হরিপদবাবু ও ম্যাক্রোকসম গ্রহের অধিবাসী
লেখক: এস. সি. মন্ডল
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
রোজকার অফিস শেষে লোকাল বাসে ঝুলে যানজট পেরিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হরিপদবাবু যখন বাড়ি পৌঁছালেন, ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। এমনিতেই চাকরি করতে ভালো লাগে না হরিপদবাবুর, তার উপরে আজকে আবার অফিসের বড়োবাবুর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ছিল। সেটা অবশ্য প্রতিদিনই থাকে, তবে আজকে শেষ বিকেলে কাজকর্ম শেষ করে হরিপদবাবু যখন খবরের কাগজে বিজ্ঞানীদের নতুন একটা বসবাসযোগ্য গ্রহ খুঁজে পাওয়ার খবরটা পড়ছিলেন ঠিক তখনই ব্যাপারটা বড়োবাবুর চোখে পড়ে যায়। সেসময়ে কিছু না বললেও অফিস শেষে হরিপদবাবু যখন বের হব হব করছেন, তখন আচমকা বড়োবাবু ডেকে পাঠালেন। তারপর দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে হরিপদবাবু অফিসে কী কাজ করেন সেই ফিরিস্তি নিলেন। তারপর মনের মাধুরী মিশিয়ে একরাশ উপদেশ দিয়ে যখন ছাড়লেন ততক্ষণে হরিপদবাবুর অফিসের বাস চলে গেছে।
অফিসে বড়োবাবুর ধাতানি আর লোকাল বাসের ধাক্কা গুঁতো খেয়ে হরিপদবাবুর মেজাজ গেল বিগড়ে। বছরের এই সময়টাতে এমনিতেই হালকা গরম পড়া শুরু করেছে। একটু হাঁটলেই গায়ে চিটচিটে ঘাম জমছে, শীত শীত লাগছে আবার গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরে জামা কাপড় ছেড়ে গিন্নিকে ডেকে এক কাপ চা দিতে বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে হরিপদবাবু আবার সেই খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন। ভিনগ্রহের খবরাখবর ব্যাপারে হরিপদবাবুর মনে ছোটোবেলা থেকেই বেজায় আগ্রহ। আজ খবরটা পড়তে পড়তে হরিপদবাবু ভাবলেন ভিনগ্রহে চলে যাবার সুযোগ পেলে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে তিনি নির্ঘাত চলে যাবেন। ভিনগ্রহের জীবনটা কেমন হতে পারে সেই ভাবনাটা সবেমাত্র হরিপদবাবুর মনে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে এমন সময় চিঁ চিঁ করে গিন্নি ছুটে এল। গিন্নির গলা তো নয়, যেন ফাটা বাঁশের বাঁশি। সেই গায়ে হুল ফোটানো চিঁ চিঁ স্বরে গিন্নি বলল—বলি অফিস থেকে এসে কী শখে শুয়ে পড়লে? চা যে বানিয়ে আনব, সে কী হাওয়া থেকে? সকালবেলা যে বাজারের লিস্টি দিয়েছিলুম তা কি গুলে খেয়েছ? বলি লজ্জা করে না? সারাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি করে, আবার বাসায় এসে হাত-পা ছড়িয়ে আয়েশ করতে?
গিন্নির ধাতানি খেয়ে হরিপদবাবু চুপচাপ উঠে পড়লেন। সারাদিন অনেক হ্যাপা সামলেছেন। আর না। জীবনটা যদি সিনেমা হত তবে এখনই হয়তো তিনি সংসার ছেড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো নির্বাণের খোঁজে বেরিয়ে পড়তেন। কিন্তু জীবন তো আর সিনেমা নয়! তাই গায়ে একটা জামা চড়িয়ে, বাজারের লিস্ট আর ব্যাগ হাতে বাসা থেকে বের হইয়ে পড়লেন।
হাঁটতে হাঁটতে গলির মুখে চায়ের দোকানটার সামনে আসতেই কে যেন ডাক দিল—আরে হরিপদ না? বলি এত রাতে কোথায় যাচ্ছ ভায়া?
হরিপদবাবু খেয়াল করে তাকাতেই দেখলেন তার বন্ধু ও প্রতিবেশী অমলবাবু। তিনি একবার ভাবলেন উত্তর না দিয়ে চলে যাবেন, কিন্তু তা আর হল না। অমলবাবু জোর করে ডেকে বসিয়ে দোকানদারকে চা দিতে বলে জিজ্ঞেস করলেন—কি ভায়া আজ আবার গিন্নি বের করে দিয়েছে বুঝি? বলি তুমি কী করে পারো ভায়া এমন আগ্নেয়গিরি নিয়ে সংসার করতে?
অমলবাবু তার প্রতিবেশী, তাই সংসারের হাল কমবেশি জানেন। তাই বলে এমন চায়ের দোকানে বসে সবার সামনে খোঁটা দেওয়াটা হরিপদবাবুর পছন্দ হল না। চাইলে অমলবাবুকে পালটা দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু সেই ইচ্ছেও তার হল না। কোন উত্তর না দিয়ে, কাপের চায়ে একটা চুমুকও না দিয়ে হরিপদবাবু উঠে পড়লেন।
২
বাজারে এসে হরিপদবাবু ঘুরে ঘুরে একটা দোকানে গিয়ে লিস্ট ধরে ধরে সবকিছুর অর্ডার দিলেন। কিন্তু কথায় বলে না, খারাপ সময় একা আসে না। সবকিছু ব্যাগে ভরে দাম দিতে গিয়ে হরিপদবাবু দেখলেন ভুলে মানিব্যাগটাই নিয়ে আসেননি। অপরিচিত দোকানদার। কাজেই বাকি দেবার প্রশ্ন আসে না। ব্যাগ ভরতি বাজার দোকানে রেখে, হরিপদবাবু বাসার দিকে রওয়ানা হলেন মানিব্যাগ নিয়ে আসতে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক চিন্তা খেলা করে যাচ্ছিল হরিপদবাবুর মাথায়। বারবার মনে হচ্ছিল সেই অবিবাহিত জীবনের কথা, ছাত্র জীবনের কথা। কতই না সুখের জীবন ছিল! এরপর চাকরিতে ঢুকলেন, বিয়ে করলেন। যতই চিন্তা করছিলেন, রাগে দুঃখে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল তার। বাড়ির গলির সামনে আসতেই দেখলেন অমলবাবু এখনও চায়ের দোকানেই বসে আছেন, সঙ্গে আরও দু-একজন জুটেছে। কথাবার্তার মাঝে দুয়েকবার নিজের নামটা শুনে বুঝলেন তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। তাই ক্ষোভে দুঃখে আবার উলটো পথ ধরলেন হরিপদবাবু। না এমন জীবন রাখার কোনো মানে হয় না!
রাগের মাথায় শহরের রাস্তা ধরে এলোমেলোভাবে হাঁটতে হাঁটতে হরিপদবাবু চলে এলেন ময়দানের মাঠের সামনে। এমনিতে এদিকটাতে রাতের বেলায় কেউ আসে না। চুরি ছিনতাই এর ভয়ে। কিন্তু আজকে হরিপদবাবু ভয়শূন্য। মনে খানিকটা বিবাগী ভাব চলে এসেছে। এর মাঝে আকাশে এক মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে, আর সেই আলোয় বিশাল মাঠটা যেন পরিণত হয়েছে জ্যোৎস্নার সমুদ্রে। জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গেল হরিপদবাবুর। মাঠের ভিতরে এক ঝোপের ধারে একটা ইটের পাঁজা দেখে সেটার উপর বসে পড়লেন।
জ্যোৎস্নালোকিত খোলা প্রান্তর, মৃদু মন্দ দখিনা হাওয়া, ওদিকে পেটে ক্ষুধা, দুপুরের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি। এমন অবস্থায় স্বভাবজাতভাবেই বাঙালি দার্শনিক হয়ে ওঠে। হরিপদবাবুর বেলায়ও তার ব্যতিক্রম কিছু হল না। ইটের পাঁজার উপর বসে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হরিপদবাবুর মনে হল—‘এই যে মনুষ্য জীবন, কী তার মানে?’ তিনি ব্যাপারটা নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়ে গেলেন। শেষে অনেক ভেবে ভেবে হরিপদবাবু এক চূড়ান্ত দার্শনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন—‘মনুষ্য জীবন মানেই হল কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ানো।’ তারপর আর একটু চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে শুধু মানুষ না, সকল প্রাণের উদ্দেশ্যই হল সারাজীবন ধরে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ানো। যেমন একটা কুকুর সকাল থেকে একটাই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে—কোথায় গেলে খাবার পাব? মানুষও তাই। কেউ খোঁজে খাবার, কেউ খোঁজে সাফল্য, বেকার খোঁজে চাকরি, অবিবাহিত খোঁজে জীবন সঙ্গী আর বিবাহিত মানুষ খোঁজে শান্তি।
নিজের কথা ভেবে দেখলেন। সেই সকাল থেকে কত কত প্রশ্নের মুখে পড়তে হল তাকে। অফিসে কী করেন? কাজ করেন না, তো অফিসে আসেন কেন? বাজার নিয়ে আসোনি, তো চা খেতে চাও কেন? এমন বউ নিয়ে সংসার কীভাবে কর? এমনকি নিজেও নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, এত কিছুর পরেও বেঁচে আছেন কেন? এত এত প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই!
বাড়ি ফিরলেই আবার শুরু হবে প্রশ্ন, অফিসে গেলে দিতে হবে প্রশ্নের উত্তর। এই প্রশ্ন আর তার উত্তরের খোঁজ এর কি কোনো শেষ আছে? কেউ কি পেরেছে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে? মনে হয় না। তারপর তার মনে হল—আসলে সব প্রশ্নের কি উত্তর হয়? সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে কি জীবন এমনই থাকে? এই সব ভাবতে ভাবতে বসা অবস্থা থেকে সেই ইটের পাঁজার উপর শুয়ে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লেন হরিপদবাবু।
৩
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন মনে নেই, আচমকা একটা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে গেল হরিপদবাবুর। প্রথমটায় ভাবলেন কোনো গাড়ির হেডলাইট বুঝি। কিন্তু সমস্যা হল আলোটা আসছে উপরের দিক থেকে। আকাশে যদিও চাঁদ আছে, তবে এই আলোটা চাঁদের আলোর মতো মোলায়েম নয়। কেমন একটা হুল ফোটানো ভালো আছে।
একহাতে চোখ ঢেকে একটু ভালোমতো আলোর উৎসটা খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি বুঝলেন আলোটা স্থির নয়। আলোটা ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছে মাঠের উপরে। হরিপদবাবু একবার ভাবলেন, হেলিকপ্টার নাকি? এদিকটাতে মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার নামে বটে, কিন্তু হেলিকপ্টার হলে তো শব্দ হত, আর এটার কোনো শব্দ নেই।
আলোটা ক্রমে ক্রমে নীচে নেমে হরিপদবাবুর থেকে হাত বিশেক দূরে মাঠের উপর স্থির হল। তারপর আলোর তীব্রতা কমে এল। তীব্র আলোর বদলে একটা হালকা মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে এবার। সেই আলোতে যে জিনিসটা দেখা গেল সেটা কোনো হেলিকপ্টার নয়। অবিকল এমন না হলেও, এই রকম দেখতে জিনিস হরিপদবাবু এর আগে দেখেছেন। দেখেছেন নানা রকম হলিউডি বলিউডি সিনেমায় আর ম্যাগাজিনে। একটু ভাবতেই নামটাও মনে পড়ল, হ্যাঁ একে বলে উড়ন্ত চাকি, মানে কিনা ফ্লাইং সসার ওরফে UFO। মানে কিনা ভিনগ্রহীদের নভোযান!
উত্তেজনায় শিহরিত হলেন হরিপদবাবু। একটু একটু ভয় করলেও, ভয়ের চেয়ে কৌতূহলটাই বেশি হচ্ছে। কোনো এক বইয়ে পড়েছিলেন যে ভিনগ্রহীরা ভালোও হতে পারে আবার নির্মম নিষ্ঠুরও হতে পারে। কি আছে আজকে তার কপালে কে জানে? এক দৌড়ে পালাবেন কিনা ভাবলেন। পরক্ষনেই নিজের গিন্নির কথা মনে হতে, দৌড়ে পালানোর চিন্তা বাদ দিলেন। গিন্নির থেকে ভিনগ্রহী ভালো।
যা আছে কপালে মনে মনে এই চিন্তা করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মিনিট দুয়েক নিঃশব্দে কেটে গেল। এরপর চিং করে একটা শব্দের সঙ্গে একটা গোলমতো ঢাকনা খুলে চাকির ভিতর থেকে একটা প্রাণী বেরিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে হরিপদবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল।
এবারে কিন্তু হরিপদবাবু ভয়ের বদলে বেশ কিছুটা অবাকই হলেন। টিভি সিনেমায় ভিনগ্রহী বলতে যেমন বোঝায় এ দেখতে একদমই তেমন না। এই ভিনগ্রহী দেখতে মানুষের মতোই। শুধু মাথার খুলিটা একটু বড়ো, চোখে পাতা নেই, আর হাতে তিনটে করে আঙুল। গায়ে চকচকে একটা পোশাক থাকলেও মৃদু নীলাভ আলোয় মুখ দেখে ভিনগ্রহীর গায়ের রংটা লাল বলেই মনে হল। হাতে তিনটে করে আঙুল না হলে হয়তো তিনি একে ভিনগ্রহী বলে বিশ্বাসই করতেন না। ভিনগ্রহী ততক্ষণে হরিপদবাবুর একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবারে হরিপদবাবুকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় সে বলল—মিস্টার হরিপদ, তোমার সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি?
৪
হরিপদবাবুর আবার একবার মনে হল, এটা কোনো বিচ্ছিরি রকমের মজা নয় তো? আজকাল তো এমন হামেশাই ঘটছে, প্রাংক না কী জানি বলে। কিন্তু ওই বিশ হাত দূরে দাঁড়ানো উড়ন্ত চাকি, হাতের তিন আঙুল, চোখের পাতা না থাকা—এ কীভাবে সম্ভব? আবার ভিনগ্রহী তার নামও জানে। এটা তো আরও অবাক করার মতো ব্যাপার। সম্ভবত সেটা বুঝতে পেরেই ভিনগ্রহী বলল—অবাক হয়ো না। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে আমি তোমার মনের ভাব বুঝতে পারছি, আর তোমার ভাষায় কথাও বলতে পারছি। আমি এসেছি কুড়ি আলোকবর্ষ দূরের ম্যাক্রোকসম গ্রহ থেকে আর আমার নাম ইনকংরুয়াশ, তুমি আমাকে কং নামে ডাকতে পারো।
ভিনগ্রহী কংয়ের কথায় হরিপদবাবুর ভয় কিছুটা কেটে গেল। তিনি বললেন—কং সাহেব, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
অবশ্য ভিনগ্রহী কংকে তিনি সাহেব কেন বললেন সেটা নিজেও বুঝতে পারলেন না। কং সাহেব অবশ্য সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, সে বলল—আমার একটা সাহায্য প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
ব্যাপারটা হরিপদবাবুর জন্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তার কাছে সচরাচর কোনো চেনা মানুষই সাহায্য চায় না, সেখানে একটা ভিনগ্রহীকে তিনি কীভাবে সাহায্য করবেন সেটা বুঝতে না পেরে দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন—সাহায্য করতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তোমার কী প্রয়োজন সেটা আগে জানা দরকার।
ভিনগ্রহী কং সাহেব তখন হরিপদবাবুর পাশে সেই ইটের পাঁজাটার উপর বসে পড়ে বলল—সে সব অনেক কথা, সব কথা বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে। তাই সংক্ষেপে বলছি।
আমাদের সভ্যতা তোমাদের চেয়ে অনেক অনেক উন্নত। সেটা যে কতটা বেশি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু কয়েকটা ছোটো উদাহরণ দিই। আজ থেকে সাড়ে চারশত বছর পূর্বে আমরা শক্তির চাহিদা মেটাবার জন্য একটা নক্ষত্রকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে সেখান থেকে শক্তি আহরণ শুরু করি। অফুরন্ত শক্তির জোগানের ফলে আমাদের গ্রহের খাদ্য, বিশুদ্ধ জল এই সবের চাহিদা মিটে যায়। আমাদের ওখানে এখন আর বেঁচে থাকার জন্য কাউকে কাজ করতে হয় না। এছাড়া জেনেটিক রিজেনারেশন প্রক্রিয়ায় আমরা প্রতি ত্রিশ বছর পরপর আমাদের পুরো শরীরকে নতুনের মতো করে নিই। তাই আমাদের গ্রহের সকল মানুষের শারীরিক বয়স এখন ত্রিশ আর দুর্ঘটনায় মৃত্যু না হলে আমরা অমর।
কং সাহেবের এর কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন হরিপদবাবু। কথার মাঝে কং সাহেব একটু থামতেই হরিপদবাবু আপন মনেই বললেন—এ তো মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের বর্ণনা শুনছি।
কং সাহেব খানিক ভেবে বললেন—সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সভ্যতার শুরুতে আমরাও স্বর্গ বলতে এমন কিছুই বুঝতাম। কিন্তু এখন এসে আমরা বুঝতে পারছি আমাদের সেই ধারণায় বেশ বড়োসড় ভুল ছিল।
হরিপদবাবু বিস্ময়-মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—কী বলছেন! এত সব থাকার পরেও সমস্যাটা কোথায়?
প্রশ্নটা শুনে কং সাহেব একটু ভেবে নিয়ে বলল—ব্যাপারটা বোঝাতে পারা একটু কঠিন। সমস্যাটা হল আমাদের সভ্যতার আর কোনো উন্নতি ঘটছে না। নতুন কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টি হচ্ছে না।
—সেটা আবার কীরকম?
কং সাহেব এবারে খানিক মাথা চুলকে বলল—আসলে এই ব্যাপারটা আমিও ঠিক বলতে পারব না। আমাদের গ্রহে আমরা মানুষেরা এখন আর কোনো কিছু চিন্তা করি না। আজ থেকে দুশো বছর পূর্বে আমাদের বিজ্ঞানীরা কৃষ্টি নামক এক আলট্রা সুপার হাইটেক কোয়ান্টাম কম্পিউটার সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের হয়ে সব কাজ, সব চিন্তা এই কৃষ্টিই করে দেয়। সেই কৃষ্টিই আমাদের জানিয়েছে যে আমাদের উন্নতি হচ্ছে না কারণ আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। আর নতুন প্রশ্ন না করার কারণে আমাদের মধ্যে নতুন কোনো দর্শন বা জ্ঞানের জন্ম হচ্ছে না।
হরিপদবাবু খানিক ভেবে নিয়ে বললেন—মনে হচ্ছে কিছুটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তোমরা যেহেতু এত উন্নত সভ্যতা তবে এক কালে নিশ্চয়ই তোমাদের অনেক দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিক ছিলেন। যেমন ধর আমাদের এখানে একজন কবিগুরু একাই এত কিছু সৃষ্টি করে গেছেন যে তার মৃত্যুর আশি বছর পরেও আমরা তার লেখার মধ্য থেকে নতুন নতুন দর্শন খুঁজে পাচ্ছি।
এর উত্তরে কং সাহেব বলল—সেসব এক কালে ছিল। কিন্তু এখন আর আমাদের কেউ সেসব পড়ে না।
—সেকি, কিন্তু কেন?
—তুমি সম্ভবত এখনো আমাদের অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারনি। আমাদের মানুষদের এখন আর নতুন কিছু জানার প্রতি, ভাবার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। কারণ আমাদের সকল চাহিদা মিটে গেছে। যা দরকার তার সবই আমরা না চাইতেই ঘরে বসে পেয়ে যাচ্ছি।
—তাহলে তোমরা অবসরে কী কর?
আলগোছে প্রশ্নটা করেই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন হরিপদবাবু। কং সাহেবের কথা মতো তার গ্রহের মানুষদের তো বেঁচে থাকার জন্য কিছু করা লাগে না, কাজেই তাদের কাছে আলাদা করে অবসর নামে কোনো শব্দ না থাকাই স্বাভাবিক। কং সাহেবও এই প্রশ্নটার কোনো উত্তর দিল না। তাই দেখে হরিপদবাবুই আবার বললেন—সমস্যাটা বেশ কড়া বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্যায় আমি কী করে সাহায্য করব?
৫
কং সাহেব এবারে বলল—তোমাকে তো আগেই বলেছি যে আমরা নিজেরা কিছু চিন্তা করি না, চিন্তা করার মূল কাজটা আমাদের আলট্রা সুপার হাইটেক কোয়ান্টাম কম্পিউটার কৃষ্টিই করে দেয়। আমাদের সভ্যতার এই সমস্যাটা ধরতে পেরে সেই কৃষ্টিই মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অন্যান্য সভ্যতাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে আর একসময় তোমাদের এই গ্রহটাকে খুঁজে পায়। তারপর আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্য সংগ্রহের জন্য আমাকে এখানে পাঠায়। আমি আমার নভোযানে করে তোমাদের গ্রহের চারিদিকে চক্কর কাটছিলাম, ঠিক তখনই নভোযানের রাডার তোমাকে সনাক্ত করে।
—এত এত লোক থাকতে তোমার রাডার আমাকেই খুঁজে পেল কেন?
—দেখ আমাদের গ্রহে মানুষদের মধ্যে কোনো অনুভূতি নেই। তারা এখন আর ভয় পায় না, কারো প্রতি রাগ হয় না, কারো প্রতি অভিযোগ নেই, অনুরাগ নেই। কিন্তু আমাদের প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা কোনো মানুষের মনে সৃষ্ট অনুভূতি বুঝতে পারি। সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আমি নভোযানে বসে একসঙ্গে অনেক মানুষের দিকে লক্ষ রাখছিলাম। সেসকল মানুষদের মধ্যে তুমিও ছিলে। আজকে সন্ধ্যার পর থেকে তোমার মনে ক্ষোভ, বিরক্তি, বিদ্বেষ, হতাশা, ভয়, কৌতূহল এই সব অনুভূতিগুলো একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকে। আর এই অনুভূতির বৈচিত্র্য দেখেই আমার নভোযানের রাডার তোমাকে হাই প্রায়োরিটি অবজেক্ট হিসেবে ধরে নেয়।
কং এর কথা শুনে হরিপদবাবু বললেন—দেখ কং সাহেব, আমি কিন্তু ওসব ভেবে চিন্তে করিনি। এই সকল অনুভূতি আর চিন্তা আমার মনে এমনিতেই বা বলতে পারো পারিপার্শ্বিকের প্রভাবেই তৈরি হয়েছিল। এই যেমন ধর অফিস থেকে ফেরার সময় আমার মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল আমার অফিসের বড়োবাবুর ব্যবহার আর রাস্তার যানজটের কারণে। তারপর বাড়ি আসতেই বউয়ের বকুনি শুনে বিরক্ত হলাম। চায়ের দোকানে গিয়ে প্রতিবেশীর বিদ্রূপ শুনে তার প্রতি বিদ্বেষ জন্মাল। ওদিকে বাজারে গিয়ে যখন দেখলাম মানিব্যাগ ফেলে এসেছি তখন হতাশ হয়ে পড়লাম।
কং সাহেব এবারে হরিপদবাবুর কথা শুনে নীরস কণ্ঠে বলল—এই পিছনের কারণগুলো আমরা মানে আমাদের যন্ত্রও কমবেশি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ওসবের চেয়েও বিস্ময়কর একটা ব্যাপার তোমার মধ্যে দেখা গেছে।
হরিপদবাবু ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন—কী সেটা?
—এইখানে এই ইটের পাঁজার উপর ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তোমাদের গ্রহের ওই একমাত্র উপগ্রহটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তোমার মনে এক অতি উন্নত দার্শনিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। মনের ভিতরে জমে থাকা ক্ষোভ বিরক্তি হতাশা সবকিছুকে অতিক্রম করে তোমার মনে এই দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব কী করে হল সেটা জানার জন্যই আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি সাহায্য করলে হয়তো আমাদের সভ্যতাকে আরেকবার বাঁচিয়ে তুলতে পারব।
কং সাহেব এর কথা শুনে হরিপদবাবুর একটা অদ্ভুত দুঃখবোধ হল। তিনি যেসব চিন্তা করেছেন সেগুলো নেহাতই অগোছালো চিন্তাভাবনা। অথচ কং সাহেবের যন্ত্রের কাছে সেগুলোকেই মনে হয়েছে অতি উচ্চস্তরের দর্শন। বিষণ্ণ কণ্ঠে তাই হরিপদবাবু বললেন—দেখ কং সাহেব, আমি তো কোনো দার্শনিক নই। তুমি যদি একজন সত্যিকারের দার্শনিকের কাছে এই প্রশ্নগুলো করতে তবে যোগ্য উত্তর পেতে।
কং সাহেব বলল—দেখ কী প্রশ্ন করা দরকার আর কাকে করা দরকার সেসবই আমাদের কৃষ্টিই ঠিক করে দিয়েছে। কৃষ্টির হিসেব মতে এই প্রশ্নের উত্তর একজন সাধারণ মানুষের থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। কারণ প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রহের মানুষদের চিন্তা করার ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছে, তাই গভীর তত্ত্বকথা তারা বুঝতে পারবে না বা গ্রহণও করতে পারবে না।
হরিপদবাবু ভেবে দেখলেন কৃষ্টি নামের কম্পিউটারটা হয়তো ঠিকই বলেছে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে যা বোঝেন সেগুলোই কং সাহেবকে বলবেন। সেটা কং সাহেবকে জানাতেই কং সাহেব বলল—তোমার কথা শুরুর আগে তুমি যদি অনুমতি দাও তবে তোমার কথাগুলো আমি আমার যন্ত্রে রেকর্ড করে নিতে চাই।
হরিপদবাবু সম্মতি দিলেন। কং সাহেব এবারে তার স্যুটের বুক পকেট থেকে নোট খাতার মতো দেখতে একটা যন্ত্র বের করে একটা সুইচ চেপে দিয়ে এমনভাবে বসল যেন মনে হল অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সে নোট করে নিতে চলেছে।
হরিপদবাবু দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে বললেন—দেখুন আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি যা বুঝি তাতে মনের ভিতর একটু দুঃখ কষ্ট, একটু না পাওয়ার অনুভূতি না থাকলে উন্নত চিন্তা বা দর্শন চর্চা ঠিক জমে না। অতি সুখে মানুষের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। ভরা পেটে কাব্য আসে না। কাব্য আসতে হলে পেটে ক্ষুধা থাকতে হয়। যেমন ধরুন ওই যে আমাদের গ্রহের একমাত্র উপগ্রহটাকে দেখছেন, ওটাকে দেখেই আমাদের একজন কবি লিখেছেন—“পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। ভরা পেটে থাকলে কী আর এমন একটা কালজয়ী শব্দ বন্ধ তিনি লিখতে পারতেন?
কথার মাঝে হরিপদবাবু চেয়ে দেখলেন তার কথার সঙ্গে সঙ্গে কং সাহেব বেশ মাথা নাড়িয়ে সায় দিচ্ছে। সেই দেখে আরও বলার আগ্রহ পেয়ে খুব বিজ্ঞের মতো করে হরিপদবাবু বলে চললেন—কিছু অপূর্ণ চাওয়া পাওয়া না থাকলে জীবন নিরস হয়ে যায়। আমাদের একজন গায়ক তার গানে বলেছেন, “সব পেলে নষ্ট জীবন”। বুঝলে কং সাহেব, জীবনে সব কিছু পাওয়া হয়ে গেলে জীবন নষ্ট হয়ে যায়।
কং সাহেব আবারো মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
—হৃদয়ে অনুভূতির জন্ম হতে হলে, বোধের জন্ম হতে হলে জীবনে প্রেম থাকতে হয়, প্রেমে ব্যর্থতা থাকতে হয়। ব্যর্থতাই মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে। নিজের ব্যর্থতার সময়ে, হৃদয় ভাঙার সময়ে মানুষ নিজেকে নিয়ে, নিজের চারপাশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখে। এই পৃথিবীরই এক মহান দার্শনিক বলে গেছেন—“হৃদয়ে ফাটল না থাকলে সেখানে আলো প্রবেশ করবে কীভাবে?” তাই হৃদয়ে আলোর প্রবেশের জন্য হৃদয়ে ফাটল থাকতে হয়। কথায় আছে মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। তাই না চাইতেই সব কিছু পেয়ে গেলে মানুষ সেটার মূল্য দিতে পারে না। কপাল পুড়লেই তখন মানুষ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে…।
কথা বলতে বলতে হরিপদবাবু নিজেও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছিলেন। আসলে তার নিজের মনেই যে এত কথা জমে ছিল সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। হয়তো এতকাল কেউ জানতে চায়নি সেকারণেই বলা হয়ে ওঠেনি। অথচ আজ একজন ভিনগ্রহীর কাছে নিজের মনে জমানো কথাগুলো অকপটে বলে চলেছেন। আর সেই ভিনগ্রহী কং সাহেব, সেও প্রবল আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনে যাচ্ছে আর নিজের নভোযানে পাঠিয়ে চলেছে। আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে হরিপদবাবু এইভাবে আরও টানা দশ মিনিট নানান দার্শনিক কথাবার্তা বলে গেলেন।
হয়তো আরও কিছু বলতেন, কিন্তু এমন সময় হঠাৎ করেই কং সাহেবের কানে লাগানো একটা যন্ত্রে আলো জ্বলে উঠল আর সেটা থেকে অংবং ধরনের সব শব্দ ভেসে এল। হরিপদবাবু বুঝলেন এটা কোনো এক ধরনের যোগাযোগ যন্ত্র আর তাতে হয়তো কোনো বিপদের আভাস দেওয়া হচ্ছে। কং সাহেব দ্রুত আশপাশে দেখে নিয়ে হরিপদবাবুর দিকে চেয়ে বলল—কৃষ্টি জানাল তোমাদের ডিফেন্স ফোর্স আমার নভোযানের আলো দেখতে পেয়ে এদিকেই আসছে। আমার হাতে আর বড়োজোর মিনিট দশেক সময় আছে। তাই তোমার যদি আরও কিছু বলার থাকে দ্রুত বলে ফেল।
হরিপদবাবু পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে বললেন—আর তেমন কিছু বলার নেই। তবে এতক্ষণ আমার কথা থেকে তুমি কী কী বুঝলে সেটা একবার বল দেখি।
কং সাহেব তক্ষুনি হাতের যন্ত্রটা দেখে নিয়ে বলল—শোন তবে আমি কী কী লিখে নিয়েছি।
১। মানুষকে তিন বেলা খেতে দেওয়া যাবে না। মাঝেমধ্যেই না খাইয়ে রাখতে হবে।
২। আকাশের কোনো একটি উপগ্রহকে রুটির মতো রং এবং আকার দিতে হবে।
৩। প্রেম করা এবং প্রেমে ব্যর্থতা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪। সকল মানুষের হৃৎপিণ্ডে অপারেশনের মাধ্যমে ফাটল তৈরি করতে হবে।
৫। মানুষের দাঁত ভেঙে দিতে হবেই, তবেই দাঁতের মর্ম বুঝবে।
৬। সেই সঙ্গে কপালও পুড়িয়ে দিতে হবে…
কং সাহেব আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু এই পর্যন্ত শোনার পর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন হরিপদবাবু। এই যদি হয় ভিনগ্রহী উন্নত জীবের বিচার বুদ্ধির নমুনা তাহলে কুড়ি আলোকবর্ষ দুরের ম্যাক্রোকসম গ্রহের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে সেই চিন্তা করে মনে মনে আতঙ্কিত বোধ করলেন তিনি। সেই সঙ্গে এটাও বুঝলেন যে নিজেরা চিন্তা না করতে করতে আজ তাদের এই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু সব কিছু ভালো করে বুঝিয়ে বলার জন্য এখন আর সময় নেই। তাই একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে হরিপদবাবু কং সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন—কং সাহেব, তোমাদের গ্রহের মানুষ কী বিয়ে করে ঘর সংসার করে?
কং সাহেব বলল—না, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সকল চাহিদা পূরণের বিকল্প ব্যবস্থা হবার কারণে আমাদের গ্রহের মানুষ এখন স্বাধীন এবং এককভাবে জীবন যাপন করে।
দূরাগত সাইরেনের শব্দটা ক্রমেই জোরালো হয়ে আসছিল। হরিপদবাবু বুঝলেন সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এবারে তাই জিজ্ঞেস করলেন—তোমাদের সুপার কম্পিউটার কৃষ্টির সঙ্গে কী আমাকে কথা বলিয়ে দিতে পারবে?
—হ্যাঁ, এখনি দিচ্ছি।
বলেই কং সাহেব আবার হাতের যন্ত্রের একটা বোতাম চেপে নিজের ভাষায় কী সব বলল। তারপরেই যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা যান্ত্রিক স্বর ভেসে এল
—প্রিয় হরিপদবাবু, আমার শুভেচ্ছা নেবেন। আমি কৃষ্টি। আমি আপনার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করছি।
হরিপদবাবু তখন বললেন—কৃষ্টি তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না, তুমি শুধু তোমাদের গ্রহে মানুষের বিয়ে করাটা বাধ্যতামূলক করে দাও। ওতেই হবে।
কং সাহেবের মুখ দেখে বোঝা গেল হরিপদবাবুর কথাটা সে একদমই বুঝতে পারেনি। সে জিজ্ঞেস করল—বিয়ে চালু করলে কী হবে?
হরিপদবাবু মুচকি হেসে বললেন—শোন কং সাহেব, অতি আহ্লাদে তোমরা সব অকর্মার ধাড়ি হয়ে গেছ। বিয়ের পর তোমার মতো অকর্মার ধাড়িগুলোকে বউ যখন কারণে অকারণে ধাতানি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবে, তখন দেখবে দার্শনিক না হয়ে আর কোনো উপায় নেই। তুমি হয়তো জানো না যে আমাদের এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিস বলে গেছেন “অবশ্যই বিয়ে করো। যদি একজন ভালো জীবনসঙ্গী পাও, তুমি সুখী হবে। আর যদি উলটোটা হয়, তুমি হবে একজন দার্শনিক।”
কং সাহেবের হাতের যন্ত্রটা থেকে এবারে কৃষ্টির গলা শোনা গেল, সে বলল—আমাদের সাহায্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় হরিপদবাবু। আপনার এই মহা মূল্যবান উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব। আপনার এই উপদেশ আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে, আর হয়তো আমাদের সভ্যতা আবার একটা নতুন সুযোগ পাবে।
সাইরেনের শব্দ এবার খুবই নিকটে এসে পড়েছিল। তাই কিছু বুঝুক বা নাই বুঝুক কং সাহেবও এবার উঠে দাঁড়িয়ে হরিপদবাবুর হাত ধরে বলল—তোমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ হরিপদবাবু। এবার তবে আসি।
বলেই কং সাহেব দৌড়ে গিয়ে তার নভোযানে উঠে মুহূর্তের মাঝে আকাশে মিলিয়ে গেল। কং সাহেবের নভোযানের আলোটা দেখতে পেয়ে দূর থেকে পুলিশের গাড়িগুলোও মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে ছুটতে শুরু করল।
কব্জির ঘড়িতে চেয়ে হরিপদবাবু দেখলেন রাত দুটো বাজতে চলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি গুটি গুটি পায়ে নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। কুড়ি আলোকবর্ষ দূরের ম্যাক্রোকসম গ্রহের অধিবাসীদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা হয়তো তার আর কোনোদিন জানা হবে না। তবে আপাতত তিনি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়োই চিন্তিত অনুভব করছেন। এত রাতে বাড়ি ফিরে গিন্নির ঝাঁটার বাড়ি থেকে কী করে বাঁচবেন সেটাই এখন তার কাছে বড়ো চিন্তার বিষয়।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, এস. সি. মন্ডল, মজার কল্পবিজ্ঞান