হুয়ানের বইটা
লেখক: বিকাশ বিশ্বাস
শিল্পী: সুমন দাস
কুয়াশায় চারদিক জড়িয়ে থাকলেও সকাল সকাল প্লেন ধরবার তাড়া ছিল। ঘুম থেকে উঠেই তৈরী হয়ে ছুটলাম। ঘুম চোখেই এয়ারপোর্টের তিন নম্বর টার্মিনালের গেট ঠেলে ঢোকবার আগে মনে হল পুরো জায়গাটা আবছা সাদা পর্দায় কেউ ঢেকে দিয়েছে। গেটে আইডেন্টিটি চেক-এর পর ঢুকে পড়লাম ভেতরে। সিকিওরিটি চেক, লাগেজ ফাগেজের ঝামেলা মিটিয়ে লাউঞ্জের দিকে এগোতে থাকলাম। এখন একটা কড়া কফি চাই। ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাতে হবে।
কফিশপের কাছে গিয়ে কফি অর্ডার করে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সকাল সকাল আমারই মতো কিছু লোক এসেছে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে বসে আছে, প্লেন ধরবে বলে। এই এয়ারপোর্ট জায়গাটা বেশ মজার। কত লোক আসে কত জায়গা থেকে। এখানে এসে কিছুক্ষণ থাকে আবার কোথায় কোথায় চলে যায়। কেউ কারোর কথা জানতেও পারে না। একটা পয়েন্টে এসে একে অপরের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া। মহাবিশ্বের স্থান-কালে একটা বিন্দু, একটা ক্রসিং পয়েন্ট মাত্র। মনে হলেই অদ্ভুত একটা ফিলিং হয়, একটা বিন্দু মাত্র! জাষ্ট একটা ডট।
দাম দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ নিয়ে বসার জায়গাটার দিকে এগোলাম। ফ্রী নিউজ পেপার ষ্ট্যান্ড থেকে আজকের একটা খবরের কাগজ তুলে নিয়ে রিষ্ট ওয়াচে দেখলাম ছ-টা চল্লিশ। এবার একটু আয়েশ করে বসে কফি খাওয়া যাবে। আমার প্লেন আসতে এখনও সময় আছে, সাতটা তেত্রিশ। কাঁচে ঢাকা এনক্লোজারের ওপারে রানওয়ে, কুয়াশা ঢাকা। কুয়াশার ভেতর কিছু প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। সাদা ঘন কুয়াশার ভেতর প্রাগৈতিহাসিক কোনও যুগের যান্ত্রিক পাখি যেন সব। যেন কোনও কিছুর নির্দেশের অপেক্ষায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। পুরো পরিবেশটার মধ্যে বেশ একটা রহস্যের ছোঁয়া আছে। আর একটু বাদেই কুয়াশা কেটে গিয়ে ওখানে একের পর এক প্লেনের ওঠা-নামা শুরু হবে। রানওয়ের ওপর প্লেনের ওঠা-নামা দেখতে আমার বেশ লাগে।
সামনের দিকের বসার জায়গাগুলো খালি। কফির কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে আরও একটু এগিয়ে সামনের দিকে গিয়ে একটা চেয়ারে গিয়ে বসি। বাঃ কফিটা বেশ! সকালবেলায় এরকম একটা কফি সারাদিন চনমন করে রাখে। দিনটা শুরু হওয়াই উচিৎ এইরকম কফির স্বাদে! পেপারটায় চোখ বোলাতে থাকলাম। রাজ্যের, বিশ্বের সব খবর। বেশীরভাগই সেই চর্বিত চর্বণ। ইন্টারন্যাশনাল সেকশানে, বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যার বেড়ে যাওয়ার কথা। বর্ডারে বর্ডারে মানুষের ভিড় বাড়ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অস্থিরতায় রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে আলোচনা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে টেররিস্ট সংগঠনগুলোর অ্যাক্টিভিটির নতুন নতুন দিক। সবই মানুষের অসহনীয়তা, অসহায়তার খবর। একই পাতায় ডানদিকের কলামে বিশ্বখ্যাত দাবাড়ুর নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রায় প্রতিদিন আরও উন্নত হয়ে উঠতে থাকা কম্পিউটারের সঙ্গে। মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে মানুষেরই তৈরী যান্ত্রিক মস্তিষ্কের। সুদূর অতীতের পৃথিবী থেকে কোনও এক অন্য পৃথিবীর দিকে আমরা চলেছি নিজেদের অজান্তেই। ধীরে ধীরে বহু লোকের অগোচরে যে পরিবর্তন তার সম্বন্ধে কোনও ধারণাই কি আমরা করতে পারছি! নাকি … নাঃ বিবর্তন অমোঘ! সময়ের চরিত্র অদ্ভুত! কফিতে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকালাম। বেশ চনমনে লাগছে, ঘুমঘুম ভাবটাও কেটে গিয়ে শরীরে একটা তরতাজা ভাব আসছে।
সকালের সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশাও একটু একটু করে কাটছে। রানওয়ের ওদিকটায় বেশ ঘন সবুজের আভাস। রিস্টওয়াচে ঘড়ির কাঁটা সাতটা পনেরো ছুঁই ছুঁই। সময় এগিয়ে আসছে। কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখে, শূন্য কফির কাপটা সামনের ডাষ্টবিনে ফেলে আসার জন্য উঠলাম। বাইরে সকাল স্পষ্ট হয়ে উঠছে! কুশায়া আস্তে আস্তে সরে গিয়ে ফুটে উঠছে সব কিছু। একটু একটু করে রোদ এসে পড়েছে ঘন সবুজ রানওয়ের ওপর। বাঃ চোখ জুড়িয়ে যায়। হোয়াট! কী হল? কিছু ভুল দেখছি? আরে! রানওয়ের ওপর সবুজ আসবে কোত্থেকে? এক ঝটকায় পুরো শরীর টানটান হয়ে গেল।
পূবদিকে সূর্যের আলো ফুটেছে, সেই আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিশাল রানওয়েটা জুড়ে সবুজ অচেনা গাছগাছালি আর ঘাস! রানওয়েটার মাঝে মাঝে ফাটাফুটি। যেন কবেকার পুরনো, পরিত্যক্ত একটা রানওয়ে। কতদিন যেন এভাবেই পড়ে আছে। ঘুরে তাকালাম। কেউ কোত্থাও নেই! আমি কতগুলো জং ধরা ভাঙাচোরা চেয়ারের মধ্যে, কবেকার একরাশ ধুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।
একি! এখানে আমি এলাম কী করে? এ কোথায়? ছুটে গেটের দিকে গেলাম। আমার পায়ের আওয়াজ পুরো জায়গা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হল। গেটের দরজা বন্ধ, জং ধরা। এঁটে মাটির মধ্যে বসে গেছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না! কী হচ্ছে! ঘুরে আবার এপাশে এলাম। কফিশপ আউটলেটটার ধ্বংসাবশেষে একটা কঙ্কাল, নারী দেহের। কাউন্টারের ওপর হেলে আছে। বুক হিম হয়ে গেল। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না! হচ্ছেটা কী? আরে! মাথা ভোঁ ভোঁ করছে মনে হচ্ছে এক্ষুনি পড়ে যাব। হাতের পেপারটা কোথায় গেল? বসার জায়গাটায় চেয়ারগুলোর ওপর যেখানে একটু আগেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু লোক বসে ছিল সেখানে এখন বিগত কোনও যুগের মানুষের কঙ্কাল সব। গায়ে মাকড়সার জাল আটকে আছে। মাথায় একটা ঘোলাটে… টলে যাচ্ছি! আরে! একটা ভাঙাচোরা কোনও কিছুর জং ধরা হাতল ধরে নিজেকে সামলালাম। চারদিকেই জং ধরা, ধুলো ভর্তি চেয়ার, শাটার, কাউন্টার …। সব কবেকার পুরনো। সব আবছা অন্ধকারে ঢাকা। কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা! কী করে… কিন্তু কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে এই দৃশ্যটা? আঃ মনে করতে পারছি না! মনে হচ্ছে কোথায়… কোথায়… সারা শরীর দরদর করে ঘাম হচ্ছে। ছুটতে আরম্ভ করলাম। এখান থেকে বেরোবার রাস্তা বের করতে হবে। একটার পর একটা দরজার দিকে ছুটে গেলাম, কিন্তু কোনও দরজাই তো খুলবে না। ভেঙে জং ধরে আটকে বসে গেছে সেই কোনও এক প্রাচীনকালে! খুব জলতেষ্টা পেয়েছে। চারদিকে সবই খটখটে শুকনো। গলা শুকিয়ে আসছে! নাঃ মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মাথা ঠান্ডা রাখা খুব দরকার। এভাবে হবে না। কী করা যায়? আগের জায়গাতে ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু কোথায় দেখেছি এই একই দৃশ্য? বার বার মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি! কোথায় দেখেছি! হুবহু একই দৃশ্য! কোথায়? কোথায় যেন? এক বিন্দু নড়চড় হওয়ার উপায় নেই এমন হুবহু মিল! কোথায়? কোথায়? আঃ! ইয়েস! ইয়েস! মনে পড়েছে! আরে! এখানে! আশ্চর্য! হ্যাঁ ঠিক এই দৃশ্য! একই! মনে পড়েছে!
আগের আগের দিন, অনেক রাত্রে হুয়ান একটা বই দেখিয়েছিল। হোটেলের রুমে অনেক রাত অবধি ভরপুর মদ খাওয়া, তাস খেলা আর প্রচুর আবোল তাবোল বকবক করার পর হঠাৎ কী যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়েছে এইভাবে প্যান্টের হিপপকেট থেকে একটা পেপারব্যাক বই বের করে, আমার দিকে আরও খানিকটা কাছে সরে এসে, গোপন কিছু দেখাচ্ছে এমন করে বইটা দেখাল। ফিসফিস করে বলল “এটার কথাই তোমায় বলছিলাম”।
এইবার মনে পড়ে গেছে! বইটার ভেতরে হালকা বেগুনী নীলচে পাতায় একটু ছোট অক্ষরে, ঠাস বুনোট ছাপায় লেখা। প্রায় সওয়া পাঁচশ কি ছ-শ পাতার একটা নিরীহ দেখতে বই। এই বই নাকি হুয়ানের মতে অতীত ও ভবিষ্যতের চাবি। বইটার মলাটে হিজিবিজি কিছু অক্ষরের মতো জলছবি আর পেন্ডুলামের মতো একটা ঘন্টার ছবি দেওয়া, রঙিন প্রচ্ছদ। হাতে নিয়ে উল্টে দেখছিলাম। প্রকাশকের নাম উদ্ভট টাইপের। কস্মিনকালেও কোনওদিন শুনেছি বলে মনে হল না। এই বইটাই হুয়ান আমাকে পড়তে দিয়েছিল, একটা শর্তে। এক রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে এবং টানা পড়ে যেতে হবে। দাঁড়ি-কমা ছাড়া কোথাও থামা চলবে না। আমি প্রথমে রাজী হচ্ছিলাম না কিন্তু হুয়ান বলল, “তুমি বলেই দিচ্ছি, নাহলে এই বইয়ের কথা আর কেউ জানেই না।” “আমাকেই বা দিচ্ছ কেন?”, জানতে চাইলাম আমি। “ব্যাপার আছে! তোমার মতো একজন পলিগ্লট যখন হাতের কাছেই আছে, বুঝলে… তোমাকে পড়িয়ে রাখছি।” ফিসফিসিয়ে চাপা গলায় হুয়ান বলেছিল। ওর কণ্ঠস্বরে কিছু একটা ছিল। মনে হল এখনও শুনতে পাচ্ছি!
বইটা কোনও একটা ভাষায় লেখা নয় এবং অদ্ভুত সব শুরু আর শেষ এক একটা অধ্যায়ের। অবশ্য শেষ কিনা বলা মুশকিল। কোনও অধ্যায় হয়ত পুরোটাই লেখা স্প্যানিশে আবার অন্যটা হয়ত সংস্কৃতে এবং ল্যাটিনে। বইটার লেখকের নাম মনে পড়ছে না। হয়ত লেখকের কোনও নাম নেই, বা হয়ত কারোর একার লেখা নয়। কে জানে! তবে ভাগ্যিস পেশার সুত্রে যে দু-চারটে ভাষা জানি তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে গোটা বইটা কোনওমতে পড়ে উঠতে পেরেছিলাম। অদ্ভুত অসাধারণ, চমৎকার আর গ্রোটেস্ক মিশিয়ে এক অভিজ্ঞতা। ভাষায় ঠিক বুঝিয়ে বলা যায় না। হ্যাঁ সেই বইতেই তো ঠিক হুবহু এরকম একটা দৃশ্য ছিল! হ্যাঁ হ্যাঁ কী যেন – আরে! বইটাতো আমার সঙ্গেই ছিল! কোথায় যেন? বইটাতো ইন ফ্যাক্ট আমার সঙ্গেই নিয়ে আসার কথা। হ্যাঁ ঠিক মনে আছে! বেরোবার সময় বইটা মনে করে আমি ব্যাগের ভেতর নিয়ে ছিলাম। কোনও ভুল হওয়ার কথাই নেই! কিন্তু ব্যাগটা কোথায় গেল?
হুয়ান খুব সাবধান করে, বারবার করে কানের পাশে ঘ্যানঘ্যান করে মনে করিয়ে দিয়েছিল বই ফেরত আনার কথা। “আর কাউকে দেখিও না বইটা”। একথাও বারবার করে বলে দিয়েছিল। “কিন্তু ধর যদি হারিয়ে যায়?”, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। “কক্ষনো না! তাহলে কিন্তু সর্বনাশ! খুব সাবধানে রাখবে!” “কিন্তু তাও ধরো যদি…” “আমি অনেকগুলো ফটোকপি করে রেখেছি, কালারে। ঠিক যেমনটা, তেমনটা। থ্যাংক্স টু মডার্ণ টেকনোলজি, হুবহু বইটাই। রেখে দিয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন দেশে, এমনকি ব্যাঙ্কের লকারে –” “আসলটাই তো রাখতে পারতে?” “ব্যাপার আছে, দেখাতে হবে একজনকে, বুয়েনস আইরেসে। তারপর রাখবো। আর সময় নেই। তা না হলে কি… ”, বলে একটু মুচকি হেসেছিল হুয়ান। “নিয়ে আসতে ভুলো না কিন্তু বইটা, তুমি তো আসছে সোমবার বুয়েনস আইরেসেই আসছ!… তাইতো?” “হুম! প্রথমে ওখানে, তারপর ওখান থেকেই কিন্তু যাওয়া হবে। পৌঁছেই কোনও হোটেলে উঠছ সেটা আমাকে জানিয়ে দিও!” “ওক্কে! আপাততঃ বিদায় তাহলে… দেখা হচ্ছে!” বলেই দ্রুত পায়ে হুয়ান হাত নাড়তে নাড়তে রাস্তা ক্রস করে চলে গেল।
ঠিক! এইসব যা যা ঘটেছে মনে পড়ে যাচ্ছে! কিন্তু বইটা কোথায়? বইটা তো পেতেই হবে। হুয়ানকে ফেরত দেওয়া তো পরের কথা, আগে তো দৃশ্যটাকে মেলাতে হবে! হুবহু ঘড়ির কাঁটার মতো করে। নাহলে হবে না। ওটাই আমার এখান থেকে বেরোবার চাবি! ঐ বইটাই! যে বইতে প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছিল এক বুড়োর কথা বলা দিয়ে – “ফ্যান্টাসিতে ভাসিও নাগা! চলমান মৃতদের থাকে না হুঁশ! চোখ খোলার সূত্রে করো না ভুল! স্বপ্ন তো তৈরী হয় বুকের পাঁজরে আগুন ধরিয়ে আর সত্য দিয়ে। দিক নির্দেশ নিতে হবে সাবধানে বুঝে! যখন পশ্চিমাকাশে অস্ত গেছে সূর্য আর আকাশে ভেসে উঠেছে নক্ষত্র, মৃত আর সদ্য জন্মান তারারা।” বইটা খুঁজে পেতেই হবে! আর সময় নেই! বইটা গেল কোথায়?
Tags: তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, বিকাশ বিশ্বাস, সুমন দাস, হুয়ানের বইটা