বৈজ্ঞানিক বর-যাত্রী সম্বৰ্দ্ধনা
লেখক: অধ্যাপক ডক্টর শ্রীসুশীলচন্দ্র মিত্র, এম্-এ, ডি-লিট্ (প্যারিস্)
শিল্পী: মূল অলংকরণ
হিমাচল বাবু বনেদী বংশের লোক। অনেক বিষয়-সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর পেশা কিন্তু জমিদারী নয়,—তাঁর পেশা বিজ্ঞান-চর্চ্চা। বাড়ীতে একটা মস্ত বড় ল্যাবরেটরী থাড়া করে’ তুলেছেন। তবে তিনি যে সারাদিনই তাঁর ল্যাবরেটরীর বদ্ধ বাতাসে আপনাকে আবদ্ধ করে’ রাখেন,—তা’ নয় ৷ কেন-না,—তাঁর নামেরই উপযোগী তাঁর যে দেহখানি,—সেটাকে সমস্ত দিন কোনো সঙ্কীর্ণ জায়গার মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়; সম্ভব হ’লেও তার চেয়ে অবৈজ্ঞানিক কাজ কিছু হ’তে পারে বলে তিনি কল্পনাও কর্তে পারেন না। তাই তিনি সমস্ত দুনিয়াটাকেই তাঁর পরীক্ষাগার বানিয়ে তুলেছেন; জীবনের প্রত্যেকটা খুঁটি-নাটিতে তিনি বৈজ্ঞানিক প্রণালী অবলম্বন করে’ চল্তে চেষ্টা করেন, এবং এই চেষ্টার ফলে তিনি এমন অনেক বৈজ্ঞানিক প্রণালী বার করেছেন,—যার দ্বারা অতি সাধারণ লোকও অতি সহজেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন কঠিন কাজগুলো নির্বিঘ্নে বেশ করে যেতে পারে।
তারই একটা নমুনা পেলাম,—সেদিন তাঁর বাড়ীতে তাঁর মেয়ে বিরতির বিয়েতে বরযাত্রীর নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে। তাঁর বাড়ীর ফটকটী সেই উপলক্ষে তিনি একটু অসাধারণ রকমেই সাজিয়েছিলেন। প্রবেশের চওড়া পথটাকে দু’দিকে কঞ্চির বেড়া দিয়ে তিনি সরু করে’ ফেলেছিলেন। একসঙ্গে অনেক লোক প্রবেশ করলে, সকলকে ঠিকমত সমাদর ও অভ্যর্থনা করার সুবিধা হয় না বলে’, তিনি প্রবেশ-পথটী এমন করে দিয়েছিলেন যা’তে একজনের বেশী লোক একই সময়ে পাশাপাশি যেতে না পারে। কঞ্চির বেড়াগুলি লাল কাপড়ে মুড়ে দিয়েছিলেন,—কতকটা সার্কাসের তাঁবুর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর আসন-বিভাগের মত। ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই দেখি,—হাত দুই দূরে বেড়ার অপর ধারে একটী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। তাঁর দু’পাশে দুটী বাঁশের খুঁটী। ডান দিকের খুঁটীটাতে লাল কাপড়ে মোড়া কঞ্চিরই একটা আল্না মতন করা; তাতে অনেকগুলি বেলফুলের মালা ঝুল্ছে। বাঁ দিকের খুঁটীটাতে একটা মাঝারি গোছের কাঠের বাক্স বাঁধা। তার ডালার উপরে কি রকম একটা স্প্রীংয়ের হ্যাণ্ডেল। ভদ্রলোকটীর নিকট যেই এগিয়ে গেলাম,—অমনি তিনি, “এই যে আসুন, নমস্কার” বলেই ডান হাতে করে একটা মালা নিয়ে আমার গলায় ফেলে দিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতে করে স্প্রীংটায় একটা চাপ দিলেন। অমনি এক টুক্রা কি কাগজ আমার সাম্নে মাটীতে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিয়ে দেখি, একখানি প্রীতি-উপহার। হাতে করে নিয়ে সরু পথটী বেয়ে এসে ঢুকে পর্লাম একেবারে প্যাণ্ডেলের (তাঁবুর) মধ্যে।
সামনেই হিমাচল বাবু, দাঁড়িয়ে। বিশাল বপু; প্রফুল্ল মুখ; স্ফীত অধরের কোণে চাপা হাসি।
“এই যে আসুন,—হেঁ, হেঁ,! মালা-ও পেয়েছেন প্রীতি উপহার ও পেয়েছেন। স্কিমটা (ব্যবস্থা) তাহ’লে সাকসেসফুল (সফল) হয়েছে!”
স্কিমটা যে কি, তখনো পর্য্যন্ত ভাল করে বুঝ্তে পারিনি। পরে কথায় কথায় বুঝেছিলাম। সাধারণতঃ কাজকর্ম্মের বাড়ীতে যে অভ্যর্থনা কাজটা পাঁচজন লোকের দ্বারা ও সুসম্পন্ন হয় না,—হিমাচল বাবুর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থায় একজন লোকের দ্বারা তা’ অনেক বেশী সুচারু ভাবে সম্পন্ন হ’য়েছিল। প্রথমতঃ,—অভ্যর্থনার জন্য পাঁচ জন লোকই’ রাখ আর দশ জন লোকই রাখ, সকলের গলায় মালা কখনো পড়ে না। দু’একজন ফস্কে যায়-ই। দ্বিতীয়তঃ প্রীতি-উপহার বিলানোটা একটা মস্ত হাঙ্গামা। একে ত কাগজগুলো একটার সঙ্গে একটা এমন জড়িয়ে থাকে, যে একটা একটা করে বিলি কর্তে অনেক সময় লাগে। ফলে কেউ হয়ত দু-তিন খানা পায়, কেউ একখানিও পায় না। তার উপর, যারা আবার পায় না, তারা,—“মশাই, এদিকে একখানা—এদিকে একখানা”—করে’ এমন চীৎকার আরম্ভ করে, যে বিশৃঙ্খলা শতগুণ বেড়ে যায়। এতে যে কতখানি ম্যান-পাওয়ার (man-power = মানুষের শক্তি) মিছামিছি নষ্ট হয়, তা’র হিসাব নাই। অথচ এই ম্যান পাওয়ার খাওয়া দাওয়ার কাজে লাগালে কত বেশী কাজ হয়! এর অভাবে, বিয়ের নিমন্ত্রণে পংক্তিতে খেতে বসে যে কতলোকের কত সময় বৃথা নষ্ট হয়, সে কথা ভাব্তেই লজ্জা বোধ হয়।
হিমাচল বাবুর বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কিন্তু এসব অসুবিধা সহজেই দূর হ’য়েছে। চোখের সামনে একটা জিনিষ মাটীতে পড়ে যেতে দেখ্লে সেটাকে কুড়িয়ে নেবার একটা ইচ্ছা প্রত্যেক মানুষেরই হয়। সেই ইচ্ছাটাকে যে এমন চমৎকার কাজে লাগানো যেতে পারে, এবং তাই দিয়ে যে এতখানি ম্যান-পাওয়ারের ইকনমি (মিতব্যয়) সম্ভব,—একথা বিরতির বিয়ের আগে আজ পর্য্যন্ত কারো মাথায় আসে নি,—এমন কি হিমাচল বাবুরও নয়,—এইটেই আশ্চর্য্যের বিষয়। বিরতির বিয়ের সময়েই হিমাচল বাবু প্রথম এই এক্স্পেরিমেন্টটা (পরীক্ষাটা) করলেন। এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে, বিজ্ঞান-সাধক মাত্রেরই যা’ হয়,—হিমাচল বাবুরও তাই হ’য়েছে দেখ্লাম—তিনি কিছুতেই সেটা আমাদের কাছে লুকোতে পার্লেন না। সেটা হ’চ্চে তাঁর চোখেমুখে একটা অপূর্ব আনন্দের দীপ্তি।
এই ম্যান-পাওয়ারের ইকনমির দরুণ অনতিবিলম্বেই এল খাওয়ার ডাক। আমাদের কিন্তু তখনই খেতে যাবার ইচ্ছা ছিল না। বিয়ে দেখ্বার ইচ্ছা ছিল। বিয়ের নিমন্ত্রণে পংক্তিতে খেতে বস্লে কত দেরী যে হয়, তা’ ত আমাদের অজানা ছিল না। তাই পাছে খেতে খেতে বিয়ে হ’য়ে যায়,—এই ভয়ে খেতে উঠ্ছিলাম না, বসেই ছিলাম। আমাদের অবশ্য ভুল হ’য়েছিল। হিমাচল বাবুর বৈজ্ঞানিক প্ৰণালীতে এই সময়টা যে কত সংক্ষিপ্ত হ’য়ে যেতে পারে,—তা’ তখনো পর্য্যন্ত ধারণা কর্তে পারিনি। যাহো’ক আমরা উঠ্ছি না দেখে হিমাচল বাবু আমাদের কাছে এগিয়ে এসে বল্লেন,—“পাতা হ’য়েছে যে।”
আমি বল্লুম,—“তাড়াতাড়ি কি? বিয়েটা দেখেই খেতে যাওয়া যাবে।”
হিমাচল বাবু বল্লেন, “হ্যাঁ বিয়ে দেখ্বেন বই কি। বিয়ের নিমন্ত্রণের অতিথি আপনারা,—বিয়ে দেখ্বেন না, তা কি হয়? সকলেই ত বিয়ে দেখ্বেন।”
আমি বল্লাম, “কিন্তু লগ্ন ত এখনি।”
হিমাচল বাবু বল্লেন, “তা হ’লেই বা। ছাদেই সব বন্দোবস্ত আছে।”
আমি ত অবাক্! ছাদেই খাবার জায়গায় বিয়ের বন্দোবস্ত! আমার মনের কথাটা মুখ দিয়ে কি রকম ফস্ করে বেরিয়ে গেল।
হিমাচল বাবু হেসে বল্লেন, “তা না হ’লে কি চলে? বিয়ের নিমন্ত্রণের অতিথি যাঁরা, তাঁরা বিয়ে দেখ্বেন না, সে কি হয়? নিমন্ত্রণের যে উদ্দেশ্য, তার সঙ্গে তাঁদের নিমন্ত্রণ রাখার যোগ তা না’ হ’লে থাক্ল কোথায়? অথচ দানের ঘরে সমস্ত অতিথির স্থান সঙ্কুলান হওয়া যদিও সম্ভব হয়, সকলের পক্ষে শুভকার্য্য দেখা এবং মন্ত্র শুন্তে পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই আমি ছাদে খাবার জায়গাতেই সকলের সামনে একটা screen এ projectionএর (পর্দ্দা টানানর) ব্যবস্থা করেছি। বিয়ের যে মন্ত্র পাঠ হ’বে তাও সেখানে একটা রেডিও ও লাউডস্পীকার দিয়ে ব্রড্কাষ্ট্ করে দেওয়া হ’বে। আপনারা চলুন, আপনাদের সব ইচ্ছাই সেখানে পূর্ণ হ’বে।”
ছাদে উঠে দেখি, বিরাট্ ব্যাপার। খানিকক্ষণ সময় গেল ঠিক কর্তে যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি,—সেটা একটা বাড়ীর ছাদ,—না—কোন রেলওয়ের একটা বড় জংসন ষ্টেসনের কাছাকাছি একটা রেলপথ। ছাদের এক প্রান্ত থেকে রেলওয়ে লাইনের মত তেরো সারি লোহার পাইপ বেরিয়ে চলে গিয়েছে ছাদের অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত, এবং তার পাশাপাশি চলে গিয়েছে, সরু সরু শিশের তার। অপর প্রান্তে একটু উঁচুতে একটা পর্দ্দা টাঙানো। তার পাশে একটা টেবিলের উপর একটা রেডিও সেট। প্রকাণ্ড ছাদে তেরো সারি আসন পাতা হ’য়েছে। প্রত্যেক সারিতে কতগুলি আসন ছিল, তা গুণ্বার সুবিধা হয়নি,—তবে আন্দাজে মনে হ’ল ত্রিশ পঁয়ত্রিশের কম নয়। একসঙ্গে আন্দাজ পাঁচশ লোক খাওয়ানোর বন্দোবস্ত। প্রত্যেক আসনের বাঁদিকে দেখ্লাম টেলিগ্রাফ পোষ্টের মত এক হাত করে উঁচু দুটী খুঁটী। একটী উঠেছে পাইপটা থেকে, অপরটী শিশের তারটী থেকে। পাইপ থেকে যে খুঁটীটা উঠেছে তার উপরের দিক্টা গোল হ’য়ে আবার একটু নেমে এসেছে—কতকটা রাস্তার ধারে ইলেক্ট্রিক ল্যাম্প-পোষ্টের মত। তার মাঝখানে একটা বোতামের মতন, তার উপর লেখা “টিপুন”। শিশের তারটী থেকে যে খুঁটীটী উঠেছে, তার তলায় একটা সরু কাঠের উপর তিনটী বোতাম, একটীতে লেখা, “লাল,” আর একটীতে ‘সবুজ’ ও তৃতীয়টীতে “সাদা”; এবং সেই খুঁটীটীর উপর ঐ তিন রঙের তিনটী ইলেক্ট্রীকের বাল্ব এবং সেই খুঁটীটীর উপরে একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো একটী করে ছাপান খায়-তালিকা।
এই সব দেখে শুনে ত আমি অবাক্। যাহো’ক একটা আসনে ত বসে পড়া গেল। বসেই দেখি, খাদ্য তালিকাটার উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে,–“অনুগ্রহ করিয়া পরিবেশনের পূর্ব্বেই নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি পড়িয়া আয়ত্ত করিয়া ফেলুন, নচেৎ পরিবেশনে বিশেষ অসুবিধা হইতে পারে।” লেখাটা দেখেই ক্লিপ থেকে কার্ডখানা খুলে নিয়ে ব্যবস্থাগুলি পড়তে আরম্ভ করে দিলাম।
সবে মাত্র দু’ এক লাইন পড়েছি, এমন সময় রেডিও বেজে উঠ্ল। মনে করলাম বুঝি, বিয়ে আরম্ভ হ’ল,–কিন্তু তা নয়। হিমাচল বাবু রেডিওতে তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রণালী ও ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমাদের কিছু উপদেশ দিচ্ছিলেন। তাঁর সে সুদীর্ঘ বক্তৃতার সারাংশটুকু মাত্র আমি এখানে দিতে পারি; তাঁর ভাষা হুবহু পুনরাবৃত্তি কর্তে পারি, এমন স্মৃতি-শক্তি আমার নাই। তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল,–কো-অপারেশন অর্থাৎ সহযোগিতার প্রয়োজনীতা। সহযোগিতা ব্যতিরেকে কোনো সুব্যবস্থাই সম্ভব নয়। আজকের এই বিরাট ভোজ-ব্যাপার নির্বিঘ্নে সম্পন্ন কর্তে হ’লে, প্রথমেই চাই, ভোজনকারী ও পরিবেশনকারীদের মধ্যে পরিপূর্ণ সহযোগিতা। অতএব তাঁর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর পরিবেশন আরম্ভের মধ্যে যে দশ মিনিট কাল ব্যবধান থাকবে, তার মধ্যে আমরা যেন খাদ্য-তালিকায় মুদ্রিত উপদেশগুলি আয়ত্ত করে নিই, এবং অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলি। হিমাচল বাবুর দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, এই অনুরোধের জন্য একটা কৈফিয়ৎ। অনেক চিন্তা করেও তাঁর আয়োজন তিনি এর চেয়ে বেশী সরল কর্তে পারেন নি। তবে সেজন্য বেশী দুঃখ নাই। বিজ্ঞানের দান আমরা যে পরিমাণে গ্রহণ করে জীবনে অধিকতর সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ কর্তে থাক্ব, ঠিক সেই পরিমাণেই আমাদের জীবনটা জটিলতর হ’য়ে উঠ্বে, তার কোন উপায় নাই। কি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, কি সামাজিক ব্যবস্থায়, কি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, জীবনটা আজকাল সর্ব্বত্রই আগের চেয়ে অনেক জটিলতর হ’য়ে উঠেছে; কিন্তু তাই বলে আমরা বিজ্ঞান-প্রদত্ত সুবিধাগুলো ছেড়ে দিতে পারি না। গোলাপ ফুলের গন্ধ যদি উপভোগ কর্তে চাও, তবে গোলাপ গাছের কাঁটা এড়িয়ে চলতে গেলে চলবে না। অতএব আমরা যেন খাদ্য-তালিকায় মুদ্রিত উপদেশগুলো আয়ত্ত করবার এবং তা’ মেনে চলার কষ্ট স্বীকার থেকে বিরত না হই। হিমাচল বাবুর বক্তৃতার তৃতীয় কথা ছিল,–অপব্যয়-নিবারণ। এই সব ভোজ-ব্যাপারে কত জিনিষ যে বৃথা নষ্ট হ’য়ে থাকে, তার ইয়ত্তা নাই, অথচ এই অপচয় নিবারণের কোন সদুপায় উদ্ভাবন করা বিশেষ শক্ত। তার প্রধান কারণ কোন রকম ষ্ট্যাটিস্টিক্সের অভাব। আজ পর্য্যন্ত কোন গৃহস্থ, এই সব ভোজ-ব্যাপারে তাঁর অতিথির সংখ্যা, কিংবা কোন্ খাদ্যদ্রব্য কত পরিমাণে রান্না হ’য়েছিল, তার কতখানিই বা পরিবেশিত হ’য়েছিল, আর কতখানিই বা রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হ’য়েছিল, তার কোনো বিবরণ রাখেন নি। হিমাচল বাবু তাঁর বড় মেয়ে আরতির বিয়ের সময় এই রকম একটা বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন, এবং বর্তমান ব্যাপার উপলক্ষে সেটা ব্যবহার করে রান্নার পরিমাণও কিছু কমিয়েছেন। এবারেও তিনি ঐ রকম একটা বিবরণ রাখবার ব্যবস্থা করেছেন, এবং তাঁর ছোট মেয়ে প্রণতির বিয়ের সময় এই দুটো বিবরণই ব্যবহার কর্বেন। কিন্তু অন্যান্য গৃহস্থেরাও যদি তাঁর প্রদর্শিত এই পথ অনুসরণ করেন, তবে সেই সব বিবরণগুলো মিলিয়ে ভবিষ্যতের ব্যবহারের জন্য একটা বিশেষ রকম উপযোগী ষ্ট্যাটিস্টিক্স গড়ে উঠতেও পারে। তবে সেই ষ্ট্যাটিস্টিক্সের মধ্যে লিপিবদ্ধ সংখ্যাগুলো যতটা সম্ভব নির্ভুল হওয়া প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে আমরা যেন তাঁহাকে সাহায্য করি। যে আহাৰ্য্যগুলি রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হয়, শুধু সেইগুলিই যে নষ্ট হয় তা ত’ নয়, পাতে পরিবেশিত হ’য়েও অনেক জিনিষ নষ্ট হয় এবং সেগুলির আর পরিমাপ করা সম্ভব হয় না। অতএব হিমাচল বাবু আমাদের তৃতীয়বার অনুরোধ কর্লেন যেন আমরা খাদ্যতালিকায় মুদ্রিত উপদেশগুলি ভাল রকমই আয়ত্ত করে নিয়ে সেগুলো মেনে চলি। হিমাচল বাবু আরো বল্লেন যে,–সময়-সংক্ষেপ এবং কষ্ট-লাঘবের জন্য পরিবেশনের ব্যবস্থা যতটা অটোমেটিক করা সম্ভব, তা তিনি করেছেন। যথা—খেতে খেতে কখন যে গেলাসের জল ফুরিয়ে যায়, তার ঠিক নেই, অথচ যখন তখন ‘জল’ ‘জল’, করে’ চিৎকার করাটা বিশেষ অসুবিধাজনক। এবং তার জন্য পাঁচ সাত জন লোক নিযুক্ত করে রাখাটাও মানব-শক্তির বিরাট্ অপব্যয়। তাই তিনি প্রত্যেক আসনের পাশেই একটা করে জলের কল বসিয়ে দিয়েছেন। দরকার হ’লেই বোতাম টেপো, আর যত ইচ্ছা জল গড়িয়ে খাও। হিমাচল বাবু আরো যে কত কি বলেছিলেন,—তা’ আমার মনে নেই। বিজ্ঞানের বিন্দু-বিসর্গও জানি না আমি; অত বড় বৈজ্ঞানিকের বক্তৃতা শুনে বুঝার চেষ্টা কর্তেই গলদঘর্ম্ম হ’য়ে গেলাম; তা’ সে সব কথা মনে থাকবে কি ক’রে? বক্তৃতা যখন শেষ হ’ল, তখন মানসিক পরিশ্রমের ফলে যে বিষম ক্ষুধার উদ্ৰেক হ’ল, তাইতেই চারদিক অন্ধকার দেখতে লাগ্লাম। পরিবেশন আরম্ভ হওয়ার আগে পৰ্য্যন্ত যে দশ মিনিট কাল ব্যবধান ছিল, সেই দশ মিনিট আমার কাছে মনে হ’ল যেন দশ বছর। খাদ্য-তালিকায় মুদ্রিত উপদেশগুলি পড়বার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় কোন অর্থবোধ হ’ল না। কার্ডখানি সঙ্গে এনেছিলাম, তাই থেকে উপদেশগুলি এইখানে উদ্ধৃত করে দিলাম!
“১। উপরের খাদ্যদ্রব্যগুলি যে অনুসারে মুদ্রিত রহিয়াছে, ঠিক সেই অনুসারেই একটী একটী করিয়া পাতে পরিবেশন করা হইবে।
২। সমস্ত আহাৰ্য্যই নির্দিষ্ট সমান অংশে ছোট ছোট মাটির খুরিতে সাজান হইয়াছে, এবং সেই খুরি শুদ্ধই পরিবেশিত হইবে। প্রত্যেক খুরিতে যেটুকু করিয়া আহার্য্য সাজান হইয়াছে, সেইটুই প্রত্যেক আহার্য্যের ইউনিট্। একজন সাধারণ সুস্থ ব্যক্তি স্বাভাবিক ক্ষুধার্ত্ত অবস্থায় প্রত্যেকটি আহার্য্যই আহার করিলে প্রত্যেকটী আহার্য্যের যতটুকু পরিমাণ আহার করিতে পারেন, পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, প্রত্যেকটী আহার্য্যের ইউনিট্ ততটুকু পরিমাণেই নির্দ্ধারিত হইয়াছে।
“৩। ভিন্নরুচির্হি লোকঃ। কেহ কেহ হয় ত কোনো আহার্য্য একেবারেই খাইতে চাহিবেন না, আবার কোন আহার্য্য হয় ত এক ইউনিটের বেশী পরিমাণে খাইতে চাহিবেন। অনুগ্রহ করিয়া প্রথম কেসে সেই আহার্য্যের পরিবেশন আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গে বাম হস্তে লাল সুইচটী টিপিয়া লাল বাতিটা জ্বালাইয়া রাখিবেন। তাহা হইলে পরিবেশনকারী সেই আহার্য্যটী আপনার পাতে ফেলিবে না। হস্তদ্বারা ইঙ্গিত করিলে তাড়াতাড়িতে সব সময় সেই ইঙ্গিতের অর্থবোধ হয় না। পরিবেশনকারী আপনাকে ছাড়াইয়া চলিয়া গেলেই আবার সুইচটী টিপিয়া বাতিটী নিভাইয়া রাখিবেন। নতুবা যতক্ষণ আপনার আসনে লাল বাতি জ্বলিতে থাকিবে, ততক্ষণ আপনার পাতে কোন আহাৰ্য্যই পড়িবে না।
“৪। দ্বিতীয় কেসে অনুগ্রহ করিয়া আহার্য্যটী পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে সবুজ সুইচটী টিপিয়া সবুজ বাতিটী জ্বালাইয়া রাখিবেন এবং পরিবেশনকারী আপনার পাতে আসিলেই, যে কয় ইউনিট্ আপনার প্রয়োজন, সেই সংখ্যাটী শুদ্ধ উচ্চারণ করিবেন। তাহা হইলেই পরিবেশনকারী আপনার পাতে সেই কয় ইউনিট্ দিয়া যাইবে! পরিবেশনের সময়, “আর একটু দিয়া যান, মশাই” বলাটা যেমন অসুবিধাজনক, তেমনি লজ্জাজনক। পরিবেশনকারীর পক্ষেও সেটা সুবিধার নয়, কেননা প্রথমতঃ তাড়াতাড়িতে সে একটু অগ্রসর হইলে তাহাকে আবার ফিরিয়া আসিতে হয়, এবং সেজন্য পরিবেশনে দেরী হয়; দ্বিতীয়তঃ ‘আর একটু’ মানে যে ঠিক কতখানি তার একটা ধারণা করিবার কোনোই উপায় নাই।
“৫। যে আহার্য্য পরিবেশন করা হইয়া গিয়াছে, তাহা যদি পুনরায় আপনার প্রয়োজন হয়, বা অন্য কোনো আবশ্যক হইলে, অনুগ্রহপূর্বক সাদা বাতিটী জ্বালাইয়া দিবেন। তাহা হইলেই এটেণ্ডিং ষ্টাফ, (attending staff = দেখাশুনা কবার লোক) আসিয়া আপনার প্রয়োজন অনুসন্ধান করিবে।
“৬। যখন যে বাতিই জ্বালান না কেন,—কাজ হইয়া গেলেই তাহা পুনরায় নিভাইয়া দিতে ভুলিবেন না। নতুবা অনেক রকম গোলোযোগ হইবার সম্ভাবনা।”
আগেই বলেছি,—হিমাচল বাবুর লম্বা বক্তৃতা শুনে আমার এমনই ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছিল,–যে এই সব উপদেশগুলো পড়বার ধৈর্য্য তখন আর ছিল না। যেটুকু বা চেষ্টা করেছিলেম,—তার কোনো অর্থবোধ হয় নি। যাহোক সেই দীর্ঘ দশ মিনিট কাল শেষ পর্য্যন্ত কেটেই গেল,–এবং তার পর পরিবেশনও আরম্ভ হ’ল। পরিবেশনের প্রণালী দেখে আমার যে কি মজা লেগেছিল,—তা বর্ণনা কর্তে পারা যায় না। ঝুড়ি বা বাল্তির কোনো বালাই ছিল না। তার বদলে আস্ছিল, একরকম নূতন ধরণের ঠেলাগাড়ী। মস্ত বড় বড় কাঠের তক্তার দু’দিকে চারটে করে ছোট ছোট চাকা লাগান,—এবং পিছন দিকে তক্তার মাঝখানটায় একখণ্ড লম্বা সরু কাঠ দিয়ে একটা হাণ্ডেল মতন করা। তক্তাটা সারি সারি সাজান খুরিতে ভর্ত্তি। একজন লোক পিছন থেকে গাড়ীটা ঠেছে, আর দু’দিকে দুজন লোক খুরিগুলো পাতে পাতে ফেলে চলেছে।
প্রথম নম্বর এল একখানি খুরিতে দু’খানি লুচি, এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পিছনে আর একখানা গাড়ীতে একটা করে বেগুন-ভাজা। বলা বাহুল্য আস্বামাত্রই তা’ আমি সাবাড় করে ফেলেছিলাম। শেষ করেই একটা গোলমাল শুনলাম। চেয়ে দেখি,—দু’ তিন সারি পরে আমার সামনের একটা সারিতে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক চিৎকার করছেন, “এ পাতে লুচি বেগুন-ভাজা কিছুই পড়্ল না যে।” তাঁর পাশেই বসেছিল,–একটী ছোট মেয়ে,–বয়স আন্দাজ পাঁচ ছ’ বছর হ’বে। একবার চিৎকারে কোনো ফল হ’ল না দেখে তিনি ক্রমাগত চিৎকার আরম্ভ কর্লেন, “এ পাতে লুচি বেগুন-ভাজা কিছু পড়্ল না যে”।
অমনি হিমাচল বাবুর গম্ভীর কণ্ঠের হুঙ্কার শুন্তে পেলাম,—“কোথায় লুচি বেগুন ভাজা পড়্ল না,—য়্যা? লুচি-বেগুনভাজা পড়্ল না কেন?” ফিরে দেখি তাঁর বিশাল বপু নিয়ে তিনি একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নাম্ছেন, আর হুঙ্কার কর্ছেন। ছাদের যে প্রান্তে পর্দাটা টাঙানো ছিল,—তারই অপরপ্রান্তে একটা ছাদওয়ালা সরু বারান্দা ছিল। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নি, সেই বারান্দার ছাদে একটা টেবিলের উপর একটা লণ্ঠন বসানো ছিল। তিনি বোধ হয় সেই লণ্ঠনটা নিয়ে কিছু করছিলেন, এখন চিৎকার শুনে নেমে এলেন। কিন্তু তাঁর বিশাল বপু দুলিয়ে সরু কাঠের সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে সে পাতে লুচি বেগুনভাজা পড়ে গেল,–আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারও থেমে গেল। হিমাচল বাবু তবুও ছাড়লেন না। পরিবেশনকারীকে জোরসে ধমক দিয়ে উঠলেন,–“একটা পাতে লুচি বেগুনভাজা পড়েনি কেন?”
পরিবেশনকারীও তেমনি উচ্চকণ্ঠে জবাব দিল, “ওখানে লালবাতি জ্বলছিল যে!”
তখনি হিমাচল বাবু অনুসন্ধান করে দেখলেন,–যে,–যে পাতে লুচি বেগুনভাজা পড়েনি,–সে পাতের দখলকারিণী একটী ছোট মেয়ে। সেই দশ মিনিট কাল ব্যবধানের মধ্যে খেলা কর্তে কর্তে লাল বাতিটা টিপে দিয়ে থাক্বে।
হা হতোহস্মি! হুকুম হ’ল পাঁচ মিনিট কাল পরিবেশন বন্ধ রেখে রেডিও ও লাউড-স্পীকারের সাহায্যে উপদেশগুলি পড়ে সরলভাষায় ব্যাখ্যা করে দেওয়া হোক!
ঠিক সেই মুহূর্ত্তে রেডিওতে সোঁ সোঁ করে শব্দ উঠল। একজন লোক চেঁচিয়ে বলে উঠল,–“রেডিওতে যে মন্ত্র ব্রড্কাষ্ট্ আরম্ভ হ’চ্চে”।
হিমাচল বাবু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,–“সে কি কথা! আমার যে এখনো লণ্ঠনে স্লাইড পরানো হয় নি। শীগ্গির দানের ঘরে টেলিফোন করে বিয়ে বন্ধ রাখ্তে বলে দাও”।
ছাদের এককোণে একটা টেলিফোন ছিল। একজন পাত্লামতন লোক—লম্বা, উঁচু নাক–লাফিয়ে গিয়ে তার রিসিভারটা তুলে চিৎকার করে উঠল,—“হালো! পুরুত মশাই! হ্যালো, পুরুত মশাই!”
রেডিওতে মন্ত্র বেজে উঠল।
“হ্যালো, পুরুতমশাই! হ্যালো! পুরুতমশাই!”
হিমাচল বাবু আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “কই, বিয়ে বন্ধ কর্লে না?”
“কি কৰ্ব্ব? নো রিপ্লাই। হ্যালো, পুরুতমশাই! হ্যালো পুরুতমশাই!”
মন্ত্র বেজে চল্ল।
হিমাচল বাবুর হুঙ্কার। “নো রিপ্লাই,–ত দৌড়ে নেমে যাও। গিয়ে দেখ কি হ’ল, আর বিয়ে দশ মিনিটের জন্য বন্ধ রাখ্তে বলে এস।”
পাতলা মতন লোকটী নেমে গেল। কিন্তু হিমাচল বাবুর বাড়ীটা প্রকাণ্ড,—তাই রেডিওতে মন্ত্রটা খানিকক্ষণ বেজে তারপর বন্ধ হ’ল। খানিকক্ষণ পরে দেখি, সেই ভদ্রলোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এসে বল্ছেন,–“একটী লোক আছে কি দানের ঘরে, যে টেলিফোন ধরবে? ম্যান-পাওয়ারের ইক্নমি হ’য়েছে!”
হিমাচল বাবু, এমন কি স্বয়ং বরকর্ত্তাকেও ছাদের উপর সমস্ত বন্দোবস্ত আছে বলে,—খেতে বসিয়েছেন। দানের ঘরে ছিলেন কেবল, দু’জন পুরুত—তাঁদের মধ্যে একজন মন্ত্র পড়াচ্চিলেন, আর অপরজন মন্ত্রপাঠে ভুল হয় কি না তার তদারক করছিলেন; আর ছিলেন সম্প্রদাতা,—তিনি মন্ত্রপাঠ করছিলেন,–আর ছিলেন, বর। টেলিফোন ধরবে কে?
তারপর রেডিওতে উপরের উপদেশগুলি ব্যাখ্যা সহ শুন্লাম। ভালই হ’ল। নইলে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটীর মত কখন কি অবৈজ্ঞানিক বেয়াদবী করে বস্তাম তার ঠিক কি? আবার পরিবেশন আরম্ভ হ’ল। বিয়েও আরম্ভ হ’ল, রেডিওতে মন্ত্র বাজ্তে লাগ্ল। স্ক্রীনের উপর দেখ্লাম দানের ঘরের ছবি। তখন পরিবেশন হ’চ্চির ছেঁচ্ড়া। সেটা আমি খাইনে। লাল বাতিটা টিপে দিয়ে ছবি দেখতে লাগ্লাম। দানের ঘরের একেবারে পরিষ্কার পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি। দানের আঙ্টীটা পর্য্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। পুরুত, সম্প্রদাতা এবং বর বসে আছেন দেখ্লাম। ক’নে তখনো আসে নি। খানিক পরে পাতের উপর চোখ নামিয়ে দেখি,—লাল বাতিটা তখনো জ্বল্ছে, আর আমার সামনে দিয়ে কাট্লেটের গাড়ীটা গড় গড় করে চলে গেল। কাট্লেট্টা আমার অত্যন্ত প্রিয় জিনিস, কিন্তু সকলের পাতেই পড়্ল, আমারই পাতে পড়্ল না। তখনি সাদা বাতি টিপে আবার কাট্লেট্ আনতে বলতে বড়ই লজ্জা কর্তে লাগল। অথচ অমন প্রিয় জিনিসটা ছেড়ে দেওয়া যায় না। ভাবলাম আর দু’টো তিন্টে জিনিস পরিবেষণের পরে আবার সাদা বাতি টিপে কাট্লেট চাইলেই হ’বে৷
কিন্তু, কাট্লেট্ খাওয়া সেদিন আমার অদৃষ্টে ছিল না। খানিকটা বাদেই উঠল ভয়ানক গোলমাল। সে একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড। খাওয়া যখন অর্দ্ধেকটা অগ্রসর হ’য়েছে,–তখন এক সঙ্গেই বোধ হয় অনেকেরই জলের দরকার হ’য়েছিল, অথচ আগের দিকের লোকেরা যতক্ষণ জলের কল টিপে ছিলেন, ততক্ষণ পেছনের দিকের লোকেরা জল পাচ্ছিলেন না। অনেককে বোধ হয় এমন পাঁচ মিনিট পর্য্যন্ত অপেক্ষা কর্তে হ’চ্চিল। শেষ পর্যন্ত তাঁরা ধৈর্য্য হারিয়ে ‘জল’ ‘জল’ করে বিষম চীৎকার আরম্ভ করে দিলেন। “একি চালাকি নাকি মশাই, জল পাই না কেন?” তাঁরা যে বরযাত্রী সে কথা বোধ হয় হিমাচল বাবু ভুলে গিয়েছিলেন। রেডিওর আওয়াজের সঙ্গে নানাকণ্ঠের ‘মিশ্রিত’ আওয়াজ কেবলি শুনতে লাগ্লাম,—“জল! জল।” “বোতাম টিপুন” “বোতাম টিপুন!” “জল কই মশাই,–একি চালাকি না কি?”
ব্যাপারটা এইখানেই থাম্ল না। আরো কিছুদূর গড়াল। একজন বরযাত্রী অধীর হ’য়ে বোতামের উপর বোধ হ’য় এমন একটা জোর টিপুনি লাগিয়েছিলেন, যে সে বোতাম টেপাই রইল,—আর উঠল না। তাই সে কলে অবশেষে জল যখন এল, তখন একেবারে ছাদশুদ্ধ ভাসিয়ে দিল।
“কল বন্ধ করুন। কল বন্ধ করুন!” আর কল বন্ধ! জল পড়্তে লাগ্ল। ছাদ ভেসে গেল। বরযাত্রীরা অনেকেই তড়াক্ করে আসন থেকে লাফিয়ে উঠ্লেন। ঠিক সেই সময় ভাগ্যদোষে ইলেক্ট্রিক্ আলোও গেল নিভে। সঙ্গে সঙ্গে রেডিও ও থাম্ল। পর্দ্দাও অন্ধকার। তারপর যে লুচি ছোঁড়াছুঁড়ির ব্যাপার চল্ল তা বেশ কল্পনা করে নেওয়া যায়। আমার বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।
বরকর্তা ছিলেন বিশেষ ভদ্রলোক। তাই বরকে সভা থেকে তুলে নেওয়া হয় নি ৷ আমিও বরের বিশেষ বন্ধু, তাই শেষ পৰ্য্যন্তই ছিলাম।
বিয়ে হ’য়ে যাওয়ার পর হিমাচল বাবু অত্যন্ত গম্ভীর ও বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন, এমন সময় বরকর্ত্তা মশাই এসে একটু হেসে বল্লেন,—“হিমাচল বাবু! আপনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলো বিয়ের খাওয়ানোর ছাদের উপর না করে ল্যাবরেটারির ভিতর কর্লেই ভাল হয়”।
হিমাচল বাবু অত্যন্ত অপ্রতিভ হ’য়ে উত্তর দিলেন,–“না—না,—কি জানেন, একটু ভুলের জন্য এই কাণ্ডটা হ’য়ে গেল। আগে থেকেই একটা ব্রেক-ডাউন সারভিস্ অরগ্যানাইজ (ভণ্ডুল হলে পরে তার ব্যবস্থা) করে রাখা উচিত ছিল।”
প্রথম প্রকাশ: রামধনু, ৩য় বর্ষ, ১২শ সংখ্যা, পৌষ, ১৩৩৭
গল্পে মূল প্রকাশের বানান রাখা হয়েছে।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মজার কল্পবিজ্ঞান, শ্রীসুশীলচন্দ্র মিত্র