হারানো হ্যালোইন (একটি ফ্যান ফিকশন)
লেখক: সুপ্রিয় দাস
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এল। হাইওয়ের ধার দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পাশ দিয়ে প্রবল গতিতে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি গুলোর আলোয় মাঝে মাঝেই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে অর্কর। অক্টোবরের শেষ। বেশ কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে ম্যাসাচুসেটস-এ – তার ওপর মাউন্ট গ্রেলকের কাছাকাছি বলে এই জায়গাটায় ঠান্ডা আরো বেশি।
আজ প্রায় সাত মাস হল আমেরিকার বস্টন শহরে কাজের সূত্রে এসে রয়েছে অর্ক। এই ক’মাস কাজের চাপে মাথা তোলার ফুরসত পায় নি সে। এদিকে শীতকাল প্রায় দোরগোড়ায় চলে এসেছে। তাই এই সময়ে একটা উইক-এন্ডের সাথে আরো দু’দিন বাড়তি ছুটি নিয়ে এই মাউন্ট গ্রেলক অঞ্চলে হাইকিং-এ এসেছিল সে আর ডেক্সটার। ডেক্সটার তার অফিসের সহকর্মী। এই ক’মাসে এই ছেলেটির সাথেই তার সব চেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তার বাড়িও বস্টনে নয় নেভাদায়। সেও এদিকে নতুন অর্কের মতই। তাই দুজনে মিলে প্ল্যান করে বেড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু গতকাল রাতে হল বিপত্তি। গত তিন দিন তারা দিনের বেলাটা হাইকিং করে ঘুরে বেরিয়েছে মাউন্ট গ্রেলকের আশেপাশে। জায়গাটা অস্বাভাবিক রকমের নির্জন ও পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা। যদিও এই পাহাড় বা জঙ্গলে সেরকম বড় বন্য জন্তু জানোয়ার নেই। কিন্তু সেই না থাকাটাই হয়েছিল বিপদের কারন। আজ বেলার দিকে ডেক্সটার ক্যাম্প থেকে একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসার জন্য বেরিয়েছিল। অর্ক তখন খাবারের যোগাড়ে ব্যস্ত থাকায় সে আর সঙ্গে যায়নি। ডেক্সটার বলেছিল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরবে। কিন্তু প্রায় চার ঘন্টা পরেও ডেক্সটার ফিরল না। এদিকে বেলা প্রায় পড়ে আসায় অর্ক চিন্তায় পড়ে গেছিল – ভাবছিল ডেক্সটারের মোবাইলে ফোন করবে কিনা। এমন সময়ে তার মোবাইলটা বেজে ওঠে। ডেক্সটারের ফোন! নিশ্চই ব্যাটা রাস্তা হারিয়েছে এই ভেবে অর্ক ফোনটা রিসিভ করেছিল। কিন্তু ওদিক থেকে যা শুনল তা অর্ক আশা করে নি। ডেক্সটার বলেছিল, পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে সে নিচের উপত্যকা দিয়ে চলে যাওয়া হাই-ওয়ের ধারে পৌঁছে গেছিল। ঠিক সেই সময়ে ঘটে গেছে একটা দুর্ঘটনা। একটা আলগা পাথরে পা হড়কে সে হাইওয়ের ধারে একটা অগভীর খাদে গড়িয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়। ভাগ্যিস হাইওয়েতে পেট্রোলিং পুলিশের একটা গাড়ি তাকে পড়ে থাকতে দেখে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল, তাই এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছে সে। জ্ঞান হতেই সে ফোন করেছে অর্ককে। তার চোট খুব গুরুতর নয়, তবে পা মচকে কয়েকদিনের জন্য চলাফেরা বন্ধ। সে রয়েছে এখন অর্কর ক্যাম্প থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে নর্থ অ্যাডামস শহরে।
এই খবর পেতেই অর্ক বেরিয়ে পড়ে। ক্যাম্প ফেলে রেখেই যেতে হল। যদিও নাইলনের ছোট তাঁবুটা ছাড়া বাকি সব জিনিসপত্র তার হ্যাভারস্যাকে এঁটে গেছে। তাঁবুটা গুটিয়ে একটা পাথরের খাঁজে রেখে এসেছে। যদি সম্ভব হয় পরে ওটার ব্যবস্থা হবে। হাইওয়ে তে এসে নর্থ অ্যাডামসের দিকে যাওয়া একটা ট্রাকে লিফট নিয়ে এই সবে ট্রাক থেকে নেমেছে। ট্রাকের চালক বলেছিল শহরটা আরো মাইল পাঁচেক দূরে। এখান থেকে সে অন্যদিকে যাবে। সে যদিও বলেছিল যে এখান থেকে স্বচ্ছন্দে অন্য গাড়িতে লিফট পাওয়া যাবে কিন্তু অর্কর আর গাড়িতে চাপতে ইচ্ছে করে নি। পাঁচ মাইল পথ হাঁটা তার কাছে খুব একটা কিছু নয়। যদিও এই জায়গাটা অর্ক একেবারেই চেনে না। তবে হাইওয়ে বরাবর পাশ দিয়ে হাঁটা যখন, তখন পথ হারানোর ভয় নেই। আর এই এখানটা অতটা জঙ্গুলে নয় বলে, জন্তু জানোয়ারের সামনাসামনি হওয়ার সম্ভবনাও নেই।
সেই থেকে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে চলেছে অর্ক কিন্তু শহরের নামগন্ধও এখনো চোখে পড়ল না।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে এল; হাইওয়েতে গাড়ির আনাগোনাও প্রায় আর চোখে পড়ছে না।প্রমাদ গুনল অর্ক। সে ঠিক দিকে যাচ্ছেতো? ট্রাক ড্রাইভার ভুল রাস্তা বাতলে দিলো নাকি? এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল। যাই হোক, আসার পথে শেষ মাথা গোঁজার মত জায়গা কম করে পঁচিশ মাইল পেছনে ফেলে আসা একটা মোটেল। কাজেই পেছন ফিরে যাওয়ার মানে হয় না। মনে মনে ঠিক করে ফেলে অর্ক। ঝোঁকের বশে হঠকারিতা করে ফেলেছে কিন্তু আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। একটা গাড়ি পেলে লিফট চাইতে হবে। রাস্তা হারিয়ে ফেলে থাকলে এই ঠাণ্ডা রাত্রে আর ঠিক দিকে যাবার চেষ্টা করা উচিত হবে না। আশে পাশে যেখানে একটা মাথা গোঁজার যায়গা পাওয়া যায় সেখানেই রাতটা কাটাতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল হাইওয়েটা হঠাত কেমন যেন নির্জন হয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা এসে জড়ো হচ্ছে চারপাশে। আর হয়ত তার জন্যই আর একটাও গাড়ির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
এই রকম পরিস্থিতিতে অর্ক ঠিক করল যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। যদি গাড়ি ধরতেই হয় তাহলে আর এগিয়ে কি লাভ? চার দিকের কুয়াশা এতক্ষনে জমাট বেঁধে অর্কর চার দিকে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এরকম কুয়াশা অর্ক আগে কোনদিন দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। ঘড়িতে প্রায় রাত আটটা বাজে। নাহ! গাড়ির দেখা আর মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। হ্যাভারস্যাক পিঠে তুলে নিয়ে অর্ক হাঁটার উপক্রম করছে এমন সময়ে কানে এল একটা ইঞ্জিনের শব্দ। তাড়াতাড়ি পিছনে ফিরে তাকালো অর্ক। কুয়াশা ভেদ করে কিছুদুরে একজোড়া হাল্কা আলোর বিন্দু ফুটে উঠে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হ্যাভারস্যাক মাটিতে ফেলে দৌড়ে রাস্তার একদম ধারে পৌঁছে প্রবল ভাবে হাত নেড়ে আর চিৎকার করে আগুয়ান গাড়ির চালকের দৃষ্টি আকর্ষন করবার চেষ্টা করতে থাকে অর্ক। গাড়িটা সামনে এসে গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এবার গাড়িটা ভালো করে দেখতে পেল সে। এরকম গাড়ি সে আগে কখনো দেখে নি। বহু পুরনো সাদাকালো সিনেমাতে এরকম গাড়ি দেখে থাকবে বলে মনে হল তার। গাড়ির জানালায় মুখ বাড়িয়ে গাড়ির চালককে দেখা গেল। কালো সুট ও মাথায় গলফ ক্যাপ পড়া একজন লম্বাটে গড়নের লোক বড় বড় অনুসন্ধিৎসু চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
অর্কই প্রথম কথা শুরু করল। লোকটাকে সমস্ত পরিস্থিতিটা বোঝাতে কয়েক মিনিট সময় লাগল। সব শুনে সে ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত মিহি অথচ গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
-“নর্থ অ্যাডামস! সেরকম নামে কোন শহর ত আশেপাশে আছে বলে শুনি নি। যাই হোক আজকে রাতের মত মাথা গোঁজার জায়গা চাইলে আমার সাথে আসতে পারো। আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে জায়গা পেয়ে যাবে। বেশি দূরেও নয়। এখান থেকে মাত্র আর আধঘন্টার রাস্তা।“
অর্ক আর কি করে। এই পাওয়া গেছে তার ভাগ্য ভালো বলেই। অচেনা এই পান্ডববর্জিত জায়গায় পথ হারিয়ে যখন ফেলেইছে তখন আজ রাতে ক্লান্ত শরীরে আর কিই বা করতে পারবে। কাল সকালে আশা করা যায় নর্থ অ্যাডামস পৌঁছনোর একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তাই সে আর বেশি কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। অর্ক এতক্ষনে লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল। লোকটার পরনে একটা বেশ পুরনো কালো কোট-প্যান্ট। লম্বাটে শীর্ণ গড়ন। লম্বা মুখ, পাতলা ঠোট আর বড় বড় উজ্জ্বল চোখ নিষ্পলক ভাবে আধো অন্ধকার রাস্তায় স্থির। কথাবার্তা বলার খুব একটা উৎসাহ লোকটা দেখালো না। তাই অর্কই বাধ্য হয়ে কথপোকথন শুরু করল।
-“আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গাটার নাম কি?”
-“আর্কহ্যাম।“ জবাব দিল লোকটা।
নাহ নাম শোনে নি অর্ক; যাই হোক লোকটা আবার চুপ করে গেছে। অর্ক এবার তাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। লোকটা সব প্রশ্নেরই এক-দু কথায় উত্তর দিয়ে চুপ করে যায়। তবু অর্ক প্রশ্ন করে করে জেনে নিল যে এই লোকটা প্রভিডেন্স শহরের বাসিন্দা, ওর নাম ওয়ার্ড আর এই গাড়িটা অনেক পুরোনো ও বেন্টলি কোম্পানির তৈরি। লোকটা আর্কহ্যামে কেন যাচ্ছে বা কোথায় থাকবে সেসব জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কথাবার্তায় লোকটার উৎসাহের অভাব দেখে অর্ক আর লোকটাকে বিশেষ ঘাঁটালো না।
(২)
আবছা কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা ধরে গাড়িটা একঘেয়ে চালে এগিয়ে চলেছে। সারাদিনের ধকলে অর্কর চোখে একটু তন্দ্রা লেগে এসেছিল। হঠাৎ গাড়িটা থেমে যাওয়ায় সজাগ হয়ে উঠল সে। চোখ মেলে দেখল গাড়িটা একটা শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
-“এই তাহলে আর্কহ্যাম?” জিজ্ঞেস করল অর্ক।
ওয়ার্ড মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো। এবার ওয়ার্ড-এর মুখে কথা ফুটল। সে বলে উঠল,
-“আমি প্রত্যেক বছর এই রাতটাতে এখানে আসি আমার কিছু পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। এই শহর যে দেখছ তা এককালে খুব জমজমাট ছিল। বড় বড় বাড়িতে লোকলস্কর গমগম করত। এখানকার মিসক্যাটনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে ছিল। সে সব প্রথম মহাযুদ্ধের আগের ব্যাপার। এখন এই শহর প্রায় পরিত্যক্ত মস্ত সব অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষের জঙ্গলমাত্র।“
অর্ক এবার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এ কোন ধ্বংসস্তুপে নিয়ে এলো লোকটা! এখানে মানুষ থাকে? চারদিকে চোখ বুলিয়েও কুয়াশার চাদর ভেদ করে প্রায় কিছুই দেখতে পেল না। শুধু কুয়াশার আড়ালে লম্বা লম্বা কালো ছায়ার মত বাড়িঘরের আভাষ, চারপাশে কিছু পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো দ্বিপদ ছায়া ও কুয়াশার মাঝামাঝি কিছু জীবের অবয়ব টের পেল। অকারনে কেন যেন তার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল। ওয়ার্ডের দিকে তাকাতে লোকটা যেন কিছু একটা আঁচ করে বলে উঠল,
-“ভয় নেই। যায়গাটা একটু পুরনো সময়ে যেন থমকে গেছে। আধুনিক সভ্যতার রেশ খুব একটা লাগতে পারে নি। আর একটা মরণাপন্ন শহর নিয়ে কারই বা মাথাব্যথা থাকে বল? আমারা কয়েকজন শুধু এই জায়গাটার মায়া কাটাতে পারি নি বলে এখানে বার বার ফিরে ফিরে আসি। এখানে এলে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা হয়। ওরাও এই জায়গাটা ছেড়ে বহুদিন চলে গেছে আমারই মত। কিন্তু আমারই মত এই দিনটাতে ছুটে আসে এই শহরের টানে। আজকের দিনটা জানো তো? এই শহরের সব চেয়ে বড় উৎসব এটা।“
মুহূর্তে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে আসে অর্কর কাছে। ও হরি! আজ ত হ্যালোইন! এই লোকটার অদ্ভুত সাজপোশাক তাহলে সেই কারণেই! যাই হোক, সে এবার একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে বলে ওঠে,
-“এই অদ্ভুত কুয়াশা, পুরোনো আধো অন্ধকার শহর আর আপনার হ্যালোইন কস্টিউম সব মিলিয়ে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম।“
ওয়ার্ড মৃদু হেসে বলে “সে ত বুঝলাম। কিন্তু আজ রাতে থাকবে কোথায়। এই শহরে সেরকম লোকজন তো নেই, তাই হোটেল-সরাই যা আছে তাতে অতিথি নেই বলে হ্যালোইনের দিনে সবকিছু বন্ধ থাকবে। তবে তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আজ রাতটা আমার বাড়িতেই থেকে যাও। আমার বন্ধুরা আসবে, আড্ডা-গল্প হবে। সময়টা ভালোই কাটবে তোমার। কাল সকালে তোমাকে আমি গাড়ির রাস্তায় পৌঁছে দেব। তার পরে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবে।“
প্রস্তাবটা পেয়ে অর্ক ভাবনায় পড়ল। এই প্রায় অচেনা লোকটাকে কি এত চট করে ভরসা করা যায়? অথচ ভরসা না করেই বা উপায় কি? এই ভাঙ্গা শহরে আর কাকেই বা চেনে সে। আর হাইকিং করতে এসেছে বলে সাথে দামী জিনিসপত্র সেরকম কিছুই নেই। তা ছাড়া এখন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল যে ওয়ার্ডের পরনের হ্যালোইন কস্টিউমটা বেশ দামী। মনে হয় কোন অ্যান্টিক শপ থেকে কেনা। গাড়িটা যদি ভাড়াও করে থাকে, এই ধরনের ভিন্টেজ গাড়ির জন্য বেশ ভালোরকমের রেস্ত খরচা হয়েছে নিশ্চই। সাধারন চোরডাকাত এত খরচা করে এইরকম নির্জন শহরে আসবে কেন? কাজেই সে ওয়ার্ডের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কোন কারন দেখতে পেল না। সে সম্মতি দিতেই ওয়ার্ড গাড়ি চালিয়ে দিল। অর্ক পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ডেক্সটারকে ফোন করতে গিয়ে আবিষ্কার করল যে চার্জ ফুরিয়ে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়ার্ডের বাড়িতে পৌঁছে চার্জ দিয়ে ডেক্সটারকে জানাতে হবে যে সে আজ নর্থ অ্যাডামসে পৌঁছোতে পারবেনা। মনে মনে যখন অর্ক এইসব ভেবে চলেছে, এমন সময় গাড়িটা একটা প্রায় অন্ধকার জায়গায় এসে ব্রেক কষল। অর্ক সামনে তাকিয়ে প্রথমে কুয়াশায় ও অন্ধকারে কিছু দেখতে পেলো না। কিন্তু ক্রমশ কুয়াশার আবরণ ভেদ করে একটা বিরাট অট্টালিকার কালো ছায়া ফুটে উঠল।
-“চল অর্ক, আমরা পৌঁছে গেছি।“
গাড়ি থেকে নেমে একটু এগিয়ে যেতে বাড়িটা আরো স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হল। বাড়িটা পাথরের তৈরি, বেশ বড়, আর চেহারা দেখে মনে হল কম করে একশো বছরের পুরনো। দেখে বোঝা যায় যে এই বাড়িতে লোকজন বিশেষ থাকে না সাধারণত। সামনের বাগানে শুকনো আগাছা তার প্রমাণ। তবে আজ এই বাড়িতে লোক রয়েছে। একতলার একটা জানালা দিয়ে একটা আলোর হাল্কা আভা বাইরে এসে পড়ে তার প্রমাণ দিচ্ছে। বাড়ির দরজায় পৌঁছে ভেতর থেকে ভেসে আসা কিছু লোকের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরও যেন শুনতে পেল অর্ক।
ওয়ার্ড কড়াটা মৃদু শব্দে নাড়তে দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা যে খুলল সেই লোকটা বেশ লম্বা, কম করে ছ-ফুট হবে; বৃদ্ধ ফ্যাকাশে মুখে তার অসংখ্য বলিরেখা। পরনে শতচ্ছিন্ন তাপ্পি মারা একটা খাকী রঙের কোটপ্যান্ট। অর্কর যদি জানা না থাকত যে এটা হ্যালোইন এর কস্টিউম, সে নির্ঘাত এরকম চেহারার লোক দেখে অস্বস্তি বোধ করত। তবে লোকটার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও সেটা সটান অর্কর দিকে নিবদ্ধ। ওয়ার্ড সেটা লক্ষ্য করেই বলে উঠল,
-“সাথে গেস্ট আছে ওল্ডি। ভেতরে ঢুকতে তো দাও! সহবতের কি মাথা মুড়িয়ে এসেছ?”
ধমক খেয়ে বুড়োর যেন সম্বিত ফিরল। একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে দরজা ছেড়ে দিয়ে ওয়ার্ড আর অর্কর ঢোকার পথ করে দিল। অর্কর মনে হল লোকটা তাদের মজলিসে তার অনাহুত উপস্থিতিতে খুব একটা প্রসন্ন হয় নি।
(৩)
বাড়িতে ঢুকে একটা আধো অন্ধকার করিডর পেরিয়ে ওয়ার্ড এর পিছু পিছু অর্ক একটা বেশ বড়সড় ঘরে এসে পৌছল। ঘরটা কালো কালো প্রাচীন আসবাবপত্রে ঠাসা। একদিকের দেওয়ালে প্রকান্ড একটা দেওয়াল জোড়া কাঁচের পাল্লা ওয়ালা আলমারি। সেটা আপাদমস্তক মোটা মোটা চামড়ায় বাঁধানো বইয়ে ঠাসা। ঘরের মধ্যিখানে একটা লম্বা টেবিল ও সেটাকে ঘিরে রয়েছে গোটা দশেক কাঠের হাতলওয়ালা পুরনো ফ্যাশনের চেয়ার। টেবিলে পুরোন কাঁচের চিমনিওয়ালা বাতিদানে সার দিয়ে দশ বারোটা বড় মোমবাতি জ্বলছে। আর সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে সেই টেবিল ঘিরে বসে থাকা অদ্ভুত দর্শন প্রানীগুলোর মুখ। সব মিলিয়ে ওয়ার্ড আর ওল্ডিকে বাদ দিয়ে সংখ্যায় তারা পাঁচজন। ওয়ার্ড ঘরে ঢুকতেই তাদের মধ্যে একটা সাড়া পরে গেল। একটা ধপধপে সাদা মোমের মুখোশ পড়া লোক এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালো ওয়ার্ডকে। লোকটার পরনে একটা পুরনো মিলিটারি ওভারকোট ও কোমরের বেল্ট থেকে একটা অদ্ভুত চৌকো ঘনকাকৃতি বেঢপ বাক্স ঝুলে রয়েছে। ওয়ার্ড লোকটার সাথে করমর্দন করে বাকিদের হাত তুলে পাল্টা অভিবাদন জানালো। এবার একে একে সবার সাথে অর্কর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা। ওয়ার্ড গলা চড়িয়ে ঘরের সবার অবগতির জন্য অর্কর পরিচয় ঘোষনা করল। সেই মোমের মুখোশ পরা লোকটা প্রথমে এসে অর্কর সাথে করমর্দন করল। লোকটা নিজের নাম বলল ক্ল্যাফাম। ঘরের বাকিরা সবাই একে একে অর্ককে নিজেদের পরিচয় দিল।
ক্ল্যাফামের পরে যে এল সে মাঝবয়সী শীর্ন ও পরনে পুরনোদিনের কাউবয়দের মত পোশাক। এর নাম নাহুম।
এর পরে এলো দানিয়েল। এর বয়স ওয়ার্ডের মতই হবে। এবং এর সাজসজ্জা অনেকটাই ওয়ার্ডের মত। অর্থাৎ বেশ দামী পুরনো কোটপ্যান্ট।
এর পরে এল এই দলের সবচেয়ে বিচিত্র সাজপোশাক পড়া লোকটা। বেশ লম্বাচওড়া লোকটা ঠিক কি সেজে এসেছে বোঝা গেল না। কিন্তু তার মুখটা দেখাচ্ছে অবিকল একটা শিঙ ভাঙ্গা ফ্যাকাশে হলদেটে ছাগলের মত। এর নাম উইলবার। আর অর্ক লক্ষ্য করল যে লোকটার গায়েও বোকা পাঁঠাদের মতই একটা বিশ্রী গন্ধ। নেহাত ভদ্রতার খাতিরে অর্ক কোনরকমে সেটা সহ্য করছিল। লোকটা পরের জনকে জায়গা করে দিতে সরে যেতে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
শেষের লোকটা আরো অদ্ভুত। লোকটা এতক্ষণ বসে ছিল বলে অর্ক বোঝে নি। কিন্তু এবার দাঁড়িয়ে উঠতে সে আবিষ্কার করল যে লোকটার উচ্চতা চারফুটের বেশি হবে না। রোগা-পাতলা চেহারা, গলার স্বরও মিহি। হঠাত দেখলে বাচ্চা বলে মনে হবে। কিন্তু লোকটার মুখের ভাব ও কথাবার্তায় ঝরে পড়া গাম্ভীর্য বলে দেয় যে লোকটা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ। এর নাম রুডলফ।
আলাপ পরিচয়ের পালা শেষ হলে অর্কর খেয়াল হল তার মোবাইল চার্জ করবার কথা। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে এই দেখে হতাশ হল যে কোন দেওয়ালে কোন বৈদ্যুতিক লাইন, প্লাগ পয়েন্ট বা সুইচ বোর্ড ইত্যাদির কোন চিহ্ন নেই। ওয়ার্ডকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল যে এই বাড়িতে কেউ থাকে না বলে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। অগত্যা অর্ক মোবাইল চার্জ করবার আশা ত্যাগ করে ঘরের চারপাশে চেয়ে দেখতে লাগল। সকলে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে কথাবার্তা বলছে। অর্ককে কেউ খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনছে বলে মনেই হলো না। অর্ক ঘরের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে আলমারিতে রাখা বই গুলো দেখতে লাগল। বেশ কিছু বই বিভিন্ন বিদেশী ভাষায়। তাই নাম গুলো পড়া তার পক্ষে সম্ভব হল না। অনেক গুলোই ইংরাজি তে কিন্তু সেগুলোর নাম পড়ে সে মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝল না। এমন সময়ে ওয়ার্ডের গলা পাওয়া গেল। গলা চড়িয়ে ওয়ার্ড ঘোষনা করল,
-“জেন্টলমেন! ডিনারের এখনো দেরী আছে কিছুটা ততক্ষণের জন্য একটু গলা ভেজানো যাক আর একটু গল্পগুজব হোক। অর্ক দেখল ওয়ার্ড এসে দাঁড়িয়েছে লম্বা টেবিলটার একপ্রান্তে। তার হাতে একটা লম্বা ওয়াইনের বোতল। আর ওল্ডি টেবিলে রেখে গেল এক সেট কাঁচের গেলাস আর তিন-চারটে ট্রে তে কিছু শুকনো খাবার। খাবারের মধ্যে রয়েছে শুকনো মাংস, চীজ ইত্যাদি। ওয়ার্ড সবার জন্য গেলাসে ওয়াইন ঢালতে শুরু করল। এতক্ষণ এই অদ্ভুত বাড়ি ও লোকগুলোর কথাই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল তাই অর্ক খিদে টের পায় নি। এখন খাবার দেখে সে অনুভব করল যে তার আসলে বেজায় খিদে পেয়েছে। ঘরের সবাই এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে গেলাস আর প্লেটে পছন্দ মত খাবার তুলে নিয়ে টেবিলে ঘিরে বসে পড়ল। অর্কও ওয়ার্ডের আহ্বানে তাদের সাথে যোগ দিল।
খাওয়া দাওয়া চলছে এমন সময় ক্ল্যাফাম বলে উঠল,
-“এই দিনটার জন্য আমরা সারা বচ্ছর মুখিয়ে থাকি। এই আর্কহ্যামের প্রতি আমাদের যে টান তার কারন আমাদের পুরনো দিনের স্মৃতি। আজ হ্যালোইনের দিনে আমরা আমাদের পুরনো দিনে একবার ফিরে যাই না কেন? আর এবার তো আমাদের সাথে একজন অতিথিও রয়েছেন। উনিও ব্যাপারটা উপভোগ করবেন।“
এই প্রস্তাবে দেখা গেল সকলেই এককথায় রাজী। ঠিক হল সকলেই আর্কহ্যাম কে নিয়ে নিজের নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা বলবেন।
প্রথম গল্প বলার পালা এল নাহুমের। নাহুম বলতে শুরু করল।
-তোমরা সকলেই জানো এই আর্কহ্যামের মাটির তলায় বহু প্রাচীন যুগযুগান্তের কত রহস্য লুকিয়ে আছে। সব রহস্যের হদিসও লোকে আজ অবধি পায় নি। কিন্তু আমি একটা রহস্যের সন্ধান জানি। জানতে আমায় নিজের জীবনপাত করতে হয়েছে কিন্তু তাতে আমার আফসোস নেই। এই আর্কহ্যামের বাইরে এককালে একটা বিশাল খামারবাড়িতে আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকতাম। পরিবার বলতে আমার স্ত্রী ও ছেলে। কিন্তু একদিন আর্কহ্যামের আকাশ ফুঁড়ে নেমে এলো এক জ্বলন্ত বিভীষিকা। লোকে দেখল একটা উল্কাপাত। কিন্তু আমি জানি যে সে কোন জড় পদার্থ নয়। ওটা ছিল কোন অপার্থিব অশুভ শক্তির আধার। যার প্রভাবে আমার জীবন ছারখার হয়ে গেল। আমার স্ত্রী ও আমার ছেলেকে চিরতরে আমায় হারাতে হল। কিন্তু যা আজও পৃথিবী জানে না তা হল এই আর্কহ্যামের মাটির নিচে প্রাচীন অনেক সুরঙ্গপথের জাল ছড়িয়ে রয়েছে। তার একটা মুখ তো এই বাড়ির বেসমেন্টেই রয়েছে। আর সেই সব সুড়ঙ্গের কোন এক গোপন গহ্বরে আজো ঘুমিয়ে রয়েছে সেই অশুভ শক্তির এক অংশ। যারা সেই সময়ে তার ধ্বংসের সাক্ষী ছিল তারা কেউই আর এই শহরে থাকতে চায় নি।“
এই অবধি একটানা বলে নাহুম থামল। এমন সময়ে উইলবার মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে উঠল।
সবার দৃষ্টি এখন উইলবারের দিকে। সে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,
-“শুধু সে নয়। আরো অনেক অজানা শক্তির অংশ এই আর্কহ্যামে রয়েছে। এদের একজনকে ত আমি নিজের চোখে দেখেছি! উফ! কি বীভৎস তার রক্ততৃষ্ণা! অনেক চেষ্টা করেছি তাকে সংযত করতে। মিস্ক্যাটনিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমাকে বিশ্বাস করে তাদের নেক্রোনমিকনের কপিটা আমাকে একদিনের জন্যও ধার দিত তাহলে আজ হয়ত এই শহরটার চেহারাই পালটে যেত। আমি শুধু তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। সে যে আমার আপন যমজ ভাই! কিন্তু পারলাম না। শহরের লোকেরা ভুল বুঝে তাকে পুড়িয়ে মারল।“
এক অদ্ভুত হাহাকার ঝরে পড়ল উইলবারের কন্ঠ থেকে। অর্ক এবার একটু অস্বস্তি বোধ করল। এতক্ষণ সে মনে করে আসছিল পুরো ব্যাপারটাই একটা নাটকের মত। লোকগুলো কিম্ভুত সেজে নানা রকম উদ্ভট গল্প বলছে। হ্যালোইনের পার্টিতে এরকম সে আগেও দেখেছে। কিন্তু এবার তার মনে হতে শুরু করেছে যে এই লোকগুলো হয় খুব দুর্দান্ত অভিনেতা অথবা মানসিক রোগী। অমনি একটা সম্ভাবনার কথা তার মাথায় খেলে গেল। মানসিক রোগী! আর্কহ্যাম! কি আশ্চর্য! পৃথিবী বিখ্যাত ব্যাটম্যানের কমিক্সে তো আর্কহ্যাম একটা বিশাল পাগলাগারদের নাম! সেখানে সব অস্বাভাবিক রকমের হিংস্র ও সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক পাগলদের বন্দী করে রাখা হয় ব্যাটম্যানের গল্প অনুযায়ী। মনে মনে হেসে ওঠে অর্ক। আরে এই লোকগুলো জব্বর ফেঁদেছে তো নাটকটা! তবে এই জায়গাটার নাম কিন্তু সত্যি আর্কহ্যাম। আসার পথে কয়েকটা সাইনবোর্ড আবছা দেখেছে সে। যাই হোক, পাছে রসভঙ্গ হয়ে যায় সেই ভয়ে অর্ক মুখে কিছু বলল না। ওদিকে উইলবার তখনো বলে চলেছে।
-“নেক্রোনমিকন কি জানেন ?”
অর্ক ভাবনার সুত্র ছিন্ন হয় এই প্রশ্নে। উইলবারের দৃষ্টি সটান তার দিকে। অর্ক মনের ভাব গোপন করে বেশ সিরিয়াস মুখ করে মাথা নাড়ে।
-“ওই যে!” সটান উইলবারের আঙ্গুল নির্দেশ করে রয়েছে বইয়ের আলমারির দিকে। ওয়ার্ড মুচকি হেসে বলে -“থাক উইল। আমি বলছি। অর্ক, নেক্রোনমিকন হল একটা প্রাচীন গ্রন্থ। পৃথিবীর সব অতিপ্রাকৃত রহস্যের চাবিকাঠি ঐ নেক্রোনমিকন। মানুষের অনুভবের উর্ধ্বে থাকা অকল্পনীয় শক্তির অধিকারীদের যে জগত, তার নাগাল পাওয়ার উপায় ওই নেক্রোনমিকনে রয়েছে।“
এই বলে সে এগিয়ে গিয়ে আলমারি থেকে একটা বিশাল মোটা বাদামী রঙের বই নামিয়ে নিয়ে এসে টেবিলের ওপরে রাখল। মোমবাতির আলোয় অর্ক যা দেখল, সেরকম বই সে কোনদিন দেখে নি। বইটা নিঃসন্দেহে অনেক পুরনো। ওটার কভার কালচে কাঠের। পেতলের কব্জা দিয়ে দুটো কভার একটার সাথে অন্যটা গাঁথা। কভারের খোলা দিকটায় একটা লোহার শিকল পেছনের মলাট থেকে সামনে অবধি বইটা জড়িয়ে রেখেছে আর সেই শিকলটা সামনের মলাটের একটা কড়ার সাথে একটা পেতলের তালা দিয়ে আটকানো। ওই তালা না খুলে বইটার ভেতরে কি রয়েছে তা পড়া অসম্ভব। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হল সামনের মলাটে কাঠে খোদাই করা একটা নকশা। অদ্ভুত অনেকগুলো শুঁড় সম্বৃদ্ধ হিংস্র দাঁত-নখ সর্বস্ব একটা বিকটদর্শন কোন জীবের চিত্র। এরকম জীবের কল্পনাও যে কেউ করতে পারে তা অর্কর ধারনার বাইরে ছিল। এবার অর্ক একটু ভয় পেল। এতক্ষণ যে জিনিস গুলোকে মজা বা অভিনয় ভাবছে তা সত্যিই অভিনয়, না এই লোকগুলো আসলে উন্মাদ? কিন্তু উন্মাদ হলেও এই বইটার চেহারা দেখে আর সেটাকে হাল্কা ভাবে নিতে পারছে না সে। সে শুনেছে এদেশে অনেক উদ্ভট মধ্যযুগীয় ধারনা সমৃদ্ধ গুপ্ত সমিতি আছে ও তাদের অনেকগুলোর কার্যকলাপ বেশ বিপজ্জনক। সে সেরকম কোন সমিতির পাল্লায় পড়ল না তো?
(৪)
-“মানুষের চেতনার বাইরের জগতের নাগাল পাবার কিন্তু নেক্রোনমিকন ছাড়াও অন্য উপায় আছে উইলবার।“ মন্তব্যটা ভেসে এলো র্যান্ডলফের কাছ থেকে। এই বলে সে তার পোষাকের আড়াল থেকে হাত ঢুকিয়ে একটা চকচকে ধাতব জিনিস বের করে টেবিলের উপর রাখল। জিনিসটা একটা ধাতব চাবি। অর্ক দেখল বেশ বড় মাপের অদ্ভুত দর্শন রুপোলী চাবিটা। র্যান্ডলফ বলে চলল,
-“এই চাবিটার গুরুত্ব ওয়ার্ড জানে। এই চাবির সাহায্যে অতিক্রম করা যেতে পারে সেই অলঙ্ঘ্য দেওয়াল যার অপর পারে রয়েছে এই মহাবিশ্বের কালো, সাদা ও ধুসর সব রকম জগতের জ্ঞান। এই চাবি থাকলে হয়ত উইলবারের ভাইকে বাঁচানো যেত। কিন্তু উইলবারের নিজের পিতাই তা চান নি। উনি পরম জ্ঞানী। ইয়গ-সথোথ কারো অনিষ্ট চান না। উনি নির্লিপ্ত। যে যতটা জানতে বা দেখতে চায় উনি তাকে ততটাই জানান বা দেখান। তার পরে সেই জ্ঞানের পরিণামের দায়িত্ব ওনার নয়। উনি আমাকে তাই উইলবারের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে বারন করেছিলেন।“
“জানি বন্ধু! আগে জানতাম না। তবে এখন জানি। মৃত্যু আমার দৃষ্টি প্রসারিত করেছে।“ র্যান্ডলফকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে উইলবার। এবার অর্ক আর চুপ থাকতে পারে না। বেশ জোরে বলে ওঠে “আপনাদের অভিনয়টা বেশ ভালো। কিন্তু এইটা কিন্তু বেজায় ক্লীশে হয়ে গেল মিস্টার উইলবার! আপনি এবার নিশ্চই দাবী করবেন আপনি আসলে মৃত” এই বলে বেশ জোরেই হেসে ওঠে অর্ক।
কিন্তু তার হাসির ফলে ঘরের আবহ হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। সবাই চুপ, আর সবার দৃষ্টি অর্কর দিকে। কয়েক মুহূর্তর এই নৈঃশব্দ ভেঙ্গে এবার কথা বেরোয় ক্ল্যাফামের মুখ দিয়ে।
“অভিনয়! আপনি এতক্ষণ তাই ভাবছিলেন নাকি? তাহলে ত এবার আমাদের সন্মান রক্ষার্থে আপনাকে কিছু প্রমাণ দেখাতেই হয়!” উঠে দাঁড়ায় ক্ল্যাফাম। তার হাতে তখন এতক্ষণ কোমরে ঝুলে থাকা চৌকো ঘকাকার বাক্সটা। তার মুখে মোমের মুখোশ তাই তার মুখের ভাব অর্ক দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ঘরের বাকিদের মুখে অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট। অর্ক প্রমাদ গুনল। এদিকে ওয়ার্ড এর হাত ততক্ষনে অগ্রসর হয়েছে নেক্রোনমিকনের দিকে। তার হাতে একটা ছোট চাবি আর সে সেটা বইটার তালার গর্তে ঢুকিয়ে একটা মোচড় দিয়ে ফেলেছে।
ক্ল্যাফাম ততক্ষনে খুলে ফেলেছে তার চৌকো বাক্স। আর তার ডান হাত সেই বাক্সের ভিতরে হাতড়ে কি যেন একটা তুলে আনছে আর তার অন্য হাতের লম্বা আঙ্গুল গুলো একে একে লম্বা ভয়ঙ্কর শুঁড়ের আকার নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তার মোমের মুখোশ সমেত মুণ্ডুটাকে! প্রচন্ড আতঙ্কে অর্কর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল। তার মনে হল তার চারদিকে অন্ধকার আরো ঘনিয়ে আসছে। সে জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান হারানোর আগের মুহুর্তে সে দেখল যে শুঁড় গুলোর চাপে ক্ল্যাফামের মুণ্ডুটা মোমের মুখোশ সুদ্ধ ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল! আর সেই কবন্ধ মূর্তির ডান হাত সেই চৌকো বাক্সটা থেকে বার করে আনল একটা রক্তাক্ত মানুষের কাটা মুন্ডু! মুন্ডুটা জীবন্ত! আর তার চোখে মুখে অবর্ননীয় হিংস্রতা। সেই মুণ্ডু চিৎকার করে বলছে “এই দেখ অর্বাচীন মানুষ! এই হল মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুঢ় রহস্যের প্রমাণ।“
অন্যদিকে নেক্রোনমিকনের একটা পাতা খুলে ওয়ার্ড বিড়বিড় করে একটা কিছু উচ্চারন করে চলেছে উচ্চস্বরে। ক্ল্যাফামের শুঁড় গুলো তখন দ্রুত পেঁচিয়ে ধরছে অর্কর সারা শরীর! তাদের প্রবল চাপে অর্কর দম আটকে আসছে, এমন সময় ওয়ার্ডের বিড়বিড়ানি থামল। আর সাথে সাথে অর্ক শুনল বাইরে আকাশ বিদীর্ণ করা প্রচন্ড বজ্রপাতের শব্দ। একটা নয়, দুটো নয়, ক্রমাগত! সারা বাড়িটা সেই ক্রমাগত বজ্রপাতের শব্দে থরথর করে কেঁপে আস্তে আস্তে গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে চার পাশ থেকে। হঠাত ক্ল্যাফামের শুঁড়ের বাধন আলগা হয়ে অর্কর শরীর থেকে খসে পড়ল। ক্ল্যাফামের কবন্ধ শরীর আর কাটা মুণ্ডুটা শূন্যে একে অপরকে ঘিরে তীব্র ঘুরপাক খেতে শুরু করল প্রচণ্ড কোন শক্তির আকর্ষনে। ক্রমে সে দুটো বিলীন হতে থাকল নেক্রোনমিকনের পাতায়! ক্ল্যাফামের শরীর বিচ্ছিন্ন মুণ্ডুর মুখ থেকে এক অপার্থিব আর্তনাদ বেরিয়ে এসে বাইরের বজ্রপাতের শব্দকেও ঢেকে দিলো। অর্কর পক্ষে আর এতটা আতঙ্ক সহ্য করা সম্ভব হল না। তার চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে।
(৫)
চোখ খুলতেই সূর্যের তীব্র আলোয় অর্কর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ধাতস্থ হতে অনেকটা সময় নিল অর্ক। ওঃ কি বিকট দুঃস্বপ্ন! বিছানা ছেড়ে উঠে বসল অর্ক। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা। একটা অসম্ভব সন্দেহ এসে গ্রাস করল অর্কর সমস্ত চেতনাকে। তাড়াতাড়ি জামা খুলে নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই সে দেখল তার সারা শরীরকে পাক দিয়ে আঁকা রয়েছে সরু সরু কালশিটের দাগ! তবে কি…
-“গুড মর্নিং রক! বাইরে আজ দারুন ওয়েদার।“ ক্যাম্পের দরজায় ডেক্সটার হাসিমুখে পিঠে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে।
-“তুমি উঠতে দেরী করলে তাই ভাবলাম তুমি ক্লান্ত। তাই আমি আর তোমাকে জাগালাম না। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমার ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। আমি একটু ট্রল-এ বেরোচ্ছি। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরব। এসে একসাথে লাঞ্চ খাবো।“
অর্কর মনে যে আশঙ্কার মেঘটা জমাট বাঁধছিল সেটাতে হঠাত যেন একটা বিদ্যুৎ সঞ্চার হল। সে ডেক্সটারকে উদ্দেশ্য করে আর্তনাদ করে উঠল “আজ কি হ্যালোইন?” একটু অবাক চোখে ডেক্সটার তার দিকে চেয়ে থেকে উত্তর দিল “হ্যাঁ। আজ হ্যালোইন।“
একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে অর্ক বলে উঠল –
“একটু দাঁড়াও আমিও তোমার সঙ্গে যাব। হাইওয়ে যাওয়ার রাস্তার উল্টো দিকের পায়ে চলা রাস্তাটায় কাল খুব পাখির ডাক শুনছিলাম। চল তো দেখি সেগুলোর দু-চারটে ছবি তোলা যায় কি না।“
(উপসংহার)
বস্টনে ফিরে ইন্টারনেটে অর্ক সেই অদ্ভুত নাম গুলো নিয়ে কিছু খোঁজ খবর করেছিল। সে যা জানতে পেরেছিল তার একটা সার সংক্ষেপ হল –
আর্কহ্যাম- আর্কহ্যাম নামের কোন জায়গা বাস্তবে নেই। এটা একটা কল্পিত শহর। ব্যাটম্যান নয়, এই শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯২০ সালে রচিত এইচ পি লাভক্রাফটের ‘দ্য পিকচার ইন দ্য হাউস’ গল্পে। এর পরে লাভক্রাফট তার বহু গল্পে আর্কহ্যাম নামের জায়গাটার উল্লেখ করেছেন।
ওল্ডি-এই লোকটার নাম সে জানে না। কিন্তু লাভক্রাফটের সমস্ত গল্প সে এর মধ্যে জোগাড় করে পড়েছে। এই লোকটার সাথে ‘দ্য পিকচার ইন দ্য হাউস’ গল্পের খুনে বুড়ো লোকটার খুব মিল আছে।
ক্ল্যাফাম- এই লোকটা নিঃসন্দেহে ‘দ্য রি-এনিমেটর’ গল্পের স্যর এরিক মরল্যান্ড ক্ল্যাফাম লি। যুদ্ধে মুন্ডচ্ছেদে মৃত্যুর পরেও এই লোকটার শরীরে এক পাগল বৈজ্ঞানিক প্রাণ সঞ্চার করেছিল বলে লাভক্রাফট লিখে গেছেন গল্পে।
র্যান্ডলফ- এই লোকটা সম্ভবত ‘দ্য সিলভার কী’ গল্পের র্যান্ডলফ কার্টার। গল্প অনুসারে ইনি এনার স্বপ্নে একটা অলৌকিক রহস্যময় চাবির সন্ধান পান। সেই চাবির সাহায্যে স্বপ্নের ও স্বপ্নের অতীত পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করা সম্ভব। সেই জগতে প্রবেশ করে ইনি প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়া থেকে আবার নিজের দশ বছরের বালক অবস্থার নিজের শরীরে প্রবেশ করেন। ফলে তার চেহারা ওইরকম একাধারে শিশু ও পূর্নবয়স্ক মা্নুষের মত।
নাহুম- লাভক্রাফটের ‘দ্য কালার আউট অফ স্পেস’ গল্পে নাহুম গর্ডন এক গ্রাম্য কৃষক। এক অপার্থিব অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে তাঁর পরিবারের প্রত্যেকের মৃত্যু হয় ও শেষে তিনি নিজেও প্রাণ হারান।
উইলবার – এর নাম উইলবার হোয়াটলি। এর উল্লেখ পাওয়া যায় লাভক্রাফটের ‘দ্য ডানউইচ হরর’ গল্পে। এনার জন্ম বৃত্তান্ত অত্যন্ত রহস্যময়। লাভক্রাফট লিখেছেন যে প্রাচীন মহাপ্রাণ ইয়গ সোথথ এর সাথে এক মানবীর সংযোগে জন্ম নেয় উইলবার ও তার এক দানবরূপী যমজ ভাই।
ওয়ার্ড- এর উল্লেখ অর্ক কোন গল্পে পায় নি। কিন্তু সে মনে মনে একটা তত্ত্ব খাড়া করেছে। ওয়ার্ড নামটা আসলে এই অঞ্চলে হাওয়ার্ড এর কথ্য রূপ বা বাংলায় যাকে বলা চলে ডাকনাম। আর হাওয়ার্ড? সেটা হাওয়ার্ড ফিলিপ লাভক্রাফট ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে!
Tags: এইচ পি লাভক্রাফট, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস