ফুটোস্কোপ
লেখক: ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সকালবেলা কাগজ ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ একটা খবরের দিকে চোখ পড়ায় চমকে উঠলাম। খবরটা এই রকম—
নতুন ভূমিকায় ডাক্তার চট্টখণ্ডী
(নিজস্ব সংবাদদাতার রিপোর্ট)
এককালের বিখ্যাত অস্ত্রচিকিৎসক ডক্টর সুভ্ৰাট চট্টখণ্ডী, যিনি নাকি কিছুদিন আগে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলেছেন বলে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাকে সম্প্রতি এক নতুন ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। জন কয়েক সমাজবিরোধী গুণ্ডাশ্রেণীর যুবকের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই যুবকদের যখন তখন তার তথাকথিত ‘চেম্বারে’ হাজির হতে দেখা যায় এবং তিনি নাকি তাদের প্রচুর আদর-আপ্যায়ন করে থাকেন। এই অসম আঁতাতে কোন পক্ষের ভূমিকা বেশি তা যদিও জানা যায়নি কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থায় এটিকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখবেন। আমরা মহামান্য সরকার বাহাদুরের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি।
সুভ্রাট আমার ছেলেবেলাকার বন্ধু। একই স্কুলে সেই নীচের ক্লাস থেকে শুরু করে ম্যাট্রিক ক্লাস পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পড়েছি, একসঙ্গে খেলেছি, একসঙ্গে বেড়িয়েছি, তর্কাতর্কি করেছি, সময় বিশেষে ঝগড়াও যে করিনি তা নয়; কিন্তু ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব চিরদিনই অটুট ছিল। অসম্ভব বুদ্ধিমান আর অসম্ভব তুখোড় ছেলে। তেমনি অসম্ভব খামখেয়ালীও বলা চলে; সেই ছেলেবেলা থেকেই ওর ছোট্ট মাথায় যে কত রকম উদ্ভট কল্পনা, কত রকম উদ্ভট প্ল্যান আর কত রকম উদ্ভট চিন্তা গিজগিজ করত তা নিয়ে আমরা কত হাসাহাসিই না করেছি! কিন্তু ও তাতে ভ্রূক্ষেপ করাও দরকার মনে করত না।
তারপর ম্যাট্রিক পাশ করলাম, কলেজে উঠলাম। আই.এস-সি. পাশ করে ও ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হল, আমি আই.এ. পাশ করে ভালো করে পড়াশোনা করব ভেবে চলে গেলাম লখনৌ। সেখানে আমার মামা ইতিহাসের অধ্যাপক। ঐতিহাসিক হবার সাধ আমারও।
দেখাসাক্ষাৎ কমে এল। তারপর ডাক্তারি পাশ করে ও চলে গেল বিলেত, আমি ইতিহাসের একটা অধ্যাপকের কাজ জুটিয়ে নিয়ে প্রাচীন ভারতের লুপ্ত মহিমা খুঁজে বার করার জন্য কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। ভাঙা মূর্তি আর শিলালিপির খোঁজে চষে বেড়াতে লাগলাম এখানে সেখানে। দেখা সাক্ষাতের আর ফুরসতই রইল না।
দেখা হল বহু বছর পরে। তখন আমরা দুজনেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে কিছুটা নাম করেছি। তবে সুভ্রাটের তুলনায় আমার নাম যে কিছুই নয় তা বুঝতে কষ্ট হল না। সুভ্ৰাট তখন শহরের একজন প্রথম শ্রেণীর অস্ত্রচিকিৎসক। লোকে বলত ও ছুরি ধরলে যমদূতরাও পালাতে পথ পায় না। কিন্তু হলে কি হবে, ওর সেই ছেলেবেলাকার খামখেয়ালিপনা মোটেই যায়নি, বরং যেন বেড়েই চলছিল। অস্ত্রচিকিৎসার নাম করে সে মাঝে মাঝে এমন সব বিপজ্জনক কাজ করে বসত যে রোগীর অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত। শেষে ওর নামে নানা অভিযোগ শোনা যেতে লাগল। ওর নাকি একটু একটু মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যাকে আমরা বলি মানসিক ভারসাম্য— তা নাকি ও ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে।
এরকম লোককে, আর যাই হোক, চিকিৎসার মতো জীবন-মরণ সমস্যার কাজে রাখা নিরাপদ নয়। কর্তৃপক্ষ তাই ওকে সরকারি কাজ থেকে ইস্তফা দেবার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলেন এবং শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে, ওই একদিন ধুস্ বলে পদত্যাগ পত্র পেশ করে দিল।
এর মধ্যে ওর সঙ্গে দু-একবারের বেশি দেখা হয়নি। আজ কাগজ পড়ে ভাবলাম, সত্যি, ব্যাপারটা জেনে আসা উচিত। বাল্যবন্ধু হিসেবে আমারও কিছু কর্তব্য আছে তো!
বালীগঞ্জে সুভ্রাটের বিরাট বাড়ি। সামনের ঘরেই কাউন্টারের ভেতর নার্সের পোশাক পরা একটি মেয়ে বসে আছে। যেতেই সে একটা স্লিপ এগিয়ে দিল নামটা লিখে দেবার জন্য এবং নাম লেখা হলেই একটি খাকি-জামা-পরা রোগা গোছের লোক সেটা নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
মিনিট খানেক পরেই সে ফিরে এল। সাহেব ডাকছেন।
সুভ্রাটের ঘরে তখন দু-তিনটি তথাকথিত তরুণ বসেছিল। তাদের চেহারা দেখেই মনে হল তবে তো খবরের কাগজওয়ালারা বানিয়ে কিছু লেখেনি। তিনটি ছেলেই চেহারায়, পোশাক-আশাকে যাদের আমরা পাড়ার মাস্তান বলে থাকি— ঠিক তাই। তাদের সামনে খাবারের প্লেট সাজানো, পাশে চা-ভরতি পেয়ালা। সুভ্রাট তাদের সঙ্গে যেমন গদগদ হাসিমুখে কথা বলছিল তাতে মনে হল ওদের সঙ্গে তার ভারি খাতির।
ঢুকতেই, আমার দিকে মাথা নেড়ে সুভ্রাট ইঙ্গিতে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল, তারপর মাস্তানদের সঙ্গে ফের তার কথাবার্তা চলতে লাগল।
আমার ধৈর্য যখন প্রায় শেষ সীমায় তখন ছোকরা তিনটি উঠে পড়ল। সুভ্রাট উঠে দরজা পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে এল।
এইবার সে আমার সঙ্গে কথা বলার ফুরসত পেল।
“তারপর? হঠাৎ তুই যে! কী মনে করে?”
“এলাম তোদের হালচাল দেখতে। কাগজে লিখেছে কিনা।”
“কাগজ!”—সুভ্ৰাট অট্টহাস্যে ঘর ফাটিয়ে তুলল।—“নো ওয়ার্ক, ফ্রাই খইঃ নেই কাজ, খই ভাজ। খই-এর ইংরেজি কী রে? জানি নে বাবা!”
“হ্যাঁ, খই ভেজে যে অন্যায় করেনি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। লোকে তোকে পাগলা ডাক্তার বলে, সেটা সহ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে তোকে এই সব মাস্তানদের সাকরেদ বলে ভাবা যায় না।”
সুভ্রাট কথার জবাব দিল না, মিটিমিটি হাসতে হাসতে শুধু বলল, “চা খাবি?”
“না।”
“চা খাবি না? তবে কফিই আনতে বলি।”
আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সে চাকরকে ডেকে দু-কাপ কফি পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলে বলল, “চল, আমার চেম্বারে গিয়ে বসি।”
“চেম্বারে কেন?”
“চলই না।”
চেম্বার দেখে মনে হল ওটাকে চেম্বার না বলে কোনো আধুনিক বিজ্ঞানীর সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি বললেই ঠিক বলা হয়। চারদিকে নানা রকম যন্ত্রপাতি সাজানো। দেয়ালে নানা রকম চার্ট, নক্সা ইত্যাদি ঝুলছে। একপাশে কতকগুলো শিশি-বোতল, ইনজেকশনের সরঞ্জাম, আরও নানারকম সার্জারির অস্ত্রশস্ত্র। হ্যাঁ, অস্ত্রশস্ত্রই বলা চলে যন্ত্রপাতি না বলে। শুধু রোগের সঙ্গে নয়, রোগীর সঙ্গেও যুদ্ধ করা চলে ও দিয়ে।
একটা কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রও দেখলাম। অনেকটা মাইক্রোস্কোপের আর টেলিস্কোপের মাঝামাঝি দেখতে। ভারি কৌতূহল হল। জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা আবার কী?”
সুভ্রাট মুচকি হেসে বলল, “ফুটোস্কোপ।”
“তার মানে?”
“কেন, পড়িসনি সুকুমার রায়ের কবিতা?
“আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে,
দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে।”
“তা তো পড়েছি, কিন্তু…”
“কিন্তু নয়, সত্যিই এটা ফুটোস্কোপ। এর সাহায্যে আমি মানুষের মাথার খুলির ভেতরটা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাই। কোথায় আছে মোটর এরিয়া, যা নাকি সেরিব্রাম— বাংলায় যার নাম দেওয়া হয়েছে গুরুমস্তিষ্ক—তার মাঝ বরাবর একটা সরু নালীর সামনে বসানো, আছে, কোথায় আছে সেন্সরি এরিয়া যা নাকি আছে ওর পেছন দিকে। আর, তুই তো জানিস, আমাদের সব নার্ভ অর্থাৎ স্নায়ুর আসল কেন্দ্র হচ্ছে মস্তিষ্ক বা মগজ। আমাদের শরীরের কোথায় কী কাজ হবে, কী কাজ হচ্ছে এবং কী কাজ করতে হবে সবই ঠিক করে দিচ্ছে এই মগজ।”
বাধা দিয়ে বললাম, “না রে বাবা, ও-সবের কোনো খবর-টবর আমি রাখি নে।”
“তা রাখবি কেন? যত সব অকাজ নিয়ে পড়ে আছিস! সেই যে কবে কান্তকবি লিখে গিয়েছিলেন, গৌতম সূত্রে আর রেশম সূত্রে প্রভেদ কী কী— তাই নিয়েই পড়ে থাক। তারপর শিলালিপি ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন দেখবি তুইও একটা জ্যান্ত পাথর হয়ে গেছিস। আজকের দিনের শেষ কথা হচ্ছে বিজ্ঞান। কী অসম্ভব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে! কোথায় তা নিয়ে মাথা ঘামাবি, তা না যত্তসব…”
আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম, সুভ্রাট থামিয়ে দিয়ে বলল, “যা যা, মেলা বাজে বকিস না। নে, কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আগে খেয়ে নে। মগজটা তাজা তাজা লাগবে।”
কফি খেয়ে সত্যি মগজ না হলেও মেজাজটা একটু তাজা তাজা লাগছিল। বললাম, “এ অদ্ভুত যন্ত্র কোথায় পেলি?”
“পেয়েছি কি আর? মাথা খাটিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়েছি। দশ বছর লেগেছে এটি বার করতে।” বলেই সুভ্রাট আবার সুর করে আওড়াতে লাগল—
“কোন দিকে বুদ্ধিটা খেলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা,
কতখানি ভস্ ভস্ ঘিলু, কতখানি ঠক্ঠকে ফাঁপা।”
নাঃ, আমার আবার মনে হল কাগজওয়ালারা বাজে কথা লেখবার লোক নয়। এত বড়ো ডাক্তারটা সত্যি পাগলা হয়ে গেছে।
অগত্যা অন্য কথা পাড়লাম। বন্ধুবান্ধবদের কে কোথায় আছে, কে কী করছে— এই সব মামুলি গল্প সেরে খানিকক্ষণ বাদে উঠে এলাম।
কয়েকদিন পরে কাগজে আবার দেখি একটা জোর খবর। না, সুভ্রাট সম্বন্ধে নয়। ও নিয়ে আর আমি মাথা ঘামাই না। খবরটা জো ডিম্বো সম্বন্ধে। জো ডিম্বো একজন নিগ্রো কুস্তিগীর। ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ন না হলেও তারই সমগোত্রীয়। পৃথিবীর নানা দেশের কুস্তিগীরদের ঘায়েল করে সে নাকি এবার কলকাতায় আসছে। এদেশের বাঘা বাঘা কুস্তিগীরদের সঙ্গে লড়বে সে। লম্বায় সাত ফুট, ওজনে প্রায় পাঁচ মণ। অতিকায় এই নরদানবটির ছবি দেখেছি, কিন্তু তার কুস্তি যে কখনো দেখার সুযোগ হবে তা ভাবিনি। নিজে কুস্তিগীর না হলেও কুস্তি আমার চিরদিনের প্রিয় খেলা। ছেলেবেলায় গামা, গুংগা, ইমাম বক্স, গোবরবাবু—এঁদের কুস্তি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল; সেই সূত্রে ওটা একটা নেশার মতো দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং সে ধরনের বড়ো কোনো কুস্তিগীরের লড়াই দেখার সৌভাগ্য হয়নি। জো ডিম্বো আসছে শুনে তাই ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক ওর লড়াই দেখতেই হবে।
তবে শুনেছি লোকটা নাকি ভীষণ হিংস্র প্রকৃতির। কুস্তিটাকে খেলা হিসাবে ও দেখে না—দেখে সত্যিকার লড়াই—যাকে আমরা বলি দ্বন্দ্বযুদ্ধ বা ডুয়েল—সেই চোখে। অর্থাৎ লড়াই-এর ফলে যদি বিপক্ষের প্রাণহানি ঘটে যায় তা হলেও কোনো পরোয়া করে না। একবার সত্যি তাই হয়েছিল। যার সঙ্গে ওর কুস্তি হল লড়াইএর আধঘণ্টা পরেই সে মারা গেল। এ নিয়ে জো ডিম্বো একটু মুশকিলেই পড়েছিল। কীভাবে জানি না, শেষ পর্যন্ত মৃত লোকটির হার্ট খারাপ ছিল এই রকম একটা, যাকে বলে ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর অজুহাতে ও ছাড়া পায়। আর একবার কুস্তি লড়তে গিয়ে ও প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল বলেও শুনেছি। তা সত্ত্বেও জো ডিম্বোর লড়াই যে একটা দেখবার মতো জিনিস হবে তাতে সন্দেহ নেই।
হু-হু করে টিকিট বিক্রি হতে লাগল। পাঁচ টাকা দশ টাকার টিকিট লাইন দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। আমি বহু কষ্টে পঁচিশ টাকা দিয়ে একটা দশ টাকার টিকিট জোগাড় করলাম— তাও খেলার এক সপ্তাহ আগে।
কিন্তু খেলার তিন দিন আগে আবার এক বিস্ময়কর খবর বেরোল, জো ডিম্বোকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতায় একটা নামী হোটেলে ও উঠেছিল এবং নিত্যকার অভ্যাসমত রাত্রে একটু বেশি মদটদ খেয়ে শুয়েছিল। হয়তো সেদিনকার মদের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে থাকবে। ভোর রাত্রে উঠে দেখা গেল ওর ঘর খোলা। পালোয়ান বাবাজীর নো পাত্তা। কোথায় গেল? কোথায় গেল? খোঁজ খোঁজ খোঁজ। মদের ঝোঁকে কোথাও বেরিয়ে গেল? নাকি কেউ ওকে কিডন্যাপ— কিনা অপহরণ করল? কিন্তু অত বড়ো পালোয়ানটাকে কিডন্যাপ করা তো সহজ কথা নয়— যদি না লোকটা একদম বেহুঁশ হয়ে থাকে।
এদিকে খেলার টিকিট সমস্ত বিক্রি হয়ে গেছে। কর্তারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। পুলিশ চারদিক চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু না, কোনো খোঁজ নেই জো ডিম্বোর!
অবশেষে খেলার নির্দিষ্ট দিন ভোরবেলা ওকে আবিষ্কার করা গেল। গঙ্গার ধারে একটা গাছের নীচে বসে আপন মনে চুরুট ফুঁকছিলেন বাবু! ওর ওই মিশমিশে কালো অতিকায় চেহারা দেখেই লোকে সন্দেহ করেছিল। শেষে পুলিশে খবর দিতে তারা ছুটে এসে ওকে সনাক্ত করে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে এল। আর, আশ্চর্য, ও বেশ খোশমেজাজে হাসতে হাসতেই তাদের সঙ্গে উঠে এল। সেদিনই সন্ধ্যায় ওর খেলা।
হাজার হাজার দর্শকের সঙ্গে আমিও বসে আছি। যথা সময়ে জো ডিম্বো মঞ্চে এসে ঢুকল। ওর সঙ্গে প্রথম লড়বে বেনারসের বিখ্যাত পালোয়ান শিউশরণ তেওয়ারী। মস্ত বড়ো নামী কুস্তিগীর। একটু থলথলে হলেও মোটামুটি বেশ মজবুত চেহারা। সমস্ত মাথা কামানো, শুধু মাঝখানে, ঠিক ব্রহ্মতালুর ওপর একটিপ নস্যির মতো ছোট্ট একটুকু চুলের আভাস। সেটি ওর টিকি, যা ওকে অবশ্যই রাখতে হবে। কিন্তু সে টিকি ধরে কেউ টানবে এমন উপায় নেই।
কিন্তু জো ডিম্বোর চেহারা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। এতদিন শুনে এসেছি এই লোকটি শুধু চেহারায়ই কুৎসিত নয়—স্বভাবেও অতি বদমেজাজী এবং তার চেয়েও বেশি হিংস্র। কিন্তু এখন দেখি একেবারে উলটো। না, চেহারা কুৎসিতই, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মেজাজটা ভীষণ আমুদে। কথায় কথায় হেসে উঠছে, পারলে যেন গড়িয়ে পড়ে! শিউশরণকে মঞ্চে উঠতে দেখেই ও পরম আনন্দে এগিয়ে গিয়ে হাতখানা বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করবার জন্য।
যথা সময়ে ঘণ্টা বাজল, হুইস্ল পড়ল, শুরু হল কুস্তি। কিন্তু এ কি! কুস্তি লড়বে কে? জো ডিম্বো হেসেই কুল পায় না—ফুর্তিতে এতই ডগোমগো! শিউশরণ যত তেড়ে আসে ও ততই পিছিয়ে যায় আর হাত নেড়ে এমন ভাব দেখায় যাকে পুঁথির ভাষায় বললে হয়তো বলা যায়—“না ভাই, আমাকে লড়তে বোলো না। সত্যি বলছি কুস্তি করে তোমার সঙ্গে পারব না। তার চেয়ে এস, দুজনে গলাগলি করে বসে একটু রসের গান গাই।”
দেখে হাজার হাজার দর্শক সবাই থ!
এ অবস্থায় যা হবার তাই হল। শিউশরণ লড়বেই। জিতলে সে একটা খুব মোটা টাকা পাবে। তাই মিনিট খানেকের মধ্যেই সে জো ডিম্বোকে তুলে চিৎ করে দিল। অত বড়ো ভারী দেহটা তুলতে যতটা সময় লাগে ততটুকুই সময় লাগল তার। আর মজা, চিৎ হয়েও জো ডিম্বোর লজ্জা নেই। তখনও সে বোকার মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসছে।
হঠাৎ একটু দূরে আর একটা অট্টহাসি শুনে চমকে ফিরে দেখি আমাদের অদূরে বসে আছে সুভ্রাট। হেসে গড়িয়ে পড়ছে সেও। আর তার পাশে? সেই তিন মস্তান। তারাও সমানে হাসছে। সুভ্রাটেরও তা হলে এ সব খেলা দেখার শখ আছে। কিন্তু সঙ্গে ওই সব সঙ্গী কেন?
যাই হোক, মল্লযুদ্ধের ইতিহাসে এরকম ঘটনা কখনো শোনা যায়নি। আমার না হয় পঁচিশটা টাকা জলে গেল, কিন্তু জো ডিম্বোকে যারা এনেছিল বহু টাকা খরচ করে তারা তো রামখাপ্পা হবেই। সেই রাত্রেই তাকে দমদম এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে প্লেনে রওনা করিয়ে দিয়ে আসা হল। প্লেনে উঠেও নাকি জো ডিম্বোর মনে কোনোরকম অনুশোচনা দেখা যায়নি, সে নাকি তেমনি ফুর্তির সঙ্গেই শিস দিতে দিতে গিয়ে বসেছিল তার সিটে।
এই ঘটনার পর মাস খানেক কেটে গেছে, লোকে আস্তে আস্তে সব ভুলে গেছে, এমন সময় আবার কাগজে দেখা গেল এক রগরগে বিজ্ঞাপন। কি, না কলম্বাস কলকাতায় আসছে। কে কলম্বাস? ইতিহাসের বিখ্যাত আবিষ্কারক ক্রিস্টোফর কলম্বাস? তিনি তো কয়েকশো বছর আগের লোক! আরে না না, ক্রিস্টোফর নয়, গঞ্জালেস কলম্বাস— যে নাকি এখন স্পেনের সবচেয়ে নামকরা বুল ফাইটার।
বুল ফাইট—ক্ষেপা ষাঁড়ের সামনে মানুষের একা দাঁড়িয়ে হাতাহাতি লড়াই স্পেনের একটি জাতীয় খেলা—বহুদিন থেকে চলে আসছে এবং এখনও চলে।
বুল ফাইটের গল্প অনেক পড়েছি বইয়ে কিন্তু এদেশে ও জিনিস কখনো চাক্ষুষ দেখিনি। কলম্বাস সেই খেলা দেখাবে কলকাতার স্টেডিয়ামে। সত্যি এটা একটা রগরগে খবরই বটে!
আবার সেই টিকিটের জন্যে লাইন। কিন্তু এবারে টিকিট জোগাড় করতে আরও কষ্ট হল। অনেক ধরাধরি করে শেষে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে একটা কম দামি টিকিট জোগাড় হল। তাই সই।
আশ্চর্য খেলা! কল্পনাই করা যায় না। স্টেডিয়ামের একদিকে একটা বিরাট ষাঁড় দাঁড়িয়ে। থেকে থেকে মাটিতে শিং ঘষছে আর নাক দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ করছে। আমরা দূরে বসেও তা বেশ শুনতে পাচ্ছি। ষাঁড়টার অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে কলম্বাস। তার কোমরের কাছে একটা টুকটুকে লাল তোয়ালে জড়ানো। একহাতে একটা চটের বস্তা, অন্য হাতে একটা বড়ো ছোরা।
শুনেছি লাল রং দেখলে গরু-মোষরা দারুণ ক্ষেপে যায়। এক্ষেত্রেও তাই দেখলাম। হঠাৎ ষাঁড়টা তীরবেগে ছুটে এসে আক্রমণ করল কলম্বাসকে। কলম্বাস চটের বস্তাটা ষাঁড়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে চকিতে পাশে ঘুরে গেল। ষাঁড়টা লক্ষ্যচ্যূত হয়ে হুড়মুড় করে উলটে পড়ল মাটিতে। কিন্তু না, পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়েছে সে। কলম্বাস কিন্তু এই ফাঁকে আবার অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আর ষাঁড়টার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বস্তাটা বাগিয়ে ধরে।
ষাঁড় আবার তেড়ে এল, আবার সেই রকম পাশ কাটিয়ে ওকে এড়িয়ে গেল কলম্বাস—চটের থলিটা এগিয়ে দিয়ে। আবার হুড়মুড় খেয়ে গড়িয়ে পড়ল ষাঁড়।
এই রকম চলল খানিকক্ষণ। মনে হল ষাঁড়টা এবার বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তবু শেষ বারের মতো সে আর একবার তেড়ে এল, কিন্তু এবার তার গতিতে ক্ষিপ্রতা যেন কম। কলম্বাস সে সুযোগ নিতে দেরি করল না। ষাঁড়টা চটের থলির উপর এসে পড়তেই সে ঘ্যাঁচ করে ছোরাটা তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল। ষাঁড়টা টলতে টলতে বসে পড়ল। তখনও মরেনি, রক্তের ধারা দেখে বোঝা গেল সে আর সহজে উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
একটা পা শায়িত ষাঁড়ের গায়ে বাড়িয়ে দিয়ে কলম্বাস কোমরের লাল তোয়ালেটা খুলে নিশানের মতো দোলাতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে চটাপট হাততালি আর বিপুল হর্ষধ্বনিতে সমস্ত স্টেডিয়াম যেন ফেটে পড়ল।
চেঁচামেচি, হইচই থামলে, সবাই অবাক হয়ে দেখে দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কী যেন বলছে। তাকিয়ে দেখি আর কেউ নয়, স্বয়ং ডাক্তার সুভ্রাট চট্টখণ্ডী। এখানেও সে হাজির।
তারপর যা ঘটল তা অভাবনীয়। সমস্ত জনতাকে চমকিত করে সুভ্ৰাট ঘোষণা করল, এ রকম বুল ফাইট সেও দেখাতে পারে। যে কোনো পাগলা ষাঁড়ের সঙ্গে সেও লড়তে প্রস্তুত। এবং আজ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে এ খেলা সেও দেখাবে। এই স্টেডিয়ামেই।
যারা ওকে চিনত তারা হেসে উড়িয়ে দিল—পাগলা ডাক্তারের এ আর এক পাগলামি ভেবে। কিন্তু কলম্বাস গম্ভীরভাবে বলল, “বেশ, আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি। যদি পারেন, আমার সমস্ত পারিশ্রমিকের টাকা ফেরত দিয়ে দেব।”
“বেশ, আমি আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। কোন ষাঁড়টার সঙ্গে লড়তে হবে আপনিই না হয় ঠিক করে দিন।”
একটা খোঁয়াড়ে অনেকগুলি অতিকায় জোয়ান ষাঁড় আটকানো ছিল। কলম্বাস এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে বদ্রাগী যেটা সেটাকে দেখিয়ে বলল, “এইটির সঙ্গে আপনি লড়বেন। কেবল ওই ষাঁড়টিরই ঘাড়ের কাছে কালো ছাপ রয়েছে। কাজেই ওকে চিনে নিতে কোনো অসুবিধে হবে না।”
এক সপ্তাহ পরের কথা। স্টেডিয়াম সেদিন লোকে লোকারণ্য। আগের দিনের চেয়েও ভিড় বেশি। এবার আর আমি টিকিট সংগ্রহ করতে পারিনি। কিন্তু সুভ্রাটই একটা কমপ্লিমেন্টারি টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে।
সন্ধ্যার দিকে সুভ্রাট সেজেগুজে স্টেডিয়ামে ঢুকল। ইচ্ছে করেই সে আজ একটা কোঁচানো ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে এসেছে। তবে কোমরে কলম্বাসের মতোই একটা লাল তোয়ালে জড়িয়েছে—হয়তো ষাঁড়টাকে উত্তেজিত করার জন্য। তবে হাতে তার ছোরাটোরা কিছু নেই—আছে শুধু একটা ছোটো চটের বস্তা। বাজার-করা থলির মতোই ছোটো সেটা। কলম্বাসের বস্তার চাইতে অনেক ছোটো তো বটেই!
নিশ্বাস বন্ধ করে দেখছি। হ্যাঁ, সেই ঘাড়ের কাছে কালো ছাপ ষাঁড়টাই তো। —সবচেয়ে বদমেজাজী বলে যেটাকে সবাই জানে—সেটাই তো রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে সুভ্রাটের মুখোমুখি।
কিন্তু কই, সুভ্রাটকে আক্রমণের জন্য তো তেড়ে আসছে না ষাঁড়টা! বরঞ্চ সুভ্রাটই পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে!
একটু পরে আরও আশ্চর্য কাণ্ড! সুভ্রাট বাঁ-হাতে চটের থলিটা পাশে ঝুলিয়ে রেখে ষাঁড়টার ঘাড়ে আস্তে আস্তে হাত বোলাতে শুরু করল। আর ষাঁড়টা, গোঁয়ার্তুমি করা দূরে থাক, পোষা কুকুরের মতো মাথা নীচু করে যেন ওর আদর কাড়তে লাগল।
সুভ্রাট চেঁচিয়ে বলল, “এই, লড়বি না? আয়! আয়!”
কিন্তু ষাঁড় নির্বিকার। কোথায় গেছে তার বদমেজাজ! একেবারে লজ্জানত নতুন বউয়ের মতো মাথা নীচু করে সেই যে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই!
“দেখুন, ষাঁড় বলছে ও লড়াই করবে না। তার মানে ও স্বেচ্ছায় হার স্বীকার করে নিচ্ছে, তাই না? তা আমি আর কি করব?”—ষাঁড়ের গায়ে হেলান দিয়ে হাসতে হাসতে ঘোষণা করল সুভ্রাট—“একটা বরঞ্চ ফোটো তুলে নিন আপনারা। আর মিষ্টার কলম্বাস! লড়াই যখন হলই না তখন আপনার পারিশ্রমিকের টাকা আর ফেরত দেবার প্রশ্নই উঠছে না। ও টাকা আপনারই প্রাপ্য, ও আপনি নিয়ে যান।”
স্টেডিয়াম সুদ্ধ লোক দেখেশুনে থ!
পরদিন ভোর না হতেই ছুটলাম সুভ্রাটের কাছে। এ অদ্ভুত রহস্যের সমাধান চাই-ই। আর, একমাত্র সুভ্রাটই হয়তো পারে তা করতে।
সুভ্ৰাট আজও সেই মাস্তানদের নিয়ে বসে বসে কফি খাচ্ছিল, হ্যাঁ, চেম্বারেই। আমায় দেখে আর এক পেয়ালার হুকুম দিয়ে বলল, “বোস্। জানতাম তুই আজ আসবি।”
ছোকরা তিনটি হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল৷ “আজ আসি তবে, স্যার!”
“হ্যাঁ, এস।”
ওরা চলে গেলে আর ভণিতা না করে বললাম, “জানিস নিশ্চয়ই কেন এসেছি। বাজে কথা না বলে ভালো করে বুঝিয়ে দে তো রহস্যটা।”
সুভ্রাট সস্নেহে সেদিনকার সেই যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বলল, “সব রহস্যের মূলে রয়েছে এই যন্ত্রটি—যার নাম আমি আদর করে দিয়েছি ফুটোস্কোপ। সব যন্ত্রপাতিরই ইংরেজি নাম হবে কেন, দু-একটার দিশী নামও থাকুক। বিশেষ করে অত বড়ো গুণী লোকের দেওয়া নাম!”
“তার মানে? ও সব হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথাটা বলবি কি-না বল!”
“বলব বৈকি! আগে একটু জিরিয়ে নে। বড্ড উত্তেজিত মনে হচ্ছে তোকে।”
“না আমার সবুর সইছে না।”
“আচ্ছা আচ্ছা, বলছি। তবে সংক্ষেপে বলব কিন্তু।”
তার পর সুভ্রাট সংক্ষেপেই সমস্ত ব্যাপারটা এইভাবে বুঝিয়ে দিল—
“তুই হয়তো শুনে থাকবি, বহুদিন থেকে এই মগজ নিয়ে আমি রিসার্চ করছি। আমাদের শরীরের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে মগজ বা মস্তিষ্ক। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্র বলা যায় এটিকে। সেদিনই তোকে বলেছিলাম আমাদের দেহের কোথায় কী কাজ হবে, কী কাজ হচ্ছে এবং কী কাজ করতে হবে সবই ঠিক করে এই মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের মধ্যে রয়েছে দুটি ভাগ—একটিকে বলা হয় সেরিব্রাম বা গুরুমস্তিষ্ক, আর একটিকে বলে সেরিবেলাম বা লঘুমস্তিষ্ক। গুরুমস্তিষ্কের পেছন দিকে এমন এক-একটা জায়গা আছে যা আমাদের এক-একটা ইন্দ্রিয়ের কাজ নিয়ন্ত্রিত করে। যেমন, কোনটা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দৃষ্টি, কোনটা শ্রবণশক্তি, কোনটা ঘ্রাণশক্তি, কোনটা বাক্শক্তি—এই রকম আর কি! ওই রকম আমাদের ক্রোধ, হিংসা, আনন্দ, মনের স্ফূর্তি, স্মৃতিশক্তি—এ সবও কি মস্তিষ্কই নিয়ন্ত্রিত করে না? নিশ্চয়ই করে এবং তাদের জন্যও গুরুমস্তিষ্কে এক-একটা নির্দিষ্ট জায়গা বাছাই করা আছে।
“মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমার মনে হয়েছিল যদি ওই জায়গাগুলোকে ঠিক ঠিক খুঁজে বার করতে পারি তা হলে ইনজেকশন দিয়ে এক-একটা জায়গাকে ইচ্ছেমতো নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারলে তার কাজগুলোকেও সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে আমাদের ইচ্ছেমতো। এখানে আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছে এই যন্ত্রটি যার নাম আমি আদর করে রেখেছি ‘ফুটোস্কোপ’। সুকুমার রায়ের ওই কবিতাটা আমার খুব প্রিয় কিনা! বিলেতে থাকতে আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু—ডক্টর কিউইউ, যে ছিল ইউনিভার্সিটির অপটিক ফিজিক্সের অধ্যাপক—এই যন্ত্র তৈরির কাজে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। যাই হোক, এই যন্ত্রের সাহায্যে মগজের ভিতরকার নানা অংশ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতোই খুব বড়ো করে দেখা যায়। (এখানে সুভ্রাট আমাকে নিকল্ প্রিজ্ম্, ক্যাথোড টিউব, কনকেভ-কনভেক্স ইত্যাদি নানা রকম লেন্স এবং আরও কী কী সব বিদঘুটে বৈজ্ঞানিক তথ্য বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যা আমি বুঝিনি। কাজেই বোঝাবারও চেষ্টা করব না।)
“যাই হোক, এই ফুটোস্কোপ যন্ত্রটির সাহায্যে এবং ক্রমাগত পরীক্ষা করে করে আমি মস্তিষ্কের ওই সব বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো মোটামুটি সনাক্ত করে ফেলেছি এবং কীভাবে ইনজেকশন দিয়ে ও সব জায়গাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যায় তাও বার করেছি।
“প্রথমে হাসপাতালে রোগীদের ওপর এই পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু খুলে প্রকাশ না করায় কেউ আমার উদ্দেশ্য ধরতে পারেনি। ফলে ‘পাগলা ডাক্তার’ এই খেতাব নিয়ে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হ’ল।
“কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়েও আমি চুপচাপ বসে থাকতে পারিনি। বাড়িতেই একটা ল্যাবরেটরি গোছের বানিয়ে নিয়ে আমি আমার গবেষণার কাজ আরও ভালো করে চালিয়ে যাচ্ছিলাম! কিন্তু সমস্যা হল পরীক্ষা করব কাদের ওপর? আমি তখন বেপরোয়া হয়ে গেছি। ভাবলাম, এমনিতে না পাওয়া যায়, কৌশলে, এমন কি দরকার হলে জোর করে লোক ধরে আনব—হ্যাঁ, পুলিশের ভাষায় যাকে বলে কিডন্যাপ করা।”
আমি বাধা দিয়ে বললাম, “বলিস কি? ও যে মস্ত বড়ো ফৌজদারী অপরাধ।”
সুভ্ৰাট বলল, “জানি বৈ কি? কিন্তু বিজ্ঞানের পরীক্ষা আমার কাছে আরও বড়ো। বলেছি না, আমি এখন বেপরোয়া। পরীক্ষা চালাবার জন্য লোক আমার চাই-ই। কিন্তু এ কাজ তো আমি নিজে করতে পারব না, তাই সাহায্য নিয়েছি পাড়ার যত উঠতি গুণ্ডা গোছের ছোকরাদের— যাদের তোরা বলিস মাস্তান। ওদের সঙ্গে ভাব করে, ওদের খাইয়েদাইয়ে, দরকার মতো হাতখরচের পয়সাকড়ি জুগিয়ে ওদের আমি আপনার করে নিয়েছি। তারপর ওদেরই সাহায্যে শিকার ধরে ধরে নিজের পরীক্ষা চালাচ্ছি।
সুভ্রাট একটু থামল, তারপর যেন একটু উত্তেজিত কণ্ঠেই বলল, “দেখ সোমনাথ, এই সুযোগে ওদেরকেও আমি বেশ ঘেঁটে দেখেছি। ওদের আমরা সমাজবিরোধী, উঠতি গুণ্ডা, মাস্তান অনেক কিছু বলি; কিন্তু ওদের মধ্যেও প্রাণ আছে সে পরিচয় আমি পেয়েছি। সমাজের বিমুখতার জন্যই আজ ওরা এমনটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদের ভালোবাসলে, ওদের অভাব দূর করলে; সহানুভূতির সঙ্গে মিশলে দেখবি, ওদের তোরা যতটা খারাপ মনে করিস তা ওরা নয়। বিপদে-আপদে ওরাই এগিয়ে আসতে পারে— যা তথাকথিত ভালো ছেলেরা কখনোই পারে না। আমার এ সব পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হলে আমি ওদের নিয়ে কাজ শুরু করব—ওদের ঠিকমতো মানুষ করার কাজ।
“যাই হোক, জো ডিম্বোকে মত্ত অবস্থায় কিড্ন্যাপ করে এনেছিল আমারই ছোকরারা। এবং আমার ল্যাবরেটরিতে বসে আমিই ওর মগজের ক্রোধ, হিংসা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করার জায়গাগুলি নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে আনন্দ আর স্ফূর্তির জায়গাগুলো যাতে বেশি কাজ করে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কাজেই জো ডিম্বো কুস্তি করবে কি, ফূর্তির চোটে শিউশরণের সঙ্গে গলাগলি করার জন্যই ও তখন ক্ষেপে উঠেছে।
“এই পরীক্ষায় সফল হবার ফলেই আমি নিজে বুল ফাইটের মতো অত বড়ো একটা বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে দ্বিধা করিনি। যদিও জানতাম কোথাও সামান্য একটু হিসেবের ভুল হয়ে গেলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। এখানে আরও একটু অসুবিধা ছিল। মানুষকে যত সহজে কিডন্যাপ করা যায় অত বড়ো একটা ষাঁড়কে তো তা করা যায় ন! এজন্য আমাকে নিজেকেই যেতে হয়েছিল ষাঁড়ের খোঁয়াড়ে—গ্যাস-মুখোশ পরে রাতের অন্ধকারে। অবশ্য সেখানেও ওই মাস্তান ছোকরাগুলিই ছিল আমার প্রধান সহায়। ষাঁড়গুলোকে ঘুমপাড়ানী গ্যাস ছড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে অচৈতন্য করে তারপর ওই বিশেষ ষাঁড়টির মগজের ক্রোধ আর হিংসার জায়গাগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিলাম ইনজেকশনের সাহায্যে—যদিও এখানে জায়গাগুলো খুঁজে বার করতে বেশ মেহনত করতে হয়েছিল আর ওষুধের ডোজও দরকার হয়েছিল অনেক বেশি। কিন্তু আমার যে ভুল হয়নি তা তো স্বচক্ষেই দেখেছিস। ওই দুর্দান্ত ক্ষেপা বদমেজাজী ষাঁড়টাও যেন মন্ত্রবলে শকুন্তলা নাটকের সেই আশ্রম-মৃগের মতো হয়ে পড়েছিল। তাই না?”
শুনতে শুনতে আমি তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। ঘোর ভাঙ্গল সুভ্রাটের অট্টহাসিতে। “কিরে, তুইও যে অন্যমনস্ক হয়ে গেলি! কফি যে পড়ে পড়ে ঠান্ডা হয়ে গেল! নাঃ, তোর মগজেও এবার একটা ইনজেকশন দিয়ে দিতে হবে দেখছি অন্যমনস্ক ভাবটাকে তাজা করতে। দিবি নাকি মুণ্ডুটা ফুটোস্কোপের তলায়?”
আবার অট্টহাস্যে ঘর কাঁপিয়ে তুলল সুভ্রাট।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, মজার কল্পবিজ্ঞান