পালের কাশু পথ
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সে দিনটা ছিল বুধবার। মানে বুধবার যে ছিলই সে কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। বৃহস্পতিবার বা শুক্রবারও হতে পারে, শনি-মঙ্গলবার হওয়াও অসম্ভব নয়। মানে কোন একটা দিন ছিল আর কি। তা সেই বুধবার, কিম্বা বৃহস্পতিবার, সক্কাল সক্কাল বাস থেকে নেমে হাঁটা দিয়েছি শ্যামবাজারের একটা রাস্তা ধরে। মানে রাস্তাটা যে শ্যামবাজারেরই সে কথা অবশ্য ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারি না। জানবাজারও হতে হতে পারে, কিম্বা রাধাবাজার, অথবা টেরিটিবাজার। মানে কলকাতার কোনো এক বাজার নামধারী অঞ্চলের কোনো এক রাস্তা। অত খুঁটিনাটি মনে নেই।
সে যাই হোক, রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দিব্বি ঝকঝকে সকাল, দশটা-টশটা বাজে হয়তো, কিম্বা নটা-টটা, এগারোটা-ফেগারোটাও হতে পারে। মাথার ওপর ঝলমল করছে রোদমাখা নীল আকাশ, রাস্তার একদিকে একটা ষাঁড় আয়েশ করে পচা বাঁধাকপি চিবোচ্ছে, তার দু-হাত দূরে রাস্তার কলে সর্বাঙ্গে সাবান মেখে কেউ গলা ছেড়ে গান করছে, সংসার অসার জ্ঞানে জনাদুয়েক লোক মোবাইলে ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করতে করতে রাস্তা পারে হচ্ছে, একটা কুকুর ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় ঘুমনোর চেষ্টা করছে। সব পার্ফেক্টলি নর্ম্যাল, ওয়েদার একেবারে ফেয়ার এন্ড লাভলি, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই আচমকাই বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল।
না, না, আকাশ থেকে নামা বৃষ্টি না। ইট বৃষ্টি। কোনো রাজনৈতিক দল বন্ধ ডেকেছিল, সে ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্যে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে তাদের প্রেমানন্দে কিঞ্চিৎ ইষ্টক বিতরণ। ইট পড়ার শব্দে ষাঁড়টার বাঁধাকপির মোহ ছেড়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, কলে চান করা লোকটা সঙ্গীতসাধনা থামিয়ে সাবান গায়ে দৌড় দিল, কুকুরটাও ল্যাম্পপোস্টের ছায়ার মায়া কাটিয়ে অন্য কোন দিকে পালাল। কেবল মোবাইল দেখা লোক দুটো সব জলমতি তরলং জ্ঞানে নির্লিপ্তভাবে আগের মতোই রাস্তা পার হতে লাগল।
এই অবধি সব ঠিকই ছিলো। কিন্তু একটা আধলা ইটের আঘাতে ষাঁড়টার ধৈর্যচ্যুতি হল, এবং সেটা সামনে আর কাউকে দেখতে না পেয়ে শিং উঁচিয়ে আমার দিকে তেড়ে এল।
উলটো দিকে ফিরে দৌড় দিলাম বটে, কিন্তু বুঝলাম ইটের বৃষ্টি আর ষাঁড়ের কোপদৃষ্টি দুই একসঙ্গে খোলা আকাশের নীচে এড়ানো যাবে না। রাস্তার পাশের দোকানগুলো ততক্ষণে বন্ধে উদ্বুদ্ধ হয়ে হুড়মুড় করে শাটার নামাচ্ছে। একটা দোকানের প্রায় তিন ভাগ নেমে আসা শাটারের তলা দিয়ে সুড়ুৎ করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, ভেতরের কেউ একজনের খ্যাঁচখ্যাঁচিয়ে ওঠা ‘এই, এই’ গ্রাহ্য না করেই।
দোকানের ভেতরটা আলো আঁধারি। সামনে একটা কাউন্টার। তার পেছনে, দেওয়ালে বসানো তাকে থরে থরে সাজানো বড়ো-মেজ-সেজ-ছোটো সরু-মোটা-লম্বা-বেঁটে রংবেরঙের নানান শিশি, বোতল আর বয়েম। দোকানটা কীসের বোঝার চেষ্টা করছি, পেছন থেকে খপাৎ করে আমার কাঁধটা খামচে ধরলো। “এই! কথা নেই বার্তা নেই না বলেকয়ে সটান ঢুকে পড়লেন যে, অ্যাঁ?”
ফিরে দেখি একজন লোক, পোশাক-আসাক তার বড়োই অদ্ভুত। মাথায় টাইট করে বসানো একটা চামড়ার কানঢাকা টুপি, একটা এক বেঘত লম্বা পেতলের কাঠি তাতে খাড়া করে আঁটা। চোখে গোল ফ্রেমের একজোড়া পেল্লাই চশমা, তার ডাঁটিতে তামার প্যাঁচানো। পরণে গ্রহ নক্ষত্র আঁকা বেগুনি রঙের ল্যাবকোট আর সবুজ রঙের প্যান্ট, পায়ে পেতলের বুটি দেওয়া গোবদা জুতো।
আমি তার ওই বাহারি চেহারার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, লোকটা ফের তেড়েমেড়ে উঠল। “হঠাৎ করে এমন ধাঁ করে সেঁধিয়ে এলেন কেন বলুন তো?”
আমার এবার মাথা গরম হয়ে হয়ে গেল, তেড়ে উঠে বললাম, “ঢুকেছি তো ষাঁড়ের হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু আপনিই বা কেমন দোকানদার? লোক ঢুকলে যদি এতই আপত্তি তাহলে দোকান খুলেছেন কেন?”
লোকটা কেন মিইয়ে গেল। “আমি দোকানদার কে বলল? আমি একটা দরকারি জিনিস কিনতে এসেছিলাম। গুদোম থেকে এনে দিচ্ছি বলে দোকানী কোথায় হাওয়া হয়ে গেল, তার আর পাত্তা নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, এদিকে হঠাৎ ইট-পাটকেল পড়া শুরু হয়ে গেল। শাটার নামিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ করে তার তলা দিয়ে গলে আপনি এসে হাজির!” পকেট থেকে একটা রংবেরঙের রুমাল বের করে কপালের ঘাম মোছে লোকটা। “উফফ, কি ভয়ানক বেয়াড়া জায়গা রে বাবা। ব্যবসা করতে শেষে বেঘোরে প্রাণটা না খোয়াতে হয়।”
“যাকগে, যাকগে।” আমি লোকটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার করি, “তা এটা কীসের দোকান বলুন তো? মদের না ওষুধের?”
“আপনাদের এখানে ও দুটো আলাদা নাকি? কি আশ্চর্য!” চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায় লোকটা। “নাঃ, দুটোর কোনোটাই নয়। ওই দেখুন।”
লোকটা যেদিকে ইঙ্গিত করছে সে দিকে তাকিয়ে দেখি দেওয়ালের গায়ে টাঙানো একটা টিনের সাইনবোর্ডে হলুদ জমির ওপর লাল রঙে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা—
দোতলের বোকান
যাবতীয় বোতলস্থ এবং বোতলজাত বস্তূর একমাত্র বিক্রেতা
“যাহা নাই বোতলে তাহা নাই ভূতলে”
সাইনবোর্ড পড়ে মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম বটে, কিন্তু লোকটাকে সে কথা বুঝতে না দিয়ে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললাম, “ও, আচ্ছা, আচ্ছা।” তারপর, সে আবার পাছে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলে, সেই ভয়ে কথা ঘোরাতে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি এই পাড়াতেই থাকেন?”
লোকটা কেমন শিউরে উঠল। “আমি? আপনাদের এখানে? না, না, কি ভয়ানক জায়গা! আমি অন্য কোথাও থেকে আসছি।”
লোকটার কথার ধরণধারণে বেশ বিরক্তি হল। খানিকটা তেরিয়া হয়েই বললাম, “আমাদের এখানে মানে? আপনি কি বিলেত থেকে আসছেন নাকি?”
“আরে না না।” জোরে জোরে দু-হাত নেড়ে আপত্তি করে উঠল লোকটা। “আমি এদিককারই নই। একেবারে অন্য দেশ-কাল থেকে আসছি। এখানে এক শিশি অহিনকুলদানা কেনার জন্যে এসেছিলাম।”
লোকটা কী বলছে তার বিন্দু-বিসর্গ বুঝতে না পেরে পাগলের পাল্লায় পড়লাম কি বুঝতে চেষ্টা করছি এমন সময় দোকানের শাটারে বাইরে থেকে কিছুতে ধড়াম করে ধাক্কা মারল।
সে কি ভয়ানক ধাক্কা! ধাক্কার কাঁপুনিতে কাউন্টারের ওপরে রাখা গোটা দুয়েক বোতল মাটিতে আছড়ে পড়ে একেবারে খানখান হয়ে গেল। লোকটা আঁতকে উঠে প্রায় একহাত লাফিয়ে উঠল। “এই সেরেছে! এ আবার কি? ভয়ানক কিছুর আক্রমণ মনে হচ্ছে।”
আমার বুকের ভেতরটাও তখন কেমন ধুকপুক করছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখে সাহাস দেখিয়ে বললাম, “ও তেমন কিছু নয়। ষাঁড়টা বোধহয় এখনো আমাকে খুঁজছে। তবে চিন্তা করবেন না, শাটার ভেঙে ঢুকতে পারবে না।”
লোকটা ফের খ্যাঁচম্যাচ উঠল। “হ্যাঁ, আপনি তো বলেই খালাস! ঢুকে পড়লে তখন আমাকে বাঁচাবে কে? আচ্ছা ফ্যাসাদে ফেললেন তো! ব্যবসা করতে এসে শেষে প্রাণ নিয়ে টানাটানি!”
আমিও উত্তরে তেড়েমেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই দেখি লোকটা নীচু হয়ে কাউন্টারের সামনের মেঝেতে বসানো একটা ম্যানহোলের ঢাকনা ঘটাং করে খুলে ফেলল। “ঢের হয়েছে। প্রাণে বাঁচলে ব্যবসার নাম।”
কথা শেষ করেই লোকটা ম্যানহোল দিয়ে তড়বড় করে নীচে নামতে লাগল। ক্রমে তার মাথাটা ম্যানোহোলের কিনারার নীচে হারিয়ে গেল। আমি হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি লোকটা পাগল কিনা, হঠাৎ দেখি সে ম্যানহোলের মধ্যে থেকে মাথা তুলেছে। “এই যে ভাই শুনছেন? ওইটা একটু দেবেন? বহু কষ্টে জোগাড় করা, অর্ডারি মাল, ভুলে ফেলে গেলে লোকসান হয়ে যাবে।”
লোকটা যেই দিকে দেখাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে দেখি কাউন্টারের ওপর একটা রংচটা, শেড তোবড়ানো টেবিল ল্যাম্প রাখা। দেখে মনে হয়ে হয় কোনো রদ্দি মালের দোকান থেকে ওজনদরে কিনে আনা। হাতে তুলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ভাঙা টেবিল ল্যাম্পের দাম অনেক টাকা?”
লোকটা তেড়ে উঠে বলল, “ভাঙা টেবিল ল্যাম্প কে বলল? ওটা জ্ঞানের আলো! আমি বুঝবেন না। দিন, দিন!”
হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা দিতে গেছি, আর তাতেই হল বিপত্তি। ভাঙা বোতল থেকে হড়হড়ে পিচ্ছিল কিছু একটা মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, পা-টা গিয়ে পড়ল তা ওপরে, এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ষাঁড়ের গুঁতোর ধাক্কায় আর একবার ঝনঝন করে কেঁপে উঠল দোকানের শাটার। আমি তাতে চমকে উঠতেই পা পিছলে গিয়ে পড়লাম লোকটার ঘাড়ে, আর তারপর তাকে সঙ্গে করে গড়িয়ে পড়লাম ম্যানহোলের ভেতরে।
পড়েই আঁতকে উঠেছিলাম, সটান নীচে পড়ে হাড়গোড় না ভাঙে। কিন্তু কি আশ্চর্য, ম্যানহোলের ভেতরের সুড়ঙ্গটা একেবারে সোজা নীচে নামেনি। নেমেছে ঢালু হয়ে। কুমড়ো গড়াগড়ি খেতে খেতে তার ঢাল বেয়ে পড়তে লাগলাম নীচে।
ভেবেছিলাম পচা, পেঁকো, নোংরা, দুর্গন্ধ কিছু মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। কিন্তু মিনিট খানেক ঢালটা দিয়ে গড়ানোর পর হুড়মুড় করে যেখানে গিয়ে পড়লাম সেখানটা বেশ পরিষ্কার শুকনো। উঠে হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে দেখি এসে পড়েছি একটা টানা লম্বা গলির মতো জায়গায়, তার ছাদে সার-সার আলো বসানো। গলির যে দিকে আমি দাঁড়িয়ে সেদিকে একটা ঢালু রাস্তা উঠে গেছে ওপরের দিকে। আর তার উলটোদিকে অন্যদিকে একটা বন্ধ দরজা।
কোথায় এসে পড়লাম অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, আমার সঙ্গে গড়িয়ে পড়া লোকটা পেছন থেকে আমাকে এক ধাক্কা মেরে উলটোদিকের দরজাটার দিকে প্রাণপণে দৌড় দিল। আমিও সে কোথায় যাচ্ছে দেখার জন্যে পড়ি-কি-মরি করে তার পেছনে দৌড়লাম।
লোকটা কাছাকাছি পৌঁছতেই দরজার পাল্লাটা পর্দার মতো সোঁ করে ওপরে উঠে গেল। লোকটার পিছুপিছু আমিও সেটার তলা দয়ে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। টের পেলাম আমার পেছনে দরজাটা নেমে এসে খটাং করে বন্ধ হয়ে গেল।
দরজার পেছনে একখানা বড়োসড় ঘর। তার একদিকে দেওয়াল ঘেঁষে নানান সাইজের প্যাকিং কেস, কার্টন আর কৌটো জড় করা। অন্যদিকের দোয়ালের গায়ে একটা দাঁত বের করা লজ্ঝড়ে র্যাক। র্যাকের সব ক-টা তাক বোঝাই রং জ্বলা, চটা পড়া, ভাঙা, তোবড়ানো, মরচে-পড়া নানা হাবিজাবি জিনিসে বোঝাই।
আমি যেখান দিয়ে ঢুকেছি ঠিক তার উলটোদিকে ঘরের সামনের দেওয়ালটা বেয়ে লোহার, প্লাস্টিকের, রবারের তামার, পেতলের, নানা সরু মোটা বাঁকা সোজা পাইপ আড়ে লম্বায় উঠেছে নেমেছে। তাদের গায়ে এখানে ওখানে বসানো স্টপকক, ভাল্ভ আর গোল চৌকো নানা কাঁটা বসানো মিটার। পাইপের লাইনের মাঝখানে একটা সুইচ বোর্ড, তাতে ছোটোবড়ো নানা সুইচ ছাড়াও নাইট ল্যাম্পের মতো গোটা কতক লাল-নীল-হলুদ বাল্ব বসানো। এই দেওয়ালের সামনে একটা টেবিল, তার ওপর একটা আদ্যিকালের পেটমোটা টিভি, আর একটা মান্ধাতার আমলের টাইপ রাইটার রাখা। টেবিলটার সামনে একটা লোক চাকা লাগানো অফিস চেয়ারে বসেছিল, সে আমাদের দেখেই আগের লোকটাকে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে উঠল।
“এতক্ষণে তোর আসার সময় হল? কখন থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছি?”
চেয়ারে বসা লোকটার বেশভূষা অন্য লোকটার চাইতে কিছু কম অদ্ভুত নয়। মাথায় তার ক্রিকেটারদের মতো চওড়া কানার টুপি, তাতে ইলেকট্রিকের তার জড়ানো। পরণে ফুলপাতার রঙিন নক্সা তোলা কাঁথার মতো জামা আর বাটিক প্রিন্টের চুড়িদার পাজামা। পায়ে নাগরা জুতো, দু-হাতের কব্জিতে তিনটে-তিনটে করে কম করে ছ-টা নানা ধরনের ঘড়ি বাঁধা।
তার দিকে তাকিয়ে প্রথম লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, “আমি হাওয়া খাচ্ছিলাম নাকি? কি ভয়ানক জায়গা রে বাবা! আর একটু হলেই বেঘোরে প্রাণটা যাচ্ছিল!”
“যা, যা, বেশি রং চড়াস না! তোর সব তাতেই বাড়াবাড়ি!” চেয়ারে বসা লোকটা পাত্তাই দিল না। “জিনিসগুলো সব ঠিকঠাক পেয়েছিস কিনা আগে বল!”
তোবড়ানো টেবিল ল্যাম্পটাকে তাকে রাখতে রাখতে প্রথম লোকটা বলল, “জ্ঞানের আলোটা পেয়েছি। অহিনকুলদানা পাইনি। দোকানী ‘মালটা নিয়ে আসছি’ বলে সেই যে বেপাত্তা হয়ে গেল, তার আর টিকিটি দেখতে পেলাম না।”
“যাঃ!” দ্বিতীয় লোকটার মুখটা কেমন বাসি বেগুনভাজার মতো হয়ে গেল। “এই ট্রিপটা লোকসান হয়ে যাবে রে!” বলতে বলতেই হঠাৎ আমার দিকে চোখ গেল তার। “ওহো, সেই জন্যেই বোধহয় প্যাসেঞ্জার তুলেছিস? বেশ, বেশ। তা কোথায় যাবেন দাদা?”
লোকটা কী বলছে মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, প্রথম লোকটা ফেরে তেড়েমেড়ে উঠল, “আরে দূর দূর! প্যাসেঞ্জার কোথায়? তখন থেকে ছিনে জোঁকের মতো আমার পেছনে লেগে আছে। এর জন্যেই তো ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছিলাম আর একটু হলেই!!”
“বলছি না প্রাণ বাঁচাতে—” আমি ফের তেড়েমেড়ে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই দ্বিতীয় লোকটা বাধা দিল। “আহাহা, ছেড়ে দিন ওর কথা। সভ্যতা ভদ্রতা জ্ঞান নেই। বসুন, বসুন!” ভাঙাচোরা জিনিসের র্যাকটার সামনে পাতা একটা নড়বড়ে বেঞ্চির দিকে আপ্যায়নের ভঙ্গীতে হাত তুলে দেখাল লোকটা।
বেঞ্চিটার পেরেক ওঠা লগবগে চেহারা দেখে দেখে বসতে সাহস হল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “এটাতে বসা যাবে? এ তো লর্ড ক্লাইভের আমলের বেঞ্চি মনে হচ্ছে!”
দ্বিতীয় লোকটা কেমন আশ্চর্য হয়ে গেল। “আরিব্বাস! এক্কেবারে ঠিক ধরেছেন তো! কী করে বুঝলেন? আপনিও কি আমাদের লাইনের লোক নাকি দাদা?
“আপনাদের লাইন মানে?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“এই অদ্ভস্তু কেনাবেচা! হ্যাঁরে, দাদাকে আমাদের কার্ড দিসনি?”
“সময় আর পেলাম কোথায়?” প্রথম লোকটা গজগজ করে উঠল।
“অ্যাঃ! তোকে দিয়ে যদি কোন একটা কাজ হয়! এই নিন দাদা।” জামার পকেট থেকে একটা বড়োসড় কার্ড বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল লোকটা। কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলাম ছাপা রয়েছে,
তুলারাম খেলারাম এন্ড কোং
মার্চেন্টস এন্ড অর্ডার সাপ্লায়ার্স
সুলভ মূল্যে দুর্লভ বস্তু!! সংগ্রাহকদের একমাত্র ভরসাস্থল!!
যে কোনো দেশ-কাল-মাত্রার দুষ্প্রাপ্য অদ্ভস্তু সযত্নে অর্ডার মাফিক সাপ্লাই করা হয়
২৯৯/৭৯২/৪৫৮ নং রমতা পাড়া লেন, সময়খালি
কার্ডটা পড়ে দেখছি, দ্বিতীয় লোকটা একেবারে গদগদ হয়ে বলল, “এ লাইনে আমাদের খুব সুনাম, বুঝলেন না। দুজনে পার্টনারশিপে অনেকদিন ধরে ব্যাবসা চালাচ্ছি। আমি খেলারাম আর আর ওই ও হল তুলারাম।”
আমি কার্ডটা পকেটে রাখতে রাখতে বললাম, “না ভাই আমি অদ্ভস্তু কাকে বলে তার মানে জানি না, কস্মিনকালে চোখেও দেখিনি, আপনাদের লাইন ধরা তো দুরের কথা। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, এই পাতাল ঘরে বসে ব্যাবসা চালাচ্ছেন কেন? আপনাদের এটা চোরাই মালের কারবার নয়তো?”
“চোরাই মাল!” খেলারামের গলা শুনে মনে হল তার বুকে লক্ষণের শক্তিশেল লেগেছে। “আজকালকার যুগে মাটির নীচে ছাড়া আর কোথায় পার্কিং পাওয়া যায় বলুন! তাই বলে আপনি আমাদের শেষে চোর-জোচ্চোর ঠাওরালেন?” পকেট থেকে একটা চটের টুকরো বের করে ফোঁৎফোঁৎ করে নাক মুছল খেলারাম।
আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছি, হঠাৎ অনেক ওপর থেকে ঝনাঝন ঠঙাঠঙ শব্দে কিছু ভেঙে পড়ার আওয়াজ ভেসে এল।
শব্দটা শুনে তুলারাম একেবারে ছারপোকা কামড়ানোর মতো চমকে উঠল। “এই খেয়েছে! ষাঁড়টা বোধহয় শাটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এবার এক্ষুণি এখানে এসে পড়বে। ছাড়, ছাড় শিগ্গির গাড়ি ছেড়ে দে।”
খেলারাম কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “কিন্তু এঁকে-?”
“ফিরতি ট্রিপে নামিয়ে দেব। নে, নে, চল।”
একটা ইয়াব্বড় ধুমসো ষাঁড় কী করে ওই ম্যানহোলের ছোট্ট গর্ত দিয়ে নীচে নেমে আসবে, আর কোন গাড়ি ছাড়ারই বা কথা হচ্ছে সে সব কিছুই জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। টেবিলের তলা থেকে তুলারাম একটা কাচের আলবোলা টেনে বের করে আনল। আলবোলার মাথায় একটা ফানেল উলটো করে বসানো, তার থেকে একটা সরু প্লাস্টিকের পাইপ বেরিয়ে এসেছে। পাইপটাকে দেওয়ালে বসানো পাইপের আঁকিবুঁকির একটা মুখে গুঁজে দিয়ে তুলারাম আলবোলার নলে প্রাণপণে ফুঁ দিতে লাগল। খেলারামও উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের সুইচবোর্ডে পটাপট কয়েকটা সুইচ ওপর নীচে করে দিল।
পায়ের নীচে কোথাও একটা গোঁগোঁ আওয়াজ হল, দেওয়ালের গায়ে বসানো মিটারের কাঁটাগুলো কাঁপতে লাগল, সুইচবোর্ডের গায়ে দু-তিনটে আলো টুপটাপ করে জ্বলে উঠল। সুইচবোর্ড ছেড়ে খেলারাম ফের চেয়ারে বসে পড়ল, তুলারামও মুখ থেকে আলবোলার নল নামিয়ে ফেলে বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসল।
আলবোলাটার দিক তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওটাতে ফুঁ দিচ্ছিলেন কেন?”
আমার প্রশ্ন শুনে কেমন অবাক হয়ে গেল তুলারাম। “হাওয়া না দিলে মেশিন চালু হবে কী করে?”
সে পাছে ভাবে আমি কিছু জানিনা, তাই বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে বললাম, “অহো, তাই বলুন। ফার্নেসে হাওয়া দিচ্ছিলেন!”
“ফার্নেস!” আমার মুখের দিকে খানিক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল তুলারাম। “ফার্নেস! এটা কি আদ্যিকালের স্টিম গাড়ি নাকি যে এতে ফার্নেস থাকবে? একেবারে লেটেস্ট আলোকল বসানো!”
জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম আলোকল আবার কি বস্তু, কিন্তু দেখলাম তাতে প্রেস্টিজ থাকবে না। তাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাতে হাওয়া দিতে লাগে?”
“লাগবে না?” প্রায়ে তেড়ে উঠল তুলারাম। “হাওয়া না হলে কোনো কিছু চালু হয়? কর্মের কল বাতাসে নড়ে, জানেন না?”
এবার আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। নড়বড়ে বেঞ্চিটাতে তুলারামের পাশেই ধপ করে বসে পড়লাম। বুঝলাম কোন পাগলের খপ্পরে পড়েছি। এখান থেকে বেরোতে না পারা অবধি যা বলে সব চুপচাপ মুখ বুজে শুনে যাওয়া ভালো।
ঘরের অন্যদিক থেকে খেলারাম তাগাদা দিল, “হ্যাঁরে, তখন থেকে বাজে বকছিস! কোথায় যেতে হবে ঠিক কর!”
“আরে দাঁড়া, দাঁড়া তাড়া মারিস না। আগে ফর্দটা তো দেখতে দে!” পকেট থেকে একটা লাটিম বের করে তার গায়ে জড়ানো ফিতের মতো লম্বা কাগজটার প্যাঁচ খুলতে লাগল তুলারাম।
“আচাভুয়ার বোম্বাচাক একটা, সবুরে মেওয়া আড়াইশো, উত্তম মধ্যম তেল এক শিশি, হালুয়া টাইট করার রেঞ্জ, আঁকার হাত—“
“আঁকার হাত! আঁকার হাত!” খেলারাম বাধা দিল। “এইটা দিয়ে আসি চল। এক পাতা পুঁথি দেবে বলেছিল। দে যাত্রেন্দুটা দে।”
চশমাটা তুলে কাগজটা আর একবার পড়ে নিলো তুলারাম, “এই নে, ১৪ /২৮।”
“১৪/২৮।” বলতে বলতে টাইপ রাইটারে খটাখট করে টাইপ করতে লাগল খেলারাম। টিভি স্ক্রিনে কী সব আঁকিবুঁকি আলোর লাইন ঢেউ খেলতে শুরু করল, গোঁগোঁ আওয়াজটা বেড়ে গেল, আর সুইচবোর্ডের আলোগুলো দপদপ করতে শুরু করল।
মুখ বুজে থাকার প্রতিজ্ঞাটা ভুলে গিয়ে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “যাত্রেন্দু আবার কি?”
“যে ফোস্কা অবধি আমাদের যাত্রা করতে হবে সেইটার বিন্দু।” কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই গম্ভীরভাবে উত্তর দিল তুলারাম।
“ফোসকা!” প্রশ্ন করার জন্যে নিজের মনে নিজেকেই গাল দিলাম।
“হ্যাঁ।” খেলারাম আকর্ণ হেসে উত্তর দিল। “সোজা পথ ধরে যেতে গেলে তো হাজার হাজার বছর লেগে যাবে। দেশকালের গায়ে জায়গায় জায়গায় ফোস্কার মতো উঠে থাকে। আমরা দেশকালের মধ্যে দিয়ে সোজা না গিয়ে এক ফোসকা থেকে আর এক ফোসকায় চলে যাই। তাড়াতাড়ি হয়।”
“আর দুটো ফোস্কার মাঝখানে কী থাকে?” কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করলাম।
“সেটা বুঝিয়ে বলা মুস্কিল।” এবার খেলারামও কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। “ব্রহ্মাণ্ডের মূল কাণ্ড বলা যেতে পারে। কিংবা ব্রম্ভাণ্ডকে ধরে রাখার ভাণ্ড। মানে একটা প্রকাণ্ড জটিল ব্যাপার আর-কি। কি জানেন, এ সব হল বিচিত্র কাণ্ড-কারখানা, রকমসকম যায় না জানা।”
পাছে ফের উদ্ভুট্টে কিছু শুনতে হয় সেই ভয় আর এ বিষয় নিয়ে আর বেশি না ঘাঁটিয়ে নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “যেখানে যাচ্ছেন সেখানে আপনাদের নিশ্চই ভালো রোজগার হবে?”
খেলারামের ভাবটা কেমন চুনকাম করা দেওয়ালের মতো উদাস হয়ে গেল। “শুধু রোজগারের আশায় এ লাইন ধরিনি দাদা। একটা দরকারি জিনিস আমরা অনেকদিন ধরে খুঁজে চলেছি। মনে আশা, হয়তো এই ব্যাবসার লাইন ধরে একদিন না একদিন সেটা খুজে পাব।”
“কী জিনিস?” প্রশ্ন করার রিস্ক সত্ত্বেও জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
“পালের কাশু পথ!”
আবার হতভম্ব হয়ে পড়ি, “ভাই পালের মাস্তুল শুনেছি, পালের গোদা শুনেছি, পালে হাওয়া লাগার কথাও জানি। রাজপথ, সোজা পথ, বাঁকা পথ, চোরা পথ ন্যায়ের পথ এসবও শোনা আছে। কিন্তু পালের কাশু পথ কী বস্তু? সে খায় না মাথায় দেয়?”
গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালো তুলারাম, “সেটা যে ঠিক কী জিনিস কেউ জানে না। কিন্তু একটা খুব দরকারি জিনিস। অনেক কিছু করা যায়।”
“হ্যাঁ।” সায় দিল খেলারাম, “ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। অনেক রকম কাজে লাগে।”
“কী কাজে লাগে?” দুজনের মুখের দিকে খানিক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে আমি প্রশ্ন করলাম।
“সেটাও ঠিক বলা যাচ্ছে না।” আগের মতোই গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল খেলারাম, “কিন্তু লোকে বলে ওটা বহু প্রয়োজনে লাগে।”
প্রায় খাবি খাওয়ার মতো অবস্থা হলো আমার। “কি আশ্চর্য! জিনিসটা কী ঠিক জানেন না, সে দিয়ে কী হয় তাও জানেন না, অথচ সেটা খুঁজছেন! পাবেন কী করে?”
“দুটো ধাপে।” উত্তর দিল তুলারাম।
“হ্যাঁ, দুটো ধাপে।” সায় দিল খেলারাম। “এটার কথা একটা পুঁথিতে আছে। সেই পুঁথিটাও দুষ্প্রাপ্য। আমরা এ পর্যন্ত তার কেবল গোটা দুয়েক পাতা জোগাড় করতে পেরেছি। পুরো পুঁথিটা হাতে পেলে পালের কাশু পথের সন্ধান পাওয়া যাবে।”
“কী পুঁথি?”
“একটা প্রাচীন পুঁথি। কে লিখেছে কে জানে না। ওই তুলো, দেখা না দাদাকে, যদি কিছু হেল্প করতে পারেন।”
উঠে নড়বড়ে র্যাকটার ভাঙাচোরা মালপত্রের মধ্যে থেকে একটা চকলা ওঠা কাঠের হাতের বাক্স নামিয়ে আনল তুলারাম। তার ভেতরে থকে একটা হলদে হয়ে যাওয়া ছাপানো পাতা বের করে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। “নিন, পড়ে দেখুন।”
দেখলাম প্রায় ঝাপসা হয়ে আসা অক্ষরে পাতা জুড়ে একটা লম্বা পদ্য লেখা।
দুন্দুভি মঙ্গল কাব্য
কৈলাস শিখরে শঙ্কর করেন নিবাস।
পারিজাত বায়ু সেথা বহে বারোমাস।।
মহেশ্বর শঙ্কর তাঁর শঙ্করী গৃহিণী।
রণদা মোক্ষদা দেবী অসুরদলনী।।
প্রবল প্রতাপে দেবীর সবে রয় ত্রাসে।
সহজে না ঘেঁষিতে পারে মহেশ সকাশে।।
একদা পাইতে পূজা মর্ত্যে যান দশভূজা
পুত্রকন্যা যায় পাছে পাছে।
হাতেতে পাইয়া চাঁদ সাধিতে মনের সাধ
কলি আসে মহেশের কাছে।।
জরকশী বস্ত্র তার সর্বেদেহে অলঙ্কার
রতন অঙ্গুরী বিবিধ প্রকার।
চাহে ধূর্ত নয়নে হাসে কুটিল বদনে
খল ছল যেন মানব আকার।।
বৈসে মহেশ সকাশে কলি গদগদ ভাষে
ঠাঁই দেহ প্রভু মোর চরণে তোহ্মার।
তুমি অগতির গতি তোমাতে প্রলয় স্থিতি
তুহ্মি ভিন্ন না জানি সংসার।।
তুহ্মি জগতের পার ব্রহ্মাণ্ড সারাৎসার
তোহ্মারে কেহ বুঝিতে বা পারে।
তুমি দেব মহেশ্বর রোগ শোক দুঃখ হর
তব কৃপাছায়া যেন কভু নাহি সরে।।
কহেন কলির বাক্যে তুষ্ট ভোলা মহেশ্বর।
বেঁচে থাক বাবা বল তুই মাঙ্গিস কি বর।।
কপট কলি কহে চক্ষে লয়্যা জল।
মোর বহুত অভাব বাবা সংসার অচল।।
কৃপা করি দাও বাবা ধরার দেওয়ানী।
রোজগার করি কিছু টাকা-সিক্যা- আনী।।
সন্তান সন্ততি লয়্যে থাকি দুধেভাতে।
পূর্ণ কর বাঞ্ছা বাবা বন্দি জোড়হাতে।।
ধুতরো মউরী আদি গালেতে ফেলিয়া।
ক্ষণেক ভাবেন শিব দুই চক্ষু মুদিয়া।।
বজ্জাত শিরোমণি এই কলি ব্যাটা।
জিলিপির প্যাঁচ কষে এটা বড়ো ঠ্যাঁটা।।
ছলে বলে লুটি লয় আশরফি কড়ি।
কুনজরে মাপে যত ঝিউড়ী বহুড়ী।।
ধরাধামে পাড়ি দিলে মূর্ত্তিমান পাপ।
স্বস্তিতে স্বর্গবাসী ছাড়িবেক হাঁপ।।
এতেক ভাবিয়া মনে দেব বিশ্বম্ভর।
তথাস্তু কহেন তারে উত্তোলিয়া কর।।
পড়ে কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “এ দিয়ে কী হবে? এটা তো কোনো পাঁচালী মনে হচ্ছে। আর দুন্দুভি তো একরকম বাজনা। মানুষের মঙ্গল চেয়ে এটা দুন্দুভি বাজিয়ে বাজিয়ে পড়া হয়, তাই বোধহয় নাম রাখা হয়েছে দুন্দুভি মঙ্গল।”
“আরও একটা পাতা আছে, পড়ে দেখুন না।” উত্তর দিল খেলারাম, “তুলো, পরের পাতাটা দে দাদাকে।”
বাক্স থেকে আর একটা পাতা বের করে আমাকে দিল তুলারাম। পাতাটা একেবারে দুমড়ানো মুচড়ানো, তাতে কালো কালিতে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং অক্ষরে একটা পদ্য লেখা রয়েছে।
ধরাতে দেওয়ানী কলির হৈল বহাল।
দাপে তাপে তার কাঁপে গ্রাম নগর মহাল।।
লুটেরা বর্গী ঠক হার্মাদ প্রভৃতি।
সভাসদ তার যত দুষ্ট প্রকৃতি।।
মন্দেরে ভালো করে কালোরে ধলা।
পরধন কাড়ি লয় করিয়া অছিলা।।
একা কলি রক্ষা নাই যত বণিক দোসর।
মিষ্টভাষে কণ্ঠ কাটে কসাই সোদর।।
আমীর ওমরাগণে করিয়া সহায়।
রাজধন প্রজাধন গোপনে সরায়।।
পণ্ডিত কবিয়াল নট বিদ্যা বৃহস্পতি।
আশরফি মোহে রচে কলির প্রশস্তি।।
করজোড়ে চক্ষু মুদি কলি কলি ভজে।
কলি বিনা অন্য নাস্তি নহবৎ বাজে।।
ঘোমটা টানিয়া মাথে লোকে নাচয়ে খেমটা।
ধনী সে ফতুর হৈল ফতুর লেঙ্গটা।।
ত্রাহি ত্রাহি বলি ধর্ম্ম যায় রসাতলে।
সুবিচার ন্যায় কিছু না রহে ভূতলে।।
পড়ে মাথা নাড়লাম, “না ভাই। এতেও তো কিচ্ছু বোঝা গেল না। কী সব হাবিজাবি লেখা। ওই যে কাশার পথ না কাশীর পথ কী বললেন, তার কথা তো কোথাও নেই!”
খেলারামের মুখটা ফের বাসি বেগুনভাজার মতো নেতিয়ে পড়ল। “হ্যাঁ দাদা, বললামই তো। পুঁথির সব ক-টা পাতা না পেলে কিচ্ছু বোঝা যাবে না।”
তুলারামও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগে ভঁপভঁপ করে একটা হর্ন বেজে উঠল, সুইচবোর্ডের আলোগুলো একসঙ্গ দপদপ করে উঠে নিভে গেল। এরপর ঘরের গোঁগোঁ আওয়াজটা থেমে গেল, আর দরজাটাও পর্দার মতো উঠে গেল।
খেলারাম তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, “এসে গেছি। নে নে তুলো, চল চল, আঁকার হাতটা দিয়ে আসি চল। যদি আর পুঁথির আর একটা পাতা পাওয়া যায়।”
র্যাকটা থেকে ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো কিছু একটা ল্যাবকোটের পকেট ঢুকিয়ে তুলারাম বলল, “হ্যাঁ চল।”
দরজা দিয়ে বেরিয়ে তুলারাম আর খেলারামের পিছুপিছু গলিটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, যাক এইবার হয়তো এই দুই পাগলের হাত থেকে ছাড়ান পাবো, গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটু খটকা লাগল। দেখলাম ওপরে যাওয়ার সেই ঢালু পথটা নেই, তার বদলে একটা লাল রঙের সাদামাটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে। কিছুটা কিন্তু কিন্তু করে ওপরে উঠে দেখলাম ম্যানহোলটা নেই, তার বদলে রয়েছে বদলে একটা সাধারণ দরজা।
দরজা পেরিয়ে ফের আশ্চর্য হলাম। যেখান দিয়ে এসেছিলাম, সেই ওষুধের কিম্বা মদের দোকানটা নেই। তার বদলে রয়েছে একটা মালপত্রে ঠাসা পুঁচকে ঘর। ছাদ থেকে ঝোলানো একটা টিমটিমে বাল্বের আলোয় মনে হল যাত্রার বাতিল জিনিসপত্র। ভাঙা সিংহাসন, ছেঁড়া রাজপোশাক, ধুলো পড়া মুকুট, তোবড়ানো গদা ঘরময় ছড়ানো ছেটানো রয়েছে।
তুলারাম আর খেলারামের পেছন পেছন সাবধানে জিনিসপত্র ডিঙিয়ে ঘরটা থেকে বাইরে এসে আর একবার আশ্চর্য হলাম। যতদূর মনে আছে সকাল ন-টা, কিম্বা দশটা কিম্বা এগারোটা নাগাদ রাধাবাজার, জানবাজার, বা টেরিটিবাজার ওইরকম কোনো একটা জায়গা থেকে ওষুধ বা মদের দোকানটায় ঢুকেছিলাম। কিন্তু বেরিয়ে দেখলাম রয়েছি কোন পাড়াগাঁ মতো জায়গায়, মেঠো পথের দু-পাশে নানা গাছপালা। রাত হয়েছে, পরিষ্কার আকাশে তারা জ্বলজ্বল করছে, দূর থকে কাঁশর-ঘণ্টার আওয়াজ আসছে। পেছন ফিরে দেখলাম যেখান থেকে বেরিয়েছি সেটা একটা টালির চালের ঘর। তার ইট বের করা দেওয়ালে টিমটিমে আলোর নীচে ‘ভ্রান্তিবিলাস অপেরা’ লেখা একটা ছেঁড়া ফ্লেক্স ব্যানার ঝুলছে।
তুলারাম বা খেলারামকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব তার সুযোগ পেলাম না, তারা দুজনেই হনহনিয়ে হাঁটা দিল। কোথায় এসে পড়েছি জানি না, তাই আমিও সুবোধ বালকের মতো তাদের দুজনের পেছন পেছন চললাম।
একটা খালি মাঠ, একটা পুকুরপাড় আর দুটো নারকেল গাছ পার হয়ে এসে থামলাম একটা উঁচু বাড়ির কাছে। বাড়ির দরজায় আলো জ্বলছে, নেমপ্লেটে লেখা ‘কঞ্চি দা ভিঞ্চি’। কাউকে ডাকাডাকি করার তোয়াক্কা না করেই দরজা ঠেলে তোলারাম খেলারাম সটান ভেতরে ঢুকে পড়ল। উপায় না দেখে আমিও অগত্যা তাদের পেছন পেছন গেলাম।
দেখলাম ঘরটা লম্বায় চওড়ায় বেশ বড়ো। উঁচু ছাদটা তার দেখতে উলটোনো বাটির মতো। থামের মতো মোটা একটা টেলিস্কোপ মাটি থেকে তেরচা হয়ে উঠে সেই ছাদের একটা ফোকর দিয়ে বাইরে উঁচিয়ে রয়েছে। টেলিস্কোপের আইপিসে চোখ রেখে একজন টুলে বসেছিল। মাথায় টাক, বুক অবধি দাড়ি, গায়ে চকরা-বকরা বাউলদের মতো আলখাল্লা। তাকে উদ্দেশ্য করে খেলারাম হাঁক পাড়ল, “ও কঞ্চিদা। এসে গেছি গো!”
টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কঞ্চিদা বললেন, “এয়েছ সে তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার জিনিসটা এনেছ?”
“সে আর বলতে! অনেক খুঁজে জোগাড় করে এনেছি।” পকেট থেকে ন্যাকড়া জড়ানো জিনিসটা বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তুলারাম।
আমার কানে ফিসফিস করে খেলারাম বলল, “খুব বড়ো বংশের সন্তান। নামকরা বটানিস্ট।”
“বটানিস্ট!” আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম “উনি তো টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখছিলেন! আমি তো ভাবলাম উনি অ্যাস্ট্রোনমার।”
কথাটা বোধহয় একটু বেশি জোরেই বলা হয়ে গিয়েছিল, কঞ্চিদা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলেন, “তুমি কোথাকার গণ্ডমূর্খ হে! আকাশের ফুল দেখতে হলে টেলিস্কোপ লাগবে না তো কি মাইক্রোস্কোপ লাগবে?
“আকাশের ফুল! আকাশে ফুল হয় নাকি?” আমি হাঁ করে কঞ্চিদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমার ধ্যাষ্টামো কঞ্চিদার আর সহ্য হল না। একরকম আমার ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে আমার মাথাটা টেলিস্কোপের আইপিসে গুঁজে দিলেন। “হয় কি না হয় নিজেই দেখে নাও না!”
ইচ্ছে না থাকলেও আইপিসে চোখ লাগিয়ে আমি একেবারে চমকে উঠলাম,। আকাশে ঝকঝক করছে অগুন্তি তারা। আর তাদের মাঝে মাঝে থোকায় থোকায় ফুটে রয়েছে আলোয় গড়া নানা রঙের ফুল।
আমাকে কঞ্চিদা ঘাড় ধরে সোজা করিয়ে দিয়ে বললেন, “হয়েছে? দেখলে তো?”
আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো কী ফুল?”
ফের খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলেন কঞ্চিদা। “আকাশকুসুম। কেন আগে শোনোনি?”
মুখ ফস্কে বলে ফেললাম, “কিন্তু সে তো কল্পনা!”
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কঞ্চিদা কেমন চুপসে গেলেন। তঁর হয়তো মনে হয়ে থাকবে তিনি জড়বুদ্ধি কোন লোকের পাল্লায় পড়েছেন। স্নেহশীল মাস্টারমশাইয়ের মতো একবারে মধুমাখানো গলায় বললেন, “কল্পনা নয় বাবা, জল্পনা। আকাশকুসুম জল্পনা। মানে খুব সুন্দর, দামি আলোচনা। ভুলে যেও না, কেমন? উলটোপালটা বললে লোকে হাসবে, যে বাবা।”
তারপর আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “কই গো খেলারাম তুলারাম। জিনিসটা সেট করে একবার দেখিয়ে দাও।”
“হ্যাঁ কঞ্চিদা, দেখিয়ে দিচ্ছি! একটা টেবিল লাগবে যে।” তড়িঘড়ি উত্তর দিল খেলারাম।
“ওই তো ঘরের ওদিকে রয়েছে।”
কঞ্চিদার দেখানো টেবিলটা টেলিস্কোপের কাছে টেনে নিয়ে এল খেলারাম। হাতের জড়ানো জিনিসটার ন্যাকড়ার ঢাকা খুলে সেটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল তুলারাম। “এই যে কঞ্চিদা, আপনার আঁকার হাত। তন্নতন্ন করে অনেক দেশ-কাল খুঁজে জোগাড় করে এনেছি।”
ঝুঁকে দেখলাম একটা বেঘতখানেক লম্বা প্লাস্টিকের হাত। বোধহয় কোন বাচ্ছাদের পুতুলের গা থেকে খুলে নেওয়া, ওপরের দিক থেকে একটা সরু তার বেরিয়ে আছে।
ফের বেফাঁস কিছু বলে ফেলি সেই ভয় খুব জোরে নিজের পেটেই একটা চিমটি কেটে চুপচাপ দেখতে লাগলাম।
তুলারাম তার বেগুনি ল্যাব কোটের পকেট থেকে এক-এক করে কাগজ পেন্সিল, একটা পিন, কিছুটা তার, একটা সার্কিট বের করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। তারপর তার দিয়ে পুতুলের হাতটাকে সার্কিটের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সার্কিটটাকে টেলিস্কোপের সঙ্গে জুড়ে দিলে। এরপর হাতটার মুঠোয় একটা পেন্সিল গুঁজে দিয়ে সেটাকে কাগজের ওপর রাখল।
গর্বের দৃষ্টিতে টেবিলের জোগাড়যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে খেলারাম বলল, “এই নিন কঞ্চিদা, সব সেট। আমাদের একেবারে বেস্ট সার্ভিস। যা চাইবেন একেবারে ব্রহ্মাণ্ড তল্লাস করে এনে দেব।”
কঞ্চিদা ফের খ্যাঁকখ্যাক করে উঠলেন, “অতো লেকচার দিতে হবে না, এবার চালিয়ে দেখাও।”
কঞ্চিদার কথাতে তুলারাম সার্কিটের গায়ে একটা বোতাম টিপতেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল। পেন্সিল ধরা হাতটা তরতর করে কাগজে কয়েকটা তারা আর ফুল এঁকে ফেলল।
“বাঃ বেশ বেশ।” কঞ্চিদার মুখের চেহারা দেখে মনে হল তিনি বেশ খুশি হয়েছেন। “বাইজান্টিয়ামের বেজী ধরতে গিয়ে কব্জিটা জখম হওয়ার পর থেকে আজকাল আঁকতে কষ্ট হয়। এটাতে তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যাবে।”
নীচু হয়ে ছবিগুলো আর একবার দেখলেনে কঞ্চিদা, “যাক। এবার কেটে পড়ো, আমার অনেক কাজ আছে।”
কাঁচুমাচু হয়ে তুলারাম জিজ্ঞেস করল, “কঞ্চিদা, আমাদের জিনিসটা?”
ঘরের একপাশ থেকে একটা কাঠের তক্তি নিয়ে এসে তার হতে গুঁজে দিয়ে কঞ্চিদা বললেন “এই নাও। এবার ভাগো।”
তক্তিটা যে ঠিক কী দেখতেও পেলাম না, আমাদের একরকম ঠেলতে ঠেলতেই ঘরের বাইরে বের করে দিলেন কঞ্চিদা।
অন্ধকার পথ পেরিয়ে, ভ্রান্তিবিলাস অপেরার মালপত্র ডিঙিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে, গলিপথ পার হয়ে ঘরটাতে ফিরে তবে কাঠের তক্তিটা দেখার সুযোগ হল।
দেখলাম একটা পাতলা প্লাইউডের ফালি, তাতে কালি দিয়ে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে কী সব লেখা।
উৎকণ্ঠার স্বরে খেলারাম জিজ্ঞেস করল, “কিরে তুলো, পুঁথির লেখা তো?”
ওপর নীচে মাথা নেড়ে তুলারাম বললো, “হ্যাঁ তাইতো মনে হচ্ছে।”
“পড়, পড়, পড়ে দেখ কী লেখা আছে!”
তুলারাম পড়তে শুরু করল।
কলির দেওয়ানী পাশে প্রজাগণ রহে ত্রাসে
ডাকাত ছিনাল চোর না রহে শাসনে।
দিয়া প্রজারে যাতনা আদায়ে খাজনা
নাজির নায়েব মুন্সী আমলা আমিনে।।
হাঁকিয়া পেহেরাদার হুঁস্যার খবরদার
বেত ল্যয়ে গস্ত করে পাড়া।
সম্মুখে যারে পায় হাতে পায়ে বেড়ি দেয়
ছাড়ে পেলে টাকা মুটা ভরা।।
কেবা দুই মাথা ধরে মনোকথা ব্যক্ত করে
অলিগলি কোটালে দেয় থানা।
বেফাঁস কহিলে পরে ফাটকে আটক করে
ধার্য্য করে কোড়া জরিমানা।।
এইরূপে প্রজাগণ কষ্ট সহে সর্বক্ষণ
সহর নগর ত্রাসে কাঁপে থরথর।
সবে করে ত্রাহি ত্রাহি বলে হরি মাম পাহি
হেনকালে জন্ম লয় দুন্দুভিকর।।
বুদ্ধি তার সূক্ষ্ম অতি বিদ্যা জিনি বৃহস্পতি
দুন্দুভি বড়ো হয়্যে চন্দ্রকলা সম।
ক্ষীণ তনু খর্বকায় মাথাটি কুমড়ার প্রায়
কন্টকী কেশ তাতে শোভে নিরুপম।।
“কী বোঝা গেল বল তো?” পড়া শেষ করে জিজ্ঞেস করে তুলারাম।
“বিশেষ কিছু না।” মাথা ঝাঁকায় খেলারাম, “কোন এক দুন্দুভির কথা বলা হয়েছে কেবল।”
“হ্যাঁ।” বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে আমিও সায় দিই, “একদম শুরুতে যে লেখা ছিল দুন্দুভি মঙ্গল কাব্য, দুন্দুভি তাহলে কোনো লোকের নাম, বাজনা নয়।”
“কিন্তু তাহলেও তো সবটা বোঝা গেল না।” খেলারামের মুখটা ফের বাসি বেগুনভাজার মতো হয়ে গেল।
“না।” উত্তর দিল তুলারাম, “পরের পাতাটা লাগবে।”
“কোথায় যাবি?”
“জ্ঞানের আলোটা দিয়ে আসি। একটা পাতা দেবে বলেছিল।”
“চল তাহলে।”
আগে আর একবার যে সব কাণ্ডকারখানা দেখেছিলাম, দুজনে মিলে ফের সেই সব শুরু করে দিল। টেবিলের নীচ থেকে কাচের আলোবোলা টেনে এনে তুলারাম তার নলে প্রাণপণে ফুঁ দিল, আর খেলারাম পটাপট করে সুইচবোর্ডের কতকগুলো সুইচ ওপরে নীচে করে দিল।
ফের সেই আগের মতোই গোঁ-গোঁ আওয়াজ শুরু হতেই তুলারাম পকেট থেকে ফিতের মতো কাগজটা বের করে তাতে চোখ বুলিয়ে খেলারামকে নির্দেশ দিল, “যাত্রেন্দুটা নে – ৩/৭২।”
খটাখট করে টাইপ-রাইটারে টাইপ করে বাঁহাতের ঘড়িগুলোর দিকে তাকাল খেলারাম, “বেশিক্ষণ লাগবে না। খানিক বাদেই পৌঁছে যাব।”
কিছুক্ষণ বাদে আগের মতোই ভঁপভঁপ করে একটা হর্ন বেজে উঠে সুইচবোর্ডের আলোগুলো একসঙ্গ দপদপ করে উঠে নিভে গেল। আর ঘরের গোঁ-গোঁ আওয়াজটা থেমে গিয়ে দরজাটা উঠে গেল।
র্যাক থেকে তোবড়ানো টেবিলল্যাম্পটা তুলে নিয়ে তুলারাম বাইরে পা বাড়ালো, তার পেছন পেছন আমি আর খেলারাম।
গলিটা পেরোনোর পর এবার দেখলাম সিঁড়ি নেই, তার জায়গায় একটা নড়বড়ে বাঁশের মই লাগানো। সাবধানে মই দিয়ে উঠে একটা দরজা পেরিয়ে যেখানে এসে পড়লাম সেখানে রাশি রাশি কলার কাঁদি জড়ো করে রাখা। সেগুলো পার হয়েই একটা দোকান মতো জায়গা, ছাদ থেকে ইয়াব্বড় দাঁড়িপাল্লা ঝুলছে, ফরাসে হাতবাক্স নিয়ে একজন বসে আছে, লোকজন আসছে যাচ্ছে, পাল্লায় কলার কাঁদি ওজন হচ্ছে। বুঝলাম এটা কোনো কলার পাইকারী দোকান হবে।
আমাদের দেখতে পেয়েও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না, আমরাও চুপচাপ দোকান থেকে রাস্তায় নেমে এলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমার আন্দাজ মিথ্যে নয়, দোকানের মাথায় একটা রংচটা সাইনবোর্ড লাগানো, তাতে লেখা—
অষ্টরম্ভা কদলী কেন্দ্র
সর্বপ্রকার মর্তমান, চিত্র, কাঁঠালী, নৃত্য, চাঁপা, ছলা এবং অনান্য কলা বিক্রেতা
প্রোঃ – কানাইবাঁশি ধর
রাস্তায় নেমে বুঝতে পারলাম কোনো একটা ঘিঞ্জি বাজার মতো জায়গায় এসে পড়েছে। দু-পাশে উঁচু উঁচু বাড়ি, তাদের নীচের তলায় সব নানারকম দোকান, সরু রাস্তায় গিসগিস করছে ভিড়, তার মধ্যে দিয়ে দু-একটা মান্ধাতার আমলের গাড়ি কোনোমতে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে।
ভিড় ঠেলে তুলারাম খেলারামের পেছন পেছন গিয়ে একটা যেখানে পৌঁছলাম বাইরে থেকে দেখেই বোঝা গেল যে সেটা একটা বইয়ের দোকান। তার দেওয়ালে ‘দ্রিঘাংচু বিদ্যাচুঞ্চু বুক এজেন্সী’ লেখা একটা টিনের সাইনবোর্ড লটকানো। দোকানের কাউন্টারে যে বসেছিল, তাকে গিয়ে খেলারাম জিজ্ঞেস করল “দ্রিঘাংচুদা আছেন নাকি?” উত্তর না দিয়ে লোকটা কেবল ঘাড় তুলে ভেতর দিকে ইশারা করল।
তুলারাম খেলারামের পিছু পিছু কাউন্টারের পাশ ঘেঁষে, বইয়ের র্যাকে ঠাসা একটা স্টোর রুম পার হয়ে একটা ঘরে এসে পড়লাম। ঘরের একদিকের দেওয়ালে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো একটা বিশাল অয়েল পেন্টিং—একটা হলুদ আর সবুজ রঙের ওরাং-ওটাং একগাদা ইটপাটকেলের ওপর শুয়ে আছে, আর তার পাশে একটা থামের ওপর একটা কাক বসে। এই ছবির উলটোদিকে একটা টেবিলের পেছনে একজন বসে একটা বই খুলে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কী দেখছিল। তার মাথার চুল নুটি করে বাঁধা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ে জরির কাজ করা ভেলভেটের কোট। তার সামনে গিয়ে তুলারামা ঠকাস করে টেবিল ল্যাম্পটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললো, “এই যে দ্রিঘাংচুদা, আপনার জ্ঞানের আলো।”
দ্রিঘাংচুদা দেন হাতে চাঁদ পেলেন মনে হল। শূন্যে দু-হাত ছুড়ে একেবারে আহ্লাদে চেঁচিয়ে উঠলেন “বাঃ বাঃ! অনেক কাজ আটকে যাচ্ছিল! একবার টেস্ট করে দেখি তাহলে?”
টেবিল ল্যাম্পের তারটা একটা প্লাগ-পয়েন্টে গুঁজে দিয়ে, খটাস করে সুইচ টিপে ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলেন দ্রিঘাংচুদা। তারপর ঘরের একটা বুক-সেলফের দিকে আঙুল দেখিয়ে আমাকে বললেন, “ওপরের তাকের বাঁ দিকের বইটা আনো তো ভাই।”
তাক থেকে বইটা নামিয়ে আনলাম। ইয়া গোবদা মোটা বই। চামড়া দিয়ে বাঁধানো, মলাটের ওপর সোনার জল দিয়ে লেখা—‘গোডেলিকা প্রবাহ’।
আমার হাত থেকে নিয়ে বইটা এক জায়গায় খুলে টেবিল ল্যাম্পের আলোর তলায় রাখলেন দ্রিঘাংচুদা। তারপর ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দিয়ে পাতাটা পড়তে পড়তে ঘাড় নাড়তে লাগলেন। “বাঃ! এই তো এবার দিব্বি বুঝতে পারছি। গত এক সপ্তাহ ধরে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছিল না।”
“তবে!” গর্বে ঘাড়টা একেবারে উঁচু করে বলে উঠলাম তুলারাম, “বলেছিলাম না দাদা, একটা জ্ঞানের আলো জোগাড় করতে পারলেই আপনার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কাঠের মতো শক্ত শক্ত সব বই একেবারে জলবৎ তরলং হয়ে যাবে।”
কিছুতেই কথা চেপে রাখতে পারলাম না। সেই মুখ ফস্কে বলেই ফেললাম, “আলোর তলায় ধরলে বইয়ের মানে বোঝা যায়?”
“আলো নয়, আলো নয়, জ্ঞানের আলো!” একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠল খেলারাম। আর দ্রিঘাংচুদা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে রইলেন যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক জীব দেখছেন।
কিছুক্ষণ এইভাবে তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে দ্রিঘাংচুদা বইখানা ঘুরিয়ে আমার সামনে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মেলে ধরলেন, “দেখো, নিজেই দেখো নাও।” খেলারামও সঙ্গে সায় দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার দেখেই নিন না!”
কী আর করি, অগত্যা ঝুঁকে পড়ে বইয়ের পাতাটা দেখতেই হল। দেখলাম পাতা জুড়ে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে জটিল সব ফর্মূলা লেখা রয়েছে। মনে, মনে ভাবছি এসব মানে উদ্ধার করা আমার কম্ম নয়, দ্রিঘাংচুদা জিজ্ঞেস করলেন, “কি, কী বুঝলে? বলে ফেলো, বলে ফেলো।” কী আর করি! মাথায় যে কথাটা প্রথমে উঠে এলো সেটাই ফস, করে বলে দিলাম। “সম্পূর্ণ আর অসম্পূর্ণ দুটোকে আলাদা করে চেনা যায় বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ যে নিজেই কোন এক দিক দিয়ে অসম্পূর্ণ নয় সেকথা সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করা যায় না, অসম্পূর্ণতার মধ্যেও কোনো বিশেষ সম্পূর্ণতার সম্ভাবনার কথাও কথা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করা যায় না।”
কথাগুলো বলে নিজেই হাঁ হয়ে গেলাম। ভাবলাম এই মরেচে এই আজগুবি হিং-টিং-ছট শুনে সবাই আঁতকে উঠবে। কিন্তু দ্রিঘাংচুদা দেখি মাথা নাড়ছেন। “‘বাঃ, এই তো বুঝে গেছ দেখছি!”
পাগলের পাল্লায় পড়ে আমি নিজেও পাগল হয়ে গেছি কিনা বোঝার চেষ্টা করছি, দ্রিঘাংচুদা টেবিলে থেকে একটা ছেঁড়া বইয়ের পাতা খেলারামের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। “এই নাও। তোমাদের পদ্যের এক পাতা, যেমন কথা হয়েছিল।”
খেলারাম পকেটে পাতাটা পুরে ‘তাহলে আসি দ্রিঘাংচুদা’ বলেই অ্যাবাউট টার্ন করে সটান হাঁটা দিল। আমি আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না।
আবার ঘিঞ্জি বাজারের ভিড় ঠেলে, কদলী কেন্দ্রের কলার কাঁদি টপকে, বাঁশের নড়বড়ে মই বেয়ে নেমে ঘরটাতে ফেরত এলাম। এর মাঝখানে আর অন্য কিছু হয়নি, কেবল খেলারাম ‘পাঁচ মিনিটে আসছি’ বলে কিছুক্ষণের জন্যে কোথাও হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
ঘরে পৌঁছতেই তুলারাম তাগাদা লাগাল, “পদ্যটা এবার পড়ে ফেল রে খেলা।”
“আরে দাঁড়া, দাঁড়া।” বলে খেলারাম আমার দিকে একটা প্লাস্টিকের ডিবে আর চামচ বাড়িয়ে ধরল। “নিন দাদা, খান। সেই কোন সকালে বেরিয়েছেন!”
ডিবেটা থেকে এক চামচ মুখে দিয়ে একবারে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। “কি দুর্দান্ত স্বাদ আর গন্ধ! কী ভাই এটা?”
“এ অঞ্চলের বিখ্যাত খেয়ালী পোলাও। অন্য আর কোনো দেশ-কালে এ জিনিস পাবেন না। আপনি খেতে থাকুন, আমি পদ্যটা পড়ি।”
পকেট থেকে বইয়ের ছেঁড়া পাতাটা বের করে পড়তে আরম্ভ করল খেলারাম।
কালেজের পাঠ দুন্দুভি করিলেক সাঙ্গ।
তাহা বাদে চর্চা করে নানা বিদ্যা অনুষঙ্গ।।
সম্বাদপত্র পড়ে আর পোর্টাল দৈনিক।
পড়ে রঙ্গীন পত্রিকা আদি বিবিধ মাসিক।।
সার্ফ করে নিশিদিন চ্যানেলে চ্যানেলে।
সশ্যাল মিডিয়া দেখে বিবিধ মিশেলে।।
এইরূপে দুন্দুভি সত্য বুঝিলেক সার।
কলির আমলে নরের দুঃখ অপার।
ব্যাধিতে দারিদ্রে কেহ বা হৈল কাঙ্গাল।
বিনা দোষে রাজরোষে কারোর পুড়িল কপাল।।
আঁধার নগরীতে যেন জুয়াচোর রাজা।
টাকা সের মুড়ি বিকে টাকা সের খাজা।।
তিলমাত্র কর্মে ফাঁদি কাহিনি প্রকাণ্ড।
পারিষদে লুটি খায় সরকারি ফান্ড।।
লুটপাটে দুষ্ট কভু নাহি দেয় ক্ষান্ত।
শিষ্ট ফুকারি কাঁদে হয়্যা সর্বস্বান্ত।।
দেখিয়া প্রজার দুঃখ দুন্দুভিকর।
সুবিচার আনিতে হবে ভাবে অতঃপর।।
কেতাব পড়িয়া করে বিবিধ রিসর্চ।
নানাবিধ সাইটে করে নানারূপ সর্চ।।
এইরূপে জুটাইয়া বিধিমতো গেয়্যান।
রুদ্ধ করি ঘরদ্বার ধরিলেক ধেয়্যান।।
জানিবারে উপায় যাতে মিলে সুবিচার।
ইকয়ালিটি ফ্রেটরনিটি মন্ত্র জপে বহুবার।।
অবশেষে ধেয়্যান মধ্যে দর্শে চবুতরা।
শিলাময় রূপ তার দেখিতে মনোহরা।।
চারিপাশে বালাখানা চক চাঁদনি সুন্দর।
বৈসে সেথা বহুবিধ বাদ্যের আসর।।
দামামা দগড় বাজে জয়ঢাক কাড়া।
ঢেমচা খেমচা ঢোল পাখোয়াজ পড়া।।
করতাল তুরী ভেরী খঞ্জনী বাঁশী।
মাদল ডমরু তাসা চৌতারা কাঁসী।।
ভোরঙ্গ মোচঙ্গ ঘণ্টা মৃদঙ্গ ডম্ফ।
নাকাড়া টিকারা সঙ্গে বাজে জগঝম্প।।
বাতাস ভেদিয়া উঠে শত যন্ত্রের রব।
দশানন সভায় যেন হৈছে মহোৎসব।।
আচম্বিতে থামে শব্দ চৌদিক হয়্যা নিস্তব্ধ
দৈববাণী হয় শুনহ আছে এক পথ।
করিয়া দুষ্টেরে শাসন শিষ্টেরে করিতে পালন
করহ সন্ধান দুন্দুভি পালের কাশুপত।।
পদ্যটা শেষ করে খেলারাম নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল “আরে! এখানে তো দেখছি লেখা আছে কাশুপত! কথাটা তাহলে কাশু পথ নয়?”
“কই, দেখি দেখি!” খেলারামের হাত থেকে পাতাটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে, একবার চোখ বুলিয়ে তুলারামও আশ্চর্য হয়ে গেল, “তাই তো রে! কাশুপতই তো লেখা রয়েছে।”
“কিন্তু পালের কাশুপত মানেই বা কি? আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল খেলারাম।
“পালের কাশুপত মানে—, পালের কাশুপত মানে—” কথাটার অর্থ যেন ধরি ধরি করেও ধরতে পারলাম না। খেয়ালী পোলাও খেয়ে চোখ ভারী হয়ে আসছে মনে হল। বললাম “দাঁড়ান, দাঁড়ান, বেঞ্চিটাতে বসে একটু ভেবে বলছি।
কিন্তু বেঞ্চিতে বসে আর ভাবা হল না। ভাবার জন্যে চোখ বন্ধ করতেই, চোখের পাতাদুটো কেমন ভারী হয়ে এল। কখন যে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না।
ঘুম ভাঙল কারোর ‘উঠুন, উঠুন’ ডাকাডাকিতে। চোখ খুলে দেখি একটা সিনেমা হলের একদম লাস্ট রোতে বসে আছি, আর একটা লোক “উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন, সিনেমা শেষ হয়ে গেছে।” বলে ডাকাডাকি করছে।
হল থেকে বেরিয়ে চা খেতে খেতে এতক্ষণ কোন আজগুবী স্বপ্ন দেখছিলাম কিনা ভাবছি, চায়ের পয়সা দিতে গিয়ে পকেটে রাখা কিছু একটা হাতে ঠেকল। বের করে দেখি খেলারামের দেওয়া সেই কার্ডটা। তার উলটোপিঠে কলম দিয়ে লেখা,
পালের কাশুপত মানে বুঝতে পেরেছি। পুঁথির আর একটা পাতা আনতে চললাম। ফিরতি ট্রিপে তুলে নেব, ওই দোকানটাতে থাকবেন।
–খে.
তার নীচে রং পেন্সিলে লেখা,
দোকানদারের কাছ থেকে অহিনকুলদানার বোতলটা চেয়ে রাখবেন।
– তু.
তুলারাম খেলারামের সঙ্গে ফের দেশান্তরে কালান্তরে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু মুস্কিল হল সেই দোতলের বোকানটা যে কোথায়, সেটা শ্যামবাজারে, না জানবাজারে, না রাধাবাজারে না কি টেরিটিবাজারে সেটাই এখন ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না। কারোর যদি চোখ পড়ে একটু জানাবেন প্লিজ।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বড় গল, মজার কল্পবিজ্ঞান, সুমিত বর্ধন
Now, after completing the story, I need to go to that bottle shop.
দারুণ দারুণ👌👌👌।
আমি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়লাম। পদ্যগুলোও খুব ভাল লেগেছে।
খুব ভালো লাগলো। কল্পবিজ্ঞানের জগতে নতুন সংযোজন। পদ্যগুলোও সরেস।
খুব ভালো লাগলো “কালের পশুপত”। বেশ মজাদার।
আধুনিক হযবরল। পদ্যটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল সত্যি কোন মঙ্গলকাব্যের অংশ। যত তাড়াতাড়ি কলি বিনাশের অস্ত্র পাওয়া যায় ততই ভাল। অন্যরকম এবং যথারীতি অসাধারণ।
পড়লাম। কিন্তু আল্টিমেটলি কী হলো সেটা বুঝলাম না। মানে, নানারকম কথার জাগলারির মধ্যে দিয়ে ঘুরে এলাম। কিন্তু কোথাও পৌঁছলাম না। গল্পের বক্তব্যটা কী?
মজার মোড়কে স্বাদু সাইফাই। কল্পনার উড়ানকে কুর্ণিশ। কলকাতা, মঙ্গলকাব্য, টাইম/ডাইমেনশন ট্রাভেল, আজব চরিত্র, এ সব একযোগে মেখে নিখাদ বাঙালী ঝালমুড়ি!!
সিরিয়াসলি সুমিতদা, এ শুধু আপনিই পারেন। আভূমি সেলাম।