বাংলায় এইচ জি ওয়েলসের অনুপ্রেরণা, ‘পাস্টিশ’ ও রূপান্তর
লেখক: প্রদোষ ভট্টাচার্য্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বাংলায় এইচ জি ওয়েলসের অনুপ্রেরণা নিয়ে দুটি কাহিনি সম্বন্ধে কল্পবিশ্ব পত্রিকা-র ২০শে জুলাই ২০২১-তে প্রকাশিত ‘হেমেন্দ্রকুমার রায় ও বাংলা কল্পবিজ্ঞান’ শীর্ষক প্রবন্ধে বক্তব্য রেখেছি।1 প্রথমটি হল মৌচাক পত্রিকায় ১৩৩২ বঙ্গাব্দে (১৯২৫-২৬ খৃ:) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হেমেনবাবুর মেঘদূতের মর্তে আগমন, যা’তে লেখক ওয়েলসের The War of the Worlds (১৮৯৭-৯৮) উপন্যাস থেকে মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের পৃথিবী-আক্রমণের ‘ট্রোপ’-টুকু নিয়ে রচনা করেছিলেন এক সম্পূর্ণ মৌলিক অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনি। এরপর, সম্ভবত ১৯৩০ সালে, প্রেমেন্দ্র মিত্র ওয়েলসের ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ছোটগল্প ‘The Empire of the Ants’ থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষদের বিরুদ্ধে পিঁপড়েদের মারণ-যুদ্ধঘোষণার কথা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রামধনু পত্রিকায় লেখেন এক ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতে (৭৮৯৯ সালের পর) অবস্থিত সেকালের কথা, যা পরে ডি এম লাইব্রেরী থেকে বেরোয় পিঁপড়ে পুরাণ নামে।
A Dictionary of Literary Terms and Literary Theory বইটিতে ‘পাস্টিশ’-এর সংজ্ঞা দেওয়া আছে:
pastiche (It pasta, ‘paste’) A patchwork of words, sentences or complete passages from various authors or one author. It is, therefore, a kind of imitation (q.v.) and, when intentional, may be a form of parody (q.v.). An elaborate form of pastiche is a sustained work (say, a novel) written mostly or entirely in the style and manner of another writer. 2
আবার, সুদীপ দেব, তাঁর স্বমহিমায় শঙ্কু-র ‘কৈফিয়ত’-এ দু-রকম পাস্টিশের (সুদীপবাবু বানান করেছেন ‘প্যাস্টিশ’) কথা বলেছেন: এক হল ‘মূল লেখকের লেখনশৈলী যথাযথভাবে অনুকরণ করে … নতুন প্লটের সঙ্গে পুরোনো স্টাইল মিলিয়ে দেওয়া’-র চ্যালেঞ্জ গ্রহণ। দ্বিতীয় রকমের পাস্টিশ হল ‘লেখকের অসমাপ্ত গল্প পরবর্তীকালে অন্য কোনও লেখকের দ্বারা সমাপ্ত হওয়া।’3 ওয়েলসের দুটি ভিন্ন-ভিন্ন উপন্যাসের যে পাস্টিশ নিয়ে এবার আলোচনা হবে, সে দুটি বোধহয় তৃতীয় কোনও ঘরানার।
ড. মোরোর দ্বীপ
প্রথমে আসবে ১৮৯৬ সালের উপন্যাস The Island of Dr Moreau-র পরিণাম বা পরিশিষ্ট বা sequel-রূপী, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ।4 ওয়েলসের উপন্যাস জীবচ্ছেদের মাধ্যমে পশুকে মানুষে উদ্বর্তিত করার উন্মাদ প্রচেষ্টা এবং তার নৈতিক সংশ্লেষ সংক্রান্ত এক করালদর্শন আখ্যান। উপন্যাসের শেষে কথক পেন্ড্রিক সভ্য ঘোড়া আর পাশবিক কিন্তু মানবাকৃতি ইয়াহুদের দেশ থেকে ফেরা গালিভারের মতোই অর্দ্ধোন্মাদ। মানুষের সান্নিধ্যে কি গালিভার কি পেন্ড্রিক কেউই স্বচ্ছন্দ নয় আর। গালিভার দুটি ঘোড়া কিনে তাদের সঙ্গে থাকে। পেন্ড্রিক ঠিক ততটা ক্ষেপে না গেলেও, লন্ডন ছেড়ে গ্রামে বাস করে আর রসায়ন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে সময় কাটায়। মানুষ দেখলেই তার মনে হয় এই বুঝি তারা ড. মোরোর সৃষ্ট বিকট জীবগুলোর মতো তাদের পাশবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে!
হেমেন্দ্রকুমার কিন্তু রচনা করেছেন একটি নির্ভেজাল অ্যাডভেঞ্চার। চট্টগ্রামে বনমুরগি শিকার করতে গিয়ে কুমার সম্মুখীন হয় এক বিচিত্র জীবের যে মাংশাসী (পশু বা মানুষ, কিছুতেই তার অরুচি নেই) এবং, কুমারের গুলিতে আহত হয়ে সে চার পা ছেড়ে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে ইংরেজিতে আর্তনাদ করে ওঠে, “Oh my God! My God!” (২২২) তার পদচিহ্ন মানুষের মতোই, সে এরপর নৌকো করে পালাতে-পালাতে অট্টহাস্য হাসে, যা’তে কুমার শোনে ‘একসঙ্গে মানুষের কণ্ঠস্বর এবং ব্যাঘ্রের হুঙ্কার।’ (২২৪) দূরবীনে এও ধরা পড়ে যে জীবটি ‘সম্পূর্ণ নগ্ন … কিন্তু তার গায়ের রঙ অনেকটা চিতাবাঘের মতো … হলদের ওপর গোল গোল কালো ছাপ।’ (২২৫) বিমল এই ঘটনা শুনেই তার আর কুমারের সংগ্রহ থেকে বার করে ওয়েলসের উপন্যাসখানি। মোরোর দ্বীপের এই প্রাণীটি হল ‘চিতা-মানুষ’ বা Leopard Man, যে তার স্রষ্টার তিন-তিনটি নিদান লঙ্ঘন করেছিল: দু-পায়ের বদলে চার পায়ে হাঁটা, নীচু হয়ে চুমুক দিয়ে কিছু পান করা, আর মানুষ দেখলে তার পিছু নেওয়া বা তাকে তাড়া করা! ওয়েলসের আখ্যানে চিতা-মানুষ পেন্ড্রিকের পিছু নিয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে, বাকি দুটি কাজও তাকে করতে দেখা গেছে। মোরোর আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদান ছিল আমিষ-ভক্ষণের বিরুদ্ধে। পেন্ড্রিক জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এক খরগোশের দেহ পায় যেটির মাথা ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে! পরে মোরো তাঁর সৃষ্ট জীবদের সভা ডেকে ওই চিতা-মানুষকেই এ ব্যাপারে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাকে প্রাণদণ্ড দেবার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও পেন্ড্রিক মনে করে যে খরগোশের হত্যাকারী একা চিতা-মানুষ নয়, তার জন্য দায়ী হায়েনা-শূকরও যা’কে পরে পেন্ড্রিক আত্মরক্ষার্থে হত্যা করতে বাধ্য হয়।
চট্টগ্রামে পৌঁছে এই চিতা-মানুষ চাকারিয়া গ্রামে গবাদি পশু এবং মানুষ অপহরণ শুরু করে। কুমারের বন্দুকের নাগালে সে পড়ে যখন কুতবদিয়া প্রণালীর কাছে এক জঙ্গলে সে এক অর্ধভুক্ত গরুর দেহ আবার খেতে আসে। বিমল-কুমার-রামহরি-বাঘা, এবং তাদের সঙ্গে জয়ন্ত-মাণিক-সুন্দরবাবুরা, সূর্যনগরীর গুপ্তধন অভিযানে বিমল-কুমারের অন্যতম পথপ্রদর্শক ফিলিপ সাহেবের দেওয়া মানচিত্র ব্যবহার করে5 যখন মোরোর দ্বীপে হাজির হয়, সেখানেও তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে অন্তত দুটি চিতা-মানুষ। বন্দুকের গুলিতে তাদের মৃত্যু ঘটে।
ওয়েলসের উৎস-আখ্যান থেকে প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ-এ আমরা পাই বেশ কিছু চেনা জিনিস। প্রথম, মোরোর দ্বীপের বর্ণনা। ওয়েলসের কথক পেন্ড্রিক লিখেছিল:
It was low, and covered with thick vegetation, chiefly of the inevitable palm-trees. From one point a thin white thread of vapour rose slantingly to an immense height, and then frayed out like a down feather. We were now within the embrace of a broad bay flanked on either hand by a low promontory. The beach was of a dull grey sand, and sloped steeply up to a ridge, perhaps sixty or seventy feet above the sea-level, and irregularly set with trees and undergrowth. Half-way up was a square stone enclosure that I found subsequently was built partly of coral and partly of pumiceous lava.6 (জোর প্রবন্ধকারের)
এর পরে পেন্ড্রিক বলেছে:
The island, which was of irregular outline and lay low upon the wide sea, had a total area, I suppose of seven or eight square miles. It was volcanic in origin, and was fringed on three sides by coral reefs. Some fumaroles to the northward, and a hot spring, were the only vestiges of the forces that had long since originated it. Now and then a faint quiver of earthquake would be sensible, and sometimes the ascent of the spire of smoke would be rendered tumultuous by gusts of steam. (Chapter the Fifteenth, 61; জোর প্রবন্ধকারের)
প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ-কে আমরা দেখছি:
… [দ্বীপের] আয়তন সাত-আট বর্গমাইলের বেশি হবে না। এ অঞ্চলে অধিকাংশ দ্বীপেরই উৎপত্তি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে … দ্বীপের একদিকে রয়েছে নতন্নোত মুক্তভূমি, বাকী সবখানেই দেখা যাচ্ছে ঘন সবুজ রঙের ছবি, লতা-গুল্ম-পাতায় ঢাকা গাছের পর গাছের দল। সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে তালজাতীয় একরকম গাছ। একদিকে সমুদ্রের নীল জলের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে খুব উঁচু ও সুদীর্ঘ কালো পাথুরে পাড়। তার ওপরে একটানা চলে গিয়েছে বড় বড় ঝোপের পর ঝোপ। (২৩৫) (জোর প্রবন্ধকারের)
কিছু পরে বিমল বলছে যে দ্বীপে পায়ের তলার মাটি মাঝে-মাঝেই কেঁপে উঠবে, কারণ:
“এটা সাধারণ দ্বীপ নয়, এখানে সমুদ্রের তলায় যে আগ্নেয়-পর্বত আছে, এই দ্বীপটিকে তারই চূড়া বলে বর্ণনা করা যায় … চারিদিকেই দেখেছি পাথরের গায়ে রয়েছে গর্তের পর গর্ত … আগ্নেয়-পর্বতের ধোঁয়া বেরোবার পথ। ওই দেখুন, খানিক দূরে একটা ধোঁয়ার রেখা দেখতে পাচ্ছেন?” (২৩৭)
আর একটি নাটকীয় দৃশ্য তো মূল উপন্যাস থেকে প্রায় উদ্ধৃতই করেছেন হেমেন্দ্রকুমার। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে পেন্ড্রিক মোরোর সৃষ্ট এক বানর-মানব-দ্বারা আনিত হয় এই বিচিত্র প্রাণীগুলির আস্তানায়, যেখানে এক দলপতি তাদের পাঠ করায় মোরোর শেখানো নিদানসমূহ। তফাৎ এখানেই যে পেন্ড্রিক এই নিদান-আবৃত্তি শুনেছিল জীবগুলির মধ্যে বসে। বিমল-কুমার-প্রমুখ তা শুনেছে আড়ি পেতে। আর মোরোর বহুবিধ নিদান— যার মধ্যে পেন্ড্রিক মাত্র পাঁচটি লিপিবদ্ধ করেছে— কমে বাংলা উপন্যাসে দাঁড়িয়েছে তিন দফায়:
“Not to go all all-Fours; that is the Law. Are we not Men?”
“Not to suck up Drink; that is the Law. Are we not Men?”
“Not to eat Flesh or Fish; that is the Law. Are we not Men?”
“Not to claw Bark of Trees; that is the Law. Are we not Men?”
“Not to chase other Men; that is the Law. Are we not Men?” (Chapter the Twelfth, 43)
একজন বললে, “চার পায়ে চলবো না; এই হচ্ছে আইন। আমরা কি মানুষ নই?”
কয়েকটা কণ্ঠ সমস্বরে বললে, “আমরা মানুষ!”
প্রথম কণ্ঠ বললে, “মাছ-মাংস খাবো না; এই হচ্ছে আইন। আমরা কি মানুষ নই?”
সমস্বরে শোনা গেল, “আমরা মানুষ!”
আবার প্রথম কণ্ঠ বললে। “মানুষদের দেখলে তাড়া করবো না; এই হচ্ছে আইন! আমরা কি মানুষ নই?”
সমস্বরে শোনা গেল, “আমরা মানুষ!”
তারা ইংরেজী ভাষায় কথা কইছে বটে, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বরে একটা অত্যন্ত অস্বাভাবিকতা এবং উচ্চারণে ছিল অদ্ভুত এক জড়তা। (২৪৫)
ওয়েলসের উপন্যাসে নিদানের কথককে আমরা খুব স্পষ্ট করে দেখতে পাই না। শুধু বলা আছে যে সে আকারে বৃহৎ আর তার লোমের রং ধূসর। পরে মন্টগমারি, ম’লিং (ভালুক, কুকুর আর ষাঁড়ের সংমিশ্রণ) আর অন্যান্য জীবদের মধ্যে সংঘর্ষে তার মৃত্যু ঘটে। সম্ভবত এই কারণেই হেমেন্দ্রকুমার বর্তমান নিদান-কথককে বানর-মানুষের সঙ্গে এক করে দিয়েছেন। সে গোরিলার মতো দেখতে, আর আবৃত্তি করতে-করতে গাছের ঝুরি ধরে দোল খায়। এখানে আরও দেখা যাবে শূকর-মানুষকে (হিংস্র হায়না-শূকর থেকে এই জীব আলাদা)।
এছাড়া হেমেন্দ্রকুমার ব্যবহার করেছেন নিজের উদ্ভাবনী কল্পনাশক্তি। ১৯২৬ সালে, কোনান ডয়েলের The Lost World (১৯১২) উপন্যাসের অনুপ্রেরণা ব্যবহার করলেও, তাঁর ময়নামতীর মায়াকানন উপন্যাসে হেমেন্দ্রকুমার কোনান ডয়েলের বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক জীব ছাড়া এনেছিলেন প্রকাণ্ড ফড়িং, তারপর সমুদ্রের তলা থেকে উঠে এসেছিল ডিপ্লোডোকাস, খাঁড়া-দেঁতো বাঘ শিকার করেছিলো হাতীর মতো বড় ষাঁড়কে, ছিল ডানাবিহীন হাঁস, অতিকায় স্লথ ও ট্রাইসেরাটপস।7 প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ-এ এই কল্পনাশক্তির পথ ধরে এসেছে, সর্বপ্রথম সুন্দরবাবুর তাঁবুতে হনুমান-বিছে, আর তারপর অভিযানকারীরা দেখছে সিংহ-ভালুক-গণ্ডার মিশিয়ে সৃষ্ট এক হিংস্র জীব, যেটি তাড়া করবে রামহরিকে, তার ফলে সেটি প্রতি-আক্রান্ত হবে বাঘার দ্বারা, এবং শেষে প্রাণ দেবে বিমল-কুমারের বন্দুকের গুলিতে। এই জীবগুলির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিমল বলেছে:
“পেনড্রিক সাহেবের কাছে ডাঃ মোরো বলেছিলেন, জন্তু-মানুষের পর জন্তু-মানুষ গড়তে গড়তে তাঁর যখন একঘেয়ে লাগত, তখন তিনি বৈচিত্রের জন্যে একাধিক জন্তুর চেহারা মিলিয়ে মাঝে-মাঝে সৃষ্টিছাড়া সব জানোয়ার তৈরি করতেন। ওই হুনুমান-বিছে প্রভৃতি সেই সব জানোয়ারেরই নমুনা।” (২৫৩-২৫৪)
সরাসরি উদ্ধৃতি আর মৌলিক কল্পনা থেকে নতুন কিছুর পাশাপাশি উৎস-কাহিনি আর পাস্টিশের এক চিত্তাকর্ষক সংমিশ্রণও আমরা হেমেন্দ্রকুমারের কাছে পেয়েছি। জয়ন্ত-মাণিক-সুন্দরবাবুর জ্ঞাতার্থে বিমল যেখানে মোরোর দ্বীপের ইতিহাস ও মোরোর চিন্তাধারার ব্যাখ্যা দিচ্ছে, সে অংশগুলি মন দিয়ে পড়া দরকার। বিমল বলেছে যে জীবতত্ত্ববিদ ও দক্ষ শল্য-চিকিৎসক মোরো বিশ্বাস করতেন যে “বিভিন্ন জন্তুর জীবন্ত দেহের উপরে অস্ত্রোপোচার করে তাদের দেহগুলো মানুষের দেহের মতো করে তোলা যায়।” (২৫১) দৈহিক পরিবর্তন ছাড়া এইসব জন্তু-মানুষদের মধ্যে মানুষের আচার-ব্যবহার এবং তাদের মুখে অন্যতম মনুষ্যভাষা ইংরেজী দেবার জন্য মোরো ব্যবহার করেছিলেন সম্মোহন-বিদ্যা। কিন্তু এই খোদার ওপর খোদাকারির প্রতিশোধ প্রকৃতি নিয়েছে: আস্তে আস্তে জন্তু-মানুষেরা তাদের পশুসুলভ স্বভাব ও আচরণেই ফিরে যেতে শুরু করেছে।
এ বক্তব্য ওয়েলসের উপন্যাসেই আছে। এছাড়াও ওয়েলস দেখিয়েছেন জন্তু-মানুষদের মধ্যে স্বভাব-ভেদ। যেমন, বিশেষ করে হায়না-শূকর, পেন্ড্রিকের প্রতি হিংস্র ও শত্রু-ভাবাপন্ন, যে কারণে পেন্ড্রিক তাকে আত্মরক্ষার্থে হত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। অপর দিকে আছে পেন্ড্রিকের প্রতি বিশ্বস্ত সারমেয়-মানুষ যে হায়না-শূকরের হাতে নিহত হচ্ছে, আর ম’লিং, যে তার প্রভু মন্টগমারিকে অন্য জন্তু-মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। এছাড়া পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ওয়েলসের এই বক্তব্যের দিকে:
Montgomery told me that the Law, especially among the feline Beast People, became oddly weakened about nightfall; that then the animal was at its strongest; a spirit of adventure sprang up in them at the dusk, they would dare things they never seemed to dream about by day. To that I owed my stalking by the Leopard Man on the night of my arrival. But during these earlier days of my stay, they broke the Law only furtively, and after dark; in the daylight there was a general atmosphere of respect for its multifarious prohibitions. (Chapter the Fifteenth, 61)
এই বক্তব্যের প্রতিফলন আমরা শুনি বিমলের মুখে যখন সে নিশ্চয়তা প্রকাশ করে যে জন্তু-মানুষরা অভিযানকারীদের রাত্রেই আক্রমণ করবে:
“আপনি কি হিংস্র জন্তুদের স্বভাব জানেন না? দিনের বেলায় তাদের হিংস্র মন আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। দিনের আলো নেববার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা জাগ্রত হয়ে উঠে ধীরে ধীরে। রাত্রি যত বাড়ে তাদের হিংস্র ভাবও তত বেশি হয়ে উঠে। সেই সময় তারা বেরিয়ে পড়ে দলে দলে জীব শিকারে।” (২৫৪)
ওয়েলসের উপন্যাসে জন্তু-মানুষদের মধ্যে হিংস্রতা আর আনুগত্যের যে প্রভেদ দেখা গেছে তা ছিল ব্যক্তি-স্তরে: একদিকে চিতা-মানুষ আর হায়না-শূকরের জিঘাংসা, অপর দিকে ম’লিং আর সারমেয়-মানুষের মন্টগমারি আর পেন্ড্রিকের প্রতি বিশ্বস্ততা। হেমেন্দ্রকুমার এই প্রভেদকে তাঁর আখ্যানের শীর্ষবিন্দুতে পরিণত করেছেন দুই প্রজাতির মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘাতে। বিমল জয়ন্তকে বলছে যে যেসব নরপশুরা তাদের আক্রমণ করতে চায় তারা সম্ভবত মোরোর সৃষ্ট জীবদের বংশধর। তারা মোরোকে দেখেনি তাই তারা তাঁর সম্মোহনের প্রভাব থেকে মুক্ত, মোরোর কোনও নিদানই তারা গ্রাহ্য করে না। তাই চতুস্পদদের সঙ্গে বেঁধে যায় নিদান-আবৃত্তিকারী দ্বিপদদের যুদ্ধ! বিমলের উক্তি – মোরোর থিওরির গোড়াতেই গলদ ছিল, কারণ অস্ত্রোপচারে বদলায় শুধু পশুর বাইরের আকার, ভেতরকার স্বভাব নয় – মিথ্যা প্রমাণ করে, মাণিকের ভাষায় অভিযানকারীদের অজানা বন্ধুরূপে, আবির্ভূত হচ্ছে মোরোর নিদান-প্রভাবিত দ্বিপদেরা। উৎস-আখ্যানেও মোরোর প্রচেষ্টার এইরকম মিশ্র ফলের উদাহরণ আমরা একটু আগেই দিয়েছি, একদিকে হায়না-শূকর আর অপরদিকে সারমেয়-মানবের মাধ্যমে। আরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে বিমলের ব্যাখ্যা অতি-সরলীকৃত। এখানে শুধু মোরোর সময়কার দ্বিপদ বনাম হায়না-শূকর বা চিতা-মানুষদের বংশধরদের – যারা মোরোকে না দেখার ফলে তার প্রভাবমুক্ত – বিরোধিতা ঘটনা ঘটেনি। বিমল নিজেই বলেছে যে পেন্ড্রিক মোরোর দ্বীপে এসে পড়ে ১৮৮৭ সালে। প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ প্রকাশিত হয়েছে সূর্যনগরীর গুপ্তধন-এর পর, এবং এই দ্বিতীয়োক্ত উপন্যাসের প্রকাশকাল সম্ভবত ১৯৪৪।8 ১৮৮৭ ও তার পরবর্তীকালের ঘটনা ওয়েলস প্রকাশ করেছেন তাঁর ১৮৯৬ সালের উপন্যাসে। ঘটনা ঘটা এবং তা লিপিবদ্ধ হওয়ার মধ্যে যদি হেমেন্দ্রকুমারের ক্ষেত্রেও এই দশ বছরের মতো দেরি আমরা ধরে নিই, তাহলে বিমলেরা মোরোর দ্বীপে পদার্পণ করেছে ১৯৪৫ সাল নাগাদ। ওয়েলসের উপন্যাসে বৈজ্ঞানিক মোরো স্বমুখে বলেছেন যে প্রাণীদের ওপর তিনি যে ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেন, তার ফলে তারা ভোগ করত অত্যধিক যন্ত্রণা। বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয় যে এমন বিকৃত ও পীড়াদায়ক প্রক্রিয়ার লক্ষ্য যেসব প্রাণী তারা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শক্ত শরীর নিয়ে জীবিত থাকবে, একে অপরের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা রাখবে। আর এর থেকে আমরা এও ভেবে নিতে পারি যে মোরোর সম্মোহনী শিক্ষা এক প্রজন্মের পরেও স্থায়ী হয়েছিল, কারণ হেমেন্দ্রকুমারের আখ্যানের শুরুতে যে চিতা-মানুষ কুমারের গুলিতে আহত হচ্ছে, সে ইংরেজিতে তার কষ্ট ব্যক্ত করছে।
শেষে কিন্তু মোরোর কীর্তির নৈতিক সংশ্লেষ নিয়ে হেমেন্দ্রকুমার ধোঁয়াশার আশ্রয় নিয়েছেন। চতুস্পদ-দ্বিপদদের যুদ্ধ এবং তারপর বন্দুকের গর্জন শুনে দ্বিপদদের চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে বলা, “আবার আমাদের প্রভুরা এসেছেন! এইবারে আমাদের শাস্তি পেতে হবে,” এসবের মধ্যেই দ্বীপের আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে তপ্ত লাভাস্রোতে নিশ্চিহ্ন করবার উপক্রম করছে সমস্ত প্রাণীকে, আর অভিযানকারীরা কোনওক্রমে তাদের জাহাজে উঠে প্রাণরক্ষা করছে। দ্বিপদেরা এর আগেও নিজেদের মধ্যে জাহাজ করে তাদের প্রভুদের আগমন এবং ফলস্বরূপ তাদের শাস্তিভোগের কথা বলেছে। তারা কি চতুস্পদদের নিদান-ভঙ্গের দায় নিচ্ছে, সমগ্র জন্তু-মানুষের প্রতিভূ হিসেবে? এতো নরপশুর মধ্যে নীতিবোধ ও বিবেক জাগ্রত করায় অসাধারণ সাফল্য দাবি করে! ড. মোরো কি শুধুই এক উন্মাদ বৈজ্ঞানিক ছিলেন না তাহলে?
এর উত্তর নেই! বিমলের ভাষায়, “মনে এই আক্ষেপ রয়ে গেল, [দ্বীপের] সমস্ত রহস্য জানা গেল না।” (২৬৪) অর্থাৎ, হেমেন্দ্রকুমার শুধু ওয়েলসের উপন্যাসের sequel লেখেননি। আলোচনার শুরুতে ব্যবহৃত ‘পরিণাম’ কথাটির খানিক সংশোধন করে বলা যায়, তিনি মোরোর পশুদের মানুষে পরিণত করার আপাত-উদ্ভট পরীক্ষার আখ্যানকে অতীত থেকে বর্তমানে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগর থেকে অবিভক্ত বাংলার বঙ্গোপসাগরে প্রথমে এনে, তারপর অভিযানকারীদের আবার মূল দ্বীপে নিয়ে গিয়ে আখ্যানকে অন্তিম পরিণতি দিতে দিতেও অন্তত নৈতিক স্তরে উন্মুক্ত রেখে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অদৃশ্য মানুষ
The War of the Worlds বা The Island of Dr Moreau-র তুলনায় ১৮৯৭ সালে, প্রথমে ধারাবাহিকভাবে, এবং সেই বছরেই পুস্তকাকারে প্রকাশিত The Invisible Man, অন্তত প্রথমার্ধে, অনেকটাই লঘু এবং কৌতুকাবহ। পরের দিকে ঘটনা এবং অদৃশ্য মানুষ গ্রিফিনের স্বভাব অবশ্য নির্মম আর হিংস্র দিকে মোড় নিয়েছে।
১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩-য় বাংলায় মুক্তি পায় অদৃশ্য মানুষ নামে একটি ছায়াছবি। সেই বছরেই ‘১৯৫৩ বড়দিন’ তারিখ দিয়ে কাহিনিকার প্রবোধ সরকার লেখেন:
‘অদৃশ্য মানুষ’ H. G. Wellsএর Invisible Manএর অনুবাদ নয়, তার ‘ছায়া’ কোনও জায়গায় নেই তবে কয়েকটি জায়গায় স্বেচ্ছাকৃত ‘ছাপ’ আছে। এই ঋণের জন্য আমি লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ।9
ওয়েলসের আখ্যানের ‘ছাপ’ হিসেবে প্রবোধবাবু ব্যবহার করেছেন মূলত ইংরেজি উপন্যাসের প্রথম, এবং অপেক্ষাকৃত লঘু, অংশে আখ্যাসম্বন্ধীয় চরিত্রের অদৃশ্য অবস্থায় অন্যান্যদের নানা ভাবে পর্যুদস্ত করা। অদৃশ্য হবার উপাদান আবিষ্কারী সমরবাবুর সেবায়েত দেবুদা তার মালিকের সংসারে একাধারে গৃহিণী ও কর্তা, সেই সঙ্গে সমরবাবুর ভাগ্নে ভানুর অভিভাবকও। সমরবাবুর মৃত্যুর পর বাড়িওয়ালা নবদ্বীপ ভানুর সঙ্গে নিজের মেয়ে মন্টুরাণীর বিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে বকেয়া ভাড়ার দাবিতে সমরবাবুর ঘরদোরে গুণ্ডা লাগিয়ে ভাঙচুর শুরু করেন। ক্ষুব্ধ দেবুদা ল্যাবোরেটরির ভাঙা আলমারি থেকে ‘অদৃশ্য হওনের ঔষধ’ গিলে অদৃশ্য হয়ে করে নবদ্বীপ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের ওপর আক্রমণ। এইখানেই আমাদের মনে পড়ে যাবে উৎস-কাহিনির চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি, বিশেষ করে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের ‘The Furniture that Went Mad’ আর সপ্তম পরিচ্ছেদে ‘The Unveiling of the Stranger’ শীর্ষক কীর্তিকলাপগুলি। মূল তফাৎ এখানেই যে বাংলা গল্পে আবিষ্কর্তা বৈজ্ঞানিক অদৃশ্য হচ্ছেন না, হচ্ছে তাঁর ভৃত্যস্থানীয় দেবু। গ্রিফিনের মতো দেবুর কোনও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নেই, সে চায় অদৃশ্য থাকার সুযোগ নিয়ে তার সন্তানতুল্য ভানুর উপকারে আসতে, সে যা’তে কলকাতায় কলেজের হস্টেলে সহপাঠীদের হাতে অযথা হেনস্থা না হয়, যা’তে সহপাঠিনী সাবিত্রীর সঙ্গে ভানুর প্রেমও সঠিক পরিণতি পায়। নানা কৌতুকপূর্ণ ঘটনার মধ্যে আছে ভানু আর জহরের মধ্যে (অভিনেতারা মনে হয় স্ব-স্ব নামেই নিজেদের চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন) মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতা। এই অনু-ঘটনার উৎস ওয়েলসের উপন্যাস নয়, ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইউনিভার্সাল স্টুডিয়ো প্রযোজিত অদৃশ্য মানুষ সিরিজের ষষ্ঠ ছবি Abbott and Costello Meet the Invisible Man, যেটি ছিল বাংলা ছবিটির মতোই নির্ভেজাল ‘কমেডি’, যা’ সিরিজের প্রথম এবং দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ছবির ক্ষেত্রে – ১৯৩৩ সালের মূল উপন্যাস-আধারিত The Invisible Man, ১৯৪০ সালের The Invisible Man Returns, ১৯৪২ সালের Invisible Agent এবং ১৯৪৪ সালের The Invisible Man’s Revenge – প্রযোজ্য নয়।10 প্রথমটি কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে horror-এর সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে উপন্যাসের আদলেই, যা’র সঙ্গে চিত্রনাট্যে যোগ হয়েছে ক্রমোন্মাদ গ্রিফিনের সঙ্গে তার বাগদত্তা ফ্লোরার টানাপোড়েন। দ্বিতীয় ছবিটি একেবারে ‘থ্রিলার’-ধর্মী, নায়ক অদৃশ্য হয়ে তার ওপর মিথ্যে খুনের দায়ভার নামাবার জন্য সচেষ্ট। মোটামুটি এই ‘প্লট’ নিয়েই এগিয়েছে ষষ্ঠ ছবিটি, অদৃশ্য নায়ক পেশায় মুষ্টিযোদ্ধা হবার সুবাদে এসেছে বক্সিঙের ঘটনা, যা’ ধার করেছে আমাদের বাংলা কাহিনী। দৃশ্যমান ভানু ইংরেজি ছবির লু স্পেন্সরের মতো ঘুঁষি ছুড়ছে, আদতে প্রতিপক্ষ, আমাদের গল্পে জহর, মার খাচ্ছে অদৃশ্য দেবুদার হাতে। এই কৌতুকাবহ আবহাওয়ার জন্য এরপর এসেছে ভানু-সাবিত্রীর প্রেমের পথে বাধাদানকারিণী তার মাসীমা রাজলক্ষ্মী এবং মাসতুতো বোন যমুনাকে অদৃশ্য দেবুদার ‘কাঁইকুতু’ দেওয়া। বাংলা ছবির আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে বৈজ্ঞানিক চমৎকারিত্ব কাহিনিতে যৎসামান্য এসেছে প্রথমে সমরবাবুর খরগোশ অদৃশ্য করা এবং অদৃশ্য দেবুদার সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। সবশেষে দেবুদা দৃশ্যমান হয়েছে মৃত্যুর কারণে (উপন্যাস) বা রক্ত-পরিসঞ্চালনের (দ্বিতীয় ও পঞ্চম ছবি) জন্য নয়। দেবুদা যে শিশি থেকে ‘অদৃশ্য হওনের ঔষধ’ খেয়েছিল, তার লেবেলে ‘নির্দ্ধারিত সময়’-এর পরের অংশটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। মূল সব ঘটনা ঘটে যাবার বছর দেড়েক পর ভানু-সাবিত্রীর সপুত্রক সংসারে যেদিন তাদের বাড়িতে কলেজের সবাই নিমন্ত্রিত, সেখানেই দেবুদা হঠাৎ অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হয়। এখানে কিন্তু একটা বড় গোঁজামিল রয়ে গেছে। উপন্যাসের প্রায় শেষে মৃত গ্রিফিনের নগ্ন এবং ক্ষতবিক্ষত শরীর ফুটে ওঠে সবার চোখের সামনে। ১৯৩৩ সালের চিত্ররূপে এই নগ্নতা আড়াল করা হয়েছে আহত গ্রিফিনকে হাসপাতালের শয্যায় শুইয়ে। বাংলা গল্পে দেবুদার রক্ত-মাংসের দেহ দিব্যি সকলের সামনে ফুটে উঠছে, ওষুধের ঘোর কেটে যাওয়ায়! সর্বসমক্ষে তার কি সুতোবিহীন অবস্থাতেই মূর্ত হওয়া উচিৎ নয়? লেখক এ ব্যাপারে নীরব!
এ এক অতি-সীমিত ধরনের পাস্টিশ যেখানে উৎস-রচনার খুব বাছাই করা উপাদানটুকু – অদৃশ্য হয়ে কিছু মজার ঘটনা ঘটানো এবং অনেকের ওপর সাময়িক ক্ষমতা বিস্তার করা – নিয়ে লেখা হয়েছে একটি কমেডি যাতে ‘কমিক রোম্যান্স’-ও স্থান পেয়েছে। এই বিচিত্র আবিষ্কার যে ব্যবহারকারীর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে তার আচরণ দানবিক পর্যায়ে নামাতে পারে, সে নেতিবাচক সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে। ওয়েলসের প্রথমার্ধ থেকে হাসি-উদ্রেক-করা মেজাজটুকুই জুড়ে আছে সমস্ত গল্পতে, সামান্য করুণ রস এসেছে সমরবাবুর মৃত্যুর পর দেবুর দুঃখ নিয়ে।
প্রবোধ সরকারের কাহিনি ও ছায়াছবির সঙ্গে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অদৃশ্য মানুষ-এর তফাৎ ‘ছাপ’ আর ‘রূপান্তর’-এর মধ্যে যা’, তা’ই।10 তাঁর অন্যান্য বিদেশি গল্পের রূপান্তরের মতোই, হেমেন্দ্রকুমার ওয়েলসের আখ্যানকে ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি সমাজের পটভূমিতে এনে ফেলেছেন। ব্র্যাম্বলহার্স্ট রেল স্টেশন আর তার কাছে ইপিং শহর হয়েছে বাংলার পশ্চিমে, এবং যেহেতু বরফ পড়ার কথা বলা আছে, কিছুটা উত্তরে, শ্রীপুর। ওয়েলসের আগন্তুক – The Stranger – প্রথমে অভিহিত হয়েছে ‘যাত্রী’ বলে, তার পর, মূল উপন্যাসের মতোই সে নিজেকে এবং অন্যরা তাকে বর্ণনা করেছে ‘অদৃশ্য মানুষ’ বলে, এবং অবশেষে সে তার কলেজের বন্ধু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, উৎস-কাহিনিতে বার্ডক শহরের মিঃ কেম্প, -এর কাছে নিজের স্বনাম জানিয়েছে: সিটি কলেজের বিধুভূষণ মুখোপাধ্যায়, ওয়েলসের আখ্যানে ইউনিভার্সিটি কলেজের গ্রিফিন। অন্যান্য চরিত্র এবং প্রতিষ্ঠানও উপস্থিত। মূল উপন্যাসের সরাইখানা Coach and Horses ভারতবর্ষের নিয়ম মেনে হয়েছে শ্রীপুর স্বাস্থ্যনিবাস, তা’র মালকিন ও মালিক মিসেস ও মিঃ হলেন এখানে দাস-দম্পতি। প্রধান পার্শ্বচরিত্র ভবঘুরে টমাস মার্ভেল হয়েছে বাবু বংশীবদন বসু। এমনকি মাত্র একটি দৃশ্যে আবির্ভূত, অদৃশ্য বিধুর হাঁচি শুনে আতঙ্কিত, প্রকৃতিবিদ গিবনসকেও আমরা পেয়েছি শ্রীপুরের কবি অবলাকান্ত রূপে। ঘড়ি-মেরামতকারী টেডি হেনফ্রি আর ন্যাশনাল স্কুলের মি. গৌল্ড মিলে-মিশে হয়েছেন ঘড়ির দোকানের মালিক রামরতনবাবু যিনি ‘যাত্রী’-র রহস্য ভেদ করতে মিসেস দাসের প্ররোচনায় আগন্তুকের ঘরে ঢোকেন এবং পরবর্তী সময়ে, ঠিক যেমন গৌল্ড আগন্তুককে নৈরাজ্যবাদী বা Anarchist বলেছিল, তেমনই রামরতনবাবু আমাদের রহস্যময় ব্যক্তিকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘স্বদেশী বোমাওয়ালা’ – যে উক্তি থেকে মনে হয় হেমেন্দ্রকুমার তাঁর আখ্যানের পটভূমি করেছেন ভারতের প্রাক-স্বাধীনতা যুগকে। একই ভাবে শহরের ডাক্তার কাস আর পল্লী-পুরোহিত (vicar) বান্টিং এবং তাঁর স্ত্রী মিশে সৃষ্ট হয়েছে সরকারি ডাক্তার মাণিকবাবু এবং তাঁর স্ত্রী বিমলা। কাস অদৃশ্য মানুষের হাতে সরাইখানায় নাকমলা খেয়ে আতঙ্কে বান্টিং-এর বাড়িতে ছুটে এসে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে। হেমেন্দ্রকুমার পুরো ঘটনাটিই আমাদের দেখিয়েছেন, যার শেষে মাণিকবাবু পান্থনিবাসের একতলায় নেমে এসে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এর পর রাতে বাড়ি থেকে টাকা চুরির ঘটনা বাংলায় ঘটছে বান্টিং-এর বাড়িতে নয়, মাণিকবাবুর আবাসনেই।
মূল উপন্যাসের প্রধান ঘটনাসমূহও মোটামুটি অক্ষত রেখেছেন হেমেন্দ্রকুমার। প্রথমদিকে যেগুলি প্রধানত কৌতুকাবহ, এবং দ্বিতীয়ার্ধে যেসব ঘটনা মনে ভয় ও বিরূপতার সৃষ্টি করে, সবই আছে, এমনকি নির্বিরোধ চন্দ্রবাবু (মি. উইক্সটীড)-র বিধুর হাতে নির্মম হত্যা অবধি। কাহিনির শীর্ষবিন্দুতে, সম্ভবত কিশোর পাঠকদের কথা ভেবে হেমেন্দ্রকুমার হিংস্রতার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন, অদৃশ্য বিধুর পূর্ণবাবুকে তাড়া করা দেখে তখন-অবধি মাছ ধরতে ব্যস্ত রামরতনবাবুর জলে ঝাঁপ দেওয়া দেখিয়ে উৎকণ্ঠার মাঝখানে খানিকটা কৌতুকাবহ ত্রাণ বা ‘কমিক রিলিফ’ এনেছেন, কিন্তু মূল উপাখ্যান শেষ হচ্ছে ওয়েলসের চেয়েও মর্মান্তিকভাবে। ওষুধের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় গ্রিফিনের দৃশ্যমান মরদেহ তবু একটি বাড়ির মধ্যে শয্যা পেয়েছিল:
And there it was, on a shabby bed in a tawdry, ill-lighted bedroom, surrounded by a crowd of ignorant and excited people, broken and wounded, betrayed and unpitied, that Griffin, the first of all men to make himself invisible, Griffin, the most gifted physicist the world has ever seen, ended in infinite disaster his strange and terrible career.11
হেমেন্দ্রকুমারের বিধুর দেহ পড়ে থাকছে পথেই:
পৃথিবীতে প্রথম যে মানুষ অপূর্ব বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রসাদে রক্তমাংসে গড়া নিরেট দেহকে অদৃশ্য করবার অদ্ভুত উপায় আবিষ্কার করেছিলো, দুর্ভাগ্যক্রমে এমনি শোচনীয়ভাবে সে তার ভয়াবহ জীবন সমাপ্ত করলে।
প্রবোধ সরকারের সঙ্গে হেমেন্দ্রকুমারের সবচেয়ে বড় তফাৎ এখানেই যে ওয়েলসের উপন্যাস থেকে অদৃশ্য হবার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হেমেন্দ্রকুমার কিশোর পাঠকদের পক্ষে সহজবোধ্য করার জন্য সংক্ষেপিত করলেও, রেখেছেন। ওয়েলসে উনবিংশ ও বিংশ পরিচ্ছেদ ধরে পদার্থবিদ্যায় আলোর বিচ্ছূরণ আর শারীরবৃত্তির তত্ত্ব মিশিয়ে তৈরি হয়েছে অদৃশ্য হবার উপায়। উনবিংশ ও বিংশ পরিচ্ছেদ এই দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার যে অংশটুকু সংক্ষেপিত এবং সরলীকৃত করে হেমেন্দ্রকুমার ব্যবহার করেছেন, মূল ইংরেজির পাশাপাশি পাঠকদের সুবিধার্থে তা এখানে দেওয়া হল। যে অংশগুলি বাংলায় অনূদিত হয়েছে, ইংরেজি এবং বাংলা উদ্ধৃতিতে সেগুলিতে জোর দেওয়া হয়েছে”
“… A box of very thin common glass would be hard to see in a bad light, because it would absorb hardly any light and refract and reflect very little. And if you put a sheet of common white glass in water, still more if you put it in some denser liquid than water, it would vanish almost altogether, because light passing from water to glass is only slightly refracted or reflected or indeed affected in any way. It is almost as invisible as a jet of coal gas or hydrogen is in air. And for precisely the same reason!” (pdf 90; জোর প্রবন্ধকারের)
…
“… If a sheet of glass is smashed, Kemp, and beaten into a powder, it becomes much more visible while it is in the air; it becomes at last an opaque white powder. This is because the powdering multiplies the surfaces of the glass at which refraction and reflection occur. In the sheet of glass there are only two surfaces; in the powder the light is reflected or refracted by each grain it passes through, and very little gets right through the powder. But if the white powdered glass is put into water, it forthwith vanishes. The powdered glass and water have much the same refractive index; that is, the light undergoes very little refraction or reflection in passing from one to the other. (pdf 90-91; জোর প্রবন্ধকারের)
…
Just think of all the things that are transparent and seem not to be so. Paper, for instance, is made up of transparent fibres, and it is white and opaque only for the same reason that a powder of glass is white and opaque. Oil white paper, fill up the interstices between the particles with oil so that there is no longer refraction or reflection except at the surfaces, and it becomes as transparent as glass.” (pdf 91; জোর প্রবন্ধকারের)
‘ধরো, কাঁচের কথা। পাথরের চেয়ে কাঁচ স্বচ্ছ, তাই পাথরের ভিতর দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু কাঁচের ভিতর দিয়ে যায়। অস্পষ্ট আলোতে খুব পাতলা কাঁচ সহজে চোখে পড়ে না – কারণ সে আলো শোষণ ও প্রতিফলিত করতে পারে খুবই অল্প। সাধারণ সাদা কাঁচ তুমি যদি জলের ভিতরে ফেলে দাও, তাহলে সে বিশেষরূপে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আবার জলের চেয়ে ঘন কোনো তরল পদার্থের ভিতরে কাঁচকে ফেলে দিলে সে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায় – কারণ, সেই তরল পদার্থ ভেদ করে খুব অল্প আলোই তার কাছে গিয়ে পৌঁছুতে পারে। ঠিক এই কারণেই বাতাসের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস অদৃশ্য হয়ে থাকে। কাঁচকে যদি ভেঙে গুঁড়ো করা হয়, তাহলে বায়ু-চলাচলের স্থানে তাকে রাখলে সকলেই দেখতে পায়। কিন্তু সেই দৃশ্যমান কাঁচের গুঁড়ো জলের মধ্যে ফেলে দিলে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। সাদা কাগজ স্বচ্ছ নয় – তার ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চলে না। কিন্তু ভালো করে তেল মাখিয়ে সাদা কাগজকেও স্বচ্ছ করা যায়। … এই রকম সব ব্যাপারের উপরেই নির্ভর করে আমি এই অপূর্ব আবিষ্কার করেছি।’ (৩৯৯; জোর প্রবন্ধকারের)
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কিন্তু হেমেন্দ্রকুমার বাদ দিয়েছেন। গ্রিফিন বিশেষভাবে ‘স্বচ্ছ’ হবার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল কারণ সে ছিল albino বা অস্বাভাবিকরকম শ্বেতচর্মের অধিকারী।
মোটের ওপর, আমরা হেমেন্দ্রকুমারের রূপান্তরকর্মকে ওয়েলসের উৎস-আখ্যানের প্রতি বিশ্বস্তই বলব, এমনকি তুলনায় হিংস্র দ্বিতীয়ার্ধের পর কৌতুকপূর্ণ কিন্তু পূর্বলক্ষণ-যুক্ত উপসংহারটিও বাংলায় উপস্থিত। ওয়েলসের গল্পে আমরা এক ভিন্ন শহরে (পোর্ট স্টো) এক সরাইখানায় আসি, যার নাম হচ্ছে ইংরেজি উপন্যাসটির নাম: The Invisible Man। তার মালিক গর্বের সঙ্গে সকলকে বলে যে সে যে অপ্রত্যাশিত টাকার মালিক হয়েছিল (ব্যাঙ্ক থেকে এবং বিভিন্ন মানুষের পকেট কেটে গ্রিফিনের চুরি করা টাকা) তার স্বত্ব যে ওই মালিকের নয় তা কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। আর প্রতি রবিবার মালিক দরজা-জানলা বন্ধ করে মন দিয়ে পাতা উলটোয় চামড়া-বাঁধানো তিনটি মোটা খাতার – যেগুলিতে লিপিবদ্ধ আছে অদৃশ্য হবার উপায়!
বিধুর ক্ষতবিক্ষত দেহ ও মুখে-চোখে নিরাশা ও ক্রোধের দৃশ্যের পর আমরা যাচ্ছি শ্রীপুরের ‘স্বাস্থ্যনিবাস’-এ নয়, নতুন পান্থনিবাস হোটেলে। এইখানেই হেমেন্দ্রকুমার আবার সরলীকরণ করেছেন। তিনি পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন যে এই হোটেলের মালিক সেই বংশীবদনবাবু। শ্রীপুর ব্যাঙ্ক থেকে উড়ে আসা টাকায় তিনি আজ ধোপদুরস্ত পোশাক পরেন আর অদৃশ্য মানুষের কুখ্যাতি শুনলেই তার প্রতিবাদ করেন কারণ উক্ত ব্যক্তিকে তিনি গুরু মানেন! ওয়েলসের গল্পের (অশুভ?) ইঙ্গিত – অদৃশ্য হবার উপায় জেনে মার্ভেলের দ্বিতীয় গ্রিফিনে পরিণত হওয়া – এখানে অনুপস্থিত।
উপসংহার
এইচ জি ওয়েলস তাহলে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন একাধিকবার এবং একাধিকভাবে। কখনও তাঁর কাহিনি অনুপ্রাণিত করেছে সম্পূর্ণ মৌলিক বিজ্ঞান-নির্ভর কাল্পনিক উপাখ্যান, কখনও বা তাঁর গল্পকে তাঁর অতীতকাল থেকে বর্তমানে, এবং, আংশিকভাবে, দেশান্তরে এনে নতুন পরিণতি দেবার চেষ্টা হয়েছে, কখনও তাঁর grotesque বা উদ্ভট ‘রোম্যান্স’ (The Invisible Man-এর গৌণ নাম তাইই) জন্ম দিয়েছে নির্ভেজাল রোম্যান্টিক কমেডির (যা আবার চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে), আবার কখনও আমরা পেয়েছি তাঁর আখ্যানের মোটামুটি বিশ্বস্ত, যদিও খানিকটা পরিমিত, রূপান্তর, তার বৈজ্ঞানিক অন্তস্তলকে অক্ষত রেখেই।
- [1] https://kalpabiswa.com/article/y6i1_essay7/
- [2] J. A. Cuddon, rev. M. A. R. Habib, A Dictionary of Literary Terms and Literary Theory (5th edn.), (Wiley-Blackwell: Malden MA, Oxford, Chichester, 2013) 517.
- [3] সুদীপ দেব, স্বমহিমায় শঙ্কু-র ‘কৈফিয়ত’-(কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস, কলকাতাঃ ২০১৯, ২য় মুদ্রণ ২০২০) ৭-৮।
- [4] প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৯) ২১৩-৬৪।
- [5] সূর্যনগরীর গুপ্তধন (১৯৪৪), হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৯) ১২৩-২১২।
- [6] H. G. Wells, The Island of Dr. Moreau (1896, Dover Publications, Inc.: New York, 1996), Chapter the Sixth, 17.
- [7] https://kalpabiswa.com/article/y6i1_essay7/. ময়নামতীর মায়াকানন, হেমেন্দ্রকুমার রায়, ছোটদের অমনিবাস (এশিয়া পাবলশিং কোং, কলকাতাঃ ১৯৯৭, পুনর্মুদ্রণ ২০০০) ।
গ্রন্থপঞ্জী
প্রাথমিক পাঠ্য
H. G. Wells, The Island of Dr. Moreau (1896, Dover Publications, Inc.: New York, 1996).
The Invisible Man (1897), The Project Gutenberg eBook of The Invisible Man, by H. G. Wells, Release Date: June 9, 2002 [eBook #5230] [Most recently updated: November 15, 2020].
The War of the Worlds (1898, http://www.planetpublish.com/wp-content/uploads/2011/11/The_War_of_the_Worlds_NT.pdf 10 December 2020).
‘The Empire of the Ants’ (1905)
প্রবোধ সরকার, অদৃশ্য মানুষ (ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানিঃ কলিকাতা)।
প্রেমেন্দ্র মিত্র, পিঁপড়ে পুরাণ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কল্পবিজ্ঞান সমগ্র, সম্পাদনা সুরজিৎ দাশগুপ্ত (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতাঃ ২০১০, ২য় সংস্করণ ২০১৩) ।
হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী ১১শ খণ্ড, সম্পাদনায় গীতা দত্ত, সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৯) ২১৩-৬৪।
অদৃশ্য মানুষ, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ২য় খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোংঃ কলকাতা, ১৯৭৬, ৫ম মুদ্রণ ১৯৮২) ৩৪৫-৪২৪।
মেঘদূতের মর্তে আগমন, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, সম্পাদনা গীতা দত্ত, ১ম খণ্ড (এশিয়া পাবলিশিং কোংঃ কলকাতা, ১৯৭৪, ৫ম মুদ্রণ ১৯৮৪) ২৮৪-৩৬৯।
গৌণ পাঠ্য
J. A. Cuddon, rev. M. A. R. Habib, A Dictionary of Literary Terms and Literary Theory (5th edn.), (Wiley-Blackwell: Malden MA, Oxford, Chichester, 2013).
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাস: উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য (১৯৯১, পরিবর্ধিত কারিগর সংস্করণ, কলকাতা: ২০১৩)।
সুদীপ দেব, স্বমহিমায় শঙ্কু-র ‘কৈফিয়ত’-(কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস, কলকাতা: ২০১৯, ২য় মুদ্রণ ২০২০) ৭-৮।
Tags: প্রদোষ ভট্টাচার্য্য, প্রবন্ধ, বিশেষ আকর্ষণ, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
খুব উপভোগ করলাম আপনার প্রবন্ধটি। আপনি যত কিছু বিশ্লেষণ করে এত সুন্দর করে দেখিয়েছেন, তত কিছু চট করে সব পাঠকের চোখে পড়ে না – অন্ততঃ ‘এক পড়া’-য় না। Time Machine-এর এইরকম বিশ্লেষণ করবেন নাকি?
দাদা, কোন বাংলা রূপান্তরের খোঁজ দিলে চেষ্টা করতে পারি। মনে হয় না হেমেন্দ্রকুমার করেছেন; অন্তত আমার জানা নেই। এই নিয়ে আমার মতো আরেক হেমেন্দ্রভক্তও সাম্প্রতিক আক্ষেপ করেছে।
অনেক নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ এর সন্ধান পেলাম। এরকম প্রবন্ধ কল্পবিশ্বে প্রকাশ করতে পেরে আমরা আপ্লুত।
আর একাধিক ভুলের জন্যে আমি যারপরনাই লজ্জিত!
একাধিক ভুল রয়ে গেছে। সেগুলো সংশোধন করছি। এই সমস্ত ভুলের দায় সম্পূর্ণভাবে আমার। সকলের কাছে ক্ষমাও চাইছিঃ
প্রথম অনুচ্ছেদেঃ প্রেমেন্দ্র মিত্র ওয়েলসের ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ছোট গল্প ‘The Empire of the Ants’ থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষদের বিরুদ্ধে পিঁপড়েদের মারণ-যুদ্ধঘোষণার কথা দ্বারা অনুপ্রাণিত নিয়ে
হবে ‘অনুপ্রাণিত হয়ে’
প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ উপন্যাসের আলোচনায় ১৩শ অনুচ্ছেদে (প্রথম বাক্যঃ এছাড়া হেমেন্দ্রকুমার ব্যবহার করেছেন নিজের উদ্ভাবনী কল্পনাশক্তি। ) ‘প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ-এ এই কল্পনাশক্তির পথ ধরে এসেছে, সর্বপ্রথম সুন্দরবনের তাঁবুতে হনুমান-বিছে’ হবে ‘প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ-এ এই কল্পনাশক্তির পথ ধরে এসেছে, সর্বপ্রথম সুন্দরবাবুর তাঁবুতে হনুমান-বিছে’।
‘ঘটনা ঘটা এবং তা লিপিবদ্ধ হওয়ার মধ্যে যদি হেমেন্দ্রকুমারের ক্ষেত্রেও এই দশ বছরের মতো দেরী আমরা ধরে নিই, তাহলে বিমলেরা মোরোর দ্বীপে পদার্পণ করেছে ১৯৪৫ সাল নাগাদ। ‘ এখানে বছরটি হবে ১৯৪৫।
অদৃশ্য মানুষ ছবির আলোচনায় ‘অদৃশ্য মানুষ সিরিজের তৃতীয় ছবি Abbott and Costello Meet the Invisible Man’ আসলে উক্ত সিরিজের চতুর্থ ছবি। সিরিজের প্রথম দু’টি ছবি – ১৯৩৩ সালের মূল উপন্যাস-আধারিত The Invisible Man এবং ১৯৪০ সালের The Invisible Man Returns’-এর সঙ্গে যোগ হ’বে ১৯৪৪ সালের The Invisible Man’s Revenge। এরপর আসছে ১৯৫১ সালের Abbott and Costello Meet the Invisible Man।
এক্ষুণি জানলাম যে Universal Studios আমার ওপরে বলা চারটি ছবি ছাড়াও অদৃশ্য মানুষ নিয়ে আরও দু’টি ছবি করেছিলঃ ১৯৪০-এ The Invisible Woman আর ১৯৪২-এ Invisible Agent, যা’ র কেন্দ্রীয় চরিত্র মূল কাহিনীর গ্রিফিনের নাতি!
আমার যাবতীয় সংশোধন লেখার মধ্যে করে দেবার জন্য সন্তু বাগ মহাশয়কে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।