বপ্ন শেষ হবে না। কারণ আমরা শপথ নিয়েছিলাম—“এ পোকা মরবে না”।
~ অরিন্দম চক্রবর্তী (নৈহাটি)
৩) “ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বই পাগল বাঙালি পাঠকদের এক ছাতার তলায় আনার চিন্তা ভাবনা নির্মাল্য দা’র আগে কেউ করেছে বলে চোখে পড়েনি। যখন ‘বাংলা বই’এর পাঠক সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বলে সমালোচনা করা হচ্ছে, তখন নিঃশব্দে নির্মাল্য দা’র পতাকা তলে আমরা, সাধারণ পাঠকেরা ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছি। নির্মাল্য দা’র প্রশ্রয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে বই নিয়ে আলোচনা করেছি, তর্ক করেছি, নিজের পড়া বইগুলোর সম্পর্কে অন্যদের জানিয়েছি এবং এতে কোনও না কোনও ভাবে আমরা সবাই লাভবান হয়েছি। নির্মাল্য দা’র চলে যাওয়ায় কেউ লিখবে না- ‘বাংলা সাহিত্যে ইন্দ্রপতন’, কিন্তু আমরা… তাঁর কাছের লোকেরাই একমাত্র জানি আমরা কি হারালাম। আশা রাখি ভবিষ্যতে নির্মাল্য দা’র কাজের গুরুত্বটা সবাই বুঝতে পারবে।”
~ অর্পণ বক্সী (খড়দহ)
৪) প্রিয় নির্মাল্য,
“শ্রাবণের ধারার মতো পরুক ঝড়ে”
খুব দরকার ছিল কি নির্মাল্য এই গানটাকে এতটা সিরিয়াসলি নেওয়ার!
কি দিয়ে শুরু করব জানি না। কবে তোকে আপন করেছি সেই দিনক্ষণ কিছুই আজ আর স্মরণে নেই। কিন্তু আজ বলা হয়েছে তোকে আলাদা করে কিছু লিখে স্মরণ করতে। তুই একটা জবাব দে তো… কেন ? স্মরণ করব তোকে? তোর বাড়ি গেলাম প্রথমবার কাউকে চিনি না তবু, কোন কথা বললি না শুধু ঘুমিয়ে রইলি। একবারও পিডি বলে ডাকলি না। জানিস খবরটা শোনার পর কোন এক শক্তি আমায় দিয়ে কাজটা করিয়ে নিল, মানে তোর বাড়ি যাওয়ার কথা বলছি। যখন সেই অনেক ঝড়ঝাপটা হলো আমাদের বন্ধুত্বে একটা দ’ পড়ল, মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম একে অপরের থেকে, জানি তোর দুঃখ হয়েছিল, আমারও হয়েছিল অভিমান। কিন্তু কি জানিস তো আমাদের এই বন্ধুত্ব যেন এক বিনিসুতোর মালা, সেই জোড় ছিল বলেই হয়তো আমরা দুজনেই শত দুঃখ পেয়েও প্রকাশ্যে একে অপরের সম্বন্ধে কোনদিন মন্দ কথা বলিনি, শুধু একটু দূরে সরে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কি হল রে তোর, তুই এত অভিমান দেখিয়ে সেই বন্ধুত্বের সুতো কেটে পালিয়ে গেলি! তুই তো চলে গেলি কিন্তু যাদের ফেলে গেলি তাদের জন্য তোর হৃদয় কাঁদলো না! অনেক অভিযোগ তোর বিরুদ্ধে, অনেক কথা বাকি রয়ে গেল। এতক্ষণ যা বললাম প্রচণ্ড কষ্টে বললাম রে নিমু।
ভালো থাকিস এবং অনেক আদর।
ইতি প্রবুদ্ধ (পিডি)
~ প্রবুদ্ধ (ল্যান্সডাউন)
৫) “তোকে খুব মনে পড়ছে”
সত্যি আজ তোকে খুব মনে পড়ছে রে নিমু। নির্মাল্য চ্যাটার্জী, বইপোকার সৃষ্টিকর্তা, আমার ভাই নিমু, আজ অনেকটা দূরে চলে গেছিস। নিমু এমনই একজন যার হাত ধরে কুড়ি হাজার মানুষ এক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে। বইপাগল আমার এই ভাই ছিল যেমন অমায়িক তেমনই সরল, স্বচ্ছ এক মানুষ। নিমু তুই ছিলিস আর সবসময় থাকবি বইপোকাদের মনের মণিকোঠায়…. ভালো থাকিস ভাই।
~ ঋচা দত্ত ঘোষ (বেহালা)
৬) স্মৃতিচারণা বিষয়টা যে কি সেটা ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় চলে গেল। প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলার ফাঁকে সময় পেলে যখন পিছনে ফিরে তাকাই, চোখে পড়ে একরাশ হাতছানি।
“ঋজু, বড্ড অভিমান করিস তুই ..বড় আর কবে হবি!” এখনো যেন শুনতে পাচ্ছি গলাটা … বড় হয়ে গেছি নির্মাল্যদা ..ভালো করে চেয়ে দেখো …তাইতো চোখের জল আর ফেলি নি ….নিষ্ঠুর পরিহাস বলেই মেনে নিয়েছি।
ফেসবুকীয় দুনিয়ায় আজ আমরা যেটুকু লেখালিখি করতে পারি, সেই মঞ্চটা তৈরী করার পেছনে তোমার অবদানের কথা বলে বিষয়টাকে লঘু করবো না, বরং বলবো এসবের আড়ালে চোখে পড়তো মিশুকে, সরল, প্রাণবন্ত একটি বইপ্রেমীকে …..সবাইকে কাছে টেনে নেওয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিলো যার … অগাধ স্বপ্ন দেখতে যে ভালোবাসতো।
ঈশ্বর বলে যদি কিছু থাকেন তাহলে তার কাছে এটাই প্রার্থনা করবো, তিনি যেন তোমায় ভালো রাখেন। আমরা তোমার পাশে ছিলাম, আছি, থাকবো ও।
~ ঋজু পাল (খড়গপুর)
৭) নাম না জানা কোন একজন আমাকে প্রথম বইপোকাতে নিয়ে এসেছিল। সময়টা বোধ করি ২০১৩-র শেষের দিকে। আর এসেই যার প্রবল উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম, সে হল ছোটখাটো চেহারার একটি ছেলে, মানে নির্মাল্যের। অতুল দূরদর্শী তার পদক্ষেপ যেন বদলেই দিল আমাদের বই পড়ার আঙ্গিককে। খুব স্বল্প সংলাপে জেনেছিলাম ওর বই প্রীতির কথা। আজ ও স্থূলদেহে হয়তো নেই কিন্তু সূক্ষ্মদেহে ওর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে আমরা টের পাবো। সর্বশক্তিমানের রাতুল চরণে যেন শান্তি পায় নির্মাল্যের আত্মা।।
~ রুদ্র সেন (যোধপুর পার্ক)
৮) নিমু মানে নির্মাল্যকে নিয়ে লিখতে বসেছি। কিন্তু কি লিখব! আমার কলমটাও কি আজ চেতনা পেয়েছে? সেও যেন নড়তে চাইছে না সাদা পাতায়। কিভাবে আলাপ লিখব নাকি কিভাবে বুক দিয়ে এই সুবৃহৎ একটা গ্রুপ সামলাত সেটা লিখব? বইয়ের পোকা ছিল। বই পড়তো না গোগ্রাসে খেত। একবার আড্ডা মারতে মারতে বলেছিল ওর একটা বিশাল পাঠাগার করার ইচ্ছে আছে যেখানে কোন বিধিনিষেধ থাকবে না। বই পড়বে লোকে মনের আনন্দে, সেখানে নিয়মের বেড়া থাকবে কেন? শুধু মনে পড়ছে এই বছরের সবকটা পূজাবার্ষিকীর অ্যাডভান্স অর্ডার দিয়ে রেখেছিল আর বলেছিল ‘দেখো সব কটার প্রথম রিভিউ আমি দেবো”। প্রবুদ্ধ আমাকে নির্মাল্যকে লিখতে বলেছিল ওর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। আমি লিখলাম নিমুকে নিয়েই, এটা আমাদের কথা হিসেবেই থাক। নির্মাল্য কোনদিন স্মৃতি হবে না আমাদের কাছে। ও ছিল, এখনও আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে। থাকবে বইপোকা, বইপোকার কলম, সাহিত্য সরণী আর থাকবে নির্মাল্য চ্যাটার্জি।
~ সৌম্য চক্রবর্তী (বারুইপুর)
৯) নির্মাল্যদা মানে নিমুদার সাথে আমার আলাপ বছর দুয়েক আগে। একটি পত্রিকা সংক্রান্ত দরকারে নিজেই একদিন মেসেজ করেছিলাম। তারপর থেকে প্রায়শই কথা হতো। নিত্য নতুন বই, পত্রিকা এবং লেখকদের কথা দাদা আমাকে বলতেন। নানান বইয়ের খোঁজ দিতেন। বলা যেতে পারে দাদার সাথে আলাপ হওয়ার পরেই বই পড়ার নেশাটা আরো বেশি মাত্রায় আমাকে পেয়ে বসে। শুধু কি তাই? যখন চুপি চুপি অন্যদের লেখা পড়তাম আর দাদাকে বলতাম “সত্যি নিমুদা এরা কি সুন্দর লেখে!” তখন দাদা আমাকে বলত “তুইও তো লিখলে পারিস।” আমি ভয় পেতাম। কলেজের সায়েন্স টিমের মেম্বার হওয়ার জন্য আমার লেখার দৌড় ঐ স্কুল কলেজ পাড়ার ম্যাগাজিন অবধিই ছিল। শুধুমাত্র দাদার দেওয়া উৎসাহে আমি লিখতে শুরু করলাম। প্রায়ই দাদা আমাকে বলত “কিরে নতুন কি লিখলি!” এভাবে আস্তে আস্তে কবে যে দাদা আমার অনেকটা বড় জায়গা নিয়ে নিয়েছিল তা আজ আর সঠিক ভাবে মনে করতে পারি না। “ও দাদা ম্যাগাজিনের কভারটা দেখো না! কাউকে দিয়ে ভালো করে আঁকিয়ে দাও না!” ব্যস! একদিনের মধ্যে ‘আর্টিস্ট’ ঠিক করে দিল। “ও দাদা! তোমাদের গ্রুপ মিট তো আড়াইটে থেকে। কিন্তু আমার কাজ ছিল বলে আমি এখনি চলে এসেছি। রোদে বেশিক্ষণ একা একা দাঁড়াতে পারছি না। তোমরা এখুনি নন্দনে এসো”.,.. সময়ের ঘন্টাখানেক আগেই নিমুদা স্নিগ্ধাদিরা চলে এল। এরকম আবদারগুলো করার মতো মানুষটা নেই ভাবতেও পারছি না। সেদিন বলল “পক্স হয়েছে, সামান্য জ্বর্।” ভাবিনি খুব একটা। ভুলেই গেছিলাম যে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত মানুষের কাছে সামান্য শরীর খারাপও ভয়ঙ্কর্। অথচ কি আশ্চর্য! এতদিন কথা হয় অথচ একবারের জন্যও জানতে দেয়নি যে দাদা থ্যালাসেমিক। শুধু ভেবে গেছে অন্যকে কিভাবে কতটা সাহায্য করা যায়, তার পাশে থাকা যায়, অনুপ্রেরণা দেওয়া যায়। জীবনের চরম দুঃসময়ের দিনগুলোতে পাশে থেকেছে মানুষটা। সব রকম মানসিক ঘাত প্রতিঘাতগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আরো কত কিছু তা বলতে গেলে এই পোস্টের কমেন্ট লেখার জায়গা শেষ হবে, শেষ হবে বলার জন্য উপযুক্ত ভাষা; তবু বলা শেষ হবে না। এরকমই ‘বিস্ময়’ ছিলেন সদাহাস্যময় এই বইপাগল দাদাটি।
~ সোহিনী দেব রায় (ব্যারাকপুর)
১০) নিমু নট-আউট
বইপোকার শুরুর দিকে তখন। “অনেকের গল্প” ইভেন্ট নিয়ে কথা হচ্ছে – অদিতি, সৌম্য, বুয়ান সবাই মিলে ঠিক করলাম গ্রুপের অ্যাডমিনকে বললে কেমন হয় এইরকম একটা ইভেন্ট নিয়ে? পিং করলাম নির্মাল্যকে। সেই শুরু।
তারপর ইভেন্ট, আমাদের চ্যাটগ্রু প, শুভি, শুভ, অরিনদা, বুয়ান,পোলো, অডি, সৌম্য, সুমনা। দিন নেই, রাত নেই, বকবক চলছেই। এভাবেই কবে যে নির্মাল্য “অ্যাডমিন” থেকে আমাদের ভাই নিমু হয়ে উঠল, সত্যি জানতেও পারলাম না।
প্রথম সামনা সামনি দেখা বইমেলা ২০১৫। জমিয়ে কিন্তু আমরা পোস্টার লাগিয়েছিলাম বইপোকার। মনে আছে তোর? তারপর সেই স্বপ্নময়বাবুর অনুগল্প সমগ্র?
সেই বাচ্চাছেলেটা আজ আমাদের সব্বাইকে ছেড়ে অনেক দূরের পথে, এটা ভাবতে পারছি না জাস্ট! কিচ্ছু গুছিয়ে লিখতে পারছি না। কি লিখব বলতো তোকে নিয়ে? এইসময়।
তুই যেতে পারিস না ভাই, তুই যাসনি কোত্থাও। আমরা সবাই হেরে গেছি তোর কাছে। দেখ, সব্বাই এখন আবার একসাথে বইপোকাতে। তুই সব্বাইকে এক করে দিয়েছিস। পেরেছিস তুই। আমরা কিন্তু অনেক চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি কখনো। এভাবে সব্বাইকে বুকে আঁকড়ে ধরার পড়েও তুই আজ ক্রীজ ছেড়ে চলে যেতে পারিস না।
তুই নটআউট। তুই নটআউট নিমু।
~ সৌমিক বিশ্বাস (হাওড়া)
১১) পাঠক-রাজ
ডাইনিং টেবিল বা পাড়ার মোড় এ দেখি আমরা অনেককেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বুলি ওড়ায়, “বাংলা সাহিত্যে কিসু নেই আর, কেও আজকাল ভালো লিখেই না।” আবার আপনি ওই লোকটিকে যদি জিজ্ঞেস করেন, দাদা, আপনি সমসাময়িককালের কার কার লেখা পড়েছেন বলুন তো? তখন আপনি উত্তর পাবেন, “ওই পড়েছি শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ অব্দি!”
বুঝুন কান্ড! এরাও কিনা সাহিত্য চর্চা করে।
তার মানে এটা দাঁড়াল বাংলা সাহিত্যে কবি আছে, লেখক আছে, কিন্তু পাঠক নেই।
দক্ষিণ কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়ের জীবনটাই ছিল এই জায়গাটা পূরণ করার জন্য। নির্মাল্যের জন্যই আজ বলা চলে পাঠকরা বেশ কিছুটা হলেও জায়গা পেয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
ফেসবুকের কক্ষে বইপোকা ও সাহিত্য সরণীর মতো দুটো উল্লেখযোগ্য গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নির্মাল্য। গ্রুপদুটির সম্মিলিত সদস্য সংখ্যা পচিশ হাজার। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ও প্রবাসের হাজার হাজার বাঙালী অবাঙালীর নির্মল একটি বইয়ের ঠেক গ্রুপ দুটি। আমার অসীম সৌভাগ্য নির্মাল্য বইপোকা গঠন করেই এই সূদুর ত্রিপুরার দাদাটিকে এডমিন বানিয়ে দিয়েছিল।
নির্মাল্যের মূল উদ্দেশ্যই ছিল পাঠক আর লেখক সম্মিলিত করানো। বাণিজ্যে স্নাতক মেধাবী ছেলেটির ২৬ বছরের জীবনটি পদে পদে স্বার্থক। ভাবনার কোন অঙ্গে ও ভাবিনি নির্মাল্য এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু জীবন তো এমনই। আমাদের মানতে হবে। আশা করবো সেই কল্পলোকেও বই নিয়ে বাস করবে নির্মাল্য, সুখে থাকিস ভাই। নির্মাল্যর স্বপ্নগুলোকে বাস্তব করার দায়িত্ব আমাদের। অটুট থাকবে পাঠক-রাজ।
~ শুভ চৌধুরী (আগরতলা)
১২) তোর সম্পর্কে পাঁচ-ছ লাইনে কি লিখি বলত নিমু? কত কথাই মনে পড়ছে. . ‘আত্মীয়’ বলতেই মনে আসে রক্ত সম্বন্ধীয় কাউকে …. কিন্তু জীবন তো আমায় শেখাল আত্মীয় তারাই যারা আত্মার সমব্যাথী – এই যেমন তুই, ঋচাদি, ঋজু, স্নিগ্ধা, নিলু এরম আরো গুটিকয়েকজন।
বইপাগল নিমুকে তো সবাই চেনে? আর মানুষ নিমু? এত কম বয়সে এত পরিণত, পরোপকারী, সরল এবং দায়িত্ববান মানুষ খুব কম হয়। সে সবাইকে নিয়ে চলতে চায়…. সে এই খুনসুটি করে জ্বালিয়ে মারে তো তার পরক্ষণেই কোন উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখলে রসবোধের জল ছিটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আনে তো তারপরই কেউ কোন সাহায্য চাইলে তার পাশে দাঁড়ায়! বিশ্বাস কর নিমু ভাবতেই পারছি না তুই দিনের মধ্যে একবারও জিজ্ঞাসা করবি না “সুচিদি শরীর কেমন আছে?” ভাইফোঁটায় ফোন করবি না …. আমি আর ঋজু রাগারাগি করলে থামাতে আসবি না …. স্নিগ্ধাকে জ্বালিয়ে মারবি না …. এমন কত কিছুই করবি না!
অকারণে হয়ত তোকে অনেক দুঃখ দিয়েছি। ক্ষমা করিস। অনেক বই পড়া, বইয়ের আলোচনা, আড্ডা, খুনসুটি বাকি রইল। সুযোগ পেলে আর ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে দেব না কিন্তু। পাক্কা প্রমিস রইল।
~ সুচরিতা দত্ত (হাওড়া)
১৩) ‘নিমু দা’
২০১৩ সালে ফেসবুকে নির্মাল্য চট্ট্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ। আলাপচারিতায় সেতুবন্ধনের কাজ করেছিল দুজনের গভীর গ্রন্থপ্রেম। পরবর্তী তিন বছরে সেই আলাপ ঘনীভূত হয়েছে। নির্মাল্যদা হয়ে উঠেছে খুব কাছের মানুষ নিমুদা। ফেসবুকের সেরা বাংলা বই সংক্রান্ত গ্রুপ বইপোকা জন্ম থেকেই একসঙ্গে কাজ করেছি, মেতে উঠেছি সাহিত্যভিত্তিক তর্ক বিতর্কে। কখনও হাসি ঠাট্টায়ে ফেটে পড়েছি, কখনও ঝগড়াও হয়েছে। মতান্তর হয়েছে একাধিকবার মনান্তর হয়নি। শান্ত সরল বই অন্ত প্রাণ নিমুদা যে এত তাড়াতাড়ি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে তা কল্পনার অতীত। ২৬ বছর বয়েস মাত্র। আরও কত পথ হাঁটা বাকি ছিল। মন থেকে মেনে নেওয়া যাচ্ছেনা, কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন।
তুমি এখন দূরের কোন দেশে রয়েছ তা জানি না। যেখানেই থাকো, ভাল থেকো নিমুদা।
~ সুমন দলুই (হাওড়া)
১৪) নীল, কি গো … তুমি তো আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারো না … কাল চুপ করে শুয়ে রইলে ..কত করে ডাকলাম একবারও ফিরে তাকালেন … তুমি কি রাগ করেছো সোনা? আমি কত কী বললাম তোমায়, না দেখেই ঘুমিয়ে পড়লে! আমি জানি তুমি ঠিক পাশে বসে দেখছ আর ভাবছ কুড়ে ভতকুটা তোমায় ছোট্ট চিরকুট না দিয়ে কি সব লিখছে … না গো কিই বা লিখবো আর..তোমার সাথে অনেক কথা বাকি রয়ে গেল। খুব ইচ্ছে ছিল নিজে তোমার যত্ন করব … কিছুই হল না। আমার একটা কথা রাখ …. যেভাবেই হোক তুমি আমার জীবনে ফিরে এস … আমি যেন চিনতে পারি তোমায়, আমি তোমায় স্বার্থপরের মতই একান্তভাবে চাইলাম ।।
~ সুমনা চক্রবর্তী (ভবানীপুর)
১৫) নির্মাল্য সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি জানি
একটা ছেলে পরপর পূজাবার্ষিকী কিনে রাখছে পড়বে বলে। শুনলাম আনন্দমেলায় গোগোলের কমিক্সটা ওর পছন্দ হয়নি। আজকাল পুজোসংখ্যাগুলো এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়, এটা তার অপছন্দ ছিল। তবু সে পড়া থামায়নি, তার ঘরে অনেক অনেক বই বর্ষার ঠান্ডা দুপুরে একটা চশমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। অনেক অনেক বই অপেক্ষায় থাকতো একটা ছেলে মেট্রো থেকে নেমে এসে ওদের পড়বে বলে। এমনিতে বড়ো বড়ো চোখের রোগা ছেলেটা ফেসবুকে চ্যাংড়ামো করার বদলে স্বপ্ন দেখতো সব বদলে দিতে হবে বলে। ছেলেটা ছিল অভিমানী, ছেলেটা খুব মিশুকেও তো ছিল। আমরা যখন নিজেদের দোহাই দিয়ে অন্যদের পরোয়া করতাম না, ঐ ছেলেটা মাঝরাতে পরীক্ষার পড়া করতে করতে নিয়মগুলো নতুন করে লিখতো। বিরিয়ানী খেতে ভালোবাসতো, একটা মিষ্টি মেয়েকে ভালোবাসতো ছেলেটা। তারপরে তো চলেই গেল। অভিমান করে নাকী নতুন বন্ধুদের সাথে মিশতে চলে গেল আমি জানি না। বইগুলোর মনখারাপ। মেট্রোয় চেপে সেই বন্ধুটা আসবে না আর!
~ শুভার্থী শোভন মোহান্তী (বেলদা)
১৬) ছেলেটার সাথে প্রথম আলাপ ফেসবুকসূত্রেই বছরখানেক আগে। সাহিত্য সরণী গ্রুপে আমার এক রিভিউ প্রসঙ্গে ম্যাসেজ করে আর সেই থেকেই বন্ধুত্ব। তখনো জানতাম না আমাদের পাশের পাড়াতেই ওর বাস… শুধু জানতাম এক পাগলকরা খিদে আছে বই সম্পর্কে ওর মধ্যে আর আছে অনেকজনকে নিয়ে পথচলার এক নিরলস প্রয়াস, যার ফল সাহিত্য সরণী আর বইপোকা গ্রুপদ্বয়।
প্রথম সামনে দেখি কুদঁঘাট স্টেশানে, শীর্ণদেহে কালো এক ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছে ব্যাণার্জিপাড়ার বাড়ির পথে…. ঠিক হয় একদিন জমিয়ে আড্ডা হবে সামনাসামনি। প্রায় রোজই মুখমুখি দেখা হত, যদিও আড্ডা আর হয়ে উঠছিল না…. আর হওয়ার সুযোগও নেই।
সে যে আর দেখা দেবেনা রোজ বিকেলে বাড়ির পথে, কোথায় পাব তাকে???
ভাল থেকো বন্ধু। অনেক কিছু হারালাম তোমাকে হারিয়ে
~ নীলাভ ভাওয়াল (টলিগঞ্জ)
Tags: কল্পবিশ্ব, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, স্মৃতিচারণ, স্মৃতিপথের নির্মাল্য