হিমশীতল – এইচ পি লাভক্র্যাফট
লেখক: বাংলা অনুবাদঃ দীপাঞ্জন মুখার্জী
শিল্পী: সূর্যোদয় দে
ভদ্রলোক বললেন – “আপনারা জানতে চাইছেন ঠান্ডা আবহাওয়াকে আমি কেন ভয় পাই? কেন ঠান্ডা হাওয়ায় আমার শরীর মাঝে মাঝে গুলিয়ে ওঠে? কি কারনে আমার মধ্যে এক শৈত্যবিরোধী ভাব জেগে ওঠে?”
যাচ্ছিলাম গ্যাংটক, আমরা তিন বন্ধু মিলে। শিলিগুড়ি যাবার পথে ট্রেনে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ। ভদ্রলোকের নাম দীপক ভট্টাচার্য। কলকাতার এক নামী কলেজের অধ্যাপক, বছর পঞ্চান্ন বয়েস। তিনি শিলিগুড়ি যাচ্ছিলেন একটি সেমিনারে যোগ দিতে। ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারের দরুন অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের বেশ আলাপ জমে উঠল।
আমি ভদ্রলোককে বললাম “আপনার সেমিনার শেষ হলে গ্যাংটক চলে আসুন আমদের সঙ্গে।
দীপকবাবু বললেন, “আসলে কি জানেন, ঠান্ডা পরিবেশ আমার কাছে এক কেমন আতঙ্কের সৃষ্টি করে।”
আমার বন্ধু গদাই বলল – “আশ্চর্য! ঠান্ডাকে এত ভয় আপনার?”
ভদ্রলোক কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলতে লাগলেন– “আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা, আমি তখন সদ্য এম এস সি পাশ করে একটা কলেজে পার্ট টাইম পড়ানোর কাজ পেয়েছি। খুব বেশী মাইনে পাইনা। আমদের গ্রামের বাড়ির থেকে কলেজ রোজ যাতায়াতের অসুবিধা, তাই কলেজের আশে পাশে একটা কম ভাড়ার ঘর খুঁজছিলাম। অনেক খোঁজ করার পর একটা বাড়ির সন্ধান পেলাম। বাড়িটা কলেজ থেকে খুব বেশী দূরে নয়, তিনতলা এবং বেশ পুরানো। কিন্তু ঘরগুলি বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির মালিক ভবতোশবাবু অকৃতদার ব্যক্তি, বাড়ির একতলাটা নিয়ে থাকেন। অনেকগুলি ঘর। সব ঘরেই ভাড়াটিয়ারা রয়েছে।
দেখতে দেখতে প্রায় হপ্তাদুয়েক ভালই কেটে গেল। একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। টিউশন সেরে রাত্রি ন’টা নাগাদ ঘরে ফিরে দেখি আমার ঘরের ছাদের একটা কোনা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে, আর ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়ার গন্ধে ঘরের বাতাস ভারি হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ঘরের জানালা গুলো সব খুলে দিলাম। কোথা থেকে গন্ধটা আসছে খেয়াল করতে গিয়ে দেখলাম ছাদের যে জায়গা থেকে জল পড়ছে, সেখান থেকেই গন্ধটা আসছে। আমার ঘরের ঠিক উপর তলায় কে থাকে তা আমি তখন জানতাম না। আমি ভবতোশ বাবুকে ডেকে এনে ব্যাপারটা দেখালাম। উনি বললেন “চিন্তা করবেন না, ব্যাপারটা আমি দেখছি, এ নিশ্চয়ই মনোজ বাবুর কাণ্ড।”
আমি বললাম “মনোজ বাবু? তিনি কে?”
ভবতোশ বাবু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললেন – “ডঃ মনোজ বসু। এক বৃদ্ধ ডাক্তার কাম গবেষক। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ আর ওষুধ নিয়ে তার কাজ কারবার। তিনি এক অদ্ভুত অসুখে আক্রান্ত। তাই তাকে বিভিন্ন রাসায়নিক মেশানো জলে বার বার স্নান করতে হয়। অথচ অন্য কোনো ডাক্তারে সাহায্যও তিনি নেন না, পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হন না। তার ঘরের সমস্ত কাজ তিনি একা হাতেই করেন। আমার কাজের লোক রামু মাঝে মাঝে তাকে দরকারি সব জিনিসপত্র কিনে এনে দেয়। তিনি যে ঠিক কি নিয়ে গবেষণা করছেন, তাও কেউ জানে না। সে তার যা ইচ্ছে তিনি করুন কিন্তু অন্য বাসিন্দারা তার জন্য অসুবিধায় কেন পড়বেন?” বলতে বলতে ভবতোশবাবু সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠতে লাগলেন। কিছুক্ষন পর আমার ঘরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়াটা বন্ধ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়ার গন্ধটাও চলে গেল।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম এখানে আসার প্রায় দুই সপ্তাহ বাদে আমি এই প্রথম ডঃ মনোজ বসুর নাম শুনলাম। তিন তলায় যে কেউ থাকেন তাই আমি এত দিন বুঝতে পারিনি, এমন কি তার পায়ের শব্দও কোনো দিন শুনিনি। কি এমন রোগ হয়েছে ভদ্রলোকের? যে তিনি এমন অদ্ভুত রাসায়নিক মেশান জলে সারাদিন বার বার স্নান করেন? ঘরের বাইরেও বের হন না। অন্য কোনো ডাক্তার দেখান না। ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বলতে পারব না।
কিন্তু এই ডঃ মনোজ বসুর সঙ্গেই একদিন ঘটনা চক্রে আমার পরিচয় হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। সেদিন একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ খেয়ে একটু রাত করে ফিরেছি। শোয়ার পর থেকেই শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল। প্রচড গা গুলোতে লাগল সেই সঙ্গে বুকে প্রচন্ড ব্যাথা। দর দর করে ঘামতে লাগলাম। হঠাৎ মনে পড়ল মনোজ বসুর কথা। কোন রকমে টলতে টলতে তিনতলায় ডঃ বোসের দরজার সামনে গিয়ে বেল বাজালাম।
ভিতর থেকে এটি অদ্ভুত গলায় আওয়াজ এল– “কে?”
আমি কোন রকমে বললাম – “ডাক্তার বোস দরজাটা খুলুন, আমি আর পারছিনা।”
আস্তে আস্তে দরজাটা একটু ফাঁক হল সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক হিমশীতল হাওয়া আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জুন মাসের গরমেও আমার হাড়গুলো পর্যন্ত হিম হয়ে গেল সেই ঠান্ডা হাওয়ায়। আমি ভিতরে ঢুকতে উনি তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরটি বিশাল আকারের এবং বেশ দামি দামি আসবাব দিয়ে সাজান। ঘরটি মালিকের সুরুচির বাহক।
পাশের হল ঘরটা সম্ভবত ডঃ বসুর ল্যাবরেটরি। সম্ভবত এই ঘরটাই আমার ঘরের উপরে অবস্থিত। ঘরটি নানা ধরনের শিশি বোতল এবং যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। এই ঘরের একপাশে একটা বিশাল বাথরুম। যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় আছন্ন দৃষ্টিতে এসব লক্ষ করলাম। এই সময় আবার আমি যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠলাম। ডঃ বোস আমার বিবরণ শুনে আমাকে পরীক্ষা করে একটা ইঞ্জেকশান দিলেন। এরপর কতক্ষন যে আমি আচ্ছন্নের মত পড়েছিলাম বলতে পারি না। আস্তে আস্তে আমার চেতনা হতে ডঃ বোস কে ভালো করে লক্ষ করলাম। বেঁটে খাটো চেহারার মানুষ। কিন্তু চেহারার মধ্যে একটা বেশ আভিজাত্য রয়েছে। পরনের জামা কাপড় বেশ ফিটফাট, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। কিন্তু যেটা আমার চোখে অস্বাভাবিক লাগলো সেটা হল ভদ্র লোকের গায়ের রঙ, কিরকম যেন কালচে নীলাভ। শীর্ন হাতগুলো অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা।
ঘরের অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমি কাঁপতে লাগলাম। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রে তিনি যে কিরকম দক্ষ তা অচিরেও টের পেলাম। ধীর গলায় বললেন – “আপনার হার্টের কোন সমস্যা নেই, অম্বলের থেকেই বুকে ব্যথা হচ্ছিল। ভয়ের কোন কারন নেই।”
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করলাম। তিনি আমাকে কয়েকটি ওষুধ দিয়ে দিয়ে বললেন এগুলি তার নিজের তৈরি, এগুলি খেয়ে কেমন থাকি কাল যেন ওনাকে জানিয়ে যাই। আমি ডঃ বোস কে ধন্যবাদ জানিয়ে হিমশীতল ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
ডঃ বোস যে কতবড় ডাক্তার আমি পরদিনই টের পেলাম, শরীরের সমস্ত কষ্ট ব্যথা যেন ম্যাজিকের মত উধাও হয়ে গেল। কলেজে যাবার আগে আমি গেলাম ডঃ বোস কে ধন্যবাদ জানাতে।
“আপনি আমাকে বাঁচালেন ডঃ বোস।”, আমি ডঃ বোসের হিমশীতল হাত দুটো ধরে বললাম।
অদ্ভুত এক কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বললেন, “মানুষকে বাঁচানোর জন্যই তো আমার সংগ্রাম, মৃত্যুর বিরুদ্ধেই তো আমার লড়াই। মৃত্যুর সবথেকে বড় শত্রু হলাম আমি, মৃত্যুকে জয় করার লক্ষ্যেই আমার গবেষণা, আমার সারাজীবনের সব সম্পদ আমি সেই গবেষণার জন্য ব্যয় করেছি”। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র শুনে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, তার সমস্ত কথা স্রোতের মত বেরিয়ে আসতে লাগল। তিনি বলে চললেন, “মানুষের দেহকে যদি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংরক্ষন করা যায়, এবং মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে যদি একীভূত করা যায় তবে মৃতদেহেও হয়তো প্রানের সঞ্চার হতে পারে, সেই মানুষটি হয়তো সব ক্ষেত্রে হয়তো সাধারন মানুষের মত কাজ করতে পারবেনা, কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো তার থাকবে। তা সত্ত্বেও মানুষের মতই খাওয়া দাওয়া করতে পারবে, কিছু কিছু কাজ কর্ম করতে পারবে” একটু থেমে তিনি বলতে আবার বলতে লাগলেন – “এই নিয়েই আমার গবেষনা। কিন্তু জানিনা এই গবেষণা শেষ করতে পারব কিনা, আমি নিজেই এখন মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার রোগটাও খুব জটিল। এই অদ্ভুত রোগের জন্যই আমাকে সবসময় এই হিমশীতল ঘরে থাকতে হয়। ঘরের তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায় তবে তা আমার পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। সব সময় আমার ঘরের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির আশে পাশে রাখতে হয়। এই ঠাণ্ডা ঘরে থাকতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঘরের শীতলতা ঠিক রাখতে আমার ঘরে সব সময় একটি গ্যাসোলিন ইঞ্জিন চালু থাকে, অ্যামোনিয়া গ্যাসের সাহায্যে তাপমাত্রা শোষন করে ঘরটাকে ঠাণ্ডা রাখে এর জন্যই আমার ঘর সব সময় হিমশীতল থাকে। এই পর্যন্ত বলে ডঃ বোস থামলেন। তিনি ওনার মোটা সেলের চশমা দিয়ে আমার দিকে কেমন যেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমার ভেতরে ভেতরে হঠাৎ কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগল।
এর পর থেকে আমি প্রায়ই ডঃ মনোজ বোসের ঘরে যেতাম। প্রত্যেক বারই অবশ্য আমি একটা মোটা জ্যাকেট পরে তবে যেতাম। তিনি তার মৃত্যু নিয়ে গবেষনার বিষয়ে নানা কথা বলতেন। বিজ্ঞানের নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন। একদিন আমি প্রশ্ন করলাম “আপনি কি এমন রোগে ভুগছেন? যার জন্য আপনাকে এই রকম হিমশীতল পরিবেশে সব সময় বাস করতে হয়?”
ডঃ বোস কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন “আমি যে অসুখে ভুগছি, তার সূচনা হয়ে ছিল আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে। আমার বন্ধু ডঃ অবনী রায়ের সঙ্গে আমি আমার গবেষণা শুরু করেছিলাম। কিভাবে মৃত্যুকে জয় করা যায় সেই নিয়েই ছিল আমদের নিরলস গবেষণা। কিন্তু কাজের চাপে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডঃ অবনী রায়ের চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম বটে কিন্তু ডঃ রায়ের শেষ রক্ষা হল না। যে মৃত্যু নিয়ে আমাদের গবেষণা সেই মৃত্যুই তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আসলে আমাকে সারিয়ে তুলবার পদ্ধতিটি ছিল অদ্ভুত রকমের। আমার মনে হয় সেই পদ্ধতিটি হয় তো তিনি মনে মনে সমর্থন করতে পারেননি। সেই চাপ নিতে না পেরেই তিনি ভেতরে ভেতরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। ডঃ বোস কিন্তু আগের মতো আর নেই, তিনি ক্রমশ দুর্বল আর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তার মুখের নীলচে ভাবটা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। তার কণ্ঠস্বরটাও কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই সময় এক অদ্ভুত শখ পেয়ে বসল তাকে। সবসময় তার ঘরটিকে নানা ধরনের সুগন্ধ দিয়ে সুরভিত করে রাখতেন। তিনি নিজেও নানা রকমের দামী দামী পারফিউম মেখে থাকতেন। তিনি তার ঠাণ্ডা মেশিনের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে ঘরের তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নামিয়ে আনলেন। ডঃ বোসের ব্যবহারে কেমন যেন একটা বিষন্ন ভাব ফুটে উঠল। যে মৃত্যু নিয়ে তার গবেষণা সেই মৃত্যুর কথাই এখন সর্বক্ষন তার মুখে। তার ঘরটি ক্রমশই যেন এক আতঙ্ক ঘন হয়ে উঠতে লাগল, প্রচন্ড হিমেল হাওয়ার মধেই কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ সবসময় ঘরের বাতাসে ভাসছে। তিনি রাসায়নিক মেশানো জলে বারাবার স্নান করতে লাগলেন। আমার শুধু বার বার মনে হতে লাগল তার অসুখটা কি? তিনি অন্য ডাক্তারের সাহায্য কেন নিচ্ছেন না। একদিন তাকে বললাম “ডঃ বোস আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে একজন ডাক্তার নিয়ে আসি?
এই কথা শুনে তিনি আমার উপর প্রচন্ড রেগে গেলেন। আসলে তিনি আমাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে ছিলেন। তাই তার উপর কেমন যেন একটা কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মেছিল। তার উপর আমি কিছুতেই রাগ করতে পারতাম না। তার ভাব দেখে মনে হত কোন ডাক্তারকেই তিনি ধর্ত্যব্যের মধ্যে আনতেন না। কিছু দিনের মধ্যে খাওয়া দাওয়াও তিনি প্রায় ত্যাগ করলেন। সামান্যই খেতেন।
এরপরই এল আমার জীবনের সেই সবথেকে আতঙ্ক ঘন দিন।
অক্টোবর মাস। হঠাৎ একদিন ডঃ বোসের ঘর ঠান্ডা করার পাম্পটা খারাপ হয়ে গেল। হু হু করে ঘরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করল। আমি আর ডঃ বোস মিলে অনেক চেষ্টা করলাম যন্ত্রটাকে সারানোর জন্য। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফল হল। ডঃ বোস পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করলেন। হঠাৎ তিনি নিজের চোখ দুটি চেপে পাগলের মত বাথরুমের দিকে ছুটে গেলেন। একটু পরেই অন্ধের মত হাতড়াতে হাতড়াতে মুখে একটা ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায় ফিরে এলেন। ডঃ বোস এর চোখ দুটি এরপর আর কোনদিন আমি দেখতে পাইনি।
ডঃ বোস পাগলের মত আচরন করছেন – “প্লিজ আমাকে বাঁচান। এই উত্তাপ আমি সহ্য করতে পারছিনা।”
আমি ডক্টরের আচরণ দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি, তখনি ডঃ বোস বললেন – “এক কাজ করুন কোনো বরফ কারখানা থেকে আমার জন্য বরফ নিয়ে আসুন”। এই কথা বলে তিনি বাথরুমের দিকে ছুটলেন।
আমি তড়িঘড়ি ছুটলাম বরফ আনতে। একটা ভ্যান ভাড়া করে অনেকটা বরফ এনে তার বাথরুমের দরজার সামনে রাখলাম। তিনি চিৎকার করে উঠলেন কর্কশ গলায় – “আরও আরও বরফ নিয়ে আসুন আমার জন্য…..” বাথরুমের ভিতরে অশান্ত ভাবে জল ছিটানোর শব্দ শুনতে পেলাম…. ক্ষীণ গলায় ডঃ বোস বললেন “তাড়াতাড়ি একজন মেকানিক দেখুন যাতে ঠান্ডা হওয়ার মেশিনটা ঠিক করা যায়।”
আমি আবার বরফ কারখানায় দৌড়লাম। সেখানকার একটা ছেলেকে কিছু পয়সার লোভ দেখিয়ে বললাম “তুমি এই কারখানা থেকে বরফ নিয়ে গিয়ে ডঃ বোস এর বাথরুমের সামনে রেখে আসবে। আমি তাকে ডঃ বোস এর ঘর চিনিয়ে দিয়ে ছুটলাম মেকানিকের সন্ধানে। শেষ পর্যন্ত ঘন্টা দুয়েক খুঁজে দু’জন মিস্ত্রিকে সঙ্গে নিয়ে আমি আবার ভাড়াবাড়িতে ফিরলাম। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলাম, বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম বাড়ির সামনে শোরগোল পড়ে গেছে। ভাড়টেরা সব উত্তেজিত ভাবে কি সব বলাবলি করছে। ডঃ বোস এর ঘরের সামনে থেকে একটা প্রচণ্ড পচা দুর্গন্ধ বেরচ্ছে। ভবতোশ বাবু বললেন– “আপনি যে ছেলেটিকে বরফ রাখার জন্য বলেছিলেন সে দ্বিতীয়বার বরফ রাখতে গিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু দেখে পালিয়ে যায়, আর আসেনি। তারপরই ডঃ বোস দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন আর খোলেননি। ঘরেরে থেকে হাল্কা জল পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। ভবতোশ বাবুকে বললাম “দেখুন এখন দরজা ভেঙ্গে ফেলা ছাড়া আমদের আর কোন উপায় দেখছি না”।
তিনি বললেন “দাঁড়ান আমি একটা শেষ চেষ্টা করে দেখছি”।
উনি একটি সরু জি আই তার নিয়ে এসে কিছুক্ষনের চেষ্টায় দরজা খুলে ফেললেন। ঘরে ঢুকেই একটা পচা বিকট গন্ধে আমদের সকলের বমি চলে এল। কোনো রকমে নাকে রুমাল চেপে ঘরে ঢুকলাম। ঘরের সব দরজা জানালা গুলো খুলে দিলাম। ঘরের মধ্যের সেই হিমশীতল পরিবেশ এখন আর নেই। বরং প্রখর সূর্যের তাপে ঘরগুলো বেশ গরম। কিন্তু কোথায় ডঃ মনোজ বসু। তার তো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না ঘরের মধ্যে।
“যাঃ বাবা দিনে দুপুরে লোকটা বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেল নাকি?” ভবতোশ বাবু বললেন।
সত্যি ভারি আশ্চর্যের বিষয়, গেলেন কোথায় ভদ্রলোক? আমি ঘরের এদিক ওদিক দেখতে গিয়ে দেখলাম এক জোড়া কালো আঠালো পায়ের দাগ বাথরুমের কাছ থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজার কাছে থেমে আবার ঘরের একপাশের একটা ডেস্কের কাছে শেষ হয়েছে। এখানেও কিছুটা জলের সঙ্গে আঠাল কালো দুর্গন্ধময় জিনিস পড়ে আছে। ডেস্কের উপর একটা রাইটিং প্যাডে আঁকাবাঁকা অক্ষরে কি যেন লেখা, দেখলে মনে হয় কোন অন্ধ মানুষের লেখা। কাগজটাতেও আঠালো দুর্গন্ধময় দাগ লেগে আছে। এরপর চোখ পড়লো পাশের হাতল উচু গদি চেয়ারটার দিকে, সেটার দিকে তাকিয়ে ভীষন আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। সেটা এতক্ষন পিছন দিকে ফেরানো ছিল বলে চোখে পরেনি। বাড়িওলা আর মেকানিক দুজন ভীষন আতঙ্কে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কাগজের উপর আঁকাবাঁকা অক্ষরে যা লেখা ছিল, বিশ্বাস কর এত বছর বাদেও তা ভাবতে গিয়ে আমি শিউরে উঠি। আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা, “আমার শেষ সময় আসন্ন, বরফ রাখতে এসে ছেলেটি আমাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে। সে আর আসবে না আমি জানি। আর বরফ ও আমার কিছু করতে পারবে না। ঘরের তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, আমার দেহের মাংসপেশী গুলো সেই উত্তাপ সহ্য করতে পারছেনা। সেদিন আপনাকে যা বলেছিলাম এবার নিশ্চয়ই আপনি তা বুঝতে পারছেন। আমার আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে মানুষের দেহকে মৃতুর পর কৃত্রিম উপায়ে সংরক্ষিত করলে তাতে পুনরায় প্রানের সঞ্চার করা যায়। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক অবক্ষয়কে রোধ করা যায় না। আমার আবিষ্কৃত পদ্ধতির আশ্রয় নিলে সেই অবক্ষয় ধীর গতিতে আসে। আমার আবিষ্কারের এই বিষয়টি আমি ভেবে দেখিনি আমার বন্ধু ডঃ রায় কিন্তু ব্যাপারটি জানতেন। সেই আঘাতই তার মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়ায়। তাকে আমি যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। আমি তাকে ডাইরিতে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেই মতো তিনি আমাকে নিয়ে গেছিলেন এক অন্ধকার ল্যারেটরিতে। তারপর বিভিন্ন রাসায়নিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে আমাকে আবার জাগিয়ে তুললেন। কিন্তু আমার দেহের সব যন্ত্রগুলো আর কাজ করলো না। তাই ঠান্ডা পরিবেশে আমার আবিষ্কৃত রাসায়নিকের সাহায্যে আমার দেহকে কৃত্রিম ভাবে সংরক্ষিত করতে হল কেননা আজ থেকে আঠারো বছর আগে স্বাভাবিক ভাবেই আমার মৃত্যু হয়েছিল।”
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ গল্পটি এইচ পি লাভক্র্যাফটের “কুল এয়ার” থেকে অনুপ্রাণিত। মূল গল্পটি ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে Tales of Magic and Mystery ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।
Tags: এইচ পি লাভক্র্যাফট, দীপাঞ্জন মুখার্জী, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সূর্যোদয় দে, হিমশীতল