ওহ্ ডালিলা
লেখক: সম্রাট লস্কর
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
১
“মেয়েদের একেবারেই বিশ্বাস করা উচিত নয়। যত নষ্টের গোড়া এই মেয়েরাই।”
এই রকম চূড়ান্ত মিসোজিনিস্টিক মন্তব্যটা শুনেও না শোনার ভান করে থাকলাম। এই ২১২৩-এ এই ধরনের মন্তব্য জনসমক্ষে করলে নিশ্চিত জেল হবে কয়েক বছরের জন্য। তবুও আমার বাড়িতে এইরকম কথাবার্তা আজকাল একটু বেশিই শুনতে হচ্ছে। উদ্দেশ্য যে আমাকে শোনানো তা কি আর আমি বুঝি না? চুপ করেই রইলাম। কিন্তু আমাকে চুপ করে থাকতে দিলে তো!
“কী হল? তুমি কিছু বললে না যে?”
আমি মনুর দিকে তাকালাম। ওর হাতে ওর প্রিয় রিডিং ডিভাইস, নিশ্চয়ই কোনো বই পড়ছিল। এখন অবশ্য চোখ আমার দিকে।
“কী বই পড়ছিস রে?” আমি কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলাম।
“স্যামসন অ্যাগনিস্টিস, মিল্টন”
“আচ্ছা, বুঝলাম”
“কী বুঝলে?”
“তোর মাথায় এসব উদ্ভট চিন্তাগুলো কোথা থেকে আসছে। এসব প্রাগৈতাহাসিক বই পড়া বন্ধ কর।”
“উদ্ভট চিন্তা মানে? কোন্ কথাটা ভুল বলেছি? এই যে তোমার আজকাল কাজে একদম মন বসে না তার কারণ কি আর বুঝি না ভেবেছ? ওই তোমার অফিসের মেয়েটা…”
“বড্ড বাজে বকছিস আজকাল। তোর রিনিউয়ালটা সামনের বছর ডিউ আছে না? এরকম করলে সেটা করা হবে না কিন্তু। যা, একটা প্রোটিন শেক বানিয়ে আন।”
মনু আমার দিকে একটা স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়াল। ধপ ধপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চটেছে।
আমি হতাশ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এই যে মনু আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিল এতক্ষণ, ওর বয়স মাত্র নয় বছর। মানে ওকে তৈরি করা হয়েছিল নয় বছর আগে। সাড়ে আট বছর আগে জেঠু ওকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়ির জন্য। বাড়ির নিজস্ব রোবট। মূলত আমারই জন্য। তার বছর খানেক আগেই আমি বাবা আর মা-কে হারিয়েছি কয়েক মাসের ব্যবধানে। বাবার একমাত্র দাদার কাছে থাকা ছাড়া আমার আর কোনো অপশন ছিল না। না জেঠুর কাছে খারাপ কিছুই ছিলাম না। তবে অ্যাডভান্সড বায়ো-টেকনোলজির নাম করা বৈজ্ঞানিক হওয়ায় ওঁর পক্ষে আমাকে বেশি সময় দেওয়াও সম্ভব ছিল না। উনি বিয়েও করেননি। একা থাকার জন্য কোনো কাজের লোকেরও প্রয়োজন হয়নি। আমি আসার পরই বুঝলেন লোক লাগবে। মনুর আবির্ভাব হয়ে গেল বাড়িতে, যদিও মনু যে কোনো মানুষ নয় সেটা তো আগেই বলেছি। বছর দুয়েক হয়ে গেল জেঠুও মারা গেছেন। সেই থেকে বাড়িতে আমি আর মনু। জেঠু বেঁচে থাকতেই আমার ওপর বেশ মাতব্বরি চালাত। এখন তো পুরোপুরি আমার জ্যাঠামশাই হয়ে বসেছে। জ্ঞানবৃদ্ধ মনুজ্যাঠা। কথাটা মাথায় আসতেই ফিক্ করে হেসে ফেললাম।
মনুর মধ্যে প্রথম থেকেই বেশ একটা নারী-বিদ্বেষী ব্যাপার লক্ষ করেছি। আমার বেশ সন্দেহ হয় যে জেঠু সেইভাবেই ওকে প্রোগ্র্যামিং করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জেঠু সারাজীবন বিয়ে তো করেনইনি, আদৌ কোনো নারী-সঙ্গ করেছিলেন কিনা বেশ সন্দেহ আছে। দু-একবার তাঁর কথাতে বেশ বুঝেছি যে মেয়েদের তিনি তেমন একটা পছন্দ করতেন না। সেটার কারণ খোঁজার আর চেষ্টা করিনি কিন্তু মনুর মধ্যেও এই ব্যাপারটা বড্ড বেশি। ওর মনু নামটাও জেঠুর দেওয়া। আসলে রোবটদের তো আর নাম থাকে না, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার থাকে। যেমন মনুরটা হল AM/012237X2114। অ্যাডভান্সড রোবোটিক্স ওকে এমনভাবে তৈরি করেছে যে চট করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওকে আলাদা করা সহজ নয়। হ্যাঁ, কণ্ঠস্বরটা ধাতব বটে কিন্তু তা ছাড়া ও এতটাই মানুষের মতো যে মাঝে মাঝে ও যে না-মানুষ সেটা ভুলেই যাই। ওর বই পড়ার নেশা দেখলে অবাক হতে হয়। জেঠুর দুটো রিডিং ডিভাইস আছে। সেগুলো অন করে সারাদিনই পড়ছে। তবে হার্ডকোর বিজ্ঞানের বাইরে ও আর যে সমস্ত বই পড়ে সেগুলোর মধ্যে অনেক ক’টাই বেশ নারী-বিদ্বেষী। সেটাই স্বাভাবিক কারণ বইগুলো সবই জেঠুর আপলোড করা। এই সব বই পড়ে মনুর সিস্টেমে মেয়েদের প্রতি ভালোবাসা যে বাড়বে না তা কি আর আলাদা করে বলতে হবে?
এসব ভাবতে ভাবতেই মনু এসে প্রোটিন শেকটা দিয়ে গেল।
“কী রে বসবি না?”
“না, কাজ আছে। তুমি তো এখন ব্যস্তও থাকবে”
মনু চলে গেল। তবে ও যে ইঙ্গিতটা করে গেল সেটা আমার কাজ নিয়ে নয়। সেটা শ্রীরাজ্ঞীকে নিয়ে। শ্রীরাজ্ঞী। নামটা একবার অস্ফুটে বলে নিলাম। আমি যে ব্যাংকে কাজ করি তার ফিনানশিয়াল কনসালটেন্ট হয়ে শ্রীরাজ্ঞী যোগ দিয়েছে গত বছর। ওই কাজের সুবাদেই ওর সঙ্গে আলাপ। আগেকার দিনের মতো তো আর ব্যাংকে গিয়ে কাজ করতে হয় না আমাদের, তাই মেয়েটার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়েছে মাত্র বার দুয়েক। কিন্তু ভার্চুয়াল স্ক্রিনে আমাদের দেখা হচ্ছে বারংবার। ধীরে ধীরে কাজের থেকে অকাজের কথা বেড়েছে আর আমি বুঝেছি যে আমি ডুবছি গভীরে। অন্য পার্টিও যে ভেসে নেই সেই ইঙ্গিতও পাচ্ছি। দুজনেই ডুবতে রাজি কিন্তু ওই যে মনু…। ব্যাটা ঠিক বুঝেছে কী চলছে। বিগড়ে বসেছে। সারাদিন ধরে ঘুরিয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। এত উন্নত, সংবেদনশীল রোবট যে কী করতে জেঠু অর্ডার দিয়েছিল? অথচ মনুকে ছাড়া আমার একেবারেই চলবে না। এক দিক থেকে দেখতে গেলে মনুই আমার এখন একমাত্র আত্মীয়। ব্যাটাকে পথে আনতে হবে। শ্রীরাজ্ঞীর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু সেই সময় বাড়িতে মনু থাকলে চলবে না। কায়দা করে ওকে বাইরে পাঠাতে হবে।
“মনু,” আমি হাঁক দিলাম, “একবার শুনে যা তো তাড়াতাড়ি। একটা কাজ আছে…”
২
“সমস্যা তা হলে বেশ জটিল।”
“হুম”
“আর তুমি তো মনুকে ছাড়া থাকতেও পারবে না।”
“প্রশ্নই নেই। ওকে যদিও ধমকি দিয়ে রেখেছি যে ওর রেজিস্ট্রেশনের দশ বছরের রিনিউয়ালটা করাব না পরের বছর কিন্তু সেটা নেহাত কথার কথা। ওকে ছাড়া আমার চলবে না আর তোমাকে ছাড়াও… ইয়ে মানে… ওই আর কি। আসলে, আমাদের ব্যাপার নিয়ে মনু যেরকম বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।”
“আমাদের আবার কোন্ ব্যাপার?’ শ্রীরাজ্ঞীর ঠোঁট টেপা হাসি আমার সামনের থ্রি-ডি ভার্চুয়াল স্ক্রিনে।
এই কথার কোনো জবাব হয়? আমি মুখ গোমড়া করে চুপ করে রইলাম।
“আচ্ছা, আচ্ছা, আর রাগ দেখাতে হবে না। মজা করছিলাম। আর মনুর ব্যাপারে আমি সিরিয়াসলি ভাবছি। একটু সময় দাও। এবার একটু কাজের কথা হোক।”
আমরা কাজের আলোচনায় ডুবে গেলাম। মনুর ব্যাপারটা তখনকার মতো চাপা পড়ে গেল। তবে শ্রীরাজ্ঞী যে মনুর ব্যাপারটা সত্যিই গুরুত্ব দিয়েছে সেটা দু’দিন বাদেই বোঝা গেল। সন্ধেবেলায় টানা কাজ করে সবে একটু তন্দ্রা মতন লেগে গিয়েছিল আমার হাতের সঙ্গে বাঁধা স্মার্ট ডিভাইসটা কেঁপে উঠল। শ্রীরাজ্ঞীর মেসেজ। “প্রবলেম সলভ্ড। কালকে সকালেই সমাধান পৌঁছে যাবে তোমাদের বাড়িতে।”
“মানে?”
শ্রীরাজ্ঞী আমাকে মানে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিছুই তেমন বুঝলাম না যদিও। দেখা যাক কী হয় কাল সকালে।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে করতেই কলিং বেলের আওয়াজটা পেয়েছিলাম। একটু বাদে মনু এল।
“একটা রোবট এসেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।”
মনু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলতে চায়। কিন্তু শেষমেষ কিছু না বলেই চলে গেল।
একটু বাদে মনু যাকে নিয়ে ঢুকল তাকে দেখে আমিই চমকে গেল। বাপরে, এ কাকে পাঠিয়েছে শ্রীরাজ্ঞী? এই তন্বী রোবট-নারী তো আমাদের বুকেও কাঁপন ধরাতে পারে। পারে কি, রীতিমতো ধরিয়ে দিয়েছে। এই হাইট, এই ফিগার, তার ওপর যেরকম ড্রেস পরে আছে। উফ্। পরমুহূর্তেই নিজেকে শাসন করতে হল। কী সব ভাবছি? ফোকাসটা রাখতে হবে তো…।
“স্যার আমি AF/007357X2119। অর্জুন স্যার আপনার কাছে আজ সকাল আটটায় রিপোর্ট করতে বলেছে।”
অর্জুন শ্রীরাজ্ঞীর মাসতুতো দাদা। এই রোবট-নারী ওদের বাড়িরই।
“হ্যাঁ, আমাকে শ্রীরাজ্ঞী বলেছে তোমার কথা। তুমি তো আজ থেকে এখানেই কাজ করবে…”
একটা যান্ত্রিক, ধাতব আওয়াজ কানে এল। ওটা যে মনুর গলা থেকেই বেরিয়েছে বুঝতে দেরি হয়নি। কিন্তু পাত্তা দিয়েছি বুঝতে দিলাম না।
“তোমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা তো বললে। কিন্তু নামটা কী? কী বলে ডাকব তোমায়?”
“আমার নাম ডালিলা, স্যার”
এবারের ধাতব আওয়াজটা আরও তীব্র। ডালিলা নাম শুনে মনু আঁতকে উঠেছে। আমিও এই নামটা শুনে একটু থমকে গেলাম। আবার সেই বাইবেল আর মিল্টন? কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর যথা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, “আচ্ছা ডালিলা, তুমি তাহলে তোমার নির্দিষ্ট ঘর মানে কিউবিকলে চলে যাও। মনু, ওকে দোতলার স্পেয়ার কিউবিকলটা দেখিয়ে দে। ও আজ থেকে এখানেই থাকবে।”
মনু নড়ল না। এক সময় রোবটেরা রোবোটিক্সের তিনটি মৌলিক নিয়মের বাইরে চলতই না। সেই সব ভালো দিনগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল?
ডালিলা বোধহয় ব্যাপারটা বুঝেছে। ওর প্রোগ্র্যামিংয়ে প্ল্যান অনুযায়ী পরিবর্তন নিশ্চয়ই করা হয়েছে। শ্রীরাজ্ঞী সেরকমই একটা ইঙ্গিত কাল দিয়েছিল।
“আমি নিজেই চলে যাচ্ছি, স্যার। খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না।”
“বেশ, তাই করো তা হলে। তবে ডালিলা একটা কথা…”
“বলুন স্যার।”
“আমাকে স্যার ডাকার প্রয়োজন নেই। এই যে মনু—ও তো আমাকে দাদা বলেই ডাকে। তুমিও তাই ডেকো।”
“ঠিক আছে দাদা।” ডালিলা বেরিয়ে গেল ওর কিউবিকল খুঁজতে।
মনু কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। আমি আন্দাজ করেছিলাম ওর কাছে আমাকে কিছু জবাবদিহি করতে হবে। তাই হল।
“এই মেয়েছেলে-রোবটটা এখানে কেন এসেছে?” মনুর ধাতব কণ্ঠস্বরে ইনটোশনের ওঠা-নামা চট করে বোঝা যায় না। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে যে ‘মেয়েছেলে’ আর ‘রোবট’ শব্দগুলোর মধ্যে কী তীব্র তাচ্ছিল্য জড়িয়ে আছে।
“এ এখানেই কাজ করবে তাই।”
“কীসের কাজ? আমি তো সব কাজ-ই করি।”
“ঠিক তা নয়। আসলে শ্রীরাজ্ঞী আর আমি কিছুদিন পর থেকেই এক সঙ্গে থাকব। প্রথম কয়েক মাস এই বাড়িতেই। ডালিলাও ওর সঙ্গে থাকবে। ও বাড়িটা শ্রীরাজ্ঞীর পছন্দ অনুযায়ী সাজিয়ে নেবে এই কয়েক দিনে।”
“তোমার অফিসের ওই মেয়েটা এই বাড়িতে থাকবে?” তথ্যটা প্রসেস করতে যেন অসুবিধা হচ্ছে মনুর।
“প্রথম কয়েক মাস, তারপর কয়েকমাস আমরা ওর বাড়ি। তুই-ও যাবি আমার সঙ্গে। এভাবেই চলবে।”
“আমি মোটেও কোথাও যাব না। এসব খুব খারাপ হচ্ছে।”
মনু বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শ্রীরাজ্ঞীর প্ল্যান তো প্রথম থেকেই হোঁচট খাচ্ছে। ধুত্তোর। কী যে করি।
৩
পরের কয়েকটা দিন মোটেই ভালো কাটল না। মনুর অসহযোগিতা আন্দোলন নিয়ে যা ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হল। ডালিলার প্রতি সম্পূর্ণ অসহযোগিতা চালিয়ে গেল। এটাকে কি অহিংস অসহযোগিতা বলা যায়? বোধহয় না। মনুর আচরণে ভায়োলেন্স নেই বটে, তবে হিংসা তো পুরোমাত্রায় আছে।
ডালিলা অবশ্য নিজের কাজ করে যাচ্ছে চুপচাপ। সুন্দর করে আমার বেডরুমটা গুছিয়ে দিয়েছে। এখানেই কিছুদিন পরে আমি আর শ্রীরাজ্ঞী থাকব। বাড়ির ইন্টিরিয়র ডেকরেশন নিয়েও কিছু পরামর্শ দিয়েছে যেটা আমার দিব্যি লেগেছে। মানতেই হবে মেয়েটার এস্থেটিক সেন্স বেশ ভালো। এসব নিয়ে আমরা এতদিন কেন যে ভাবিনি? তবে অন্য কোনো কাজে ওকে ঢুকতেই দিচ্ছে না মনু। ওর মতে বাইরের কেউ এসে বাড়ির রোজের কাজ করতে পারবে না। ডালিলাকে ও যতটা পারে এড়িয়ে চলছিল প্রথমে তবে ঝামেলা লাগতেও দেরি হল না। এক দুপুরে মনু এসে নালিশ করল, “ওই রোবট-মেয়েটা আমার রিডিং ডিভাইস নিয়ে পড়ছে কেন?”
এও বই পড়ে? সব পড়ুয়া রোবট আমার বাড়িতেই আছে নাকি? আর মনু এমন করে বলছে যেন রোবটের বই পড়া উচিত নয়? ব্যাটা তুই নিজে কী? নাকি ও বলতে চায় মেয়েদের বই পড়া উচিত নয়।
ডালিলা পিছু পিছু চলে এসেছে, “দাদা আমি তো একটা রিডিং ডিভাইস দিয়ে পড়ছিলাম। মনু তো অন্যটা দিয়ে তখন পড়তে পারে।”
“শুধু সেটাই নয়। ও রিডিং ডিভাইসে রাখা বইগুলো ডিলিট করে অন্য বই সব আপলোড করছে।” মনুর ধাতব স্বর গর্জে উঠল।
‘স্পেস ছিল না যে। কীসব কঠিন কঠিন সায়েন্সের বই আর প্রাচীনকালের কবিতার বই দিয়ে ভরতি ছিল ডিভাইসটা। ওসব আবার কেউ পড়ে?”
মনু চুপ। ওর সিস্টেমে ভরা ক্রোধের সিমুলেশন ওকে চুপ করিয়ে রাখল। রাগে বাক্যহারা একেবারে।
এসব ঝামেলা সামলানোর অভিজ্ঞতা আমার একেবারেই নেই। অসহায়ের মতো বললাম, “এ সব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করছিস কেন মনু? ওকে একটা রিডিং ডিভাইস থেকে পড়তে দে না। তোর তো অনেক বার ওসব পড়া আছে।”
কোনো জবাব পেলাম না। মনু ঘর থেকে উধাও। ডালিলা অবশ্য দাঁড়িয়ে। ওকে চলে যেতে বলে শ্রীরাজ্ঞীকে মেসেজে সব লিখলাম।
“এ তো সমস্যা আরও বেড়েই যাচ্ছে”
“একটু ধৈর্য ধর, শাম্ব। তোমার ধৈর্যটা বড়োই কম।”
এ সব জ্ঞান বাইরে থেকে দেওয়া বেশ সহজ। বিরক্ত হলেও শ্রীরাজ্ঞীকে কিছু বললাম না।
“ডালিলাকে সব শেখানো আছে। তোমার স্যামসন… মানে ওই মনুকে ও ঠিক বশে আনবে।”
“বশে আনবে মানে? কী করে?”
“দেখে যাও খালি। এটা তো আর বাইবেলের যুগ নয়। এই দ্বাবিংশ শতাব্দীতে একটা অতি-উন্নত রোবটকে বশে আনতে অন্য টেকনিক লাগে। সুভদ্রা সেটা ভালোই জানে।”
“সুভদ্রাটা আবার কে?”
“আরে কলকাতার কোনো রোবটের নাম আবার ডালিলা রাখা হয় নাকি? অর্জুনদা ওর নাম রেখেছে সুভদ্রা…”
“কিন্তু সুভদ্রা তো অর্জুনের… ইয়ে মানে…”
“অত জেনে তোমার কাজ কি? কিছু কিছু মানুষের এরকম ফেটিশ থাকে। তুমি শুধু জেনে নাও যে তোমাদের বাড়িতে ওর নাম ডালিলা। আর ওকে কী করতে হবে ও সেটা দিব্যি জানে। শুধু কয়েকটা দিন একটু ধৈর্য ধর, কেমন?”
অগত্যা। বাড়ির জটিল পরিস্থিতি পরের কয়েক দিন যে বিশেষ বদলেছে তা মনে হল না। তবে মনু আমাকে নালিশ করাটা বন্ধ করেছে। বুঝেছে যে আমি ওর পাশে দাঁড়াব না। আরেকটা জিনিসও লক্ষ করছিলাম মনু আজকাল রিডিং ডিভাইসে আগের থেকেও বেশি সময় কাটাচ্ছে। ও কি ডালিলার আপলোড করা বইগুলো পড়ছে নাকি?
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মনুর ব্যবহারে ধীরে ধীরে আরও কিছু পরিবর্তন দেখতে লাগলাম। ডালিলা কাছে থাকলে একটু অন্যরকম আচরণ করছে। ওর দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে, কী দেখছে কী জানে? মনু কি ডালিলার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে? আমাকে অবাক করে, মানে একেবারে প্লেজেন্টলি সারপ্রাইজড করে, দেখলাম যে সত্যিই তাই। মনু ডালিলার সঙ্গে কথা বলছে আজকাল। প্রথমে অল্পস্বল্প, তারপর বেশ অন্তরঙ্গই মনে হল। দুজনে পাশাপাশি বসে রিডিং ডিভাইসে বই পড়ছে—এ দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়তে লাগল। মনুকে তার মানে পথে আনা গেছে।
“তোমার ডালিলা তো ম্যাজিক জানে দেখছি।”
আমার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে থাকা শ্রীরাজ্ঞীকে বললাম। আজকেই প্রথম আমাদের বাড়িতে ও এসেছে। কিছুদিন পর থেকে এখানেই থাকবে।
“প্ল্যানটা কিন্তু আমার… আর কিছুটা অর্জুনদার ও বটে…”
“তা তো বটেই… কিন্তু তোমাদের প্ল্যানটা ঠিক কী ছিল?”
শ্রীরাজ্ঞী সোজা হয়ে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো, এমনিতে ডালিলা কতটা অ্যাট্রাক্টিভ তা তো প্রথমেই দেখে নিয়েছ… না না, অস্বীকার করার চেষ্টা করবে না। তোমাদের আমি ভালোই চিনি।”
এই যে এক বচন থেকে বহু বচনের ব্যবহার হল সেটা মোটেই ভালো লাগল না। কিন্তু প্রশ্ন কি আর করা যায় যে ‘আমাদের’ নিয়ে এত ধারণা তোমার কী করে হল? অতএব, ঘুরিয়ে উত্তর দিলাম, “তোমার অর্জুনদার পছন্দ আছে বলতে হয়। একেবারে নিজের চাহিদা মতো সুভদ্রাকে বানানোর অর্ডার দিয়েছে।”
“অর্জুনদাকে নিয়ে বাজে কথা বোলো না। এটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার একেবারেই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। কিন্তু মনুকে…?”
“সেটাই তো বলছি। মাঝখানে বাধা দিও না। ব্যাপার হচ্ছে যে প্রথমেই বুঝে গেছিলাম যে মনুকে অন্যভাবে বশ করতে হবে। মনুর মতন রোবটদের প্রোগ্র্যামিং ইচ্ছে মতো পরিবর্তন করা যায়। ওকে রোবোটিক্স সেন্টারে নিয়ে গিয়ে পরিবর্তনগুলো করা যেত। কিন্তু তোমার তাতে আপত্তি থাকত, আমি নিশ্চিত। তা ছাড়া ওই কাজে চ্যালেঞ্জ কোথায়? মনুর ভিতরের মিসোজিনিটা ধীরে ধীরে কিন্তু স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন করাটাই আসল কাজ। আর সুভদ্রা মানে ডালিলাকে সেইরকমভাবেই প্রোগ্র্যাম করে পাঠানো হয়েছিল।”
“কিন্তু, কীভাবে…”
“বলছি তো, শোনো না একটু চুপ করে…। নিজের প্রি-প্রোগ্র্যাম করা ডেটা ছাড়া মনুর অধিকাংশ ডেটা ইনপুট হত বই পড়ে। ডালিলাকে শেখানো ছিল ও যেন মনুর রিডিং ডিভাইসগুলোতে থাকা বইগুলো সরিয়ে দিয়ে নতুন বই ঢুকিয়ে দেয়। বই পড়লেই তো হবে না, ঠিকঠাক বই পড়তে। ইনপুট ডেটা যেরকম হবে মনুর আচরণও সেরকম হবে। ডালিলা দুটো রিডিং ডিভাইসে নতুন যে বইগুলো আপলোড করেছিল সেগুলো পড়েই মনুর এই পরিবর্তন, বুঝলেন মশাই?”
‘তা নতুন বই কোনগুলো আপলোড করল ডালিলা?” আমি স্বভাবতই কৌতূহলী।
“আহা নতুন মানে কি একেবারে নতুন। মনু যে ধরনের বই পড়ছিল তার থেকে একেবারে আলাদা রকমের বই। একটা রিডিং ডিভাইসে সব ফেমিনিস্ট থিয়োরির বই। উলস্টনক্রাফট থেকে সিমোন দ্য বোভেয়া, ভার্জিনিয়া উল্ফ থেকে জুডিথ বাটলার, ডোনা হ্যারাওয়ে থেকে একেবারে আমাদের সময়ের সিদ্দিকা সাঈদির লেখাগুলো। অন্য রিডিং ডিভাইসে বাছাই করা গল্প, কবিতা—কালিদাস, জয়দেব, রবীন্দ্রনাথ, শেকসপিয়র, বায়রন, জেন অস্টেন, জীবনানন্দ থেকে তসলিমা নাসরিন, সবই আপলোড করা হয়েছিল। এইসব পড়ার পর তোমার মনু কি আর পথে না এসে পারে?”
সত্যিই তাই। মনু পুরো বদলে গেছে। এমন কি শ্রীরাজ্ঞীকে বাড়িতে দেখে ও খুশি হয়েছে বলেই তো মনে হল। এই যে এতক্ষণ শ্রীরাজ্ঞীর সঙ্গে এক ঘরে আছে একবারও ঘরে ঢুকে রসভঙ্গ করেনি।
“তোমার আর তোমার ডালিলার জবাব নেই, মানতেই হবে।”
কৃতজ্ঞতা বোধ জানাতে শ্রীরাজ্ঞীকে কাছে টেনে নিলাম। আর তারপর আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
৪
আর তিন দিন বাদেই শ্রীরাজ্ঞী আমার বাড়িতে চলে আসবে। আমাদের সম্পর্ক ফর্ম্যালভাবে শুরু হতে চলেছে। কিন্তু এর মধ্যেই গোলমালটা বেধে গেল। একটা সামান্য অফিসিয়াল সমস্যা নিয়ে দুজনের মধ্যে যে ঝামেলা লাগল সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেল। আমাদের প্রথম সিরিয়াস ঝগড়া। মন মেজাজ খারাপ করে বসে আছি।
“কী হল? এরকম করে বসে আছ কেন?” মনু এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।
“তুই ঠিকই বলেছিলিস রে মনু। মেয়েদের একেবারেই বিশ্বাস করা উচিত নয়। যত নষ্টের গোড়া মেয়েরাই।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
“বাজে বোকো না তো। মেয়েদের গভীরতা বোঝার ক্ষমতা নেই তোমাদের। যত গোলমাল তো তোমরা ছেলেরাই পাকাও।”
বলে কী রে? এক ডালিলাতেই এই অবস্থা ব্যাটার। ডালিলা যখন সুভদ্রা-রূপ ধারণ করে আবার তার অর্জুনের কাছে ফিরে যাবে তখন কী বলবি? বলা বাহুল্য, এই কথাগুলো মনে মনে বললাম।
“মনটাকে স্থির করো। বাইরে তাকিয়ে দেখো, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে।”
চাঁদ? চাঁদ আবার দেখার কি আছে? এই মরা উপগ্রহে যে মানুষের বাসস্থান গড়া যাবে না তা বুঝতে পেরে চাঁদ নিয়ে উৎসাহ এখন বেশ কমে গেছে। আগেকার দিনে নাকি চাঁদ নিয়ে লোকে গল্প-কবিতা লিখত। অদ্ভুত যত।
তবুও মনুর কথাতে চাঁদের দিকে তাকালাম। পূর্ণিমার রুপোলি চাঁদ। ঝকঝকে। আমার বেশ ভালো লাগতে শুরু করল। আমি কি চাঁদের মধ্যে শ্রীরাজ্ঞীকে খুঁজছিলাম? আর মনু কী দেখছে চাঁদে? ডালিলাকে? ধুস্।
২১২৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের এক পূর্ণিমার সন্ধ্যায় শাম্ব নামে এক মানুষ আর মনু নামে এক না-মানুষ চাঁদ দেখতে লাগল, দেখতেই লাগল।
Tags: অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মজার কল্পবিজ্ঞান, সম্রাট লস্কর
বেশ ভালো লাগল। অভিনন্দন।
গল্পটি পড়ার ও মতামত দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। উৎসাহিত হলাম।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। হালকা চালে কিছু সিরিয়াস কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনার সেটা ভালো লাগায় উৎসাহিত হলাম।
বেশ লাগলো। মজার অথচ গভীর
Chand Uthechilo Gogone..
Khub bhalo hoeche..
ধন্যবাদ নেবেন। লেখালেখি কম করি, প্রতিক্রিয়া তো খুবই কম পাই। আপনাদের মতামত পেয়ে খুব খুশি হলাম। ভালো থাকবেন।
খুব সুন্দর একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, শেষটাও দারুন
অনেক ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার আর মতামত দেওয়ার জন্য। আমার সৌভাগ্য যে গল্পটি অনেকেরই ভালো লেগেছে।